#তোমার_আমার_প্রণয়,part_1
#israt_jahan_arina
গ্রীষ্মের কাঠ ফাটা রোদ বরাবরই বিরক্তিকর।চারিদিকের এই ভ্যাপসা গরমে বাহিরে এক দন্ড দাঁড়িয়ে থাকা দায়। সবচাইতে বিরক্তিকর বিষয় হচ্ছে এই দমবন্ধ করা গরমে লোকাল বাসে দাঁড়িয়ে থাকা। দৃশ্যর এখন ঠিক তেমন বিরক্ত লাগছে। এটা আর নতুন নয়। প্রতিদিনই এভাবে বাসে ঝুলে ঝুলে যাতায়াত করে তার অভ্যাস হয়ে গেছে। দৃশ্য মাঝে মাঝে অবাক হয়। যে মেয়ে কিনা কোনদিন বাসে চরতেই পারতনা, সে আজ দিব্যি দৌড়ে বাসে উঠতেও জানে, ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকতে ও জানে।
লোকাল বাস কখনোই মেয়েদের জন্য নিরাপদ ছিল না। এই বাসে মেয়েরা নানাভাবে অপদস্থ হয়। অনেক পুরুষের লালসার শিকারও হয়। এমনটা যে দৃশ্য সাথে ঘটেনি তা নয়। প্রথম প্রথম দৃশ্য কিছু মানুষের বাজে স্পর্শের শিকার হয়েছে। তবে সময়ের সাথে প্রতিবাদ করা এবং মানিয়ে নেওয়া দুটোই শিখে গেছে।
দৃশ্য ভাবছে কাল তার বেতন পেলে বাসে করে আর আসবেনা। অন্তত কিছু দিন তো অবশ্যই না। তবে মাসের শেষের দিকে কিভাবে আসবে তা ঠিক জানে না। একমাস হলো সে চাকরিটা পেয়েছে। আর যাই হোক টিউশনি দিয়ে তার চলছিল না।
বাসায় পৌঁছে ডোর বেল বাজাতেই লতা আপু দরজা খুলে দিলো।লতা আপু তার রুমমেট।আরো একজন আছে,তার নাম জিনিয়া।লতা আপু মাস্টার্স এ পড়ছে।আর জিনিয়া তার সাথে পরে।দৃশ্য এবার অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ছে।জিনিয়া তার বেস্ট ফ্রেন্ড।ঢাকায় তারা দুই রুমের ছোট একটা বাসায় থাকে।অনেক চেষ্টা করেও হোস্টেলে সিট পায়নি তারা।তাই এক প্রকার বাদ্য হয় এই বাসায় থাকতে হচ্ছে।তবে এই বাসার ভাড়া খুব কম। হয়তো অনেক পুরনো বাসা বলেই।
দৃশ্যকে দেখে লতা মুচকি হেসে বললো
-“কিরে আজ এত তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলি?”
দৃশ্য ক্লান্ত কন্ঠে বললো
-“ওই মিস. লুবনা ডাইনি কোন পার্টিতে যাবে তাই অফিস থেকে বের হয়ে গেছে। আমার হাতের কাজ শেষ হয়ে গেছিলো, তাই চলে আসলাম।”
-“ওই লুবনা ডাইনিরে পাইলে আমি কষাইয়া থাপ্পড় মারতাম। একমাসেই তোর জীবন তেনা তেনা বানায় ফেলছে।”
-“কি করবো বলো? নেহাত চাকরিটা আমার দরকার, না হলে কবেই চলে আসতাম।”
-“বাদ দে! যা ফ্রেশ হয়ে আস।”
দৃশ্য আর কোন কথা না বলে রুমে চলে গেল। এখন একটা লম্বা সারওয়ার না নেওয়া পর্যন্ত শান্তি পাবে না। ফ্রেশ হয়ে দৃশ্য আর লতা একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে নিল। লতা আজ অফিস যায়নি কারণ তার ভার্সিটিতে এক্সাম ছিল। খেতে খেতেই দৃশ্য বললো
-“আপু তোমার টাকাটা আমি কাল দিয়ে দিব।কাল হয়তো বেতন পাবো।”
-“আরে সমস্যা নেই ধীরেসুস্থে দে।”
-“না আপু। গত মাসে আমার বাসা ভাড়ার টাকাটা তুমি দিয়ে দিলে। তাছাড়া তোমার নিজের পড়ার খরচ আছে। আবার বাড়িতেও টাকা পাঠাতে হয়। কাল আমি তোমাকে টাকাটা দিয়ে দিব।”
-“তোকে আর জিনিয়াকে আমি বোন মনে করি। বোনের বিপদে যদি পাশে না থাকতে পারলাম তাহলে কিসের বোন হলাম?”
-“তুমি সবসময়ই আমাদের জন্য অনেক করো আপু।”
-“বাদ দে।এখন খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমা, দুপুরে তো রেস্ট নিতে পারিস না।”
-“হমম।”
দৃশ্য রুমে যেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। এই রুমটাতে জিনিয়া আর সে থাকে। রুমে একটা সেমি ডাবল খাট বিছানো। বাঁ পাশের একটা এটাস্ট কেবিনেট, আর ডান পাশে পড়ার টেবিল। একটা ছোট টয়লেট আর বারান্দা ও রয়েছে এ রুমটাতে।বারান্দাটা দৃশ্যর অনেক পছন্দ।দক্ষিণে বারান্দা থাকাটা সৌভাগ্যের বিষয়।বারান্দা দিয়ে শীতল হাওয়া রুমটাকে অনেকটাই ঠান্ডা করে রাখে। জন্মলগ্ন থেকে এসি রুমে থাকা মেয়েটা আজ দখিনা হাওয়ায় নিজেকে বেশ মানিয়ে নিয়েছে।মাথার উপরের ফ্যানটা খট খট শব্দ করে যাচ্ছে।কিছুক্ষণ সেই দিকে তাকিয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে নিলো।চোখ জোড়া বন্ধ করতেই মায়ের মুখটা ভেসে উঠলো।আজ কতদিন হলো মাকে দেখেনা।পরক্ষণেই বাবা আর ভাইয়ের কথা মনে পড়লো।মনের অজান্তেই চোখের কোন ঘেঁষে দু ফোঁটা অশ্রুধারা গড়িয়ে পড়লো।
সন্ধায় জিনিয়ার ডাকে তার ঘুম ভাঙলো।জিনিয়া বললো
-“এই ওঠ,আর কত ঘুমাবি?”
দৃশ্য চোখ কচলে উঠে বসলো। আর বললো
-“তুই কখন এসেছিস বাসায়?”
-“মাত্রই আসলাম। আজ এত জলদি বাসায়?তোর মিস.লুবনা কেমনে ছাড়লো তোরে?”
-“আরে ওনার একটা পার্টির দাওয়াত আছে তাই চলে গেছে।আমার কাজও শেষ হয়ে গেছিল তাই চলে এসেছি বাসায়।”
-“ভালো করেছিস। আমার জন্য এক কাপ রঙ চা করে দিবি ভীষণ মাথা ধরে আছে।”
-“তুই গোসল করে আস, আমি করে দিচ্ছি।”
জিনিয়া সোজা ওয়াশ রুমে চলে গেল। দৃশ্য গেলো রান্নাঘরে রং চা করতে। তিনজন একসাথে বিকেলে চা নাস্তা করছে।জিনিয়া বলে উঠল
-“আমাদের অফিসের পাশে স্টেডিয়ামে কনসার্ট হবে। চলোনা লতা আপু আমরাও যাই। অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়না।”
লতা অনেকটা এক্সাইটেড হয়ে বলল,
-“হ্যাঁ যাও যেতেই পারে। আমি অনেকদিন ধরে অফিস আর কলেজ করতে করতে বিরক্ত হয়ে গেছি। কবে কনসার্ট?”
জিনিয়া জবাব দিল
-“পরশু শুক্রবার। আমাদের সবার অফিস বন্ধ থাকবে সেদিন।”
দৃশ্য কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো
-“সপ্তাহে একটা দিনই তো বন্ধ পাই, ওই দিনও কোথাও যেতে আমার ভালো লাগেনা।”
জিনিয়া বললো
-“এই নিরামিষ মহিলা,তোর জীবনে এখন একটু আমিষের দরকার। ওই মিস লুবনা বোম্বাই মরিচের অত্যাচার সহ্য করার জন্য মাইন্ড টাকে একটু রিফ্রেশ করতে হবে তোর। এই কোন কথা না বলে চুপচাপ যাবি।”
-“আমাকে কোন দিক দিয়ে মহিলা মনে হয়? আর এতো সাউন্ড আর মানুষের ভিড় আমার পছন্দ না।”
এবার লতা বলে উঠলো
-“দৃশ্য আর কিছু বলিস না তো। সবাই মিলে একটু ঘুরে আসলে ভালো লাগবে।”
-“ঠিক আছে আপু, কিন্তু আমি বেশি সময় সেখানে থাকবো না।”
-“আচ্ছা দেখা যাবে।”
পরদিন সকালে দৃশ্য অফিসে চলে আসলো। তার অফিসটা মূলত একটা ফ্যাশন হাউজ। বেশকিছু নামিদামি ফ্যাশন ডিজাইনার এই ফ্যাশন হাউসে রয়েছে।তার মধ্যে মিস লুবনা আফরোজ অন্যতম। তার আন্ডারে রয়েছে দশজন এমপ্লয়ি। তার মধ্যে একজন দৃশ্য। বড় বড় সেলিব্রেটিদের ড্রেস এখানেই ডিজাইন করা হয়। দৃশ্যর মূল কাজ হলো, মিস লুবনার সাথে সাথে থাকা তার সকল অর্ডার ফলো করা, ক্লায়েন্টের ড্রেস ট্রায়েল করানো ইত্যাদি। মিস লুবনা আফরোজ ভীষণ স্ট্রিক। দৃশ্য জায়গায় আগে অন্য একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু সে মিস লুবনার ডিজাইন গুলো চুরি করে অন্য একটি কোম্পানিতে সাপ্লাই করছিল। যখন তিনি এটা টের পেয়েছেন সাথে সাথেই মেয়েটিকে বের করে দিয়েছেন। দৃশ্য মোটেও কাজে পারদর্শী নয়। কিন্তু তার সততার জন্যই মূলত নিস লুবনা তাকে কাজে রেখেছেন। সকলেই বলে মিস লুবনার কাছে গরু ঘাধা থাকলেও কাজে পারদর্শী হয়ে ওঠে। সেখানে দৃশ্য যথেষ্ট বুদ্ধি মতি।
অফিসে ঢুকে সে মিস.লুবনার আজকের সিডিউল সিট তৈরি করল। সবার আগে মিস লুবনা এটাই চাইবেন। কিছুক্ষণ পর মিস লুবনা অফিসে আসলেন। আধুনিকতার ছোঁয়া যেনো তার মাঝে মিশে আছে। ওয়েস্টার্ন ড্রেস এর সাথে হাই হিল সুজ। ভীষণ স্মার্ট তিনি। তার কথা বলা থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা কদম আধুনিকতায় ভরপুর। দৃশ্য মিস লুবনার কাছে এসেই আগে সালাম দিলো। এই জিনিসটা মিস লুবনার ভীষণ পছন্দ। মূলত অফিসের সবাই তাকে দেখে হ্যালো হাই বলে সম্মোধন করলেও দৃশ্য সবসময়ই সালাম দেয়। তবে মিস লুবনা তার এই ভাল লাগাটা দৃশ্যকে বুঝতে দেয় না। তিনি ভীষণ প্রফেশনাল একজন মানুষ। সালামের উত্তর দিয়ে মিস লুবনা বললেন
-“আজকের সিডিউল সিট কোথায়?”
দৃশ্য দ্রুত কাগজটা উনার হাতে দিল। মিস লুবনা ‘ফলো মি’ বলে নিজের কেবিনে ঢুকে পড়লেন। দৃশ্য আর সময় ব্যয় না করে দ্রুত মিস লুবনাকে ফলো করলো।
কিছুক্ষণ কাজ করার পর মিস লুবনা আবার দৃশ্য কে রুমে ডাকলেন। দৃশ্য আসতেই তিনি বললেন
-“মিস নেন্সির ওয়েডিং ড্রেস টা কি রেডি হয়েছে?”
দৃশ্য কিছুটা কাচুমাচু হয়ে বলল
-“ম্যাম সেটা তো কালকে রেডি হবে। ফিনিশিং ওয়ার্ক এখনো বাকি আছে।”
মিস লুবনা ভীষণ রেগে বলল
-“মানে কি এসবের? আমি কাল তাদের সাথে লাঞ্চ আওয়ার এরপর মিটিং ফিক্সেড করেছি। আর তুমি বলছো এখনো ড্রেস রেডি হয়নি।”
দৃশ্য একটু ভয়ে ভয়ে বললো
-“ম্যাম আপনি চিন্তা করবেন না। আমি এক্ষুনি তাদের সাথে কথা বলে কালকে সকালের মধ্যে রেডি করার ব্যবস্থা করছি।”
-“দ্রুত যাও এখনই কথা বলো।আমি আমার কাজে কোন বাধা চাইনা।”
-“জি ম্যাম।”
দৃশ্য দ্রুত বেরিয়ে আসলো রুম থেকে। মনে হচ্ছে এখনই তার প্রাণটা বেরিয়ে যাবে। এই মহিলা কি একটু ভালো করে কথা বলতে পারেনা।সারাক্ষণ ধমকের উপরে রাখে।
সারাদিন কাজ শেষে বিকেলে বাসায় ফিরলো দৃশ্য। এই মুহুর্তেই বাসায় কেউ নেই। লতা আপু আর জিনিয়া দুজনেই তাদের অফিসে। চাবি দিয়ে লক খুলে সে বাসায় প্রবেশ করো। আগে ফ্রেশ হয়ে এক কাপ চা খেয়ে নিল। একটু পর রান্না বসাবে। রান্নার কাজটা মূলত লতা আপু বেশি করে। তিনি ভীষণ ভাল রান্না করেন। লতা আপুর বাবা বেঁচে নেই। পুরো পরিবারের দায়িত্ব তার হাতে।লতা আপুর ছোট বোন আছে সেও লেখাপড়া করছে।জিনিয়া মধ্যোবিত্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবার ওপর যাতে প্রেসার না পড়ে তাই সে লেখাপড়ার পাশাপাশি চাকরি ও করছে। নিজের লেখাপড়ার খরচ চালানোর জন্য। তবে এই মানুষ দুটো তার জীবনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবনের সবচেয়ে খারাপ সময়টাতে এ দুজন মানুষকে সে খুব কাছে পেয়েছে।
রান্না খুব একটা ভালো জানে না সে। তাও মোটামুটি শিখেছে এখন। হাতে তুলে একগ্লাস পানি না খাওয়া মেয়েটাও আজ সব দায়িত্ব একাই নিতে পারে। আসলে সময় মানুষকে অনেক পরিবর্তন হতে শেখায়।