ছদ্মবেশ,পর্ব ৬৯,৭০

0
1167

#ছদ্মবেশ,পর্ব ৬৯,৭০
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
৬৯

ফ্রেশ হয়ে রুমে আসলো রাজ। ফরিদা আন্টি আর তুষার ছারা বাসায় কেউ নেই। মাঝে মাঝে বাসাটাকে খুবই শুন্য মনে হয়, আবার হটাৎ করেই পূর্ণ হয়ে উঠে।
জীবনের অনেক সময়ই বন্ধু বান্ধব ছারা একা কাটিয়েছে রাজ। এখন একটা বন্ধু মহলে যেন একেবারেই মিশে গেলো সে। মনে হয় পরিবারের বাইরে ও এটা তার অন্য একটা পরিবার।

রাজের মাথায় একটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা সমাধানে লেপটপ হাতে বসে খুব মনোযোগ সহকারে।
অনেকদিন আগে ইকবাল সানির পাঠানো সেই ছবিটা বের করে সে। যেদিন নিলয় রাজের সাথে দেখা করার জন্য ইকবাল সানির কাছে গিয়েছিলো।

তখন বিষয়টা তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি রাজ। বড় দাড়ি-মোচ লাগানো একটা লোককে ফুটেজে ও ছবিতে দেখে তখন বিষয়টা নিয়ে এতো ঘাটাঘাটি করেনি সে।
এমন অনেক ছোটখাটো বিষয়ের সাথে সেটাও চুপচাপ এড়িয়ে গেলো সে।

ছবিটা স্কিনে এনে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো রাজ। কিছুটা জুম করে কিছুক্ষন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো লোকটাকে।

কিছুক্ষণ ওভাবে কাটিয়ে লোকটার দাড়ি গুলো রিমুভ করে একটা সাধারণ চেহারা আনার চেষ্টা করতে লাগলো। কিছুক্ষনের মাঝে পুরো কাজ শেষ হওয়ার পর এবার কিছুটা গাঁ ছেড়ে হেলান দিয়ে বসে স্কিনের দিকে তাকিয়ে রইলো।

নিলয়কে প্রথম প্রথম স্বাভাবিক মনে হলেও মাঝখানের কিছু সময় থেকে অস্বাভাবিক মনে হতো তার। চেহারায় কেমন একটা লুকোচুরি ভাব মিশে থাকতো। এতো তীক্ষ্ণ ভাবে যে হুটহাট নিজের মুড চেঞ্জ করে নিতে পারতো যে এই বাড়িতে ফরিদা আন্টি সহ বাকি চারজনও তাকে বুঝতে পারেনি।
এখন রাজ পুরোপুরি নিশ্চিত যে এই নিলয়ের মাঝে নিশ্চই কিছু একটা লুকিয়ে আছে। তবে কি সেটা, তা বের করার অপেক্ষায়।
ইকবাল সানিকেই বা সে কিভাবে চেনে? আর ছদ্মবেশে রাজের সাথে দেখা করার জন্যই বা কেন ইকবাল সানির কাছে গিয়েছিলো, বিষয়টা এবার মনে হয় একটু খুটিয়ে দেখা প্রয়োজন।

ওদিকে রুশান গেলো তার একটা ছোট অপারেশনে। নিশ্চই এখন তা নিয়ে প্ল্যানিং-এ আছে। ওসব ভাবতে ভাবতে রুমে তুষারও প্রবেশ করে। রাজের পাশে বসে লেপটপে তাকিয়ে কিছুটা অবাক হয়ে বলে,
– নিলয়ের ছবি এভাবে সামনে নিয়ে কি ভাবছো এতো?
রাজ আড় চোখে একবার তুষারের দিকে চেয়ে বলে,
– তুই শিউর যে এটা নিলয়?
তুষার একটু ভালো করে তাকিয়ে বলে,
– নিলয়ের মতোই তো লাগছে। কেন অন্য কেউ নাকি? আমি প্রথমে দেখে ভেবেছিলাম নিলয়ই।

রাজ এবার দাড়ি সহ ছবি ও দাড়ি রিমুভ করা ছবি দুটোই তুষারের দিকে দেখিয়ে বলে,
– এই বেশে আমাকে খুজতে আমার এসিস্ট্যান্ট পর্যন্ত পৌছে গেলো সে। বুঝতে পারছিস কিছু?
তুষার কিছুটা ভেবে দুই দিকে মাথা নাড়িয়ে বলে,
– তোর কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। নিলয় কেন এমন বেশে তোমার এসিস্ট্যান্ট পর্যন্ত গেলো এটাও বুঝতে পারছি না। এসবে ওর কাজ কি?
রাজ ঠোঁটের কোনে একটু হাসি ফুটিয়ে বলে,
– তোর মাথায় এতো কিছু ঢুকবে কি করে? সাধারণ আমার সাথে কথা বলার সময়ই ‘তুই’ আর ‘তুমি’ এই দুইটা শব্দ নিয়ে নিজের মাঝে কম্পিটিশন লাগিয়ে দিলি।

বলেই লেপটপ অফ করে উঠে রুমের বাইরে চলে গেলো রাজ। তুষার এবারও কিছু বুঝতে পারেনি। তুই, তুমি, কম্পিটিশন এসব কি বলে গেলো রাজ?
,
,
বিকেলে নীলাকে নিয়ে বাইরে বের হলো নিবিড়। আজ কতদিন পর দুজন আবার সেই আগের মত একসাথে সময় কাটাতে পারছে।
একসাথে হাটা, রিক্সায় করে ঘুরা, একসাথে বসে কখনো আইসক্রিম, কখনো ফুচকা, ঝালমুড়ি, চটপটি আবার কখনো দুজন বাদামের ছোলা ছাড়াতে ছাড়াতে গল্প করা, মাঝখানের কিছু সময়ের জন্য যেন আর ভাবতেই পারেনি দুজন তেমন করে আবার মত আবার হাসিখুশি ভাবে চলতে পারবে।

কিছুটা হাটার পর দেখলো একটা ছেলে ও একটা মেয়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হচ্ছে।

মেয়েটাঃ- তোর সাথে সব শেষ করার পরও কেন এভাবে বাসার নিচে এসে দাড়িয়ে আছিস? দু’দিন পর আমার বিয়ে। আমার শশুর বাড়ির মানুষ তোর সাথে আমাকে এভাবে দেখলে কি ভাববে বলতো?
ছেলেটাঃ- তিন বছর আমার সাথে রিলেশন করে এখন আরোক জনকে বিয়ে করে নিবি। আর শেষ বললেই আমি সব শেষ মনে করে দুরে সরে যাবো?
মেয়েটা আবার রেগে গিয়ে বলে,
– তুই যা পারবি কর। খবরদার আর এভাবে বাসার সামনে এসে দাড়িয়ে থাকলে তোকে পু’লিশে দিবো আমি।
ছেলেটাও সোজাসুজি ভাবে বলে,
– তুমি কি চাও তোমার আমার মাঝে ঘটে যাওয়া সব নেট দুনিয়ায় ভাইরাল করে দিই?
এতোক্ষন রাগে গজগজ করা মেয়েটা মুহুর্তেই চুপশে গেলো।
কিছুটা কোমল গলায় বলে,
– দেখো তুমি বিষয়টা বুঝতে চাইছো না কেন? বাবা কখনোই তোমার মত ছেলেকে তার মেয়ের বর হিসেবে মেনে নিতো না। তারচেয়ে ভালো তুমি তোমার নিজের লেভেলের একটা মেয়ে খুজে বিয়ে করে নিও। দুজনের দিকেই একবার চেয়ে দেখো, কোথায় আমি আর কোথায় তুমি।
ছেলেটা একটু তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
– তাহলে প্রম করার আগে কি এসব মাথায় ছিলো না?
মেয়েটা আবার বলে,
– তখন হুটহাট কি থেকে কি হয়ে গেছে বুঝতে পারিনি। তাই তো এখন পস্তাতে হচ্ছে। তুমি প্লিজ আমার পিছু ছেড়ে দাও। যেটা সম্ভব না সেটা নিয়ে অজথা সময় কাটিয়ে লাভ কি বলো?

নিবিড় আর নীলা এতোক্ষন তাদের মাঝে এমন ঝগড়া দেখে আবার সামনের দিকে পা বাড়াতে থাকলো। হুট করে দাড়িয়ে গেলো নীলা। নিবিড়ের চোখের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,
– আবার ছেরে চলে যাবেনা তো কখনো?
নিবিড় স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
– সব ঝামেলা শেষ হওয়ার পরও এই প্রশ্নটা কম করে হলেও পঞ্চাশ বারের উপরে জিজ্ঞেস করেছো। সব সময় কি উত্তর পেয়েছো বলোতো।
নীলা একটু মুচকি হেসে বলে,
– কিছু প্রশ্ন বারংবার করতে ভালো লাগে। কারণ উত্তরটা যে আমার ভিষণ প্রিয়।
,
,
রাতের বেলায় পাঁচটা ট্রাক আটক হয়েছে। পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে যাওয়া আসামিদের পেছনে ছুটেছে। কয়েকজনকে ধরে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এর মাঝে পুরোনো জামার সাথে মাথায় গামছা পেচানো এক ছেলে রুশানের করা গু’লিতে বাম হাতের বাহুতে আ’ঘাত পেয়ে ছিটকে পরেছে কিছুটা দুরে।
ডান হাত দিয়ে তা তা চেপে ধরে উঠে দাড়ানোর মুহূর্তেই সামনে রুশানের চেহারাটা ভেষে উঠলো। এক হাতে পি’স্তল নিয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে রুশান। চাইলে এখনই নিলয়কে গু’লির আঘাতে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে সে।

এদিকে নিজের মৃ’ত্যুকে এতো কাছ থেকে দেখে, নিজের কোমরের দুই পাশে দুইটা পি’স্তল থাকলেও নিশ্চুপ হয়ে আছে নিলয়। চাইলে এই মুহুর্তেই দুজন দুজনকে ঝাঁঝরা করে দিতে পারে। কিন্তু অজানা এক অনুভূতি দুজনকেই আটকে রেখেছে।
এতোটা দিন লুকো-চুরিতে দিন গেলেও আজ ঠিকই একে অপরের সামনা-সামনি এসে দাড়ালো।

ধীরে ধীরে পুরো হাত লাল হয়ে উঠছে নীলয়ের। অতিরিক্ত র’ক্ত ক্ষরণে কিছুক্ষন পর হয়তো এমনিতেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে সে।
উঠে দাড়ানোর জন্য রুশান এক হাত বাড়িয়ে দিলো। এই মুহুর্তে নিজেদের মাঝে যাই থাকুক, কাছের মানুষদের কষ্টও অনেকটা যন্ত্রণা দায়ক।

সকলের আড়ালে নিলয়কে নিয়ে কাছের একটা হসপিটালে রেখে আসে রুশান। একজন দায়িত্ববান অফিসার হয়েও এমন একটা কাজ করা কতোটা ঠিক হয়েছে সেটা এই মুহুর্তে মাথায় আসছে না তার। এ ছারা কি করবে সে? হাতে ধরে নিজের বন্ধুর জীবনটা কিভাবে নষ্ট করে দিবে? কেনোই বা নিলয় আজ এখানে? নিশ্চই কোনো কারণ ঠিকই আছে।
,
,
পরদিন সকাল হতেই গতকাল রাতের নিউজ ছড়িয়ে পরে খবর, পত্রিকা সব জায়গায়। ৭ জন আসামিকে পুলিশ গ্রে’ফতার করতে সক্ষম হয়েছে। সবার কোমড়ে দড়ি বেধে দাড় করিয়ে তোলা ছবি ছরিয়ে পরছে চার দিকে। পুলিশ সদস্য গুলো ক্যামেরার আড়ালেই রয়ে গেলো। এসব অনৈতিক কাজের শেষটা দেখা অব্দি রুশান সহ তার টিমের অন্যান্ন সদস্য রা এর আগে নিজেদের পরিচয় প্রকাশ করবে না। বলতে গেলে তাদের কাছে এটাও একটা শপথের মত। তারা নিজেদের জন্য না, দেশের জন্য কিছু করতে চায়।

এদিকে শেষ রাতে আবার হসপিটালে ফিরেছিলো রুশান। অনেক র’ক্ত ক্ষরণ হয়েছিলো নিলয়ের। ইমার্জেন্সি এক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়েছিলো তার। রাতের মাঝেই হসপিটালে ও-নেগেটিভ রক্ত না থাকায় ডাক্তাররা রুশানকে বললো কোথাও থেকে ম্যানেজ করতে।
এতো রাতে কোথা থেকে ম্যানেজ করবে সে? নিজের র’ক্তের গ্রুপও ও-নেগেটিভ হওয়ায় রুশানই র’ক্ত দিলো তাকে। দুজনের র’ক্তের গ্রুপ কাকতালীয় ভাবে এক থাকাটাও যেন নিলয়ের জন্য এটা ভাগ্যের ব্যাপার ছিলো। বন্ধুত্বের সম্পর্কটা অদ্ভুত একটা সম্পর্ক। প্রথম থেকেই তদের সম্পর্ক থাকেনা। মাঝামাঝি সময় পরিচয় হয় তাদের। এরপর সম্পর্কটা হয়ে যায় রক্তের সম্পর্কের মতোই গভির। হাজার ঝগড়া ঝামেলা তৈরি হলেও, শেষে অদ্ভুত এক মায়া মিশে থাকে।
,
,
একদিন নিলয়কে মোটামুটি সুস্থ হতে একদিন হসপিটালে থাকতে হয়েছিলো। পরদিন সন্ধার দিকে তাকে বাড়ি নিয়ে আসে রুশান।
সবাই নিলয়কে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে পরলেও রাজ শান্ত ভাবে বসে আছে রুশানের সাথে।

রুশান অপারেশনে যাওয়া। সেই সাথে নিলয়ও উধাও হয়ে যাওয়া। পরদিন আবার দুজন একই সাথে বাসায় ফিরে আসা। তার উপর নিলয়ের বাম হাত বেন্ডেজ করা। কি হয়েছে, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে রাজ।

সেই রাতটা কোনো ভাবে কেটে গেলো। সন্ধার পর থেকে বন্ধুদের মাঝে এসব নিয়ে আলোচনা হলে, ঘটনাটা বন্ধু মহলের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাকলো। নিবিড় হা করে চেয়ে আছে। নিলয়ের এমন কিছু কখনো শুনবে, তা হয়তো ভাবনাতেই ছিলো না তার। তুষারও কিছুটা অবাক হয় এতে। আচমকাই বলে উঠে,
– সেদিন তোর কথা মত আমিও এসবে জড়িয়ে গেলে আজ তোর জায়গায় আমিও থাকতাম। আল্লাহ বাচাইছে আমাকে।

সকাল সকাল উঠে নিলয়ের জন্য গরম গরম হালিম তৈরি করে দিলো ফরিদা আন্টি। ভারি খাবার খেতে হয়তো প্রব্লেমও হতে পারে এই অবস্থায়। সকালে ফ্রেশ হয়ে সবাই একই রুমে এসে নিজেদের মাঝে কথা বলছে।

ফরিদা আন্টি হালিম দিয়ে গেলো এর মাঝে। একটা টোল টেনে নিলয়ের সামনে এসে বসে রুশান। হাতের বাহুতে গু’লি লেগে সামনে শুয়ে আছে আছে নিলয়। রুশান তাকে আধ শোয়া করে বসিয়ে বাটি হাতে চামচ দিয়ে তাকে খাইয়ে দিতে দিতে বললো,
– নিজের আসল রুপ টা যতই লুকিয়ে রেখেছিলি, বাট আমার চোখ ফাকি দিয়ে বেশি দিন থাকতে পারিস নি। এই প্রথম কোনো অপরাধির দিকে গু’লি চালানোর সময় আমার টার্গেট মিস হয়েছে। তাও সেটা তুই ছিলি বলে। কিন্তু নেক্সট টাইম মিস হবে না। সময় থাকতে এই অন্ধকার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আয় দোস্ত। কারণ অপরাধিদের বুকে গু’লি চালাতে আমি দ্বিতীয় বার ভাবি না। কিন্তু নিজের কাছের বন্ধুর বুকে গু’লি চালাতে আমার একটু হলেও কষ্ট হবে রে।

বলতে বলতে নিলয়ের মুখে চামচ তুলে দিচ্ছে রুশান। গতকাল রাতে নিলয়ের সম্পর্কে সবটা জানায় পাশ থেকে নিবিড়ও বলে,
– এসব করে কি লাভ বল? আমরা কি সাধারণ জীবন নিয়ে ভালো নেই, বল? আমাদের মানব জীবনটা খুবই সীমিত। জীবনের থেকে একটা দিন চলে যাচ্ছে মানে আমরা হাজার বার চাইলেও সেই দিনটা আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না। তাই সব সময় চেষ্টা করবি সেই হারিয়ে যাওয়া প্রতিটা দিনে যেন তোর কারণে অন্য কেও কষ্ট না পায়। কাউকে কষ্ট দেওয়ার আগে একটু ভেবে দেখ তোরটা যেমন জীবন, অন্যেরটাও তেমন জীবন। জীবন নিয়ে তোর যেমন স্বপ্ন আছে তেমন অন্যদেরও আছে। কেন অন্যকে কষ্ট দিয়ে আমরা সুখি হবো? জীবন থেকে যেই দিনটা চলে যাচ্ছে, সেই দিনটা অন্যের ক্ষতি না করে আমরা কি পারিনা সুন্দর ভাবে উপভোগ করতে? আমরা কেন অন্যের জন্য আতঙ্ক মনে হবো? তাদের কাছে কি আমরা ভালোবাসা হতে পারিনা?

To be continue……………

#ছদ্মবেশ (পর্ব ৭০)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

রুশান, নিবিড় সবার কথায় নিশ্চুপ হয়ে আছে নিলয়। সত্যিই তো, এতো মানুষের ক্ষতি করে সে কি পেলো জীবনে? পাঁচ বছর আগে তার বাবা নিজেও তো ওসব মানুষদের সাথে লড়তে গিয়ে শহিদ হয়েছিলো।

ছোট বেলা থেকেই বাবার নানান কথা সহ্য করে বড় হয়েছিলো নিলয়। মা সেই ছোট বেলায়ই মা’রা গেছে। বাবা আর ছেলে মিলেই তাদের পরিবার ছিলো।
নিলয়ের বাবার ইচ্ছে ছিলো, ছেলেকে বড় কিছু একটা বানাবে। যেন সবার সামনে মাথা উচু করে বলতে পারে এটা আমার ছেলে।
আর অন্য দিকে পড়াশোনায় একদমই মনোযোগী ছিলোনা নিলয়। প্রতি ক্লাসে মার্কস হিসেবে তার রোল থাকতো অনেক পেছনে।
যার কারণে তার বাবা অনেকদিন মে’রেছিলোও তাকে। সব সময় বকা-বকির উপর রাখতো। পড়াশোনা না করা, এলাকায় বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দেওয়া সব মিলিয়ে জে’এস’সি ২ বার ও এস’এস’সি ২ বার পরিক্ষা দিয়ে পাশ করতে হয়েছিলো তাকে। তার বাবা তাকে নিয়ে হতাশা ছারা কিছুই পায়নি।
এস’এস’সি থেকেই তার শুরু হয় রাজনৈতিক দলের লোকদের সাথে দৌড়া-দৌড়ি করা। এলাকা ভিত্তিক, উপজেলা ভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠনে নিজের জায়গা শক্ত করে নিয়েছিলো খুব কম বয়সেই।

নিলয়ের বাবা যখন বুঝতে পারলো ছেলে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তখন রাগে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলো ছেলেকে। সাথে নানান কথা তো আছেই। জীবনটা অল্প বয়সেই শেষ করেছে সে। এখন এসবের পেছনে ছুটে বড় হলে অন্যের কাছে হাত পাতা ছারা কিছুই কপালে নেই তার।
নিলয়ের জেদি মন সেদিন বাবার থেকে অনেক দুরে নিয়ে গিয়েছিলো তাকে। বাবার কথাটাই চেলেন্জ হিসেবে নিয়েছিলো যে, সে নিজে কারো কাছে হাত পাতবে না। অন্যেরা তার কাছে হাত পাতবে। মাথায় ঢুকে যায় শুধু ক্ষমতার খোজার নেশা।

তার বাবা ভেবেছিলো এই এক ধাক্কায় নিলয়কে অনেকটা বদলে দিবে। তার মা ম’রার পর থেকেই বিগড়ে গিয়েছে সে। সারা দিন ডিউটিতে থেকে ছেলের এতো বেশি কেয়ার করতে পারেনি সে।
এর কয়েক মাসের মাথায় একটা অপারেশনে মারা যায় তার বাবা। শেষ কথাটা আর বলা হলো না বাবার সাথে। শেষ দেখাটা দেখার জন্য সেদিন বাড়িতে ছুটে এসেছিলো। দেখেছিলো শুধু সন্ত্রাসীদের গু’লির আঘাতে বিধ্বস্ত সেই বাবার লা’শ।

মা-বাবা সবাইকে হারিয়ে অনেকটাই এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো সে। বাবার উপর জেদ করে পড়ালিখায় কিছুটা মনোযোগি হয়ে উঠলেও, বাবা মারা যাওয়ার পর ইন্টার থেকে শুরু হয় এসব চোরা কারবারের সাথে সংযোগ। ভার্সিটি লাইফে দ্বিতীয় ইয়ার শেষ করে পড়াশুনা থেকে সরে গিয়ে এসব কাজে জড়িয়ে গিয়েছিলো সে। কয়েক বছরের মাঝে নির্জনের নজরে এসে সব কিছুর কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠে। দলের লোক বাড়ানোর সবচেয়ে সহজ উপায়টা খুজতে আবার ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। স্টুডেন্ট হয়ে বিভিন্ন ভার্সিটির অনেক ছেলেকে এসবের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে সে। সাথে বুঝে গেলো নিজেকে আড়াল রাখতে কোনো না কোনো বেশ নিয়ে থাকতে হবে তাকে।

আজ এই পর্যায়ে এসে এসব কিছুকে নিজের একটা নেশা বানিয়ে ফেলেছিলো সে। নিজ হাতে কত মানুষের প্রা’ন নিয়েছিলো সে। কত মেয়ের জীবনে সে এক অন্ধকার অধ্যায় তার কোনো হিসেব নেই।
কখনো উপলব্ধি করেনি সেই মানুষ গুলোর অনুভূতি, কষ্ট, তাদের আত্মচিৎকার। কত মেয়ে তার পা জড়িয়ে কেঁদেছিলো। কখনো নিজের মাঝে একটু মায়া তৈরি হয়নি তার।

আজ জীবনের এমন এক পর্যায়ে এসে ওসব ভাবতেই কেমন যেন বুকটা কেঁপে উঠছে তার। নিজের মাঝে একটাই প্রশ্ন জেগে উঠছে বারংবার, সে কি কখনো ক্ষমার যোগ্য? তার জীবনে যেসব পাপ করেছে তা কখনোই ক্ষমার যোগ্য না। শত মানুষের জীবন, শত মেয়ে সতিত্ব নিজ হাতে নষ্ট করেছে সে। জীবন কি তাকে ক্ষমা করবে? নাকি রাস্তার কোনো কুকুরের মতো মৃ’ত্যু হবে বলে তার জীবনটা এখনো টিকে আছে?

তার চার পাশের মানুষ গুলো তো দিব্যি ভালো আছে। অল্পতেই অনেক সুখি তারা। অন্যের মনে কষ্ট দিয়ে তারা সুখি নয়, অন্যের সাথে মিশেই তারা সুখি।
,
,
পিন্টুর কাছে ইমার্জেন্সি খবর পেয়ে অসুস্থ অবস্থাতেই আবার নিড়জনের কাছে চলে গেলো নিলয়। ইদানিং ভালো খারাপ কিছুই নির্নয় করতে সক্ষম হচ্ছে না সে। মনে হচ্ছে এটা ভালো, ওটা ঠিক। আবার মনে হচ্ছে ওটা ভালো, এটা ঠিক। একটা অদ্ভুত ডিপ্রেশনের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে সে।

হাতের সামনে যা পাচ্ছে সবই আছড়ে ভে’ঙে ফেলছে নির্জন। পাশে চুপচাপ দাড়িয়ে আছে নিলয়। কাজের প্রতি নিলয়ের অবহেলা এর আগেও বেশ কয়েকবার কিছু না বলে সহ্য করেছে নিড়জন। কিন্তু নিলয়ের এই উদাসীনতা দিন দিন বেড়েই চলছে। কেমন এক অন্য মনষ্ক হয়ে সময় কাটাচ্ছে সে। এমন চলতে থাকলে ধরা পরতে আর খুব একটা বাকি নেই।

নির্জনের এমন অনেক কথা শুনেও চুপ করে রইলো নিলয়। অন্য মনষ্ক হয়ে হতাশা মিশ্রিত গলায় বলে,
– আমার কি হয়েছে তা আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা ভাই। যেদিকে তাকাই সেদিকেই যেন কেমন ঘোলা ঘোলা মনে হয় ইদানিং। নিজেই নিজের কাছে খুব অদ্ভুত মনে হয়। আমি একটু একান্ত সময় চাইছি। কয়েকদিন সব কিছু থেকে দুরে থেকে নিজেকে একটু ফ্রেশ করতে চাই আমি। আমি নিজেও বুঝতে পারছিনা আমার এমন কেন মনে হচ্ছে।

নির্জন কিছুক্ষন চুপ থেকে বলে,
– এটা অনেক আগে থেকেই লক্ষ করছি আমি। এতো আবেগ ইমোশন দিয়ে এই পথে চলা যায় না। তোমার জায়গায় এখন থেকে সামিরই সব সামলাবে। তার নেতৃত্বেই চলবে সব। নিজেকে আবার আগের মত স্ট্রং করতে পারলেই নিজের জায়গাটা চাইতে আসবে।

সেদিন এই বিষয়টা নিয়ে তেজ দেখালেও আজ কোনো উত্তেজনা কাজ করছেনা নিলয়ের মাঝে। এই পথটাই যেন ধীরে ধীরে তার কাছে তিক্ত মনে হতে শুরু করেছে। তাই কিছু না বলে চুপচাপ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায় নিলয়।
পেছন থেকে নির্জন ডেকে বলে,
– কোনো চালাকি করার চেষ্টা করলে পরিনাম কি হবে তা আশা করি তোমাকে নতুন করে বোঝাতে হবে না।

নিলয় কিছুক্ষন চেয়ে থেকে কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলো সেখান থেকে। পিন্টু তার পাশে হেটে হেটে বলতে লাগলো,
– ভাই এটা কি হলো? আপনি এখন থেকে ঐ ছেলেটার কথায় চলবেন? আর এটাও আমার দেখতে হবে?
নিলয় এখনো কিছু না বলে চুপচাপ রইলো। সব কিছুই এখন পানসে মনে হচ্ছে তার কাছে।
,
,
আরো কয়েকদিন কেটে গেলো। এদিকে আরোহির এসব অবস্থা দেখে সামির চাইছে বিয়ের কাজটা সেরে রাখতে আপাতত। আরোহিকে হাত ছারা করতে কিছুতেই চাইছেনা সে। নির্জনের সব কিছু, সব পাওয়ার নিজের করে নিতে হলেও আরোহিকে তার প্রয়োজন।
যে চিন্তাধারা নির্জনের ভাবনারও বাইরে।

এদিকে নিলয় এতোদিন অনেক ভেবে দেখলো, এসবে আর এগিয়ে যাওয়াটা পসিবল হচ্ছে না তার জন্য। জীবনে যেসব পাপ গুলো সে নিজ হাতে করেছে, সেগুলোরও ক্ষমা সে কখনো পাবে না। এবার এই অন্ধকার জগৎ থেকে বেড়িয়ে সবাইকে নিয়ে একটু শান্তিতে বাচতে চায় সে।

যদিও এটা কোনো সহজ কাজ নয়। এসব পথে কেও নিজের ইচ্ছায় ঢুকলেও নিজ ইচ্ছায় বের হতে পারে না। হয়তো লা’শ হয়ে বের হতে হয়, নয়তো সব সময় এসবের সাথেই থেকে যেতে হয়। তার জীবনের শেষে কি অপেক্ষা করছে তার জানা নেই।
যেই জীবনে এতো মানুষের জীবন নষ্ট করেছে সে, সেই জীবন তাদের জন্য বিসর্জন দিলেও এই পাপ মোচন হবে না।

পিন্টুকে ডেকে বাসায় আনলো নিলয়। রাজ দেখেও কিছু বললো না পিন্টুকে। নিশ্চই নিলয় কারণ ছারা আজ সরাসরি এই বাসায় নিয়ে আসেনি।
রুশানকেও শান্ত থাকতে বলে রাজ।

পিন্টুকে নিলয়ের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে বলে,
– শুধু আমি না, তুইও এসব রাস্তা থেকে সরে আসবি। অনেক তো হয়েছে, আর কত? আমরা কেন অন্যদের জীবন নিয়ে এমন খেলা করবো? তাদেরও তো জীবন নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে।

পিন্টু কিছু না বুঝলেও নিলয়ের কথায় পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বলে,
– পথ থেকে উঠে আজ এই জায়গায় দাড়ালাম। তাও শুধু সম্ভব হয়েছে আজ আপনার জন্য। সেই জায়গায় আপনার সিদ্ধান্তই আমার কাছে সবার উর্ধে। তবে এসব থেকে বেড়িয়ে কতোক্ষন বাচতে পারবো বলেন?

তাদের মাঝে কথাবার্তা শেষ হলে পিন্টুকে পাঠিয়ে দেয় নিলয়। রুমে চুপচাপ বসে আছে সে। রাজ, রুশান রুমে এসে বসলো তার সামনে। সাথে নিবিড়, তুষারও এসে বসে।
রুশান গম্ভির ভাবে জিজ্ঞেস করে,
– এসব কি হচ্ছে?
নিলয় শান্ত ভাবে বলে,
– ছোট্ট এই জীবনে অনেক মানুষেরই তো ক্ষতি করেছি। আর কত নিজেকে এমন পাপে জড়িয়ে রাখবো? আর পিন্টু আমার খুব কাছের একজন ছোট ভাই। বলতে গেলে নিজের ভাইয়ের মতোই। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম কিছু দিনের মাঝেই সব কিছু ছেরে চলে যাবো অনেক দুরে। তোদের সাথে হয়তো দেখা হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। সেটা ভাগ্যের উপর নির্ভর করবে। তবে ভালোবাসাটা থাকবে সব সময়। অনেক দিনই তো তোদের সাথে একই ছাদের নিচে কাটিয়েছি। জীবনের কিছু সম্পর্ক আসে অল্প দিনের জন্য। তবে সম্পর্ক গুলো আবার হারিয়ে যাওয়ার সময় মনে দাগ কেটে দিয়ে যায়।

সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। পাশ থেকে রাজ শান্ত গলায় বলে,
– যদি তোরা মন থেকেই এসব ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকিস, তাহলে কোথাও যাওয়ার প্রয়োজন নেই তোদের। দুজনই আমার হেফাজতে থাকবি। তোদের কাছ অব্দিও কেউ যেতে পারবে না ক্ষতি তো দুরের কথা।

রাজের কথায় একটা মৃদ হাসি দেয় নিলয়। তারপর স্বাভাবিক হয়ে বলে,
– এই নিলয় জীবনে তার বাবার কাছেও মাথা নত করেনি। ছোট বেলা থেকেই সব সময় মাথা উচু করেই বাচতে শিখেছে সে। প্রয়োজনে নিজেকে শেষ করে দিবো। তবুও অন্যের কাছে হাত পাতবোনা কখনো। আমার নিজের টা আমি নিজেই দেখে নিবো। চেঁটে দশ দিন বাচার চেয়ে খেটে এক দিন বাচাটাই উত্তম।

To be continue………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here