ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,১৮,১৯

0
368

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,১৮,১৯
#আফসানা_মিমি
|আঠারো তম পর্ব|

একটা সময় আসে, যখন আমরা ভালো খারাপের দিক বিবেচনা করতে পারি না। দিক বেদিক উপলব্ধি করতে পারি না। চোখে যাই দেখি তাই চাকচিক্য মনে হয়। আমরা ভুলে যাই চকচক করলেই সোনা হয় না।
কাজী অফিসে কাঠের কেদারায় বসে আছি। ভয়ে,দ্বিধায় বুকে স্কুল ব্যাগ চেপে রেখেছি।
পরিবারের সহস্র ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে যাবির ভাইয়ার হাত ধরেছি। আমি জানি এই পথ ভুল কিন্তু অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমি সুখী হতে পারব না। আমার জন্মদাত্রী মা নিজের রাগ,জেদের মধ্যেই অটল। উনি নিজের কার্য হাসিলের জন্য অনেক নিচে নামতে পারেন। বর্তমানে আমি একা বসে আছি। কাজী সাহেব আড়চোখে কিছুক্ষণ পর পর তাকাচ্ছেন আবার আগত মানুষদের সাথে কথা বলছেন। সকলের মধ্যমণি হয়ে আছি। একজন একজন করে আসছেন আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে যাচ্ছেন। জীবনের প্রথম একাকী কোনো স্থানে বসে রয়েছি। যাবির ভাইয়া আধঘণ্টার মত সময় হয়েছে বের হয়ে গেছেন। বিয়ের জন্য কিছু কাগজপত্র তৈরি করতে হবে সেই সুবাদে। আমার হাতে আমাকে দেওয়া ফোন এবং কিছু শুকনো রুটি কলা কিনে দিয়ে গেছেন। আমরা গাজীপুর থেকে ঢাকায় চলে এসেছি টঙ্গীর একটা কাজী অফিসে বিয়ে করব বলে।
আরো দুই ঘণ্টা অতিবাহিত হয়েছে। যাবির ভাইয়া আসার কোনো খবর নেই। ইতিমধ্যে কাজী সাহেবও দুপুরের খাবার খেতে চলে যাবেন বলে তাড়া দিচ্ছেন। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। মনে শুধু খারাপ ভাবনা আসছে। যাবির ভাইয়া কী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? আমি একা একজন মেয়ে এই ঢাকা শহরে কোথায় ঘুরে বেড়াবো। হঠাৎ মনে হল আমার হাতে না ফোন আছে। যাবির ভাইয়াকে একটা ফোন করি। নাম্বার ডায়াল করে উনাকে ফোন লাগালাম। তিন চার বার লাগাতার ফোন লাগানোর পর সপ্তমবারের মতো উনি ফোন রিসিভ করে হাপিয়ে বললেন, –” আর একটু অপেক্ষা করো জান! আমি এইতো চলে এসেছি।”

কান্না করে দিলাম। নাক টেনে জবাব দিলাম, –” তাড়াতাড়ি আসুন কাজী সাহেব চলে যাবেন।”

দেখা গেলো পাঁচ মিনিটের মধ্যে উনি চলে আসেন। একা নয় সঙ্গে দুইজন লোককে নিয়ে এসেছেন। আমাকে দেখা মাত্রই অভিবাদন জানালেন। যাবির ভাইয়া খুব ব্যস্ততার সহিত কাগজপত্র দেখছেন। পরিহিত ধূসর রঙের পাঞ্জাবী ঘেমে চুবচুবে হয়ে আছে। একটু পর পর ললাটে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘাম পাঞ্জাবীর হাতা দ্বারা মুছে নিচ্ছেন। আগন্তুক দুইজন উনার বন্ধু। প্রায় পাঁচ মিনিট দুই বন্ধুকে বুঝিয়ে এবার আমার পাশে এসে বসলেন।
দুজনেই নীরব। আমি ভাবছি বাবা-মার কথা। সময় অনেক বাকী, জীবনের বিশেষ সিদ্ধান্তে বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছি। মন বলছে, যা করছি ভুল কিন্তু বিবেক বলছে, সেখানে থাকলে দম বন্ধ হয়ে মরে যাবো। কিছুক্ষণ পর হাতে উনার হাতের ছোঁয়া মিলে। উনার চোখের দিকে তাকালাম, যেখানে অসীম ভালোবাসা দেখতে পেলাম। তবে আমার মনে প্রশ্ন উঁকি দিলো, উনি কী সারাজীবন এভাবেই আমাকে ভালোবাসবেন? সঙ্গে সঙ্গে উওর পেয়ে খেলাম। আমার চোখে চোখ রেখে উনি বললেন, –” ভয় পাচ্ছো? কী ভাবছো, সময় ফুরিয়ে গেলে ছেড়ে দিবো? কখনোই না,মায়া। আমি তোমার থেকে অনেক বড়ো। ভালো মন্দ বিবেচনা করার বয়স হয়েছে। আমি সজ্ঞানে তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি। আমি চাইনা, সমাজের মানুষ তোমাকে কটূক্তি করুক। ভরসা করে দেখো। কথা দিচ্ছি, কখনো কষ্ট দিবো না।”

ছলছল চোখে তাকিয়ে রইলাম। এই মুহূর্তে আমি ভীষণ অসহায়। যাবির ভাইয়া চিবুকে হাত রেখে উনার দিকে ফিরালেন। চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন, –” শুনো মায়াবিনী, তৈরি হয়ে নাও লাল রঙে। বঁধু বেশে আলতো হেসে। কপোলে টিপ পরে,চোখে গাঢ় কাজল দিয়ে।”

স্বপ্ন হলেও সত্যি। বাস্তবে, সজ্ঞানে উভয়ের মতামতে বিয়ের কার্য সম্পন্ন হলো। লাল শাড়িতে বিয়ে না হলেও লাল থ্রি পিস পরে কবুল বলে যাবির ভাইয়ার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে গেলাম।
বিকালে পথ হাঁটছি। আমার হাত উনার হাতের বন্ধনে শক্তভাবে আবদ্ধ। অপরপাশে উনার দুই বন্ধু হামিদ এবং নাবিল ভাইয়ার সাথে আলোচনা করছেন। আলোচনার বিষয়বস্তু হলাম আমি। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী তা নিয়েই আলোচনা করছেন। কথার ছলে নাবিল ভাইয়া বলেন, –” মায়া এখন অনেক ছোট। মাত্র দশম শ্রেণীতে পড়ে। তুই যদি কোনো ভাড়া বাসায়ও থাকিস তবে পু’লি’শ কে’স হতে পারে।”

–” নাবিল ঠিক বলেছে। জোর করে তো আমাকে উকিল বাপ বানালি শা’লা। এখন যে বাপের দায়িত্ব পালন করব তারও কোনো উপায় নেই। তোদের বাড়িতে উঠালেই বাবা ঝাঁ’টা হাতে দৌঁড়ানি দিবে।”

শত চিন্তার মাঝেও হেসে দিলাম। হামিদ ভাইয়াও হাসলেন। যাবির ভাইয়ার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে উনারা চলে গেলেন। আব্দুল্লাহপুর বাস কাউন্টারে এসে দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের এলাকায় বাস,গাড়ি সময়মত কিছু পাওয়া না গেলেও ঢাকা শহরে যানবাহনের অভাব নেই।
দুইটা টিকিট কেঁটে বাসে চড়ে বসলাম। বাস ছেড়ে দিয়েছে। অচেনা শহর, পথঘাটও অচেনা। একজন মানুষকে ভরসা করে তার সাথে এগিয়ে যাচ্ছি। কপালে হাতের ছোঁয়া পেয়ে যাবির ভাইয়ার দিকে ফিরলাম। উনি এক দৃষ্টিতে আমাকে দেখছেন। হঠাৎ উনার কী হলো জানি না। আমার দুই গালেহাত দিয়ে ধরে কপোলে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলেন। আবেশে চোখ বন্ধ করে রইলাম। তখনই কর্ণধারে উনার স্বর ভেসে আসে, –” আমার প্রতি তোমার হাজারো অভিমান জমা হয়েছে। তুলে রাখো, একদিন সব অভিমান ভেঙে দিবো।”
–” আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
–” সিরাজগঞ্জ, তোমার শ্বশুর বাড়ি।”
–” সেখানে আমাকে সবাই মেনে নিবেন তার গ্যারান্টি কী?”

যাবির ভাইয়া বাসে গা এলিয়ে দিলেন। আমাকে টেনে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলেন। দিন শেষে এমন একটা শান্তির স্থান আমার জন্য দরকার ছিল। চোখ বন্ধ করে রইলাম। অপেক্ষা করছি প্রশ্নের উওরের। অবশেষে উনি মুখ খুললেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, –” এক জায়গায় তো মাথা ঠেকাতেই হবে,মায়াবিনী। তোমার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধে। নিজের স্বার্থের জন্য তোমাকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছি তাই বলে তোমার ভবিষ্যত দেখব না তেমন মানুষ নই। তোমার ভবিষ্যত এখনো পড়ে আছে। এজন্য আমার শক্ত খুঁটি প্রয়োজন,যা আমি সিরাজগঞ্জে আমার পরিবারের কাছে পাবো।”
——–
সারাদিনের ধকল কাটিয়ে উঠতে পারিনি। শরীরের অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করছি। বড়ো মা জ্বর পট্টি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন কিন্তু কাছে আসছেন না। বড়ো মার মুখ শুকনো, থমথমে যেন কত বেলা মুখে আহার উঠেনি। আমি হাতের ইশারায় বড়ো মাকে কাছে ডাকছি। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। উফ সে কী যন্ত্রণা! কিছুক্ষণ পর দেখি মা রক্তিম চোখে তাকিয়ে আছেন। তিনিও দরজার সামনে। কাছে আসছেন না। মালা,মেহেদীর মুখ চেপে ধরে রেখেছেন। আমি চিৎকার করে বলছি, –” মা ওদের ছেড়ে দাও, মরে যাবে তো।”
মা উন্মাদের মত হেসে বলছেন, –” তোকে এত আদর দিয়ে কী লাভ হলো। সেই তো আমাদের মুখে চুনকালি মেখে চলে গেলি। আজ এদের মে’রে ফেলবো। নয়তো বড়ো হয়ে এরাও তোর মত কাজ করবে।”

আমি দুর্বল স্বরে মা বলে চিৎকার করে বলছি, –” আমাকে ক্ষমা করে দাও,মা। আমার দোষের কারণে আমার দুই ভাই বোনকে শাস্তি দিও না।”
মা আমার কথা শুনলেন না। মালা,মেহেদীকে টেনে নিয়ে গেলেন অন্ধকারে। এদিকে আমার যেনো দম বন্ধ হয়ে আসছে। পানি পানি বলে চিৎকার করে যাচ্ছি কিন্তু কেউ পানি দিচ্ছে না।
কপালে পানির ছোঁয়া পেয়ে সজাগ হয়ে গেলাম। তার মানে আমি এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম। স্বপ্নটা এত ভয়ংকর কেন ছিল? আমি এমন স্বপ্ন আর দেখতে চাই না। খেয়াল করলাম কপালে আমার রুমাল দিয়ে জ্বর পট্টি দেওয়া। বাস থেমে আছে। কোথায় থেমেছে জানা নেই। আশেপাশে তাকালাম। বাসের অনেকেই ঘুমিয়ে আছে, আবার অনেকেই সজাগ। আমার পাশের সিটটা খালি পড়ে আছে। যাবির ভাইয়া নেই। ভয় পেয়ে গেলাম। মনে খারাপ ভাবনা উঁকি দিচ্ছে, উনি কী আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন? কে জানে, সিট থেকে উঠা চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না। প্রচন্ড মাথা ব্যথা এবং জ্বরের কারণে দুর্বল হয়ে বাসের সিটে আবারো বসে পড়লাম। চোখ বন্ধ অবস্থায় উনার স্বর কর্ণধারে পৌঁছে, –” উঠে পড়েছো? সারাদিন তো কিছু খাওনি। আমিও চিন্তায় কিছুই খাইনি। বিশ্বাস করো, আমার মনেই ছিল না যে আমাদের দুজনেরই পেটে কিছু পড়েনি। সন্ধ্যা হয়ে গেছে আমাদের পৌঁছাতে আরো তিন-চার ঘন্টা লাগবে। চলো কিছু খেয়ে নিই।”
সত্যিই ক্ষুধা পেয়েছে। যাবির ভাইয়া খাবার এনেছেন। বক্স খুলে দেখি, সাদা ভাত আর ডিম ভুনা। কিন্তু এগুলো খেতে ইচ্ছে করছে না। জ্বরের মুখে এসব খেলে বমি করে দিবো। উনি হয়তো বুঝতে পারলেন, আমাকে আশ্বস্ত করে বললেন, –” খেতে পারবে না তাই ভাবছো, তাই না! আমি খাইয়ে দেই। স্পেশাল ভাবে খাইয়ে দিব। বমি আসবে না।”

এতদিন বড়মার হাতে খেয়ে এসেছি। আজ প্রথম স্বামীর হাতে খাবো। ব্যাপারটা অন্যরকম।

বেশি লেবুর রস দিয়ে ভাত মাখিয়ে আমার মুখে তুলে দিলেন। তৃপ্তি সহকারে খেয়ে ঢেকুর তুললাম। এরপর উনি নাপা হাতে ধরিয়ে দিলেন সেটাও খেয়ে নিলাম।

মাথা ভার হয়ে আসছে। বসে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। মাথা এলিয়ে দিলাম যাবির ভাইয়ার কাঁধে। উনিও ভাত খেয়ে নিলেন। ইতিমধ্যে বাস ছেড়েছে। জানালার দিকে তাকিয়ে আছি। আমাদের গন্তব্য এখন সিরাজগঞ্জ। জানি না সেখানে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে ।
ভাগ্য যদি সহায় হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে। আর যদি ভাগ্য যদি খারাপ হয় তাহলে বাকি পথ আমাদের একাই চলতে হবে।

চলবে…….

#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
|ঊনিশ তম পর্ব |

সূর্যের সোনালী কিরণ চোখে প্রতিফলিত হতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়। জানালা ঘেঁষে বসার দরূন প্রকৃতির চমৎকার সৌন্দর্য চোখে বাঁধে। নদীর ঢেউয়ের তালে তালে নৌকার দোল খাওয়া দেখে চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে। নদীর পাড় বেয়ে সবুজ মাসকালাইয়ের গাছ রোপণ করে রেখেছে। নদীর ঢেউয়ের তালে কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে। মাঝিরা নৌকায় বসে জাল পেতে আছে সন্ধ্যায় সেই মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরে পেট পুরে খাবেন।

প্রকৃতির মাঝে এতোটাই ডুবে ছিলাম যে আমার জীবনের নতুন সূচনার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। বাম পাশটার মানুষের সাথে সারাজীবন পাড় করতে হবে। সারারাত হয়তো যাবির ভাইয়া জেগে ছিলেন। বর্তমানে উনি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আমার কাঁধকে বালিশ বানিয়ে স্বপ্নের রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
বাস থেমে যাওয়ার ঝাঁকুনিতে যাবির ভাইয়ার ঘুম ভেঙে যায়। আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে বলে, –” চোখ লেগে গেছিল, কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল করিনি।”
পিটপিট চোখে উনাকে দেখছি। এই প্রথম নয় যে উনাকে দেখছি তবে আজকের সকাল আমার জন্য অন্যরকম। আমাদের বিয়ের পর আজ প্রথম সকাল।
ঘুম থেকে উঠার পরের অবস্থায় যাবির ভাইয়াকে যে প্রথম দেখছি তা কিন্তু নয়। এই ফোলা ফোলা চোখ,শুষ্ক ঠোঁট জোড়ার মালিককে লুকিয়ে, সামনাসামনি কত দেখেছি কিন্তু আজকের দেখা ভিন্ন। আজ আমার স্বামীকে দেখছি। আমার তাকানোতে উনি অস্বস্তিতে পড়েন পরমুহূর্তে আমাল গালে হাত রেখে বলেন, –” এভাবে তাকিয়ে কী দেখছো? আমি চলে যাচ্ছি না। সারাজীবন তোমার পাশে থাকব। চলো মায়া, আমরা চলে এসেছি। এখানেই নামবো।”

অন্তরে চাঁপা কষ্ট অনুভব করলাম। শ্বশুর বাড়ির লোকেরা আমাদের কীভাবে মেনে নিবেন কে জানে।
বাস থেকে নেমে আশেপাশে তাকালাম। আমরা সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়ার বাস স্টপে এসে দাঁড়িয়েছি। একটা রিকশা ডেকে উনার সাথে উঠে পড়লাম। আমার হাত শক্তভাবে ধরে বললেন, –” আমি জানি না সেখানে আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। তবে তোমার কাছে অনুরোধ, যাই কিছু হোক আমার উপর ভরসা রাখবে। আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”

–” আপনি আমার আপনজন। আপনাকে বিশ্বাস করি বলেই এতটুকু পথ পাড়ি দিতে পেরেছি। আমার বিশ্বাস কখনো ভাঙবেন না, নয়তো আমি ভেঙে যাবো।”

যাবির ভাইয়ের বাসায় পৌঁছাতেই এলাহি কান্ড চোখে ভাসে। বাড়ির উঠোনে লম্বা সারি করে মাদুর বিছানো। এখন সময় সকাল নয়টা বাজে। যাবির ভাইয়ার দিকে তাকাতেই উনি বললেন, –” আমাদের এখন সকালের নাস্তা করার সময় এখানে তারই আয়োজন করা হচ্ছে।”

যাবির ভাইয়ের কথা আমার মাথায় ঢুকল না। আমরা সাধারণত নাস্তা করি খাবার টেবিলে বসে অথবা নিচে পাটি বা মাদুর বিছিয়ে। কিন্তু উঠোনে এত বড়ো বড়ো মাদুর কেন বিছিয়েছে তার উত্তর পেলাম না।

যাবির ভাইয়ার হাতে হাত রেখে আশেপাশে পর্যবেক্ষণ করছে তখনই কানে স্টিলের পাত্র নিচে পড়ে ঝনঝন শব্দের উৎপত্তি হয়। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা অবাক নয়নে আমাদের দেখছেন। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর চিৎকার করে বলেন, –” ওরে কে কোথায় আছিস, দেখে যা ছেলেটা কি করেছে। এই বাড়ির মান সম্মান কিছুই রাখেনি। এ কাকে ধরে নিয়ে এসেছে! আলমের বাপ এখনো বের হন না? দেখে যান আপনার ছোট ছেলের কীর্তি।”

যাবির ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিলেন। এগিয়ে গেলেন মধ্যবয়স্ক মহিলার কাছে। দুই হাতে মহিলাটিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, –” মা শান্ত হও। এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করো না। লোকে কি বলবে, চুপচাপ আমরা সমাধান করি।”

মধ্যবয়স্ক মহিলা যেন আরো রেগে গেলেন। উনার দুই হাত ছাড়িয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজে বললেন, –” তুমি আমার বাড়ির মান সম্মান ধুয়ে মিশিয়ে দেবে আর আমি চুপ থাকব? কখনোই না। আমি চিল্লিয়ে পুরো পাড়া প্রতিবেশী এক করে ফেলবো। তোমাকে ঢাকা শহরে পাঠিয়েছিলাম এই কারণেই কী? বিয়ে করে বউ ঘরে তুলেছো আবার উঁচু আওয়াজে কথা বলছো, তোমার লজ্জা করছে না!”

পরিস্থিতি খুবই অস্বাভাবিক। আমি ভয়ে কান্না করছি। এক জায়গায় জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছি এমন সময় একজন পুরুষালির কন্ঠস্বর কর্ণধারে এসে পৌঁছায়, –” মেয়ে মানুষের এত চিৎকার চেঁচামেচি কিসের? মেয়ে মানুষের কন্ঠ থাকবে নরম। এভাবে চিৎকার করে পুরুষদের শুনাচ্ছো? থামো বলছি। কি হয়েছে আমাকে দেখতে দাও।”

মধ্যবয়স্ক লোকটির কথা শেষ হতেই যাবির ভাইয়ার মা আবারও তেতে উঠে বলেন, –” আজ কোন চুপ থাকছি না। এত আদরে বড় করেছি ছেলেটাকে আর সে আমার মান-সম্মান এভাবে মিশিয়ে দিচ্ছে। আমি মানি না। এই মেয়েকে আমি ঘরে তুলবো না।”

–” আমি এখনো বেঁচে আছি। তোমার সিদ্ধান্ত জানতে চাইনি।”

আমার এখন ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে দূরে কোথাও পালিয়ে চলে যেতে। এমন পরিস্থিতিতে আমি কখনো পরিনি। না জানি আমার বাড়িতে এখন কি ঘটছে।

কথোপকথন শুনে বুঝতে পারলাম বয়স্ক লোকটি যাবির ভাইয়ার বাবা। উনি আস্তে করে হেঁটে আমার কাছে আসলেন এবং শান্ত গলায় বললেন, –“তোমার নাম কি?”
–” মায়া।”
–” বাড়ি কোথায়?”
–” গাজীপুর।”
–” তুমি যে এখন সিরাজগঞ্জে তা কী তোমার পরিবার জানে?”

উনার কথায় মাথা নেড়ে না বোধক ইশারা করলাম উনি লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে কাউকে ডাকলেন, –” ফারিহা তোমার মামীকে মামার ঘরে নিয়ে যাও। আর তোমার পরিধানের একটা পোশাক দাও যেন গোসল করে সেটা পরে।”
যাবির ভাইয়ার দিকে তাকালাম। উনি চোখের ইশারায় আমাকে ফারিহার সাথে যেতে বললেন।আমিও তাই করলাম, পিছন থেকে শুনতে পেলাম ভদ্রমহিলা চিৎকার করে বলছেন, –” ঐ মেয়েকে আমি কিছুতেই ঘরে তুলবো না। আপনি যতই ঐ মেয়েকে ঘরেও উঠান না কেন। আমি কখনোই মেনে নিব না।”

–” সেটা পরে বুঝা যাবে। যাও খাবারের ব্যবস্থা করো।”

যাবির ভাইয়ার ঘরে এসে উঠলাম। কোমড় পর্যন্ত ইট দিয়ে তার উপরে টিন দিয়ে বাঁধাই করা। জমিন ইট পাটকেল দিয়ে পাকা করে দেয়া হয়েছে। ফারিয়া নামক মেয়েটা আমাকে বিছানার উপর বসিয়ে হাসমুখে দাঁড়িয়ে রইল। আমাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, –” তুমি আমার থেকে এক দুই বছরে বড় হবে। তুমি দেখতে খুবই মিষ্টি। আমি তোমাকে মিষ্টি মামী বলে ডাকি।

আমি হেসে মাথায় ইশারা করলাম। গোসল করার সময় বিপত্তিক ঘটলো। এখানে সকলেই নাকি পুকুরে গোসল করে। যার কারণে পুকুরে গোসল করা হয়। চাপকলের পানিতে আয়রন আছে। এই পানিতে গোসল করলে মাথার চুল সব নষ্ট হয়ে যাবে। আমার পুকুরে গোসল করার অভ্যাস নেই তাই কষ্ট করে চাপকলে গোসল করে নিলাম। অবশ্য ফারিহা পানি উঠিয়ে দিয়েছে। চাপ কলে পানি উঠানোর অভিজ্ঞতা নেই বলে পারিনি।
গোসল করে সবুজ রঙের থ্রি পিস করে পরে বসে রইলাম। বাহিরে এখনো চিৎকার চেঁচামেটির আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। বিষয়বস্তু আমি এবং যাবির ভাইয়া। আমাদেরকে নিয়েই আলোচনা হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর সবকিছু নীরব হয়ে যায়। যাবির ভাইয়া ঘরে আসেন। উনাকে দেখা মাত্র বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। উনি আমার কাছে এসে বললেন, –” ভয় পেয়ে না মায়া। বলেছিলাম না সব ঠিক হয়ে যাবে। বাবা তোমাকে মেনে নিয়েছে। আস্তে আস্তে বাড়ির সবাইও তোমাকে মেনে নিবে। চিন্তা করো না, চলো খেতে যাই।

আসার সময়ে বাহিরে মাদুর বিছানো উঠান খালি পড়েছিল সেই উঠোন এখন মানুষে ভরপুর। মাদুরের দুই প্রান্তে মানুষ খেতে বসেছে। সকলের সামনে একটা গ্লাস ভর্তি এবং খাবার ভর্তি প্লেট। আমি অবাক নয়নে দেখছি। কয়েকজন লোক দায়িত্বে আছেন সকলকে দেখাশোনা করা যেমনটা কোন দাওয়াত থানায় হয়ে থাকে। ফারিহার দিকে প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে সে হাসিমুখি উত্তর দেয়, –“ভয় পেয়ো না মিষ্টি মামী। এটা আমাদের তিন বেলার কাজ। আমরা এভাবেই খাই। আমাদের পরিবার বিশাল। ঐ যে বলে না, চৌদ্দগুষ্ঠী! আমাদের আটাশ গোষ্ঠী। তিন বেলার রান্না দেখে তুমি তো পাগল হয়ে যাবে। বলবে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি, আমি এখন উল্টা পথে গেলেই বাচি
হা হা হা।”

ফারিহার কথায় মলিন হাসলাম। আশপাশে তাকিয়ে যাবির ভাইয়াকে খুঁজে যাচ্ছি। অবশেষে উনার দেখা মিললো। খালি গায়ে, কাঁধে ভেজা লুঙ্গি রেখে মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে আসছেন। এই প্রথম উনাকে এই অবস্থায় দেখা। চোখ বড়ো করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি আমার কাছে এসেছেন চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বললেন, –” অনেক গরম বুঝলে, মায়া! পুকুরপাড় থেকে গোসল করে এসেছি। আমার সাথে একটু ঘরে আসো তো, কথা আছে।”

উনার কথা এতটাই স্বাভাবিক মনে হয়েছে যেন উনার সাথে সংসার করছি কত যুগ ধরে। উনার পিছু পিছু ঘরে গেলাম এর মধ্যে উনি সবুজ রঙের পাঞ্জাবী পরে নিয়েছেন। আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, –” পৃথিবীতে আমরা দুজন দম্পতি মনে হয় এমন অভাগ্যবান। যাদের কোন বাসর হলো না। না দুষ্টু মিষ্টি নতুন দিনের সূচনা হলো।”
উনার কথায় চুপসে গেলাম। ভ্রু যুগল কুঁচকে প্রশ্ন করলাম, –” আপনি এসব ভাবেন?”
আমার কথায় উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হু হা করে হেসে ফেললেন। আমার নাকে চাপ দিয়ে বলেন, –” এখন কষ্ট হচ্ছে। দেখবে একটা সময় আসবে যখন আমাদের অনেক সুখ হবে।”

উনার কথার প্রত্যুওরে কিছু বললাম না। চুপ করে রইলাম। এরপর চলে গেলাম খাবার খেতে।
সারাটা দিন এভাবেই কা’ট’লো। যাবির ভাইয়াও বাহিরে কোথাও যাননি। কখনো ঘরের বাহিরে দৌঁড়াচ্ছিলেন আবার কখনো আমাকে এসে দেখে যাচ্ছেন। আমি সারাদিন ফারিহার সাথে বসে ছিলাম।

রাত্রি বেলা। এখানে রাত আটটা বাজলেই রাত গভীর হয়ে যায় যেখানে আমাদের এখানে আটটা বাজলে রাত শুরু হয়। রাতের খাবার খেয়ে যে যার ঘরে চলে গেছে। এই সময়টুকুর মধ্যে আমার কারো সাথে কথা হয়নি। কথা হয়নি বলতে, কেউ কথা বলতে আসেনি। আমিও চুপচাপ বসে ছিলাম। এখন বাজে আটটা পঁয়তাল্লিশ।
জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কালো আকাশের বুকে উজ্জ্বল চাঁদ দেখছি। তখনই যাবির ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করেন। ঘরের দরজা আটকে নিঃশব্দে আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমি উনার উপস্থিতি বুঝতে পারি, কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলি, –” আপনাকে পাঞ্জাবী পরিহিত দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। আমার সামনে পাঞ্জাবি পরেই বেশি থাকবেন। আমি পাঞ্জাবী ওয়ালাকে দেখেই সর্বপ্রথম প্রেমে পড়েছি।”

–” আমি কি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, মায়া?”

–” এমনটা মনে হওয়ার কারণ?”

–” আসলে আমি নিজের জন্য স্বার্থপর হয়ে গেছি। নিজের সুখের জন্য তোমার মতামতকে প্রাধান্য দেইনি। এখানে নিয়ে এসেছি। দিন শেষে এখন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছি, আদৌও কী আমি সঠিক কাজ করেছি?”

আমি উনার দিকে ফিরে তাকালাম। উনার হাতে হাত রেখে আশ্বস্ত স্বরে বললাম, –” মনের মধ্যে এতটা দ্বিধাও রাখবেন না। আপনাকে ভালোবাসি বলেই আপনার সাথে এসেছি। ভাগ্য আমাদের যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই যাব। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আপনি শুধু আমার পাশে থাকবেন এতোটুকুই যথেষ্ট।”

–” তোমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কোন বাহানা করতে চাই না। তোমাকে ছেড়ে চলে যাবার কথা মনে করতেই চাই না। আমি শুধু চাই তোমার আশেপাশে থাকতে সর্বক্ষণ। তোমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতে আজীবন।”

বাকী রজনী উনার বুকে মাথা রেখে গল্প করেছি। একসাথে পথ চলার ওয়াদাবদ্ধ হয়েছি। যাডির ভাইয়ার বন্ধু সুলভ আচরণে মুগ্ধ হয়েছি। আবার কখনো দুষ্টু কথায় লাজে লাল হয়েছি। নিজেকে সবচেয়ে সুখী স্ত্রী মনে করেছি। আদৌও কী তাই!
সকাল সকাল পাড়া প্রতিবেশীদের আগমন ঘটে। ঘুম থেকে উঠে যাবির ভাইয়াকে পাশে পাইনি। অনেকেই ঘরে এসে ঢুকে পড়েন। আমাকে দেখে ছি ছি করতে একজন বলেন, –” তোমার মুখ দেখাও তো পাপ। এই মাইয়া ফরজ গোসল করো নাই কেনো? হাদিস কালাম কিছু শিখো নাই? এখন দেখি এই মাইয়ারে পবিত্র করতে হবে। কইরে জমিলা, কলস ভর্তি পানি নিয়ে আয় তো!”

দুইজন মহিলা আমাকে টেনে বাহিরে নিয়ে আসেন। কলপাড়ে বালতি, কলস দিয়ে পর পর তিন চার বালতি পানি গায়ে ঢেলে দেন। আমি হতভম্ব হয়ে আছি। ঠান্ডা পানি গায়ে লাগায় থরথর করে কাঁপছি। এমন সময় কারোর কন্ঠস্বর শুনতে পাই।

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here