#প্রণয়ের_তৃষ্ণা-০২,০৩
অলিন্দ্রিয়া রুহি
০২
_____
দূরের মসজিদে মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে। একটা ঝোপের আড়ালে কালু, রতন, শাপলা, গোলাপী আর পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দৃষ্টি কাচা রাস্তার উপর। এখান থেকেই আলু ভাই বাড়ি ফিরবে খুব সম্ভবত। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও আলু ভাইকে আসতে না দেখে পুতুল চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়লো, ‘ওই কালু, তোর ভাই এহনো আহে না ক্যা?’
কালু ঢোক চেপে বলল, ‘আমি কী জানি!’
‘তুই কী জানোস মানে? তোর ভাই, তুই জানোস না কোনখান দিয়া আহে যায়?’ মাথায় রাগ চড়ে বসেছে রীতিমতো। পুতুল কোমরে হাত গুঁজে বজ্রকণ্ঠে কথাখানি ছুঁড়ে দিয়ে আরেকবার রাস্তার উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বুলালো।
শাপলা বলল, ‘এই ছেড়া একটা কামও ঠিক করবার পারে না। ওর ভাইয়ের খোঁজটাও ঠিক মতো আইনা দিবার পারে না। আসলে আমগো ভুল হইছে। ওর সাহায্য করাডাই ভুল। সাহায্যের নাম ঘাড়ে লাত্থি..’
গোলাপী ঠাস করে কালুর মাথায় একটা গাট্টা বসিয়ে দিলো। কালু ফুঁপিয়ে উঠে। নিজেদের ভেতরই হট্টগোল লেগে যাচ্ছে দেখে রতন মুরুব্বির ন্যায় গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আরে সবাই চুপ যা। আর কতক্ষণ দেখি। আইলে আইবো, না আইলে যামু গা। আজান পইড়া গেছে। বেশি দেড়ি করলে মায়ে পুইতা হালাইবো।’
‘হ, হ, রতন ঠিক কথাই কইছে। আমারো বাড়িত যাওন লাগবো।’ বলে উঠে গোলাপী। শাপলাও সায় জানালো। পুতুল গরম চোখে কালুর চোরা মুখটার দিকে তাকাল। তার আঁচলের ভেতর ব্যাঙের বাচ্চাটা রীতিমতো লাফালাফি শুরু করেছে। আশেপাশে ব্যাঙও ডাকছে। হতে পারে,ওদের গলার স্বর শুনেই ও ছোটাছুটি লাগিয়ে দিয়েছে যাওয়ার জন্য। আরও পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করা হলো। আলু ভাই এলো না। আকাশের লালিমাটুকুও নিভে গেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার জড়িয়ে যাচ্ছে। পুতুল আঁচলের ভেতর থেকে ব্যাঙের বাচ্চাটা বের করে একপ্রকার আছাড় মেরেই ফেলে দিলো দূরে। যেন কালুর রাগটা ওর উপর ঝাড়া হলো। তারপর গমগমে সুরে বলল, ‘চল,সবটি বাসায় চল। আল্লাহই জানে,মায়ে মনে হয় কঞ্চি লইয়া বইয়া আছে।’
শাপলা প্রত্যুত্তর করে, ‘তোর ভয় কীয়ের? তোর বাপে তো আইয়া পড়ছে এতক্ষণে। হেয় থাকতে তোর গায়ে তোর মায় হাত দিবার পারবো?’
এতক্ষণে পুতুলের মুখে অল্প একটু হাসি ফুঁটে উঠল। সত্যি, সে তার বাবার বড় প্রিয়। তার বাবা যতক্ষণ ঘরে থাকে পুতুলের জোরই থাকে আলাদা। মা কিছু বলা তো দূর, গরম চোখে তাকানোরও সাহস পায় না। পুতুল তখন চড়ুই পাখির মতো ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ উড়ে,ঘোরে। তাকে শাসনের তখন কেউ থাকে না।
ওরা সবাই মিলে বাড়ির পথ ধরে। কালু মুখটাকে প্যাঁচার মতো করে রেখেছে। ভাগ্যিস অন্ধকার, নইলে সবাই দেখে হাসতো। যেতে যেতে ওরা কত কথা বলে। নীরব রাস্তাটা ওদের পদচারণায় সরগরম হয়ে উঠে। প্রথমে গোলাপীর বাড়ি আসে। সে চলে যায়। তারপরই রতন আর কালুর বাড়ি। পাশাপাশি। ওরা চলে গেলে শাপলা আর পুতুল হাত ধরাধরি করে হাঁটতে থাকে। ওদের দু’জনের বাড়িটা একটু দূরেই বলা চলে।
পুতুলকে একা পেয়ে শাপলার ইচ্ছে করে তার খুব গোপন কথাটি বলে দিতে। আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও কাউকে না দেখতে পেয়ে শাপলা ধীরে ধীরে ডাকে, ‘পুতুল, এই পুতুল..’
‘হুঁ..’ খানিকটা বিস্ময় নিয়েই তাকায় পুতুল। পাশাপাশি থেকেও কেন এত আস্তে কথা বলছে শাপলা? শাপলা ঈষৎ লজ্জায় লাল হয়ে উঠে। গলার স্বর আরও খানিকটা নিচে নামিয়ে নিলো। বলল, ‘আমার একটা খবর আছে।’
পুতুল তাকাল। অন্ধকারে শাপলার মুখাবয়ব স্পষ্ট দেখা না গেলেও তার বাচনভঙ্গি বুঝতে পারল। বিস্ময়তা লুকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী? বল।’
‘কথা দে,কাউরে কবি না। তুই আমার সই। তাই শুধু তোরেই কইতাছি।’
শাপলার এহেন কথায় বিস্ময়তা বাড়লো বৈ কমলো না পুতুলের। সে পূর্বের স্বরেই জবাব দেয়, ‘আচ্ছা,কমু না। তুই ক।’
‘আমার…’ শাপলা থামে, দম নেয়। লাজুক গলায় তারপর বলে, ‘আমার একটা ভালোবাসার মানুষ আছে বুঝছোস।’
পুতুল আকাশ থেকে পড়ে। হঠাৎ করেই পরিবেশ টা আরও চুপ হয়ে যায়। প্রথম কয়েক সেকেন্ড পুতুলের মুখে রা নেই৷ শাপলার কথাখানি ঠিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করে। তারপর ধীরে ধীরে বলল, ‘কী? কী কইলি?’
শাপলা থামলো। পুতুলের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। যথাসম্ভব নিচু গলায় বলল, ‘শাহীন ভাই আমারে পছন্দ করে। আমিও তারে পছন্দ করি। আমগো মধ্যে সম্পর্ক হইছে। হেয় আমার বাপের কাছে খুব শীঘ্রই বিয়ার প্রস্তাব দিবো রে। আমার যে কী খুশি লাগতাছে।’
প্রতিটি শব্দ উচ্চারণের সময় শাপলার গলা কেঁপে কেঁপে উঠে। সে পুলকিত বোধ করে। পুতুল নির্বাক হয়ে রইলো। পরমুহূর্তে সে নিজেও নিজের ভেতর একধরনের আলোড়ন অনুভব করল। নিজের বান্ধবীর খুশিতে নিজেও আত্মহারা হয়ে পড়ে। শাপলার দুই বাহু ঝাঁকি দিয়ে সে বলে উঠল, ‘সত্যি? সত্যি কইতাছোস? ভং দিতাছোস না তো?’
‘না, সত্যি। তিন সত্যি।’ শাপলার কণ্ঠে তখনো লাজুকতা।
‘আমার না বিশ্বাস হইতাছে না রে।’
‘ওর লগে কথা কবি? তাইলে কী বিশ্বাস করবি?’ শাপলার ভ্রু কোঁচকানো উত্তর।
পুতুল হেসে বলল, ‘না, লাগবো না। বিশ্বাস করছি। তুই আমারে এতদিন কস নাই ক্যান? আমার থেইকা লুকাইছোস?’
শাপলা অপরাধী কণ্ঠে উত্তর দেয়, ‘আমি বলতে চাইছিলাম কিন্তু হেয়ই আমারে মানা করছে। বলছে কাউরে না বলতে। মাইনষের নজর লাইগা গেলে সম্পর্কে ক্ষতি হয় নাকি। হেয় আমারে হারাতে চায় না। তাই কইছে বিয়া না হওয়া পর্যন্ত কাউরেই যেন কিছু না কই।’
পুতুল বুঝদারের মতো মাথা নাড়ায়, ‘হুম, বুঝছি। হেয় তোরে সত্যই ভালোবাসে রে। এই লইগা হারাইবার চায় না।’
‘হ রে। ভালোবাসা অনেক সুন্দর রে পুতুল,অনেক সুন্দর। তোরে বুঝাইবার পারুম না। যেদিন তুই কাউরে ভালোবাসবি, হেদিন বুঝবি। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি, তোর জীবনেও যেন একজন আহে। যে তোরে প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসবো পুতুল।’
‘যাহ! প্রাণের চাইতেও কেউ কাউরে বেশি ভালোবাসে নাকি?’
শাপলা পুতুলের চোখে চোখ রাখার চেষ্টা করে অন্ধকারে, নরম কণ্ঠে বলে, ‘বাসে রে বাসে। তোরেও বাসবো, কেউ না কেউ..’
পুতুল চুপসে যায়। তার মনে ধাক্কা খায় কথাটি। আচ্ছা,সত্যিই কী কেউ আসবে? তাকে ভালোবাসবে? আচ্ছা তার জীবন টা কেমন করে যাবে? পার হবে? সামনে কী কী অপেক্ষা করছে তার জন্য? কোথায় বিয়ে হবে,কার কাছে? যার কাছে হবে সে কী ভালোবাসবে? প্রাণের চাইতেও বেশি?
_____
বাড়ির ভেতর গুমোট পরিবেশ। পুতুল ভয়ে ভয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিলো। বাবা আর মা বসে আছেন। তারা কিছু একটা নিয়ে কথা বলছিলেন,পুতুলের উপস্থিতি টের পেয়ে চুপ করে গেলেন। পুতুল ঢোক চেপে একবার ডাকলো, ‘আব্বা।’
জবাবে পারুল খেঁকিয়ে উঠেন, ‘কই ছিলি? সারাটা দিন ঘুরঘুর করোস। আজানের আগে আগে বাসায় আইতে কই সবসময়,তাও কথা শুনোস না। তুই কী পণ করছোস, মায়ের কথা জীবনেও হুনবি না?’
পারুল বকে চলেন কিন্তু তার বকার ভেতর আজ তেজ নেই। গলার আওয়াজটাও ম’রা ম’রা। পুতুল অবাক হয়। এতক্ষণে তো কুরুক্ষেত্র লাগার কথা। আজ অন্যদিনের চাইতেও একটু বেশিই দেড়ি করে ফেলেছে। বাবারও তো সামান্য রাগ হওয়ার কথা। কিন্তু তারা দু’জনেই কেমন নিসাড়, নির্বাক। কিছু কী হয়েছে?
প্রশ্ন করার সাহস হয়ে উঠে না পুতুলের। সে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে রয়। পারুল বকুনি থামিয়ে কণ্ঠে নমনীয়তা যুক্ত করে বললেন, ‘হাত-পা ধুইয়া আইছোস?’
‘হুঁ।’ ঘাড় নাড়ায় সে।
‘আমার সামনে আইয়া ব। কথা আছে।’ আদেশ করলেন পারুল। পুতুল বিস্ময়তা চেপে রাখতে পারে না। ফ্যালফ্যাল নয়ন দুটি বাবা-মায়ের দিকে তাক করে। যন্ত্রের মতো মায়ের সামনে গিয়ে বসল। একবার পিতার দিকে চাইছে, একবার মাতার দিকে। হাসমত আলী উঠে চলে গেলেন। পুতুল আরও খানিকটা অবাক হলো। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে মায়ের দিকে তাকাল।
পারুল অতি সন্তর্পণে বললেন, ‘বয়স তো কম হইলো না। এহন তো বিয়াশাদী করান লাগে তোরে, লাগে না?’
পুতুল মাথা হেট করে আস্তে করে বলে, ‘লা..লাগে।’
‘তুই তো জানোস, এই পর্যন্ত যারা-ই তোরে দেখবার আইছে, সবাই কিছু না কিছু চাইছে। আর এইডাও জানোস, আমগো কোনো কিছু দেওয়ার সামর্থ্য নাই।’
‘জা..জানি।’ পুতুলের ছোট্ট উত্তর।
‘কিন্তু আল্লাহ চাইলে কী না হয়? এইবার একখান প্রস্তাব আইছে তোর লইগা। হেয় কিচ্ছু চায় না। খালি তোরে চায়। পাত্র ভালো। তোর চেনা আছে। বয়সটা একটু বেশি, এই যা। বয়স্ক বেডারা জামাই হিসেবে ভালা হয়। বউরে অনেক সোহাগ করে। তুই যদি রাজী থাকোস, তাইলে আমরা হ কইয়া দেই?’
পুতুল চমকে উঠল। প্রথমেই তার মাথায় প্রশ্ন ভেসে আসে, কার কথা বলছে মা? তার চোখ দুটিতে সেই প্রশ্নটি ভেসেও উঠে। পারুল যেন মেয়ের মনের কথা বুঝতে পারলেন। তাই ধীরে ধীরে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘আখতার, আখতার তোর জন্যি বিয়ার প্রস্তাব দিছে তোর আব্বার কাছে।’
‘আখতার চাচা?’ সাত আসমান যেন নিমিষেই মাথার উপর ভেঙে পড়ে পুতুলের। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে দাঁড়ায় দুই সেকেন্ডের জন্য। তার আর্তনাদ মাখানো কণ্ঠস্বর পারুলের কটু লাগে ভীষণ। তিনি ধমকের সহিত বলে উঠেন, ‘কীয়ের চাচা? হেয় তোর বাপের কোন ভাই লাগে?’
‘কিন্তু আব্বা তো হেরে ভাই কইয়াই ডাক দেয়। আমিও হেরে চাচা কইয়া আইছি সবসময়।’ মিনমিন করে পুতুল।
পারুল বললেন, ‘কইছোস, এহন থেইকা আর কবি না। তাইলেই তো হয়।’ পরমুহূর্তেই বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলতে লাগলেন, ‘হুন, তোর বয়স বাড়তেই থাকবো, তোর আব্বার ইনকাম বাড়বো না। তোর বড় আপার বিয়ার সময় জমিজমা বেইচা কত কষ্ট কইরা হেরে বিয়া দিছি। হেরপরও ওর জামাই কয়দিন বাদে বাদে এইটা চায়,ওইটা চায়। আমরা দিতে পারি না দেইখা তোর আপার লগে জুলুম করে। অনেক কষ্ট কইরা তোর আপা সংসার টা টিকাইয়া রাখতাছে। মাইয়া মানুষের কপাল আর বান্দীর কপাল সমান সমান। হেই তুলনায় তোর ভাগ্য ভালা। আখতারে কিচ্ছু চায় নাই, আর চাইবোও না। উল্টা আমগো পানির বিল ও মওকুফ কইরা দিছে। প্রতি মাসে দুই হাজার টাকার বাজার হের দোকান থেইকা ফিরিও আনবার পারুম৷ হেয় শুধু তোরে চায়। ওর কথাবার্তায় তোর আব্বা বুঝছে,ওয় তোরে ম্যালা পছন্দ করে। খালি হের বয়সটা বেশি দেইখা, আর হেয় মানুষটা রাগী দেইখা তোর আব্বার সংশয় হইতাছে। বেডাগো রাগ,জিদ এইডি তো থাকবোই নাকি? হেইডি ধরলে দুনিয়া চলে না। এরম প্রস্তাব আর আইবো না পুতুল। তুই ভাইবা দেখ। তোর উপরে জোর নাই ছেড়ি।’
পুতুল নির্বাক বসে রইলো। তার মনে একশো একটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব। তার বিয়ে হচ্ছে না দেখে এবং অনেক প্রস্তাব আসার পর পিছিয়ে যায় বলে গ্রামের অনেকেই পিঠ পিছনে তার ব্যাপারে সমালোচনা করে। এ কথা পুতুলের জানা। তার চেয়ে বয়সে ছোট শিলা। ওর-ও বিয়ে হয়ে বাচ্চা হয়ে গেছে। পুতুল যদিও এসব বিয়ে টিয়ের ব্যাপারে খুব একটা সিরিয়াস নয়। বাবা-মা’কে ছেড়ে চিরদিনের জন্য পরের বাড়ি চলে যাওয়াটা তার জন্য ভীষণ ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু এটাই যে সত্য। বরং যেসব মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও বাবা-মায়ের বাড়ি ছাড়তে পারে না, তারা যেন সমাজের চোখে এলিয়েন বনে যায়।
‘কী ভাবতাছোস এতো?’ পুতুলকে ধাক্কা দিলেন পারুল। পুতুল হকচকিয়ে উঠে। জড়ানো স্বরে বলল, ‘তোমরা যা ভালো ভাবো আম্মা।’ তারপর উঠে দৌড়ে চলে গেল পিড়িতে। এক কোণায় চুপ করে বসে পড়ল। তার দৌড়ে চলে যাওয়াটা পারুলের কাছে সম্মতিসূচক মনে হলো। তিনি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়লেন। অবশেষে তার মেয়েরও বিয়ে হবে। পাড়াপড়শি সবার মুখ তিনি এবার ভোঁতা করে দিবেন।
আকাশে চাঁদ নেই। থম ধরা অন্ধকার। ঝিঝি পোকাদের আওয়াজে কান ঝালাপালা হওয়ার জোগাড়। পুতুলের অবশ্য সেসবে খেয়াল নেই। তার বুকটা ধুকধুক করছে। শাপলার কথাগুলো বারবার মাথায় বারি দিচ্ছে। আখতার-ই কী তবে তার চিরদিনের সঙ্গি হবে? সে-ই তাকে প্রাণের চাইতেও বেশি ভালোবাসবে? যেমনটা শাহীন ভাই শাপলা কে বাসে?
পুতুলের মন অজানা মুগ্ধতায় নয়, অজানা ভয়ে ভরে উঠে। সে চোখ বন্ধ করে আখতারের মুখটা ভাবার চেষ্টা করল। বন্ধ চোখের পাতায় পরিচিত মুখখানি ধরা পড়তেই তার সমস্ত শরীর গুলিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ল। তার জীবন কেন এমন মোড়ে এসে দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত!
(চলবে)
#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (৩)
অলিন্দ্রিয়া রুহি
_____
‘আম্মাজান।’ আদুরে গলা। পুতুল তড়িঘড়ি করে চোখের জল মুছে নিলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে, কণ্ঠটা স্বাভাবিক করে হাসমত আলীর দিকে তাকাল। জবাব দিলো, ‘জি আব্বা।’
হাসমত আলী হাত ইশারায় মেয়েকে ঘরের দাওয়ায় আমন্ত্রণ জানালেন। পুতুল চুপচাপ সেখানে গিয়ে বসল। হাসমত আলী বসা-ই ছিলেন। নীরবতার পর্ব চলে কয়েক সেকেন্ড। কেউ কোনো কথা বলল না। পুতুল হাতের নখ খুঁটছে। বারে বারে বাবার মুখপানে তাকাচ্ছে। পরমুহূর্তেই চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। তার কেন যেন বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কেন পাচ্ছে, সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
অতঃপর নীরবতা ভাঙলো। হাসমত আলী নরম সুরে বলে উঠলেন, ‘তোমার মায়ে তোমারে সব কইছে নিশ্চয়ই। তোমার যদি মত না থাকে তাইলে তুমি চিন্তা নিও না। মাইয়াগো যতই বয়স বাড়ুক, বাপ-মায়ের কাছে হেরা কোনোদিন বোঝা হইয়া যায় না আম্মাজান।’
পুতুল আঁধারে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। বাঁধ ভাঙা স্রোতের মতো হু হু করে তার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। হাসমত আলী পুনরায় বলে উঠলেন, ‘আইজকা আহনের সময় ওগো দোকান হইয়া আইছিলাম। কয়েক সের চাউল আর ডাউল কিনবার গেছিলাম। তহন আমারে ভিত্রে ডাইকা আখতারে এডি কইলো। ওর লগে মনু মিয়াও আছিলো। হেয়-ও সম্মতি দিছে। হেয় কিছু চায় না। আমার ঘরে এক ওয়াক্ত খানা ও চায় না। কোনোমতে বিয়াডা পড়াইয়াই তোমারে লইয়া যাইবো। আমি ‘ভাইবা দেহুম’ এই কথা কইয়া উইঠা আইছি। তোমার মারে কইলাম। হেয় রাজী। কিন্তু আমি কইয়া দিছি,তোমার মতামতই শেষ কথা। তুমি রাজী হইলে আমি ভাইবা দেখুম, নাইলে আর ভাবুমই না। এহন তুমি কী কও আম্মা?’
‘আ..আমি..’ জড়ানো কণ্ঠস্বর। এতক্ষণ চুপ করে বাবার কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছিল সে। সব শুনে বুঝলো, এখানে বিয়ে হলে প্রায় সবদিক দিয়েই তার জন্য ভালো হয়। মানুষের খোঁচা মারা কথা আর হজম করতে হবে না। তার বাবা-মারও কোনো চিন্তা থাকবে না তাকে নিয়ে। তাদের সম্পত্তি বলতে এই ভিটাবাড়ি টুকুই আছে। আরেকটু জমি ছিল। সেটা বিক্রি করে বড় আপার বিয়ে দেওয়া হয়েছে। পুতুলকেও যদি সেভাবে বিয়ে দেওয়ানো হয় তবে এই ভিটা টুকু বিক্রি করা লাগবে। পুতুল উপর নিচ মাথা নাড়ল। হাসমত আলী খেয়াল করে ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কী অইলো? মাথা নাড়াও ক্যা?’
পুতুল সম্বিৎ ফিরে পেয়ে দ্রুততার সঙ্গে জবাব দেয়, ‘না আব্বা কিছু না।’
হাসমত আলী বললেন, ‘আইচ্ছা। তা কী যেন কইতাছিলা আম্মা…’
‘কইতাছিলাম যে..’ মুখে বাজে, মনে সায় দেয় না। কার সঙ্গে বিয়ে হবে,তার কত বয়স,সে মানুষ টা কেমন,এটা নিয়ে একটি প্রশ্নও তার মন বাড়িতে উদিত হয়নি। শুধু দুঃখ লাগছে এই ভেবে, জন্মের পর চোখ খুলে যে বাড়ি দেখল, বুঝ হওয়ার প থেকে যে বাড়িকে নিজের করে নিলো, সেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে চিরদিনের জন্যে! তখন স্বামী চাইলে মাসে বছরে একবার আসা হবে। নইলে সেটুকুও কপালে জুটবে না। বাবার আহ্লাদী মেয়ে হয়ে থাকা আর হবে না। আহ্লাদী কিশোরীও হয়ে থাকাও হবে না আর। চাইলেই টইটই করে ঘুরে বেড়ানো হবে না। দাপিয়ে বেড়াবে না মাঠের পর মাঠ। আর রতন, কালু, গোলাপী, শাপলা? ওদের সাথেও দেখা হবে কীনা সন্দেহ। তার চিরচেনা দুনিয়া, চিরচেনা নিয়ম- সব কিছুই পাল্টে যাবে এক লহমায়।
মনের চিন্তাভাবনা গুলো নিয়ন্ত্রণে এনে পুতুল ভেজা গলায় জবাব দিলো, ‘আপনি যা ভালো বুঝেন তাই করেন আব্বা। আমি বড় হইছি। বিয়া হয় না বইলা মাইনষে কত কথা কয়। আমারও আর হুনতে ভালা লাগে না আব্বা। কী আজব নিয়ম আব্বা! যেই বাড়িত জন্ম হইলো, যেই বাড়িত আমার আপন জায়গা, হেই বাড়ি থুইয়া আমগো চইলা যাওন লাগে সারাজীবনের জন্যে। যদি না যাই, হেইডাও নাকি আমগো দোষ হইয়া যায়! আচ্ছা আব্বা, এক মাটির গাছ আরেক মাটিতে যাইয়া সুবিধা করবার পারে না। মানায় নিতে পারে না। তাইলে আমরা কেমনে পারুম আব্বা? দুনিয়ার এই নিয়ম আমি কিছুই বুঝি না।’
পুতুল থামে, দম টেনে ফুসফুস ভর্তি করে নিলো। তার ভেতরটা ভেঙেচুরে যাচ্ছে। বাবা-মাকে ছেড়ে চলে যেতে তার খুব কষ্ট হবে,খুউউব! কী হতো, যদি আজীবন বাবা-মায়ের সাথে থাকা যেতো! একটাই তো জীবন। বাবা-মায়ের সঙ্গে থেকে কাটিয়ে দিলে খুব কী ক্ষতি হতো?
হাসমত আলী মেয়ের কান্নারত মুখের দিকে তাকালেন। তার নিজেরও মনটা ভালো লাগছে না। কেমন মোচড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। তিনি ঠোঁট জোড়া চেপে ভাবলেন, আখতারকে মানা করে দেবেন। যদি মেয়ের বিয়ে না হয় তবে সব ফেলে বউ বাচ্চা নিয়ে চলে যাবে বহু দূরে। এছাড়া আর কী করার আছে? সমাজ নামক ভদ্র পাড়ায় থাকতে হলে যে আর সবার মতোন তাকে মন গড়া নিয়মের বেড়াজালে আঁটকে তবেই বসবাস করতে হবে। এইসব বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরোনোর মতো সাহস তার অন্তরে নেই। হাসমত আলী নিজেকে খুব অসহায় মনে করলেন। তিনি এমন এক পিতা, যিনি চেয়েও সন্তানের জন্য কিছুই করতে পারছে না।
‘বাপ ঝি’য়ের কতা শেষ হইছে? খাওন বাড়মু?’
পেছন থেকে বলে উঠে পারুল। তিনিও এগিয়ে আসেন। হাসমত আলী বউয়ের মুখের দিকে তাকালেন। প্রশ্ন করলেন, ‘হাসিবে কই? আহে নাই?’
এহেন প্রশ্ন শুনে পারুলের মুখ বেজার হয়ে যায়। সে গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর করে, ‘হেয় কী বাপ-মা চিনে নাকি? লায়েক হইলে আর কেউ বাপ-মা চিনে না। বড়ডা যেমনে গেছে গা, হেয়ও যাইবো গা। আইজকাও আমার লগে কাইজ্জা কইরা বাড়িত থেইকা বাইর হইয়া গেছে। এহনো আহনের নামগন্ধ নাই। না আয় না আহুক। পেডে টান পড়লে ঠিকই আইবোনি। বাপ-মা ছাড়া আর কেডা আছে মুখে খাওন তুইলা দেওয়ার?’
হাসমত আলী বজ্রকণ্ঠে বললেন, ‘তুমি কোন বা** মা হইছো? পোলারে সামলাই রাখোন পারো না? তোমারে না কইছি, দরকার পড়লে ঘরের ভিতর বাইন্ধা রাখবা। তাও বাইর হইতে দিও না। খারাপ পাল্লায় পড়তাছে তোমার পোলায়। তোমার কী আক্কেলজ্ঞান কোনো কালেই হইবো না পারুল?’
পারুলও সমান তেজ নিয়ে বললেন, ‘পোলায় খারাপ কাম করলেই মায়ের দোষ। আর ভালো কাম করলে বাপের সুনাম। আপনের পোলা আপনে বাইন্ধা রাখেন যান। আমি কিছুতে নাই।’
পারুল গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন। হাসমত আলী স্ত্রীর গমন পথের দিকে চেয়ে থেকে বললেন, ‘আমার হাতে ছাইড়া দিলে পোলা আর জীবিত পাইবা না, কইয়া দিলাম। ওরে আমি মাইরাই ফালামু। খালি একবার সামনে পাইয়া লই।’
পুতুল ভয়ার্ত মুখে চেয়ে রইলো, ‘আব্বা, থাক, মাথা গরম কইরেন না। যে যেমনে ভালা থাকে তারে সেমনেই ভালা থাকতে দেন। ভাইয়ে বড় হইছে। হের ভালা মন্দ জ্ঞান কী হের নাই?’
‘নাই। নাই দেইখাই তো খারাপ পথে গেছে গা। যার ভালা মন্দ জ্ঞান আছে,হেয় কী খারাপ পথে যাইবার পারে রে মা?’
‘থাউক আব্বা, বাদ দেন। হেয় যদি খারাপ কাম কইরা শান্তি পায়, পাক। আমগো দরকার কী? বড় ভাই তো গেছেই গা, হেয়ও বলে যাইবো গা। সবাই যাক আব্বা। আমি কোনোদিন আপনাগো থুইয়া কোথাও যামু না আব্বা। কথা দিলাম আপনারে ছুঁইয়া।’
পুতুল হাসমত আলীর এক বাহু স্পর্শ করে। হাসমত আলীর ঠোঁটে অনেক ক্ষণ পর হাসি ফুঁটে উঠল। তিনি মেয়ের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু তোমারে তো যাইতেই হইবো আম্মা। বিয়া দিয়া দিলে তুমি হইয়া যাবা পরের অধীন। তহন কী আর আমগো লইগা টান থাকবো?’
পুতুল স্পষ্ট দৃষ্টি ফেলে। নরম কণ্ঠে বলে, ‘যে হাত আমারে হাটা শিখাইছে, যে হাত আমারে সব বিপদ আপদ থেইকা রক্ষা করছে, যে হাত আমারে মানুষের মতো মানুষ কইরা তুলছে, হেই হাত জোড়া আমি কেমনে ঠেইলা দিমু আব্বা? আমার বিয়া হইলেও আমি আপনাগো ছাইড়া কোত্থাও যামু না। আজকেও যেমন আপনাগো সুখ-দুঃখে আমি আছি, তহনো আমি থাকমু।’
হাসমত আলীর বুক ভরে যায়। সে কোথায় যেন শুনেছিল, যার মেয়ে হয়, আল্লাহ তাকে জান্নাত দেন নাকী। এ কথা বোধহয় সত্যিই! তার ছেলেরা তাকে ফেলে চলে গেছে। কেউ বাবা-মায়ের কথা একটিবারও ভাবেনি। অথচ তার মেয়েরা! দুটোই মেয়েই বাবা-মাকে সমান ভাবে ভালোবাসে। কেউ কম না কেউ বেশি না। ইশ! তার যদি আরও দুটো মেয়ে হতো! আল্লাহ তাকে চার জান্নাত দিতো।
(চলবে)