#তোমার_আমার_প্রণয়,39,40
#israt_jahan_arina
#part_39
মাহাদ দের পুরো পরিবারে ছেয়ে গেছে শোকের ছায়া।একজন মানুষের অনুপস্থিতি পুরো পরিবারকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে।আমজাদ রহমানকে মাটি দেওয়ার পর থেকে মাহাদ বাবার কবরের পাশে চুপ করে বসে আছে।অপরাধ বোধ তাকে গ্রাস করে আছে।আজ তার জন্য বাবা পাশে নেই।এই অপরাধ বোধ নিয়ে সে কি করে বাঁচবে?তার জীবনের শ্রেষ্ঠ মানুষটি যে তার পাশে নেই।এই শূন্যতা কি করে দূর করবে?
শামসুন্নাহার বেগম ছেলেকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে।তার প্রেসার অনেক বেড়ে গেছে।বিছানা ছেড়ে উঠতে পড়ছে না।দুই ছেলেই তার চোখের মণি।কিন্তু বড়ো ছেলেটা একদম আলাদা।তার মতো মাটির মানুষ আর হয় না।রাজনীতিতে এতো জটিলতা আর দুর্নীতি দেখে সে রাজনীতি ছেড়েছে।নাহলে বংশগত রাজনীতি কে ছারে।তার একটাই কথা মানুষের সেবা করার জন্য রাজনীতিতে থাকতে হবে এমন কোনো কথা নেই।রাজনীতির বাইরে থেকেও সেবা করা যায়।সে বরাবর একটা সাধারণ জীবন চেয়েছে।নিজে থেকে কিছু করতে চেয়েছে।ব্যাবসায়ী প্রতি তার বেশ ঝোঁক ছিল।তাই ঢাকায় একটা ছোট ফেক্টরি দিয়ে শুরু করে।যা দিন দিন বড়ো হতে থাকে।ঢাকা শহরে বিশজন ধনী ফেক্টরী মালিকের মধ্যে তিনি একজন।
তবে এই ব্যাবসায় পরিচালনার ক্ষেত্রে তার অনেক কষ্ট করতে হতো।কারণ তাকে প্রতি সপ্তাহে ঢাকা টু রাজশাহী যাতায়াত করতে হতো।তিনি চাইলেই খুব সহজে পরিবার নিয়ে ঢাকায় শিফট করতে পারতেন।কিন্তু তার মা শামসুন্নাহার বেগম কিছুতেই ঢাকায় যাবেন না।ওই যান্ত্রিক শহরে নাকি তার দম বন্ধ হয়ে আসে। আর শাশুড়িকে ছেড়ে আখি রহমানও যেতে রাজি হয়নি।
তার এই মুহূর্তে ছেলের বউয়ের চিন্তা হচ্ছে।তার ছেলেকে ছেড়ে মেয়েটা কি করে থাকবে?ছেলেটা বউকে ভীষণ ভালো বাসতো।ভাগ্য করে এমন বৌমা পেয়েছেন তিনি।তাকে ভীষণ সম্মান করে আখি।আজও মনে আছে সে দিনের কথা।তখন আমজাদ রাজনীতিতে পুরো পুরী মত্ত।বিয়ের কথা বললেও ছেলে রাজি হতো না।একদিন বাসায় এসে জানালো তার একটা মেয়েকে পছন্দ।মেয়েটাকে কলেজে যাওয়ার পথে দেখেই নাকি পছন্দ হয়ে গেছে।তিনি পর দিনই আখির বাসায় বিয়ের প্রস্তাব রাখেন।তারপর পারিবারিক ভাবে তাদের বিয়ে হয়।ছেলে যে বউকে চোখে হারাতো।
আখি রহমান নিস্তব্ধ হয়ে গেছেন।না কান্না করছে,না করো সাথে কথা বলছে।যেনো পাথর হয়ে গেছে।নিজের প্রাণ প্রিয় স্বামীকে এই ভাবে হারাতে হবে ভাবতে পারেননি।মানুষটা তো তাকে কথা দিয়েছিলো সারা জীবন পাশে থাকবে।তবে আজ কেনো স্বার্থপরের মত একা চলে গেলো।একটি বারও কি তার কথা ভাবলো না? আজ থেকে কে তার খেয়াল রাখবে?কে আদর করে ম্যাডাম বলে ডাকবে?রাগ করে থাকলে কে আদুরে কথা বলে রাগ ভাঙিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিবে?
মাহিম ঘর বন্ধ করে বসে আছে।এই মুহূর্তে তার করো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।সে কিছুতেই অশ্রুধারা কে আটকে রাখতে পড়ছে না।বাবা নামক ছায়াটা মাথা থেকে হারিয়ে গেলে ঠিক কতটা অসহায় লাগে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।তার বাবা তো আট দশটা বাবার মতো ছিলো না।তার বাবা ছিলো তাদের দুই ভাইয়ের বেস্ট ফ্রেন্ড।শাসন জিনিসটা তারা বাবার কাছ থেকে কোনো দিন পায়নি।যা শাসন মা আর দাদী করতো।বাবার এমন কাজের জন্য মা আর দাদীর কাছ থেকে কতো কথা শুনেছে।কিন্তু তবুও কোনো দিন একটা ধমক ও তিনি দেননি।এমন বাবার ছায়া হঠাৎ এই ভাবে হারিয়ে গেলে তারা কি করে নিজেকে সামলাবে?
আরিফ ও অপরাধ বোধের কারণে ভাবির সামনে যায়নি।সে এই বয়সে এসে এমন ভুল কি করে করলো?এমন ডিসিশন নেওয়ার আগে একবার ভাই কে জানলে হয়তো পরিস্থিতি এতটা ঘোলাটে হতো না।
মাহাদের মামা আর মামীরা সব আত্মীয় স্বজনদের সামলাচ্ছেন।কারণ এই বাড়ির করো পরিস্থিতি কথা বলার মতো নেই।এলাকার সকল মানুষ ছুটে এসেছিল আমজাদ রহমানকে শেষ বার দেখার জন্য।মানুষটি কে অপছন্দ করে এমন খুব কম মানুষ পাওয়া যাবে।রাজনীতিতে থাকতে তিনি সবার জন্য ভালো কিছু করার চেষ্টা করেছে।এমনকি রাজনীতি ছাড়ার পরও মানুষের বিপদে সব সময় পাশে থেকেছেন।এমন মানুষ হটাৎ এই ভাবে চলে যাওয়াটা সবার জন্য দুঃখের।
এলাকার সকলের এতো সময়ের মধ্যে জানা হয়ে গেছে মেয়র এর মেয়ে আর মাহাদ পালিয়েছিলো।যার কারণে মেয়র সাহেব আমজাদ রহমানের সাথে ঝামেলা করেছে।আশরাফ হুসেনের মতো অহংকারী মানুষ যে কি করতে পারে তা সকলের জানা।আশরাফ হুসেনের কারণেই আমজাদ রহমান অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন তা পুরো এলাকায় রটে গেলো।মানুষ আশরাফ হুসাইনকে ছি ছি করছেন।অনেকে এটাও বলছে আমজাদ রহমানের মতো এতো বিত্তশালী লোকের ছেলে যে তার মতো অহংকারী লোকের মেয়েকে পছন্দ করেছেন এটাই তার সাত কপালের ভাগ্য।নাহলে আমজাদ রহমানের মতো এতো ভালো মানুষ ওই অহংকারী আশরাফের বাড়ির মেয়ে কোনো দিন অনতো না।আশরাফ হুসাইন ক্ষমতায় থাকায় এলাকার মানুষ তার সামনে কিছুই বলতে পারে না।তবে দৃশ্য আর মাহাদ বিয়ে করে নিয়েছে সেটা সবাই জানে না।কারণ তাদের ধারণা বিয়ে করলে নিশ্চয়ই কয়েক দিন পর বাড়ি ফিরতো।তাদের ধারণা তাদের পালানোর সময় আশরাফ ধরে নিয়েছে।আর এর জন্যই আমজাদ রহমানের সাথে ঝামেলা করেছে।আবার অনেকের ধারণা তারা বিয়ে করে ফেলেছে।
টাকা আর ক্ষমতা থাকলেই যে ভালো মানুষ হওয়া যায়না সেটা আশরাফ হুসাইন বুঝিয়ে দিয়েছেন।অন্যদিকে সাত পুরুষ বিত্তশালী হলেই যে তাদের মধ্যের অহংকার চলে আসে না সেটা আমজাদ রহমানকে দেখে বোঝা যায়।
আমজাদ রহমানের মৃত্যুর খবর শুনে দৃশ্যর মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পরলো।বুকের বা পাশে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলো।চিৎকার করে কাদলো।আচ্ছা ভালো মানুষ গুলো এই ভাবে কেনো চলে যায়?এই মানুষটা যখন তাকে ঘরের লক্ষী বলে তখন তার শরীর বেয়ে শীতল হাওয়া বয়ে যায়।এতো আদুরে ডাকে কোনো মানুষ তার ছেলের গার্লফ্রেন্ডকে ডাকতে পারে সেটা তো জানা ছিল না। দৃশ্য ভেবেছিলো তাদের বিয়ের খবর শুনে তিনি বকা ঝকা করবেন।আর যখন তার বাবা তাকে অপমান করছিলো তখন দৃশ্য ধরেই নিয়েছে তিনি তাকে কখনো মেনে নিবে না।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটি তার বাবার পথ আগলে দাড়িয়েছে।তাকে বাড়ির বউ বলে মেনে নিয়েছে।
আজ নিজের বাবার প্রতি তীব্র ঘৃণা কাজ করছে।এই মানুষটির আর কতো খারাপ রূপ আছে?এই মানুষটি যে কোনদিন তার মাকে সম্মান করেনি সেটা দৃশ্য বুঝে গেছে।এই পরিবারে জন্ম নিয়ে আজ দৃশ্যর আফসোস কাজ করছে।সে কেনো আমজাদ রহমানের মতো একজন বাবার ঘরে জন্মালো না?আর ওই মানুষটিকে সে বাবা হিসেবে পেয়েও হারিয়ে ফেললো।এমনটা কেনো হলো।আর মাহাদ!সে ঠিক আছে তো?বাবা যে তার জীবনে কতোটা জুড়ে আছে সেটা দৃশ্য জানে।নিশ্চয়ই সে ভীষণ ভাবে ভেঙে পড়েছে।এই সময় তার কি করা উচিৎ নিজেও জানেনা।সে একটা বার সে বাড়িতে যেতে চাইলো।কিন্তু যাবে কি করে?তার বাবা যে তাকে ঘর বন্দি করে রেখেছে।সেদিন হসপিটালে আমজাদ রহমানকে দেখতে যাবার অপরাধে তাকে রুমে আটকে রেখেছে।এই দুই দিনে দৃশ্য এক ফোঁটা খাবার মুখে তুলেনি।আশরাফ হুসাইন করা ভাবে নিষেধ করেছেন ওই রুমের দরজা খুলতে।আনিকা কবির শুধু আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেদে চলছেন।মেয়ের জন্য কিছুই করতে পারছেন না।
ফাহিম দুই দিনে অনেকটা চুপসে গেছে।বাবার ভিন্ন কিছু রূপ তার চোখে পড়ছে।তার বাবা কি করে ওই সম্মানী মানুষটিকে আঘাত করতে পারলো?আবার ওই বাড়ি থেকে ফিরে দৃশ্যকে রুমে বন্দি করে রাখলো।সে রুম খুলতে চাইলে তাকে একটা থাপ্পর মেরে শাসিয়ে দিলো।এতো কিছুর পরও বাবার মধ্যে বিন্দু মাত্র অপরাধবোধ তার চোখে পড়েনি।তাহলে কি ওই বাড়ির মানুষ গুলি বাবা সম্পর্কে ঠিক বলছিলো?বাবা কি আসলেই এমন?সেদিন মায়ের গায়েও অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখেছিল। তবে কি সে চিহ্ন গুলো বাবার দেওয়া আঘাতের কারণে হয়েছে? বাবা কি আসলেই মায়ের গায়ে হাত তুলে? আর কিছুই ভাবতে পারল না সে। নিজের বাবা সম্পর্কে এতটা খারাপ ধারণা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।
একটা খারাপ লাগা কাজ করছে তার মাঝে। আমজাদ রহমানের জানাজায় সে শরিক হয়েছিল। তার অবচেতন মন এই মানুষটাকে পছন্দ করে সম্মান করে। সেখানে মাহাদকে দেখেছিল বিধ্বস্ত অবস্থায়। বাবার মৃত্যুতে ছেলেটা একদম ভেঙে পড়েছে। এই প্রথম মাহাদের জন্য কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করেছে ফাহিম এর মধ্যে।
সে বাসায় ঢুকতেই দেখতে পেল তমা দরজা খুলে দিয়েছে। এই মেয়েটা আজ অনেকদিন পর তাদের বাসায় এসেছে। সেদিনের পর আর তাঁর চেহারা দেখা হয়নি ফাহিমের। হয়তো মেয়েটা ইচ্ছে করেই তার সামনে আসতো না। মেয়েটা কি অভিমান করেছে তার সাথে? করলে করুক তবে তার কিছু যায় আসে না।ফাহিম আর তমাকে নিয়ে বেশি মাথা ঘামালো না। সে নিজের রুমের দিকে এগোতে নিলেই তমা ডাকলো।আর বললো
-“এখন নিশ্চয়ই অনেক খুশি হয়েছেন আপনারা। আপনাদের ইগো তো জিতে গেল তাই না?”
-“কি বলতে চাইছিস তুই?”
তমা তাচ্ছিল্য হেসে বললো
-“আপনাদের পরিবারের সমস্যা কি জানেন আপনারা কখনো কারো মন বুঝতে চান না। সবসময়ই অহংকার আপনাদের রন্দ্রে রন্দ্রে ঘুরে। দৃশ্যর কি অপরাধ ছিল বলুন তো? সে একটা মানুষকে ভালোবেসেছে সেটাই অপরাধ নাকি সে আপনাদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর আপনাদের চাইতে দ্বিগুণ ক্ষমতাশালী কাউকে ভালবেসেছে সেটা অপরাধ? আমজাদ আঙ্কেলের মত এমন একজন ভালো মানুষ অত্র এলাকায় আর একটা আছে কিনা আমাকে দেখান তো? আপনার বোনতো রাস্তার কোন লোফার ছেলেকে ভালোবাসে নি। আর না ভালোবেসেছে কোন ঘর চুলহীন ছেলেকে। মাহাদের বাবার ক্ষমতা আর প্রতিপত্তি সম্পর্কে আমার চাইতে আপনি ভালো জানেন। মাহাদের ক্যারিয়ার ও ব্রাইট। অথচ দেখুন তারা এত বিত্তশালী হওয়ার পরও তাদের মধ্যে কোন অহংকার নেই। মানুষের সাথে খুব খুব সহজেই তারা মিশে যায়। মানুষের বিপদের কিভাবে সবার আগে তারা এগিয়ে আসে। এমন একটা মানুষ আজ আপনাদের ইগো আর অহংকারে জন্য দুনিয়া ছেড়ে চলে গেলো।ওই মানুষটার মৃত্যুর জন্য দায়ী কিন্তু আপনারা।
সত্যি করে একটা কথা বলুন তো। মাহাদের নামে আজ পর্যন্ত কোনদিন একটা খারাপ কথা শুনে ছিলেন আপনি? কোনদিন কোন নারীঘটিত ব্যাপারে কোনো স্ক্যান্ডেল শুনেছেন?”
ফাহিম এক মিনিট ভাবলো।আসলেই সে কোনোদিন মাহাদের নামে একটা খারাপ কথা শুনেনি।তার বাবার মতো তার বেশ নাম আছে এলাকায়।আর মেয়ে সংক্রান্ত কোনো কোথাও কোনো দিন শুনেনি।সে সব সময় মেয়েদের এরিয়ে চলে এমন শুনেছে।বছর খানেক আগে রকির মাধ্যমে জেনেছিল মাহাদ এক বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করছে। তাও আবার ভীষণ সিরিয়াস প্রেম।যে কিনা মেয়েদের এড়িয়ে চলত সে শেষ পর্যন্ত একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে প্রেম করছে বিষয়টা জেনে ফাহিম নিজেও প্রচন্ড হেসেছিল। কিন্তু তার জানা ছিলনা সে বাচ্চা মেয়েটা তার নিজের বোন।
তমা আবার বললো
-“আপনারা আসলেই ভীষণ বোকা।একটা বার ভেবে দেখেছেন মাহাদ যদি আপনার বোনের জীবন নিয়ে খেলতে চাইতো তবে সে অনেক আগে সেটা করতে পারত। দৃশ্য মাহাদের প্রতি কতটা অ্যাডিক্টেড সেটা নিশ্চয়ই দেখেছেন। মাহাদ চাইলে আপনার বোন নিজেকে বিলিয়ে দিতে এক মিনিটও কিন্তু ভাবতো না। তার খারপ ইচ্ছা থাকলে আপনার বোনকে বিয়ে করার জন্য বাসায় প্রস্তাব পাঠাতো না।
আপনারা বারবার তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন।দৃশ্যর উপর অত্যাচার করেছেন। অথচ একটাবার আপনারা দেখেন নি তারা দুজন দুজনকে কতটা ভালোবাসে। মাহাদ যদি আপনার বোনের জীবন নষ্ট করতে চাইত তবে বিয়ে করে নিজের বাড়িতে তুলতো না। সে চাইলেই পারতো দৃশ্য কে বিয়ে করে দূরে কোথাও চলে যেতে কিছুদিনের জন্য কিন্তু সেটা করেনি সে তাকে সসম্মানে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল।
কিন্তু সেটা আপনাদের বোঝার ক্ষমতা নেই। মানুষের ভালোবাসাকে কখনোই আপনি সম্মান দেখান নি। না নিজের বোনের আর না অন্য কারোর। আপনাদের মত মানুষরা কাউকে ভালবাসতে জানেনা। আপনারা নিজে কাউকে ভালবাসতে পারেন না আর না করো ভালবাসা দেখতে পারেন।। শুধু জানেন নিজের ইগোকে সেটিস্ফাইড করতে।”
প্রচন্ড রেগে কথা গুলি বলে তমা দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।বাসা থেকে বেরিয়ে তমা সিড়িতে বসে পড়লো। দুই চোখ ভিজে উঠেছে তার। সে এমন একটা মানুষকে ভালবেসেছে যার মধ্যে মন বলে কিছু নেই। যে মানুষের মন বুঝে না। ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারে না।যে মানুষটা এত আদরের বোন কে বুঝতে পারল না সে তাকে কি করে বুঝবে? দৃশ্য জন্য প্রচন্ড খারাপ লাগা কাজ করছে তার। চঞ্চল মেয়েটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। বাচ্চা মেয়েটার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। অথচ এই পাথর মানুষগুলোর মন গলেনি।
ফাহিম নিজের রুমে যেয়ে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। তমার বলা প্রত্যেকটা কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।তার বোনের জন্য মাহাদ কি আদৌ ছেলে হিসেবে খারাপ ছিল? বরং অনেক বেশি যোগ্য ছিল। তার বাবা কিংবা সে হাজার খুঁজেও আদো ওর চাইতে ভালো কোন ছেলে খুঁজে পেতো? ব্যক্তিগত কারণে সে মাহাদকে পছন্দ না করলেও মাহাদ ছেলে হিসেবে কেমন সেটা খুব ভালো করে জানা আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় তার বোন মাহাদ কে ভালোবাসে।বোনের কথাটাও তো সে একবার ভেবে দেখেনি। বোন টা যে কত দিন ধরে কতটা মানসিক যন্ত্রণায় আছে সেটা কেন তার চোখে পড়েনি?মাথাটা তার চিন্তায় ভনভন করছে। এত সব কিছু সে কেন ভেবে দেখেনি। তমা ঠিক বলেছে ইগো আর অহংকার এর কারণে আর দুই চোখ বন্ধ হয়ে আছে। চোখের সামনে ন্যায় অন্যায় গুলো সে দেখতে পাচ্ছিল না। ওই মানুষটার মৃত্যুর জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তারাই দায়ী। এতো রিয়াক্ট না করে তারা যদি একটা বার সবকিছু ভেবে দেখতো, তাহলে হয়তো আজ এমন কিছু হতো না।
পরদিন দৃশ্য আর কিছুতেই চুপ করে বসে থাকতে পারলো না। মাহাদ কে একটা বার দেখার জন্য মন অস্থির হয়ে উঠেছে। মানুষটা যে ঠিক নেই সেটা সে বুঝতে পারছে। সে অনবরত কান্না করতে লাগল আর দরজা ধাক্কাতে লাগলো। আশরাফ হোসেন তখন বাসায় ছিলেন না। আনিকা কবির আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি একটা হাতুড়ি এনে দরজার লক ভেঙে ফেললেন। রুম থেকে বেরিয়ে দৃশ্য মাকে জাপটে ধরে কাঁদতে লাগলো। আনিকা কবির পরম আদরে মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন। দৃশ্য মাহাদের বাড়িতে যেতে চাইলে আনিকা কবির আর মানা করতে পারলেন না। আর কেউ মানুক বা না মানুক তিনি মানেন এই বিয়েটা। যেখানে মেয়ে সুখে থাকবে তিনি চান মেয়ে সেখানেই থাক। সেই ছেলেটার মাঝে যে তার মেয়ের সুখ নিহিত সেটা তিনি অনেক আগেই বুঝেছেন। তাই আর বাধা দিলেন না।
দৃশ্য দিকবিদিক ভুলে মাহাদ দের বাড়ির দিকে ছুটলো। এই মুহূর্তে তার মানুষের পাশে থাকা উচিত। সে কথা দিয়েছিলে মাহাদকে কোনদিন তার হাত ছাড়বে না। কথার বরখেলাপ সে করবে কি করে। তাছাড়া মাহাদ তার স্বামী। বাবা হাজার চেষ্টা করেও তাকে তার স্বামীর কাছ থেকে কিছুতেই দূরে রাখতে পারবে না।কিছুতেই না।
#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_40
আকাশটা আজ ভীষণ মেঘলা।জায়গায় জায়গায় নীলচে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী মতো পাকিয়ে আছে। মাহাদ বারান্দায় বসে এক দৃষ্টিতে সেই ধোঁয়া পর্যবেক্ষণ করছে।এই মেঘের ঘনত্ব কি তার মনের আকাশের মেঘের চাইতে বেশি?
গলা কেমন শুকিয়ে আছে তার।কয়েকটা ঢোক গিলে বুঝতে পড়লো মুখটা কেমন তেতো হয়ে আছে।এমন কেনো লাগছে?মন তেতো হয়ে থাকলে কি মুখ ও তেতো লাগে?
এই মুহূর্তে সে বাবাকে ভীষণ মিস করছে।আগে মা কোনো কারণ ভুল করলে বাবা সামলে নিতো।মায়ের আক্রোশ থেকে বাঁচাতো।কিন্তু আজ তার বাবাকে বলতে ইচ্ছে করছে মা কেনো আমাকে বকা দিচ্ছে না?কেনো কথা বলছে না? মারুক আমাকে।মেরে রক্তাক্ত করে দিক।
একটু আগে সে গেছিলো মায়ের রুমে।মা রুমের লাইট অফ করে জানালা পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছেন।তবুও রোদের আলো রুমটাকে অনেকটাই আলোকিত করে রেখেছে।মা খাটে হেলান দিয়ে বসে আছে। মাহাদ দরজায় দাড়িয়ে আছে।আজ প্রথম মায়ের রুমে ঢুকতে তার সংকোচ বোধ হচ্ছে। মায়ের মুখোমুখি হতে ভীষণ ভয় হচ্ছে।মাকে কি জবাবদিহি করবে সে?
কাপা কাপ পায়ে সে মায়ের রুমে ঢুকে বিছানার কাছে দাড়ালো।মায়ের পায়ের কাছে বসে পায়ের পাতায় হাত বুলালো।কিন্তু মায়ের কোনো রিএকশন নেই। তিনি এক দৃষ্টিতে পাশের বালিশের দিকে তাকিয়ে আছে।সেই বালিশটা বাবার।মাহাদের হৃদয়টাকে যেনো কেউ ছুরি আঘাত করছে।বাবার অনুপস্থিতি যে মাকেই সব চাইতে বেশি পীড়া দিচ্ছে। মাহাদের দু ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ল আখি রহমানের পায়ের পাতায়। এতেও তার কোনো সোধ বোধ নেই। মাহাদ বলতে লাগলো
-“জানো মা, বাবা সব সময় আমাকে বলতো প্রকৃত পুরুষ তারাই যারা নিজের আপন মানুষ গুলোকে ভালো রাখে।তাদের স্বপ্ন পূরণ করে।তাদের দিকে ধেয়ে আসা সকল বিপদ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।কিন্তু আমাকে দেখো,আমি আমার আপন মানুষ গুলোকে ভালো রাখতে পারিনি।বিপদ আমার উপর দিয়ে বয়ে গিয়ে আমার আপন মানুষ গুলিকে আঘাত করছে।ক্ষত বিক্ষত করছে।অথচ আমি আটকাতে পারছি না।তার মানে আমি প্রকৃত পুরুষ নই।আমি একটা কাপুরুষ।”
আখি রহমান কিছুই বললো না। শুধু একবার মাহাদের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন।সেই দৃষ্টি মাহাদের হৃদয়টাকে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো।মায়ের সেই দৃষ্টি চিৎকার করে বলছিলো
-“তুই একটা খুনি।তোর বাবাকে তুই খুন করেছিস।তোর মতো নিকৃষ্ট সন্তান আর কারো ঘরে না আসুক।”
একটা দৃষ্টি কতো কথা বলে দিতে পারে। এখন তার অপরাধ বোধ আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেলো।সে বুঝতে পারলো শুধু বাবাকে না,সে তার মাকে ও হারিয়ে ফেলেছে।
মাহাদ চেয়ে রইলো মায়ের মলিন মুখটার দিকে।এই কয়দিনে মায়ের সন্দৌর্যে যেনো ভাটা পড়েছে।চোখের নিচে কালি জমেছে।মুখটাও শুকিয়ে গেছে।চুলগুলি এলোমেলো।তার দেখা সবচাইতে সুন্দর নারী হলো তার মা।ছোট বেলায় সে নাকি তার মাকে সামনে বসিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা দেখতো।আর নাকে, মুখে, চোখে চুমু খেতো।তখন তার বাবা নাকি বলতো
-” বুজলে ম্যাডাম,আমার ছেলেও মনে হয় বউ পাগলা হবে আমার মত।”
আখি রহমান ধেত বলে উড়িয়ে দিলে তিনি বলতেন
-“আরে যে ছেলে মাকে এতো মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে দেখে
সেই ছেলে যে বউকে কতটা নেশাক্ত চোখে দেখবে সেটা বুঝা হয়ে গেছে।”
আর তার দেখা দ্বিতীয় নারী দৃশ্য।এই মেয়ের সৌন্দর্যের বর্ণনা তার কাছে নেই।তবে সে এটা নিশ্চিত তার সেই পাগল করা সৌন্দর্য একমাত্র তার চোখেই পড়ে।এই মেয়েটার চোখের পলক ফেলাটাও সৌন্দর্যে ভরপুর।আর এতো নিখুঁত ভাবে নিশ্চয়ই কেউ তার সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করবে না। অন্তত মাহাদ এটা করার সুযোগ দিবে না।
মাহাদ মায়ের পায়ে কয়েকটা চুমু খেয়ে চলে এসেছে।সেখানে আর বসে থাকতে পারলো না।
মাহাদের বাড়ির সামনে দাড়িয়ে দৃশ্য কয়েকবার ঢোক গিলে নিলো।বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে আছে। শোকের ছায়া যেনো বাড়ির প্রতিটা দেয়ালে দেয়ালে ছড়িয়ে পড়েছে।তার হাত পা কাপছে।প্রথম দিন এই বাড়িতে আসার সময় সে যতটা নার্ভাস ছিলো, আজ তার চাইতে বেশি নার্ভাস আর অসস্তি ফিল হচ্ছে।অপরাধ বোধ তাকে ঘিরে ধরেছে।নিজের পরিবারে নিকৃষ্ট ব্যাবহারের জন্য এই পরিবার আদো তাকে ক্ষমা করবে?
সামসুন্নাহার বেগম সোফার রুমে বসে আছেন।হতে তার ছবির অ্যালবাম।এইখানে তার দুই ছেলের ছোট বেলার অনেক ছবি আছে।সেটা দেখছেন আর চোখের জল ফেলছেন।কোনো মা কি দুই সন্তানেরই এই করুন পরিণতি মেনে নিতে পারে?আর সবটাই হয়েছে একজনের জন্যই।
তার পাশে বসে আছে আমরিন আর মাহাদের দুই মামী।আমরিন এর চোখ ফুলে আছে।তার ফুপার মতো এতো পজিটিভ মাইন্ডের মানুষ সে জীবনে খুব কম দেখেছে।আর তিনি ছিলেন বিচক্ষণ।নাহলে যা করো চোখে পড়েনি সেটা তার চোখে কেনো পড়লো?যেই অনুভূতি গুলি সে মনের মাঝে গোপনে সংরক্ষিত করে রেখেছিল সেটা ফুপা কেমন করে বুঝে গেলো?
বেশ কিছুদিন আগে যখন দৃশ্য এই বাসায় এসেছিলো সেদিন রাতে অনুষ্ঠানের পর রাতে ফুপাকে নিজের হাতের তৈরি চা দিতে গেছিলো, সেদিন ফুপা চা নিয়ে পরম আদরে তাকে পাশে বসিয়ে কিছুক্ষণ গল্প করেছিলেন।আর এক পর্যায় বলেছিলেন
-“জানিস মা জীবনটা বড্ডো অদ্ভুত।অনেক সময় আমরা যা চাই তা পায়না।ছুটে বেড়াই মরীচিকার পেছনে।যেই জিনিস আমার না তার পেছনে ছুটে নিজের কষ্টের মাত্রা বাড়ানো নেহাত বোকামি।বরং আমাদের সেই জিনিসটাই বেছে নেওয়া উচিত যেটা আমাদের জন্য মরিয়া হয়ে উঠে।আমাদের মূল্যায়ন করে।আমাদের অনুভূতির সম্মান দিতে পারে।আর আমি জানি তুই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী।”
কথাটা শুনে সে ভীষণ চমকে উঠেছিলো।তার ফুপা কি ইঙ্গিত দিয়েছে সেটা বুঝতে তার এক মিনিট সময় লাগলো না।
মাহাদের বড়ো মামী অনেক চেষ্টা করেও কাউকে কিছু খাওয়াতে পারেনি।শামসুন্নাহার,আখি, মাহাদ,মাহিম,আরিফ কেউ একটা দানাও মুখে তুলেনি।বাকি সবারটা বাত দিলেও শামসুন্নাহার বেগমকে খাওয়ানো অতীব জরুরী। না হলে এই বয়সে এতো ধকল সামলাতে পারবে না।আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।সন্তান হারানোর যন্ত্রণা আসলেই লাঘব করা অসম্ভব।
সবাই যখন নানান চিন্তায় মগ্ন ঠিক সেই সময় আগমন ঘটে দৃশ্যর।সকলেই দৃশ্যকে দেখে অবাক হয়ে যায়।এই মুহূর্তে কেউ তাকে এখনে আশাই করেনি।
দৃশ্যকে দেখেই শামসুন্নাহার বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন।এই মেয়েটার জন্য।শুধু মাত্র এই মেয়েটার জন্য আজ এতো কিছু।সেদিন দৃশ্যকে দেখে অনেক ভালো লাগলেও আজ দৃশ্যকে তার কাছে বিষের মতো লাগছে।যার পদার্পণের সাথে সাথে তার পরিবারের সব সুখ নিমিষেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
মাহাদের মামীরাও ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন।আর আমরিন।তার মন চাইছে এই মেয়েটার মুখটা ঝলসে দিতে।তাহলে আর মাহাদ ভাইকে মায়ার ফাঁদে ফেলতে পারবে না।
সকলের দৃষ্টি দেখে দৃশ্য চুপসে গেলো।সামনে সকলেই তার দিকে অগ্নিকুন্ডের শিখা দুই চোখে জ্বালিয়ে রেখেছে।যেনো এক্ষনি তাকে ভৎসো করে দিবে।দৃশ্য ভীষণ ভয় পাচ্ছে।
শামসুন্নাহার বেগম চিৎকার দিয়ে বলে উঠলেন
-“ওই অলক্ষী আমার বাইত কোন সাহসে আইছস?আমার পোলারে খাইয়াও তোর মন ভরেনাই? এহন আমার নাতিরে খাইতে আইছস?”
দৃশ্যর চোখ ভিজে উঠলো।সে দাদীর কাছে এসে দুই হাত চেপে নিজের হাতে ধরে বললো
-“দাদী আমাকে মাফ করে দিন।আমাদের একটা ভুলের জন্য এতো বড়ো ঝামেলা হবে আমি বুঝতে পড়িনি?আজ আংকেল ও আমাদের মাঝে নেই।”
শামসুন্নাহার বেগম যেনো আরো তেতে উঠলেন।তিনি হাত ঝাড়া মেরে সরিয়ে নিলেন। আর বললেন
-“নাটক করবিনা জানোয়ারের বাচ্চা।আমার নাতির মাথা খাইছিস তুই।নাইলে তোর মতো কুলাঙ্গার বাপের মাইয়ারে পছন্দ করতো না।আমার সংসারের সব সুখ শান্তি তোরা নষ্ট করছিস।বহু বছর আগে আমার ছোডো পোলার জীবনেডা নষ্ট কইরা তোগো মন ভরে নাই।অহন আমার নাতির পিছে পড়ছিস।”
দৃশ্য কাদতে কাদতে বললো
-“দাদী আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।আমি মাহাদকে সত্যি ভীষণ ভালোবাসি।”
-“জল্লাদের বাচ্চা আমারে ভালোবাসা শিখাস?তোর বংশে মায়া মহব্বত বলতে কিছু আছে?সব হইলি শয়তান।আইজ তোর বাপের লাইগা আমার বড়ো পোলাডা মরছে।আমার বুকের মানিক আর নাই।”
এই বলে তিনি কাদতে লাগলেন। মাহাদের বড়ো মামী বললেন
-“ছি ! এর জন্যই লোক বলে জাতের মাইয়া কালো ভালো।এই মেয়ের তো জাত ঠিক নাই।যার বাপ একটা জানোয়ার তার মেয়ে কেমন হবে জানা আছে।”
দৃশ্য কাদঁছে।ভীষণ কাদঁছে।কথা গুলি বিষাক্ত লাগছে।কিন্তু তার কাছে এই কথার কোনো জবাব নেই।
শামসুন্নাহার বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন
-“এহনি আমার বাসা থাইক্যা বাইর হ।তোর মতো অলক্ষ্মী মাইয়া যে বাড়িতে কদম ফালাইবো সে বাড়ির সুখ-শান্তি নিমিষে শেষ হইয়া যাইব।”
দৃশ্য আবারো দাদীর হাত ধরে বললো
-“দাদী আমাকে এই ভাবে তাড়িয়ে দিবেননা।আমি সব কিছু পেছনে ফেলে এসেছি।”
ঠিক এই সময় বাড়িতে প্রবেশ করে মাহাদের বড়ো মামা।দৃশ্যকে দেখে তার ভীষণ রাগ হয়।এতো কিছুর পর এই মেয়ের সাহস কি করে হয় এই বাড়িতে আসার?তিনিতো ওই আশরাফ হুসাইনকে জেলের ভাত খাইয়ে ছারতো।আমজাদ রহমান হসপিটালে থাকা অবস্থায় তিনি আশরাফের নামে মামলা করতে চেয়ে ছিলেন।কিন্তু আমজাদ রহমান তাদের সাফ শব্দে মানা করে দিয়েছেন।নাহলে এই মেয়ের চোদ্দো ঘুষ্ঠিকে তিনি জেলের ভাত খাইয়ে ছাড়তেন।তিনি রাগী গলায় বললেন
-“এই মেয়ে তুমি এই বাসায় কি করো?বের হও এক্ষনি।সাহস তো কম না তোমার।”
দৃশ্য দাদীর দিকে হাত জোড় করে বললো
-“দাদী আমি কোথায় যাবো?এটা আমার স্বামীর বাড়ি।প্লিজ আমাকে তাড়িয়ে দিবেন না।”
শামসুন্নাহার বেগম এবার যেনো নিজের রাগটা কিছুতেই সামলাতে পড়লেন না।আল্লাহ জানেন তার মধ্যে কি শক্তি ভর করেছে।তিনি দৃশ্যর গালে পর পর কয়টা চর মেরে চুলের মুঠি ধরে বললেন
-“কিসের স্বামীর বাড়ি?তোর বাপ না এই বিয়ে মনে না? তোরে নিয়া যাওয়ার লাইগা আমার পোলারে চোট দিলো?আর অহন তুই নাটক করতে আইছস?”
অনেক্ষন যাবত বাহিরে চেচা মেচির শব্দ পাচ্ছেন আখি রহমান।কিন্তু উঠে যাবার কোনো ইচ্ছে নেই।তবে এতো শব্দে আর নিজেকে সামলাতে না পেরে বেরিয়ে এলেন।আর দৃশ্যকে দেখেই চমকে গেলেন।
হটাৎ দৃশ্যর নজর পড়ে আখি রহমানের দিকে।দৃশ্য ভরসা পায়।এই মানুষটা নিশ্চয়ই তাকে বুজবে।এই মানুষটার মধ্যে সে নিজের মাকে দেখেছিল।সেদিন কত আদরে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন।কিন্তু দৃশ্যর চিন্তা ধারাকে বদলে দিলো আখি রহমানের দৃষ্টি।তার সেই কঠিন দৃষ্টি দৃশ্যকে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো।যে দৃষ্টিতে ছিলো ঘৃণা।দৃশ্যর গায়ে হাত তোলা দেখেও তিনি সেখানেই নির্লিপ্ত ভাবে দাড়িয়ে ছিলেন।
অন্য দিকে সবাই তাকে যাচ্ছে তাই বলে যাচ্ছে।এমনকি আমরিন ও বাদ যায় নি।শামসুন্নাহার বেগম এর মধ্যে বেশ কয়েকটা চর বসিয়েছেন তার গালে।
তিনি এক প্রকার জোর করে দৃশ্যকে দরজার কাছে নিয়ে যাচ্ছেন।এই মেয়েকে তিনি এক মুহূর্তও এই বাড়িতে রাখবেনা।দৃশ্য এবার শামসুন্নাহার বেগমের পায়ে পড়ে গেলো।সে কাদতে কাদতে বললো
-“দাদী আমি আপনার পায়ে পড়ছি।এতো নিষ্ঠুর হবেননা।আমাকে একটা বার মাহাদের কাছে যেতে দিন।আমি এই সময় তার পাশে থাকতে চাই।আমারও তাকে বড্ডো প্রয়োজন।আমাকে তাড়িয়ে দিবেননা।আমার স্বামীকে ছেড়ে আমি যাবো না।”
শামসুন্নাহার বেগমের রাগে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে।এই মেয়ের জন্য তার বিন্দু মাত্র মায়া হচ্ছে না। বরং একটা কালনাগিনী লাগছে।যার ছোবলে তার পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ এই মেয়ে কেমন নাটক করে যাচ্ছে।এই মেয়েও বাপের মতোই শয়তান। এর ছায়াও তিনি মাহাদের উপর পড়তে দিবেননা।প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি দৃশ্যর পেট বরাবর একটা লাথি মারে।দৃশ্য “ও মাগো” বলে পেতে হাত রেখে চিৎকার দিয়ে উঠে।শামসুন্নাহার বেগম আজ নিজের মধ্যে নেই।তিনি চিৎকার করে বলে উঠে
-“বেয়াদবের বাচ্চা বের হ আমার বাড়িত থাইকা।এই বাড়িত তোর কোনো জায়গা নাই।আমার চোখের সামনে থাইকা বের হ।”
কথাটা বলেই তিনি আরো দুইটা লাথি মারেন।যার একটা লাগে দৃশ্যর বুকে আর একটা লাগে তলপেটে।তীব্র যন্ত্রণায় দৃশ্য ফ্লোরে গড়াগড়ি করতে থাকে।দুই হাতে পেতে ঝাপটে ধরে রেখেছে মেয়েটা।
এমন কান্ডে সবাই হতবম্ব হয়ে যায়।শামসুন্নাহার বেগম এমন একটা কাজ করে বসবেন কেউ ভাবতে পারেনি।আখি রহমান নিজেও হতবম্ব।তিনি কয়েক কদম আগাতেই শুনতে পেলো মাহিমের চিৎকার।তিনি উপরে তাকিয়ে দেখলেন মাহিম ভাবী বলে ডাকতে ডাকতে সিড়ি বেয়ে নিচে নামছে।আর মাহাদ সিড়ির ধরে ঠায় দাড়িয়ে আছে।কেমন পথন বনে গেছে মাহাদ।এক দৃষ্টিতে দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে আছে।আখি ভাবলো কখন আসলো মাহাদ?
মাহিম নিজের রুমের বারান্দায় বসে ছিলো।বাবাকে ছাড়া দিন গুলি কেমন বিষাদ লাগছে।বাবা যে মন ভালো করার ঔষধ। হঠাৎ নিচ থেকে অনেক শব্দ শুনতে পেয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখলো তার ভাই সিড়ির ধরে দাড়িয়ে আছে।একদম পাথরের মতো।হয়তো এই দুনিয়াতে নেই।সে দ্রুত সিড়ির কাছে আসতেই দেখলো দৃশ্য ফ্লোরে পড়ে আছে আর তার দাদী একটা লাথি মারলো।যেহেতু দৃশ্য পেটে হাত রেখে ছিলো তার মানে দাদী আগেও লাথি দিয়েছে।এটাই প্রথম না।সে আর ভাবতে পারলো না।চিৎকার দিয়ে নিচে চলে আসলো।দৃশ্যর কাছে এসে ফ্লোরে বসে পড়লো।আর বলতে লাগলো
-“ভাবী তুমি ঠিক আছো?বেশি খারাপ লাগছে?দাদী তোমার মাথা ঠিক আছে?ভাবির গায়ে কেনো হাত তুলছো?”
মাহিমের মুখে ভাবী শুনে শামসুন্নাহার বেগম রেগে গেলেন।আর বললেন
-“খবর দার ওরে ভাবী কবি না। এই জানোয়ারের বাচ্চার কোনো যোগ্যতা নাই এই বাড়ির বউ হওয়ার। এহনি বের হইতে ক।”
-“দাদী তুমি পাগল হয়ে গেছো?ভাবী এই বাড়ির বউ।তুমি তাকে এই ভাবে আঘাত করতে পারো না।সে কোথাও যাবে না।”
-“ভালোই জাদু জানিস মাইয়া।আমার পোলাগো আর নাতি দুইডারে বস কইরা ফালায়ছস।”
-“দাদী চুপ করো।”
আখি রহমান আর দাড়িয়ে থাকতে পারছেন না।আজ কেনো যেনো দৃশ্যর প্রতি তার মায়া কাজ করছেনা।এই মেয়েটার জন্য আজ তার স্বামী তার কাছে নেই।তিনি মাহাদের দিকে তাকালেন। মাহাদের দৃষ্টি মায়ের দিকে।যে দৃষ্টি বলছে মা ওর কষ্ট হচ্ছে।দাদীকে থামাও।কিন্তু তিনি কিছুই বললেন না। বরং আরো কঠিন দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে তাকালেন।তার দৃষ্টি কঠিন হলেও চোখে ঝরছে অশ্রু।তারপর নিজের রুমে চলে গেলেন।
মায়ের চোখের জল মাহাদের অন্তর আত্তাকে নাড়িয়ে দিলো।তার পুরো শরীর কাপছে।
দৃশ্যর নজর পড়ল মাহাদের দিকে। মাহাদের জির্ণ শীর্ণ চেহারা দেখে মুহূর্তেই দৃশ্য নিজের পেটের বেথা ভুলে গেলো।ইসস কি হাল হয়েছে মানুষটার। এলোমেলো চুলে মাহাকে বেমানান লাগছে।মন চাইছে হাত দিয়ে চুল গুলি ভাঁজ করে দিতে।চোখ গুলো ফোলা।সে কষ্টে জোড়ে কাদতে লাগলো।আর বললো
-“মা.. মাহাদ! মাহাদ দেখো আমি চলে এসেছি।দাদীকে বোঝাও না একটু।”
মাহাদ নিচে নেমে আসলো।দৃশ্যর সামনে দাড়ালো।হাত ধরে দার করিয়ে দিলো দৃশ্যকে।দৃশ্য ব্যাথায় কুকিয়ে উঠলো।কিছুতেই দাড়িয়ে থাকতে পারছে না।পড়ে যেতে নিলে মাহাদ দ্রুত তাকে কোলে তুলে নেয়।
এই দৃশ্য দেখে শামসুন্নাহার বেগম প্রচন্ড রেগে গেলেন।আর বললেন
-“ছি মাহাদ! লজ্জা করেনা তোর?আবার এই মাইয়ার জালে ফাইসা গেলি?এই মাইয়ার লাইগা তোর বাপ আজ নাই।আমাদের কইলজাডা আজ মাডির নিচে।আর তুই এই বেহায়া মাইয়ারে এই বাড়িতে তুলবি?নিজের মায়ের লাইগা মায়া লাগে না?এই মাইয়ার লাইগা আজ তোর মা বিধবা।আর তুই কিনা ছি!!তুই একটা কুলাঙ্গার।”
বিধবা শব্দটা মাহাদের বুকে তীরের নেয় বিধলো।বুকে রক্তক্ষরণ হলো।তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।সে কাউকে আর কিছু না বলে দৃশ্যকে নিয়ে সোজা বাসা থেকে বেরিয়ে আসলো।
দৃশ্য মাহাদকে ঝাপটে ধরে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে।পেটের ব্যাথাকে আর বেথা মনে হচ্ছে না।সে তার স্বামীর কোলে আছে।তার বুকের কাছে আছে।আর কি লাগে? বাকি দুনিয়া যা খুশি বলুক।এই মানুষটা পাশে থাকলে সে সব হজম করে নিবে।