ছদ্মবেশ (পর্ব ৪৬)

0
915

#ছদ্মবেশ (পর্ব ৪৬)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

রাত ৯ টার দিকে বাসায় ফিরে বাবার সামনে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে নীলা ও নিবিড়। সামনে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আছে সে। কিছুক্ষন পর গম্ভির গলায় প্রশ্ন করে,
– কোথায় গিয়েছিলি এতো রাতে? আর কে এই ছেলে?
কিছুটা নার্ভাস হয়ে আছে নীলা। উত্তর টা মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না তার। বাবা বলেছিলো আজ ফিরতে দেরি হবে। তাই নিবিড়ের সাথে একটু বাইরে গিয়েছিলো হাটতে। এটা কি করে বাবাকে বলবে সে?
চুপ করে থাকলে বাবা আবার বলে,
– কি হলো কথা বলছিস না কেন? তোকে বলেছি না, সন্ধার পর বাইরে না যেতে?

নীলাকে ভয়ার্ত দেখে নিবিড় কিছুটা জড়তা নিয়ে বলে,
– আসলে আঙ্কেল ওর কোনো দোষ ছিলো না। আপনি দেড়িতে আসবেন শুনে, সে একা থাকতে বোরিং ফিল করছিলো। তাই ফরিদা আন্টির সাথে আড্ডা দিয়ে সময় পার করতে আমাদের বাসায় গিয়েছে।

নিবিড়ের কথায় নীলাও এবার উপর নিচে মাথা নেড়ে হ্যা সূচক স্বম্মতি জানালো। নীলার বাবা এবার স্বাভাবিক হয়ে বলে,
– তোমাদের কি মনে হয়, আমি তোমাদের ফরিদা আন্টির কাছে খোজ করিনি? তোমরা তো বাসায় ছিলেই না। তাহলে মিথ্যে বলছো কেন? যাই হোক, ভেতরে আসো।
বাবার অনুমতি পেয়ে নীলা ভেতরে আসলো। আর নিবিড় বিদায় নিয়ে চলে যেতে চাইলে নীলার বাবা বলে,
– কোথায় যাচ্ছো? তুমিও ভেতরে আসো। তুমি কি ভেবেছো তোমায় চিনতে পারিনি আমি? আমার মেয়েটা কার সাথে মিশে, চলে-ফিরে এসব খোজ নেওয়া কি আমার দায়িত্বের মাঝে পড়ে না? ভেতরে আসো, একসাথে ডিনার করে তারপর বাসায় যাবে।

নিবিড় কিছুটা অবাক ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর নীলার ইশারায় ভেতরে প্রবেশ করলো সে। সব কিছু এতো ইজি-লি হয়ে যাবে ভাবনাতেই ছিলো না। কার কাছে যেন শুনেছিলো, কঠিন কোনো কিছু খুব সহজেই হয়ে গেলে তার পেছনে কোনো না কোনো কারণ লুকিয়ে থাকে। হয়তো কোনো বিপদেরও পূর্বাভাস হতে পারে তা।
যাই হোক, এতো কিছু ভাবার প্রয়োজন নেই। যা হবে পরে দেখা যাবে।
,
,
একসাথে আট-দশটা গাড়ি এসে থামলো নির্জনের বাগান বাড়িটার সামনে। বিশাল বড় বাড়িটার চার পাশে উচু দালানে ঘেরা। ভেতরে নানান ফুল ফলাদির গাছে সৌন্দর্যতা অন্য রকম ভাবে ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে এই সন্ধায় পর মুহুর্তে লাল নীল লাইটের আলোয় চার পাশ টা আরো মন মুগ্ধকর।
গেস্টদের জন্য স্পেশাল রুমে অনেক্ষন যাবত বসে আছে নির্জন ও নিলয়। পাশে কাঁচের এরিয়ার বাইরে একটা সুইমিংপুল।
বাড়ির চার পাশে নির্জনের সিকিউরিটি গার্ড টা পাহারা দিচ্ছে। আর পিন্টু সহ কয়েকজন মিলে গেষ্টদের নিয়ে আসলো এই বাগান বাড়িতে।

ইন্ডিয়া থেকে এসেছে গেস্ট, রোহান পান্ডে। সাথে আরো দুজন।
রোহান পান্ডে সোজা এসে নির্জনে ও নিলয়ের সামনে দাড়িয়ে দু’হাত জোড় করে তাদের ধর্ম মতে প্রনাম জানালো। বিনিময়ে নির্জন তার সাথে হাত মিলিয়ে তাদের সামনে বসতে বলে। আথিতেয়তার পূর্বে নিজেদের ডিল ফাইনাল করে কন্টাক্ট পেপারে সাইন করলো নির্জন।

এবারের কন্টাক্ট টা হলো ৬ মাসে তিনশত মানুষ পা’চার করা। তার মাঝে একশত ছেলে আর বাকি দুই শত মেয়ে হতে হবে।
কয়দিন আগে ব্লাক মার্কেটে শত মানুষের পা’র্স পাঠানোর কন্টাক্ট টা সফল ভাবে কমপ্লিট হওয়ায় এবার এক সাথে তিন শত মানুষ পা’চারের কন্টাক্ট পেপারে সাইন করলো নির্জন। নির্জনের পাশে দুই হাত এক করে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে নিলয়। দেশের সিকিউরিটি আগের তুলনায় কঠোর করা হয়েছে। চার দিকে পরিস্থিতি উত্তাল। এমন পরিস্থিতিতে ৬ মাসে তিন শত মানুষ তুলে নেওয়াটা কোনো সহজ কথা না। তবুও রিস্ক-এর মাঝেই তো বিজনেস।
,
,
পরদিন বিকেলে স্কুল ছুটির মুহুর্তে ছাদের এক পাশে দাড়িয়ে আছে নিবিড় ও নীলা। বাড়ির ছাদ থেকে স্কুল টা দেখা যায় পুরোপুরি। ছেলে মেয়ে গুলো দুষ্টুমি করতে করতে বাসায় যাচ্ছে। নিবিড় তাদের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় বলে,
– ছোট কালে আমি যখন এদের মতো স্কুলে পড়তাম। তখন আমি অনেক পুরোনো কাপড় পড়ে স্কুলে যেতাম। আমায় পালিত মা যে সামর্থবান ছিলো এমনটাও না। একা একা নিজেই কাজ করে আমাকে খাওয়াতো স্কুলে পাঠাতো। তখন এতো কিছু বুঝতাম না। মায়ের কাছে ছুটে গিয়ে একটা অভিযোগ করতাম। আমিও বাকি ছেলেদের মতো নতুন জামা পড়বো৷ পুরান জামা দেখে অনেকে আমায় এড়িয়ে চলে। মা তখন চুপ করে থাকতো। শুধু বলতো এক সময় সব পারবি। নিজের ছেলে না হওয়া স্বত্বেও অনেক কেয়ার করতো আমার। আর আমার বাবা মা নিজের ছেলেকেই নিজের কাছে রাখতে পারেনি। আমার বাবা মাকে খুজে পেলে একটা কথা জিজ্ঞেস করতাম, কেন আমি তাদের সাথে নেই।
পাশ থেকে নীলা তাকে শান্তনা দিতে বলে,
– সবার জীবন এক রকম হয় না। তবুও সবারই জীবনকে মানিয়ে নিতে হয়। যারা আফসোস বয়ে বেড়ায় তারা কখনো এগিয়ে যেতে পারে না। তাদের জীবনের গতিবীদ থমকে থাকে আফসোস ও হতাশার কারণে। জীবনকে মানিয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে পারলেই তুমি কঠিন ঝড়েও টিকে থাকতে পারবে৷

নিবিড় এবার একটা হাসি দিয়ে বলে,
– একবার আমি আমার সেই মাকে প্রশ্ন করেছিলাম যে, ভালোবাসার মানুষ গুলো কেমন হয়? মা বলেছিলো, ভালোবাসার মানুষ কেমন হয় জানিনা। তবে তাকে তোমার কাছে পৃথিবির চেয়েও দামি মনে হবে। যার হৃদয়ের কম্পনের সাথে তোমার হৃদয়ের কম্পন মিলে যাবে। যার মাঝে তুমি নিজেকে দেখতে পাবে। তাহলে বুঝে নিও সেই তোমার ভালোবাসার মানুষ।
এমনটাই শুনেছি আমি। যদি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে আমার সেই মানুষটা তুমি নীলা। আমার সব প্রিয় মানুষ গুলো আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি আর কাউকে হারাতে দিবো না। আমার বন্ধুরা, মায়ের মতো ফরিদা আন্টি এমনকি তোমাকেও। কাউকে হারাতে দিবো না আর।

বলেই নীলার ঘাড়ে হাত রেখে তাকে নিজের সাথে চেপে ধরলো নিবিড়। নীলা একটু কেঁপে উঠে তার কাধ চেপে ধরে তাড়া নিবিড়ের হাতটার দিকে তাকালো। নিবিড় কি তাকে ইন-ডিরেক্টলি ভালোবাসার বার্তা দিয়েছে?
হাতটার দিকে একটু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর নিবিড়ের দিকে চেয়ে একটু মুচকি হাসলো সে। যেন চিৎকার করে নিবিড়ের কানের কাছে বলতে ইচ্ছে করছে,
– তুমি আর কাউকে হারাতে হবে না। সবাই তোমার পাশে থাকবে। সবার মাঝে আমিও।
,
,
গত দুদিন ধরে রাজকে নিয়ে কিছুটা হলেও ভাবনা তৈরি হচ্ছে নিলয়ের মনে। নিজের ভাবনা গুলোর উত্তর খুজতে সন্ধার পর নাস্তা শেষে রাজের পাশে গিয়ে বসে সে।
আজ শুক্রবার। আরোহিকে পড়াতে যায়নি রাজ। সেই সুবাদে আজ বাসাতেই আছে রাজ।

রাজের সামনে গিয়ে দুই হাটু ভাজ করে ভদ্র ছেলেদের মতো বসে নিলয়। মুখে একটা হাবলা হাসিটা সবসময়ই বিদ্যমান থাকে।
রাজের দিকে চেয়ে নিলয় বলে,
– তোমার টিউশনি কেমন চলে?
রাজ একটা হাসির রেখা টেনে বলে,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো।
নিলয় আবার বলে,
– তুমি মনে হয় নির্জন নামের কারো মেয়েকে পড়াও তাই না? আমি তোমাকে ঐ বাসায় যেতে দেখেছি তাই বললাম।
রাজ একটু ভ্রু-কুচকে বলে,
– হ্যা, কিন্তু তুমি কিভাবে জানো?
নিলয় এক গাল হেসে বলে,
– আরে তাকে কে না চেনে? অনেক বড় বিজনেসম্যান। বেশির ভাগ বাড়ির বাইরেই থাকে। আমি যতদুর জানি সে সিলেটে বেশি সময় কাটায়। তবে সেখানে কি করে, তা কেউ জানে না।
নিলয় কথাটা বললো কারণ, সে দেখতে চায় রাজের মনে কোনো উত্তেজনা তৈরি হয় কি না।
কিন্তু রাজ নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে বলে,
– হয়তো তার বিজনেস সেখানে? সিলেট কোন জায়গায় থাকে সে?
নিলয় মনে মনে একটু খুশি হলো। তীরটা হয়তো ঠিক জায়গায় লেগেছে। সে রাজকে একটা জায়গার নাম বলে। তারপর একটু চিন্তিত স্বরে বলে,
– তবে আমি শিউর জানিনা। লোকজনের মুখে শুনেছি আমিও। অনেকেই নাকি তাকে প্রায়ই দেখে সেখানে।
রাজ আর কিছু বললো না। নিলয় নিজের মতো আর কিছু কথা বলে উঠে চলে যায় সেখান থেকে।
নিলয়ের ভাবনা মতে রাজের মাঝে কোনো ঘাপলা থাকলে নিশ্বই রুশান অথবা রাজের মাঝে কেও সেই জাগাটায় খোজ করতে পৌছে যাবে। আর কারো ছায়াও না পৌছালে ভেবে নিবে রাজ এসবের কিছুই জানেনা। এখন দেখার বিষয় যেই জায়গাটার ঠিকানা দিয়েছে সেখানে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ে কি না।

এর মাঝে ঐ জায়গাটায় নিলয় সব সিকিউরিটি তৈরি করে রাখলো। এদের মাঝে কেও সেখানে পা রাখলেই যেন বুঝতে পারে।

এদিকে নিজের মাঝে নিজে একটা রহস্যজনক হাসি দিলো রাজ। নিলয় যে বেশি চালাক সাজতে গিয়ে নিজেকেই কারো সন্দেহে ফেলে দিয়েছে তা কি সে জানে?
রাজ এতোটাও বোকা নয় যে কারো শুনা কথায় লাফাতে যাবে। সে নিজে পরিপূর্ণ শিউর হওয়া ছারা কোনো দিকে পা বাড়ায় না। টুকে টুকে খাওয়া মাছকে কি এতো সহজেই টোক দিয়ে বঁড়শিতে তোলা সম্ভব?
রাজের সাথে নিলয়ের এমন কাজ যে নিলয়কেই বিপদের দিকে ঠেলে দিবে তা হয়তো ধারণাতেই নেই নিলয়ের।

মানুষ সত্য বলার সময় তার হাত গুলো নারাচারা করে আর মুখেও একটা উজ্জলতা মিশে থাকে।
আর মিথ্যা বলার সময় হাত গুলো লক্ষনিয় ভাবে স্থির থাকে সাথে চোখে মুখে থাকে একটা অস্থিরতার ছাপ।
যেটা নিলয়ের কথা বলার সময় ভালোই লক্ষ রেখেছিলো রাজ। যা বুঝলো নিলয় এতোক্ষন যা বলেছে, কোনোটাতেই পরিপূর্ণ সত্যতা নেই।
রাজ এবার ঠোঁটের কোনো একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিলয়ের একটা ছবি সেন্ড করে দিয়ে কয়েকজন গার্ডকে বলে দিলো অল টাইম নিলয়ের উপর নজর রাখতে। তবে খুব সাবধানতার সাথে।
নিলয় কি করে, সে কি চায়, সে আসলে কে? অল আফডেট তার চাই।

To be continue…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here