#ভ্যাম্পেয়ার_রাজ্য,পর্বঃ ০৪
#লেখিকাঃ_মার্জিয়া_রহমান_হিমা
শুভ্র তার রক্তের তৃপ্তি মিটিয়েছে এখন বিছানায় শুয়ে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। এখনও নিজেকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে তার। শুভ্র উঠে বসে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। এরমাঝেই শুভ্রর রুমে তার বাবা সৈকতের প্রবেশ ঘটে। সৈকত হেল্ডকে দেখে শুভ্র বলে উঠে
” বাবা আমার সাথে এমন কেনো হচ্ছে ? একদম অস্বাভাবিক লাগছে আমার। নিজেকে কোনো ভাবেই কন্ট্রোলে রাখতে পারছি না। আজ তো রাস্তার মাঝে হঠাৎ ভ্যাম্পেয়ার রূপ বেরিয়ে যায়।”
সৈকত হেল্ড ছেলের সামনে বসে বললো
” এরকম তখনই হবে যখন তোমরা ত্রিমুখী এক সঙ্গে বা আশেপাশে থাকবে।” শুভ্র সৈকতের কথা বুঝতে না পেরে ভ্রু কুঁচকে বললো
” ত্রিমুখী মানে ?” সৈকত গম্ভীর গলায় বললো
” তুমি, সোডাল্ট আর প্রিশা। প্রিশার সামনে সোডাল্ট তোমার কাছে আসলে তোমার শক্তি তোমার অজান্তেই হিংস্র হয়ে উঠবে সোডাল্টকে ধ্বংস করার জন্য। প্রিশা ছাড়াও তোমরা দুজন মুখোমুখি হলে ভ্যাম্পেয়ার রূপ বেরিয়ে আসবে কিন্তু প্রিশার সামনে তা হিংস্র হয়ে বেরিয়ে আসবে।” শুভ্র চিন্তিত হয়ে বললো
” তাহলে প্রিশাকে সোডাল্ট নামক বিপদ থেকে রক্ষা করবো কি করে ?” সৈকত শান্ত গলায় বললো
” সোডাল্ট নামক বিপদকে তুমি খুব সহজ ভাবে শেষ করতে পারবে যদি তুমি তার নাড়ীনক্ষত্র জানতে পারো। সোডাল্টের প্রত্যেকটা অঙ্গীভঙ্গি থেকে ধরে সব কিছু খুঁজে বের করো। তাহলেই জানতে পারবে কিভাবে তুমি প্রিশাকে সোডাল্টের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে। এছাড়াও তুমি প্রিশার সামনে ভ্যাম্পেয়ার রূপে এসেও সোডাল্টকে মেরে ফেলতে পারো। তোমার কাছে এই দুটো পথ রয়েছে। এবার বাকিটা তোমার হাতে।” সৈকত চলে যেতেই শুভ্র ভাবনায় ডুবে যায়।
রাতে প্রিশা তার মা,বাবার সাথে কথা বলে। তাদের গতকালের রাতের ঘটনা জানায়নি। জানালে হয়তো চিন্তা করতো সেটা ভেবেই। প্রিশা ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। বাড়ির সবাই তাকে খুবই আদর করে। এখানে খুবই ভালো লাগছে তার যদিও মাঝে মাঝে গতকাল রাতের ঘটনা মনে পড়লে ভয় পায় সে।
ব্যালকনির মুক্ত বাতাসে প্রিশার খোলা চুল গুলো বাধাহীন ভাবে উড়ছে। প্রিশা চোখ বন্ধ দীর্ঘনিশ্বাস নেয়। বাতাস অনুভব করতে থাকে নিস্তব্ধতায়।
বাড়ির পেছনের জঙ্গল থেকে প্রিশাকে অনায়াসে দেখতে পেলো শুভ্র। দূড় থেকেও একদম স্পষ্টভাবে দেখতে পারছে সে প্রিশাকে। শুভ্র চোখ বন্ধ করে হাওয়ায় উপরে উঠে গেলো। হাওয়ায় ছুটে গেলো প্রিশার কাছে। ব্যালকনির কাছে এসে শব্দহীন ভাবে প্রিশার পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রিশাকে মুগ্ধাতার সঙ্গে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে সে। প্রিশার চোখ মুখ থেকে আলাদাই এক আলো জ্বলছে মনে হচ্ছে।
কারো অস্তিত্ব অনুভব হতেই প্রিশা চোখ খুলে পাশে তাকায়। শুভ্রকে দেখে চমকালো প্রিশা। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে কিছুটা অস্থির হয়েই বললো
” আপনি এখানে কিভাবে ? কখন এসেছেন ?”
শুভ্র প্রিশাকে দেখায় এতোটাই মত্ব হয়ে ছিলো যে প্রিশার প্রশ্ন তার ধ্যান ভাঙাতে পারেনি। প্রিশা এবার গলার জোর বারিয়ে জিজ্ঞেস করলো
” আপনি কিভাবে এসেছেন এখানে ?” শুভ্রর ধ্যান ভাঙ্গে। শুভ্র শান্ত গলায় বললো
” কিভাবে এসেছি সেটা জেনে তোমার কি কাজ ? এতো রাতে এখানে কি করছো তুমি ? চুপচাপ রুমে যাও।” প্রিশা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো
” কেনো যাবো আমি ? এটা এখন আমারও বাড়ি। যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাবো আমি।” শুভ্র শান্ত গলায় শুধালো
” রুমে যাবে না সিউর ?” প্রিশা উত্তর দিলো না। এই শান্ত গলা শুনে মনে হলো শুভ্র রেগে আছে। প্রিশা কিছুক্ষণ চুপ থেকেই উত্তরে বললো
” না যাবো না। এখনও এতো রাত হয়নি যে এখানে আসা যাবে না।”
” তুমি কিন্তু বেশি কথা বলছো ! আমার কথা অমান্য করার সাহস দেখাচ্ছো তুমি। ঠিক হবে না কিন্তু ! বয়সে অনেক বড় আমি তোমার। রাত হয়েছে কিনা সেসব আমি ভেবে নেবো।চুপচাপ আমার কথা শুনে ভেতর যাও নাহলে খারাপ হবে।”
শুভ্রর কন্ঠে রাগের আভাষ। কিন্তু প্রিশা সেটা গায়ে মাখলো না বরং দ্বিগুণ রাগ নিয়ে বললো
” যাবো না বললাম তো ! আপনি চলে যান এখান থেকে। আমার সাথে এভাবে কথা বলার কেউ না আপনি।” শুভ্রর রাগে চোখ জ্বলে উঠলো। চোখের রং নীল রঙ ধারণ করার আগেই শুভ্র চোখ বন্ধ জোড়ে নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।
চোখ খুলে দাঁতেদাঁত চেপে প্রিশার দিকে তাকিয়ে বললো
” আর কখনো এমন কিছু বলার সাহস করবে না। এটা আমার আদেশ। তুমি নিজেও জানো না আমি কে তোমার। যাও রুমে যাও !” শুভ্রর ধমকে প্রিশা মারাত্মক ভাবে কেঁপে উঠে। প্রিশা ঢোক গিলে ভীতু চাহনিতে তাকালো। শুভ্রর গম্ভীর চাহনি দেখে প্রিশার কান্না পেলো। ধীর পায়ে রুমে ঢুকে ঠোঁট ভেঙ্গে কেঁদে দেয় প্রিশা। প্রিশার কান্না দেখে শুভ্রর রাগ হারিয়ে যায়। প্রিশার ঠোঁট ভেঙে কান্নার স্টাইল দেখে নিঃশব্দে হাসলো শুভ্র। প্রিশা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মনে মনে বলতে থাকে
” পচা ভাইয়া একটা। খুব খারাপ উনি। আর কখনো কথা বলবো না ভাইয়ার সাথে।” প্রিশা কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় বসে। কোলে একটা বালিশ নিয়ে সেই বালিয়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে।
শুভ্র পকেটে হাত গুঁজে প্রিশার পেছনে এসে দাঁড়ায়। গম্ভীর গলায় বললো
” তুমি যা চাইবে তাই হবে নাকি ? তুমি আমার সাথে কথা না বললে তোমাকে আমি ছাঁদে নিয়ে উপর থেকে ফেলে দেবো।” প্রিশা কান্নার মাঝেই ভিষণ চমকে শুভ্রর দিকে তাকায়। কান্না যেনো এবার ভয়ে পরিণত হয়েছে। প্রিশা ভেজা গলায় আটকে আটকে বললো
” আমি কি বলেছি সেটা শুনলেন কিভাবে আপনি? আচ্ছা আপনি ভুত না তো?” শুভ্র শান্ত গলায় বললো
” আমি ভুত না ভ্যাম্পেয়ার। তোমার মনের সব কথা বুঝতে পারি আমি।” প্রিশার ফুঁপিয়ে কান্না এবার পরিণত হয়। ঢুকড়ে কেঁদে দিয়ে বললো
” সেটা আবার কি ? আপনি আমাকে মেরে ফেলবেন ? আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি। চলে যান এখান থেকে আপনি !” প্রিশা ভয়ে জোড়ে জোড়ে কাঁদতে থাকে। শুভ্রর কোনো হেলদোল নেই। শুভ্র দুই অয়া এগিয়ে ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো হাত পা ছড়িয়ে। প্রিশা ভয় পেয়ে চিৎকার নিয়ে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে গিয়ে পরে যেতে নিলেও নিজেকে সামলে নেয়। শুভ্র প্রিশার উদ্দেশ্যে গম্ভীর গলায় বললো
” এসব কান্না বন্ধ করে চুপচাপ হয়ে বসো। তুমি বাচ্চা মেয়ে মানছি আমি তাই বলে কি ভ্যাম্পেয়ার কি জানো না তুমি ? স্কুলে বা কলেজে এসব নিয়ে পড়োনি বা শোননি ?” প্রিশা মুখ চেপে কাঁদছিল। শুভ্রর প্রশ্ন শুনে ডানে বায়ে মাথা নেড়ে, না উত্তর দিলো। শুভ্র উঠে এসে প্রিশার সামনে দাঁড়ায়। প্রিশা পিছিয়ে যেতে নিলে শুভ্র প্রিশার বাহু চেপে বললো
” কি হয়েছে এতো ভয় পাচ্ছো কেনো তুমি? আমাকে তোমার সত্যিই ভুত বা ভ্যাম্পেয়ার মনে হয় ?” প্রিশা মাথা ঝাকিয়ে সায় দেয়। শুভ্র হাসলো। প্রিশাকে জোড় করে এনে বিছানায় বসিয়ে বললো
” ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই। ভ্যাম্পেয়ার হই আর না হই, তোমার কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা বা চিন্তা আমার নেই।” প্রিশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে বললো
” তাহলে আমাকে বকলেন কেনো ?” শুভ্র প্রিশার পাশে বসে শান্ত গলায় বললো
” কারণ আমার কথা শোননি তুমি। বড়দের সব কথা শুনতে হয়। আর একটা কথা বলো তুমি কি কোনো ক্লাসে ফেইল টেইল করেছিলে নাকি? মাত্র কলেজে ভর্তি হয়েছো কিন্তু দেখে একদমই মনে হয় না। তুমি এতো বাচ্চা একটা মেয়ে কেউ বুঝতে পারবে না।” প্রিশা নাক টেনে মুখ ফুলিয়ে বললো
” আমি কোনো ক্লাসে ফেইল করিনি। আমি অলওয়েজ ফার্স্টক্লাস। মাঝে মাঝে সেকেন্ড হয়ে যাই শুধু তবে ফেইল করি না।” শুভ্র হেসে দেয় প্রিশার কথায়।
প্রিশার হাত ধরে আবারও ব্যালকনিতে আসলো। প্রিশা অস্বস্তিতে হাত ছাড়িয়ে নিলেও শুভ্র আরেকবার হাতটি আকড়ে ধরে। এবার অস্বস্তি হলেও ছাড়িয়ে নিতে পারে না প্রিশা। প্রিশার চোখ হঠাৎ জঙ্গলের দিকে যায় সেখানে কোনো কিছু একটা জ্বলজ্বল করতে দেখে প্রিশা। প্রিশা ঊৎসাহ নিয়ে বললো
” ওই টা কি ? এভাবে জ্বলছে কেনো ?” শুভ্র ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকালো। সেখান থেকে সত্যিই কিছু দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সাদা ছড়াচ্ছে। শুভ্র মনে মনে বললো
” এতোক্ষণ তো সেখানেই ছিলাম। এমন কিছুই তো দেখিনি তখন।”
প্রিশা শুভ্রর ধরে রাখা হাতটি ধরে ঝাঁকিয়ে বললো
” বলুন না কি সেটা ?” শুভ্র অবুঝ গলায় বললো
” জানি না তো আমি। দেখতে হলে তো সামনে যেতে হবে। যাবে ?” প্রিশা আঁতকে তাকায়। ঢোক গিলে বললো
” এখন তো অনেক রাত !” শুভ্র হেসে প্রিশার চোখের উপর হাত রেখে বললো
” চোখ বন্ধ করে রাখো। আমি না বলা পর্যন্ত খুলবেই না। ” প্রিশার কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল শুভ্র। দুজন পরস্পরের সাথে
মিশে রয়েছে। প্রিশার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়।
এদিকে শুভ্র প্রিশাকে নিয়ে হাওয়ায় উড়ে যায়। জঙ্গলের সাদা আলো ছড়ানো স্থানের কিছুটা আগে গিয়ে নামলো। প্রিশার চোখ থেকে হাত সরাতেই প্রিশা বিস্মিত হয়। প্রিশা চারপাশে মাথা ঘুরিয়ে দেখে নিলো সব। আতংকিত গলায় বললো
” কিভাবে এসেছি আমরা এখানে ? আপনি সত্যিই ভুত ? নাকি ভ্যাম্পেয়ার ?” শুভ্র প্রিশাকে চুপ থাকার জন্য ইশারা করলো। প্রিশা কাঁদো কাঁদো হয়ে মুখে আঙুল তুলে ধরে। শুভ্র প্রিশার হাত ধরে এগিয়ে যেতে থাকে। প্রিশা ভয়ে জর্জরিত হয়েও এগিয়ে যেতে থাকে। প্রিশার হাত পা কাঁপছে অনবরত। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। শুভ্র প্রিশার অবস্থা দেখে শক্ত করে প্রিশার হাত ধরে রাখে। দুজন সেই স্থানে পৌঁছেই দেখতে পেলো একটা মেয়ে অচেতন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মেয়েটির এক হাতে একটা সাদা পাথর যার থেকে আলো ছড়াচ্ছে অসম্ভব ভাবে আর অন্য হাত আহত হয়ে রয়েছে। আহত হাতে রক্ত দেখেই প্রিশার মাথা ঘুরে উঠে। শরীরের ভর হারিয়ে পড়ে যেতে নিলেই শুভ্র প্রিশাকে আঁকড়ে ধরে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো
” কি হয়েছে প্রিশা ?” প্রিশা শুভ্রর বাহুডোরে আবন্ধ হয়ে থাকে। আলতো হাতে শুভ্রর শার্ট খামছে ধরে রাখে। শুভ্রর প্রশ্ন স্পষ্ট শুনেছে কিন্তু চেয়েও কিছু বলতে পারলো না। শুভ্র মস্তিষ্ক পরেই বুঝতে পারলো প্রিশা ভয় পেয়েছে। প্রিশা জ্ঞান হারায়। শুভ্র প্রিশাকে কোলে তুলে নিয়েই মেয়েটির কাছে এগিয়ে যায়। পর্যবেক্ষণ করে দেখলো মেয়েটির হাতের আঘাতটা কোনো প্রাণীরই দেওয়া।
চলবে………