ধূম্রজাল’ দ্বাবিংশ পর্ব

0
182

‘ধূম্রজাল’
দ্বাবিংশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর

__________

গুলবাহার এখন বাসাতেই থাকছে। হানজালা মেয়ের সাথে কথা কম বলেন। গুলনাজ আপুর আগমনে কিছুটা শৃঙ্খলে এসেছে। আর সাখাওয়াত আগের মতোই আছেন, যান্ত্রিক জীবন। হানজালা কথা কম বলেন কারণ তিনি মেয়েকে চিনতে পারছেন না। পুরোনো বাহার, যার পরনে থাকতো যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলা পোশাক, সেই বাহার এখন যেন আরো পুরোনো হয়ে গিয়েছে। ঠিক নানী দাদীদের যুগের মতো। যেখানেই যায় বোরখা পরে। তফাৎ এই, নানী দাদীর যুগে বেশিরভাগ মহিলা সবখানে বোরখা পড়লেও পর্দার আসল উদ্দেশ্য বুঝতেন না বলে পুরুষদের সামনে নিকাব উঁচিয়ে রাখতেন, আর নয়তো চিৎকার করে ঝগড়া করতেন। আর বাহার সব স্থানেই পর্দার সবটুকু মেনে চলার চেষ্টা করে।

এইতো কিছুদিন আগে, ড. আব্দুল্লাহ জাহাঙ্গীর স্যারের কিছু বই নিয়ে ডেলিভারি ম্যান এলো। বাহার মাথার ওড়না পুরোটা পেঁচিয়ে মুখ সহ ঢেকে দরজা খুললো এমনভাবে যেন তাকে আড়াল করে রাখা যায়। বই নিয়ে টাকা দিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে সে, কোনো বাড়তি কথা নেই। হানজালা হলে উচ্চস্বরে গৃহকর্মীকে ডেকে বলতেন, ‘ছেলেটাকে একটু পানি দে তো। তৃষ্ণা পেয়েছে মনে হয়।’

হানজালার এই গুণ ভালো হলেও এটা গ্রহণযোগ্য নয়। পানির তৃষ্ণা নিবারণে তিনি বোতল এগিয়ে দিতে পারতেন, ছেলেটার দরকার হলে সে বোতল হাতে নিতো। হানজালার উচ্চস্বরে ডাকার প্রয়োজন হতো না। তিনি যখন নিজের বড় কন্যাকে দরজা আটকে দিতে দেখলেন তখন উল্টো বললেন, ‘এই, ছেলেটার মুখ দেখেছিস? লোকজন এলে একটু পানি দিতে হয়। এটা তোদের আজও শেখাতে পারলাম না।’

বাহার মুচকি হেসে মাকে সব বুঝিয়ে বলেছে। হানজালা কিছুই বুঝতে চাননি। তিনি মনে করেন, বাহারের মতো মেয়েরা নিজেদের ঢেকেঢুকে চলে বলে সংসারের ভার কমে যায় তাদের, আতিথেয়তা করতে হয় না। আজকাল আন্তরিকতা উঠে যাচ্ছে সমাজ থেকে এইসব উগ্রবাদী ধর্মান্ধদের জন্য। তিনি সবসময় বাহারকে চোখে চোখে রাখেন। মেয়েটা আবার আফ-গা-নিস্তা-নের কোনো সংগঠনের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে না তো? কিংবা হুজুর কারো প্রেমে পড়েছে হয়তো! তিনি এ কারণেই স্বল্প কথা বলেন। যেন তার মনোবিজ্ঞানী মেয়েটা তার চালাকি ধরে না ফেলে। অথচ বাহার এসব ঠিক বুঝে যায়, সে শুধুই হাসে আর মা বাবার হিদায়াতের জন্য দুআ করে।

রাবেয়া আন্টির বাড়িতে পনেরো দিন থাকার পর নারী হোস্টেলে উঠেছিল বাহার। বান্ধবী রিজিয়া উকিলের সাথে পরামর্শ করে সে ডিভোর্সের সময়সীমা কমিয়ে আনার চেষ্টা করেছিল, তবু লাভ হয়নি। হোস্টেলে দশ দিন থেকেই সে বুঝেছিল, এখানে সে থাকতে পারবে না। মেয়েরা অদ্ভুত আচরণ করে। একটা মেয়ের লজ্জা বলে কিছু নেই। মেয়েটা যেদিন বাহারকে অশ্লীল সম্বোধন করে বসেছিল, সেদিন রাতে বাহারের ঘুম হয়নি। আরেকটা মেয়ে তিন দিন গোসল না করে থাকতে পারে, তার আবার প্রতি দিন সিগারেট না খেলে চলেই না। তবে একজন ছিল যে বাহারকে সব কাজে সাহায্য করতো। মেয়েটার নাম তাকিয়া। তাকিয়াকে ছাড়া আর কাউকেই ভালো লাগেনি বাহারের। তিন রুমের বাসায় ছয়জন থাকতো তারা। বাহারের বাবা সাখাওয়াত যখন সিয়ামের বাড়ির খবর জানালেন, তখন বাহার স্বস্তি বোধ করলো। ফিরে এলো নিজের বাসায়।

সিয়াম একবার চেষ্টা করেছে বাহারকে ফিরিয়ে আনার। সে মুসলিম পরিবারের সন্তান, তাই তার ইসলাম মানতে আপত্তি নেই, এসব বলে বাহারের মন গলাতে পারেনি সিয়াম। অবশ্য হাফসা সহ সিয়ামের আত্মীয় স্বজন কেউই বাহারকে ফিরিয়ে আনতে রাজি হননি। তাই সিয়ামকেও অপারগতা প্রকাশ করতে হয়েছে। মেনে নিতে হয়েছে তাদের শীঘ্রই বিচ্ছেদ হবে, যদিও বাহার জানে যে বিয়ে হয়নি। যদি সমাজের দৃষ্টিতে হয়েও থাকে তাহলে বিয়ের দিনই ভেঙে গিয়েছে।

আল্লাহর সাহায্যে বিয়ের সাড়ে তিন মাসের মাথায় বাহারের আইনগত তালাক কার্যকর হয়েছে। সে এখন সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে ডিভোর্সি নারী। তার বিয়ে ঠিক করা হচ্ছে। রাবেয়া যেই বিয়েটা এনেছিলেন সেটা পছন্দ হয়নি হানজালার। তিনি চাইছেন অবিবাহিত ছেলে আসুক। বাহারের কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। সে শুধু ঈমানদার পাত্র চায় যার হাত ধরে জান্নাতে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টায় প্রতিনিয়ত তারা আল্লাহর মুখাপেক্ষী থাকতে পারবে। হানজালার সেইসব পাত্র পছন্দ না। তিনি যেমন পাত্র খুঁজে আনেন, তেমন আবার বাহারের পছন্দ নয়।

এভাবেই দেখাশোনা আর মনঃযুদ্ধ চলছে মা-মেয়ের। বাহার এখন ক্বুরআন শিক্ষা কোর্স শেষে আরবি ভাষা শিক্ষা কোর্সে ভর্তি হয়েছে, আর ফরজ ইলমের কোর্স চলমান আছে। মনোরোগের বিনামূল্যে সেবা দানের জন্য তার একটা পেজ আছে। সেখানে সে বিভিন্ন তথ্য দেয়, মেয়েদের মনের সমস্যা সম্পর্কে শোনে ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। তার অনেক নতুন বন্ধু তৈরি হয়েছে, যারা হয়তো জান্নাতে গেলে তাকে খুঁজবে। এই আশায় তারা সবাই কথা বলার ক্ষেত্রে রাসূলের সুন্নাহ মেনে চলে।

আরো একটা বিষয় বাহারের ব্যস্ততার মাঝে জায়গা করে নিয়েছে। রাধিকা ব্যানার্জি ইতিমধ্যে বাহারের মাধ্যমে ইসলাম সম্পর্কিত তার সকল দ্বিধা দূরীকরণের ব্যবস্থা করছেন। বাহার তাকে একটা তালিকা করতে বলেছিল। রাধিকা প্রশ্নের তালিকা করে বাহারকে দিয়েছেন। বাহার বিভিন্ন জায়গা থেকে সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে রাধিকাকে দিয়েছে। তবে সে একটা কথা শুরুতেই বলে নিয়েছে, ‘সবকিছুর উত্তর মন মতো পাবেন না আন্টি। যা আমরা জানি না, তাতে আল্লাহ নিশ্চয়ই কল্যাণ রেখেছেন। আমাদের ক্বুরআনের আয়াতে বর্ণিত আছে, আমরা শুনেছি এবং কবুল করেছি (সূরা বাক্বরা)। অর্থাৎ, আমরা রাসূলের মাধ্যমে ইসলামের যেই দাওয়াহ পেয়েছি, তা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছি। তাই আন্টি, সব উত্তর আপনি পাবেন না।’

এ কথাতে রাধিকা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখাননি, বরং আরো আগ্রহ প্রকাশ করেছেন কেন মুসলিমরা অন্ধের মতো সবটা বিশ্বাস করে নেয়? কেন তারা রবের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় তোলে না? তারা নিবিষ্ট মনে ইবাদাত করে যায়, যেন রব সবসময়ই তাদের সাথে রয়েছেন। তিঁনি তো অদৃশ্য, তিঁনি দৃষ্টির আড়ালে। তাহলে মুসলিমদের এতো ভরসা কেন যে আল্লাহ সব দেখছেন, তিঁনিই রক্ষা করবেন! উত্তরটা খুঁজতেই রাধিকার গোপনে গোপনে এতো উদ্বেগ। তিঁনি মনের আড়াল নন, এ কথা রাধিকা ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে পারছেন। বাহার সেই দিনের অপেক্ষায়, যেদিন রাধিকা বলবেন, ‘আমি ইসলাম গ্রহণ করতে চাই। আমাকে কালিমা পাঠ করাও বাহার।’ তার প্রতীক্ষার প্রহর হয়তো আজ সমাপ্তি ঘোষণা করলো। রাধিকা কল করেছেন।

– হ্যালো আন্টি?
– আসসালামু আলাইকুম মা।

মুচকি হেসে বাহার উত্তর জানালো, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’ কিন্তু পরক্ষণেই সে ভাবলো, একজন অমুসলিমের শান্তি কামনা কি ঠিক হলো? তবে রাধিকা তার ভাবনা কমিয়ে দিলেন, ‘তুমি কি বিকেলে বের হতে পারবে?’

– জি আন্টি, কোথায় যেতে হবে?
– জানি না। কোথায় গেলে কালিমা পড়া যাবে বাহার?

থমকে গেল বাহার। উত্তর দেয়ার অনুভূতি এখন শূন্য। রাধিকা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কোথায় যাবো বলো তো? আমার এখনই কালিমা পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু বিকেলে ছাড়া অন্য সময় বের হওয়া…’

তাকে থামিয়ে বাহার বললো, ‘আপনাকে কোথাও যেতে হবে না আন্টি। আমার সাথে বলুন, আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ..’

রাধিকা পুরো কালিমা পড়লেন। বাহার খুশিতে কেঁদে ফেললো, ‘আন্টি, আপনি এখন থেকে মুসলিম। আপনি রাসূলের উম্মাত হয়ে গেলেন আন্টি। আপনি আল্লাহর মনোনীত দ্বীন পালনকারী হয়ে গেলেন। আলহামদুলিল্লাহ!’

– এতো সহজে!
– জি আন্টি। আপনাকে সর্বপ্রথম মানতে হবে আল্লাহ এক। তিঁনি ব্যতীত আর কোনো ইলাহ নেই। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রাসূল, এটাও মানতে হবে। এরপর আপনাকে দ্বীনের বাকি বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে হবে। ইন শা আল্লাহ, সব জানতে পারবেন আল্লাহর সহায়তায়।
– আলহামদুলিল্লাহ! মা, আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। যার মাধ্যমে আমার ইসলাম চেনা হলো, তাকে একবার দেখতে চাই আজকেই।
– আন্টি, সবকিছুই আল্লাহর ইচ্ছে অনুযায়ী ঘটে। তেমনই হিদায়াহ একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছে। তিঁনি চেয়েছেন বলেই আপনি ইসলাম চিনেছেন। আমি শুধুই উসিলা।

রাধিকা হাসলেন, ‘আমার নাম কি রাখবো বলো তো?’

– আমার আবিদা নামটা খুব পছন্দ। আপনি যদি চান এই নামটা রাখতে পারেন। আমি আগেই ভেবে রেখেছিলাম, আপনি মুসলিম হলে আপনাকে এই নামে ডাকবো আমি।
– ইন শা আল্লাহ, তুমি তাহলে আজকে আমার সাথে দেখা করবে বিকালে?
– ইন শা আল্লাহ।

রাধিকার সাথে কথা শেষ করে গুলবাহার গুলনাজের কাছে যাওয়ার জন্য ঘর থেকে বের হলো। নাজকে সে আগেই বলেছিল রাধিকার কথা। নাজ সবসময়ই বলতো, ইন শা আল্লাহ আন্টি হিদায়াহ পাবেন। খুশির খবরটা দিতে বাহার বেরিয়ে অবাক হয়ে গেল। হুমায়রা খালামনি এসেছেন, রিপন ভাই আর সুপ্রিয়া ভাবিও এসেছে। আর সিনথিয়া একাই এসেছে, সবুজ ভাইকে নিয়ে আসেনি। সবচেয়ে বেশি বিস্মিত সে হাফসাকে দেখে। হানজালা মেয়ের হাত ধরে তাদের কাছে নিয়ে গেলেন। বাহার দ্রুত নিজের মুখ ওড়নায় আড়াল করে নিলো। রিপন এখানে তার জন্য গায়রে মাহরাম।

হাফসা এগিয়ে গুলবাহারকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। হুমায়রা রিপনকে বললেন, ‘এই, তুই অন্য ঘরে যা। আমাদের মেয়ে পর্দা করে।’ রিপন অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইরে চলে গেল। সুপ্রিয়া যেন স্বস্তি ফিরে পেয়েছে। এ বাড়িতে এলেই রিপনের চোখ বড় হয়ে থাকে কেন সুপ্রিয়া খুব ভালো করেই টের পায়। স্বামীর ছুঁকছুঁক স্বভাব তার অজানা নয়।

সিনথিয়া বাহারের কাঁধে হাত রেখে বললো, ‘মা শা আল্লাহ, আপু তোমার বয়স বাড়ছে দেখে মনেই হয় না। এজন্যই সিয়াম ভাই পাগল হয়ে গিয়েছেন।’

পরিবেশ দ্রুতই গম্ভীর হয়ে গেল সিনথিয়ার কথায়। হুমায়রা ইশারায় কিছু বোঝালে সিনথিয়া চুপ হয়ে গেল। হানজালা বললেন, ‘এখানে না বসে চলো সবাই ঘরে যাই। এখানে কথা বলে আরাম হবে না।’

বাহার কিছুটা ধরতে পেরেছে এই মানুষগুলোর দল বেঁধে এখানে আসার কারণ কি হতে পারে। সিনথিয়া যেহেতু সিয়ামের প্রসঙ্গ টেনে এনেছে, তাই তার ধারণা সঠিক হতে পারে। এবং কিছুক্ষণ পরেই, বাহার যা ভেবেছিল তাই হলো।

বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পর হাফসা কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে সিয়ামের দুর্দশার কথা বলতে শুরু করলেন। তালাকের পর থেকে ছেলেটা বদলে গিয়েছে। সারাক্ষণ নিজের পাপের কথা বলে অনুতপ্ত থাকে। ভয় পায় সে, আল্লাহ কি তার পাপ ক্ষমা করবেন না? বাহারকে ছাড়া থাকতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে। কাজেও মন নেই। কাজ ছেড়ে বাবার ব্যবসায় যোগ দিতে চাইছে। হাফসা জোর করে ছেলেকে কাজে পাঠিয়েছেন। আবার বিয়ে দিতে চাইছেন কিন্তু ছেলের মন শুধু বাহারকে খোঁজে।

গুলবাহার চুপ করে হাফসার কথা শুনে গেল। এর পৃষ্ঠে সে কিছুই বললো না। সে জানে সিয়াম চরিত্রহীন ছেলে। তার সাথে বিয়ের আগে বহু মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়েছিল সিয়ামের। এছাড়াও নৌ বাহিনীর সদস্য হওয়ায় সিয়ামকে বউ ছাড়া থাকতে হয় সেখানে, এটা সিয়ামের মতো কাম মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির জন্য কষ্টসাধ্য বটে। বাহার জানে, সিয়াম এখন বাহারকে ফিরিয়ে আনতে চায় শুধুমাত্র তাকে বিয়ে করলে সিয়ামের অবাধ চলাচলে সুবিধা হবে। বাহার স্বল্পভাষী মেয়ে। কোনো ব্যাপারে তর্ক তার পছন্দ নয়। সে সরাসরি সমাধান করতে পছন্দ করে। তাই সিয়াম আর একবার তাকে গ্রহণ করলে সিয়ামের কুকীর্তি নিয়ে বাহারের উচ্চবাচ্য করা সম্ভব হবে না। কারণ বাহার পরিবারের সাহায্য পায় না। ধুকে ধুকে মরতে হবে তাকে।

কথোপকথনের উপসংহারে পৌঁছে বাহারকে এটাই বোঝানো হলো, ‘তুমি মানসিকভাবে প্রস্তুতি নাও সিয়ামের সাথে সংসার করার। কারণ হানজালার এতে পূর্ণ সায় আছে। আর সিয়াম এখন মুসলিম হয়েছে। সে নিজের সব দোষ স্বীকার করেছে।’

বাহার জানে সে কিছু বললেও এই পাঁচ জন নারী তাকে আটক ফেলবে কথার জালে। তাই সে মুচকি হেসে উত্তর জানালো, ‘এ ব্যাপারে পরে জানাবো ইন শা আল্লাহ। এখনই সিদ্ধান্ত জানাতে পারছি না।’

হানজালা জানেন তার জেদি মেয়ে উপরে শান্ত থাকলেও ভেতরে ঠিকই ফন্দি আটছে। তিনিও মুচকি হেসে হাফসাকে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত জানালেন না। সাখাওয়াত এলে বলে দেখবেন, এইসব বলে প্রসঙ্গ বদলে ফেললেন। এক পর্যায়ে বাহার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে হানজালা প্রসঙ্গ ফিরিয়ে এনে বোঝালেন তিনি মেয়ে আর মেয়ের বাবাকে এই ব্যাপারে সম্মতি দেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করবেন।

আজ বিকেলটা বেশ মন্দ কাটলো। বাহার রাধিকাকে ফোন করে বলেছে সে যেতে পারবে না আজ। কাকতলীয়ভাবে, রাধিকা জানালেন তিনিও আজ বের হতে পারবেন না। কাল রণজিৎ কুমিল্লার উদ্দেশ্যে বের হলে তিনি জামা কাপড় আর প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে একবারে বেরিয়ে আসবেন ঘর ছেড়ে। বাহারের একবার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো, রাধিকা সংসার ছেড়ে বের হচ্ছেন। তার কি কষ্ট হচ্ছে? তবু সে প্রশ্নটা করলো না। প্রশ্ন করে কষ্ট বাড়ানোর কোনো অর্থ নেই। বরং তাকে দ্বিধায় ফেলে দেয়া হবে। আর রবকে অনুভব করতে পারলে কোনো কষ্টই বড় মনে হয় না।

__________

পরেরদিন দুপুরবেলা হানজালা খাওয়ার টেবিলে সাখাওয়াতকে ইশারা করলেন। সাখাওয়াত একটু কেশে বাহারকে বললেন, ‘পড়াশোনা আর কাজ কেমন চলছে মা?’

– ভালোই চলছে আলহামদুলিল্লাহ।
– আর নতুন জীবন গোছানোর পরিকল্পনা? সেটার কি হবে?

বাহার বুঝতে পেরেছে কথা কোন দিকে এগোচ্ছে। সে নিজেকে প্রস্তুত রেখে বললো, ‘আল্লাহই ভালো জানেন বাবা। আমি দুআ করতে থাকি, আল্লাহ কবে কবুল করবেন তা তিঁনিই জানেন।’

– সেটা ঠিক আছে, দুআ ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব নয়। কিন্তু মা, একটা নির্দিষ্ট লক্ষ্যে তোমাকে চলতে হবে। দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে যা প্রয়োজন, তার মাঝে কিন্তু সমাজ অনেক বড় একটা বিষয়। এই সমাজ গঠনে গড়তে হয় সংসার। সেই খেয়াল আছে তোমার?
– আছে।
– কাউকে ভালো লাগে তোমার?
– নাহ, আলহামদুলিল্লাহ। এসব পাপ থেকে দূরে আছি আমি আল্লাহর আশ্রয়ে থেকে।
– আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে আমাদেরকেই উদ্যোগ নিতে হচ্ছে?
– আমার পছন্দগুলো তোমাদের বলেছি আমি। এখন তোমরা সেই অনুযায়ী পাত্র পেয়ে গেলে আমার কোনো আপত্তি থাকবে না।

মেয়ের বিচক্ষণ জবাবে সাখাওয়াত কিছুটা দমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, ‘সিয়ামের খবর শুনেছো নিশ্চয়ই? ছেলেটা নাকি না-স্তিকতা থেকে বেরিয়ে এসেছে।’
বাহার চুপ করে আছে। সাখাওয়াত আবার বললেন, ‘আমরা চাই তুমি পেছনের সব ভুলে নতুন জীবন শুরু করো।’

বাহারের প্রশ্ন, ‘পেছনের সব ভুলে যাবো? অতীতের মানুষটার সাথে থেকে সব ভুলতে বলছো বাবা?’

– এটা কঠিন কিছু নয়। তুমি যেমন ছেলে চাও সিয়াম তেমনই হয়ে গিয়েছে। তাই দুজনের মানসিকতায় মিল হবে ভালো।
– ওই বাড়িতে আমার পর্দার পরিবেশ নেই। সিজান ভাই যখন তখন ঘরে ঢুকে পড়েন, সিয়াম আর সিজান দুজন একই রকম দেখতে। আমি গুলিয়ে ফেলবো কে কোনটা।
– এটা কেমন অজুহাত দিলে মা? সিজানকে বলে দিলেই হবে সে যেন তোমার ঘরে না ঢোকে। আর ওরা সবাই জানে তুমি কেমন মেয়ে। তাই…

বাহার খাওয়া শেষে উঠে পড়লো। যাওয়ার আগে বললো, ‘সিয়ামকে আমি বিয়ে করবো না।’

__________

সাদি এখন রিসার্চ সেন্টারে। এইতো, কাল রাতে সে চলে যাবে কাতারের উদ্দেশ্যে। স্মৃতি নিয়ে যাবে, রেখে যাবে স্পর্শের ভাষা। সেন্টারে ঢুকেই তোহা স্যারের অনুপস্থিতি ঘিরে ধরলো সাদিকে। এই তোহা সেন্টার এখন শুধু নামেই তোহা স্যারের। তার মৃত্যুর পর এটা এখন স্টেরি ম্যামের দায়িত্বে চলছে। তবে শোনা যাচ্ছে স্টেরি এই সেন্টার বন্ধ করে দিবেন। তিনি স্কটল্যান্ডে একবারে ফিরে গিয়েছেন, বাংলাদেশে আসবেন না। তাই এটা কোনো কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়া হবে। সেই কোম্পানি চাইলে সেন্টারের কাজ অব্যাহত রাখবে, আর নয়তো ভেঙে ফেলা হবে তোহা রিসার্চ সেন্টারের অভিজাত দালানটি।

সাদির সাথে বাকি কর্মচারীদের কুশল বিনিময় হলো। তাহমিদ স্যার বহু আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। তিনি এখন একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন, পাশাপাশি মেডিসিন ফিল্টারের ব্যবসা চালু করেছেন। তাই এখানে তার সাথে দেখা হলো না সাদির। বাকিদের মন খারাপ। যাদের সঞ্চয় কম তারা চিন্তায় পড়ে গিয়েছেন। সেন্টার বন্ধ হয়ে গেলে তাদের কর্মের অভাব পরে যাবে। সাদিরও মন খারাপ হয়ে এলো। কেমন সব উল্টে গিয়েছে মাত্র একজনের মৃত্যুর পৃষ্ঠে! ধরণী বিস্ময়কর বটে!

রিসার্চ সেন্টার থেকে বেরিয়ে সাদি গেল বেইলি রোডের একটি রেস্টুরেন্টে। সেখানে বন্ধু জাবিরের সাথে দেখা করবে সে। জাবির ভিসা অফিসের একজন কর্মকর্তা। জাবিরের সাহায্যেই সে ভিসা সংক্রান্ত ঝামেলাগুলো মিটিয়ে নিয়েছে। আজ বন্ধুর সাহায্যের বিনিময়ে দুপুরের খাবারের দাওয়াত দিয়েছে সে। নিজের বাসায় দাওয়াত দেয়ার সাহস পায়নি, হাতের রান্না খুব ভালো হয় না। বন্ধুই বললো বেইলি রোডের একটা ভালো রেস্টুরেন্টে নিয়ে যেতে।

কথামতো রেস্টুরেন্টে দুজন হাজির হলো। খাবার আসার আগে দুজন পুরোনো দিনের আলাপে মগ্ন হয়ে পড়লো। কথার পৃষ্ঠে কথা আসে, এমনই করে জাবির প্রশ্ন করলো, ‘আচ্ছা, তোর কি মনে হয় না যে তোকে ওরা একটু বেশিই ছেড়ে রেখেছে?’

সাদি চুপ করে আছে। এই কথা তারও চিন্তায় এসেছিল। কিন্তু কাতার যাওয়ার সময় হয়ে গেল, তবু কোনো হুমকি এলো না। সে অবশ্য কাতার যাওয়ার বিষয়টা গোপন রাখার চেষ্টা করেছে। জাবির আর এয়ারপোর্টে কর্মরত বন্ধুর সহায়তায় তার বিদেশ চলে যাওয়ার ব্যাপারে সতর্কতা রয়েছে অনেক। সাদি বলে উঠলো, ‘দেখা যাক কি হয়, যাই হবে ভালোই হবে আশা রাখি। আল্লাহ যা করেন কল্যাণের জন্যই করেন। এসব কথা বাদ দে এখন। তোর বাবুটা কেমন আছে?’

কথোপকথন ও খাওয়া দাওয়া শেষে দুই বন্ধুবিদায় নিলো একে অপরের কাছ থেকে। জাবির পুরুষ মানুষ, তবু ছলছল চোখ তার। সাদি হেসে বললো, ‘কাঁদিস না। দেশে আসবো না হয়তো, কিন্তু যোগাযোগ রাখবো ইন শা আল্লাহ।’

সাদি বাসার উদ্দেশ্যে রিকশা খোঁজ শুরু করলো। তার নতুন বাসা পুরোনো ঢাকায়, দুইটা বেডরুম আছে, বসার ঘর আর খাওয়ার ঘর একসাথে। অল্প কিছুদিনের জন্য নেয়া এই বাসটাও সে গুছিয়ে রেখেছে সুনিপুনভাবে। রিকশা নেয়ার আগেই রাধিকার নম্বর থেকে ফোন এলো। সাদি তা ধরলে রাধিকা বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম বাবু। তুই কি বাসায়?’

সাদি এতোটাই হতবাক যে উত্তর দিতে ভুলে গেল সে। রাধিকা আবার প্রশ্ন করলেন, ‘কিরে সাদি? কথা বলছিস না কেন?’

সাদি আবারো বিস্মিত। রাধিকা তাকে সাদি নামে ডাকছেন! সাদি ধাতস্থ হয়ে বললো, ‘না, আমি বাইরে আছি। দেখা করবে মা?’

– তোর বাসায় যাবো।
– বাসায়! কিন্তু তোমার সমস্যা হবে না মা?
– সমস্যা এখনই। তোর বাবার সাথে আমার সম্পর্ক শেষ। আমি মুসলিম হয়েছি একদিন পার হলো।

সাদি ফুটপাতের উপর বসে পড়লো। উচ্চস্বরে বলে উঠলো, ‘কি!’

– হ্যাঁ, আমার নাম আবিদা উম্মে সাদি। আমি তোর মা রাধিকা নই, আবিদা।

সাদি রাস্তায় বসেই কেঁদে ফেললো। তবে সে দ্রুত তার চোখ মুছে ভাঙা কণ্ঠে উচ্ছাস প্রকাশ করে বললো, ‘আমাকে বলো তুমি কোথায় আছো? আমি তোমাকে নিতে আসবো মা।’

– আমার সাথে আরো একজন আছে। আমি তার গাড়িতেই আসবো। তুই শুধু বল তোর বাসা কোথায়?
– কে আছে মা?
– এখন বলবো না। তুই ঠিকানা বল।
– আমার বাসা নীলক্ষেতে।

সাদি বাসার ঠিকানা বলে দিলো। ফোন রেখে সে রিকশা ঠিক করলো। রিকশাওয়ালা যেই ভাড়া চেয়েছে তাতেই রাজি হয়ে সে রওনা হলো বাসার উদ্দেশ্যে। আজ সে খুব খুশি। তার বিশ্বাস হতে চাইছে না তার দুআ কবুল হয়েছে। সে বারবার আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করছে, অশ্রু ঝড়লেও তা দমন করছে। বাসায় পৌঁছে সে রিকশাওয়ালা মামাকে বাড়তি টাকা দিয়ে বললো, ‘এটা রাখুন। আমি আজ অনেক খুশি মামা। আমার খুশির ভাগ আপনাকেও দিলাম।’

মামা হাসিমুখে ফিরে গেলেন। সাদি বাসায় ঢুকে দ্রুত সব পরিষ্কার করতে শুরু করলো। মা আসবে, এখানে থাকবে। রণজিৎ এখন আবিদার জন্য হারাম। তাই তারা একসাথে থাকতে পারবেন না। তবে সাদির চিন্তায় অন্য বিষয় ঢুকেছে। মা এখানে একা থাকবে কি করে? মায়ের পরিবর্তন হবে জানলে সে বিয়ে করতো। বৌয়ের সাথে মাকে দেশে রেখে বিদেশ গিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতো সে। এরপর দুজনকে বিদেশ নেয়ার চেষ্টা করা যেতো। কিন্তু এখন আবিদা সম্পূর্ণ একা। এ ব্যাপারে মায়ের সাথে আলোচনা করবে সে। আপাতত রাতের খাবারের আয়োজন করতে হবে তাকে। মাকে না খাইয়ে সে যেতে দিবে না।

আবিদা চলে এলেন দ্রুতই। সাদি নীচে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। বসার ঘরে বসিয়ে সে নাস্তা আনতে গেল। পাউরুটি টোস্ট আর এক কাপ চা দিয়ে সে বললো, ‘নিচ থেকে সিঙ্গারা আর মোগলাই এনে দিই মা। তুমি বসো একটু।’ তাকে থামিয়ে আবিদা বললেন, ‘এতকিছু এখন খাবো না। আর একটু পরেই আমরা বের হবো।’

– কোথায় যাবে মা? আজকে রাতে না খাইয়ে যেতে দিব না। কোনো রণজিৎএর কথা শুনবো না।
– আমি আজ এখানেই থাকবো, শুধু আজ না। সারাজীবনের জন্য চলে এসেছি আমি।

সাদি মুচকি হেসে বিব্রত ভঙ্গিতে বললো, ‘মা, কাল রাতে আমি কাতার চলে যাচ্ছি।’

– কি!
– হুম। আমি এ দেশে থাকবো না। তাই তোমার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতে হবে আমার। বিস্তারিত আলোচনা করবো। আগে নাস্তা খাও। আমি নিচ থেকে আরো খাবার আনছি।

আবিদা সাদিকে বসে থাকতে বলে ফোন বের করে কাকে যেন কল করলেন। যা যা বললেন তাতে সাদি কিছু না বুঝলেও বিস্মিত হলো। আবিদা শেষে বললেন, ‘ও কাল বিদেশ চলে গেলেও বিয়ে করতে তোমার আপত্তি নেই বলছো?’

ওপাশ থেকে উত্তর ভেসে এলো। আবিদা মুচকি হেসে বললেন, ‘ঠিক আছে। তুমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দাও। আমি বাবুকে নিয়ে আসছি।’

ফোন রাখার পর সাদি তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করলো, ‘কে মা? কার সাথে কার বিয়ে?’

আবিদা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘তোর সাথে বাহারের বিয়ে। আমি ঠিক করেছি। এখন দ্রুত পাঞ্জাবি পরে আয় তো।’

সাদি হতবাক হয়ে বললো, ‘কি!’

একই সময়ে বাহারের মা তাকে বলে উঠলেন, ‘কি! একটা আসামিকে বিয়ে করবি তুই? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস বাহার?’

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here