তোমার_আমার_প্রণয়,34,35

0
1180

#তোমার_আমার_প্রণয়,34,35
#israt_jahan_arina
#part_34

বর্তমান:
আখি রহমান ফজরের নামাজ শেষ করে গেলেন শাশুড়ির রুমে। শামসুন্নাহার বেগমের আজ কাল কোমরের ব্যাথা বেড়েছে।সকালের দিকে ব্যথা বেড়ে যায়।তাই আখি রহমার তেল গরম করে নিয়ে এসেছেন।শাশুড়ির পাশে বসে বললেন

-“আম্মা একটু কাত হয়ে শুয়ে পড়ুন।আমি তেল মালিশ করে দিচ্ছি।”

-“আর তেল দিয়ে কি হইবো। যাওনের সময় হয়ে গেছে।অহন কতো কি যে হইবো।”

-“আম্মা এমন কথা কেনো বলেন?যাওয়ার সময় আল্লাহ নির্ধারণ করে,বয়স না।আপনি যথেষ্ট স্ট্রং আছেন।”

শামসুন্নাহার বেগম আফসোসের সুরে বললেন
-“বয়স তো কম হইলো না। কতো সখ আছিলো নাতির ঘরে পতি দেইখা মরমু।হেইডা আর হইলো কই? ঘাড় তের পোলা তোর।তার চাইতে বেশি ঘাড় তেরা তুই।আজ এতো বছর ধইরা আমার নাতি তোর লগে কথা কইতে চায়।আর তুই পাষাণের লাহান পাথর হইয়া রইছস।”

-“আম্মা আবার এইসব শুরু করলেন?”

-“তো কি করুম?তোরা কেউ আমার কোনো কথার মূল্য দেস?আইজ কাইল ওই মাইয়াও আবার আমার নাতির পিছে পড়ছে। কাল রাইতে আমরিন হেরে মাহাদের অফিসে দেখছে।”

শাশুড়ির কথা শুনে আখি রহমান কিছুটা চমকে গেলেন।শামসুন্নাহার বেগম আবার বললেন

-“আমি তোরে আগেই কইয়া দিলাম ওই মাইয়া আমি ঘরে তুলমু না।ওই বংশের ছায়াও যেনো আমার বাড়িত না পড়ে।আমার সংসারের সুখ নষ্ট কইরা গেছে। আবার কি করতে আইছে ওই মাইয়া?ওই মাইয়া এই বাড়িত আইলে ছুলের মুডি ধইরা বাইর করমু বইলা দিলাম।”

আখি রহমান কিছুই বললেন না।তবে তাকে দেখে চিন্তিত মনে হচ্ছে।তিনি শাশুড়ির রুম থেকে বের হতেই দেখতে পেলেন তার ছোটো ছেলে অনেকটা রেগে মাহাদের রুমের দিকে গেলো।তিনি ভীষণ অবাক হলেন।কারণ তার এই ছেলেটা সব পরিস্থিতে হাসি খুশি থাকে।পরিবারের কষ্টের মুহূর্তে এই ছেলেটাই সকলকে সামলেছে।তাহলে আজ এতো রাগের কারণ কি?

মাহাদ আড়মোড়া ভেঙে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।মাথা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। কাল ড্রিংক কি বেশি করে ফেললো?মাথার চুল খামচে উঠে বসতেই চমকে গেলো।মাহিম তার বরাবর কাউচে বসে আছে।এতো সকালে ছোট ভাইকে দেখে একটু অবাক হলো।মাহিম গম্ভীর স্বরে বললো

-“ঘুম ভালো হয়েছে তো ভাই?”

মাহাদ বললো
-“হুম হয়েছে।”

মাহিম এক গ্লাস লেবু পানি এগিয়ে দিয়ে বললো
-“মাথা ব্যাথা করছে নিশ্চয়ই।এইটা খাও কমে যাবে।”

মাহাদ এক দৃষ্টিতে মাহিম কে দেখে যাচ্ছে।আজ ছোট ভাইটার কথা গুলো কেমন শক্ত মনে হচ্ছে।সে ড্রিংক টা শেষ করে গ্লাসটা পাশের ছোট টেবিলে রাখলো।মাহিম
বললো

-“এবার নেশাটা কেটেছে তো?নাকি মাতলামি আরো বাকি আছে?”

-“এই ভাবে কথা বলছিস কেনো?”

-“তাহলে কি ভাবে কথা বলবো? উপস!! সরি।রকস্টার মাহাদের সাথে তো সামলে কথা বলতে হবে।তুমি তো আর আমার ভাই নাই।সেলিব্রিটি হয়ে গেছো।”

-“কি হয়েছে বলবি?”

মাহিম তাচ্ছিল্য হেসে বললো
-“সত্যি তোমার মনে নেই কি হয়েছে?তোমাকে আমার ভাই বলতেও লজ্জা লাগছে।”

একদিকে মাথা বেথা অন্য দিকে মাহিমের ব্যাবহার সব মিলিয়ে ভীষণ বিরক্ত হচ্ছে মাহাদ।সে বললো

-“আমার উপর এতো চটে আছিস কেনো?”

-“আমি চটে নেই ভাই। জাস্ট অবাক হচ্ছি।এতো দিন তুই মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতি।মাতাল হয়ে মিডিয়ার সাথে ঝামেলা করতি।আমি কখনো কিছুই বলিনি।কিন্তু কাল যা করেছিস সেটা আমি কিছুতেই মানতে পারবো না।”

মাহাদ এবার কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।সে কাল ঠিক কি করেছে সেটা মনে করতে পারছে না।লাস্ট শুধু এই টুকুই মনে আছে দৃশ্য আর মৃদুলকে এক সাথে দেখে তার ভীষণ রাগ হয়েছিলো।রাগ কমানোর জন্য কয়েক প্যাক গিলেছে।তার পর আর কিছুই মনে পড়ছে না। মাহাদ আতঙ্কিত হয়ে বলল

-“কি…. কি করেছি আমি?প্লিজ ভাই আমার বল?”

মাহিমের দুই চোখ ভিজে আসলো।দৃশ্যর সেই করুন অবস্থা চোখের সামনে ভেসে উঠলো।সে মাহাদের থেকে মুখ ঘুরিয়ে বেলকনিতে তাকালো।আর বললো

-“ভাবির গায়ে হাত কেনো তুললে?এটাই তোমার ভালোবাসা?হাত কাপলো না?ওই বাচ্চা মেয়েটার উপর তোমার কিসের এতো রাগ!সব কিছুতে ভাবির দোষ কোথায়?তুমি নিজেই তার হাত ছেড়ে দিয়েছিলে।তাহলে তাকে এই ভাবে আঘাত করার মানে কি?সবাই মিলে অন্যায় করছো ভাবির সাথে।”

মাহাদের বুকটা কেপে উঠলো।পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।সে সত্যি দৃশ্যকে আঘাত করেছে?
মাহিম আবার রেগে বললো

-“কাল মেয়েটার মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না।মাঝ রাস্তায় ভাবির গায়ে হাত তুলে পুরুষত্ব দেখাতে চেয়েছিলে? নাকি তোমার ক্ষমতা বুঝাতে চেয়েছিলে?”

মাহাদ কিছুই ভাবতে পারছে না। বুকের বা পাশে বক্ষস্থল ভীষণ ব্যথা হচ্ছে। দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনুতাপের অশ্রু।

বীভৎস একটা রাত কেটে গেল দৃশ্যর। রাতে ভীষণ জ্বর উঠেছিল।গা পুরে যাচ্ছিলো জ্বরের তাপে।মেয়েটা মার সহ্যই করতে পারে না।আজ অব্দি যত আর তার গায়ে হাত উঠেছে ঠিক ততবারই সে জ্বরে ভুগেছে।

লতা আর জিনিয়া মিলে সারা রাত জল পট্টি দিয়েছে।কখনো মাথায় পানি ঢেলেছে।মেয়েটা জ্বরের ঘোরে কত কিছু বির বির করছিলো।রাতেই দৃশ্যর গা মুছতে যেয়ে লতা আর জিনিয়া দেখতে পেলো দৃশ্যর গলায় অসংখ্য কামড়ের দাগ।আর পেটে খামছির দাগ। গালের আঙ্গুলের ছাপ তো আগেই দেখেছে।জিনিয়া ভীষণ ঘাবড়ে গিয়েছিলো।মাথায় অসংখ্য খারাপ ভাবনা আসছিল।দৃশ্যর সাথে কি হয়েছে সেটা না জানা অব্দি কিছুতেই শান্তি পাবেনা সে।

আখি রহমান নিজের রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে দূর আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু।ছেলের এই অবনতি তিনি মানতে পড়ছে না।মাহিমের আর মাহাদের সব কথাই তিনি শুনেছেন।তবে আজ ছেলেকে কিছু বলবেন বলে ভেবেছেন।ছেলেটা যে অমানুষের পরিণত হচ্ছে সেটা জানাতে হবে।

তিনি উপরে উঠে মাহাদের রুমে প্রবেশ করলেন।এই রুমে তিনি বেশি একটা আসেন না।সারা রুমে চোখ বুলিয়ে মাহাদকে পেলেন না।আর একটু সামনে আগাতেই কিছু শব্দ তার কানে ভেসে আসে।ওয়াশরুম থেকে সেই শব্দ আসছে।তিনি দরজার কাছে দাড়াতেই আঁতকে উঠলেন।কারণ ভেতর থেকে কান্নার শব্দ আসছে।চিৎকার করে কাদছে মাহাদ।তবে দরজা বন্ধ বলে বাহিরে তেমন একটা শব্দ আসছে না।

আখি রহমান দরজার সামনের বসে পড়লেন।কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে।কোনো মা কি তার সন্তানের এই করুন কান্না সহ্য করতে পারে?আজ তার কয়েক বছর আগের কথা মনে পড়ছে।ছেলেটা তখনও ঠিক এই ভাবে গভীর রাতে কাদতো।তার রুম থেকে গভীর রাতে ফুপানোর শব্দ আসতো।তার পর ধীরে ধীরে ছেলেটা বদলাতে থাকে।অনেক দিন ধরে আর ছেলের রুম থেকে এমন কান্নার শব্দ আসতো না।কিন্তু আজ!!!ছেলের মনের অবস্থা তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছেন।ছেলেটা ঠিক বাবার মতো হয়েছে।ইমোশনাল।
দৃশ্য চোখ খুলে তার মাথার কাছে লতা আর জিনিয়াকে দেখতে পেলো।তাদের চিন্তিত মুখ দেখে দৃশ্য মুচকি হাসলো।ফিসফিসিয়ে বললো

-“তোমরা এখানে কি করছো আপু? অফিসে যাওনি?”

লতা মলিন স্বরে বললো
-“ফাইজলামি কম কর। তোকে এ অবস্থায় রেখেই অফিসে যাব মাথা খারাপ? এখন কেমন লাগছে তোর?”

দৃশ্য নিচু সরে বললো
-“রাতভর তোমাদের সেবা নিয়ে খারাপ কি করে থাকি বলো? এই জিনিয়াটা এতো ছিঁচকাঁদুনে কেন? রাতভর দেখি চোখের জলে নাকের জলে এক করে ফেলেছে।”

জিনিয়া নাক টেনে বললো
-“তুই জানিস আমি কত ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম? কি হয়েছে সত্যি করে বল? তোর শরীরে এসব কিসের দাগ?”

দৃশ্য দুষ্টুমি করে বললো
-“ভালোবাসার দাগ। লাভ বাইট বুঝিস?”

লতা বিরক্ত হয়ে বললো
-“দৃশ্য এখন মোটেও মজা করার মুডে নেই। কি হয়েছে সত্যি করে বল। কেউ কি তোর সাথে কোন খারাপ কিছু করার চেষ্টা করেছে?”

এবার দৃশ্য কিছুটা সিরিয়াস হয়ে গেল।মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো

-“আমার জীবনে খারাপ হওয়ার আর কিছু নেই আপু। আপন মানুষ গুলোর দেওয়া কষ্ট আমার ভেতরটাকে শেষ করে দিয়েছে।এইযে শরীরের আঘাতগুলো দেখছো কিন্তু আমার ভেতরের আঘাত কাউকে দেখাতে পারছি না। রাতে শরীরের আঘাতে যেমন মলম লাগিয়ে দিয়েছিলে ভেতরে আঘাত গুলোকে কোন মলম দিয়ে সরাবো বলো তো?”

কথাটা বলতে বলতে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিলো।জিনিয়া এতো খনে ফুঁপাতে শুরু করেছে। লতা দৃশ্যর চোখের জল মুছে দিয়ে বললো

-“কষ্ট করে একটু উঠে বস নাস্তা করে নে তোর ঔষধ আছে।”

দৃশ্য মাথা নেড়ে হ্যা জানালো। লতা আপু জিনিয়ার দিকে চোখ গরম করে তাকিয়ে বলল
-“এই রুম থেকে বের হ।আমার রুমে বসে বসে যতো খুশি কাদ।যা বের হো।”

লতা দৃশ্যকে নিজ হাতে নাস্তা খাইয়ে দিলো।এই মেয়েটার মাঝে দৃশ্য মা মা ফিল পায়।লতা আপু না থাকলে সে হয়তো বিষাদে ছেয়ে যেতো।এই মানুষটাই তাকে সব কষ্ট চাপা দিয়ে সামনে আগাতে শিখিয়েছে।এই মানুষটা জোর না করলে হয়তো তার লেখাপড়াটা ও বন্ধ হয়ে যেতো।মন থেকে শ্রদ্ধাবোধ কাজ করে মানুষের জন্য।

লতা আর জিনিয়া মিলে দুপুরের রান্না করছে।জ্বরের কারণে দৃশ্য কিছুই খেতে পারছে না।তাই দৃশ্যর জন্য চিকেন সুপ করছে।যদি কিছু খাবার পেটে পড়ে।কাজের মাঝেই বাসার ডোর বেল বেজে উঠল। লতা জিনিয়া কে বলল দরজা খুলতে।জিনিয়া হাত ধুইয়ে দরজা খুলে দেখলো সামনের মানুষটি কে। কালো জ্যাকেট,কালো জিন্স পরা একজন লোক।যার মুখে কালো মাস্ক।মাথায় কালো ক্যাপ। আর চোখে কালো সানগ্লাস।লম্বা চওড়া মানুষটিকে দেখে জিনিয়ার কপাল কুঁচকে গেল।কালো রঙের প্যাকেট হওয়া মানুষটিকে চিনতে পারলো না।হাতের ফোলা পেশী দেখে জিনিয়া একটু চিন্তিত হলো।এই বিশাল দেহী লোকটা কোনো ডাকাত নয় তো?সে ভয়ে ভয়ে বললো

-“কে আপনি?কাকে চাই?”

সামনের মানুষটি মিষ্টি কন্ঠে বললো
-“দৃশ্য বাসায় আছে?”

এবার জিনিয়া একটু ঘাবড়ে গেলো।অচেনা একটা মানুষ হটাৎ দৃশ্যর খোঁজ কেনো করছে?দৃশ্যর কোনো ক্ষতি করতে চাইছে না তো?সে বললো

-“দৃশ্যকে কি দরকার আপনার?”

লোকটা আসে পাশে তাকিয়ে আবার বললো
-“ভেতরে এসে কথা বলি?”

জিনিয়া অবাক হলো।অচেনা একটা লোক বাসায় আসতে চাইছে।তার কি করা উচিৎ বুঝতে পড়ছে না।জিনিয়াকে অবাক করে দিয়ে লোকটা তাকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো।জিনিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এবার কিছুটা রেগে জিনিয়া বললো

-“আরে আশ্চর্য!আপনি ভেতরে কেনো চলে আসলেন?কে আপনি?”

জিনিয়ার কথায় লোকটা তার দিকে ফিরে মাথার ক্যাপ আর মুখের মাস্ক খুলে ফেললো।জিনিয়া যেনো বড়ো সরো শক খেলো।সে লোকটির দিকে হা করে তাকিয়ে রইল।সে কি সত্যি দেখছে?রকস্টার মাহাদ সত্যিই কি তার সামনে দাড়িয়ে আছে?এটা কি করে সম্ভব?সে নিজের হাতে জোরে চিমটি কাটলো।আর সাথে সাথে আহ্ করে উঠলো।তার মানে সব সত্যি।কিন্তু কেমনে কি? মাহাদ ব্রু কুচকে জিনিয়ার দিকে তাকালো।

লতা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে বলতে লাগলো
-“কে এসেছে জিনি…..!

আর বলতে পারলো না।সামনের মানুষটিকে দেখে অবাক হয়ে গেলো।রকস্টার মাহাদ তার সামনে দাড়িয়ে আছে।
মাহাদ তাদের অবস্থা বুঝতে পারলো।তাই লতাকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“দৃশ্য কোথায়?”

লতা কিছুটা চমকালো।সে দৃশ্য খোঁজ কেনো করছে?লতা খেয়াল করলো মাহাদের চোখ লাল হয়ে আছে।কিছু একটা ভেবে লতার চোখ বড় হয়ে গেলো।সে হাতে ইশারা করে দৃশ্যর রুম দেখিয়ে দিলো। মাহাদ থ্যাঙ্কস জানিয়ে সে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। জিনিয়া এখনো হা করে তাকিয়ে আছে।সে লতাকে বললো

-“এইটা কি হলো আপু।আমি স্বপ্ন দেখছি নাতো?”

-“না।”

-“আপু আমি যেইটা ভাবছি সেইটা কি সঠিক?”

-“কি ভাবছিস?”

-“দৃশ্যর মাহাদই কি এই রকস্টার মাহাদ?”

-“আমারও তাই মনে হচ্ছে।”

-“ওই বান্দরনী আমাদের আগে বললো না কেনো?”

লতা বিরক্ত হয়ে বললো
-“জানিনা।”

দৃশ্য খাটে হেলান দিয়ে ফোন চাপছিল।জ্বরের কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না।শুয়ে শুয়ে একদম বোর হয়ে গেছে।তাই ফোন বার বার স্ক্রল করছে।দরজা খোলার শব্দ পেয়ে সামনে তাকিয়ে থমকে গেলো।নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মাহাদ এখানে কি করে আসতে পারে?জ্বরের ঘোরে উল্টাপাল্টা দেখছে নাতো?গলা শুকিয়ে আসছে।কয়েক বার শুকনো ঢোক গিলতে লাগলো।কেমন তেতো সব।নিশ্চয়ই জ্বরের কারণে।

মাহাদ বিছানায় বসা দৃশ্যর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে দৃশ্যর।সে দৃশ্যর দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো।

মাহাদ কে কাছে আসতে দেখে দৃশ্য চট করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো।তার হাত পা কাপছে।ঠিক মত দাড়াতে পারছে না।কাপা কাপা গলায় বললো

-“আপনি এখানে? এখানে কেনো এসেছেন?”

মাহাদ সোজা দৃশ্যর সামনে দাড়ালো।দৃশ্যর গালে অনেক গুলি আঙ্গুলের ছাপ।পুরো গাল লাল হয়ে আছে।তারপর চোখ পড়লো দৃশ্য গলায়।অসংখ্য নীলচে কামড়ের দাগ।তার দু চোখ আবার ভিজে উঠল সামনের সব ঝাপসা লাগছে।
মাহাদের এমন তাকানো দেখে দৃশ্যর হুস হলো যে তার গায়ে ওড়না নেই।বিছানার পাশের থেকে ওড়নাটা নিয়ে দ্রুত গায়ে জড়িয়ে নিলো।

মাহাদ এগিয়ে এসে দৃশ্যর চিবুকে হাত রাখতেই বুঝতে পারলো দৃশ্যর গায়ে জ্বর।দৃশ্য অবাক হয়ে মাহাদ কে দেখছে।এই মুহূর্তে মাহাদ কে আগের মাহাদ বলে মনে হচ্ছে।
মাহাদ দৃশ্যর কপালে ঠোঁট জোড়া ছুয়ে দিলো।মুহূর্তেই দৃশ্য কেপে উঠলো।পুরো শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো।কয়েক সেকেন্ড পর ফিল করলো তার কপাল ভিজে উঠেছে। মাহাদ কি কদছে?কেনো?দৃশ্য মাহাদকে ছাড়াতে চাইলে মাহাদ তাকে জড়িয়ে ধরলো।দৃশ্যর পুরো শরীর কাপছে।পুরো শরীর অসাড় মনে হচ্ছে।সে মনে হয় আর দাড়িয়ে থাকতে পারবে না।হটাৎ তার কানে এলো মাহাদের কথা।

-“ভালোবাসি বউ।”

দৃশ্য চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো।এই লোকটা কি তাকে দুর্বল করতে চাইছে?

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_35

মায়ের চিৎকার শুনে সেদিন দৃশ্য ছুটে গেছিলো মায়ের রুমে।দরজার সামনে এসে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তার মা ফ্লোরে পড়ে কাতরাচ্ছে।চারপাশে রক্ত। কয়েকটা ভাঙ্গা কাচের টুকরো পড়ে আছে।মায়ের হাত পা কেটে রক্ত বের হচ্ছে।মায়ের কপাল আর নাক বেয়ে রক্ত ঝরছে।কিন্তু এই বীভৎস অবস্থার পর ও তার বাবা মাকে মেরেই চলছে।মুহূর্তেই দৃশ্যর পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে কেপে উঠলো।বাবার এই রূপ তার কাছে ভীষণ অপরিচিত।সে বরাবর দেখে এসেছে তার বাবা গম্ভীর,রাগী,স্বল্পভাষী মানুষ।কিন্তু বাবার এই নিকৃষ্ট রূপ সে কখনো দেখেনি।
দৃশ্য দৌড়ে মায়ের কাছে যেয়ে ঝাপটে ধরলো মাকে।দৃশ্যকে দেখে আশরাফ হুসাইন থামলেন।দৃশ্য মাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো

-“বাবা প্লিজ মাকে আর মেরো না।মা মরে যাবে।মাকে কেনো মারছো তুমি?এমন নিকৃষ্ট কাজ কেমন করে করতে পারো?”

আনিকা কবির ফ্লোরে পড়ে কাতরাচ্ছেন।দৃশ্যর বাবার প্রতি ভীষণ রাগ হচ্ছে।একজন মানুষ অন্য মানুষকে এই ভাবে মারতে পারে?
দৃশ্যকে দেখে আশরাফ হুসেনের রাগ যেনো তর তর করে বেড়ে গেলো।তিনি হুংকার ছেড়ে বললেন

-“তুই হচ্ছিস নাটের গুরু।তোর জন্য! হে সব তোর জন্য হয়েছে।আজ তোর জন্য ওই আরিফ আমাকে অপমান করে গেলো।ভাইয়ের ক্ষমতার জোর দেখিয়ে গেলো।আর তোর মাও তাদের জন্য আমাকে অপমান করে?এতো বড়ো সাহস ওর?”

কথাটা বলে আনিকা কবির কে আবার মারতে গেলে দৃশ্য রেগে বললো

-“খবরদার বাবা মায়ের গায়ে আর একটা আঘাতও করবে না।এই সবে মায়ের কোনো দোষ নেই।ক্ষমতার জোর তো তুমিও দেখিয়েছো।তাদের অপমান করে বাড়ি থেকে বের করেছো।তোমাদের জন্য আমি ফুপিকে হারিয়েছি।”

আশরাফ হুসেনের দুচোখ দিয়ে যেনো রক্ত ঝরছে।যে পরিবারকে তিনি কন্ট্রোলে রেখেছেন।নিজের আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন সব যেনো বিফলে যাচ্ছে।তার স্ত্রী সন্তান যারা ভয়ে তার দিকে তাকাতে অব্দি পারতো না,তারা তার মুখে মুখে তর্ক করছে?তার সাথে গলা উচু করে কথা বলছে? এইসব তিনি কিছুতেই মানবেনা।এতদিনে দৃশ্যর প্রতি জমানো রাগটা যেনো উপচে পড়লো।

তিনি হাতের মোট কালো লাঠিটা দিয়ে দৃশ্যর পিঠে একটা আঘাত বসলো।মুহূর্তেই দৃশ্যর কাছে মনে হলো
তার পিঠে কেউ গরম কিছু ঢেলে দিয়েছে।জায়গাটা সাথে সাথে জ্বলে উঠলো।কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মস্তিষ্ক ব্যাথার তীব্রতার জানান দিচ্ছে।দৃশ্য ‘ ও মাগো ‘ বলে চিৎকার দিয়ে উঠলো।সেই ব্যাথা লাঘব করার আগেই তার পুরো শরীরে একের পর এক আঘাত পড়তে শুরু করলো।এই মুহূর্তে তার সামনের মানুষটিকে আজরাইল মনে হচ্ছে।যে তার জান কবজ করেই দম নিবে।মারের প্রকোপে তার দম বন্ধ হয়ে আসছে।তার পুরো শরীর জ্বলতে লাগলো।পুরো শরীর ব্যাথায় অসাড় হতে শুরু করলো।

আশরাফ হুসাইন প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে দৃশ্যকে মারতে লাগলো।আর চিৎকার করে বলতে লাগলো

-“নষ্টা মেয়ে কোথাকার।তোর মত নষ্টা মেয়ে আমার লাগবে না।ওই আমজাদের পোলার সাথে নষ্টামি করিস?আর তোর জন্য ওরা আমাকে কথা শুনায়?তোকে আজ শেষ করে ফেলবো।তোরে জিন্দা কবর দিবো তবুও ওই পোলার কাছে দিবো না।আমার মান সম্মান ধূলায় মিশিয়ে দিয়েছিস।তোর আর ওই পোলার রঙ্গ লীলা এখন পুরো এলাকা জেনে গেছে।আর যদি কোনোদিন ওই ছেলের সাথে তোরে দেখি তাইলে তোর মাকে আমি সোজা উপরে পাঠাবো।”

কথা গুলো বলছে আর দৃশ্যকে আঘাত করছে।দৃশ্যর আর্তনাদ তার কানে গেলো না।এক সময় দৃশ্য জ্ঞান হারালো। তার এই ছোট্ট শরীরটা এর চেয়ে বেশি মার সহ্য করতে পারছিল না। আনিকা কবির অনেক কষ্টে উঠে স্বামীর পায়ে ধরলেন আর কেঁদে কেঁদে বললেন

-“আল্লাহর দোহায় লাগে আমার মেয়েটাকে আর মাইরেন না।মেয়েটা আমার মরে যাবে।আমি ওকে বুঝাবো।আপনি আর মাইরেন না।”

আশরাফ হুসাইন ঘেমে অস্থির হয়ে গেছেন।হাতের লাঠিটা আছাড় মেরে ফেলে বললেন

-“তোর মেয়েকে বলে দিস ওই ছেলের কাছ থেকে দূরে থাকতে।আমি বেচে থাকতে ওই বাড়িতে ওরে দিমু না।আমার কথার অমান্য করলে তোদের মা মেয়েকে কবর দিব।”

কথাটা বলেই আশরাফ হোসাইন বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন। এই মুহূর্তে বাসায় তার অসহ্য লাগছে। বাহিরের হাওয়া খেলে মাথাটা হয়তো ঠান্ডা হবে।

আনিকা কবির অনেক কষ্টে সেছরে সেছরে দৃশ্যর কাছে গেলেন।পুরো শরীর তার ব্যাথায় টন টন করছে।হাতের গ্লাস ভেঙ্গে কাচ তার হাত ও পায়ে বিধে কেটে গেছে।ফ্লোর সেই রক্তে ভিজে উঠেছে।তিনি কাপা কাপা হাতে মেয়ের মাথাটা কোলে তুলে নিলেন।পরম আদরে মাথায় হাত বুলিয়ে অস্থির হয়ে ডাকতে লাগলেন দৃশ্যকে।

-“দৃশ্য!মা আমার।কথা বল মা।চোখ খোল মা।”

কথাটা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।তিনি দ্রুত হাত বাড়িয়ে ফোন হতে নিয়ে বড়ো জা কে কল করলেন।কয়েক মিনিট পর নিচতলা থেকে তার বড়ো জা আসমা আর নাবিলা দৌড়ে আসলো।মা মেয়ের এই অবস্থা দেখে নাবিলা অনেকটা চমকে গেলেও আসমা চমকালো না।যেনো আগেও এমন বহুবার দেখেছে সে।তবে দৃশ্যর অবস্থা দেখে তিনি একটু চমকালো।

নাবিলা দৃশ্যর পাশে বসে কাদতে লাগলো আর দৃশ্যের সারা গায়ে হাত বুলাতে লাগলো।ফর্সা শরীরটা কালো মোটা মোটা মারের দাগ পড়ে গেছে।এই কাজ কে করতে পারে সেটা বুঝতে তার সময় লাগলো না।তাদের দুইজন কে অনেক কষ্টে বিছানায় তুলে দৃশ্যর মুখে পানির ছিটা দিলো।প্রায় দেড় ঘণ্টা পর দৃশ্যর জ্ঞান ফিরলো। কিন্তু পুরো শরীরে শুরু হলো অসহ্য ব্যাথা।সেই ব্যাথায় দৃশ্য চিৎকার করে কাদতে শুরু করলো।দৃশ্যকে পেইন কিলার আর ঘুমের ঔষদ খাইয়ে দিলো আসমা।আনিকা কেও ড্রেসিং করে ঔষধ দিলো।
আনিকা বিছানায় পরে চোখের জল ফেলছে।আসমা তার জল মুছে বললো

-“ওই জানোয়ার টা এখনো মানুষ হইলো না।আমি ভাবছি বউ পিটানোর অভ্যাস তার। এখন দেখি মেয়ে পটানোরও অভ্যাস আছে?অমানুষ একটা। এমনে জুয়ান মাইয়ারে মারে?”

নাবিলা ভীষণ অবাক হলো মায়ের কথায়।তার মানে ছোট চাচা চাচীকে এর আগেও মারত?
আনিকা কবির ভাঙ্গা গলায় বললেন

-“আপা আমার মেয়েটা ঠিক আছে তো?”

-“তুই চিন্তা করিস না।দৃশ্য ঠিক আছে।ওকে ব্যাথার আর ঘুমের ঔষধ দিয়েছি। তবে শরীর গরম হচ্ছে।মনে হয় রাতে জ্বর হবে। তুই চিন্তা করিস না।আমি আছি।”

আনিকা কবির ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন।আর বললেন
-“আপা আমার মেয়েটাকে ও শেষ করে দিবে।বাপ হয়ে কেমন করে মেয়েটাকে এমন করে মারতে পারলো?এই মানুষটার মধ্যে কি কোনো মায়া দয়া নাই।জানো আপা আমার ভয় হয়।ও আমার মেয়েটাকে ও যদি কোনো জানোয়ারের হাতে তুলে দেয়।আমার বাচ্চা মেয়েটা একটুও কষ্ট সহ্য করতে পারবে না।ওর পরিণতি আবার দিশার মত না হয়?”

আসমার চোখে জল।সে জানে এই কষ্ট।নিজের মেয়েকে ধুকে ধুকে মরতে দেখছে।নার্গিস যে সংসার জীবনে অনেক কষ্টে আছে।টাকা দেখে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছে ওর বাবা চাচা।মেয়ের সুখ দেখেনি।আজকাল নাবিলার জন্য ভীষণ ভয় হয় তার।না জানি এই মেয়েটার কপালেও কোন কষ্ট লেখা আছে।এই বংশে কোনো মেয়েই সুখী হতে পারেনি।না পেরেছে দিশা।না নার্গিস।আর এখন দৃশ্য।

আসমা আর নাবিলা মিলে সারা রাত মা মেয়ের পাশে বসে রইলো।দৃশ্যর ভীষণ জ্বর উঠেছে।দুইবার মাথায় পানি ডেলেছে। আর পট্টি তো চলছেই।নাবিলা হটাৎ তার মাকে প্রশ্ন করলো

-“মা বাবাও কি তোমার গায়ে হাত তুলেছে?”

আসমা একটু চমকালো মেয়ের প্রশ্নে।কিন্তু কিছু না বলে দৃশ্যর মাথায় জল পট্টি দিতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।নাবিলার দু চোখ ভিজে উঠল। এ কোন পরিবারে জন্ম নিলো সে?
ফাহিম সেদিন বিকেলে বাসায় ছিলনা।তাই মা ও বোনের সেই আর্তনাদ তার চোখে পড়েনি।আর না দেখেছে বাবার নিকৃষ্ট রূপ।ফাহিম কয়েকদিন ধরেই ভীষণ বিষণ্ণ ছিলো।নিজের আদরের বোনের সাথে ঠিক মত কথাও বলেনা।আসলে দৃশ্যর প্রতি তার মনে রাগ জমা হয়েছে।দৃশ্য কেনো দুইদিনের সম্পর্কের জন্য ভাইয়ের এতদিনের ভালোবাসা ভুলে গেলো?তার মানা কেনো শুনছে না?

রিজভী বন্ধুর মনের অবস্থা বুঝে আজ বিকেলেই তাকে নিয়ে কয়েক দিনের জন্য বেরিয়েছে।বাসা থেকে দূরে থাকলে মন ভালো হবে ভেবে তাকে নিয়ে গেছে।

টানা তিন দিন দৃশ্য জ্বরে ভুগেছে। এর মধ্যে মাহাদ মৌ এর মাধ্যমে ফোন পাঠিয়েছে দৃশ্যর কাছে।দৃশ্য একবার ভেবেছে সে ফোনটা ফিরিয়ে দিবে। মাহাদের সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করে দিবে।তার জন্য মা আঘাত পাক সেটা চায়না।কোনো সন্তানই সেটা সহ্য করতে পারবে না।নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে।বাবা এই তিন দিনে একবারও তার খবর নেয়নি।তবে দৃশ্যর তাতে আফসোস নেই।তার বাবা ঠিক কেমন সেটা তার ভালো করেই জানা হয়েগেছে।তবে বাবার প্রতি ভয়টা আরো বেড়ে গেছে।

দৃশ্য নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়েছে। মাহাদ নামক মানুষটি তার ভাগ্যে নেই সেটা মেনে নিয়েছে।তবে মাহাদ এতো সহজে মানবে না।সে যদি হটাৎ করে মাহাদের সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় তবে মাহাদ সোজা তার বাসায় চলে আসবে।তাই দৃশ্য ধীরে ধীরে মাহাদের সাথে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।ঠিক মতো মাহাদের কল রিসিভ করতো না।তার পর যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।

সেই সময়টা দৃশ্যর ঠিক কেমন কেটেছে তা সেই জানে।প্রতিটা রাত যেনো বছরের মতো কেটেছে। মাহাদ যেনো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গেছে।এই মানুষটার শূন্যতা তাকে গভীর ভাবে পুড়িয়েছে।মায়ের কোলে শুয়ে অশ্রু বিসর্জন দিয়েছে অনেক বার। মাহাদের কল এবইড করা যেনো তার কাছে পরীক্ষার মতো ছিলো। যতবার ফোনের স্ক্রিনে হার্টবিট লেখাটা সে দেখেছে,ঠিক ততবার সে নিজের হার্টবিট মিস করেছে।

সেদিন যখন কলেজে যাওয়ার সময় গেটের পাশে মাহাদকে দেখেছিল,তখন মনে হয়েছে এতো দিনে সে নিজেকে যা শক্ত করেছে সেটা নিমিষেই ভেঙে গুড়িয়ে গেছে।মানুষটার মলিন মুখটা দেখে বুকে তীব্র ব্যাথা হয়েছে।দৃশ্যর মন চাইছিলো মাহাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে।ওই বুকে কয়েকটা চুমু খেতে।তাহলে হয়তো তার বুকের যন্ত্রণা টা কিছুটা কমবে।

কিন্তু মায়ের সেই দিনের চেহারাটা তার সামনে ভেসে উঠলো। মাহাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া মানে মাকে আবার সেই পরিস্থিতিতে ফেলা।যেটা সে কোনোদিন ও পারবে না।তাই নিজেকে পুনরায় শক্ত করে মাহাদকে এড়িয়ে গেছে।
সেদিন অনেক কষ্টে সে মাহাদ কে বলেছিল সম্পর্ক শেষ করতে।তার কাছ থেকে দূরে থাকতে।বাসায় এসে সেদিন দৃশ্য হাউ মাউ করে কেঁদেছে। মাহাদ যে তার প্রাণ।সেই প্রাণকে নিজের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে সে কি করে ভালো থাকবে?

এতো কিছুর পরও মাহাদ তার পিছু ছাড়ছে না।আর দৃশ্য নিজেই দুর্বল হয়ে পড়ছে।তাই কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিলো।মানুষটার মলিন মুখ দেখলে নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।এই মানুষটিকে কষ্ট দিতে তার বুকটা ফেটে যায়।
সে জানতো মাহাদ ওকে না পেলে নাবিলাকে খুঁজবে।তাই সে নাবিলাকে ও কলেজে যেতে দেয়নি। আর আজ যখন মাহাদের চোখে পানি দেখলো সে আর নিজেকে আটকাতে পারেনি।ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানুষটার বুকে।আহা!কি শান্তি এই বুকে।ভীষণ নিরাপদ এই বুকটা।এই বুকে থাকলে কেউকে তার চুলটাও বাঁকা করতে পারবে না সেটা দৃশ্যর জানা।

সব শুনে মাহাদ থমকে গেলো।মানুষ এতটা খারাপ হতে পারে?ওই লোকটা কি আসলেই মানুষ নাকি পশু।আর সে ভাবছিল দৃশ্যর বাবার কাছে আবার যাবে।দৃশ্যর বাবার হাত পা ধরে রাজি করবে।যে মানুষটার নিজের স্ত্রীর প্রতি কোনো সম্মান নেই,মেয়ের জন্য সামান্য তম মায়া নেই সে লোক মেয়ের সুখের কথা ভাববে সেটা আদো সম্ভব?যেখানে সে দুই পরিবারের সম্মতি আসায় বসে আছে।দৃশ্যর বাবা যে কোনোদিন মেয়েকে তার হাতে তুলে দিবেনা সেটা মাহাদের বুঝা হয়ে গেছে।ওই রকম একটা মানুষের জন্য সে নিজের ভালোবাসার মানুষের কাছথেকে মোটেই দূরে থাকবে না।
দৃশ্য তখনও মাহাদের বুকে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাদঁছে। মাহাদ দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।সে দৃশ্য কে বুক থেকে সরিয়ে তার চিবুকে হাত রেখে মুখটা উচু করে ধরলো।বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে দৃশ্যর অশ্রুধারা মুছে কপালে চুমু খেলো।তারপর বললো

-“বিয়ে করবে পিচ্ছি?”

দৃশ্য চমকে তাকালো মাহাদের দিকে। নাবিলাও চমকালো। মাহাদ মুচকি হেসে বললো

-“তোমাকে কিছু চিন্তা করতে হবে না।একবার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার বাবার সাধ্য হবে না আমার কাছ থেকে তোমাকে দূরে রাখতে।আর আন্টির গায়ে যদি উনি আর হাত তুলে তবে তার জেলে যাবার বেবস্থা আমি করবো।”

দৃশ্যর চোখ বেয়ে আবার অশ্রু ঝরলো।সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো

-“তোমার বাসার সবাই যদি..?”

-“আমার বাসায় আমি ম্যানেজ করে নিবো।তুমি বলো বিয়ে করবে?”

দৃশ্য কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না।এই মুহূর্তে পৃথিবীর সব কিছুই ফিকে লাগছে।শুধু এই মুহুর্তটা মধুর মনে হচ্ছে।সময়টা এইখানে থমকে গেলে ভালো হবে।দৃশ্য হঠাৎ খেয়াল করলো তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। সে মাহাদের বউ হবে ভাবতেই কেমন যেনো অনুভূতি হচ্ছে।মাহাদের ধূসর চোখের দিকে তাকাতে পারছে না।নিজের চোখ নামিয়ে মাহাদের বুকে আবার মুখ গুঁজে রইলো। মাহাদ মুচকি হেসে বললো

-“নিরবতা কিন্তু সম্মতির লক্ষণ।পড়ে কিন্তু বলতে পারবে না জোর করে বিয়ে করেছি।অবশ্য না বললে জোর করেই করতাম।আমি আবার মহৎ প্রেমিক না।নিজের ভালোবাসা কে নিজের করে নিতে সব করতে পারি।”

দৃশ্য মাহাদের বুকে কিল বসিয়ে বললো
-“থ্রেট দিচ্ছ?”

-“অবশ্যই দিচ্ছি।আর আমাকে যে এতো দিন কষ্ট দিয়েছো তার শোধ বিয়ের পরে তুলবো।”

দৃশ্য মুচকি হাসলো। নাবিলা হা করে তাকিয়ে আছে।তার চোখের সামনে এরা পালিয়ে বিয়ে করার সব প্ল্যান করে ফেলেছে।এমনকি রোমান্স করা শুরু করেছে। আল্লাহ এদের কি লজ্জা নাই।এই দৃশ্য প্রেম করে নির্লজ্জ হয়ে গেছে।আল্লাই জানে এইগুলা আর কি কি করছে।নির্ঘাত এইখানে লিপ কিস করেনি।নাহলে নাবিলা এইখানেই অজ্ঞান হয়ে যেতো।নাবিলা গলা খকিয়ে বললো

-“সিরিয়াসলি ভাইয়া আপনারা পালিয়ে বিয়ে করছেন?”

দৃশ্যর এবার হুস ফিরলো।সে দ্রুত মাহাদের বুক থেকে সরে গেলো। মাহাদ মুচকি হেসে নাবিলাকে বললো

-“এক্সাইটিং হবে বিষয়টা তাইনা শালীকা?আর তুমি হবে বউ পক্ষের সাক্ষী।”

নাবিলা কপাল কুঁচকে ভাবলো
-এরা নিজেরা ডুববে আর আমাকে নিয়ে ডুববে।বাবা আর ছোট চাচা জানলে দেখা যাবে দৃশ্য বাসর করছে আর আমি বাঁশ খাচ্ছি।

নাবিলা চিন্তিত হয়ে বললো
-“কিন্তু ভাইয়া এমন করলে দুই পরিবারে আরো ঝামেলা বাড়বে।”

-“আমি সব ঝামেলা পোহাতে রাজি আছি।কিন্তু তোমার বোনকে আর দূরে রাখতে রাজি না।আমার ফ্যামিলিতে কোনো প্রবলেম হবে না।সবাই দৃশ্যকে ভীষণ পছন্দ করে।”

নাবিলা তবুও নিশ্চিত হতে পড়ছে না।সামনে আরো বেশি প্রবলেম হবে সেটা সে বুজলেও এই দুই পাগল প্রেমিক যুগল বুঝতে পারছে না।তাদের চোখে নেশা।একে অন্যকে পাওয়ার নেশা।

মাহাদ দৃশ্যকে বললো
-“কাল সকালে আমি তোমাকে কলেজ থেকে নিয়ে যাবো।আজ রাতটা শুধু কষ্ট করো। কাল থেকে তুমি শুধু আমার।করো সাধ্য নেই আমাদের আলাদা করার।”

দৃশ্য মাথা নেড়ে হে জানালো।সেই রাতটা দৃশ্যর দুই চোখে আর ঘুম আসলো না।এই এক সমস্যা।সে কষ্টে থাকলে ঘুম হয়না।আবার বেশি খুশি হলেও ঘুম হয়না।কিন্তু মনে মনে সে ভয় পাচ্ছে।ভীষণ ভয়।বুকের বা পাশে অচেনা বেথা হচ্ছে। মাহাদকে পাবে তো?বাবা সব জানতে পারলে কি রিয়্যাক্ট করবে?সব ঠিক হবে তো?নাকি সব শেষ হয়ে যাবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here