মনমুকুরের প্রতিচ্ছায়া,পর্ব: ০১
~আরিফুর রহমান মিনহাজ
‘এমন কালা মাইয়্যা পেটে ধরলাম কেমন করে? আঁ? চেহারায় না আছে মায়া না আছে দয়া। তার উপ্রে আছে খালি জামাই বাছনের মইদ্যে।’
রসুইঘরে পিঁড়ি পেতে বসে ধুন্দল কুচি-কুচি করতে করতে অন্দরে থাকায় বড় মেয়ের উদ্দেশ্যে কথাগুলো ছুঁড়েন মরিয়ম বেগম। পাশেই একটা চাটাইয়ে বসে হামানদিস্তা দিয়ে ঠুংঠাং শব্দ তুলে পান গুড়ো করে নিচ্ছিল মরিয়ম বেগমের অশীতিপর বৃদ্ধা শ্বাশুড়ি। তিনি কাঁপাকাঁপা গলায় বললেন, আমি কইতেছি বউ, এই মাইয়্যার ঝামেলা আছে। নইলে এমন উপযুক্ত পোলারে বিয়ে করলে সমইস্যা কী? তার লাইগা কি রাজপুত্তুর আইবো নাকি? ওর বয়সে থাইকতে আমি তিন পোলার মা হইয়া গেছিলাম।
মরিয়ম বেগম শ্বাশুড়ির কথায় সায় দিয়ে যোগ করলেন,
– নিজের চেহারাডা আয়নায় দেখছে ও কোনোদিন? এরচেয়ে ভালো পোলা সে কেমনে আশা করে? এ্যাঁ?
শ্বাশুড়ি এবার হামানদিস্তার টুংটাং থামিয়ে ঠোঁট উল্টে বলে,
– আমার চোদ্দগুষ্টিতে এমন কালা মাইয়্যা হয়নাই। তুই অবশ্যিই কোনো পাপ করছিলি,তাই এইডা আল্লার অভিশাপ।
শ্বাশুড়ির কথায় ক্ষোভে দুঃখে মরিয়ম বেগমের কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। নিজের আটপৌরে সংকীর্ণ মনে পুঞ্জীভূত সকল খেদ ঝেটিয়ে বিদেয় করতে সখেদে তিনি বড় মেয়ের উদ্দেশ্যে বিষবাক্য প্রয়োগ করতে থাকেন। সেসব বিষবাক্য আর তার শব্দচয়ন লিখে প্রকাশ করার মতো সভ্য নয়।
মরিয়ম বেগমের বয়স চল্লিশের ঘরে। সংসারের নিরবচ্ছিন্ন কর্মযজ্ঞে শরীরের নিটোল বাঁধুনি ঢিলে হয়ে এলেও বুঝা যায় চেহারায় জৌলুশ-চেকনাই ছিল একসময়। আজ মরিয়ম বেগম তার মেয়ের ওপর বেজায় ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন। অনেকদিন পর একটা ভালো সম্মন্ধ এসেছিল। ছেলে দুবাই প্রবাসী। বিস্তর টাকাপয়সার মালিক। বউবাচ্চা ছিল একসময়। খাসলত খারাপ হবার কারণে বউ পরপুরুষের সঙ্গে ভেগে গিয়ে আলাদা সংসার পেতেছে। মরিয়ম বেগম শুনেছে ছেলে নাকি টুকটাক নেশা-ভাঙ করে। তা বেটাছেলের ওসব দু’একটা দোষত্রুটি থেকে থাকে, এ আর তেমন গ্রাহ্যির কী? কিন্তু মেয়ে বিয়েতে ‘না’ করে দিল। ছেলেকে নাকি তার পছন্দ হয়নি। বয়স অনেক বেশি! নেশা করে,এমন ছেলেকে সে মরে গেলেও বিয়ে করবে না। একটু আগেই মরিয়ম বেগমের কাছে এসে ধানাইপানাই করে প্রস্তাবটা নাকোচ করেছে মেয়ে। একপর্যায়ে কথায় কথায় মেয়েকে একটা পাতিল ছুঁড়ে মেরেছিল। সে থেকেই মরিয়ম বেগম একের পর এক বিষবাক্য প্রয়োগ করে যাচ্ছেন। উঠতি মূলো নাকি পত্তনে চেনা যায়;এই মেয়ের শৈশবকালেই বুঝা গিয়েছিল বড় হয়ে সে জনক-জননীর অন্তরটিপুনির কারণ হবে। ঘুরিয়ে-বাঁকিয়ে এসব কথা বলতে বলতেই মরিয়ম একটু দম নেন। চরম বিরক্তি নিয়ে অধর ঝুলিয়ে কী ভাবেন কে জানে. পরক্ষণেই আবার চেঁচিয়ে উঠেন অন্দরের দিকে চেয়ে,
– দরোজা লাগাইয়া আ-র ঢং করা লাগবে না। রান্নাঘরে আয়। মুসর ডাল আর চাল ধুইয়া আন তাড়াতাড়ি।
ক্ষাণিক পর অন্দরমহল থেকে ধীরেসুস্থে বেরিয়ে আসে মরিয়ম বেগমের বড় মেয়ে ওয়াসিফা আনিকা। বয়স চব্বিশ। দেহের বেড়-বাঁধুনি সাধারণ বাঙালি রমণীর চেয়ে উন্নত ও দীঘল। গায়ের রং শ্যামল-কালো। গোলগাল মুখশ্রী। ঝকঝকে মসৃণ-কালো কপালের নিচে একজোড়া দীঘল-টানা হরিণী চোখ। ঈষদুন্নত নাক। ঠোঁটজোড়া নিটোল নয়, পাংশুটে গাঢ় বাদামি বর্ণের৷ সুবিন্যস্ত দন্তরাজির ফাঁকে হঠাৎ চোখে পড়ে নিচের পাটিতে ঘাপটি মেরে থাকা ঈষৎ বঙ্কিম একটি গজদন্ত! মুখভর্তি শব্দ করে কথা বললে, হাসলে সেটি সগৌরবে বেরিয়ে আসে। যার ফলে কোথা থেকে যেন একধরনের মায়ার আবেশ ছুটে আসে ওর কালো মুখে। কারো কারো চোখে সেসময় ওকে সুন্দর দেখায়। আসলেই সুন্দর দেখায় কি-না এনিয়ে আনিকার মনে বেশ জোরালো সন্দেহ রয়েছে। সে ভাবে, তার নীরস সৌন্দর্যহীনতাকে চেপে যাওয়ার জন্য কেউ কেউ সৌজন্যতা দেখিয়ে ওর গজদন্তহাসির প্রসংশা করে। আদপে,প্রশংসা করার মতো কোনো রূপ সৃষ্টিকর্তা তাকে দেননি। আনিকা মফস্বলের একটা কলেজ থেকে একাউন্টিং-এ গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেছে এই বছর। পরিবারের কেউই জতার পড়াশোনা নিয়ে বিশেষ সন্তুষ্ট ছিল না,পরন্তু,ওর পড়াশোনাকে অহেতুক বিবেচনা করে অনেকবার বাদ দেওয়ার জোরালো প্রস্তাবও উঠেছে। কিন্তু আনিকাই নিজের উদ্যোগে পাড়াগাঁয়ে দু-তিনটে টিউশনি করিয়ে কোনোমতে নিজের পড়াশোনার খরচ জুগিয়েছে, কখনো-বা কুলিয়ে উঠতে না পেরে বাবার কাছে হাত পেতেছে। ওর বাবা সজল আহমেদ ভীষণ গুরুগম্ভীর ও ঠান্ডা মাথার মানুষ। কখনো মিষ্টি করে দু’টো কথা বলেছেন বলে মনে পড়ে না। কালেভদ্রে আনিকা টাকা চাইতে এলে তিনি হিমশীতল কণ্ঠে বলতেন,
– কেন শুধুশুধু টাকা নষ্ট করতেছ? কী হবে এতদূর পড়ে? রেজাল্ট তো আহামরি কিছু না! মমিতাকে দেখ,পিএসসি থেকে শুরু করে এইচএসসি পর্যন্ত গোল্ডেন এ প্লাস। পাবলিকে ম্যাথমেটিক্সের মতো সাবজেক্ট নিয়ে পড়তেছে। তুমি কীসের পেছনে ছুটতেছ?… কত টাকা লাগবে?
আনিকা আমতাআমতা করে টাকার অঙ্কটা বলতো…। এভাবেই টেনেটুনে গ্রাজুয়েশনটা সে শেষ করেছে। বস্তুত,ছোটবোন মমিতার সঙ্গে আনিকা কখনোই প্রতিযোগিতায় যায়নি। মমিতার যেমন রয়েছে স্বর্গীয় রূপ,তেমনি ওর পড়াশোনার মেধা,তেমনি চালচলন,কথাবার্তার দূরদর্শী সম্মোহনী ক্ষমতা…।ওর সঙ্গে লাগতে যাওয়ার দুঃসাহস আনিকা কখনোই করেনি।
অন্দর থেকে বেরোতেই মায়ের সঙ্গে একবার দৃষ্টি বিনিময় হয় আনিকার। মায়ের বিরক্তিসূচক বিষদৃষ্টি হজম করে একটা নির্ভার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রন্ধনশালায় ঢুকে পড়ে সে। এই আধপাকা রান্নাঘরটা নতুন করে বাঁধা হয়েছে। দেয়ালের পলেস্তারার মন্দীভূত কাঁচা গন্ধটা এখনো নাকে লাগে। এমনিতে অবস্থাপন্ন গৃহস্থ হলেও রান্নাঘরটা পুরনো হালের নিদর্শনসরূপ বাঁশের বেড়ারই ছিল এতকাল। সম্প্রতি মরিয়ম বেগমের তৎপরতায় পুরাতন রান্নাঘরটা ভেঙে নবায়ন করাসহ মূল বাড়ির জঙধরা টিনের চালগুলি পাল্টে আধুনিক রঙিন টিনের চাল বসানো হয়েছে।
রসুইঘরের এককোনায় মাঝারি আকারের একটি ড্রাম। সেই ড্রাম থেকে মেপে মেপে চার সের চাউল ডেকচিতে ঢেলে নেয় আনিকা। পাশের আরেকটা বয়াম থেকে একটা গামলায় কিছু মুসরডাল ঢেলে নিয়ে দু-হাত ভর্তি করে ছুটে যায় পুকুরপাড়ে। আনিকার অপ্রস্তুত দ্রুততাকে দম্ভ আর জেদ মনে করে মরিয়ম বেগমের যজ্ঞের আগুনে যেন ঘৃতাহুতি হয়। দপ করে জ্বলে উঠে তার চোখজোড়া। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যান তিনি। আনিকা না দেখেও সব বুঝতে পারে। নিজেকে খুবই নস্যি মনে হয় তার। হীনম্মন্যতায় বুকের ভেতরটা ভেঙে খানখান হয়ে যায় যেন!
পুকুরপাড়ে এসে আনিকা দেখে তার ছোটবোন মমিতা ঘুমফোলা চোখে কাষ্ঠনির্মিত ঘাটলায় বসে পুকুরের শান্ত জলে পা ডুবিয়ে বসে আছে। ওর মসৃণ-ঘন চুল ছড়িয়ে আছে পিঠময়। আনিকা একবার মনভরে দেখে নেয় বোনকে। ফরসা গায়ের রং। নিখুঁত,মায়াবী মুখের আদল। দোহারা নধরকান্তি দেহাবয়ব! মনোহারি চোখ, ঘন-বঙ্কিম চোখের পল্লব;শিল্পীর আঁকা ছবির মতো সুন্দর-সুচারু ভুরু। ওর যেদিকেই তাকায় সেদিকেই যেন অন্তহীন সৌন্দর্যের জয়জয়কার দেখতে পায় আনিকা। আড়ালে-আবড়ালে লোকে বলে,একই গাছে সুগন্ধময় গোলাপ আর নামগন্ধহীন বুনোফুল ফুটল কী করে?
বুনোফুল গোলাপকে দেখেই বলে উঠল,
– কীরে উঠলি এতক্ষণে? আজ শুক্রবার সে খেয়াল আছে? ফজরের নামাজের সময় এতো করো ডাকলাম তোকে। উঠলি না!
মমিতা জবাব দিল না কোনো। আনিকা জবাবের অপেক্ষা না করে চাল ধুতে গেলে গেল। সে জানে, তার বোনটা ভার্সিটিতে উঠার পর থেকে সঙ্গদোষে বখে যাচ্ছে। কলেজে কখনো বোরকা আর কখনো হিজাব-এপ্রোন মুড়িয়ে গেলেও এখন খোলাচুলে, ঠোঁটে কড়া লিপস্টিক মেখে যায়। সেখানে গিয়ে একপাল ছেলেবন্ধুর সঙ্গে ঘুরঘুর করে সারাদিন,নামাজকালাম তো কবেই ছেড়ে দিয়েছে। পাড়ার লোকে বাবার কাছে এসে বিচার দেয়,সজল আহমেদ আদরের মেয়েকে কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারেন না। মমিতা বলে উঠল,
– কী হইছে? মা সকাল সকাল চিল্লাইতেছে ক্যান? নাকি এটাও রিজেক্ট?
বলে দাতকেলিয়ে হাসল সে। আনিকা ওর দিকে একপলক স্থিরভাবে তাকিয়ে ছোট করে বলল,
– হুম। রিজেক্ট। এরকম মদখোর দুলাভাই পেয়ে তুই বোধহয় খুশি হইতি?
– আর দুলাভাই! আচ্ছা আপা তুই কেমন পাত্র চাস বলতো?
মমিতার কথায় কেমন একধরনের হেয়-করা সুর খুঁজে পায় আনিকা। তবুও সেটা পাত্তা না দিয়ে বলল,
– আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নাই। শুধু সচ্চরিত্র হলেই চলবে৷
– কী মনে হয়? পাবি?
– আল্লাহ যদি কপালে রাখে…
– আচ্ছা ধর। তোর চোখে একটা মানুষ সচ্চরিত্র। হুম? কিন্তু তার বয়স চল্লিশ প্লাস। বিপত্নীক। তুই রাজি হবি?
আনিকার ততক্ষণে চাল-ডাল ধোয়া হয়ে গেছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে একপলক ওর দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল,
– হবো।
বলেই আনিকা আর দাঁড়ালো না। পুকুরঘাট বেয়ে উঠে রসুইঘরের দিকে যাত্রা করল। পেছন থেকে মমিতার কৌতুকপূর্ণ কণ্ঠে শোনা গেল,
– কী বলিস। হবি? দুইদিন পর ব্যাটা যখন বুইড়া হয়ে মরে ভূত হবে তখন তোর কী হবে? একলা একলা থাকতে পারবি? ওই… বলে যা।
২
আনিকার জন্য ভালো সম্মন্ধ যে আসে না তা নয়। আসে,কিন্তু সেটা কদাচিত এবং নানাবিধ শর্ত নিয়ে আরোপিত হয়। পাত্রপক্ষে সেসব লোলুপ শর্ত পূরনের জন্য বিন্দুমাত্র চাড় নেই সজল আহমেদের। মরিয়ম বেগম দিনমান দশজনের কথায় অতিষ্ঠ হয়ে ঘ্যানঘ্যান করে স্বামীর সঙ্গে,
– দিয়ে দাও। ওমন মেয়েকে যৌতুক ছাড়া কে বিয়ে করবে? এমন ভালো পাত্র হাতছাড়া করা ঠিক হবে না৷
মরিয়ম বেগমের কাছে ল্যাংড়া,কানা,মদখোর সব পাত্রই সুপাত্র, কাজেই সজল আহমেদ বউয়ের বাচনিক জলোচ্ছ্বাসকে বিশেষ পরোয়া করেন না! তিনি নিজের সিদ্ধান্তে নির্বিকার এবং অবিচল থাকেন। বাবার নিরাগ্রহে আনিকার মন কখনো-বা টনটনিয়ে উঠে ;আবার কখনো বা নিজের প্রথাগত শিক্ষিত-সচেতন মনের তাড়নায় এই ভেবে সান্ত্বনা পায় যে,যৌতুক দেওয়া-নেওয়া দু’টোই অপরাধ!
আনিকার বাল্যকাল আর কিশোরবয়সের পুরোটা সময় কেটেছে নানারবাড়িতে। মমিতা জন্মের পর ঝক্কিঝামেলার দোহাই দিয়ে মরিয়ম বেগম তাকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নানীর কাছে। সেখানে থাকাকালীন মেয়ের খোঁজখবর খুব একটা নিতেন না তিনি। আনিকা ছিল বেশ উচ্ছল প্রকৃতির। তবে বেপরোয়া নয়। সর্বদা হাসিখুশি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর পয়মন্ত একটা মেয়ে হিসেবেই তার বেড়ে ওঠা। নানীর আকস্মিক মৃত্যুর পর মামাদের অবর্তমানে মামীরা তাকে খুব একটা খাতির করতো না। পান থেকে চুন খসলেই অশ্রাব্য গালিগালাজ কিংবা মারধরও জুটত কপালে। ক্রমেই যখন সে নানাবাড়ির অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল তখন একদিন সে বড় মামার দরবারে ধরনা দিয়ে বলল,
‘আমি আর এইখানে থাকব না মামা, আমি বাড়িতে চলে যাব। মা’র কাছে যাব। ’
সে-ই থেকে আনিকা তার আপন নীড়ে। কিন্তু এ যে কেবল কলির সন্ধ্যা তা কি আর কিশোরী আনিকার বোধিতে ছিল? বুকভরা আশা নিয়ে আপন নীড়ে ফিরে আনিকা দেখল,সবকিছু কেমন যেন বদলে গেছে,অচেনা হয়ে গেছে। মা-বাবা-দাদী আর কদাচিত আগত আত্মীয়স্বজনের খুশি-উচ্ছ্বাসের ফোয়ারা তখন হৃষ্টপুষ্ট সুন্দরী বালিকা মমিতাকে ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে। মা সারাদিনের কাজকর্মের ফাঁকে আদুরে গলায় বারবার ডাকছে মমিতাকে। দাদী হামানদিস্তা দিয়ে দিয়ে পান গুড়া করতে করতে গুনগুন করে পুরোনোদিনের গল্প শুনিয়ে যাচ্ছে। মমিতা খুশিতে আটখানা হয়ে বলছে,
– তারপর কী হল দাদু?
আনিকা কখনো যদি অতিউৎসাহী হয়ে চুপিসারে দাদীর আসরে বসতো, দাদী মাথাবাঁকানো বেতের লাঠিটা নিয়ে মারমুখো ভঙ্গি করে বলত,
– এত্তবড় মাইয়া হইছস। মায়রে কিছু উজায়বাড়ায় দিতে পারস না? সারাদিন খালি ঢ্যাং-ঢ্যাং আর খাওন। যা এহানথে…।
রাতে বাবা ফিরলে দরাজ কণ্ঠে হাঁক ছাড়তেন,মমিতা কোথায়!আমার মমিতা।—দেখ তোমার জন্য কী আনছি। প্রথম প্রথম কৌতূহল দমাতে না পেরে আনিকা নিজেও পর্দার আড়াল থেকে উঁকি দিত। সজল আহমেদ মেয়েকে দেখেও যেন দেখতেন না৷ আপনমনে মমিতাকে আদর করতেন৷ পেছন থেকে মা এসে দুম করে একঘা বসিয়ে দিয়ে বলত,
– যা ঘুমা। সকালে যেন বেশি ডাকাডাকি করন না লাগে।
উৎসবে-পার্বণে,বিয়ে-মজলিশে আনিকাকে নিজের গর্ভজাত সন্তান বলে পরিচয় দিতে মরিয়ম বেগম যেন লজ্জায় মরে যেতেন। বহুকষ্টে ঠোঁটের কোণে নিস্পৃহ হাসির রেখা জাগিয়ে বলতেন,
– হ্যাঁ,আমার মেয়ে। বড়টা…।
এরপর সুযোগ বুঝে মেয়ের নরম-কচি হাতখানি শক্ত করে চেপে ধরে একপাশে নিয়ে যেয়ে বলতেন,‘ কতবার বলছি কোথাও গেলে সারাদিন গেছনে পেছনে ঘুরবি না! ছেলেমেয়েদের সাথে খেলতে পারস না?’
বয়স বাড়ার সাথে সাথে ধীরে ধীরে সমস্তই বুঝতে পেরে যায় আনিকা। আর বুঝতে পেরেই ওর সমস্ত কৈশোরক আনন্দ-উচ্ছলতায় ভাটা পড়ে যায়। মনের নদীতে উচ্ছ্বাসের যে ধারা বয়ে যেত অবিরাম সে ধারা অকালেই শুকিয়ে যায়। জেগে উঠে চর। সেই ধূ-ধূ চরের বুকে একলা-একায়,নিঃসঙ্গে মনখারাপের ঝাঁপি খুলে বসে আনিকা।
ছোট থেকেই সবার আদরে আদরে মমিতা হয়ে উঠেছিল দুর্বার, দুর্বিনীত স্বভাবের। কোনো কথাই তার মুখে আটকাতো না। কিশোরকাল পেরিয়ে আনিকা যখন যৌবনে প্রারম্ভে মমিতা তখন কৈশোরের মধ্যগগনে। ওর রূপের তেজোদৃপ্ত ছটা এরিমধ্যেই চারিপাশকে ভীষণভাবে আলোকিত করেছে। আয়নায় সে নিজেকে দেখে নানান ভঙ্গিমায়। ঘন্টার পর ঘন্টা সময় ব্যয় করে নিখুঁতভাবে সাজে। রোজ নিয়ম করে ওর কাছে আসা প্রেমপত্রগুলোকে সে রুমের দ্বার রুদ্ধ করে পড়ে শোনায় আনিকাকে। আনিকা বলে,
– ভুলেও এসবে পা দিবি না। পড়াশোনা কর মন দিয়ে। তাতেই হবে।
– উঁহু হবে না, অসম্মতি জানিয়ে মাথা ঝাঁকায় মমিতা,জীবনে সবকিছুর দরকার আছে৷ তুই তার কী বুঝবি বল? তোকে কেউ পছন্দই করবে না৷ তুই নিজেও করতে পারবি না। কারণ তোর নিজের ওপর সেই আস্থা নাই। সারাদিন তো থাকিস ভূতের মতো মুখ করে। কলেজে যাস হুজুরনির মতো বোরকা,হাত মোজা,পা মোজা পরে। আচ্ছা একটা কথা বলতো আপা,তুই কি পর্দা করার জন্য এসব পরিস,না-কি নিজেরে ঢাকার জন্য? তোর কি ইচ্ছে হয় না,ছেলেরা তোকে দেখে একটু অবাক হয়ে তাকাক, তোকে দেখে বন্ধুর সঙ্গে চিমটাচিমটি করুক!
আনিকা নির্বিকার, দায়সারা জবাব দেয়,
– বড় হ মমিতা। আস্তে আস্তে সব বুঝবি৷
মমিতা আর কিছু না বলে ঠোঁট উলটে দাম্ভিক হাসি হাসে।
সময় গড়িয়েছে। কলেজ পেরিয়ে মমিতা এখন ভার্সিটিতে। কৈশোরের নমনীয় সৌন্দর্যের আবরণ উঠে গিয়ে ওর শরীরের ভাঁজে ভাঁজে এখন যৌবনের উদগ্র শোরগোল! সময়ের সঙ্গেই জ্যামিতিক হারে বেড়েছে ওর চালচলনের ঔদ্ধত্য, বাচনিক হামবড়াই। ডজনখানেক বয়ফ্রেন্ড সে ইতোমধ্যেই ধরেছে আর ছেড়েছে। কাউকেই তার মনপুত হয়নি,কেউই তার যোগ্য না। অপরদিকে আনিকা শামুকের মতো নিজের চারিপাশে শক্ত আবরণ তৈরি করে নিয়ে নিজেকে সবকিছু থেকে সন্তর্পণে গুটিয়ে নিয়েছে। গ্রাজুয়েশনের পর নামকাওয়াস্তে থাকা বান্ধবীগুলোও এখন যে যার মতো করে থিতু হয়ে যাচ্ছে, কারো বা বিয়ে হয়ে যাচ্ছে যোগাযোগও বড় একটা হয় না৷ এদিকে বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্য কায়মনে চাইছে আনিকাকে কোনোমতে এই বাড়ির চৌকাঠ থেকে বের করে স্ব স্ব দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেতে৷ কিন্তু তার খাপছাড়া রূপের কারণে সেটি বাস্তবিকপক্ষেই সহজতর হচ্ছে না। আনিকাও মনে মনে বদ্ধপরিকর,প্রয়োজনে এবাড়ির বন্ধনরজ্জু ছিন্ন করে দিশাহীন পথের পথিক হবে,তবু বাবা-মায়ের ঠিক করা কুপাত্রের সঙ্গে সে বিয়ের পিড়িতে বসবে না৷ তার পড়াশোনা আছে,চারিত্রিক দৃঢ়তা আছে,ইস্পাতকঠিন সংকল্প আছে; এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলে কি দু’টো খেয়েপড়ে বেঁচে থাকার মতো অর্থোপার্জন সে করতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। এই জীবনে না-ই বা হলো তার নিজের একটি সংসার,নাই-বা থাকল একান্ত দুঃখগুলোর হিসসাদার।
৩
এরপরের কয়েকমাসে আরো কয়েকটা সম্মন্ধ একেবারে বিয়ের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে ভেস্তে দেয় আনিকা। এদের কেউ লুচ্চা-বদমাশ;প্রথম সাক্ষাতেই চশমখোরের মতোন আচরণ করেছে আবার কেউ বিরাট বিত্তবান,কিন্তু ঘুষখোর,সুদখোর, কিংবা অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। আনিকার মতো ছাইকে ফেলতে ভাঙা কূলোকেই যেন বারবার প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। শেষবার সম্মন্ধটা ভেঙে দেবার পর একদিন রাতে সজল আহমেদ ভীষণ রেগেমেগে মেয়েকে ডেকে পাঠালেন। আনিকা বাবার ঘরে এসে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল। সজল সাহেব কোনো ভূমিকা না করেই শুরু করলেন,
– কী সমস্যা তোমার? সারাজীবন কি এভাবেই বাপের ঘাড়ে বসে কাটায় দিবা বলে ভাবছ নাকি?
আনিকা কিছু বলতে গিয়েও ঢোক গিলে চুপ করে রইল। শান্তশিষ্ট সজল সাহেব ধৈর্যহারা হয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন,
– তোমার সাথে কথা বলতেছি। জবাব দাওনা ক্যান? এই পাত্রের তো কোনো দোষ দেখলাম না আমি। পাইসটা কী তুমি? হ্যাঁ? নিজের কথাই খালি ভাববা। আমাদের কথাও তো ভাবতে পার একবার! লোকের কথা শুনতে শুনতে তো কান পঁইচা গেল।
আনিকার বুকের পাঁজর ঠেলে দুর্নিরোধ্য কান্নার দমক উছলে উঠতে চাইল। বাবার এই মূর্তি,এই গনগনে উষ্ণ গলার সুরের সঙ্গে আগে কখনো পরিচয় ঘটেনি তার। হ্যাঁ,বাবার আদর সে কখনো পায়নি বটে,কিন্তু বাবার হাতে সরাসরি নিগৃহীত হবার ঘটনাও ইতোপূর্বে ঘটেনি। মমিতার বেলায় বাবা যেমন সদাসর্বদা বাক-বাকুম করে উঠে,আনিকার বেলায় এরচেয়ে বেশি নিস্পৃহ হয়ে থাকেন তিনি। সুযোগে পেলে মৃদু ভর্ৎসনা করেছেন,তবে আদর কিংবা অনাদর কোনটিই তিনি কখনো প্রকাশ করেননি। আনিকা এবার মাথা তুলে নীচু অথচ শক্ত গলায় বলল,
– ছেলেটা দেখা করতে এসে আমার সাথে…আমার সাথে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছে। আমার গায়ে হাত দিসে।বাজে কথা বলসে।
সজল আহমেদ এবার ধপ করে বসে পড়লেন। অসহিষ্ণু ভঙ্গিতে ডানে-বামে একবার মাথা নেড়ে বললেন,
– আমি তোমার কথা কোনোভাবেই বিশ্বাস করতে পারতেছি না৷ এই ছেলে এরকম হতেই পারে না।
– ঠিক,উঁচু স্বরে বলে উঠলেন মরিয়ম বেগম,এই ছেলে সবদিক থেকে ভালো। তুই মুখপুরী বানায়ে বানায়ে পরের ছেলের নামে মিছাকথা বলতেছস। সে যে তোর মতো কাইল্যা একটা মাইয়্যারে দেখে পছন্দ করসে এইটাই তো তোর সাতজনমের ভাগ্য৷
বলতে বলতে হিংস্রভাবে দাঁতে দাঁত পিষতে লাগলেন মরিয়ম বেগম। দেখে মনে হচ্ছে, এই বুঝি ক্রোদোন্মত্ত হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে মেয়ের ওপর। কিন্তু নাহ,মেয়ের বয়স সত্যিই অনেক বেশি হয়ে গেছে। পঁচিশ-ছাব্বিশ বছরের একটা মেয়ের গায়ে হাত তুললে লোকে মন্দ বলবে৷ তাছাড়া, কয়দিনই বা হয়েছে এই মেয়ের ওপর নিত্য নিত্য সংসারের যাবতীয় আক্রোশ মিটিয়ে পিটিয়ে আধমরা করেছেন। সজল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এমনসময় মমিতার কণ্ঠ শোনা গেল। পাশের ঘর থেকে ঘুমজড়ানো চোখে সে রঙ্গমঞ্চে আবির্ভূত হয়েছে।
– কী হইছে মা? এই রাইতবিরাইতেও তোমার চিল্লানি লাগবে? শান্তিমতো ঘুমাইতেও দিবা না? আর আপা, বিয়েতে তোর কী সমস্যা বলতো? লেসবিয়ান-টেসবিয়ান না তো আবার? নাকি নিজেরে ঐশ্বরীয়া রায় ভাবস? নায়কের মতো জামাই লাগবে! দোষগুণ মিইলাই তো মানুষ৷ একটারে ধইরা বিয়া করে বাড়িটারে একটু এবার শান্তি দে!
কথাগুলো বলে যেমন ঝড়ের মতো আকস্মিকভাবে মমিতা এসেছিল,তেমনভাবেই ফিরে গেল। নিজের রাগ প্রকাশ করতে দড়াম করে বন্ধ করল দরোজাটা।
এই সম্মন্ধটাও নাখোশ হয়ে ফিরে গেল। সজল সাহেব বুদ্ধিমান মানুষ। এই যুগে এসে যতই হম্বিতম্বি করুক,মেয়ের মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে দেওয়াটাতে তিনি যথোপযুক্ত মনে করেন না৷ আজকাল মেয়েরা কথায় কথায় লটকে পড়ে। আজ বাদে কাল যদি একটা সাংসারিক কলহের জেরে মেয়ে তার গলায় দড়ি দিয়ে বসে তাহলে দীর্ঘস্থায়ী একটা তুষের অনল তার বক্ষপিঞ্জরে প্রজ্জ্বলিত হবে। আমৃত্যু সেই তীব্র হলাহল থেকে তার মুক্তি হবে না। এদিকে মেয়ের বয়সও বেড়ে চলেছে তড়তড়িয়ে। কালো মেয়ের বিয়ের বাজার মন্দা এটা তিনি ভালোমতোই জানেন। অন্যদিকে মমিতাও সোমত্ত হয়ে উঠেছে। তারও বিয়েসাদীর কথা চিন্তা করা দরকার। কাজেই আনিকাকে আশু পাত্রস্থ করাটা খুবই জরুরি।
সজল আহমেদের বাজারে একটি হার্ডওয়্যারের দোকান আছে। ব্যবসা ভালোই জমজমাট থাকে। যৌবনে শহরের একটা হার্ডওয়্যারের দোকানে চাকরি করে ধীরে ধীরে এই ব্যবসাটাকে বেশ ভালোভাবেই আয়ত্ত করে নিয়েছিলেন তিনি৷ পরে নিজেই একটা দোকান খুলে বসেছিলেন অল্প মূলধনে। তিরিশ বছরের ব্যবধানে ক্রমে ক্রমে সেই দোকানটা বাজারের সবচেয়ে বড় ও সফল হার্ডওয়্যার দোকানে পরিণত হয়েছে। লোকে একনামে চিনে। দুপুরবেলা নিজের ডেস্কে বসে হিসাবনিকাশ করছিলেন সজল সাহেব,ম্যানেজার মধ্যাহ্নভোজে গিয়েছে। তপ্ত ঝিমুনী দুপুরে ক্রেতা না থাকায় কর্মচারীরা দোকানের পেছনে গুদামের কাছে জড়ো হয়ে আড্ডায় মেতে উঠেছে। সিসিটিভি মনিটরে সেদিকে একবার তাকিয়ে সজল সাহেব পুনরায় মনোযোগ দিলেন হিসাবের খাতায়। হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন, মহল্লার মাদ্রাসার মুহতামিম,এলাকার বরেণ্য মুরব্বি মাওলানা মহিউদ্দিন সাহেব তার দোকানে প্রবেশ করছেন। তিনি ব্যতিব্যস্ত হয়ে সসম্ভ্রম উঠে গিয়ে হুজুরকে সালাম করলেন৷ আনন্দাতিশায্যে গদগদকণ্ঠে বললেন,
– হুজুর, কী মনে করে আমার দোকানে…।
পরক্ষণেই তিনি বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে লেবুর শরবত আনার হুকুম করে সহাস্য বদনে হুজুরের দিকে তাকালেন৷ মাওলানা সাহেব বয়োবৃদ্ধ মানুষ। চেহারাসুরতে স্বর্গীয় ঔজ্জ্বল্য বিদ্যমান। মেদহীন ঋজু দেহ। বয়স আশির কাছাকাছি হলেও শিরদাঁড়া এখনো সটান। মুখে শোভা পাচ্ছে ঝরঝরে-মসৃণ সফেদ দাড়ি। উঁচু করে পরা পাগড়ি গলে বেরিয়ে এসেছে কানের লতির অবধি সুদৃশ্য বাবড়ি চুল। পরনে ঢিলেঢালা জুব্বা।
সজল সাহেবের সামনে বসেই তিনি একটু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন,
– এসেছি তোমার কাছে একবার প্রস্তাব নিয়ে। আবদারও বলতে পার।
সজল সাহেব কিছু বুঝতে না পেরে বললেন,
– সে আমার সৌভাগ্য হুজুর৷ বলুন কী প্রস্তাব৷
– একটা ছেলে ছোটবেলায় আমার মাদ্রাসায় হাফেজ পড়ে উচ্চতর পড়াশোনার জন্য চট্টগ্রাম গিয়েছিল। আল্লাহর রহমতে এখন সে আলেম হয়েছে। আমার মাদ্রাসায় শিক্ষক হয়েছে আজ দুবছর হলো। বাবা-মা,বাড়িঘর কিচ্ছু নাই। মাদ্রাসায় পড়ায়,মাদ্রাসাতেই থাকে। কিন্তু খুবই ভালো ছেলে। অভিভাবকের দায়িত্বটা আমি নিয়ে ওকে একটা বিয়ে দিতে চাইলাম। আমার মুখের কথায় অনেক বাবাই মেয়ে দিতে রাজি হয়েছে। কিন্তু বাড়িঘর, আত্মীয়স্বজন কারো হদিশ না থাকার কারণে কেউই মন থেকে চায়না ছেলেটাকে। সেটা বুঝতে পেরে বেচারা ছেলেটাও আর আগাইতে চায়নাই। এছাড়াও ছেলে চায়,একটা দ্বীনদার মেয়ে,যেটা এখনকার যুগে অত্যন্ত বিরল বস্তু। আমারে বলল,‘বাদ দেন হুজুর, এই মাদ্রাসার খেদমত আর এলেম চর্চা করেই আমি জিন্দেগী পার করে দিতে পারুম। ঘরসংসার না হইলেও চলবো।’
আঘাত পাইলাম বেচারার কথায়। দুনিয়াতে সবকিছুর করনের দরকার আছে। অল্পবিস্তর শখ-আহ্লাদ কার নাই? এখন একজনের কাছে শুনলাম, তোমার বড় মেয়েটি কলেজে পড়লেও দ্বীনদার আছে,পর্দা করে চলে। নামাজ-কালামও পড়ে। তাছাড়া…কীভাবে বলি,আল্লার সৃষ্টি নিয়ে খুঁত ধরার দুঃসাহস করি না। শুনেছি,নানা কারণে তারও নাকি বিয়ে হচ্ছে না। এখন আমি চিন্তা করলাম, এই দুইটা ছেলেমেয়ে এক হলে মন্দ হয় না আল্লার রহমতে।
সজল আহমেদ রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছিলেন৷ এবারে মাওলানা সাহেবের প্রস্তাবে পিলে চমকে উঠলেন৷ এযাবৎকালে আনিকার জন্য যতগুলো প্রস্তাব এসেছে সবগুলো আউলাঝাউলা হলেও অর্থকড়ি কিংবা সামাজিক প্রতিপত্তির দিক দিয়ে মোটেও খাটো ছিল না৷ কিন্তু এই ছেলের তো বাড়িঘরই নেই! ওই ছোট পায়রার খোপের মতো মাদ্রাসায় চাকরি করে কত টাকা পায় সেটা সজল আহমেদের ভালোই জানা আছে। অথচ ওই পোড়ামুখী মেয়েটাকে এরচেয়ে সুপাত্রস্ত করা আশাও তিনি করেন না। ভালোই ধন্দে পড়ে গেলেন তিনি। তবু মুখে একঝলক তেলতেলে হাসি বজায় রেখে তিনি বললেন,
– অতি উত্তম প্রস্তাব হুজুর। ছেলেকে নিয়ে আপনারা আসুন। তারও তো পছন্দ-অপছন্দ আছে। আ… ছেলের বাড়ি কোথায় বললেন যেন?
– পৈতৃক বাড়ি তো নরসিংদী। বাবা-মা দু’জনে মারা যাবার পর ওর অনুপস্থিতিতে চাচারা সম্পত্তি দখল করে নেয়৷ উদ্ধারের চেষ্টা করছিল,লাভ হয়নাই। তাছাড়া ছেলের তো দুনিয়াবি কোনো মোহ নাই। তাই ওসব নিয়ে দৌড়াদৌড়িও করেনাই। আল্লার ওয়াস্তে মাফ করে দিছে।
– আচ্ছা,আচ্ছা।
খুব বুঝদারের মতোন মাথা ঝাঁকালেন সজল সাহেব। মাওলানা সাহেব কনেদেখার একটা দিনক্ষণ ঠিক করে তার খাদেমকে নিয়ে প্রস্থান করলেন।
চলবে..