ধূম্রজাল’ ষষ্ঠ পর্ব

0
260

‘ধূম্রজাল’
ষষ্ঠ পর্ব
তাবিনা মাহনূর

__________

ভেজা চুলে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলো গুলবাহার। লাল রঙের ফতুয়া আর সাদা স্কার্ট পরে চুলগুলো পিঠের উপর এলিয়ে দিলো সে। ভেজা কাপড়গুলো নিয়ে ছাদে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালে গুলনাজ ডেকে উঠলো, ‘কাকাতুয়া পাখি, সে যে ডুবেছে দেখে তোমার জ্বলজ্বলে আঁখি!’

বাহার হেসে উঠে বললো, ‘আসার পর থেকে কি সব বলছিস! প্রত্যেকটা কথার মাঝে রহস্য রেখে আমার মনোযোগ পাওয়ার অপচেষ্টা করা বন্ধ কর।’

নাজ বোনের পিছে পিছে ছাদে গেল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে বললো, ‘লাল ঝুঁটি কাকাতুয়া, ধরেছে যে বায়না। চায় তার লাল ফিতে, চিরুনি আর আয়না!’

বাহার হতাশ হওয়ার ভঙ্গিতে শ্বাস ফেলে কাপড় নেড়ে দিলো। নাজ হেসে বলে উঠলো, ‘আসলে বায়না কাকাতুয়া ধরেনি, ধরেছে জলজ্যান্ত মানুষ। তার নাকি সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লাল-সাদা কাকাতুয়াকে চাই-ই চাই!’

– সেই কখন থেকে কাকাতুয়া কাকাতুয়া করছিস? কি হয়েছে পরিষ্কার করে বল নাহলে আমি গেলাম ঘরে।
– আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, বলছি তো। লাল ফতুয়া আর সাদা স্কার্টে তোমাকে কাকাতুয়ার মতোই লাগছে। তবে তুমি যার চোখে ধরা পড়েছো, সে সেদিন শুভ্র শাড়িতে দেখেছে তোমাকে। দেখেই ফিদা হয়ে গিয়েছে!

বাহার এবার বুঝতে পারলো নাজ কি বলতে চাইছে। নিশ্চয়ই আরেকটা বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, সেই ছেলে হয়তো সুদর্শন। তবে নাজ কখনো এতো আনন্দিত থাকে না। এবার কোন শাহজাদা এলো আল্লাহই জানেন!

বাহারকে নিয়ে নাজ নীচে গেল। হুমায়রা খালামনি বাহারকে দেখে দু হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আয় মা, কি সুন্দর হয়েছিস মা শা আল্লাহ!’

বাহার খালামণিকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘কতদিন পর আসলে বাসায়? তুমি তো আসোই না!’

– এবার এসেছি, দেখি বেঁধে রাখতে পারিস কিনা।
– সত্যিই বেঁধে রাখবো। সিনথিয়া কেমন আছে? নতুন সংসার, নতুন পরিবার মানিয়ে নিতে পারছে তো?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে ও। সবুজের মতো ভালো ছেলে থাকলে সব মেয়েদের ভালো হতো। তোর জন্যও আরেকটা সবুজ এনে দিব। দেখিস!

বাহার মুচকি হেসে খেতে চলে গেল। দুপুরের খাওয়া শেষে সে একটু বিশ্রাম নিবে। তারপর ঘুমের প্রয়োজন হলে ঘুমিয়ে নিবে, এরপর কাজের চাপ কমাবে। সারাদিনের কাজের তালিকা মনে মনে সাজিয়ে সে চেয়ারে বসলো। সালমা খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন। হানজালা বোন, বোনের ছেলে, ছেলের বউকে সময় দিচ্ছেন। তাই সালমাকে এদিকটা দেখতে হচ্ছে। আজকের রান্না অবশ্য হানজালা করেছেন। তার হাতের রান্নার স্বাদ দারুন হয়।

কিন্তু খাওয়ার পর চা দিয়েই বিপদে পড়ে গিয়েছিলেন তিনি। লবণের চা খেয়ে বোনের ছেলের বউ সুপ্রিয়া বমি করে ফেলছিল প্রায়। তিনি বিব্রত ভঙ্গিতে রান্নাঘরে গিয়ে সালমাকে চা বানাতে বলে চলে গিয়েছেন গল্প জমাতে। সালমা বাহারকে খেতে দিয়ে রান্নাঘরে গেলেন। এই অল্প সময়ে বাহার খেয়াল করেছে তার ফুপির মলিন মুখ। তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে সে বেসিনে হাত ধুয়ে ফুপির কাছে গিয়ে বললো, ‘ফুপি, আমাকেও এক কাপ চা দিও।’

সালমা মুচকি হেসে মাথা দুলালেন। বাহার তার হাত ধরে বললো, ‘তোমার কি মন খারাপ ফুপি?’

সালমা অশ্রু ভরা চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তোরা দুজন এই বাড়ি ছেড়ে চলে গেলে আমি কিভাবে থাকবো বল তো? তোদের নিয়েই তো আমার নিজস্ব দুনিয়া।’

বাহার সালমাকে জড়িয়ে ধরলো। তার কাঁধে চিবুক ঠেকিয়ে বললো, ‘ফুপি, আমি এখনই কোথাও যাচ্ছি না। আর বিয়ে হয়ে গেলে প্রতি মাসে একবার অন্তত আসবোই। পারলে তোমাকে নিয়েই থাকবো।’

হেসে ফেললেন সালমা, ‘পাগলী একটা! আমি কিভাবে থাকবো তোর সাথে? দুআ করি, তুই যেখানেই থাক, ভালো থাক।’

সালমাকে ছেড়ে বাহার বললো, ‘আচ্ছা ফুপি, খালামনি কি আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এনেছেন?’

সালমা কিছু বলার আগেই হানজালা এসে বললেন, ‘কই আপা? ওরা চলে যাচ্ছে যে। চা এখনো হয়নি?’

সালমা চুলা বন্ধ করে চায়ের কাপ সাজিয়ে নিলেন। হানজালা চলে গিয়েছেন। বাহার সালমাকে সাহায্য করলো। ট্রের উপর কাপ সাজিয়ে সে মায়ের ঘরে নিয়ে গেল। সবার হাতে তুলে দেয়ার সময় খেয়াল করলো, খালামনির ছেলে রিপন ভাই তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখ পড়ার সাথে সাথেই রিপন চোখ নামিয়ে নিলো। সেসময় বাহারের অবচেতন মন বললো ভাবি সুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখতে। বাহার দেখলো, সুপ্রিয়া ভ্রু কুঁচকে রিপনের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে হাসলো বাহার। নিশ্চয়ই বাসায় গিয়ে একচোট লেগে যাবে এদের, অন্য মেয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার কারণে।

তবে খালামনির সাথে কিছুক্ষণ গল্প করে বেরিয়ে আসার পর বাহারের অস্বস্তি শুরু হলো। একজন বিবাহিত পুরুষের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে সে অন্যতম মাধ্যম। ঠিক মাধ্যম নয়, সে নিজেই এমন একটা জিনিস যাকে দেখে পুরুষ তার চোখের তৃষ্ণা, হয়তোবা মনের তৃষ্ণাও মিটিয়ে নিয়েছে। ছেলেরা আজকাল মেয়েদের ‘মাল’ সম্বোধন করে। এই মুহূর্তে বাহারের নিজেকে মাল বলেই মনে হলো। এমন একটা মাল যা পুরুষের চোখ ও মনের আরাম দেয়। শরীরের আরাম ছিনিয়ে নেয়।

এসব ভাবতেই বাহারের মুখ কুঁচকে এলো। আগে কখনো এগুলো তাকে পীড়া দেয়নি। ইদানিং এই সম্পর্কে ভাবলেই গা গুলিয়ে বমি চলে আসে। যেমন এখন তার ইচ্ছে করছে রিপনের মুখে বমি করে দিতে। দৃষ্টির হিফাজত না করে নিজেকে ঢেকে রাখাও কোনো সমাধান নয়। রিপনের মতো ছেলেদের দৃষ্টির হিফাজতের সবক দিতে হবে। এর জন্য নারী জাগরণ অতি গুরুত্বপূর্ণ।

বাহারের এই ভাবনার পেছনে যাদের হাত রয়েছে, তারাও জানে বাহারের মতো মেয়েরা কত বোকা। তবে এই বোকাদের ধোঁকা থেকে বেরিয়ে আনতে কিছু মানুষ একত্র হয়েছে। আবার কিছু মানুষের রয়েছে এমন বুদ্ধিমত্তা যা বাহারদের ভুল ভাঙিয়ে দেয়। তারা নিজেদের অজান্তেই বাহারদের মনে প্রশ্ন তৈরি করে। যেমন, সাদি হাসরাত।

হুমায়রা খালামনিরা চলে যাওয়ার পর বাহার গেল বিশ্রাম নিতে। কিন্তু তার বিশ্রাম আজ ছুটিতে আছে হয়তো। তাই তাকে ক্লান্ত করে তুলতে হানজালা হাজির হলেন অজস্র কথার মালা গেঁথে। তার প্রত্যেকটা কথা সিয়াম আর সিয়ামের মা হাফসাকে নিয়ে। সিয়াম খুবই ভালো পরিবারের ছেলে, নৌবাহিনীতে যুক্ত আছে। আগামী সপ্তাহে বাগদানের অনুষ্ঠান হলে সিয়াম কয়েক মাসের জন্য চট্টগ্রাম পোর্টে চলে যাবে। তারপর অনেকদিনের ছুটি নিয়ে ফিরে এসে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবে। এসব পরিকল্পনা করা হয়েছে, এখন শুধু বাহারের অনুমতি নেয়ার পালা। যার কোনো প্রয়োজন মনে না করেই হানজালা অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।

অবাক হলো বাহার, ‘কি বলছো আম্মু? বাবাকেও বলোনি?’

– তোর বাবাকে বলবো না কেন? ফোনে সব বলেছি। উনি বললেন, এতো ভালো প্রস্তাব, আবার তোর বয়সী ছেলে পাওয়াও মুশকিল হয়ে যাবে। তাই ফিরিয়ে দেয়াটা বোকামি হবে।
– তোমরা দুজন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে আমাকে ছাড়াই? অথচ বিয়েটা আমি করবো।

রেগে গেলেন হানজালা, ‘আর কত সিদ্ধান্ত দিবি তুই? প্রতিবার প্রত্যেকটা ছেলের খুঁত বের করতেই হয় তোর। বয়স কি এখন আঠারো? ত্রিশের কাছে চলে যাচ্ছিস মনে রাখিস। বাচ্চার মা হওয়ার ক্ষমতা কিন্তু কমে যাচ্ছে।’

– কি যে বলো মা! চল্লিশ বছর বয়সেও মা হওয়া সম্ভব।
– তুই কি আরো দশ বছর অপেক্ষা করতে চাইছিস?
– না, আমি তোমাকে উদাহরণ দিলাম শুধু। আমি এখন যেই মামলায় জড়িয়ে আছি সেটা সমাধান না করা পর্যন্ত কোনো বাড়তি চাপ নিতে চাই না মা।
– তোর একটা মামলা গেলে আরেকটা মামলা আসবে। আমি আর কোনো কথা শুনবো না।
– আমি ছেলেটাকে চিনিও না মা।
– সমস্যা কোথায়? ফোন নম্বর নিয়ে নিব, তুই কথা বলবি। কয়েকদিন কথা বললেই বুঝবি ছেলের মতিগতি কেমন।

সালমা এসেছিলেন শুকনো কাপড়গুলো বাহারের ঘরে রাখতে। হানজালার এই কথা শুনে তিনি বললেন, ‘এসব কি বলছো হানজালা? একটা মেয়ে আর ছেলে এভাবে কথা চালিয়ে গেলে কত গুনাহ হয় তুমি জানো? সামনাসামনি দেখাদেখির ব্যবস্থা করিয়ে দাও।’

হঠাৎ হানজালা রেগে গেলেন। মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘আপনি সবসময় কথার মাঝে নাক গলান কেন আপা? আমরা মা মেয়ে কথা বলছি, আর আপনি এর মাঝে ঢুকে গেলেন। তাও সবসময়ই নেগেটিভ কথা আপনার মুখে। কখনো দেখলাম না পজিটিভ কিছু বলতে। দেখেন আপা, যেখানে আপনার কোনো ভূমিকা নাই সেখানে কথা বলতে আসবেন না। আমি বুঝবো আমার মেয়ের ভালো। আপনি কি বুঝবেন?’

হানজালা এই পর্যায়ে থেমে গেলেন। খুব বলতে ইচ্ছে করছিল, ‘আপনি নিঃসন্তান। আপনি সন্তানের মর্ম বুঝবেন না।’ কিন্তু সালমার মুখ দেখে তিনি থেমে গেলেন। বাহারের বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। সালমা চুপচাপ বাহারের ঘরে জামাকাপড় রেখে বেরিয়ে যাওয়ার পথ ধরলে বাহার বলে উঠলো, ‘ফুপি, আমার কাছে একটু বসবে?’

সালমা বললেন, ‘এখন সময় নেই মা। আছরের আজান দিয়েছে। সালাত আদায় করতে হবে।’

_________

বাহার ফুপির ঘরের দরজা একটুখানি সরিয়ে দেখলো, সালমা মুসাল্লার উপর বসে যিকির করছেন। বাহার ভেতরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিলো। সালমার কাছে বসে পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে সে বললো, ‘আমার ফুপি, আমি তোমার সাথে গল্প করবো।’

সালমা এক হাত দিয়ে বাহারের হাত স্পর্শ করলেন। দু চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে তার। বাহার তা দেখতে পাওয়ার আগেই তিনি অন্য হাত দিয়ে চোখ মুছে হাসার চেষ্টা করে বললেন, ‘কি গল্প করবি মা?’

বাহার গলা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সালমার বিছানায় শুয়ে বললো, ‘আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। আমি খুবই ক্লান্ত। কিছু প্রশ্ন আছে, মনে হলো এগুলোর উত্তর তুমি জানবে। তাই চলে এলাম।’

সালমা মুসাল্লা ভাঁজ করে রেখে বাহারের মাথার কাছে বসলেন। তার চুলে হাত বুলিয়ে তিনি বললেন, ‘প্রশ্নগুলো করেই দেখ। উত্তর দিতে পারি কিনা পরের বিষয়।’

বাহার বললো, ‘মেয়েদেরকে আল্লাহ কেন বুদ্ধি কম দিয়েছেন? কেন তারা কোনকিছু চট করে ধরে ফেলতে পারে না?’

সালমা হাসলেন। হাসতে হাসতে বললেন, ‘এসব কে বলেছে তোকে?’

বাহার বলতে গিয়েও থেমে গেল। সাদির মুখটা মনে করলে অনুভূতিগুলো চোখে ধুলো দিয়ে হারিয়ে যায়। তখন কথার ঝুড়িতে কোনো ফুল থাকে না। বোবা মুখে বসে থাকতে হয়। আপাতত ফুপির সাথে তার জরুরি কথা আছে। তাই সাদিকে মনে করলে চলবে না। সে চোখ বন্ধ করে বললো, ‘আছে একজন। বলেনি, কিন্তু আমি নিজেই এর প্রমাণ। আমি তার ধোঁকায় আটকে গিয়েছিলাম। বুঝতে দেরি হয়েছে।’

সালমা উত্তরটা মনে মনে গুছিয়ে নিলেন। নরম সুরে বললেন, ‘প্রত্যেক মানুষকে আল্লাহ প্রয়োজন মাফিক বুদ্ধি দিয়ে পাঠিয়েছেন। যার বুদ্ধি কম, সে তত বেশি ধরা খায়। এবং এটা তার জন্য কোনো শাস্তি কিংবা অবিচার নয়। এটা তার পরীক্ষা। একেক মানুষকে আল্লাহ একেক রকম পদ্ধতিতে পরীক্ষা করে থাকেন। একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মানুষকে নিয়ে প্রায় সকলেই হাসাহাসি করে। এটা সেই প্রতিবন্ধী মানুষটার জন্য পরীক্ষাস্বরূপ। তার যদি এই হাসি ঠাট্টা বোঝার অনুভূতি থাকে তাহলে সে মন খারাপ করবে। এবং এটাই তার পরীক্ষা যে সে কতটুকু সবর করেছে। তবে হ্যাঁ, আল্লাহ যাকে অল্প পরীক্ষা করেন তাকে তিঁনি ভালোবাসেন না, এ কথাও বলা যায় না। আল্লাহর ইচ্ছে এবং পরিকল্পনা তিঁনিই ভালো জানেন। আমাদের ক্ষুদ্র জ্ঞানে তা ধারণ করা অসম্ভব। কারণ তিঁনি আস সামাদ, তিঁনি একমাত্র অধিপতি।’

বাহার ফুপির দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কিন্তু আমার উত্তরটা দাও। এটা উত্তর হয়নি।’

– নারী পুরুষের বুদ্ধিমত্তার তুলনা করাটাই বোকামি। কারণ নারীর যেখানে বুদ্ধি খাটানোর প্রয়োজন, আল্লাহ সেই বুদ্ধিটা নারীকে দিয়েছেন। আবার পুরুষের প্রয়োজন অনুযায়ী তাকে সেই কাজের বুদ্ধি দেয়া হয়েছে যেটা তার দ্বারা সম্ভব। যেমন, বেশিরভাগ পুরুষ সংসারের কাজে পারদর্শী নন। কেন? কারণ তাদের সেই ক্ষমতার চেয়ে নারীদের ক্ষমতা বেশি। সন্তান লালন পালনে মায়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি থাকে। সংসার ও পরিবার পরিচালনা, আত্মীয়-প্রতিবেশীর ব্যাপারে খেয়াল রাখা, সমাজ গঠনে নারীদের ভূমিকা অনেক বেশি। এখানে নারীরা যদি অদক্ষ হতো তাহলে সন্তান মানুষ না হয়ে অমানুষে পরিণত হতে। সমাজে অশান্তি বিরাজ করতো।
– আর পুরুষ?
– পুরুষের কাজ বাইরে। তাদের জ্ঞান ব্যবসাভিত্তিক, ধর্মভিত্তিক কিংবা শারীরিক সক্ষমতার উপর নির্ভর করে। একজন নারী তার ব্যবসায় যতটা কৌশল ব্যবহার করবে, পুরুষ তার চেয়ে কম খেটে একই ফল বের করতে পারবে।

উঠে বসলো বাহার। সালমার মুখোমুখি হয়ে সে বললো, ‘কিন্তু এখন দেখো, কত মেয়েরা ব্যবসায়ী, উদ্যোক্তা হয়েছে। তারা কিন্তু পুরুষদের তুলনায় অনেক এগিয়ে। আবার পুরুষরা সংসারে মনোযোগী হয়েছে। এটা কিভাবে সম্ভব হলো তাহলে?’

সালমা বিজ্ঞের মতো বললেন, ‘এজন্যই তো সমাজে বিশৃঙ্খলা বাড়ছে। নারীরা বাইরের কাজে তাদের দক্ষতার পরিচয় দিতে গিয়ে ঘরের কাজে অমনোযোগী হয়ে পড়ছে। পুরুষরা বাইরের কাজ করতে অনীহা দেখাচ্ছে। ফলে সমাজে একটা বিপরীত প্রভাব দেখতে পাচ্ছি আমরা। এভাবে চলতে থাকলে সমাজ একশো আশি ডিগ্রি কোণে ঘুরে উল্টো পদ্ধতিতে চলতে শুরু করবে। এখনই দেখ, কত অনিয়ম, অনাচার বেড়েছে সমাজে। এখন তুই হয়তো বলবি নারীরা তবু পারছে, পুরুষও সংসারের কাজে থিতু হয়েছে। এটার উত্তর হলো অভ্যাস। একটা কাজ বারবার করতে করতে একটা সময় দক্ষতা এসে যায়, যদিও সেই কাজ সম্পর্কে জ্ঞান কম থাকুক না কেন। তাই নারী পুরুষ তাদের জ্ঞানের সাথে সাংঘর্ষিক কাজে দক্ষতা দেখাতে পারছে অভ্যাস ও চর্চার কারণে।’

– কিন্তু হজরত খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা…
– উনিও ব্যবসা করতেন, এটাই বলবি তো? তোদের একটা অস্ত্র হচ্ছে এটাই। আবার অনেকে বলেন আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা শিক্ষক ছিলেন। আমি বলি কি, আমরা কেউ কি তোদের ব্যবসায়ী কিংবা শিক্ষক হতে মানা করেছি? ব্যবসায়ী ছিলেন খাদিজা রাদিয়াল্লাহু আনহা। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে তার বিয়ের পর তিনি কি ব্যবসায়ী ছিলেন? নাকি বিধবা অবস্থায় ছিলেন? আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা হাদিস সম্পর্কে জানিয়েছেন কি সংসারের কাজ ফেলে?

বাহার বুঝতে পারলো সালমা কি বলতে চাইছেন। ক্ষেত্র বিশেষে অনেক রকম বিচার-বিবেচনা করার পর নারীদের কাজের স্বীকৃতি মিলে। যেমন, একজন নারীর যদি কোনো মাহরাম না থাকে, কোনো খাবারের ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে সে ইজমার ভিত্তিতে চাকরি করতে পারবে, উদ্যোক্তা হতে পারবে। তাকে এ ব্যাপারে কেউ বাধা দিবে না। বরং তাকে সাহায্য করা হবে। বাহার বললো, ‘আমার চাকরিটা হালাল নয় ফুপি?’

সালমা মুচকি হাসলেন, ‘আমি জানি না তুই কেন হঠাৎ এসব নিয়ে ভাবছিস। তবে সত্যি কথা এই যে, তোর চাকরিটা জায়েজ হচ্ছে না। তুই যতই সৎ থাকিস না কেন, তোর চাকরিটা জায়েজ হবে না।’

হঠাৎ বাহার বলে উঠলো, ‘হায় হায়! তাহলে সাদির চোখে আমি খারাপ মেয়ে?’

সালমা ভ্রু উঁচিয়ে বললেন, ‘সাদি?’

বাহার হতবাক তার নিজের কর্মে। মুখ ফসকে সাদির নামটা বেরিয়ে এসেছে নাকি অবচেতন মন তাকে সবসময় সাদির ব্যাপারে সজাগ রাখে, সে জানে না। সালমা ফুপির কাছে অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। সে বললো, ‘একজন আসামি। সন্দেহ করা হচ্ছে ডক্টর তোহার মৃত্যুর পেছনে তার হাত আছে।’

অবাক হলেন সালমা, ‘হায় আল্লাহ! শেষমেশ একটা আসামির কথায় তুই দ্বিধায় পরে গেলি?’

কৈফিয়তের সুরে বাহার বলে উঠলো, ‘ফুপি, উনি আগে হিন্দু ছিলেন। হঠাৎ কি হয়েছে জানি না, এখন দেখছি উনি মুসলিম হয়েছেন। আবার নিজেকে নিরপরাধ দাবি করছেন। আমি জানি না কোনটা সত্য, তবে তার সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। তিনি আজকে বললেন আমার চাকরি নাকি হালাল হচ্ছে না।’

সালমা চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন, ‘কিন্তু মা, একজন অপরাধীর মুখে এমন কথা কীভাবে মানায়? তুই সত্য বের করিস। অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তিদের ফাঁসিয়ে দেয়া হয়। আর হ্যাঁ, তার চোখে তুই খারাপ হলে সমস্যা কি? যদিও মানুষের চোখে তোকে ভালো হতে হবে, কারণ খারাপ কাজের সাক্ষী যত বাড়বে তোর ক্ষতি ততই বেশি। তাই তুই যে একটা ভালো মেয়ে, এর সাক্ষী বেশি থাকতে হবে। কিন্তু…’

– আর বলো না ফুপি। লোকটা অপরাধী হতেও পারে, কিন্তু আমাকে কেমন যেন হাতের মুঠোয় নিয়ে ফেলছেন তিনি। আমি প্রতিবার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব নিয়ে তার সামনে দাঁড়াই, এবং বেরিয়ে আসি ভীরুর মতো।
– এটা তো মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। তুই আগে থেকেই কোনো না কোনোভাবে তার প্রতি দুর্বল বা আকৃষ্ট। এ জন্যই সে সুযোগ পেয়েছে তোকে ব্যবহার করার। এতে তার কোনো কসরতের প্রয়োজন পড়েনি।

ফুপির কথায় বাহার উপলব্ধি করতে পারলো সাদির সুরের মন্ত্রণা কেন তাকে ইন্দ্রজালে আটকে ফেলে। সে মুচকি হেসে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ! তোমার কাছে না এলে আমি এতক্ষণ দিশেহারা হয়ে বিছানায় গড়াগড়ি খেতাম।’

বিনিময়ে সালমাও মুচকি হাসলেন, ‘তোর যেকোনো প্রশ্ন মনে এলে আমাকে বলবি। আমি চেষ্টা করবো উত্তর দেয়ার।’

বাহার সালমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। সালমা তার মাথায় গাল ঠেকিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ‘আল্লাহ তোকে হিদায়াহ দান করুন।’

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here