ছদ্মবেশ,পর্ব ১৮,১৯

0
935

#ছদ্মবেশ,পর্ব ১৮,১৯
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
১৮

হসপিটালে OT এর বাইরে এদিক ওদিক পায়চারি করছে তুষার। পাশে তার ছোট বোন তিশা চুপচাপ বসে আছে। আর একটু পর পর চোখ বন্ধ করে কি যেনো বিড়বিড় করছে।
তুষার এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে তিশার পাশে গিয়ে বসলো।
তিশা কাঁতর গলায় খুব করুন ভাবে বলে,
– মায়ের কিছু হবে না তো ভাইয়া? মা ভালো হয়ে যাবে তো?
তিশাকে এক হাতে আগলে ধরে তুষার। অন্য হাত তিশার মাথায় বুলাতে বুলাতে বলে,
– কিছু হবে না। ইন’শা আল্লাহ্ এবার মা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। দোয়া কর শুধু।
তিশা আবারও চোখ বন্ধ করে কি যেন বিড় বিড় করতে লাগলো।
তুষার উঠে আবার টেনশনে এদিক ওদিক পায়চারি করতে থাকে। বাবা মারা যাওয়ার পর এখন শুধু মা আর এই ছোট বোনটাই আছে। মায়ের কিছু হয়ে গেলে যে খুব একা হয়ে যাবে ভাই-বোন দুজন।

কিছুক্ষন পর ডাক্তার এসে গুড নিউজ দিতেই আলহামদুলিল্লাহ বলে একটা হাসি দেয় তুষার। তিশা দৌড়ে এসে তুষারের সামনে দাড়িয়ে উত্তেজিত গলায় বলে,
– ভাইয়া আমি মায়ের সাথে কথা বলবো।
তুষার জিজ্ঞেস করলে ডাক্তার বলে,
– এখন দেখা করা যাবে না। রোগির জ্ঞান ফেরার পর দেখা করতে পারবে। আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। আশা করি খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন তিনি।

তুষারে হাস্যজ্জল মুখ। ফোন বের করে কল দিলো রাজ, রুশান, নিবিড়, নিলয় এদের। কিন্তু রাজের ফোন বন্ধ পাওয়ায় কথা হলো না তার সাথে। রুশানও ফোন রিসিভ করলো না।
নিবিড় মেসেন্জারে তার বাবুদের সাথে চ্যাট করছিলো। তখনই তুষারের ফোন পেয়ে একটু বিরক্ত হলো সে। ফোন রিসিভ করে গুড নিউজ শুনতেই হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে। সেও হাসি মুখে নানান প্রশ্ন করতে লাগলো। বন্ধুত্ব বোধ হয় এমনই হয়, একজনের খুশিতে অন্য জনের আনন্দ। একজনের দুঃখে অন্য জনের কষ্ট।
নিবিড় ঢাকায় ফেরার কথা জিজ্ঞেস করলে তুষার বলে আরো সাপ্তাহ্ খানেক লেগে যাবে ঢাকায় ফিরতে।
,
,
এদিকে অনেক রাত হয়ে যাওয়ার পরও রাজ বাসায় না ফিরায় টেনশন শুরু হয় সকলের। রুশানের বেলায় তেমন একটা টেনশন করেনা কেও। কারণ রুশান প্রায়ই কি কাজে চলে গিয়ে কোনো রাত ফিরেও আসে না। ফোন করে জানিয়ে দেয় যে আজ আসতে পারবে না। তুষার আর নিবিড় অনেকবার জিজ্ঞেস করলেও কি কাজে ব্যাস্ত থাকে তা বলে না রুশান। তাই তারাও আর জোড় করেনা এসব নিয়ে।
কিন্তু রাজের বেলায় এমন দেড়ি হওয়ায় টেনশন টা বেড়েই গেলো সকলের। তার উপর আবার ফোনও বন্ধ রাজের। এতো রাতে কোনো দুর্ঘটনায় হলো না তো আবার?

রাত প্রায় বারোটার দিকে বাসায় ফিরে রাজ। ফরিদা আন্টি সহ বাকিরা এগিয়ে নানান প্রশ্ন জুড়ে দিলো। কিন্তু রাজের মনটা বিষণ্ন হয়ে থাকায় কারো কথার উত্তর দিলো না।
নিবিড় পাশ থেকে আবার বলে,
– যেখানেই যাও ফোন বন্ধ করে রেখেছিলে কেন?
রাজ এবার শান্ত ভাবে বলে,
– বন্ধ করিনি ওটা ছিন’তাই হয়ে গেছে।
– তার মানে তুমি ছিন’তাইকারির কবলে পরেছো? এ জন্য তোমাকে আগেই বলেছিলাম নতুন শহরে এসেছো একটু সাবধানে চলতে। এমন হাবাগুবা ছেলে দেখলে তো তারা ছিনতাই করবেই। তোমার ভাগ্য ভালো যে পেন্ট সহ খুলে নেয়নি।
রাজ এবার হতাশার দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– মজা নিচ্ছো তুমি?
নিবিড় এবার হেসে বলে,
– আচ্ছা বাদ দাও যা গেছে ফোনের উপর গেছে। তোমার কিছু হয়নি এটাই অনেক। কারণ ফোন গেলে যাক। তুমি বেচে থাকলে এমন অনেক ফোন কিনতে পারবে। যাও এখন ফ্রেশ হয়ে ওসব চিন্তাও ধুয়ে ফেলো।
রাজ আর কিছু না বলে রুমের দিকে চলে গেলো। তার বিষন্ন মন ফোনের জন্য নাকি অন্য কিছুর জন্য এটা বাকিরা কিভাবে বুঝবে?
,
,
কলেজ ফাকি দিয়ে গাড়ি নিয়ে ছুটছে অরিণ। আজ আবার বাবার থেকে অনেক কষ্টে গাড়ি কলেজে নিয়ে আসার অনুমতি পেলো। সমস্যা টা হলো গাড়ি হলো একটা। তার বাবা ওটা নিয়ে অফিসে আসা যাওয়া করে। আর অরিণ মাঝে মাঝে নিয়ে আসার অনুমতি পায়।

তেমনই আজ গাড়ি নিয়ে কলেজে এসে গেটের বাইরে দাড়ালো অরিণ। রাজকে ডেকে বললো গারিতে উঠতে। রাজ প্রথমে অসম্মতি জানালে অরিণ তাকে জোড় করে তুলে চলে যায় সেখান থেকে।
রাস্তায় গাড়ি ছুটে চলছে। অরিণ ড্রাইভ করছে আর রাজ পাশে বসে আছে। অরিণ গাড়ির স্প্রিড বাড়ানোর সময় রাজের দিকে চেয়ে বলে,
– সিট বেল্ট বাধতে পারো?
রাজ একটু অবাক হলেও পরে বুঝতে পারলো অরিণ কেন এমনটা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ তার বর্তমান পরিস্থিতি দেখে যে কেউই বুঝবে যে গাড়ির সম্পর্কে তেমন একটা দারণা নেই তার।
রাজের হাসি পেলেও তা কোনো মতে দমিয়ে রেখে দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
– আসলে কখনো বাধি নি তো তাই জানিনা টিক কিভাবে বাধতে হয়।
অরিণ এবার গাড়ি থামিয়ে রাজের বেল্ট টা ধরে শিখিয়ে দিচ্ছে যে, এভাবে ঘুরিয়ে এনে তারপর এখান দিয়ে সেট করে নিতে হয়।

বিনিময়ে রাজ কিছু না বলে একটু হাসলো। অরিণ আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটতে শুরু করলো। রাজ পাশ থেকে বলে,
– আমরা কোথায় যাচ্ছি?
অরিণ ড্রাইভ করতে করতে বলে,
– কোথাও না। আজ তোমাকে এ শহরের অনেক টা জায়গা ঘুড়ে দেখাবো।
রাজ কিছু না বলে কিছুক্ষন নিরব থাকলে অরিণ বলে,
– তোমার নাকি ফোন ছিনতাই হয়ে গেছে?
রাজ অবাক হয়ে বলে,
– তুমি কিভাবে যানো?
– নিবিড় বলেছে।
– ওহ আচ্ছা।
এর পর অরিণ একটা ফোনের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলে,
– দেখো তো এটা পছন্দ হয়েছে কি না?
রাজ এবার পুরোপুরি অবাক। অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
– ফোন? কার জন্য?
অরিণ হেসে বলে,
– তোমার জন্য। দেখো পছন্দ হয় কি না?
রাজ ওটা হাতে নিয়ে বলে,
– কিন্তু তুমি আমাকে ফোন গিফ্ট করছো কেনো?
– কেন বন্ধু হিসেবে কি দিতে পারি না? আর তোমার ফোনও তো ছিন’তাই হয়ে গেছে তো সবার সাথে যোগাযোগ করবে কিভাবে?
রাজ তার দিকে চেয়ে বলে,
– তার মানে করুণা দেখাচ্ছো?
অরিণ হেসে দিয়ে বলে,
– এই আমি কিন্তু একধম ও এমনটা মাথায় আনিনি। আমি ফ্রেন্ড হিসেবেই গিফ্ট করেছি তোমাকে।
রাজও হেসে বলে,
– তাহলে ঠিক আছে।

রাজ বাসায় আসার পর পরলো আরেক বিপদে। আর তা ছিলো নিবিড়কে নিয়ে। বেচারার ধারণা অরিণ রাজের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। সব সময় তো সাথে লেগেই থাকে। আর কলেজ ফাকি দিয়ে রাজকে নিয়ে লং ড্রাইভে চলে গেলো। তার উপর আবার ফোনও গিফ্ট করেছে। নির্ঘাত অরিণ রাজের প্রেমে পরেছে।
রাজ লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না আর নিবিড়কেও থামাতে পারছে না। বাকিরাও বিষয় টা নিয়ে নিবিড়ের সাথে তাল মিলিয়ে ভালোই মজা নিচ্ছে।
রাজ অতিষ্ঠ হয়ে চলে যাওয়ার সময় নিবিড় তাকে এক পাশে ডেকে নিয়ে বলে,
– ভাই আগেও বলেছিলাম এখনো বলছি। একবার প্রেম করে দেখো। সব কিছু রঙিন মনে হবে তখন। আর অরিণ নিজেই তোমার উপর ফিদা সেখানে আর কি লাগে বলো।
– ধ্যাত,,,
বলেই সেখান থেকে চলে গেলো রাজ।
ফ্রেন্ডস মহল টা এমনই কোনো ভাবে একটা মেয়ের সাথে কথা বলতে দেখলেও সেটাকে টেনে বাকিরা রিলেশন অব্দি নিয়ে যাবে।
,
,
কেটে গেলো আরো কয়েক দিন। এদিকে মিতালির বিয়ের সময়ও নিকটে চলে আসলো। কালকের পর পরশুই বিয়ে।
মা মোটামুটি সুস্থ হলে তুষারও চলে আশে ঢাকায়। এখন ফ্রেন্ডস মহল পরিপূর্ণ।

পাঁচ জন মিলে বিয়েতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পাঁচ জনে টাকা তুলে ভালো দেখে একটা দামি গিফ্ট নিয়ে চলে গেলো বিয়েতে।
বিয়ে বাড়িতে যাওয়ার পর থেকেই একেকজন একেক কাজে লেগে পরলো। নিলয় চলে গেলো বরের সাথে ছবি তুলতে।

রাজ আর রুশান গিয়ে একে একে সবার সাথে পরিচিত হচ্ছে। সেখানে সব গেষ্টদের মাঝে একজন লোক রুশানের দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। আর বিড়বিড় করে বলছে,
– ও মাই গট ছেলেটা তাহলে এই বেশে আশে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রুশানকে দেখে কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো লোকটার।

লোকটার এমন আচরণ রুশানের তীক্ষ্ম দৃষ্টি এড়ালো না। রুশানের চোখাচোখি হয়ে যেতেই সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করায় ব্যস্ত হয়ে পরলো লোকটা।

আর নিবিড় চলে গেলো কোথায় সুন্দরি মেয়ের দেখা পাবে সেই খোজে। আর তুষার লেগে আছে তার সাথে। নিবিড় কিভাবে মেয়ে পটায় তা আজ শিকবেই শিখবে। নিবির বার বার তুষারকে বলছে নিলয়ের সাথে গিয়ে ছবি তুলতে। কিন্তু তুষার আজ পিছু ছারবে না নিবিড়ের। মেয়ে পটানোর কৌশল আজ শিখেই ছারবে সে।

তুষার ঘুরতে ঘুরতে কিছুক্ষন পর লক্ষ করে নিবিড় কতোগুলো মেয়ের মাঝখানে বসে হেসে হেসে গল্প করছে। আর মেয়েগুলো খুব সুন্দর ভাবেই আড্ডা জ্বমিয়েছে তার সাথে।
যা দেখে তুষার ভেতর ভেতর জ্বলতে শুরু করলো। যেখানে তুষার একটা মেয়ের সামনে দাড়ালে হাই হ্যালো কেমন আছেন ছাড়া কিছুই খুজে পায় না। আর সেখানে কি না নিবিড় কত সুন্দরেই মেয়েদের সাথে মিশে যায়।

না আজ যাই হোক, নিবিড়ের মতো সেও মিশে যাবে মেয়েদের সাথে। তাই তুষার আর দেড়ি না করে মেয়েদের মাঝখানে নিবিড়ের পাশে বসে পরলো। আর মেয়ে গুলোর উদ্দেশ্যে নিবিড়কে দেখিয়ে বলতে শুরু করলো,
– নিবিড় আমার ফ্রেন্ড। আমার খুব ভালো বেষ্টফ্রেন্ড ও। সে তোমাদেরকে ফ্রেন্ড বানিয়ে ফেলেছে তাই না? তাহলে আমিও তোমাদের ফ্রেন্ড। আমার সাথেও আড্ডা দাও তোমরা।

মেয়ে গুলো হা করে তাকিয়ে তাকে তুষারের কথাবার্তা শুনে। তুষারের আড়াল থেকে নিবিড় মাথার কাছে আঙুল ঘুরিয়ে মেয়েদেরকে ইশারা দিয়ে বুঝায় যে, তুষার পাগল।
একটা মেয়ে বিষয় টা বুঝতে পেরে তুষারকে বলে,
– আচ্ছা ভাইয়া তোমার সাথে আমরা পরে আড্ডা দিবো। এখন চলে যাও। ওই যে ওখানে ছোট বাচ্চারা খেলা করছে ওখানে গিয়ে ওদের সাথে খেলা করো। আমরা পরে তোমাকে ডেকে নিবো আড্ডা দেওয়ার জন্য।
তুষার এবার নিরাশ হয়ে নিবিড়ের দিয়ে চেয়ে আস্তে করে বলে,
– প্লিজ ভাই একটার সাথে অন্তত ফ্রেন্ড বানিয়ে দে।

নিবিড়ও তখন ভাব নিয়ে নিলো। আর পল্টি মেরে বলে,
– আচ্ছা তুই যা ওখানে বাচ্চাদের সাথে খেলা কর। পরে ভাইয়া তোকে ডেকে নিবো।
তুষার করুন গলায় বলে,
– থাকি না কিছুক্ষন।
ওখানে একটা মেয়ে পাগল সহ্য করতে পারেনা। তাই নিবিড়ের ইশারায় তুষারকে পাগল মনে করে ঝাড়ি মেরে বলে,
– ঐ মিঞা আপনাকে যেতে বলছিনা যাচ্ছেন না কেন?
নিরুপায় হয়ে সেখান থেকে উঠে কিছুটা দুড়ে সরে এলো তুষার। পেছন ফিরে আবার অসহায় হয়ে নিবিড়ের দিকে তাকায়। আর ভাবতে থাকে, নিবিড় কিভাবে মেয়েদের সাথে এতো সহজে মিশে যায়?

ওদিকে সবচেয়ে বড় কান্ড টা ঘটিয়ে দিলো নিলয়। বরের সাথে ছবি তুলতে তুলতে পরিচিত হয়ে যায় সে। নিলয় মিতালির ফ্রেন্ড বিষয়টা জানার পর মিতালির হবু বর নিলয়কে আস্তে করে বলে,
– মিতালি মেয়ে কেমন? আপনি তো ফ্রেন্ড আপনি ভালো জানেন।
নিলয়ও হেসে বলে,
– অনেক ভালো মেয়ে মিতালি।
তখন বর আবার বললো,
– আচ্ছা মিতালি কি কোনো রিলেশনে ছিলো?
নিলয় এবার চার দিকে চেয়ে বলে,
– ওটা কাউকে বলতে নিষেধ করেছে।
মিতালির হবু বড়ও খুব চালাক ছিলো তাই বললো,
– আরে আমরা তো এখন ভাই ভাই, আমাকে বললে কিছু হবে না।
নিলয় এবার চার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভেবে বলে,
– আপনি কাউকে বলবেন না তো?
– না বলবো না।
নিলয় এবার সুন্দর করেই বলতে শুরু করলো,
– মিতালির ১১ টা বয়ফ্রেন্ড ছিলো। সাকিব, সুজন, সাব্বির, জানি, নিরব, মামুন, নবি আরো কে কে জানি ছিলো। একটা ধরতো একটা ছাড়তো। কয়দিন আগে একটা ছেলের সাথে ধরাও খেয়েছিলো। তাই তো ওর বাবা ওকে তারাতারি বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। যেন বিয়ের পর সব ঠিক হয়ে যায়। আর শুনুন, আপনাকে কিন্তু আমি এসব খুব বিশ্বাস করে কথা গুলো বলেছি। আপনি আবার কাউকে বলবেন না প্লিজ।

To be continue…..

#ছদ্মবেশ (পর্ব ১৯)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

– এই দুশ্চরিত্রা মেয়েকে কখনোই ঘরের বো বানানো যাবে না। এই জন্যই বলেছিলাম বিয়ের আগে ভালো করে খোজ খবর নিতে।

খুব কড়া গলায় কথা গুলো বললো মিতালির হবু স্বামী। উপস্থিত সবার দৃষ্টি সব দিক সরে এবার বরের দিকে নিক্ষেপ করলো। অবাক হয়ে দাড়িয়ে আছে সবাই।
বরের বাবা এগিয়ে এসে আস্তে করে বলে,
– এসব কি বলছিস? দুশ্চরিত্রা, বৌ বানানো যাবে না এসব কি?
বর আবারও বলে,
– যা শুনেছো তাই বলেছি আমি। এমন দুশ্চরিত্রা মেয়েকে কখনোই আমি বিয়ে করবো না। যে একটা না দুইটা না একাধিক ছেলের সাথে প্রেমলিলায় মগ্ন ছিলো।
বরের বাবা এবার চার দিকে তাকিয়ে লজ্জা ভঙ্গিতে বলে,
– কি করছিস এসব? চারপাশে লোকজন তাকিয়ে আছে। মান সম্মানের একটা প্রশ্ন আছে।
কিন্তু বর তার সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়বে না। ডিরেক্টলি বললো,
– সব কিছু এখানেই স্থগিত করুন। এই বিয়ে কিছুতেই হবে না।

পাশ থেকে মিতালির ভাই উচু গলায় বলে,
– বিয়ে না হলে না হবে। তবে আমার বোনের নামে এসব বলার সাহস কি করে হয় আপনার?
– সত্য কথা বলতে কোনো ভয় নেই। এমন একটা দুশ্চরিত্রা মেয়েকে আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এখন আবার বড় বড় কথা?

মিতালির ভাই এগিয়ে এসে বলে,
– এসব কে বলেছে আপনাকে?
বর এবার পাশে তাকিয়ে নিলয়ের কথা বলবে কিন্তু পাশে নিলয়ের ছায়াও খুজে পেলো না সে। ভেজাল লাগিয়েই হাওয়া হয়ে গেছে নিলয়।
এতোক্ষন কথাবার্তার মাঝে নিলয়ের নাম টা জিজ্ঞেস করতেই মনে ছিলো না তার। তাই নাম না যেনে চার দিকে চোখ বুলিয়ে নিলয়কে খুজতে শুরু করলো সে।
কিছুক্ষন পর বিরক্ত হয়ে বলে,
– একটা ছেলে বলেছিলো, তাকে তো খুজেই পাচ্ছি না। আর যেই বলুক, ওটা খোজার দরকার নেই। সে তো সত্য কথাটাই বলেছে। আপনাদের প্রত্যেকের নামে প্রতারণার মা’মলা করা উচিৎ।
কিছুক্ষনের মাঝেই যেনো পুরো বিয়ে বাড়িটা একটা ঝগড়া বাড়িতে পরিনত হয়ে গেলো।
আর ঐ দিকে ঝামেলা শুরু হচ্ছে তা দেখে নিলয় আগেই দৌড় দিয়েছে। এমন একটা ঘটনা ঘটে যাবে তা হয়তো কল্পনাও করেনি সে। কিন্তু দোষ যেহেতু করেই ফেলেছে এখন নিজের জীবন বাচানো ফরজ।

দৌড়ে রাস্তায় এসে হাপাতে লাগলো নিলয়। আর ওদিকে রাজ, নিবিড়, তুষার এদের বুঝতে বাকি নেই যে বরের কানে এসব কে পৌঁছে দিয়েছে?
তাই তারা ব্যস্ত হয়ে খুজে বেড়াচ্ছে নিলয়কে। কিন্তু পুরো বিয়ে বাড়িতে নিলয়ের কোনো অস্তিত্বও নেই। আবার রুশানকেও খুজে পাচ্ছে না তারা। কোথায় গেলো দুজন?
একটু পর নিলয় ফোন দিয়ে হাপাতে হাপাতে বলে,
– ভাই তোরা এখনো দাড়িয়ে আছিস? পিঠের উপর মার পরার আগেই বেড়িয়ে আয় সবাই।

আর এদিকে মেইন রোডে অনেক স্প্রিডে গাড়ি ছুটে চলছে। আর লোক টা বার বার লুকিং গ্লাসে পেছনে ছুটে চলা বাইটাকে দেখছে।
গাড়ির সাথে তাল মিলিয়ে পেছন পেছন ছুটছে বাইকও।
গাড়ির মাঝে এসি থাকা স্বত্তেও ঘামে শরির ভিজে গেলো লোকটার। গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করে পেছনে বাইক নিয়ে ছুটে চলা রুশানের দিকে কয়েক রাউন্ড গুলি চালালো সে। তবে উত্তেজনা বসত গুলি কোথায় গিয়ে পরছে তার কোনো হুস নেই।

কিছুক্ষন পর লক্ষ করে বাইক টা আর পেছনে ফলো করছে না। লোকটার মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো। ভেবেছে হয়তো এতোক্ষনে লাশ হয়ে রাস্তার এক পাশে পরে আছে রুশান।
কিন্তু তার ধারণা টা মিথ্যা প্রমান করে হুট করে গাড়ির সামনে এসে দাড়ায় বাইক। গাড়ির এক চাকায় গুলি করতেই গাড়ি গিয়ে রাস্তার পাশে একটা গাছের সাথে জোড়ে আঘাত করে। এরপর আর কিছু মনে নেই তার।

রুশান নেমে দেখে লোকটার নিশ্বাস এখনো চলছে আর তার পাশে থাকা অন্য লোকটা জায়গায়ই মা’রা গেছে।
লোকটাকে গাড়ি থেকে বের করে রুশান। হসপিটাল কাছে থাকায় হসপিটালে নিয়ে চলে গেলো লোকটাকে। অন্যজন এখনো গাড়িতে পরে আছে। কালকে সকালে সবাই ভাববে সেই হয়তো গাড়ি সহ এক্সিডেন্ট করেছে।

রুশান হয়তো ভেবেছিলো লোক এটাও মা’রা যাবে। কিন্তু ভাবনা মিথ্যা হলো তার। তবুও এটা তার জন্য গুড নিউজ।

বাবার সামনে বুকে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে রুশান। লোকটাকে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে নার্সকে ডেকে সব কিছু বুঝিয়ে দিলো রিদ।
রুশান বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
– ও বেচে থাকা টা আমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। মোটামুটি সেরে উঠতে কয়দিন লাগবে বাবা?
রিদ ছেলের কাধে এক হাত রেখে হেটে কিছুটা দুড়ে নিয়ে গেলো তাকে। তারপর থেমে বলে,
– একজন ডাক্তারকে বলে দিয়েছি যেন অল টাইম ওর সাথে থাকে। সাথে দুজন নার্সও। যত্নের ত্রুটি রাখবে না। আশা করি তারাতারিই ভালোর দিকে যাবে। তবে আমার মনে হয় ওকে এতোদিন এখানে রাখা ঠিক হবে।
রুশান বাবার দিকে চেয়ে বলে,
– চিন্তার কারণ নেই বাবা। হসপিটালের বাইরে বেশ কয়েকজন সিকিউরিটি গার্ড রেখে যাচ্ছি আমি। কেবিনের বাইরেও থাকবে। আর কালকে একটু ভালোর দিকে আসলেই নিয়ে যাবো তাকে।

রিদ আর কিছু না বলে ছেলের কাধে শক্ত করে হাত রেখে একটু হাসলো। ছেলের প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস আছে তার।
,
,
পর দিন সকালে বাসায় ফিরে রুশান। এসেই দেখে সবাই সবার মতো আছে আর নিলয় এক পাশে চুপচাপ বসে আছে। আর নিবিড় বিরক্তি নিয়ে বলে,
– ভাই মাপ চাই আর দরকার নেই আমাদের সাথে থাকার। নিজের রাস্তা নিজে মাপো দয়া করে।
রুশান এগিয়ে গিয়ে বলে,
– কি হয়েছে? সবাই এভাবে বকাবকি করছিস কেন ওর সাথে? আর কালকে বিয়ে খেয়ে কখন আসলি সবাই?
নিলয় পাশে হেলান দিয়ে বলে,
– আর বিয়ে,, সব রনক্ষেত্র বানিয়ে দিয়েছে আমাদের এই সত্যবাদি গুনধর বন্ধু।
রুশান একটু ভ্রু কুচকে বলে,
– কেন কি হয়েছে? বিয়ে আর রনক্ষেত্র মানে?
নিবিড় বিরক্ত নিয়ে বলে,
– কি হয়েছে বুঝতেছিস না? মিতালির জামাইকে গিয়ে সব বলে দিছে। আর সে এসব শুনে বিয়েটাই লন্ড ভন্ড করে চলে গেছে। সব এরেন্জ করা হয়ে গিয়েছিলো দেখতেই পেয়েছিস। বিয়ের সব কিছুই আয়োজন করা হয়ে গিয়েছিলো। আর ঠিক বিয়ে হওয়ার আগ মুহুর্তেই বিয়েটা ভেঙে দিলো এই হারামজাদা। কোনো ধারণা আছে একটা বিয়ের আয়োজন করতে কি পরিমান খরচাপাতি হয়? আর খরচার কথা না হয় বাদই দিলাম। ওদের মান সম্মান বলেও তো একটা কথা আছে নাকি? এখন মিতালির বাবা-মা বাসায় বসে বসে কাঁদছে।

রুশান এবার হতাশ হয়ে তাকালো নিলয়ের দিকে। নিবিড় আবারও বলে,
– আজ কোনো ইমোশনাল ড্রামা চলবে না এখানে। আজকের মাঝেই নিলয় এই বাসা ছারবে। কোথায় যাবে তা দেখার বিষয় না। হারামজাদা ঐ দিনও আমার গার্লফ্রেন্ডকে সব বলে দিয়ে ঝামেলা বাধাচ্ছিলো। এমন ফ্রেন্ড থাকার চেয়ে না থাকা অনেক ভালো।
তুষার এসব দেখে বলে,
– তোরা জানিস ও কেমন। তাও ওর সামনে এসব বলতে যাস কেন? এখন তো যাও হওয়ার হয়ে গেছে। এসব বাদ দে না।
নিবিড় তুষারের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি তো মুখে বলছি। আর তুই যদি শুনিস যে ও তোর সাথে কি করছে তাকে লা’থি দিয়ে বের করবি বাসা থেকে।
তুষার এবার দাড়িয়ে কি করেছে তা জানতে চাইলে নিবিড় চুপ হয়ে যায়। তারপর চুপচাপ চলে যায় সেখান থেকে।
,
,
পরিবেশ আজ খুব অশান্ত। সারা দিন খুব বাজে ভাবে কেটেছে আজ। সন্ধার পর রাজ আরোহিকে পড়াতে গেলে ওখানে পরে আরেক ঝামেলায়।
আসার পর থেকেই কোনো কথা বলছে না আরোহি। মানে তার হাব ভাব এমন যে, বয়ফ্রেন্ডের উপর অভিমান করেছে গার্লফ্রেন্ড। এখন তার অভিমান ভাঙাতে হবে।
কিন্তু রাজ এবার একটা ঝাড়ি মারতেই চমকে উঠে আরোহি। রাজ করা গলায় বলে,
– আমি কি তোমার ফ্রেন্ড হই নাকি অন্য কিছু? যে তুমি রাগ করে থাকবে আর আমি রাগ ভাঙাবো?
রাজের এক ধমকে আরোহি ভয়ার্ত চেহারা নিয়ে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বলে,
– আপনি কালকে আসেন নি কেন? কালকে আমায় বাইরে নিয়ে যাওয়াত কথা ছিলো না?
রাজ বিরক্ত হয়ে বললো,
– আমি কি তোমার টিচার, নাকি পার্সনাল এসিস্ট্যান্ট?
আরোহি মাথা নিচু করে বলে,
– আচ্ছা আর কোনো দিন বলবো না, স্যার।
,
,
এদিকে সন্ধায় বাধলো আরেক গন্ডগোল। তুষারের একটু সন্দেহ হলে নিলয়ের ফোন চেক করে সে। ফেসবুকে ঢুকে লগআউটে তার প্রান প্রিয় সুমাইয়া ইসলামের আইডি টা দেখে এক মুহুর্তের জন্য যেন পৃথিবী থমকে গেলো তার। তার প্রেয়শি যে নিলয়ের ফেসবুকের লগআউটে লুকিয়ে আছে তা কল্পনাও করতে পারেনি সে।
রাগে মাথায় র’ক্ত চড়ে বসে তুষারের।

এর পর চুপচাপ বসে থেকে নিবিড়কে ডাক দেয় সে। নিবিড় আসলে তাকে দেখায় বিষয় টা। নিবিড় যদিও আগেই জানতো যে এটা নিলয়ের ফেইক আইডি ছিলো তবুও তুষারকে কখনো কিছু বলেনি। আজ নিলয়ের উপর এমনিতেই অনেক রাগ। তাই রাগি গলায় বলে,
– এখনো এই হালার প্রতি দরদ দেখাবি?
তুষার রেগে বলে,
– আজকে এই হালার এক দিন কি আর আমার যা কয়দিন লাগে।

নিলয় রুমে আসা মাত্রই তুষার কোনো কথা ছারা উদম কেলানি শুরু করে। এরপর নিলয়ের কাপর চোপর ব্যাগ সব নিয়ে সাথে নিলয়কে নিয়ে বেড়িয়ে আসে সে।
গেটের বাইরে নিলয়ের দিকে সব ছুড়ে মেরে বলে,
– নিবিড় ঠিকই বলেছে। তোর মতো বন্ধু থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। আর কখনো ফিরবি না এখানে।
নিলয় খুব অসহায় চোখে তাকিয়ে বলে,
– আমাদের এতো দিনের বন্ধুত্বটা এভাবে শেষ করে দিবি তোরা? এতো দিন তোদের নিয়ে একসাথে থেকেছি। এখন আমি তো পারবো না তোদের ছারা থাকতে।
নিবিড় বলে,
– তুমি এখানে থাকবে আর আমাদের একটা একটা আছোলা বাশ দিবে, না? আগেই বলেছি কোনো ইমোশনাল ড্রামা আজ এলাও না। এবার নিজের রাস্তা মাপো।

আজ সারা দিন সকলের মুখে নানান কথা শুনে অপমান হয়ে আর এখন এভাবে বাসা থেকে বের করে দেওয়া বিষয়টা খুব গায়ে লাগলো নিলয়ের। তার একটা বদ অভ্যাসের কারণে তার কাছের বন্ধুরা আজ তার সাথে এমন আচরণ করেছে। ভাবতেই দু’চোখ ভিজে উঠে তার।
ব্যাগ নিয়ে রাস্তার এক পাশে বসে নিশ্চুপ হয়ে চোখের জল ফেলছে নিলয়। বন্ধুদের ছারা কিভাবে থাকবে সে? কষ্ট হবে খুব কষ্ট হবে।

বাসায় প্রবেশ করেই অনুসূচনা জেগে উঠলো তুষারের। নিবিড়ের দিকে চেয়ে বলে,
– নিলয়কে এভাবে তাড়িয়ে দিয়ে কি ঠিক করেছি? কোথায় বা থাকবে সে?
নিবিড় একটু হেসে বলে,
– তাড়িয়ে দিলাম কই? যাই করুক, আমাদের বন্ধু তো। এখন এই সিচুয়েশন থেকে একটা শিক্ষা গ্রহন করা দরকার তার। তাই এমনটা করেছি। সময় হলে আমি নিজেই আবার নিয়ে আসবো তাকে।

To be continue…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here