#বেসামাল_প্রেম,০২,০৩
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_২
-” আমাকে ভালোবেসে ফুল দেওয়ার জন্য থ্যাংকিউ। কিন্তু আমি তোমাকে ভালোবাসতে পারব না। তোমার সঙ্গে প্রেমটেমও চলবে না আই এম এক্সট্রিমলি সরি। ”
এমন একটি উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিল পালন। কারণ ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়া এই মেয়েটি মাত্র তিন মাসেই কলেজে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। প্রথমত, বাংলা বিভাগের নতুন লেকচারার মাহের খানের একমাত্র ছোটো বোন সে। দ্বিতীয়ত এই মেয়েটি ভয়াবহ রকমের বিচ্ছু। সর্বক্ষণ তার মাঝে একটা ছটফটে ভাব বিরাজমান। সিনিয়র আপু, ভাইয়াদের অনেকেই তাকে ভীষণ ভয় করে চলে, অনেকে আবার খুব ভালোওবাসে। সবচেয়ে বড়ো কথা সিনিয়র আপুরাই তাকে বেশি স্নেহ করে। এর পেছনে অনেক বড়ো একটি কারণ তার সুদর্শন লেকচারার ভাইটি৷ আটাশ বছর বয়সী অবিবাহিত সুদর্শন লেকচারার পেলে অনার্স পড়ুয়া অবিবাহিত মেয়েরা বেসামাল অনুভূতিতে লুটোপুটি খাবেই। বয়স সবে সতেরো হলেও ভাইয়ের মতো বোনটিও কম নয়। ভাইয়ের চেয়ে দ্বিগুণ উজ্জ্বল গায়ের রঙ তার৷ গায়েপায়ে খুব একটা বড়ো না হলেও ধবধবে ফর্সা ত্বক, গোলগাল শুভ্র মুখশ্রীর ঘন-কালো বড়ো বড়ো পাপড়িতে বেষ্টিত চোখজোড়া দেখেই সমবয়সী, সিনিয়র ভাইরা কপোকাত। তিন মাসে কম প্রপোজ পায়নি সে। বরাবরই পালনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা ঘটিয়েছে। এ নিয়েও তার খ্যাতির শেষ নেই৷ ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি হওয়ার দরুন ইন্টার, অনার্স, ডিগ্রি, মাস্টার্স সকল পর্যায়ের স্টুডেন্ট’স রয়েছে এখানে। পালন অনার্স প্রথম বর্ষের স্টুডেন্ট। পালন’কে দিয়ে মোট তেরোটা প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল হৈমী। এই তেরো বারে বারোটা গোলাপ ঠিক গ্রহণ করেছে৷ বাকি একটা গোলাপ প্রপোজকারী প্রপোজ একসেপ্ট না করাতে দেয়নি। এ নিয়ে অবশ্য এক চোট ঝগরা করেছিল ছেলেটার সঙ্গে। ছেলেটার বাইকের সিটে চুইংগাম লাগিয়ে প্রতিশোধ নিতেও ভুলেনি! বর্তমানে অধিকাংশ ছেলেমেয়েরাই ইঁচড়ে পাকা। কিন্তু হৈমীর বেলায় শুধু ইঁচড়ে পাকা নয়৷ মেয়েটি যেমন বাচাল, তেমনি দুরন্ত। শান্তশিষ্ট প্রকৃতির মিষ্টিভাষী একজন গুণী শিক্ষকের বোন এমন অশান্ত কী করে হলো ভাবতে গেলেই মাথা ঘুরে যায়।
রুদ্র সহ তার সাঙ্গোপাঙ্গ’রা মোটেই হৈমীর এইরূপ আচরণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। রুদ্র চোখ, মুখ কুঁচকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে ব্যস্ত। আগ্রহ নেই অথচ বিরক্তি আকাশ ছোঁয়া। ঝিনুক আবির সহ বাকি সকলেই কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এরা একে অপরের দিকে বিস্মিত চোখে চাওয়া চাওয়ি করছে! গোলাপ ফুল নিয়ে চঞ্চল পায়ে ঝিনুকের সামনে এসে দাঁড়াল হৈমী। পালন ক্লান্ত মুখে সেই তখনি ভার্সিটিতে ঢুকে পড়েছে। তার ইনকোর্স পরীক্ষা চলছে। পরীক্ষার সময় হয়ে যাওয়াতে আর দেরি করেনি।
-” তো ভাইয়া কী বলছিলেন? মাহের ভাইয়ার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক তাই তো? ”
হৈমী এসে একদমে কথাটা বলতেই হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথা নাড়াল ঝিনুক। আবির ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে। তার দৃষ্টি একবার হৈমীর মুখের দিকে তো আরেকবার হাতে থাকা লাল গোলাপটির দিকে ছুটোছুটি করছে। হৈমীর উত্তর দেওয়ার তেমন তাড়া নেই। সে এক এক করে সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করল। হঠাৎ যখন বলিষ্ঠ দেহের অধিকারী রুদ্রর দিকে পাকাপোক্ত নজর পড়ল কিঞ্চিৎ চমকাল। ঘন ঘন চোখের পাপড়ি নাড়িয়ে আপাদমস্তক রুদ্র’কে দেখতে শুরু করল। চিত্ত চঞ্চল হয়ে ওঠল ভীষণভাবে। চোখের পাতা এলোমেলো নড়চড় করতে করতেই গোলাপটা নয়নের হাতে দিলো। নিজের দু-হাত কোমড়ে রেখে অভিজ্ঞ ব্যক্তির মতো সুক্ষ্মভাবে তাকিয়ে রইল। আবির রুদ্রর পাশ ঘেঁষে ফিসফিস করে বলল,
-” দোস্ত দেখ তোকে কেমনে দেখতাছে। রোহিঙ্গাদের যেমনে দেখি অমনে তোরে দেখতাছে। এইটা কোন কথা হইল! তুই কিছু বল আমার কিন্তু মেজাজ খারাপ লাগতাছে। ”
আবিরের কথা শুনে রুদ্র ঠোঁটের কোণায় সিগারেট চেপে এক পলক তাকাল হৈমীর দিকে৷ সত্যি সত্যি মেয়েটা ভুত দেখার মতো দেখছে তাকে। গোলগাল মুখের গোল গোল চোখ যেন গিলে খাচ্ছে। পা থেকে মাথা অবধি বিরক্তি ভঙ্গিতে অতি সুক্ষ্মভাবেই দেখল রুদ্র। বডি ফিগার দেখেই চট করে বুঝে নিলো নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। এর সঙ্গে মাহেরের কোনকিছু থাকতে পারে বলে মনে হলো না। আবার সন্দেহও হলো, যতটুক বুঝল মেয়েটার চরিত্রে ঘাপলা আছে। ভালো মেয়েরা নিশ্চয়ই এত কথা বলে না, এভাবে একটা ছেলের থেকে গোলাপ ফুল নেয় না। তাছাড়া আজকাল পুরুষদের এমন কচি মেয়েদের প্রতিই ঝোঁক বেশি। যত শিক্ষিতই হোক অল্পবয়সী মেয়েদের প্রতি লোভ বেশিরভাগ পুরুষেরই রয়েছে। বিতৃষ্ণায় বুকটা ভরে গেল। ত্বরিতবেগে দৃষ্টি সরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। ক্ষণকাল সময় পেরোতেই হৈমীর দিকে আঙুলে তুরি বাজিয়ে গম্ভীর, রূঢ় কণ্ঠে বলল,
-” এই, মাহেরের সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? যা প্রশ্ন করেছি জাস্ট সেটার উত্তর দিয়ে বিদায় হও। নয়তো এমন হাল করব, মানুষ’কে মুখ দেখাতে পারবে না। ”
আঁতকে উঠল হৈমী। সম্বিত ফিরে পেয়ে কোমড় থেকে দু’হাত সরিয়ে এক ঢোক গিলল। পিটপিট করে কতক্ষণ তাকিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে অমনি পেছন থেকে নয়ন ওর মুখ চেপে ধরল। শঙ্কিত কণ্ঠে বলল,
-” মাহের স্যার ওর আপন বড়ো ভাই। ”
ব্যস আর একটা শব্দও উচ্চারণ করল না নয়ন। প্রাণের বান্ধবীটিকে নিয়ে প্রচণ্ড আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে একটি রিকশা ডেকে ওঠে পালিয়ে গেল। রিকশা চলছে হৈমীর বাড়ির দিকের রাস্তায়। একমিনিট সময় ধরে নয়ন ভয়াতুর কণ্ঠে অনেক কথাই বলেছে হৈমীকে। তার ধারণা রুদ্র সহ ওর সাঙ্গোপাঙ্গরা সন্ত্রাস হবে। আর তাদের লিডার হচ্ছে রুদ্র। ঐতো লম্বা লম্বা চুল, মুখ ভর্তি বড়ো বড়ো দাঁড়ি। চোখ, মুখের ভাব, কণ্ঠস্বর সবটাতেই পাক্কা সন্ত্রাসের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠেছে। কী বিশ্রী ভাবে সিগারেট খায়। নাক কুঁচকে রইল নয়ন। বাড়ির সামনে রিকশা আসতেই হঠাৎ হৈমী চিৎকার করে ওঠল। নয়নকে আকস্মিক জড়িয়ে ধরে বলল,
-” দোস্ত ফাটাফাটি। ”
-” কী! ”
-” ফাটাফাটি রকমের ক্রাশ খেয়েছি। ”
ভয়কাতুরে কণ্ঠে নয়ন বলল,
-” প্লিজ এটা বলিস না তুই ঐ সন্ত্রাসটাকে দেখে ক্রাশ খেয়েছিস। ”
-” দোস্ত এ জীবনে আমি কাউকে দেখে ভয় পাইনি। কারো কথায় আমার গলা শুকিয়ে যায়নি। বুকের ভিতর ধড়াস করেও ওঠেনি। কিন্তু আজকে! হায়! আমি ভাবতে পারছি না। তাড়াতাড়ি নাম একটা সেলিব্রেশন হওয়া উচিৎ। ”
রিকশার ভাড়া মিটিয়ে নয়নকে নিয়ে টানতে টানতে বাড়ির ভেতরে ঢুকল হৈমী। নয়নের হাত পা এখনো কাঁপছে তখনকার পরিস্থিতি মনে করে৷ কী চেহেরা! কী কণ্ঠস্বর! কী ভয়াবহ হুমকি! পুনরায় গা শিউরে ওঠল তার। অথচ হৈমী কিনা ক্রাশ খেলো! মেয়েটা কি সত্যি পাগল?
_
যুব উন্নয়ন ক্লাবের সভাপতি রাদিফ শেখ। রুদ্রর বড়ো চাচার বড়ো ছেলে। তার ফোন পেয়েই ক্লাবে ছুটে গেছে রুদ্র। সেখানে যাওয়ার পর দেখল, ছোটোখাটো একটি জটলা বেঁধে আছে। রুদ্র’কে দেখে অনেকে জড়োসড়ো হয়ে গেল। রাদিফ জটলার ভিতর থেকে বেরিয়ে এসে রুদ্রর কাছে গেল। রুদ্রকে দেখে জটলার ভিতরে থাকা প্রতিটি মানুষের হাঁটু কাঁপতে শুরু করেছে। কারণ ক্লাবের পেছনের জঙ্গলে দু’টো ছেলেমেয়ে অশ্লীল কাজে লিপ্ত হয়েছিল। তখনই ক্লাবের কয়েকজন সদস্য ধরে বেঁধে নিয়ে এসেছে। এখন তারা জটলার মাঝখানে মাথা নিচু করে চোখের পানি ফেলছে। সমস্ত ঘটনা শুনতেই রুদ্রর চোখ, কান উভয়ই রক্তিম হয়ে ওঠল। দু-হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেও পারল না৷ তড়াক করে এসে জটলার ভেতর ঢুকে ছেলেটাকে এলোপাথাড়ি আঘাত করল। মেয়েটার গালেও কয়েকটা থাপ্পড় লাগিয়ে দিয়েছে। রাদিফ ওকে টেনেটুনে সরিয়ে এনে থমথমে কণ্ঠে বলল,
-” রুদ্র মাথা ঠান্ডা কর একটা সমাধান দে। ছেলেটা আমার বন্ধুর ছোটো ভাই৷ ”
বড়ো বড়ো করে নিঃশ্বাস ছেড়ে নীরস কণ্ঠে রুদ্র বলল,
-” মেয়ের পরিচয় কী? ”
রাদিফ মেয়ের পরিচয় দিতেই রুদ্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র রেডি করে কাজী ডেকে বিয়ে পড়ানোর ব্যবস্থা করতে বলল। ছোটো ভাইয়ের পরামর্শে রাদিফ তার ছেলেপুলেদের দিয়ে সব ব্যবস্থা করে ফেলল। বিকাল গড়াতে গড়াতে ছেলে, মেয়ে উভয়ের পরিবারের সম্মুখেই বিয়ে পড়ানো হলো। পাত্রপাত্রী বিদায় করে ক্লাব থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে হঠাৎ পনির নামের রুদ্রর একজন চ্যালা বলল,
-” বস আপনার নামে একটা চিঠি আছে। ”
বাইকে বসতে বসতে ভ্রু কুঁচকে রুদ্র বলল,
-” ঝেড়ে কাশ। ”
-” ইয়ে মানে লাভ লেটার পাঠিয়েছে এক মেয়ে। ”
আশ্চর্য হয়ে বাইক থেকে নেমে দাঁড়াল রুদ্র। বাইকের পেছনে ঝিনুক বসতে নিয়ে আবার নেমে দাঁড়িয়েছে। সেও অবাক চোখে পনিরের দিকে তাকিয়ে আছে। রুদ্র ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
– “আমি একজন সন্ত্রাস। একজন সন্ত্রাস’কে যে মেয়ে লাভ লেটার পাঠায়, সে মেয়ে আরো বড়ো সন্ত্রাস। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিলাম, চব্বিশ ঘন্টা। এরমধ্যে ঐ মেয়ে’কে আমার চোখের সামনে দেখতে চাই। প্রয়োজনে ঘরে ঘরে তল্লাশি করবি। ”
পনির বলল,
– “ভদ্র ঘরের মেয়ে বস। বড়ো একটা ভাই আছে কলেজে লেকচার দেয়। ”
– ” নাম কী? ”
– ” মাহের খান। ”
-” বোনের নাম? ”
– ” হৈমন্তীকা জাহান হৈমী। ”
ঝিনুক আতঙ্কিত হয়ে মুখে হাত দিলো। রুদ্র কপাল কুঁচকে ঝিনুকের দিকে চেয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
-” বোনের তো লুস ক্যারেক্টার দেখছি! ভাইয়ের বিষয়ে আরেকটু খবর নে ঝিনুক। আমার বোনের গোটা জীবনের বিষয় এটা। ”
ঝিনুককে কথা গুলো বলেই পনিরকে বলল,
-” লাভ লেটার কার কাছে। ”
– ” বাবু ভাইয়ের কাছে। ”
সিগারেট ধরাতে ধরাতে রুদ্র গর্জন ছাড়ল,
– ” এই বাবু, কী লিখছে পড়তো। ”
পনিরের পেছন থেকে এগিয়ে এলো বাবু। মৃদু কাঁপছে তার হাতদুটো। কম্পিত হাতেই দু’ভাঁজ করা সাদা কাগজটি খুলে পড়তে শুরু করল,
– ” এই যে মি. গুণ্ডা, থুরি গুণ্ডাদলের হেড। আপনাকে
আই লাভ ইউ। অর্থ হচ্ছে, আপনাকে আমার মতো এই দুষ্টু, মিষ্টি, সুন্দরী রমণীটি ভালোবাসে। আপনাকে আমি আমার প্যারাসিটামল হিসেবে চাই, আপনাকে আমি আমার এন্টাসিড হিসেবে চাই। আপনাকে চাই, আপনাকে চাই ও গুণ্ডা আপনাকে কিন্তু চাই’ই। আসসালামু আলাইকুম গুণ্ডা। সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব, আশা করি, দু’দিনের ভেতরে জবাব পাবো। ”
চিঠিতে লেখা ভাষাগুলো কর্ণগোচর হতেই প্রচণ্ড ক্রুদ্ধতার সঙ্গে তেড়ে এলো রুদ্র। খপ করে চিঠিটা ছিনিয়ে নিয়ে বলিষ্ঠ হাতে মুচড়ে মাটিতে ফেলল। চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” বেয়াদব মেয়েটার আজ এমন অবস্থা করব যে পরবর্তীতে আমাকে লাভ লেটার তো দূরের কথা আমাকে কল্পনা করতেও ওর রূহ কেঁপে উঠবে! ”
ত্বরিতগতিতে বাইকে ওঠে ঝিনুক’কে পেছনে বসতে বলল৷ ঝিনুক বসতেই বলল,
-” মাহের খানের বাড়ির পথ বল। ”
ঝিনুক মাহেরের বাড়ির ঠিকানা বলতেই রুদ্র সেদিকে বাইক ঘোরাল। পনেরো মিনিটের পথ মাত্র পাঁচ মিনিট গিয়েছে। এমন সময় কল পেলো বড়ো চাচি জেরিনের৷ সে জানাল, সূচনা’কে দেখতে এসেছে তার বান্ধবী। তাই রুদ্রকে যত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে৷ ফোনে কথা শেষ করে রুদ্র বাইক ঘোরাতে ঘোরাতে বলল,
-” মেয়েটার কপাল ভালো। ”
বাড়িতে ঢুকতেই দেখতে পেলো বোরখা পরিহিত একজন মহিলা সূচনার পাশে বসে আছে। নিকাব খোলা থাকায় মহিলাটির বয়স আন্দাজ করল পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। রুদ্রকে দেখতেই চাচি জেরিন বলল,
-” এইতো আমাদের রুদ্র এসে গেছে। হামিদা এটাই আমার ভাতিজা। সূচনার বড়ো ভাই। ”
মহিলাটি সৌজন্যপূর্ণ হেসে রুদ্রকে বলল,
-” আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছো বাবা। ”
আমতা আমতা করে অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে রুদ্র বলল,
-” ওয়ালাইকুমুস সালাম। ”
বাকিটুকু জবাব দিলো না সে। দোনোমোনো করে দাদিনের পাশে গিয়ে বসল। হামিদা রাগ করলেন না। জেরিনের বান্ধবী হওয়ার সুবাদে রুদ্র, সূচনা সম্পর্কে পুরোপুরিই অবগত তিনি। মা হারা ছেলেমেয়ে দু’টোর প্রতি মায়ার অন্ত নেই। সে মায়া থেকেই একমাত্র ছেলে মাহেরের জন্য সূচনাকেই নির্বাচন করেছেন।ছেলে সম্পর্কে মোটামুটি যতটুক ধারণা পেয়েছে সূচনার প্রবাসী বাবা, বড়ো চাচি, চাচাতো ভাইরা এবং দাদিন কারো কোন আপত্তি নেই৷ ছেলের মায়ের স্নেহপূর্ণ আচরণ দেখে সূচনার মন অনেকটাই নরম হয়েছে। মা হারা মেয়ে সে। ছোটোবেলা থেকে মাকে ছাড়া বড়ো হয়েছে। মা, মা গন্ধটা কখনো নাকে আসেনি। বড়ো চাচি অনেকগুলো বছর অভিমানে বাপের বাড়ি কাটিয়েছেন। এখন পর্যন্তও ছেলে, ছেলে বউয়ের সঙ্গে শশুর ঘর থেকে দূরেই আছেন। বছরখানেক হলো রুদ্র আর সূচনার সঙ্গে কথা বলেন তিনি৷ বয়স বেড়েছে বুদ্ধিও খুলেছে। এক সময় অতি সরলা ছিল বলেই স্বামী ছোটো ভাইয়ের বউয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় লিপ্ত হয়ে তাকে ত্যাগ করেছেন। সেদিনের জেরিনের সাথে আজকের জেরিনের মধ্যে রাত দিন তফাৎ। নিজের বাচ্চাদের বুকে টেনে রুদ্র, সূচনার থেকে এতদিন মুখ ফিরিয়ে থাকলেও এখন তিনি বুঝতে পরেছেন এই সন্তান দুটোর কোন দোষ নেই। মায়ের পাপের অংশীদার তারা কোনভাবেই নয়। ঠিক যেমন তার ছেলেরা বাবার পাপের অংশীদার নয় তেমনি রুদ্র, সূচনাও। তাই তো সূচনার এমন খারাপ পরিস্থিতিতে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তিনি। শাশুড়ির সঙ্গে পরামর্শ করে বান্ধবী হামিদার ছেলের সঙ্গে বিয়ের কথা এগিয়েছেন। এ নিয়ে চাচির প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই রুদ্রর। সূচনাও ভাই আর চাচিকে ভরসা করে একজন মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভে বিয়েতে মত দিয়ে দিলো৷ কথাবার্তা শেষে সকলেই মিষ্টি মুখ করল। দাদিন জানে মাহেরের বাবা নেই। বছর চারেক আগে পরলোকগমন করেছেন। মা, বোন নিয়েই তার সংসার৷ তাই বললেন,
-” হামিদা, তোমার মেয়েটাকে নিয়ে আসলে না তো?”
শাশুড়ির প্রশ্ন শুনে ঠোঁট টিপে হাসল জেরিন৷ হামিদাকে কিছু বলতে না দিয়ে সেই বলল,
-” আসলে মা ওর মেয়েটা বড্ড ছেলেমানুষ। অতিরিক্ত সহজসরল। হাতেপায়ে বড়ো হলেও বুদ্ধি তেমন নেই। হৈহৈ রৈরৈ করতে পছন্দ করে। প্রথম দিন এসেই যদি অমন হৈহৈ শুরু করে আপনারা ভুল বুঝতে পারেন। তাই নিয়ে আসেনি। ”
লজ্জিত হয়ে হামিদা বলল,
-” আসলে মেয়েটা সহজেই সবার সাথে এমনভাবে মিশে যায় এরজন্য অনেক সময় লজ্জায় পড়তে হয়। বাচালও বলতে পারেন। তাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে ওকে কোথাও নিয়ে যাই না। সব ঠিকঠাক হোক নিশ্চয়ই আসবে। আপনাদের পাগল করেও ফেলবে একদম।”
এমন সময় রুদ্র দাদিনের কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-” দাদিন আমার কথা আছে। ”
-” কী বল তোর কি আপত্তি আছে? ”
ইতস্ততভাবে রুদ্র বলল,
-” ছেলেকে নিয়ে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু ছেলের বোনকে নিয়ে বিরাট সমস্যা। ”
দাদি চোখমুখ ছোটো করে বলল,
-” সেকি! বিয়ে দেবো আমার নাতনিকে ঐ ছেলের কাছে। আমার নাতিকে দিয়েতো আর ঐ ছেলের বোন আনব না। তাহলে তাকে নিয়ে কেন সমস্যা থাকবে? ”
হকচকিয়ে রুদ্র বলল,
-” ছেলের বোনের চরিত্র খারাপ দাদিন! ”
-” কী বলিস আমি জীবনেও বিশ্বাস করব না এটা। হামিদার মেয়ে খারাপ হতেই পারেনা। আর যদি হয়ও তাতে আমাদের কী? তাকে তো আর তোর বউ করে আনছি না। ”
_
বিয়ে ঠিক হয়ে গেল। হৈমীকে তার বেয়াদবির শাস্তি দিতে চেয়েছিল রুদ্র। কিন্তু বিয়ে ঠিক হওয়াতে এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাল না। শতহোক, বোনের শশুর বাড়ির লোক। এদিকে মায়ের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে আপত্তি নেই মাহেরের। শুধু এনগেজমেন্টের আগে মেয়ের সাথে একান্তে কথা বলতে চায়৷ মাহেরের এমন ইচ্ছে শুনে সূচনাও স্বস্তি পেলো৷ একজনকে ভালোবেসে আরেকজন’কে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। তাই বলে কাউকে ঠকানোর মানসিকতা নেই। আগামীকাল বিকেল চারটায় মি.মাহের খানের সঙ্গে মিট করতে যাবে সে।
চলবে…
#বেসামাল_প্রেম
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_৩
” ছ’বছর আগে মাহেরের প্রেমিকা রশ্নি’কে ধর্ষণ করা হয়েছিল। এ খবর শোনার পর ঢাকা থেকে সরাসরি হসপিটালে এসেছিল মাহের৷ বেডে নিশ্চল হয়ে শুয়ে থাকা রশ্নির একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলেছিল,
– ” উইল ইউ ম্যারি মি রশ্নি? ”
রশ্নি উত্তর দেয়নি। তার গাল বেয়ে শুধু দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়েছিল। মাহের নিঃশব্দে ওঠে দাঁড়িয়ে রশ্নির মা, বোন’কে বলেছিল,
– ” আগামীকাল আমার অভিভাবক পাঠাব আন্টি। এনগেজমেন্ট হসপিটালেই হবে। ”
কেবিন থেকে বেরোনোর পথে ওর জলপূর্ণ দু’টো চোখ স্পষ্ট দেখেছিলাম আমরা। পরেরদিন সকালেই রশ্নিকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়৷ মাহের’কে রশ্নির মা জানায়, এনগেজমেন্ট তাদের বাড়িতেই হবে। কথামতো, ঠিক দুপুর তিনটায় মা, বোনকে পাঠায় মাহের। কিন্তু এনগেজমেন্ট হয়নি। ”
ফোনের স্ক্রিনে ইংরেজি বার্তায় এ পর্যন্ত দেখেই বুক ধড়ফড় শুরু হলো সূচনার। কপাল ঘামছে তার, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, এক ঢোক গিলে দ্রুত টাইপ করল,
– ” হলো না কেন? তাড়াতাড়ি বলুন। ”
মিনিট পাঁচেক পর উত্তর এলো,
– ” রশ্নি সুইসাইড করেছিল! ”
যে ছেলেটা ম্যাসেজ করেছে তার নাম নিলয়। মাহেরের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মাহেরের মা হামিদা বেগম মাহেরের বিষয়ে সমস্তটা জানাতে বলেছেন নিলয়কে। মাহের সূচনার ফেসবুক একাউন্টে এড হয়েছে গতকাল রাতে। নিলয় মাহেরের থেকে সূচনার আইডি নিয়ে সকাল বেলা নক দিয়েছে। সূচনা ব্যস্ত থাকায় সারাবেলা কথা হয়ে ওঠেনি। কিছুক্ষণ আগে সীমিত পরিচয়ের পাশাপাশি মাহেরের অতীত জানাল। অতীত নিয়ে কথা বলতে পারে না মাহের। রশ্নি’কে নিয়ে একটি শব্দও সে উচ্চারণ করতে পারে না৷ ছ’বছর ধরে মাহেরকে কখনো কাঁদতে দেখা যায়নি। রশ্নিকে নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতে শোনা যায়নি। ছেলেটা কেমন যেন হয়ে গেছে। উচ্চ মানসিকতার মানুষদের অনুভূতিও উচ্চমানের হয়। মাহেরের জায়গায় অন্য ছেলে হলে নিশ্চয়ই প্রেমিকার মৃত্যু শোকে পড়াশোনা, পরিবার ভুলে নেশাগ্রস্থ হয়ে জীবনটা ধ্বংস করে দিত। কিন্তু মাহের তা করেনি। সে প্রেমিকাকে ভুলে গেছে কিনা বোঝা যায় না। তার স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে আছে কিনা তাও স্পষ্ট নয়। তাকে কতটুকু ভালোবেসেছিল সেটা যেমন স্পষ্ট নয় তার জন্য ঠিক কতটা কষ্টে জর্জরিত সেটাও অজানা। সাদাসিধে মানুষদের অনুভূতি হয় রহস্যেঘেরা। মাহের সাদাসিধে মানুষ। নিজের অমায়িক আচরণের জন্য সকলের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসার পাত্র হয়ে ওঠেছে ঠিকি তবে ব্যক্তিত্ব কঠিন খোলসে মোড়ানো। তার ব্যক্তিত্বের একাংশ সম্পর্ক সকলেই অবগত। প্রফেশনালি সে একজন লেকচারার। সকলের সঙ্গে সৌজন্যপূর্ণ আচরণে, জ্ঞানে, বুদ্ধিতে, দায়িত্ব বোধে সদাসর্বদা সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। বাবাহীন পরিবারে মা, বোনের একমাত্র অবলম্বন, বটবৃক্ষ সে।
ফোনে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বিচলিত ভঙ্গিতে বসে আছে সূচনা৷ তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। নিঃশ্বাসে অস্থিরতা। পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে আছে রুদ্র। একমনে ড্রাইভ করছে সে। হঠাৎ সূচনার দিকে নজর যেতেই রাশভারী কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
-” এসি চলছে তবুও ঘামছিস সমস্যা কী? ”
কিঞ্চিৎ চমকে সূচনা বলল,
-” কিছু না কিছু না। ”
-” নার্ভাস লাগলে আমি তোর সঙ্গে থাকব। ”
চোখ বড়ো বড়ো করে রুদ্রর দিকে তাকাল সূচনা৷ রুদ্রর দৃষ্টি সম্মুখে স্থির, মুখে গম্ভীর্যতা অবিচল। ড্রাইভ করছে বিরতিহীন। এক ঢোক গিলে বারকয়েক চোখের পলক ফেলল সূচনা। কী বলছে তার ভাই! যার সঙ্গে ছোটো বোনের বিয়ের কথা চলছে, তার সঙ্গে প্রাইভেট কথা বলা কালীন সে সঙ্গে থাকবে! তার ভাইটা অমিশুক, নীরস, আবেগহীন জানতো। কিন্তু সম্পর্কের বিষয়গুলোতে এত অজ্ঞ তা তো জানতো না। জোরপূর্বক মুখে হাসি আনার চেষ্টা করল সূচনা। বলল,
-” না না তোমার থাকতে হবে না। আসলে উনি আমার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলতে চান। ”
ভ্রুকুটি করে তাকাল রুদ্র। বলল,
-” তোরা পরিচিত নস, একান্তে কথা আবার কী? আমি আশপাশেই থাকব। ”
ঢোক গিলল সূচনা। বলল,
-” উনি হয়তো উনার ব্যক্তিগত বিষয় সম্পর্কে আমাকে কিছু জানাতে চান। তুমি পাশে থাকলে আনইজি ফিল করতে পারে। ”
কুঁচকানো ভ্রুজোড়া আর সোজা হলো না রুদ্রর। লম্বা করে শ্বাস টানল শুধু। ঠোঁট টিপে হাসল সূচনা। সে হাসি রুদ্রর থেকে আড়াল করার জন্য জানালার দিকে মুখ ফেরাল।
গাড়ি থামল লেকের পাশের রাস্তাটায়। লেকের ধারে সারি সারি কফিশপ এবং ফুচকার দোকান। এখানে পরিচিত এক কফিশপ রয়েছে সূচনার৷ তার বান্ধবীর ভাইয়ের কফিশপ এটা। মাঝে মাঝেই বান্ধবী নিয়ে বিকেলবেলা ঘুরতে আসে এবং এই কফি-শপেই বসে। গাড়ি থেকে ভাই বোন নেমে দাঁড়াতেই ঝিনুক, পনির সহ আরো অনেকেই এগিয়ে এলো। ঝিনুকের মুখে হাসি যেন উথলে পড়ছে। পান খাওয়া লাল টকটকে ঠোঁটের ফাঁকে আঁধ সাদা দাঁতগুলো দেখে গা জ্বলে ওঠল সূচনার। ক্রোধনে ফুঁসতে ফুঁসতে ভাইয়ের দিকে তাকাল। ঝিনুকরা ততক্ষণে তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। রুদ্র সূচনার ক্রোধের মাত্রা টের পেলো, ঝিনুক’কে কঠিন একটি ধমক দিয়ে বলল,
-” সামনে এসে দাঁত ক্যালাতে বলেছি? দূরে যা। ”
ঝিনুকের মুখের হাসি নিমিষেই মিলিয়ে গেল। সূচনার দিকে এক পলক তাকিয়ে পনিরের ঘাড়ে থাবা মেরে বলল,
-” তোরে বললাম সূচনা আপা রাগ করব আমাদের দেখলে। শালা তবুও আমারে জোর করলি। ”
পনির বোকার মতো মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলল,
-” হ আফা আমিই বলছিলাম এইখানে আসতে। আপনি ভালো আছেন আপা? ”
এরা কী পরিমাণ ঢপ মারতে পারে খুব ভালো করেই জানে সূচনা৷ তাই অগ্নি দৃষ্ট ছুঁড়ে তাকাল পনিরের দিকে। সে দৃষ্টিতে এক নজর তাকিয়েই ঝিনুক পনির সহ আরো তিনজন ক্ষিপ্র গতিতে পালিয়ে গেল। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সূচনা৷ পাছে লোকে তার ভাইকে গুন্ডা, মস্তান বলে। সন্ত্রাস হিসেবে খ্যাতি কম নেই। এসবে এখন আর লজ্জা লাগে না অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তার হবু বর এবং হবু বরের পরিবার এসবে অবগত। তাই বলে ভাইয়ের সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হবু বরের সঙ্গে মিট করতে আসা সমীচীন নয়৷ এরা এসেছে দেখলে বা জানলে মাহের খানও নিশ্চয়ই বিরক্ত হবে৷ সে নম্র, ভদ্র স্বভাবের মানুষ। একজন সম্মানিত ব্যক্তি। শহরে তার মোটামুটি সম্মানীয় একটা পরিচয় আছে। কলেজের লেকচারার। এমন একজন মানুষ শুধু এক চরিত্রহীন নারীর সন্তান নয় এক সন্ত্রাসের বোনকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে! এইতো মাথা সমান। এতটুকুতেই মাথা তুলে কথা বলার জো নেই। সেখানে আবার এই চ্যালাফ্যালারা উপস্থিত থাকা নিন্দনীয়ই বটে।
সূচনার বলা নামের কফিশপটার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল মাহের৷ হঠাৎ দু’টো ছেলে মেয়ে’কে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখল। মেয়েটার পরনে পারপেল কালার কারুকার্যে শোভিত থ্রিপিস। মাথায় পারপেল কালার উড়না দিয়ে ঘোমটা টানা। পেছনের লম্বা বিনুনির শেষ অংশ হাঁটার তালে তালে কোমড়ের পাশ দিয়ে সম্মুখে উঁকি দিচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। লম্বাটে ফর্সা মেয়েটার মায়াবী মুখটা দেখতেই চিনে ফেলল মাহের৷ হ্যাঁ এটাই তার হবু বউ! মা’য়ের পছন্দের পাত্রী। মনে মনে তিনবার মাশাআল্লাহ পড়ল সে। ততক্ষণে রুদ্র, সূচনা তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। সূচনা সালাম দিতেই অমায়িক একটি হাসি উপহার দিয়ে সালাম ফেরাল মাহের। রুদ্রর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো হ্যান্ডশেক করার জন্য৷ স্বভাবতই গম্ভীর মুখে হাত বাড়াল রুদ্র। প্রথম পরিচিতি শেষে মাহের দু’জন’কেই কফিশপে ঢুকতে বলল। বয়সের দিকে রুদ্র, সূচনা উভয়ই তার ছোটো তাই নাম ধরেই ডাকল। সূচনা ধীরপায়ে কফিশপের দিকে এগোলেও রুদ্র রাশভারী কণ্ঠে বলল,
-” আপনারা কথা বলুন আমার কিছু কাজ আছে এদিকে। ”
মাহেরকে কথাটা বলে সূচনার দিকে তাকাল। বলল,
-” আমি এদিকটায়ই আছি৷ ফোন করিস। ”
সূচনা ঘাড় কাৎ করল। রুদ্রও গম্ভীর চিত্তে মাহেরকে বলল,
-” আসি। ”
মাহের মৃদু হেসে জবাব দিলো,
-” জি। নাইস টু মিট ইউ। ”
বাঁকানো হাসি হেসে বিদায় নিলো রুদ্র। কফিশপের ভেতরে গিয়ে বসল মাহের, সূচনা৷ একে অপরের মুখোমুখি বসেছে তারা৷ মাঝে ব্যবধান শুধু একটি ছোটো টেবিলের। দীর্ঘক্ষণ নীরবতায় কাটানোর পর গলা খাঁকারি দিয়ে মাহের প্রশ্ন করল,
-” সূচনা আপনি কি লজ্জা পাচ্ছেন? ”
নিম্নমুখী সূচনা মাথা নাড়িয়ে না বোঝাল। আলতো হেসে মাহের পুনরায় বলল,
-” অস্বস্তি হচ্ছে? ”
এবারেও না করতে উদ্যত হলো সূচনা। তার পূর্বেই মাহের বলল,
-” হবু বরের সামনে প্রথম আলাপে লজ্জা পাচ্ছেন না। এ কথা হজম করেছি কিন্তু অস্বস্তি হচ্ছে না এটা কিন্তু হজম হবে না। ”
বুকের খুব গোপন স্থানে কিঞ্চিৎ শিহরন জাগল সূচনার। সন্তর্পণে মাথা তুলে তাকাল সম্মুখের মানুষটার দিকে। নিঃসন্দেহে একজন সুদর্শন পুরুষ তার সামনে বসে আছে। সুগঠিত দেহের বলিষ্ঠ শরীরটা বসে আছে অসাধারণ ভণিতায়। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। ফর্সা বললেও ভুল বলা হবে না। হেয়ার স্টাইল খুবই সাধারণ। ফ্যানের তীব্র বাতাসে সিল্কি কয়েকটা চুল কপাল দিয়ে উড়ছে। গভীর একজোড়া চোখ। নাকের এক পাশের কালো তিলটা বেশিই চোখে লাগছে। শেভ করার সময় হয়তো কয়েকদিন পেরিয়ে গেছে৷ ফর্সা ত্বকে খোঁচা খোঁচা দাঁড়িগুলো তার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
চোখেমুখে লেপ্টে আছে অমায়িক হসি৷ এমন পুরুষদেরই বোধহয় মি. পারফেক্ট বলা হয়ে থাকে।
-” পাত্র পছন্দ হয়েছে? ”
কেঁপে ওঠল সূচনা। দৃষ্টিজোড়া নিমিষেই বেসামাল হয়ে ওঠল। মাহের বিচলিত হয়ে বলল,
-” ওহ শীট! লজ্জা দিয়ে ফেললাম। লজ্জা পাবেন না শান্ত হন। যার সঙ্গে সারাজীবন কাটাবেন তাকে এভাবে দেখেশুনে নেওয়াটাই ব্যাটার। ”
ইতোমধ্যে দুটো কফি দেওয়া হয়েছে ওদের। কফির মগ সূচনার দিকে এগিয়ে মাহের পুনরায় বলল,
-” কফি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে আমরা কফি খেতে খেতে কথা বলতে পারি। ”
সূচনা মাথা নাড়িয়ে কফির মগ হাতে নিলো। মাহেরও কয়েক চুমুক দিয়ে ফেলেছে। হঠাৎ সূচনা বলল,
-” বিয়ের ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত কী? ”
-” মা’য়ের ছেলের বউ প্রয়োজন, বোনের ভাবি প্রয়োজন, আর আমার একজন বন্ধরূপী ব্যক্তিগত মানুষ প্রয়োজন। এটাই সিদ্ধান্ত। ”
কিছুক্ষণ আবারও নীরবতা কাটল। কফির মগে আস্তেধীরে চুমুক দিতে থাকা সূচনার দিকে একমনে তাকিয়ে মাহের বলল,
-” আপনার মতামত? ”
এক পলক তাকিয়ে কফির মগ টেবিলে রেখে স্বাভাবিক হয়ে বসল সূচনা। ধীরেসুস্থে শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” আপনার মতো মানুষ’কে জীবনসঙ্গী হিসেবে পাওয়া যে কোন মেয়েরই ভাগ্যের ব্যাপার। আপনি আমায় বউ হিসেবে গ্রহণ করলে নিজেকে সৌভাগ্যবতীই মনে করব। কিন্তু আমার বিষয়ে পুরোপুরি জানার পর আপনার সিদ্ধান্ত বদলাতেও পারে। ”
নড়েচড়ে বসল মাহের। বলল,
-” ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বদলানোর সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। ”
-” আমার দীর্ঘদিনের রিলেশন ছিল! ”
অত্যন্ত স্বাভাবিক কণ্ঠে মাহের বলল,
-” ছিল, নেই তো। ”
বিস্ময়াভিভূত হয়ে তাকাল সূচনা। ঢোক গিলে বলল,
-” না। ”
-” আমার আপত্তি নেই। আর কিছু? ”
-” আমি তাকে ভালোবাসতাম। ”
-” স্বাভাবিক। ”
-” বিয়েতে রাজি হলেও আমার সময় লাগবে। ”
-” কীসে? ”
-” আপনাকে স্বামীর স্থান দিতে। ”
-” বন্ধুর জায়গাটা দিলেই হবে। ”
চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ল সূচনা। বলল,
-” আমাকে নিয়ে আপনার কোন সমস্যাই নেই? ”
-” সমস্যা থাকবে কেন? আপনার চোখ তো টেরা নয়, নাকও বোচা নয়। আপনার আমাকে নিয়ে সমস্যা আছে কিনা বলুন৷ বুড়ো বর পেতে আপত্তি নেই তো?”
আশ্চর্য হয়ে সূচনা বলল,
-” কে বুড়ো আপনি! ”
-” গুণে গুণে ছ’বছরের বড়ো। আটাশ বছর বয়সী বুড়ো। ”
মৃদু মৃদু হাসতে লাগল মাহের। সূচনা আহত সুরে বলল,
-” আপনার বয়সে অনেকে চৌদ্দ, পনেরোর মেয়ে বিয়ে করে। আমার তো বাইশ চলছে। ”
-” তাহলে পারফেক্ট ম্যাচ কী বলেন? ”
সূচনা পুনরায় মাথা নিচু করল। বলল,
-” একটি প্রশ্ন করি? রাগ করবেন না তো? ”
-” ওহ ম্যাডাম প্রথম পরিচয়ে রাগ দেখালে আপনি তো পালিয়ে যাবেন। নির্দ্বিধায় প্রশ্ন করুন। ”
-” কখনো পারবেন রশ্নির জায়গাটা আমাকে দিতে? ”
নিমিষেই স্তব্ধ হয়ে গেল মাহের৷ সে জানতো নিলয় সূচনাকে সবটা জানিয়েছে। যা নিজ মুখে জানানোর সাধ্য তার নেই। তারপরও বুকের ভিতর ভীষণ রকম মুচড়ে ওঠল৷ সত্যিই কি পারবে রশ্নির জায়গা সূচনাকে দিতে। সূচনা তাকিয়ে আছে মাহেরের দিকে। সত্যি বলতে নিলয়ের ম্যাসেজ পাওয়ার পর থেকেই মাহেরের প্রতি অনেক বেশি আগ্রহী হয়েছে সূচনা। যে পুরুষ ধর্ষিত হওয়া নিজের ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখে ঐ পুরুষের মানসিকতা নিয়ে বিন্দু পরিমাণ সন্দেহও রাখা উচিৎ নয়। সূচনাও রাখেনি। বিয়েতে দ্বিধাহীন হয়েছে মাহেরের সত্যিটা জানার পরই। সূচনা উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘসময় পর মাহের বলল,
-” আমি কখনো আপনাকে রশ্নির জায়গা দিতে পারব না৷ কারণ রশ্নি আমার ভালোবাসার মানুষ। সূচনা, আপনি সত্যি ভাগ্যবতী কারণ রশ্নি যে জায়গাটা পায়নি সে জায়গাটা আপনি পাবেন। কারণ আপনি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবেন। শুধু প্রেমিকা হওয়াটাকে তো প্রাপ্তি বলে না। ওর জায়গাটা না হয় আপনি নাই নিলেন। আপনার স্থান আমার এখানে থাকবে। ”
বুকের বা’পাশ দেখিয়ে বলল মাহের। ভাষাহীন হয়ে পড়ল সূচনা। অদ্ভুতভাবেই তার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠল। বিরবির করে শুধু একটা কথাই বলল,
-” আপনি অনন্য মাহের। আপনি অনন্য। ”
_____
পরেরদিন ভোর ছ’টায় সূচনার ফোনে কল এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মাহের বলল,
-” শুভ সকাল ম্যাডাম। বিরক্ত হলেন? ”
ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসল সূচনা। স্ক্রিনে ভালোভাবে নাম্বারটা দেখে জড়ানো কণ্ঠে উত্তর দিলো,
-” না না বিরক্ত হইনি। বলুন আপনি বলুন। ”
-” পাশে পানি থাকলে পানি খেয়ে নিন। তারপর বলছি। ”
গলা শুঁকিয়ে কাঠ কাঠ অবস্থা। সত্যি ভীষণ পিপাসা পেয়েছে। তাই দেরি না করে ফোন রেখে সত্যি সত্যি ওয়াটার বোতল থেকে পানি খেয়ে স্বাভাবিক হলো সূচনা। তারপর বিছানায় এসে ধীরেসুস্থে ফোন কানে ধরে বলল,
-” জি বলুন। ”
-” আমার বোন হৈমী। আপনাকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে। বায়না ধরেছে আজ কলেজ শেষ করে আপনার ওখানে যাবে। ”
মৃদু হেসে সূচনা বলল,
-” তাই আসুক না আজ আমি বাসায়ই থাকব ভার্সিটি নেই। ”
-” আচ্ছা আমি দিয়ে আসব। হবু ননদ সম্পর্কে জানেন তো? ”
-” জি অল্পস্বল্প। ”
মুচকি হেসে মাহের বলল,
-” পুরোটা জেনে যাবেন আজ। খুব বেশি বিরক্ত করলে আমায় ফোন করবেন। ”
-” একদম না৷ আমি মানিয়ে নেবো। ”
-” এই সেরেছে মানিয়ে নেওয়ার আপনি কী বুঝেন? বাচ্চা একটা মেয়ে ওসবে জড়াবেন না। বিয়ের সময় মেয়েদের মানিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বেশ জ্ঞান দেওয়া হয়। অথচ মানিয়ে নেওয়া উচিৎ আমাদের অর্থাৎ ছেলে সহ ছেলের পরিবারদের। আপনি একা মানুষ সবার সাথে কি করে মানিয়ে নেবেন? আমি বোনকে বুঝিয়ে পাঠাব যেন বিরক্ত না করে চিন্তা করবেন না। ”
গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহের, হৈমী। সূচনাদের ডুপ্লেক্স বাড়িটা বিস্ময় চোখে তাকিয়ে দেখছে হৈমী। হঠাৎ মৃদু চিৎকার করে বলল,
-” ভাইয়া তোমার শশুর তো হেব্বি বড়োলোক!”
মাহের চোখ রাঙিয়ে বলল,
-” ভাষা ঠিক করো। ”
জিব কেটে হৈমী বলল,
-” সরি সরি তোমার শশুর তো ভীষণ বড়োলোক! কতবড়ো বাড়ি। ”
বলেই কাছে এসে ফিসফিস করে বলল,
-” আচ্ছা ভাইয়া ভাবির কোন ভাইটাই নেই? ”
-” চুপপ হৈমী… সূচনা আসছে কন্ট্রোল করো নিজেকে। নয়তো কানে ধরে বাড়ি নিয়ে যাব। ”
হৈমী দমে গেল। বিরবির করে বলল,
-” বয়েই গেছে ভাবির ভাইদের সঙ্গে লাইন মারতে। মরেছি গুন্ডা দেখে বেয়াই টেয়াইয়ের ভাত আছে নাকি হুহ! ”
সূচনা এসে গেটের তালা খুলতেই হৈমী হৈহৈ করে ওঠল। দৌড়ে এসে সূচনাকে জড়িয়ে ধরল। সূচনা ভয় পেয়ে দু’কদম পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু হৈমী তাকে জাপ্টে ধরায় পড়ে যায়নি। হৈমী খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
-” উফফ ভাবি তুমি কী সুন্দরী গো! তোমার ননদিনীও কিন্তু কম সুন্দরী না… আগে আমাকে দেখোতো দেখে বলোতো পছন্দ হয়েছে কিনা? ”
মাহের দ্রুত এসে হৈমীকে ধমক দিলো। সূচনা বলল,
-” ইস ধমকাচ্ছেন কেন? আমার তো ভালোই লাগছে। ভেতরে আসুন। হৈমী ভেতরে গিয়ে কথা বলি আমরা।”
এমন সময় একটি গাড়ি এসে থামল গেটের সামনে। মুহূর্তেই ডোর খুলে বেরিয়ে এলো রুদ্র! সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠল হৈমী। সূচনার এক বাহু জড়িয়ে ধরে বলল,
-” সর্বনাশ! গুন্ডাটা আমার প্রপোজাল পাওয়ার পর থেকে নিশ্চয়ই আমাকে ফলো করছে। নয়তো তোমার বাড়ি চিনল কীভাবে? ভাবি, এটা আমার ক্রাশ তাই বোধহয় বাঁশ দিতে এসেছে প্লিজ বাঁচাও আমায়। ”
চলবে…
জান্নাতুল নাঈমা