#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়,২২,২৩
#আফসানা_মিমি
|বাইশ তম পর্ব |
ধরণীতে নতুন ভোরের আগমন ঘটেছে সাথে আমার জীবনের নতুন সময়ের। ফজরের নামাজের পর পরই সিরাজগঞ্জ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হই। আসার সময় শ্বশুর বাবা একশত টাকার পাঁচটা নোট হাতে তুলে দেন। শাশুড়ি মা তখনো ঘুমে ছিলেন। অনেকবার ডাকাডাকির পরও তিনি উঠেননি। আমরাও বুঝতে পেরেছিলাম উনার ঘুম থেকে না উঠার কারণ। কষ্ট করে কাউকে আর ডাকিনি। যেভাবে এসেছিলাম সেভাবেই রওনা হলাম ঢাকার উদ্দেশ্যে।
আমার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে ঢাকা শহরের আরেক নাম ব্যস্ত শহর রাখতে। চা ওয়ালা থেকে শুরু করে জজ ব্যারিস্টার সকলেই সকাল হতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে কাজের সূত্রে।
কোনাবাড়ি বাস থামতেই যাবির ভাইয়া আমাকে নিয়ে বাস থেকে নেমে পড়েন। আমাদের বাসা থেকে কোনাবাড়ির দূরত্ব প্রায় বিশ কিলোমিটার। ঢাকা আর যাওয়া হলো না। একটা রিকশা ডেকে যাবির ভাইয়া প্রথম উঠে বসলেন। আমি চারপাশে নজর ঘুরাচ্ছি। এই জায়গাটাও আমার অপরিচিত। ভেবেছিলাম বাবার বাসার আশেপাশে বসবাসের স্থান হবে। দূর থেকে হলেও বাবা,বড়ো মাকে দেখতে পাবো। তার সুযোগ হলো না। যাবির ভাইয়া রিকশায় উঠে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন। মুখে প্রশস্ত হাসি। আমিও হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিয়ে রিকশায় চড়ে বসলাম। রিকশা চলছে অজানা পথে। পিছনে ফেলে রেখে এসেছি যানবাহনের স্তুপগুলোকে। উনি আমার হাত শক্ত করে ধরলেন। আমার হাতের পিঠে অধর ছুঁয়ে বললেন, –” এখন যা হবে, ভালো হবে। তুমি পাশে আছো, সবকিছু ঠিক থাকবে।”
–” আমরা কোথায় যাচ্ছি?
–” আমাদের সংসার সাজাতে।”
–” ভাইয়া ভাবী আমাদের কথা জানেন?”
–” জানে। ভাবীর কাছে যাবে?”
–” এত দূরে গিয়ে কি করব। এমনিতেই জার্নি করে এসেছি। অন্য একদিন যাবো।”
–” ভাইয়ার বাসা পরিবর্তন করে ফেলেছেন। তোমার বাবা বাধ্য করেছে বাসা পরিবর্তন করতে। এখন আমাদের আশেপাশেই থাকবে। চলো আগে ভাইয়াদের বাড়িতে যাই।”
বাবার কথা শুনে চমকে গেলাম। আমাদের চৌধুরী পরিবারের মানুষদের ক্ষমতা সম্পর্কে অজানা নই। একজন মানুষকে একদম পথে নামাতেও দ্বিতীয়বার ভাববে না। তারমানে এই এক মাসে আমার অনুপস্থিতিতে অনেক কিছুই ঘটেছে। ভেবে নিলাম ভাবীকে জিজ্ঞেস করব।
–” তুমি কী আমাকে ভয় পাচ্ছো, মায়া?”
–” আপনাকে ভয় পাবো কেন? আপনি থাকলে তো আরো সুখ খুঁজে পাই। আমার কাছে মনে হয় আমিই পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ।”
–” আমি তোমাকে সত্যিই খুব ভালোবাসি মায়া। এই একমাস আমার অনেক কষ্টে কে’টে’ছে। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলে মনে পড়েছে, একটা ছোট্ট বউকে রেখে এসেছি অদূরে। যাকে ছুঁয়ে দেওয়ার তীব্র বাসনা জাগতো মনে। এখন আর কোনো ভয় নেই না আছে কোনো সংশয় তুমি পাশে আছো আর কি চাই।”
উনার কাঁধে মাথা রাখলাম। মনে মনে বললাম, ‘
আমার দেখা চিরসুখী মানব আপনি। যে কিনা তার ছোট্ট বউয়ের জন্য পাগল।’
———
কোনাবাড়ি থেকে বিশ মিনিটের পথ পেরোতেই রিকশা থেমে গেলো। যাবির ভাইয়া নামলেন আমাকেও নামতে সাহায্য করলেন। দীর্ঘ এক মাস পর এত যত্ন পেয়ে নিজেকে কেমন ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে। উনি এক হাতে আমাকে ধরেছেন। অন্য হাতে বড়ো ব্যাগ ধরে রেখেছেন। আমরা যেই পথে হাঁটছি তার দুই পাশের ডোবা মাঝখানের রাস্তা। ভাবছি, এমন বাড়িতে ভাবী থাকেন। দুতলা বিশিষ্ট একটি বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। উনি ভাবী বলে দুইবার হাঁক ছাড়লেন। ভেতর থেকে ভাবি আসছি বলে ছুটে আসেন।
আমাকে দেখামাত্রই গেট খুলে পরম যত্নে জড়িয়ে ধরেন। বলা হয়নি, ভাবির কোন সন্তান নেই। বিয়ের আজ দশ বছর পার হয়েছে কিন্তু উনাদের কোন সন্তানাদি হয়নি। আমার মনে অনেক প্রশ্ন। এই যেমন, দীর্ঘ একমাস যে আমি শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম ভাবী আর ভাইয়া কেন সেখানে যায়নি? আমাদের বিয়ের কথা শুনে কেনো কোনো প্রতিক্রিয়া করেনি? ভাবী আমাকে ধরে ঘরে নিয়ে বসালেন।আমার কপালে চুমু দিয়ে বললেন, –” অনেক প্রতীক্ষার পর পেয়েছে তোমাকে সে। আমি দেখেছি তার ছটফটে ভাব। আমি দেখেছি তার অস্থিরতা। আমি দেখেছি তার নির্ঘুমে থাকা প্রতিটা রজনী। কষ্ট পেয়ো না, সে সত্যিই তোমাকে খুব ভালবাসে। তার উপর ভরসা রাখো, একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
–” আমিও তাকে খুব ভালোবাসি, ভাবী।এভাবে বলবেন না আমার কষ্ট হয়।”
যাবির ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করলেন। মুখে মিষ্টি হাসি। আমি বারবার ঘায়েল হয়ে যাই এই হাসিতে। কী আছে সেই হাসিতে, উনার হাসি দেখলে মনে হয় উনি পৃথিবীতে একমাত্র সুখী মানুষ, কেননা আমি তার পাশে আছি।
–” ভাবী ক্ষুধা লেগেছে। খাবার দাও। তোমার এই জা কে খাইয়ে মোটা বানাও। এমনি তো বয়সে বাচ্চা, তারুপর শরীরের হাড্ডি ছাড়া কিছুই নেই। এখন আরো বাচ্চার দেখা যায়।”
–” বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করেছেন কেনো শুনি? তাও আবার সকলকে না জানিয়ে। তার উপর বাসর তো!”
–” আল্লাহর ওয়াস্তে ভাবি চুপ যাও। এমনি আমার বাচ্চা বউ। কিছু বুঝে না। অবুঝ বাচ্চাটাকে আর পাকা বানিও না।”
ভাবী দেবরের কথা শুনে হাসছি। যাবির ভাইয়া আবারো কোথায় চলে গেলেন এবার আমি ভাবীর দিকে ফিরে বসলাম। ভাবীর হাতে হাত রেখে বললাম, –” সেখান থেকে চলে এসেছে কেনো ভাবী? কি হয়েছিল সেখানে? আমার অবর্তমানে বাবারা কী করেছিল?”
ভাবীর হাসিমাখা মুখ নিমিষে মলিন হয়ে গেলো। লম্বা নিশ্বাস ত্যাগ করে ভাবী বলতে শুরু করলেন পূর্বের সেই কথা, –” তোমাদের চলে যাওয়ার ঠিক আধা ঘণ্টা পর যাবার আমাকে ফোন করে বলে, আসল কাহিনী। আমি তখন বিশ্বাস করিনি। যাবির এটাও বলে যেন কাউকে না জানাই। আমি কথা রেখেছি। কাউকে জানাইনি, বুঝতেও দেইনি যে আমি জানি সবকিছু। সময় তখন সন্ধ্যার লগ্ন, হঠাৎ আমাদের ঘরের দরজায় কেউ কাড়াঘাত করে। দরজা খুলে বের হয়ে দেখি তোমার বাবা এবং তোমার মা এসেছেন। তোমার বড়ো মা অদূরে দাঁড়িয়ে মুখে ওড়না চেপে কান্না করছেন। তোমার মা এসে চিৎকার করে আমাকে জিজ্ঞেস করেন, –” আমার মেয়েকে কী করেছিস তুই বল? তোর সেই দেবর কোথায়? আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় গেছে?”
আমি প্রত্যুওরে বলেছিলাম, –” আমরা কিছুই জানিনা।”
আমার কথা উনারা বিশ্বাস করেনি। আমার ঘরে এসে কিছু জিনিস ভা’ঙ’চু’র করে তারপর চলে যান। তোমার বাবা-মা যেতেই তোমার বড়ো মা আমার কাছে আসেন। হাত ধরে বলেন অনুনয়ের স্বরে বলেন, –” এত বছর পর একটু সুখের মুখ দেখেছিলাম। মেয়েটা আবারো আমাকে অভাগী করে চলে গেলো। বলো না কোথায় আমার মেয়ে? আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। আমার মেয়েটাকে ছাড়া দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার মেয়ে ভালো আছে তো?”
বিশ্বাস করো মায়া! আমার তখন কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। একজন মায়ের কান্না আমি সহ্য করতে পারিনি। তবুও বুকে পাথর জমিয়ে চুপ করে ছিলাম। আমি জানি তুমি যাবিরের সাথে ভালো থাকবে এবং তোমার মা যা করতে চেয়েছিল তাদের অন্যায় ছিল।
পরের দিনের ঘটনা, তোমার চাচারা এবং কিছু নেতারা আসে। আমাদের বাসায় এসে হু’ম’কি দিয়ে যায় যে, যদি তোমাদের কথা না বলি তাহলে আমাদের মুখে কালি মাখিয়ে রাস্তায় ঘোরাবে। আমরা তখন খুব ভয় পেয়ে যাই। আমি এবং তোমার ভাইয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে বাড়ি পরিবর্তন করার। সেদিন যাবির রাতের অন্ধকারে আমাদের বাসায় আসে এবং তার কাছে সমস্ত ঘটনা খুলে বলি। যাবিরের সিদ্ধান্তেই বাড়ি পরিবর্তন করে এখানে চলে আসি।”
ভাবীর কথা শেষ হতেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম।
আমি জানি বড়ো মা ভালো নেই। এখন নিশ্চয়ই মা এই সুযোগে বড়ো মার সাথে আরো খারাপ আচরণ করে। বাবাও হয়তো পরিবর্তন হয়ে গেছে বড়ো মাকে দোষারোপ করে।
সন্ধ্যা হতেই ভাবীকে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে আসলাম। বাতাস বইছে, গাছের পাতাগুলো হেলেদুলে খেলা করছে। আজ তো আমার মন ভালো কিন্তু প্রকৃতি কেনো মন খারাপ? বুঝতে পারলাম না। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে যাবির ভাইয়া চান না আমরা ভাইয়াদের সাথে থাকি। উনি চান আমরা আলাদা কোথাও নতুন করে সংসার পাতি। আমিও অমত করিনি। নিজ হাতে সংসার সাজাবো এর মাঝে আনন্দ অনেক।
–” তুমি জানো মায়া, আমরা যেখানে থাকব সেখানে এখন কিছুই নেই। আছে শুধু একটা বালিশ, আরেকটা তোষক আর চাদর।তুমি কি সেই ঘরে আমার সাথে থাকতে পারবে?”
–” অবশ্যই পারব।”
–” দেখো শেষে না অভাবে পড়লে তোমার ভালবাসা দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়।”
উনার কথা শুনে হাসলাম উনার হাত শক্ত করে ধরে বললাম, –” আপনাদের শহরে ফাগুন মাসে পলাশ ফুল ফোটে না? ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় গান গায় না? একটা পলাশ ফুলের চাড়া নিয়ে আসবেন। আমি লাগাবো। সেটা পরিচর্যা করব। যখন ফুল ফুটবে তখন মালা গেঁথে আপনার গলায় পরিয়ে দিব। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে।”
জাবের ভাইয়া হাসলেন। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললেন, –” তোমার চারা পলাশ গাছ বড়ো হতে হতে আমি দশ বাচ্চার বাবা হয়ে যাবো, মায়াবিনী। তখন না হয় আমার ডজনখানেক বাচ্চার সাথে আমাকেও মালা পরিয়ে দিও!”
উনার কথায় লজ্জা পেলাম। উনার বুকে মুখ গুঁজে রইলাম। আমার কাণ্ডে উনি হাসলেন। আমাকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন নিজ নিবাসে।
চলবে……
#ফাগুন_হাওয়ায়_হাওয়ায়
#আফসানা_মিমি
| তেইশ তম পর্ব |
শহরের উঁচু দালানের ভীড়ে আমরা আমাদের ছোট্ট নিবাস গড়েছি। কোনাবাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে কাশিমপুর অবস্থিত। ঢাকা শহরে বসবাসরত একজন শিল্পপতি শখ করে কিছু জমি ক্রয় করেন এবং সেখানে দুটো ঘর বানায় খুব সুন্দর ভাবে কিন্তু মানুষের অভাবে সেখানে জমি,বাড়ি এমনি পড়ে ছিল। যাবির ভাইয়ার এক বন্ধুর আংকেল হোন সেই শিল্পপতি। উনার বন্ধুর সাহায্যে এ বাড়ি আমরা ভাড়া পেয়েছি। বাড়িটা আমার খুব মনে ধরেছে। আমার মনে হচ্ছে এই বাড়িতে আমরা বছরের পর বছর অনায়াসে থেকে যেতে পারবো, কোন ক্লান্তি আসবে না। না আসবে কোনো ভয়। দুই রুম বিশিষ্ট বাড়ির চারপাশে গাছ-গাছালিতে ভরপুর এবং চারপাশে দেয়াল উঁচু করে বাউন্ডারি করা হয়তো জমির সুরক্ষাণার্থে দেয়াল গঠন করা হয়েছে কিন্তু আমাদের জন্য বেশি উপকার হয়েছে। মানুষ থাকবে না, ঝামেলাও থাকবে না।
সন্ধ্যা হতে আর কিছু সময় বাকি। আমি ঘর থেকে বের হয়ে চারপাশ ভালো করে দেখে নিলাম। বাড়ির বাহিরে এক কোণে আরো কিছু স্বল্প জায়গা রয়েছে। মনে মনে ঠিক করে নিলাম এখানে একটি পলাশ ফুলের গাছ লাগাবো এবং গাছটি যখন বড়ো হব তখনই বাড়িটা মালিকের কাছ থেকে কিনে নেব।
আমার ভাবনার মাঝেই যাবির ভাইয়া আমাকে জোরে হাঁক ছাড়েন। উঠোন থেকে ‘আসছি’ বলে আমি দৌড়ে ঘরে চলে যাই।
আমাদের দুটো ঘর পুরো শূন্য, কিছুই নেই। একটা বিছানা, একটা বালিশ আর চাদর রয়েছে। ঘরের আরেক কোণে ছোট্ট টেবিল রয়েছে। যার মধ্যে একগাদা বই-পুস্তক রয়েছে।
যাবির ভাইয়া বিছানার উপর বসে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র নামাচ্ছেন। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন, –” এদিকে আসো তো বউ! হাতে হাতে সাহায্য করো।”
ব্যাগ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে কোথায় রাখবো ভাবছি। পরক্ষণে নজর গেলো জানালার দিকে। ঘরের জানালা আটকানোর পরও কিছু অংশ অবশিষ্ট রয়েছে। সেখানে প্রয়োজনে জিনিসপত্র যেমন: তেল, সাবান, স্নো, পাউডার, কলম ইত্যাদি ছোটখাটো জিনিস রেখে দিলাম। এখন রইলো কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা, সেটা যাবির ভাইয়া করে দিলেন। জানালার গ্রিলের ভাঁজে ভাঁজে একটা একটা করে কাপড় রেখে দিলেন। সবগুলো কাপড় সাজানোর পর দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো দোকানে কাপড় চোপড় বিক্রি করার জন্য সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছি। সবকিছু করতে করতে সন্ধ্যা পাড় হয়ে গেলো। পুরো ঘর সাজানোর পর উনি এসে বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লেন। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে ডাকলেন।
উনার মুখের মধ্যে দুষ্টুমি ভেসে উঠেছে। কাছে গেলাম না। ঘর থেকে বের হয়ে অন্য ঘরে গেলাম।
একটা ঘরে আসবাবপত্র থাকলে ঘরটাকে ছোট মনে হয় কিন্তু আসবাবপত্র ছাড়া শূন্য লাগে। দ্বিতীয় ঘরে এসে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কবে এই ঘর পূর্ণ হবে তাই ভাবছি। আচমকা কেউ পিছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে। খুব ভয় পেয়ে যাই। ঘাড় ঘুরে তাকিয়ে দেখে যাবির ভাইয়া জড়িয়ে ধরে রেখেছেন। আমি সম্মুখে ফিরে তাকালাম। মুখে রাজ্যের লজ্জা। উনি আমার কানে ফিসফিস করে বললেন, — “বউ লজ্জা পেয়েছো?”
আমি চোখ বন্ধ করে উত্তর দিলাম, –” অনেক লজ্জা পেয়েছি।”
–“তোমার লজ্জা আমি ভেঙ্গে দেই?”
–” কীভাবে?”
উনি হাসলেন। আমাকে কোলে করে নিয়ে গেলেন অন্য ঘরে।
আমি নির্বাক দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনার মুখে মিষ্টি হাসি। আমাকে আলতোভাবে বিছানায় শুয়ে কপালে অধর ছুঁয়ে দিলেন। নাকে নাক ঘষে বললেন, –” লজ্জা পাও লজ্জাবতী। তোমার লজ্জায় আমি সুখ খুঁজি। তুমি লাজুকমুখ লজ্জায় রাঙা হয়ে উঠবে, আমি তৃপ্তি ভরে তোমার সেই রাঙা মুখে সুখ খুঁজবো।
সত্যিই উনি আমাকে এমন লজ্জা দিয়েছেন যে লজ্জা ভাঙতে আমার কয়েক শত বছর পাড় করতে হবে। পরের দিন ঘুম ভাঙ্গে মিষ্টি কিছু পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনে। বাড়ির আশেপাশে গাছপালা হওয়ার সুবাদে পাখিদের আবাসস্থল গড়ে উঠেছে সেখানে। উনি এখনো ঘুমোচ্ছেন। আলগোছে উনার পাশ থেকে উঠে দরজা খুললাম। সকালের শীতল বাতাস শরীর ভেদ করে ঘরে প্রবেশ করলো। আমি মিষ্টি হাসি হাসলাম। এক সেট জামা নিয়ে কল পাড়ের দিকে রওনা হলাম।
সকাল হয়েছে ঘন্টা দুয়েক আগে কিন্তু খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। উনি এখনো ঘুমাচ্ছেন। এদিকে আমি ক্ষুধার তাড়নায় ছটফট করছি। এমন না যে নিজে রান্না পারি। বড়ো মা কখনোই আমাকে রান্না শেখায়নি। শ্বশুরবাড়িতে যতদিন থেকেছি কা’টা’কু’টি করেছি। রন্ধন কাজে শাশুড়ি মা এবং চাচী শাশুড়ি ছিলেন।
কথিত আছে,” ক্ষুধা মানে না পান্তা ভাত, প্রেম মানে না জাত বেজাত।”
বারান্দায় ছোট্ট একটা রুম রয়েছে। যেখানে রান্না করার কিছু পাতিল রয়েছে। কয়েকটা পাতিল ঢাকনা দিয়ে ঢাকা ছিল। ঢাকনা উঠিয়েও কিছু পেলাম না। হতাশা হয়ে পুরো ঘরের আশপাশের তাকালাম। না কিছু নেই। কি যে করি! ক্ষুধার তাড়নায় ম’রে যাচ্ছি
শেষে আর ধৈর্য ধরতে পারলাম না। উনার পাশে বসে আস্তে করে ডাকলাম। উনি হু হা করে উত্তর দিয়ে ঘুম ঘুম চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি অসহায় চোখে উনাকে বললাম, –” খুব ক্ষুধা পেয়েছে। ঘরে কিছু নেই। বাজার করবেন না?”
উনি লাফিয়ে উঠলেন বিছানা থেকে। ঘড়ি বের করে সময় দেখে নিলেন। এরপর আমাকে তাগাদা দিলেন গামছা এবং ট্রাউজার নিয়ে আসার জন্য।
কলপাড়ে কল চেপে দিচ্ছি। পানি জমা হচ্ছে একটি স্টিলের বালতিতে। যাবির ভাইয়া সেই পানি দিয়ে গোসল করছেন। বিগত এক মাসে কল চাপা শিখে গিয়েছি। এখন আর তেমন কঠিন কাজ মনে হয় না। বর্তমানে নিজেকে অনেক সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। একজন স্বামীর সেবা করাই তো একজন স্ত্রীর কর্তব্য। উনি গোসল করছেন আবার কিছুক্ষণ পর পর এটা সেটা বলে আমাকে লজ্জায় ফেলছেন। আমিও লজ্জায় লাল হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। হঠাৎ উনি একটা কাণ্ড করে বসলেন। মায়া বলে আমাকে তাকাতে বলে, আমার দিকে পানি ছুঁড়ে মারতে শুরু করেন। আমি হাসছি। উনার কান্ডে হাসতে হাসতে পিছনে চলে যাচ্ছি।
–” আমি গোসল করেছি। এইভাবে ভিজাবেন না।”
পানির ঝাপটা থেকে বাঁচতে দুই হাত সামনে এনে রেখেছি। পরপর উনার লাজুক কথায় লজ্জা পাই, –” তোমাকে তো আমার রঙে অনেক রাঙিয়েছি। এবার না হয় প্রকৃতির পানি দিয়ে ভিজাই!”
–” ইস মুখে কিছু বাঁধে না। তাড়াতাড়ি যান বাজার করে নিয়ে আসেন। আমার ক্ষুধা পেয়েছে।”
গোসলকার্য সেরে একটা পাঞ্জাবি পড়ে উনি চলে গেলেন বাজার করতে। আমিও ওড়না কোমড়ে গুঁজে বিছানা ঠিক করতে লেগে পরলাম। একটা ঝাড়ু দিয়ে পুরো বাড়ি ঝাড়ু দিয়ে বাহিরে লতা পাতা পরিস্কার করে ফেললাম।
প্রায় আধা ঘন্টা পর উনি আসেন। আমাকে এক প্রকার টেনে ঘরে নিয়ে যান।
–” বউ, দেখি তো হা করো?”
গরম গরম রুটি এবং ডাল ভাজি। উনি পরম যত্নে আমাকে খাইয়ে দিচ্ছেন হঠাৎ আমার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে শুরু করলো। উনি খাওয়ানো বাদ দিয়ে বিচলিত হয়ে আমার আমার গালে হাত রাখলেন, –” কি হয়েছে আমার মায়াবিনীর? ব্যথা করছে? অসুখ বেঁধেছে? খারাপ লাগছে? কষ্ট হচ্ছে? কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
উনার কথার প্রত্যুত্তরে ভাঙ্গা গলায় উত্তর দিলাম, –” আমি বাবা,বড়ো মাকে দেখব। আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আমি তাদের সাথে একটু কথা বলে চলে আসব।”
উনি চমকালেন, থমকালেন। রুটির টুকরো হাত থেকে খসে পড়ে গেল নিচে। আমি কান্না করেই যাচ্ছি অনেক। উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইলেন। অবশেষে মুখ খুলে বললেন, –” সেখানে গেলে তোমার কষ্ট আরো বাড়বে। তুমি কি পারবে সহ্য করতে?”
–” আমার বাবা এবং বড়ো মা আমাকে খুব ভালোবাসে। দেখবেন আমরা যদি উনাদের সামনে গিয়ে দাঁড়াই, তাহলে ওনারা আমাদের মেনে নেবেন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। বিশ্বাস করুন উনাদের ছাড়া আমার নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে।”
থেমে থেমে কান্না করছি। হঠাৎ উনার একটা কথা শুনে আমার কান্না থেমে যায়।
–” তুমি কি আমায় ছেড়ে চলে যাবে, মায়া?”
চলবে……..