প্রণয়ের_তৃষ্ণা-৪,০৫

0
695

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা-৪,০৫
অলিন্দ্রিয়া রুহি
০৪
_____
পরদিন বিকেল। মাঠভর্তি ছেলেমেয়েরা খেলছে। মাঠের সঙ্গে চিকন লম্বা খাল, গিয়ে মিশেছে বড় নদীর সঙ্গে। লোক মুখে শোনা যায়, এই খালে একজন বুড়ি বাস করে। ভরা দুপুর অথবা দিনের শেষ প্রহর, এমন সময় কাউকে যদি একলা পায় পানিতে, তবে নিচ থেকে টেনে নিয়ে যায় তার কাছে। একবার তো এমনই একটা ঘটনা ঘটে বসল। গ্রামের মেয়ে শহরের এক ছেলের কাছে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছেলে সুন্দর, ফর্সা-লম্বা। বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ি দাওয়াত খেতে এসে আনন্দ নিয়ে এই খালে নামলো গোসল করতে। তারপর হুট করেই ছেলে নাই। নাই মানে একদম নাই। ধারণা করা হলো, ছেলে নিশ্চয়ই পানির ভেতর ডুবে গেছে। ডুবুরি আনানো হলো। তারা সবাই মিলে পানির নিচ খুঁজতে লাগল। কোথাও পাওয়া গেল না। এর প্রায় তিনদিন পর শ্বশুর স্বপ্নে দেখে, এক ধবধবে সাদা বুড়ি এসে বলছে, ‘আগামীকাল ছেলে পাবি। ঠিক বিকেলে উপস্থিত থাকিস।’
পরদিন সত্যি সত্যি বিশাল বড় ভীড় জমে গেল খালের দুই পাড় জুড়ে। লোক আর লোক! সবাই এসেছে। সবার মনে একটাই ধারণা, স্বপ্নে যখন দেখেছে তখন সত্যি হবেই। ঠিক বিকেলেই হুট করে পানির তল থেকে ভেসে উঠল ছেলের লাশ, নতুন জামাইর লাশ! মেয়ে চিৎকার করে কেঁদে বেহুশ হয়ে যায়। এরপর থেকে খুব কমই এই খালে মানুষ নামে। জরুরি কাজ ছাড়া কেউ এই খালের ধার ঘেঁষেও হাঁটে না। একটা ভয় সবার মনেই ঢুকে গেছে। যদি নামে, হয়তো তাকেও টান দিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে পানির নিচে!

খাল থেকে বেশি খানিকটা দূরত্বে একটি বট গাছ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বট গাছটির দিকে তাকালে তাকে বেশ তরুণ বলেই বিবেচনা করা যায়। সেই গাছের তলায়, গুড়িতে- রতন, শাপলা, গোলাপী আর পুতুল চুপ করে বসে রয়েছে। আজ কালু আসেনি। কালুর গতকাল রাতে পেট খারাপ হয়েছে। অবশ্য সে এলেও কেউ তার সঙ্গে কথা বলতো না। গতকাল তার কারণে সবাইকে অনেক হ্যাপা পোহাতে হয়েছে। ফলাফল শূন্য। তাই আগামী তিনদিন কালুর সঙ্গে সবার কাট্টি। এটাই ওর শাস্তি।

ওদের আজকের আলোচনা পুতুলের বিয়ে নিয়ে। রতন খবরটা শুনেই হৈহৈ করে উঠে। সে খুব খুশি। অনেকদিন পর একটা বিয়ে খাওয়া হবে। শাপলা অবশ্য ধমকে তাকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। গোলাপী নাক সিঁটকে বলল, ‘শ্যাষমেশ আখতার চাচায়?’

পুতুল মৃদু স্বরে বলল, ‘কীয়ের চাচা? এহন হইতে আর চাচা কবি না।’

‘ওমা গো! বিয়া না হইতেই এত দরদ? এত টান!’ গোলাপী নাক টেনে অভিনয়ের সুরে বলল। পুতুল চোখ রাঙিয়ে তাকাল। কপট রাগ নিয়ে উঠে দাঁড়াল। খেঁকিয়ে বলল, ‘ধুর, গেলাম গা আমি। তোগো লগে থাকলে মনডা আরও খারাপ হইবো।’

শাপলা পুতুলের হাত টেনে ধরে। তাকে জোর করে পাশে বসালো। পুতুলের একটা হাত ধরে রেখেই নরম গলায় বলল, ‘তুই কী চাস পুতুল? তোর মন কী কয়?’

পুতুল নীরব থাকে। গোলাপীর যেন তর সইছে না। উত্তরখানা শোনার জন্য মনটা ছুটে গিয়েছে। সে দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল, ‘কীরে? বলোস না ক্যান?’

শাপলা ধমক দিয়ে উঠে, ‘আহ! একটু চুপ থাক না তোরা। বা** পাকনা পোলাপাইন সব। যা তো,যা এখান থেইকা। ওরে একটু একা থাকতে দে। যা..’

শাপলার রাগারাগি দেখে রতন আর গোলাপী মুখ কালো করে উঠে চলে গেল সত্যি সত্যি। পুতুল ওদের চলে যাওয়ার পানে চেয়ে থেকে বলল, ‘খামোকা বকতে গেলি কেন? ওরা আমগো চাইয়া ছোট। ওগো বুঝ কম।’

‘তুই ওগো কথা বাদ দিয়া যেইডা জিগাইছি হেইডা ক পুতুল। কথা ঘুরাবি না,খবরদার।’

পুতুল পুনরায় চুপ করে রয়। যেন সে উত্তর খুঁজে চলেছে। তার চোখের এলোমেলো দৃষ্টিতে শাপলা উত্তর খুঁজে নিলো। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাওয়া দীর্ঘশ্বাস টাকে সে লুকোলো না। বিষাদ মাখানো গলায় বলল, ‘তুই নিজেও জানোস না তুই কী চাস?’

পুতুল অসহায় চোখ করে তাকাল। দু’দিকে মাথা নেড়ে নিচু কণ্ঠে বলল, ‘না রে। আমার এক মন কয়, বিয়াডা কইরা নিয়া মা বাপরে জ্বালা থেইকা মুক্ত কইরা দিই। কিন্তু যহনই আখতার চাচার মুখটা ভাবি, আমার গা গুলায়ে উঠে। কেমনে হের লগে সংসার করুম আমি? ছোট্ট থেইকা হেরে চাচা কইয়া ডাকছি সবসময়।’

‘তুই এইটা খুইলা কইছোস হেগোরে?’

‘কইছি। আম্মায় কয়, চাচা কইয়া ডাকতি, কিন্তু হেয় তো তোর আপন চাচা না। আর বড় কথা হইলো, হেয় কিছু চায় না। আমারে একদম মাগনা বউ কইরা লইয়া যাইবো। এই সুযোগ আম্মায় হারাইতে চাইতেছে না। আমিও বুঝি। বড় আপারে বিয়া দেওয়ার সময় কত্ত কাহিনী হইছে। তহন তো জমিডা ছিল। বেইচা আব্বায় কুল কিনারা করবার পারছে। এহন তো জমিও নাই। বেচার মতো কিছুই নাই। আমারে যে কেউ মাগনা নিবার চাইছে এইডাই অনেক। হের বয়স আর এমন কী!’

পুতুলের নাসিকা পথ ভেদ করে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। শাপলার কান্না পেয়ে যায়। পুতুল তার ছোট্ট বেলার বান্ধবী। তার প্রাণের সই। তার সুখ-দুঃখের সাথী। সইয়ের এমন বিপদ, এমন করুণ অবস্থা যে তার কিছুতেই সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু সেই বা কী করবে? পুতুলদের যেমন অবস্থা, তার বাবারও একই অবস্থা। নুন আনতে পান্তা ফুরায়! শাপলা নিচের ঠোঁট কামড়ে কান্নাটাকে আঁটকানোর চেষ্টা করল।

নিজেকে সামলে পুনরায় প্রশ্ন ছুঁড়ে, ‘তাইলে কী করবি এহন?’

পুতুল ঘাড় নাড়ায়, ‘জানি না। ভাগ্যের হাতে সব ছাইড়া দিছি।’

‘যদি বিয়াডা হয়?’

শাপলার প্রশ্নে পুতুল সেকেন্ড তিনেক নির্বাক চেয়ে থেকে ধীর স্বরে জবাব দিলো, ‘তাইলে মাইনা নিয়া সংসার করুম। আম্মায় না কয়, মাইয়াগো কপাল আর বান্দীর কপাল সমান সমান।’

পুতুলের কথার পৃষ্টে শাপলা জবাব দিতে পারে না। দুই বান্ধবী পড়ন্ত বিকেলের গা নরম করা বাতাসে চুপ করে বসে রইলো বাকী কয়েক মিনিট। কারো মুখে কথা নেই, অভিশংকাও নেই। যেন দু’জনেই বোঝার চেষ্টা করছে ভাগ্যের পরিণতি।

_____

সন্ধ্যা লগ্ন প্রহর। বাতাসের দাপট হুট করে বেড়ে গিয়েছে। বৃষ্টি বৃষ্টি গন্ধ চারিদিকে। ঝড় আসার সম্ভাবনা। রতন আর গোলাপীকে আশেপাশে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না। শাপলা বলল, ‘ওরা মনে হয় গেছে গা। চল, আমরাও যাই। আকাশ টা সুবিধার লাগতেছে না।’

‘হুঁ।’ আনমনে জবাব কাটে পুতুল। এক নজর আকাশের দিকে চাইলো। পরমুহূর্তেই নজর সরিয়ে শাপলাকে বলল, ‘আইজকা বৃষ্টি আইবোরে। আম পড়ব।’

‘তুলবার যাবি?’ ফট করে প্রশ্ন ছোঁড়ে সে।

পুতুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল, ‘মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়া আইয়া পারলে আহুম নাইলে তো নাই।’

‘আইচ্ছা।’ শাপলার গলার স্বরে যে দীপ্তি জ্বলে উঠেছিল, তা আবার নিভে গেল। দুই বান্ধবী বাড়ির পথ ধরলো। ইতিমধ্যেই মাঠ খালি হয়ে গেছে। ছেলে-মেয়ে কেউ নেই। ক’জন মুরুব্বি গোছের মানুষজন আছে,তাও অনেকটা দূরে দূরে। চায়ের দোকানের সঙ্গে। শাপলা আর পুতুল বড় রাস্তায় না উঠে আজ শর্টকাট রাস্তা ধরল। কাঁচা মাটির রাস্তা। বাগানের ভেতর দিয়ে। লম্বা লম্বা পা ফেলে দু’জন দ্রুত হাঁটছে। আকাশে মেঘ গুড়গুড় করছে। দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো।
ঠিক এমন সময়ে একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর ওদের দু’জনকেই আঁটকে দিলো।

‘পুতুল, না?’

ওরা থমকে দাঁড়াল। দু’জনেই পেছন ঘুরে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটি দেখতে পেয়ে চমকে উঠল। পুতুল একটু শিউরেও উঠল যেন। শাপলার বাহু শক্ত করে চেপে একটু পিছিয়ে দাঁড়াল। আখতার পান খাওয়া লাল ঠোঁটে হাসি এঁকে ওদের সামনে এসে দাঁড়ান। তার নজর শাপলাকে ভেদ করে রাঙা ফুলের ন্যায় দেখতে মেয়েটির গায়ে থামে। গোল গোল চোখ চিকচিক করে উঠল। তিনি বললেন, ‘কই যাইতাছেন?’

‘তুই’ করে সম্বোধন করত এতোদিন। আজ হঠাৎ ‘আপনি’ করে বলছে। পুতুল বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলো। তার মুখে রা নেই। শাপলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নিজে থেকে বলে উঠে, ‘বাড়িত যাইতাছি চাচা। মেঘ আইবো।’

আখতার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। তার মনোযোগ শাপলা নষ্ট করে দিয়েছে। সেই সঙ্গে ‘চাচা’ ডেকে তাকে তার বয়সের কথাও মনে করিয়ে দিয়েছে। যার ফলে বেশ কিছুটা বিরক্তি আর রাগ- দুটোই একসঙ্গে জাপটে ধরে তার অন্তরবাড়ি। তিনি গলার স্বর মোটা করে বললেন, ‘তুমি এইহান থেইকা যাও। আমার ওর লগে কতা আছে।’

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে শাপলার জামা খামচে ধরে পুতুল। তার চোখের দৃষ্টি অসহায়। শাপলাকে যেন বলছে না যেতে। শাপলা কী করবে ভেবে পায় না। আখতার ভীষণ বদরাগী মানুষ। তাকে এ তল্লাটের সকলেই ভয় করে চলে। শাপলা মিনমিন করে বলার চেষ্টা করল, ‘আ..আমি থাকি চা..’
তার আগেই আখতার পূর্বের চেয়েও কর্কশ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘তোমারে না যাইতে কইছি? এহনো খাড়াইয়া আছো ক্যান? যাও,ওই দূরে গিয়া খাড়াও। যাও..’

শেষ শব্দটি এমন ভাবে উচ্চারণ করলেন যে পুতুল সহ কেঁপে উঠল খানিক। শাপলার উপায় নেই। সে বাধ্য হয়ে মাথা নত করে সরে গেল। তাদের পেরিয়ে অনেকটা এগিয়ে একটা গাছের গুড়িতে গিয়ে বসে কেঁদে ফেলল। গুমোট ধরা মেঘলা আকাশের পানে চেয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে উঠল, ‘ও মাওলা, আমার বান্ধবীরে তুমি সাহায্য কইরো। ওর কোনো ক্ষতি হইতে দিও না। ওয়ে অনেক ভালা মাইয়া..’

পুতুল কাঁপছে। বাহির থেকে বোঝার উপায় নেই। ভেতরটা গুড়িয়ে যাচ্ছে ভয়ে। মনে হচ্ছে,পরবর্তী নিঃশ্বাস টা নেওয়ার আগেই সে ঢলে পড়বে মাটিতে। যদি এমনটা হতো, তাও ভালো হতো। আখতার কেন তাকে থামিয়েছে! কী কথা থাকতে পারে তার সঙ্গে?

পাঞ্জাবির পকেট থেকে এক জোড়া নূপুর বের করলেন তিনি। মুখাবয়ব মুহূর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেল। রাগের জায়গায় দখল করে বসল চাপা হাসি। তিনি আদুরে গলায় বলে উঠলেন, ‘এইডা নাও।’

পুতুল চোখ তুলে তাকাল। তার হাতে নূপুর দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, ‘ক্যা…ক্যান?’

‘ক্যান মানে? এইডা তোমার জন্যি। আইজাকাই কিনা আনলাম। পথেই যে তোমারে পামু, বুঝবার পারি নাই।’

আখতার হাত বাড়িয়ে রেখেছে। পুতুল মাথা নিচু করে ছোট্ট করে বলে, ‘আ..আমার লাগ..তো না।’

আখতারের দুই ভ্রু পুনরায় কুঁচকে গেল। তিনি বাড়ানো হাত গুটিয়ে নিতে নিতে বললেন, ‘ক্যা? নিলে কী সমস্যা? তুমি আর কইদিন পর আমার বউ হইবা। তোমারে আমি খুশি হইয়া এইডা ওইডা দিতে পারি না?’

পুতুলের খুব করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘বিয়াডা তো হয় নাই এহনো। আমারে বউ কইয়া ডাকেন কোন সাহসে? হাটুর বয়সী মাইয়ারে বউ কইতে লজ্জা লাগে না?’ কিন্তু তার সাহসে কুলোয় না। পূর্বের ন্যায় নিচু কণ্ঠেই সে বলে উঠে, ‘আমি নিতে পারুম না। আপনার যা দেওয়ার আব্বার কাছেই দিয়েন। আমি অখন যাই। বৃষ্টি আইবো।’

বাতাসের বেগ সত্যি সত্যি অনেক বেড়ে গিয়েছে। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। থেমে থেমে আকাশ ডেকে উঠছে। আখতারের নিজেরও ঘরে যাওয়া প্রয়োজন। তিনি বুঝলেন, মেয়ে লজ্জা পাচ্ছে। তাই মনঃক্ষুণ্ন হলেন না। পাঞ্জাবির পকেটে পুনরায় নূপুরখানি ঢুকিয়ে রাখলেন। পুতুলের একটুখানি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পুতুল কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। আখতার হেসে উঠে বললেন, ‘আইচ্ছা, যাও বাড়িত যাও। আর হুনো, এত বেশি এদিক ওদিক টই টই করবা না। তুমি শেয়ানা মাইয়া মানুষ। সবসময় বাড়িত থাকবা। বুঝছো?’

পুতুল জবাব দিলো না। শুধু ঘাড় নাড়িয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।

আখতার বললেন, ‘এই শুক্রবারেই তোমারে আমার ঘরে তুইলা নিয়া আসুম। তোমার লাল শাড়ি পছন্দ?’

পুতুল নির্বাক। দুনিয়ার ঝড় উঠতে আর কিছু সময় বিলম্ব হলেও তার মনে ইতিমধ্যেই ঝড় উঠে গেছে। আজ বুধবার, আর মাত্র একদিন মাঝখানে! তারপর..তারপরই তার বিয়ে হয়ে যাবে! এই এর সাথে? পুতুলের চোখ ভেঙে কান্নারা নেমে এলো। সে যথাসম্ভব মাথাটা নিচু করে রাখে যেন আখতারের নজরে সেই কান্নারা না পৌঁছায়। ভেজা কণ্ঠ নাড়িয়ে দ্রুততার সঙ্গে বলে উঠল, ‘আ..আমি যাই। ঝড় উঠবো।’

তারপর আর একটি মুহূর্তও না। পেছন ঘুরেই রীতিমতো দৌড়ে আখতারের চোখের আড়াল হয়ে যায় সে। আখতার হেসে উঠলেন হো হো করে, ‘শরম পাইছে! আমার বাইচ্চা বউরে শরম পাইছে..’

শাপলা বসেই ছিল। পুতুলকে দৌড়ে আসতে দেখে সে হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। ধুকধুকানি বুক নিয়ে দ্রুত প্রশ্ন ছোঁড়ে, ‘কী হইছে? এমনে দৌড়াস ক্যান? কিছু করছে তোর লগে?’
পুতুল জবাব দিতে পারে না। দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে মুহূর্তে…

(চলবে)

#প্রণয়ের_তৃষ্ণা (৫)
অলিন্দ্রিয়া রুহি

_____
বৃষ্টির তেজ বাড়ছে। হু হু করে ঝড়ো হাওয়া বইছে। ওরা যেখানে আছে,সেটা পুরোপুরি বুনো বাগান। মাটিটাও দেখা যায় না। ঘাসে লেপ্টে আছে। এর উপর দিয়েই হেঁটে চলতে হয়। দুনিয়ার আলো একেবারেই টিমটিমে। যেকোনো মুহূর্তে ফুরিয়ে যাবে। শাপলা আকাশের দিকে এক ঝলক চেয়ে বলল, ‘আমগো উঠতে হইবো পুতুল। বেশ বড় ঝড় আইবো মনে হয়।’

পুতুলের চোখ বেয়ে তখনো দরদর করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে বসে আছে গাছের গুড়িতে। হাটুর উপর হাত দুটো জড়োসড়ো, দৃষ্টি এলোমেলো, কণ্ঠ কাঁপছে।

তার থেকে জবাব না পেয়ে শাপলা পুনরায় ডেকে উঠল, ‘পুতুল, এই পুতুল? কী কই?’

‘আ..আমি বিয়া করুম না।’ বিড়বিড় করে অবশেষে মৌনতা ভাঙলো সে। শাপলা কান পেতে রেখেছে বিধায় স্পষ্ট শুনতে পেল কথাখানা। সে প্রত্যুত্তর করে, ‘না করলে না করবি। আগে বাড়িত যাই চল। তোর বাপেরে বুঝায়া কইলে হেয় রাজী হইবো। চল পুতুল, এইনে বইয়া থাইকা লাভ নাই।’

পুতুল উঠে দাঁড়াল। আঁচল দিয়ে চোখ-মুখ ডলে ডলে মুছে পরিস্কার করে নিলো। কমজোর মনটাকে শাসিয়ে বুঝালো, কেঁদে লাভ নেই। তাই কান্নাকাটি করা চলবে না। বিয়েটা এখনো হয়নি, সুযোগ আছে। বাবা কে বলবে কী শুনবে না? অবশ্যই শুনবে!

আকাশ মাটি কাঁপিয়ে ঝরঝর করে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা জমিনে পড়ে গগণ চিঁড়ে। দাওয়ার খুঁটিটা ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই বৃষ্টি পড়া দেখছে পুতুল। ওরা বাড়ি আসার সঙ্গে সঙ্গেই মেঘ ভেঙেছে। দূর দূরান্তে বজ্রপাত হচ্ছে। হট্টগোল শোনা যায়। কিন্তু পুতুলের যেন দুনিয়াবি কোনো কিছুতেই কান নেই। আপন মনে সে কী যে ভেবে চলেছে, নিজেও জানে না।

পেছন থেকে হাসমত আলী ডাক দিয়ে উঠলেন, ‘ও মা, ঘরের ভিতর আয়। পানির ঝাপ আহে।’

পুতুল নড়ে উঠল, ‘হুঁ?’

‘দরজাডা লাগায়া ভিত্রে আহো। ভিজ্জা যাইতেছো পুরা। কোনদিক খেয়াল?’

‘না আব্বা, কিছু না।’ উদাসী নয়ন জোড়া চিকচিক করে উঠে অশ্রু জলে। চোখ নামিয়ে ঘরের দরজাটা লাগিয়ে দেয় পুতুল। হাসমত আলী, পারুল আর পুতুলের ছোট্ট ভাই প্রিন্স- বসে আছে চৌকির উপর। সেখানে গিয়ে পুতুলও উঠে বসল। চৌকির এক কোণায় মোটা কাঁথা গায়ে জড়িয়ে চুপ করে শুয়ে পড়ল। বাড়ি আসতে আসতে যে মনোবল সে তৈরি করেছিল এই বিয়েকে ‘না’ বলার,সেই মনোবল এক লহমায় ভেঙে গেছে আখতারের পাঠানো জিনিসপত্র দেখে। আজ বিকেলেই নাকি হাসমত আলীর কাছে এক ব্যাগ ভর্তি জিনিস পাঠিয়ে দিয়েছেন উনি। বিয়ের জন্য লাল শাড়ি, হলুদের জন্য কুসুম শাড়ি, সাথে প্রায় আটখানা নানান রঙের সুতি শাড়ি। পায়ের জুতো, গায়ে মাখার স্নো, ক্রিম, একটা লাল টুকটুকে লিপস্টিক ও আছে। কয়েক গাছা কাচের চুড়ি, মাথার চিরুনিটা পর্যন্ত। আশেপাশের সবাই এসে বিয়ের বাজার দেখে গেছে। সবার মুখে আখতারের কী সুনাম! পুতুলকে কত্ত ভালোবাসে! নইলে কেউ এত কিছু দেয়? একজন তো বলল, ‘আমরার বিয়া হইছে আষ্টো বছর চলে। এহন পর্যন্ত তোমার মামু একখান মালাও আইনা দেয় নাই। সত্যি, পুতুলের রাজ কপাল!’

সেসব নিয়েই আলোচনা সমালোচনা চলছিল ঘরের ভেতর। পুতুল এসে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনেছে। বাবার মুখখানা পূর্বের চাইতে একটু উজ্জ্বল। হতে পারে, সেও খুশি আছে এই বিয়েতে। সব দেখে পুতুল চুপ করে গেল। থাকুক, তাকে কোরবানি দিয়ে সবাই যদি সুখী হয়, তবে হোক। সন্তান হিসেবে তার দায়িত্বই বাবা-মাকে সুখী রাখা, খুশি করা। সে নাহয় নিজেকে শেষ করেই সবার মুখে হাসি ফুঁটাবে।

‘আম্মাজান, শরীর ভালা না?’ হাসমত আলীর চিন্তিত কণ্ঠস্বর পুতুলের ভাবনার জগত ভেঙে চুরমার করে দিলো। পুতুল নিভে যাওয়া কণ্ঠ টেনে কোনোরকমে জবাব দেয়, ‘না আব্বা, কিছু না।’

‘ওর গায়ে হাত দিয়া দেহো দেহি।’ পারুলকে সঙ্গে সঙ্গে আদেশ করলেন তিনি। পুতুলের কপালে হাতখানা ছুঁইয়ে পারুল চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, ‘গা-ও ডা গরম গরম লাগে।’

‘পরশুদিন বিয়া, আইজকা এই অবস্থা?’ হাসমত আলী জবাব দিলেন। পুতুলের বাম চোখের দেয়াল ঘেঁষে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে দ্রুত কাঁথার ভেতর মুখ লুকালো। জোরালো কণ্ঠে বলল, ‘আমার কিচ্ছু হয় নাই আব্বা। একটু মেঘের পানি গায়ে পড়ছে দেইখা এমন লাগতাছে। হুইয়া থাকলে ভালা হইয়া যামু। আপনে চিন্তা নিয়েন না। আমার বিয়া হইবোই।’

কথাটুকু বলতে বলতে প্রায় বিশ-পঁচিশ ফোঁটা উত্তপ্ত জল ফোঁটা গড়াতে গড়াতে পুতুলের চিবুক ছুঁলো। কেউ দেখল না। সে কাঁথার তলে মুখ লুকিয়ে রেখেছে।

হাসমত আলী মৃদু হাসলেন। বলেন, ‘আম্মাজান, তোমার শরীরের চেয়ে আর কোনো কিছু দামী না। তোমার যদি শরীর ভালা না লাগে তাইলে বিয়া পিছাইয়া দিমু। কোনো সমস্যা তো নাই।’

‘দুইদিন আগে হোক আর পরে, বিয়া তো হইবোই আব্বা। তাইলে লাভ কী দেড়ি করার? আপনের পিছাইতে হইবো না। যেইদিন ঠিক করছেন আপনেরা, হেইদিনই হইবো। আমি ভালা আছি।’

হাসমত আলী চুপ করে রইলেন। পারুল মাঝখান দিয়ে বলে উঠেন, ‘হুন, তুই আমগো উপর অভিমান করিস না মা। মাইয়া গো একদিন তো বিয়া করতেই হইবো। আমগো জীবনডাই তো এই জন্যি রে মা। সংসার করুম, বাচ্চা হইবো, ওগোরে মানুষ করুম, মইরা যামু। আর মাইয়া মাইনষের কপাল…’

‘বান্দীর কপাল সমান সমান। আমি জানি আম্মা।’ বাকি কথাটুকু পুতুল নিজেই বলে দিলো। আলনার উপর থেকে একটা পাঞ্জাবি আর পায়জামা দৌড়ে নিয়ে এলো প্রিন্স। পুতুলকে দেখিয়ে বলল, ‘আপা দেখ, দুলাভাই দিছে। দুলাভাই কত ভালা,না আপা?’

পুতুল দেখল, জবাব দিলো না। তার বাবা কোনোদিন্নেত ভালো পোশাক তাদের কাউকে কিনে দিতে পারেনি। পুতুল শেষ কবে নতুন শাড়ি পড়েছে,তার স্মরণ হয় না। চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে প্রতি বছর তার ব্যবহৃত পুরাতন জামা-কাপড় সবার মাঝে বিলিয়ে দেয়। সেখান থেকেই পুতুলের মা ওদের দুই ভাই-বোনের জন্য নিয়ে আসে। মায়ের শাড়িটা জায়গায় জায়গায় ফাঁড়া। সেলাই দিয়ে দিয়ে বছরের পর বছর চালাচ্ছেন পারুল।

হঠাৎ মনে পড়ল, এমন ভঙ্গিতে পুতুল প্রশ্ন করে উঠে, ‘মা, তোমারে কিছু দেয় নাই?’

‘দিছে। দুইখান শাড়ি দিছে।’ পারুলের গাল দুটো চকচক করে উঠে৷ পুতুল নিঃশ্বাস ফেলল। এই নিঃশ্বাসে সুখ মাখানো নাকী দুঃখ- ঠিক বোঝা গেল না।

_____

উত্তরের বড় সুপারি গাছটা মাঝখান থেকে দু’ভাগ হয়ে ধপাস করে নিচে পড়ে গেল। রাত বারোটা। পুরো গ্রাম নিদ্রায় ডুবে রয়েছে। সন্ধ্যের বৃষ্টির পর প্রকৃতি খানিকটা শান্ত হলেও পুনরায় কখন যে ঝড় উঠল মাথাচাড়া দিয়ে,তা কেউ টের পায়নি। তীব্র বাতাসে গাছপালা একে অপরের গায়ে হুটোপুটি খেতে লাগলে মুহূর্তেই হৈচৈ পড়ে যায়। হাসমত আলী ঘুম থেকে জেগে উঠলেন। উৎকণ্ঠা নিয়ে ডাকলেন, ‘পারুল, ও পারুল, উডো উডো। বাইরে ঝড় হইতাছে। তাড়াতাড়ি উডো।’

ঘুম চোখে পারুল উঠে বসলেন। অন্য ঘরে প্রিন্স আর পুতুল ঘুমিয়ে আছে। তারা দু’জন মিলে দ্রুত গিয়ে ওদের দু’জনকেও ডেকে তোলে। ঘন্টা তিনেক বিছানায় শুয়ে গড়াগড়ি খাওয়ার পর অবশেষে ক্লান্ত চোখজোড়া বুজে এসেছিল পুতুলের। কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় তীব্র মাথাব্যথা নিয়ে জেগে উঠল সে।

ঘুম জড়ানো কণ্ঠে প্রশ্ন করল, ‘কী হইছে আব্বা?’

‘বড় চাইদরটা বাইর কইরা গায়ে জড়াইয়া লও আম্মা। আমগো বাইর হইতে হবে। বাইরের অবস্থা সুবিধার লাগতেছে না। পিছনের সুপারি গাছটা ভাইঙ্গা পড়ছে। চালের উপরে রেন্ট্রি গাছ। একটা ডাল ভাইঙ্গা পড়লে কী হইবে,চিন্তা করছো?’

পুতুল বুঝলো, তাদের এই রাতের বেলা ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘর ত্যাগ করতে হবে। ঝড় কমলে পুনরায় আসা যাবে তখন। হাই তুলে ধরা মাথা নিয়ে পুতুল উঠে দাঁড়ায়। আলনার উপর থেকে কালো বড় চাদরটা বের করে সুন্দর ভাবে গায়ে মাথায় জড়িয়ে নিলো। ভাঙা টর্চটা হাতে নিয়ে হাসমত আলী পরিবার সহ বেরিয়ে পড়লেন। বের হওয়ার পর দেখা গেল,তারাই শুধু না,আশেপাশে যাদের বাড়ি তূলনামূলক দুর্বল, নড়বড়ে, তারা সবাই বেরিয়ে পড়েছে। গরীব মানুষের পদে পদে কষ্ট! প্রতি কদমে কদমে মাথা ঝুকিয়ে চলতে হয়। কখনো বা দুনিয়ার নেতাদের সামনে, কখনো বা প্রকৃতির তান্ডবের কাছে!

গ্রামের ভেতর হাতেগোনা অল্প ক’জনের বাড়িই ইটের। বেশিরভাগ টিনের, একদম নিম্নবিত্তদের ছাপড়ার ঘরবাড়ি। চেয়ারম্যান বাড়ির বাহির ঘরটা সবসময়ই উন্মুক্ত থাকে এজন্যে। ঝড় বৃষ্টির সময় আশেপাশের অনেকেই এসে সেখানে আশ্রয় গ্রহণ করে। এই গ্রামে এখন অবধি কোনো আশ্রয়কেন্দ্র তৈরি হয়নি। শোনা গেছে অনেকবার আশ্রয়কেন্দ্রের জন্য টাকা এসেছে। সেটা চেয়ারম্যান ও তার দলবলরা খেয়ে দিয়েছে।

পথে বেরিয়েছে মনু মিয়াও। তিনি আশ্রয়ের খোঁজে বেরোননি, বাজারে তাস খেলছিলেন, ওখানেই দেড়ি হয়ে যায়। ঝড় উঠায় মাথায় বৃষ্টি নিয়েই বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছেন তাই। মনু মিয়া হাসমত আলীকে দেখে করমর্দন করলেন।

‘কই যাইতেছেন বেবাক লইয়া?’

হাসমত আলী বিনয়ের সঙ্গে বলেন, ‘এইতো, চেয়ারম্যান বাড়ি।’

‘আশ্রয়ের লিগা? আরে জামাই মানুষের এত সুন্দর ঘরবাড়ি থাকতে ওতদূরে যাইবেন কেন শেয়ানা ঝি বেটি লইয়া? আখতার কিন্তু এডি পছন্দ করবো না। আহেন আপনে, আখতারের বাড়িত যাই। আইজকা রাইতটা আমিও ওইহানে কাটাইয়া দিমু ভাবতাছি।’

কথাটা শোনামাত্র পুরো শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল পুতুলের। চাদরের তলা দিয়ে মুখ বের করে একবার তাকিয়েই নজর সরিয়ে নিলো। বুক চিঁড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। বারবার এই লোকের সম্মুখীন কেন হতে হচ্ছে তাকে, কে জানে!

হাসমত আলী সম্মতি প্রদানে দোনোমোনো করতে লাগলেন। কিন্তু মনু মিয়ার সঙ্গে যখন পারুলও এক মত প্রদান করলেন তখন আর না করলেন না। গন্তব্য পাল্টে চললেন আখতারদের বাড়ির দিকে।

_____

রাতের জন্য রান্না করা হচ্ছে। মুরগী জবাই দেওয়া হয়েছে। মুরগীর মাংস দিয়ে মুগডাল-চালের খিচুড়ি। ঝড়ের তান্ডব কমলেও এখনো শেষ হয়নি। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বৃষ্টি পড়ছে। চারিদিকে ঠান্ডা আবহাওয়া। এর ভেতর খিচুড়ি খেতে দারুণ লাগবে। তার উপর বাড়িতে মেহমান এসে হাজির! আখতার তাই আদেশ দিয়ে এক্ষুনি রান্না করার।
হাসমত আলী বারবার শুধালেন, ‘কী দরকার? কোনো দরকার নাই তো। আমরা রাইতে খাইছি।’

আখতার শুনলেনই না। পারুল বললেন, ‘আয় পুতুল, আমরাও হাত লাগাই। কাম তাড়াতাড়ি হইয়া যাইবো।’

মায়ের কথায় পুতুল যেতে চাইলে আখতার লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলে উঠে, ‘থাউক না, ও থাকুক। আপনে যান। ওর কী এহন কাম করা সাজে? এট্টু আরাম করুক। হুনলাম ওর শরীরডাও ভালো না নাকী?’

পারুল মাথা ঝাকিয়ে মৃদু হেসে চলে গেলেন। বোঝা গেল তিনি মনে মনে এরকম মেয়ে জামাই পেয়ে বেশ খুশিই হয়েছে।

হাসমত আলী, মনু মিয়া আর আখতারের সামনে বসে থাকতে পুতুলের গা গুলাচ্ছে। আশেপাশে একটিও মেয়ে নেই! পুতুলের রাগও হচ্ছে।

‘কাইলকা একবার ডাক্তার দেহাইয়া আনি? পরশু বিয়া। এহন যদি শরীর খারাপ হয়..’

আখতারের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিলো পুতুল। রুক্ষ কণ্ঠে বলল, ‘দরকার নাই। আমি একটু ভিত্রে যাইবার চাই।’

‘যাও যাও। লজ্জা কীয়ের? এইডা তো তোমারই ঘরবাড়ি।’ হেসে বলেন আখতার। মনু মিয়াও হাসেন। পুতুল কিছু না বলেই উঠে এলো। ঘরের ভেতরও কেউ নেই। সবাই বোধহয় চুলোর ঘরে। ওখান থেকে হৈহল্লা শোনা যাচ্ছে।
একবার ভাবলো, ওদিকেই পা বাড়াবে। কিন্তু শরীরটা টলছে। সন্ধ্যায় অবেলায় ভিজেছে বলে খানিকটা গরম গরমও লাগছে। মন সায় দেয় না আর একটি পদক্ষেপ ফেলি…তাই সিদ্ধান্ত বদলে মাচায় উঠে শোয়ার কথা ভাবলো সে।

মাচা হলো গ্রামের বাড়ির দো-তলা ঘর। কাঠ দিয়ে ছাদ বানানো হয়। সেই ছাদের উপর টিন শেড থাকে। মধ্যিখানে কাঠের জমিনে কেউ কেউ ঘর বানিয়ে দো-তলা তৈরি করে ফেলে। কাঠের মজবুত সিড়িও বানানো হয়। সেই সিড়ি দিয়ে উঠানামা করে।

গায়ের চাদরটা খুলে এক হাতে নিলো পুতুল। ধীরস্থির ভাবে সিড়ি ভেঙে মাচায় উঠে সে। ঘুটঘুটে অন্ধকার। মাচায় অবশ্য বাতি থাকার কথা। কিন্তু সুইচ বোর্ড কোথায় তা পুতুল জানে না। সে বাতি জ্বালানোর কথাও একবার ভাবেনি। মাচার এক পাশ জুড়ে মোটা কাঁথা বিছিয়ে রাখা। তার উপর বালিশ থরে থরে সাজানো। হাতের আন্দাজে একটা বালিশ মাথার কাছে পেতে অবশ শরীরটাকে সেখানেই এলিয়ে দিলো পুতুল। চাদরটা লম্বা করে পুরো গায়ে ছড়িয়ে অবসাদ মাখানো চোখজোড়া বন্ধ করে নেয় সে। আপাতত একটা আরামদায়ক ঘুম খুব প্রয়োজন।

কয়েক মিনিট নীরবেই কাটলো। হুশ ভাঙলো কারো নড়াচড়ার আওয়াজে। যেন কেউ পাশে এসে শুয়েছে বা ঘুমুচ্ছে। ঘুমের ভেতর মানুষ যেমন নড়াচড়া করে ঠিক তেমনই ভাবে সেও নড়ছে। পুতুলের পুরো শরীর শক্ত হয়ে আসে। কণ্ঠে ভয়। স্পষ্ট ভাবে বলতে চাইলো, ‘কেডা? কেডায়?’
কিন্তু স্পষ্ট শোনালো না। তার জায়গায় একধরনের ভীত ফিসফিসানো কণ্ঠ বেরিয়ে এলো। তবে কী আখতার এসেছেন? কোনো সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে? বাকীরা সব কোথায়? পুতুল আর এক মুহূর্ত ও দেড়ি করল না। বেহুশের মতো উঠে দৌড় দিতে গিয়ে কারো পিঠের উপর পাড়া দিয়ে দিলো। সেই সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে তার গায়ের উপর পড়েও গেল। ঘুমিয়ে থাকা ব্যক্তিটি এহেন আচানক কর্মকাণ্ডে ভয় পেয়ে চমকে চোখ খুলে তাকাল।

বাহিরে পুনরায় ঝড় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। খুব জোরে বিদ্যুৎ চমকে উঠল। খোলা জানালার পাল্লা বেয়ে সেই আলো এক ঝলক এসে পুতুলকে দেখিয়ে দিলো, শুয়ে থাকা ব্যক্তিটি আখতার নয়, এ এক অন্য কেউ, যার নাম অর্ক। ওই অল্প বৈদ্যুতিক আলোতে দুই জোড়া চোখ একে অপরকে গাঢ় করে দেখে নিলো।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here