তপোবনে যখন সন্ধ্যা নামে,পর্ব-০২

0
1136

তপোবনে যখন সন্ধ্যা নামে
লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

|২|

খাবার টেবিলের মাঝ বরাবর একটি অদ্ভুতদর্শন লন্ঠন রাখা হয়েছে। লন্ঠনটা পিতলের। চিমনির উপর কালির ম্লান আস্তরণ ভৃত্যের আপন কর্তব্যের প্রতি উদাসীনতার প্রমাণ দিচ্ছে। খাবার ঘরের আরও দুটো জায়গায় টিমটিম করে জ্বলছে দুটি হারিকেন। বিস্তীর্ণ হলঘরের গাঢ় অন্ধকার তিন তিনটে হারিকেনেও ম্লান হচ্ছে না। তার বদলে হয়ে উঠেছে গা ছমছমে প্রেত নিবাস। তপু লন্ঠনের উপর ঝুঁকে ভ্রু কুঁচকালো। নাকের উপর থেকে চশমাটা ঠেলে দিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে পড়লো,

‘ C-r-a-i-g W-a-t-a-n-a-b-e. Craig Watanabe! বড়ো মামা? এই পিতলের নকশার আড়ালে যে
ক্রেগ ওয়াতানাবে নামে এক ব্যক্তির নাম লেখা আছে খেয়াল করেছো? কে এই ক্রেগ ওয়াতানাবে?’

বড়ো মামা রেডিও-তে লাইন ধরার চেষ্টা করছিলেন। তপুর কথায় চশমার উপর দিয়ে ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। রেডিও-টা পাশে রেখে হাত বাড়িয়ে বললেন,

‘ তাই নাকি? দে তো দেখি।’

তপু লন্ঠনটা এগিয়ে দিলো। বাহাদুর মিতুর পাতে এক টুকরো মাছ তুলে দিয়ে তটস্থ দৃষ্টিতে লন্ঠনের দিকে ঝুঁকলো। যদিও সে ইংরেজি শব্দ খুব একটা পড়তে পারে না। তথাপি মুখটাকে গম্ভীর করে রাখলো। রুহুল আমিন লন্ঠনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলেন। কপালের উপর গাম্ভীর্যের পুরু ছাপ ফেলে নকশার আড়ালে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে আসা নামটা পড়লেন। অতঃপর লন্ঠনটা যথাস্থানে নামিয়ে রেখে বললেন,

‘ আগে কখনো খেয়াল করিনি নামটা। হয়তো আগে যারা এখানে থাকতো তাদের কারো নাম। নিঁখুত নকশা দেখেই উপলব্ধি হয় খুব প্রাচীন জিনিস এটা।’

তপু অবাক হয়ে বলল,

‘ এই গহীন জঙ্গলে তোমার আগেও কোনো ইংরেজের বাস ছিলো? ইংরেজদের এতো বুকের পাটা?’

‘ ব্রিটিশ আমলের সময় ইংরেজ সাহেবদের এদিকে শিকারে আসাটা অসম্ভব কিছু না। এদিকের জঙ্গলে তখন বাঘও পাওয়া যেতো। নীল গরু, বুনো মোষ, হাতি, শুয়োর, বিভিন্ন প্রজাতির হরিণের বাহার ছিলো। বাঙালিদের থেকে ইংরেজরা শিকার প্রিয় জাতি। শিকারের জন্যই বোধহয় এই বাঙলো তৈরি করেছিলো। নয়তো এতো বছর আগে কোন ভিতু বাঙালি এই অরণ্যে ঘর বাঁধতে আসবে? বাঙালি সুপুত্ররা ঘরে বসে সাহিত্য উদ্ধারে মন দিতে বেশি আগ্রহী। তাদের কোমল শরীরে বনে-বাদাড়ে ঘুরেফিরে পশু শিকার সইবে না।’

বাইরে ঝড় হচ্ছে। অর্জুন, সেগুন গাছের কান্ডগুলো ভয়ঙ্কর দানবীয় থাবার মতো আছড়ে পড়ছে জানালের কাঁচে। কাছে কোথাও বুনো শুকরের তীক্ষ্ণ চিৎকার ভেসে আসছে। আষাঢ়ে মেঘের গুরুগুরু ধ্বনির মাঝে থেকে থেকেই আর্তনাদ করে উঠছে তীব্র বজ্রপাতের শব্দ। ক্ষণে ক্ষণে মনে হচ্ছে এই বুঝি কেঁপে উঠলো জমিন। ভয়ঙ্করদর্শন কোনো প্রাণী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অথবা বিষণ্ণ প্রলয়ে ধ্বংস হয়ে গেলো গোটা জঙ্গল। তীক্ষ্ণ এক বিদ্যুৎস্ফুরণের পর পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের হৃদয় কাঁপিয়ে পতিত হলো এক বজ্রপাত। সেই বজ্রপাতের আতঙ্কেই যেন গাছের ডগায় অশুভ প্রেতের নৃত্য জুড়লো। বনের সকল পশু এক যুগে চেঁচিয়ে উঠলো একবার। পশুপাখির নিদারুণ চিৎকারে যখন কান চাপা দেওয়ার জোগার ঠিক সেই সময় কোনো এক গাছের শক্ত কান্ডের আঘাতে ভেঙে গেল দক্ষিণা জানালার কাচ। হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকলো ঠান্ডা, শীতল হাওয়া। উপস্থিত সবাই যেন চমকে উঠলো। তপু ভাঙা জানালার নিশ্চিন্হ অন্ধকারের দিকে চেয়ে চশমা ঠিক করলো। লন্ঠনের আলোটা বার কয়েক দাপাদাপি করে নিভে গিয়েই প্রাণ জুড়ালো। সেই অল্প খানেক সময়েই আগের অস্বস্তিটা আবারও টের পেলো তপু। বুকের ভেতরটা অযথায় ধরাস করে উঠলো তার। ভাঙা জানালার নিরবিচ্ছিন্ন অন্ধকারে মানুষের মতোই অদ্ভুত এক অবয়ব দেখলো ক্ষণিকের জন্য। সত্যিই দেখলো? কী ছিলো ওটা? ততক্ষণে আবারও আলো জ্বেলেছে বাহাদুর। খাবারের টেবিলের থেমে যাওয়া আলোচনা আবারও প্রাণ ফিরে পেয়েছে।

‘ এমন একটা অদ্ভুতুরে জায়গা তুমি কী করে খুঁজে পেলে বলো তো বড়ো মামা? চারপাশে কেমন রহস্য রহস্য ভাব। আসার সময় “ডেঞ্জার জোন” এর সাইনবোর্ড দেখেছি। সিভিলিয়ানদের এই গহীন অরন্যে আসার অনুমতি থাকার কথা নয়। তবে?’

মিতুর প্রশ্নে থেমে থাকা আলোচনায় হাওয়া দিলেন রুহুল আমিন। গর্ব ভরা হাসি হেসে বললেন,

‘ তোর বড়ো মামাকে তুই বোধহয় একটু বেশিই আন্ডারেস্টিমেট করে ফেলছিস মিতু। ব্যাড! ভেরি ব্যাড! আমি যখন এই জায়গাটার খোঁজ পাই তখন ১৯৯৭ সাল। তখন আমি এখানে কর্মরত। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি চুক্তির আলোচনা বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। বিদ্রোহীদের অত্যাচারে প্রায় অতিষ্ঠ হয়েই সরকার আমাদের অপারেশনে পাঠালো। অপারেশন হবে গহীন জঙ্গলে। আমি ছিলাম অপারেশন ইনচার্জ। খবর পেয়েছিলাম জঙ্গলে বিদ্রোহীরা দল ভারী করছে। হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তো হলো কী? বিদ্রোহীরা কীভাবে যেন আমাদের অপারেশনের ব্যাপারটা জেনে গেল। যেখানে আমরা গিয়েছিলাম শুধুমাত্র অস্ত্র উদ্ধার আর তদন্তের জন্য সেখানে হঠাৎই গুলি-পাল্টা গুলি শুরু হয়ে গেল। আমাদের দলে মাত্র দশ জন আর্মি অফিসার। অপরদিকে বিদ্রোহীরা সব পাহাড়ী। পাহাড়ের কোণা কোণা তাদের নখদর্পনে। তারা একরকম অদৃশ্য হয়ে গুলি ছুঁড়ছে। আমাদের জন্য লক্ষ্য স্থির করা মুশকিল। আমাদের সেই অপারেশনে দশজনের মাঝে চার জন আর্মি অফিসার গুলি খেলেন। দু’জন ডিরেক্ট খতম। সরকার তখন উন্মাদ প্রায়। এতোগুলো আর্মি অফিসার আহত। সর্বনাশ! সরকারের হুকুমে আমরা হিউজ ফৌজ নিয়ে দ্বিতীয় অপারেশনে নামলাম। সেই অপারেশনে আর্মি অফিসারদের উপর অর্ডার এলো, “সার্চ দ্য হোল জঙ্গল।” তখন বোধ করি এপ্রিল-মে মাস চলছে। অপারেশনের লাস্ট ডে তে আমরা এই বাড়িটা খুঁজে পেলাম। পরিত্যক্ত বাড়ি। মালিকানার ঠিকঠিকানা নেই। এমন গহীন জঙ্গলে বাড়িটা খুব পছন্দ হয়ে গেল। সারাজীবন পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে শেষ বয়সে এমন একটা নিরিবিলি জায়গায় থাকার ব্যবস্থা খারাপ হবে না ভেবে ২০০৪ সালের দিকে সরকারের কাছ থেকে বাড়িটা কিনে নিলাম। তখন এখানে ডেঞ্জার জোনের সাইনবোর্ড ছিল না। মানুষের বসতি ছিল আরও কম। এদিকে আসার কথা বোধহয় কেউ স্বপ্নেও ভাবতো না।’

মিতু মাথা নাড়লো। তার অসামান্য রূপের দ্যুতি ঝিলিক দিয়ে উঠলো লন্ঠনের হলদে আলোয়। তপুর মাথা ভর্তি ঝাঁকড়া চুল। লন্ঠনের আলোয় সে চুলগুলোকে লাগছে আষাঢ়ে মেঘের মতো। যেন এক ঝাঁক মেঘ মাথায় চেপে নিশ্চিন্তে বসে আছে শ্যামরঙা দেবশিশু। তপু ভারী চশমাটা নাকের উপর ঠেলে দিয়ে বলল,

‘ ওসব গাছ-গাছালি নিয়ে না লিখে; এখানে বসে একটা দূর্দান্ত ভ্যাম্পায়ার সিরিজ লিখে ফেলতে পারিস আপা। বাড়িটার সাথে একদম মিলে যায়। মনে হয়, এই বুঝি রক্তচোষা ভ্যাম্পায়ার লাফিয়ে পড়ল কাঁধে। মুহিব ভাই থাকলে বেশ হতো। মুহিব ভাই মানেই এডভেঞ্চার।’

মুহিবের নাম শুনেই বিতৃষ্ণ চোখে চাইলো মিতু। সফেদ ফর্সা মুখটিতে মুহূর্তেই বাইরের দানবীয় অন্ধকার এসে ভর করলো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে বললো,

‘ খাল কেটে কুমির আনার চিন্তা! তোকে বলেছি না? উনার মতো ফালতু, আনসিভিলাইজড লোকের সাথে কথা বলবি না?’

তপু কাঁধ ঝাঁকালো। চশমাটা আবারও ঠিক করে নিয়ে আড়চোখে মিতুর দিকে চাইলো। এই মুহূর্তে মিতুর কথাকে পাত্তা না দিলেও চলে বুঝতে পেরে বললো,

‘ মুহিব ভাই মোটেও এসব অদ্ভুত ওয়ার্ড ডিজার্ভ করে না। হি ইজ আ মিসটোরিয়াস পার্সোন। দূর্দান্ত! তুমি শুধু শুধু তাকে নিয়ে বাজে কথা বলবে না।’

মিতুর শান্ত আচরণে ধীরে ধীরে ক্রোধের বিস্তার হলো। গরম চোখে ভাইয়ের দিকে চাইলো। মিতু কয়েক মাস ধরে ঔষধি উদ্ভিদ নিয়ে গবেষণা করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমানে ঔষধি উদ্ভিদের মজুদ কেমন, কতক বিলুপ্তির পথে পা বাড়িয়েছে সে নিয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদনের জন্যই বড়ো মামার কাছে আসা। এই প্রতিবেদন লেখার জন্য মিতুকে শতভাগ মনোযোগী হতে হবে। শান্ত থাকতে হবে। এই মুহূর্তে মুহিবকে সে কোনোভাবেই বরদাস্ত করতে পারবে না। তপু যদিও তাকে বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিলো না। আপার শাসানি সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বড়ো মামার দিকে চাইলো। ভারী উৎসাহ নিয়ে বললো,

‘ বড় মামা? তুমি কী মুহিব ভাইকে খবর দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা করে দিতে পারো?’

রুহুল আমিন রসিক মানুষ। ভাগ্নে-ভাগ্নীর বিবাদটা তিনি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখলেন। ভ্রু কুঁচকে একটু চিন্তা করে বললেন,

‘ মুহিব! নামটা পরিচিত। কোথায় শুনেছি বল তো?’

বড়ো মামার কন্ঠে আগ্রহের আভাস পেয়ে হতাশ চোখে চাইলো মিতু। বিরক্তিতে হাসফাস করে উঠলো ফুসফুস। মুহিবের নামটা শুনলেই তার এমন বোধ হয়। রাগে, বিরক্তিতে দমবন্ধ হয়ে আসতে চায়। অথচ তপু মুহিব অন্তঃপ্রাণ। মুহিবকে পেলে দিন-দুনিয়া ভুলে যেতেও প্রস্তুত। মুহিবের মাঝে এই আকর্ষণ ক্ষমতাটাই সবচেয়ে বেশি বিরক্ত লাগে মিতুর। বিরক্ত হতে হতে কেঁদে ফেলতে ইচ্ছে হয়। মিতুর মুখটা গাঢ় অন্ধকারে ডুবে গেলেও চকচক করে উঠলো তপুর কৌতুহলী দৃষ্টি। আকাশসম আগ্রহ নিয়ে বললো,

‘ মুহিব ভাই হলো রুদ্র ভাইয়ার বন্ধু। তুমি বোধহয় দেখেছিলে। লম্বামতোন দেখতে। ভীষণ ইন্টেলিজেন্ট।’

বড় মামা ভ্রু বাঁকিয়ে বললেন,

‘ তাই নাকি? তবে তো সাক্ষাৎ করা অনিবার্য! এতো ইন্টেলিজেন্ট অথচ আমার দৃষ্টিতে পড়লো না? আশ্চর্য!’

তপু খুশি হয়ে বলল,

‘ সত্যি তুমি দেখা করবে? সত্যি? তাহলে আমি কাল সকালেই মুহিব ভাইকে টেলিফোন করবো। এমন গহীন জঙ্গলে থাকার কথা শুনলে নিশ্চয় রাজি হবেন।’

বড় মামা হাসলেন। ততক্ষণে রেডিও সিগন্যাল পেয়েছে। রেডিওতে অদ্ভুত গরগর শব্দ হচ্ছে। বড়ো মামা সুইচ টিপে রেডিওটা বন্ধ করে দিলেন। আগ্রহী তপুর দিকে চেয়ে বললেন,

‘ এখানে নেটওয়ার্ক পাওয়া অনেকটা অমাবস্যার চাঁদ পাওয়ার মতো। এখান থেকে টেলিফোনের লাইন পাওয়া যাবে না। কাল আমি শহরে যাব। সেখান থেকে যোগাযোগ করা যাবে। সাথে চল। আই এ্যাম ইন্টারেস্টেড এবাউট মুহিব।’

তপু খুশিতে ঝলমল করে উঠল। এবার মুহিব ভাইকে টেলিফোনে পাওয়া গেলেই হলো!

________________

ঘরটা ঝাপসা অন্ধকার। তার থেকেও অন্ধকার রুদ্রর মুখ। ফর্সা টকটকে মুখটিতে প্রগাঢ় বেদনার ছায়া। রুদ্রর ঠিক সামনে বিশাল পর্দায় ঝুলছে আরও একটি গম্ভীর, বেদনার্ত মূর্তি।

‘ তোমার সমস্যা কী?’

মূর্তিটির মেঘমন্দ্র কন্ঠে গমগম করে উঠলো অন্ধকার ঘর। রুদ্র উত্তর দিলো না। ভীষণ ক্ষোভে অন্যদিকে মুখ ঘুরালো। চোখে-মুখে ক্ষ্যাপাটে ক্রোধ। শিকদার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কিছুটা নরম হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

‘ আমি তোমাকে কিছু জিগ্যেস করেছি রুদ্র।’

শৈশবের অভ্যাসবশত জন্মদাতার সাথে বেয়াদবি করার সাহস করলো না রুদ্র। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,

‘ কোনো সমস্যা নেই।’

‘ কোনো সমস্যা না থাকলে বারবার পালানোর চেষ্টা করছো কেন?’

রুদ্র উত্তর দিলো না। এই একই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে ক্লান্ত। নতুন করে উত্তর দেওয়ার কোনো মানে হয় না। রেদোয়ান ছেলের বেপরোয়া মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। অবিকল তার মায়ের মতো চেহেরা পেয়েছে ছেলেটা। টকটকে গৌড় বর্ণ। সুডৌল বাহু। আধুনিকতার ছাঁচে ঢালা সাজপোশাক। এমন চোখ জোড়ানো, ঈর্ষা জাগানো সৌন্দর্য তো পুরুষ মানুষের থাকতে নেই। শিকদার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,

‘ তুমি জানো আমি তোমার ভালোর জন্যই…..’

শিকদার সাহেবের কথার মাঝেই ক্ষোভ ঝরা কন্ঠে উত্তর করলো রুদ্র,

‘ আমি এমন ভালো চাইছি না বাবা। লেট মি ফ্রী। গিভ মি ফ্রীডম! প্লিজ!’

একমাত্র ছেলের দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বরাবরের মতো একই প্রস্তাব রাখলেন শিকদার সাহেব,

‘ তবে কানাডায় ফিরে এসো। অথবা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যাও। আই প্রমিজ, আই উইল গিভ ইউ ফ্রিডম! এই দেশে তুমি সুরক্ষিত নও।’

রুদ্র রোখ চেপে বসে রইলো। চুপ করে রইলেন শিকদার সাহেবও। মুগ্ধ দৃষ্টিতে ছেলের অনিন্দ্য সুন্দর মুখটির দিকে চেয়ে রইলেন। আপাতত এই পৃথিবীতে এই ছেলেটি ছাড়া আর কোনো অংশ নেই তার। পরিবার যে বুকের খুব কাছের একটা শব্দ, তা উপলব্ধি করতে বড়ো দেরী করে ফেলেছিলেন শিকদার সাহেব। দেশে-বিদেশে ব্যবসা ছড়াতে ছড়াতে ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, পরিবার থেকে যে কতটা দূরে সরে গিয়েছেন তা বুঝতে পেরেছেন কন্যা ও স্ত্রী মৃত্যুর সিঁড়ি পাড় করে যাওয়ার পর। ছেলেটাও তখন দূরের মানুষ। নৌ-বাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সার্টিফিকেটে বাবার নামটা মিটিয়ে দেওয়া ব্যতীত আর সব সম্পর্কই যেন চুকিয়ে দিয়েছে। তবুও শিকদার সাহেব স্বস্তি পেয়েছিলেন। একমাত্র ছেলে মৃত্যু ফাঁদ থেকে বহু দূরে সাগরে-মহাসাগরে ঘুরে বেড়াচ্ছে জেনেই চিন্তা মুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বাঁধলো এক গন্ডগোল। লেফট্যানেন্ট কমান্ডার পদে উন্নতি হয়েই আচমকা চাকরিটা ছেড়ে দিলো রুদ্র। তারপর অদৃশ্য হয়ে গেলো হাওয়ার মতো। শিকদার সাহেব পুরো পৃথিবী ছেঁকে ফেলেও ছেলের দেখা পেলেন না। গোটা পাঁচ বছর সন্ধান চালিয়ে যাওয়ার পর তাকে পাওয়া গেলো ঢাকার এক ক্যাসিনোতে। দিনে-দুপুরে ক্যাসিনোতে বসে ড্রাগ নিচ্ছিলো রুদ্র। সেখান থেকে একরকম তুলে এনেছে শিকদার সাহেবের লোক। ছেলের এমন অধঃপতনে আশ্চর্য হয়েছিলেন শিকদার সাহেব। ছেলেকে চোখে চোখে রেখে বুঝেছেন, ড্রাগস্ বা মদ কোনো কিছুর প্রতিই তেমন আসক্তি নেই রুদ্রর। তার একমাত্র আসক্তি হলো পালিয়ে যাওয়া। শিকদার সাহেব বুঝে পান না, তার এতো ঐশ্বর্য, এতো প্রতিপত্তি ফেলে কোথায় পালাতে চায় তার ছেলে? শিকদার সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শান্ত কন্ঠে বললেন,

‘ ওই দেশে মৃত্যু ছাড়া আর কিছু পাবে না তুমি। ফিরে এসো, স্বাধীনতা পাবে। আর যদি সেখানেই থাকতে চাও তাহলে আজীবন এভাবেই থাকতে হবে। সিদ্ধান্তটা তোমার।’

রুদ্র আগের মতোই বেপরোয়াভাবে বসে রইলো। শিকদার সাহেবের কোনো কথায় তার কর্ণগোচর হলো বলে মনে হলো না। শিকদার সাহেব ছেলের বেপরোয়া আচরণে মনে মনে হতাশ হলেন। কিয়ৎক্ষণ শক্ত চোখে ছেলের দিকে চেয়ে থেকে মারিয়ার দিকে চাইলেন। পাথরের মতো কঠিন কন্ঠে নির্দেশ দিলেন,

‘ টেইক কেয়ার অফ হিম মারিয়া। ডোন্ট গিভ হিম আ সিঙ্গেল চান্স টু এস্কেপ।’

রুদ্রর পাশে স্টিলের মতো দাঁড়িয়ে থাকা মারিয়া প্রফেশনাল কন্ঠে বললো,

‘ ইয়েস স্যার।’

টেলিভিশনের আলো নিভে গেল। রুদ্র আগের মতোই বেপরোয়া ভঙ্গিতে বসে রইলো। বেশ কিছুক্ষণ শান্ত হয়ে বসে থেকে, ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি এঁটে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো। দু’চোখে ক্ষ্যাপাটে দৃষ্টি, তাচ্ছিল্য। এই বাবা নামক মানুষটিকে সে থোরাই কেয়ার করে, হুহ! তাচ্ছিল্যের হাসিটা আকর্ণ বিস্তৃত হতেই রুদ্রর উপলব্ধি হলো, মারিয়া তার পিছু হাঁটছে। রুদ্র অসম্ভব ক্রোধ আর বিরক্তি নিয়ে পেছনে ফিরলো। শক্ত কন্ঠে বললো,

‘ কী সমস্যা? কোথায় যাচ্ছো?’

মারিয়া উত্তর দিল না। অর্থাৎ, রুদ্রের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না। রুদ্রর রাগ এবার আকাশ ছুঁলো। বিরক্তিতে বুক ব্যথা হয়ে এলো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

‘ ওয়াশরুমে যাচ্ছি। যাবে?’

মারিয়া বিন্দুমাত্র অপ্রস্তুত হলো না। পাথরের মূর্তির মতো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে যান্ত্রিক কন্ঠে বলল,

‘ সরি স্যার।’

রুদ্রর রাগ তখনও কমেনি। হিসহিসানো কন্ঠে বললো,

‘ কেন? প্লিজ চলো। দেখা গেলো ওয়াশরুমের ভেতর কেউ আমায় মারার জন্য বসে রইলো?’

‘ ওকে স্যার।’

মারিয়ার উত্তরে স্তম্ভিত হয়ে গেলো রুদ্র। যদিও মারিয়ার মুখে বিন্দুমাত্র বিদ্রুপের ছোঁয়া পাওয়া গেলো না তথাপি রুদ্রর বুক জ্বালা করে উঠলো। কত বড়ো নির্লজ্জ মেয়ে, তাকে বিদ্রুপ করে কথা বলে! কী দেখতে চায় সে রুদ্রর সাথে ওয়াশরুমে গিয়ে? রুদ্রর শৌচ ক্রিয়া? সিরিয়াসলি?

# চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here