তোমার_আমার_প্রণয়,47,48

0
1139

#তোমার_আমার_প্রণয়,47,48
#israt_jahan_arina
#part_47

একে একে মেঘালয়ে সাতটি পাহাড় একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। সাতটি পাহাড় হতে ঝর্না ধরার বয়ে চলেছে বিছানাকান্দির উপর দিয়ে।মনে হবে যেনো একটি পাথরের বিছানা। এ এক অপূর্ব দৃশ্য।পানির ঢল জায়গাটিকে মায়াময় করে তুলে।স্বচ্ছ পানির নিচে রয়েছে ছোটো বড়ো পাথর। মাহিমরা সকলেই এই সৌন্দর্যে মুগ্ধ।বর্ষা একের পর এক সেলফি ক্লিক করছে।সাথে আছে পূজা।সিয়াম বিরক্ত হয়ে মাহিম কে বললো

-“মেয়ে মানুষ মানেই পেরা।এই দশ মিনিটে মনেহয় শত খানিক সেলফি তুলে ফেলছে এই দুইটা।দেখবি আপলোড দিবে মাত্র দুইটা।টাও কতো শত ফিল্টার মাইরা।”

মাহিম বললো
-“এইটা ঠিক বলছিস।এই দুটো সারাদিনই সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভ থাকে।একে বিয়ে করে বাড়িতে নিলে সপ্তাহ খানেকের মধ্যে আমার দাদী স্ট্রোক করে বসবে।কারণ বৌমা তাদের উঠতে বসতে ব্লগ করে।দেখা যাবে রান্না করতে দিলে সবজি না নিয়ে আগে ক্যামেরা নিবে।খাবার প্লেটে বেড়ে খেতে দিবেনা।বলবে “ওয়েট দাদী আগে পিক তুলে আপলোড দিয়ে নেই।” আমার দাদী তো পাগল হয়ে যাবে।”

আরিফিন হেসে বললো
-“বর্ষার মতো মেয়ে কেমনে সংসার করবে সেটা দেখার বিষয়। জাস্ট ইমাজিন বর্ষার এক গাধা পোলাপান সামলাতে না পেরে মাহিম কে উড়া দুরা গালি দিবে। যা শুনে তোর দাদী পটল তুলবে।”

কথাটা বলে পাশে তাকাতেই দেখে বর্ষা রাগী চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।সে রেগে বললো

-“আমার সংসার করা দেখার সখ একদম মিটায় দিবো রাম ছাগল।আর বাচ্চা কাচ্চা আমি কেনো সামলাবো?ওইটা তো মাহিম করবে।আমি শুধু পায়ের উপর পা তুলে খাবো।আমি ওর চাইতে বড়ো।তাই যা করতে বলবে তাই করতে হবে।”

-“তুই জাস্ট আমার তিন মাসের বড়ো।এতো মুরুব্বী সাজার কিছু নাই।”

-“একদিনের বড়ো হলেও বড়ো হয়।এই শোন?আমি কিন্তু বাচ্চা পালতে পারবো না।ওটা আমার ধারা হবে না।বাচ্চা কাচ্চা তুই আর তোর দাদী মিলে সামলাবি।”

মাহিম মুচকি হেসে বললো
-“আগে বিয়ে করে আমাকে সামলা।বাকি সব আমি সামলে নিবো।”

বর্ষা এবার কিছুটা লজ্জা পেলো।সে মুখ বেঞ্চি কেটে চলে গেলো।মাহিম আর বাকিরা হো হো করে হেসে উঠলো।এই মেয়ে লজ্জাও পায় তাদের জানা ছিল না।

একটা গানের শুটিং নিয়ে বেশ ব্যাস্ত হয়ে পরেছিলো মাহাদ।তবে প্রতিদিন একবার অফিসে একবার ঘুরে গেছে।একটা বার দৃশ্যকে দেখার জন্য।কিন্তু দৃশ্যর দেখা সে পায়নি।চাইলে সে দৃশ্যর বাসায় যেতে পারতো।কিন্তু ওই বাসায় তিনটা মেয়ে একা থাকে।হঠাৎ এই ভাবে বার বার যাওয়াটা লোকেদের চোখে ভালো দেখাবেনা।তাই সে বাসায় যায়নি।

আজও অফিসে এসে দৃশ্যকে দেখতে পেলো না মাহাদ। মাহাদের চোখে চিন্তার চাপ।সে লুবনার সাথে দেখা করে প্রয়োজনীয় কথা বললো।শেষে আমতা আমতা করে বললো

-“মিস লুবনা আপনার অ্যাসিস্ট্যান্ট ওই মেয়েটাকে দেখছিনা যে?ছুটিতে নাকি?”

লুবনা একটু চমকে কপাল কুঁচকে বললো
-“কার কথা বলছো?দৃশ্যর?”

-“হে।দৃশ্যর কথাই বলছি।”

-“আরে ওতো আরো দুদিন আগেই রিজাইন দিয়ে জব ছেড়ে দিয়েছে।”

মাহাদ যেনো আকাশ থেকে পরলো।দৃশ্য জব ছেড়ে দিয়েছে?তার মানে সেদিন অরিনের সাথে দেখার পর সেদিনই রিজাইন দিয়ে চলে গেছে?এতটা অবিশ্বাস করলো ওকে?তাকে কিছু বলার সুযোগটাই দিলো না?
লুবনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো

-“বুজলে মেয়েটার বয়স কম হলেও কাজের প্রতি আগ্রহ ছিলো।আমার বেশ পছন্দ ছিলো মেয়েটাকে।তবে বুঝতে দিতাম না।ওকে বেশ কয়দিন যাবত ডিস্টার্ব দেখাচ্ছিলো।এই জবটা ওর ভীষণ প্রয়োজন ছিলো।একা এই শহরে থেকে নিজ খরচে স্টাডি করছে।এতো ভালো মানের জবটা হটাৎ কেনো ছেড়ে দিলো বুজলাম না।কারণ জিজ্ঞাসা করলে তেমন কিছুই বললো না।”

মাহাদের ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করলো।দৃশ্যর জব ছাড়ার কারণটা সে কিছুটা বুঝতে পারলো।এতটা অবিশ্বাস করে তাকে দৃশ্য? মাহাদের বেশ রাগ হলো।এই মুহূর্তে দৃশ্যকে সামনে পেলে দুই চারটা থাপ্পর মেরে দিতো।এতো জেদ কেনো এই মেয়ের?সে নিজের কেবিনে যেয়ে রবিনকে ডাকলো।রবিন দ্রুত তার কেবিনে উপস্থিত হলো।সে বললো

-“স্যার ডেকেছেন?”

মাহাদ তার কেবিনের কাচের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো
-“একজনের ইনফরমেশন চাই।”

-“কার ইনফরমেশন স্যার?”

-“নুরপা জাহান দৃশ্যর”

রবিন একটু চমকে বললো
-“স্যার আপনি কি লুবনা ম্যাম এর অ্যাসিস্ট্যান্ট দৃশ্যর কথা বলছেন?”

-“হে।”

-“স্যার দৃশ্য তো দুইদিন আগেই জব ছেড়ে দিয়েছে।যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখাও হয়েছিলো।ওকে একটু ডিস্টার্ব মনে হচ্ছিলো।কিন্তু হটাৎ দৃশ্যর সম্পর্কে কি জানতে চান?”

মাহাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো
-“ও এই জব ছেড়ে অন্য কোথাও জব করছে কিনা?করলেও কোথায় করছে?আর ওর নাম্বার টা এক্ষনি চাই।”

রবিন বেশ অবাক হলো।তার স্যারকে কখনোই মেয়েদের প্রতি আকৃষ্ট হতে দেখেনি।আজ হটাৎ নিজের অফিসের এতো ছোট পদের জব করা বাচ্চা মেয়েটার ইনফরমেশন কেনো চাইছে?সেদিনও দৃশ্যর সাথে মাতাল হয়ে গাড়িতে খারাপ আচরণ করেছে। স্যার তো আরো মাতাল হয়েও কোনোদিন কোনো মেয়ের সাথে খারাপ আচরণ করেনি।তাহলে হটাৎ দৃশ্যর সাথে এমন কেনো করলো?সে আর কিছুই ভাবতে পারছেনা। স্যার কোনো কারণে দৃশ্যর উপর রেগে নেইতো?সে ভয়ে ভয়ে বললো

-“স্যার দৃশ্য কি কিছু করেছে?আসলে মেয়েটা এখনো অনেক ছোট।কোনো ভুল করলে মাফ করে দিন।”

মাহাদ পেছন ফিরে মুচকি হেসে বললো
-“মাফ তো আমার চাওয়ার কথা তার কাছে।”

রবিন মাহাদের কথার মানে কিছুই বুজলো না।চোখ কুচকে দাড়িয়ে রইলো। মাহাদ আবার বললো
-“সেই বাচ্চাটাই তোমাদের ম্যাডাম।মিসেস মাহাদ।”

রবিনের চোখ যেনো রসগোল্লার মতো হয়ে গেলো।নিজের কানকে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।দৃশ্য স্যারের ওয়াইফ? স্যার বিয়ে করলো কবে? হায় আল্লাহ!!মিডিয়া এই খবর জানলে কি যে হবে?

সারাদিন দাড়িয়ে কাজ করে দৃশ্যর পা ব্যাথা ধরে গেছে।একটা সুপারশপে আজ তিনদিন ধরে কাজ করছে সে।এভাবে সারাদিন দাড়িয়ে কাজ করার অভ্যাস নেই তার।তাই তো প্রথম দিন কাজ করেই দুই পা ব্যাথায় ফুলে গেছিলো।সারা রাত সেই ব্যাথায় ঘুমাতে পারেনি।

সেদিন মাহাদ আর অরিনকে এক সাথে দেখে সে সহ্য করতে পারেনি।বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্চিলো।তার মনে হচ্ছিল ওই অফিসে আর এক মুহুর্ত থাকলে সে দম আটকে মারা যাবে।এই মানুষটার মুখোমুখি আর হতে চায়না সে।নিজেকে তো বেশ সামলে নিয়েছিলো।হটাৎ আবার মানুষটা এসে তাকে কেমন এলোমেলো করে দিলো।বুকের যন্ত্রণা টা যেনো দিন দিন বেড়ে যাচ্ছিল।দৃশ্য যেনো আর এই যন্ত্রণা নিতে পারছিলো না।তাই জবটা ছেড়ে দিয়েছে।

আর তাছাড়া দৃশ্য যখন জব খুঁজছিলো তখন এই জবটা সে পেয়ে যায়।কিন্তু এখানে সেলারি অনেক কম।তাই দৃশ্য দ্বিধা দ্বন্দ নিয়ে ছিলো যে জবটা নিবে কিনা?কারণ এই সেলারি পুরোটাই তার পড়াশুনায় চলে যাবে।থাকা খাওয়ার জন্য তাকে দুইটা টিউশনি এক্সট্রা করতে হবে।কিন্তু সেদিন দৃশ্যর আর কিছুই না ভেবে ওই জবটা ছেড়ে এই জবটা নেয়।মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে আর যন্ত্রণা বাড়াতে চায়না।

স্টোর রুমে থেকে বড়ো আর ভারি কয়েকটা প্রোডাক্টের কার্টুন এনে দৃশ্য হাপিয়ে উঠেছে।কপালের ঘাম মুছে পানি খেয়ে নিলো। লাঞ্চ আওয়ার আরো দুই ঘণ্টা আগে শেষ হয়ে গেছে।দৃশ্য কিছুই খায়নি। পেটে রীতিমতো ইদুর দৌড়াচ্ছে।ক্যান্টিনে যেয়ে খাওয়ার কোনো ইচ্ছা তার নেই। হাতে যা টাকা আছে তা দিয়ে তাকে চলতে হবে।আগে সে খিদা একদম সহ্য করতে পারতো না।চিল্লিয়ে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলতো। এবার কোনো দিন তার মন মতো খাবার রান্না না হলে রাগ করে বসে থাকতো।আর ফাহিম ভাই তার ফেভরেট বিরিয়ানি নিয়ে আসত।মাকে আর ভাইয়াকে ভীষণ মনে পড়ছে।মা খাবার প্লেট নিয়ে তার পিছু পিছু ছুটতো।আর সে বিরক্ত হয় ভাইয়ের পিছে লুকিয়ে থাকতো।আজ কেউ নেই আদর করে খাইয়ে দেওয়ার জন্য।

ঢাকায় এসে তার অনেক অভ্যাস ছুটে গেছে।যখন তার কোনো জব ছিলো না।আবার লতা আপুর হটাৎ জব চলে যায় তখন তারা এমন কয়েক বেলা না খেয়ে থেকেছে।তিনজনের অল্প অল্প টাকা মিলিয়ে বাজার করেছে।জিনিয়া চাইলেই বাবার কাছ থেকে বেশি টাকা খরচ নিতে পারতো না।তার বাবা লিমিটেড বেতনের জব করতো।দৃশ্য আর লতার জন্য জিনিয়াও কষ্ট করতো।সেই সময়টায় দৃশ্যর শরীরে সব সয়ে গেছে।দুই মাস পরই লতা আপু আবার জব পেয়ে যায়।আর দৃশ্য আরো টিউশনি তিনটার জায়গায় চারটা নেয়।কিন্তু ড্রিম ফ্যাশন হাউসে জব পাবার পর থেকে সে অনেকটা সচ্ছল ভাবে চলতে পারছিলো।টিউশনি গুলি ছেড়ে দিয়েছিলো।তবে সেই জবটা ও দৃশ্যর ছাড়তে হলো। মাহাদ কে দেখে ক্ষত আরো বেড়ে যাচ্ছিল।

সেদিন ড্রিম ফ্যাশন হাউজের জবটা ছেড়ে আসার সময় মিস লুবনা তাকে এই মাসের সেলারি ফুল দিয়ে দিয়েছে।দৃশ্য পুরো টাকাটাই ভার্সিটিতে জমা দিয়ে দিয়েছে।তার কিছু টাকা ডিউ হয়ে গেছিলো।আবার পরীক্ষার ফি বাকি থাকলে পরীক্ষায় বসতে দিবে না।তাই দৃশ্য সব শোধ করে দিয়েছে। এখন হাতে তেমন টাকা নেই। যা আছে তা দুইটা টিউশন না পাওয়া অব্দি কোনো মতে চলতে হবে।

লতা আপু আর জিনিয়াকে সে আর বিরক্ত করতে চায়না।তারা তাকে অনেক হেল্প করেছে।তাদেরও পরীক্ষার জন্য ভার্সিটিতে অনেক গুলি টাকা জমা দিতে হয়েছে।তাই নিজের সমস্যার কথা তাদের আর জানাতে চায় না।

তার সুপারভাইজার টা ভীষণ স্ট্রিক।একটু ঝামেলা হলেই বকা ঝকা শুরু করে।দৃশ্যকে প্রায় প্রতিদিনই বকা খেতে হয়েছে।আসলে এতো হার্ড কাজ করে তার অভ্যাস নেই।তাই তার কাজও স্লো।যার ফলে বকা শুনতে হয়।

কিছুক্ষণ আগেই কয়েকজন কাস্টমার বেশ কয়েকটা প্রোডাক্ট দেখে এলোমেলো করে রেখে গেছে।দৃশ্য খেয়াল করেনি। সুপারভাইজার এ নিয়েও দৃশ্যকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিল।দৃশ্য মলিন মুখে সব গুছাতে লাগলো।পাশে কেউ দাড়িয়েছে বুঝতে পেরে দৃশ্য পেছন ফিরে বলতে লাগলো

-“হাউ ক্যান আই হেল্প….

আর বলতে পারলো না।তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অতি পরিচিত মানুষ।কালো জ্যাকেট মাথায় হুডি তোলা।মুখে মাস্ক।ধূসর চোখ জোড়ায় রক্তিম আভা।মানুষটাকে চিনতে তার একমিনিট ও লাগলো না।দৃশ্য ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো।এই পাগল তার কাজের জায়গায় সিনক্রিয়েট করবে নাতো?তার মনে হলো সেই আগের রাগী মাহাদ কে দেখছে,যে সামান্য কল রিসিভ না করলে ঢাকা থেকে রাজশাহী যেয়ে দৃশ্যকে শাসিয়ে আসতো।দৃশ্যর বুক ধরফর করছে।এই মানুষটাকে সে এখানে মোটেও আসা করেনি। মাহাদ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো

-“দশ মিনিটের মধ্যে বাইরে আসবে।আমি ওয়েড করছি।”

দৃশ্য অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো। মাহাদ ঠান্ডা ভাবে তাকে থ্রেট দিচ্ছে?দৃশ্যর জবাবের জন্য আর ওয়েট করলো না। মাহাদ চলে গেলো।

দৃশ্য বের হলো ঠিক চল্লিশ মিনিট পর।সে তার ডিউটি শেষ করে তবেই এসেছে।দৃশ্য ড্রেস চেঞ্জ করে শপ থেকে বের হয়।রাস্তার পাশে আসতেই চমকে যায়।রাস্তার সাইডে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাহাদ।এতখন মাহাদ এখানেই ছিলো?সে তো ভেবেছে চলে গেছে।

দৃশ্য বেরুতেই মাহাদ দৃশ্যর হাত ধরে হাটতে লাগলো।দৃশ্য অস্থির হয়ে বললো

-“আরে হাত ছাড়ুন?এসব কি ধরনের অসভ্যতা?রাস্তার মাঝে হাত ধরে টানছে কেনো?”

মাহাদ চোখ গরম করে পেছন ফিরে বললো
-“চুপ আর একটা কথাও না।”

-“অসভ্য বাঁদর।হাত ছাড়ো বলছি।আমি কোথাও যাবো না।”

মাহাদ আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না।সোজা দৃশ্যকে নিয়ে গাড়ির পেছনে টেনে উঠালো।নিজেও দৃশ্যর পাশে বসলো।দৃশ্য ছোটাছুটি করতে লাগলে মাহাদ তার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো।দৃশ্য খেয়াল করলো ড্রাইভিং সিটে রবিন বসে আছে।আর তাদের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।মুহূর্তেই দৃশ্যর নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেলো।রবিন যদি কিছু বুঝতে পাড়ে সেই ভয়ে।

আর রবিন হা করে তাকিয়ে ভাবছে
-“স্যার বললো দৃশ্য তার বউ।তাহলে কি স্যার নিজের বউকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে নাকি? ও আল্লাহ স্যারের মাথা গেলো নাকি?”

মাহাদ তাকে গাড়ি স্টার্ট দিতে বললো।বেশ কিছুক্ষন পর একটা নির্জন জায়গাতে গাড়ি থামাতে বললো মাহাদ।রবিনকে বললো

-“পাশের চায়ের দোকানে ভালো চা পাওয়া যায়।খেয়ে দেখতে পারো।”

রবিন বুজলো মাহাদ সিস্টেমে তাকে সরাতে চাচ্ছে।তাই সে বেরিয়ে গেলো চা পান করতে।দৃশ্য চুপ চাপ বাইরে তাকিয়ে আছে। মাহাদ গম্ভীর স্বরে বললো

-“জবটা ছাড়লে কেনো?আর এই সুপার শপে কেনো জয়েন করেছো?”

দৃশ্য মাহাদের দিকে ফিরে কপট রেগে বললো
-” ওই জবটা ভালো লাগছিলো না তাই।আপনি আমাকে এখানে কেনো এনেছেন?”

মাহাদ স্বাভাবিক ভাবে বললো
-“আমার উপর কি তোমার একটুও বিশ্বাস নেই?জেদ করে জবটা কেনো ছাড়লে?”

দৃশ্যর ভীষণ রাগ হলো
-“আপনি এমন কেউ না যাকে বিশ্বাস বা অবিশ্বাস করতে হবে। ইউ আর নাথিং ফর মী।”

মাহাদের চোখের কোণা ভিজে আসলো।দৃশ্যর চিবুকে হাত রেখে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো
-“সত্যি আমি কিছুই না তোমার জন্য?”

-“…….

-“এই জবটা ছেড়ে দাও।কোনো দরকার নেই এখানে জব করার।”

-“আমি জব কেনো ছাড়বো?আর জব আমি কিছুতেই ছাড়ছি না।আর আমার পেছনে কেনো পড়ে আছো?স্টপ ফলোয়িং মি।”

-“তুমি আমাকে ভুল বুঝছো পিচ্ছি।অরিন কে নিয়ে ভুল ভাবছো।”

দৃশ্য একটা ঢোক গিলে বললো
-“আমি কিছুই ভাবছিনা। সন্ধ্যে হয়ে আসছে বাসায় যাবো।”

মাহাদ দৃশ্যর কপালে চুমু একে দিয়ে বললো
-“আই মিস ইউ বউ।”

দৃশ্য ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকে রাখলো।নিজেকে সামলে মাহাদকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে কাপা গলায় বললো

-“আমি করো বউ না।আর আমার পিছু নেওয়া বন্ধ করো।তোমার স্ট্যাটাসের সাথে এসব যায় না।মিডিয়া যদি জানে তুমি একটা সুপারশপে কর্মীর পিছনে পরে আছো তবে তোমার মান সম্মান ধূলায় মিশে যাবে।তাছাড়া আমার রক্ত দূষিত।তাই যত দূরে থাকবে ততো ভালো থাকবে।”

কথাটা বলেই দৃশ্য বেরিয়ে আসতে নিলে । মাহাদ দৃশ্যকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো।মুহূর্তেই দৃশ্য বরফের মতো জমে গেলো। মাহাদ শক্ত করে তার বুকের সাথে দৃশ্যের পিঠ ঠেকিয়ে রাখলো।দৃশ্যর ঘাড়ে গভীর ভাবে একটা চুমু খেলো।দৃশ্যর সারা শরীর হালকা কেপে উঠলো।মাতাল করা অনুভূতি।দৃশ্য চোখ বুঁজে রাখলো। মাহাদ ফিসফিসিয়ে বললো

-“তোমার রক্ত কোনোদিন দূষিত হতে পারে না পিচ্ছি।এই নিষ্পাপ শরীরে দূষিত রক্ত কেনো থাকবে?আমার দেখা সবচেয়ে পবিত্র আর স্নিগ্ধ তুমি।তোমার রক্তের সাথে মিশে এই দুনিয়ায় আসবে আমার ভালোবাসার চিহ্ন। তাহলে সেই রক্ত কি করে দূষিত হবে?”

দৃশ্য যেনো নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেলো।সে দ্রুত মাহাদকে ছাড়িয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে বললো

-“আমি তোমার জীবনে অভিশাপ মাহাদ।তাই প্লিজ দূরে থাকো।নাহলে জীবনের সব হারিয়ে ফেলবে।”

রবিন চায়ে শেষ চুমুক দিতে দিতে দেখলো দৃশ্য কাদতে কাদতে চলে যাচ্ছে।রবিন ঘটনা কিছুই বুজলো না। স্যার কি আবার দৃশ্যর সাথে কোনো খারাপ আচরণ করলো?রবিন গাড়ির সামনে এসে দেখলো মাহাদ মাথা নিচু করে বসে আছে।খেয়াল করতেই বুঝতে পারলো তার চোখ থেকে অশ্রু ঝরছে। রবিনের বেশ খারাপ লাগলো।জেদী,গম্ভীর মাহাদ আজ কাদঁছে?কিন্তু কেনো?আর তারা দুজন এমন আলাদাই বা কেনো থাকে?রবিনের মাথায় কিছুই ঢুকলো না।সে চুপচাপ গাড়ি স্টার্ট দিলো।

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_48

আখি রহমান গভীর চিন্তায় মগ্ন।সেদিন ছেলের জন্য তার প্রিয় মাংস আর ভুনা খিচুড়ি রান্না করে বসে ছিলেন।কিন্তু ছেলে আর বাসায় ফেরেনি।মনে মনে কষ্ট পেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলেন।ছেলে তার কোনো সাধারণ মানুষ না। বিখ্যাত গায়ক সে। ব্যাস্ত থাকাটাই স্বাভাবিক।তিনি রবিনকে কল করে জেনে নিলেন মাহাদ কোথায়।

শামসুন্নাহার বেগম লিভিং রুমে আসতেই রান্নাঘরের দিকে চোখ পড়লো।আখি রহমান কোমরে কাপড় গুজে মনোযোগ দিয়ে রান্না করছে।আজ হঠাৎ ছেলের কথা ভীষণ মনে পড়ে গেলো।ছেলেকে বিয়ে দেওয়ার পর তিনি ছেলে আর ছেলের বউকে দেখে ভীষণ শান্তি পেতেন।আখি যখন রান্না করতো তখন তার ছেলেও চুপি চুপি এসে কতো খুনসুটিতে লিপ্ত হতো।মাঝে মাঝে তার সামনে ধরা পড়লে দুইজনই বেশ লজ্জা পেতো।আখিকে সবসময়ই চোখে হারাতো ছেলেটা।এতো অল্প বয়সেই মেয়েটা স্বামী হারা হয়ে গেলো।কতই বা বয়স হয়েছিলো?শামসুন্নাহার বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে আখি রহমানের দিকে এগিয়ে গেলেন।আর বললেন

-“কি করো বউ?”

আখি রহমান মুচকি হেসে বললেন
-“আম্মা মাহাদের জন্য মাংস আর ভুনা খিচুড়ি রান্না করছি।”

-“ঐদিন ও না রানলা।তোমার পোলায় তো বাইত আইলো না।আইজ আবার কষ্ট করতাছো কেন?”

-“আম্মা ছেলে ব্যাস্ততার জন্য না আসতে পারলে কি হয়েছে? আমি যাবো ছেলের কাছে।”

শামসুন্নাহার বেগম বেশ অবাক হলেন।পরমুহুর্তেই তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল।আখির ছেলের প্রতি জমা অভিমান ধীরে ধীরে ভাঙতে শুরু করেছে।বুকটা তার প্রশান্তিতে ভরে গেলো।তার পরিবারটা আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠবে।আবার যেনো করো নজর না পড়ে এই পরিবারে। ওই মেয়েকে তো তিনি আর কিছুতেই তার পরিবারের সুখ নষ্ট করতে দিবে না।কিছুতেই না।

চা বাগানের পাশেই অবস্থিত রিসোর্টে করিডোরের টেবিলে বসে কফি খাচ্ছে মাহিম, রণিত,সিয়াম আর আরিফিন।আজ তারা আশেপাশের চা বাগান গুলি ঘুরে দেখবে। মনোমুগ্ধ পরিবেশে বসে কফিতে চুমুক দেওয়ার মজাই আলাদা।বর্ষা আর পূজা বিগত দুই ঘন্টা ধরে রেডি হচ্ছে।অপেক্ষা করতে করতে বিরক্ত হয়ে তারা কফি অর্ডার করেছে।আরিফিন বিরক্ত হয়ে বললো

-“ঠিক এই কারণেই আমি বিয়ে করবো না।মেয়ে মানুষদের কমনসেন্স অনেক কম।ঘুরতে এসে এরা যদি রেডি হতেই সময় শেষ করে দেয় তাইলে ঘুরতে যাবে কখন?”

রণিত বললো
-“আরে শালা মেয়ের পাল্লায় পড়লে সব সয়ে যাবে।কোথাও বের হলে পূজা ম্যাডাম আমাকে কমপক্ষে দুই ঘণ্টা রাস্তায় অপেক্ষা করাবে।”

সিয়াম হেসে বললো
-“বর্ষা তো এতো সময় নেয় না।ওই বান্দর তো তেমন সাজেও না।একটা প্যান্ট আর টপস পরেই বেরিয়ে যায়।এই পূজার পাল্লায় পড়ে বর্সাও শেষ।”

মাহিম গম্ভীর সুরে বলে
-“আরে বর্ষার মধ্যে তো মেয়েদের মতো কোনো আচরণই আমি দেখি না।দাদী ওকে দেখলে বলবে
-“কীরে এই বেডা মাইয়া কৈ থেকে ধইরা আনসোস?দুনিয়াতে আর মাইয়া ছিলো না?”

সিয়াম হো হো করে হেসে বললো
-“তোর দাদীকে আমার সেই পছন্দ।তার বয়সটা একটু কম হলে বিয়ে করে নিতাম।”

-“আমার দাদী তোর জীবন তেজপাতা করে দিতো।”

তাদের কথার মাঝেই বর্ষা আর পূজা সেখানে উপস্থিত হলো। রনিত হা করে দুইজনকে দেখছে।মাহিম মাত্রই কফিতে চুমুক দিয়েছিলো।বর্ষার দিকে চোখ পড়তেই গরম কফিতে তার ঠোঁট পুড়ে গেলো।সে দ্রুত কফি মগ টেবিলে রেখে আবার বর্ষার দিকে চেয়ে রইলো।সে যেনো চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে।তার সামনে একটা হুর পরই দাড়িয়ে।কালো জর্জেট শাড়ীটা বর্ষার উজ্জ্বল আর মেদহীন শরীরের সৌন্দর্য যেনো কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখের মোটা কাজল যেনো মাহিমের ছোট হৃদয়কে বার বার কাপিয়ে তুলছে।
এতো বছরে আজ প্রথম সে বর্ষাকে শাড়িতে দেখলো।এই মেয়েটা শাড়ি পরলে কেমন লাগতে পারে সেটা মাহিম ভাবতেও পারতো না।শাড়িতে এতো সুন্দর লাগবে জানলে প্রতিদিন শাড়ি পরিয়ে বসিয়ে রাখতো।সবসময় ছেলেদের বেশে ঘুরে বেড়ায় মেয়েটা।আসলে মায়ের ছায়া ছাড়া বাবার অতি আদরে বড়ো হওয়া বর্ষাকে মেয়েলি ভাবে চলা কেউ শেখায়নি।আজ পূজার জোরাজুরিতে শাড়ি পরে সেজেছে।মাহিম নেশা ভরা দৃষ্টিতে বর্ষাকে দেখে যাচ্ছে।

আরিফিন একবার বর্ষার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।নিষিদ্ধ জিনিসে বেশি তাকানো ঠিক না।মনের ক্ষতটা আর বাড়িয়ে লাভ নেই।বর্ষা একান্ত মাহিমের।নিজেকে শক্ত করে আরিফিন ফোনের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো।কিন্তু বেহায়া মন বার বার বর্ষার দিকে তাকাতে চাইছে।সে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করলো।
সিয়াম হা করে তাকিয়ে বললো

-“ওই পূজা আমিকি সত্যি দেখতেসি?এটা আমাদের বর্ষা?ওই বর্ষা তোরে এমন সন্দুরী মাইয়া কে বানাইলো?”

বর্ষা লাজুক হেসে বললো
-“আমি জন্মগত ভাবেই সুন্দরী।তোদেরই চোখে পড়েনি।”

-“ওই পূজা এইটা তোর কাজ তাইনা?এক কাজ করবি?আমাদের ক্লাসের চশমিশ তানি মেয়েটাকে এমন আইটেম বানায় দিতে পারবি?তাইলে ঐ বলদির লগে রিলেশনে চলে যেতাম। গফ যতো বোকা হবে ততই ভালো।”

পূজা বললো
-“ধুর!সবাই কি আমাদের বর্ষার মতো সুন্দরী নাকি?”

বর্ষার আড়চোখে তাকায় মাহিমের দিকে।মাহিম হেবলার মতো তাকে দেখে যাচ্ছে।বর্ষা মুচকি হাসলো। যাক মাহিমকে বেশ চমকে দিতে পেরেছে।এই ছেলে এবার যদি একটু রোমান্টিক হয়?

আখি রহমান ধানমন্ডির ফ্ল্যাটের লক খুলে ভেতরে প্রবেশ করলেন। মাহাদের রুমে ঢুকে দেখলেন ছেলে উপুর হয়ে শুয়ে আছে।পাশের ছোট টেবিলের এস্ট্রে ভর্তি সিগারেটের ছোট অংশ পড়ে আছে।রুমে এখনো সিগারেটের ভেপসা গন্ধ।আখি রহমান পাশের জানালা খুলে দিলেন। ছেলের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে রবিনকে বললেন

-“তোমার স্যারকে এখনই ডেকে তোলো।”

রবিন দ্রুত মাহাদকে ডেকে দিলো। মাহাদ মায়ের কথা শুনে দ্রুত সোফার রুমে দৌড়ে আসলো।দেখলো তার মা ডাইনিং টেবিলে প্লেটে খাবার বাড়ছে। মাহাদ মায়ের পাশে এসে বললো

-“মা তুমি হটাৎ এখানে?তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”

কথাটা বলেই মায়ের কপালে হাত রাখলো।আখি রহমান রবিনকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“রবিন আমি ঠিক আছি।কেউ আমার হাতের রান্না মাংস খেতে চেয়েছিলো।সেদিন রান্না করে ফেলে দিতে হয়েছে।আজ ও যেনো এইগুলা নষ্ট না হয়।”

বলেই তিনি সোফায় বসে টিভি ছেড়ে দিলেন। মাহাদ বোকার মতো কয়েক সেকেড তাকিয়ে রইলো।পড়ে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ঠোঁটের কোণে হাসি এনে জলদি খেতে বসে গেলো।কতো দিন পর পছন্দের খাবার খাবে।ডায়েট এর জন্য কিছুই খেতে পারেনা।

রবিন একবার খেতে মানা করতে চাইলো।কিন্তু পরে মাহাদের তৃপ্তি ভরে খাওয়া দেখে মানা করলো না।আখি রহমান আড়চোখে দেখলো ছেলে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে।তার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।খাওয়া শেষ হলে মাহাদ মায়ের পাশে বসে মায়ের কাধে মাথা রাখলো।মায়ের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো

-“রান্নাটা দারুন হয়েছে মা।আমার তো তোমার আঙুল চেটে খেতে মন চাইছে।”

বলেই মায়ের হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেলো।আখি রহমান কিছুই বললেন না।কয়েকমিনিট সে ভাবেই বসে থেকে উঠে দাড়িয়ে রবিনকে গাড়ি বের করতে বললেন। মাহাদ নরম সুরে বললো

-“বাসায় আসিনি বলে রাগ করেছো মা?আসলে ব্যাস্ত ছিলাম।আর একা কিছুদিন থাকতে চেয়েছি তাই।নিজেকে ভীষণ এলোমেলো লাগছে।একটু সামলে নেই তার পর আসবো?আর মাহিম আজই চলে আসবে।তুমি চিন্তা করো না।”

আখি রহমান কিছুই বললেন না। মাহাদ মুচকি হেসে বললো
-“তোমার ছোট ছেলে কি করেছে জানো?”

আখি রহমান প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন।
-“একটা মিষ্টি মেয়ে পটিয়ে ফেলেছে।অথচ আমাদের কাউকে জানায়নি পর্যন্ত।ভেবেছে আমি জানবো না। এবার আসলে ওর খবর আছে। দাড়াও মেয়েটার পিক দেখাই।”

মাহাদ তার ফোনটা মায়ের সামনে ধরলো।আখি রহমান দেখলেন ব্ল্যাক জিন্স আর টপস পরা হাস্য উজ্জ্বল একটা মিষ্টি মেয়ে মাহিমের কাঁধে মাথা রেখে হাসছে। মাহিমের চেহারায় তৃপ্তির হাসি। আখি রহমান মুচকি হাসলেন। এই মেয়েটাকে তিনি আগেও দেখেছেন। মাহিম তখন তাকে ফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিয়েছিল। আখি রহমানের কেন যেন একটু সন্দেহ হয়েছিল। প্রায় সময়ই মাহিমের ছেলে ফ্রেন্ড বাসায় এসে হাজির হয়। একদিন এই মেয়েটাও বাসায় এসেছিল। ভারী মিষ্টি আর মিশুক মেয়েটা। মনে মনে বেশ স্বস্তি পেলেন আখি রহমান। মেয়েটাকে তার আগে থেকেই মাহিমের জন্য বেশ পছন্দ হয়েছিল। আর ছেলের চোখে ও মেয়েটার জন্য কিছু একটা তিনি দেখেছিলেন। যাই হোক মায়ের চোখে ছেলে কিছুতেই ফাঁকি দিতে পারেনি তার সন্দেহ টাই সঠিক।
মাহাদ হেসে বললো

-“মাস্টার্স শেষ করুক তোমার ছেলেকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিব। তখন দেখবে নিজ তাগিদেই ব্যবসার হাল ধরেছে।এখনতো হাজার বললেও একটা দিন যায় না ফ্যাশন হাউসে।”

আখি রহমান মুচকি হাসলেন।তারপর বাসা থেকে বেড়িয়ে আসলেন। গাড়িতে উঠতেই রবিনকে বললেন

-“দৃশ্য কোথায় জব করে জানো?”

রবিন বেশ চমকে গেলো।সে তো ভেবেছিলো দৃশ্য আর স্যার হয়তো কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করেছে।তাই আলাদা থাকছেন।কিন্তু এখন তো দেখা যায় পরিবারের সবাই জানে।

-“জি ম্যাম।”

আজ শপে বেশ ভিড়।দৃশ্য কাস্টমারদের অ্যাটেন্ড করতে বেশ ব্যাস্ত। ভিড় কিছুটা কমলে দৃশ্য আবার স্টোরে চলে গেলো। ফ্রুটস সেকশন অনেকটাই ফাঁকা হয়ে আছে। স্টোর থেকে এনে তা আবার ফিলাপ করতে হবে। দৃশ্য একে একে ফ্রুটস কার্টুন আনতে লাগলো। ভুলবশত হঠাৎ একটা কার্টুন তার হাত থেকে পড়ে গেল। কার্টুনে থাকা আপেল গুলো চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো।দৃশ্য ভয়ে একটা ঢোক গিললো।আজ বকা সেই লেভেলের খাবে।ঠিক তখনই তার সুপারভাইজার হামিদ সেখানে উপস্থিত হলেন। দৃশ্য ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকালো।হামিদ ভীষণ রেগে বললো

-“এই মেয়ে তোমার সমস্যা কি?কাজ জানোনা তাহলে কাজ করতে আসো কেনো?রাস্তা ঘাট থেকে উঠে চলে এসেছে কাজ করতে। এদের বাপ মাই বা কেমন?মেয়ে কাজ জানেনা।কিন্তু ঢাকা শহরে পাঠিয়ে দিয়েছে কাজ করতে।এদের দিয়ে কোন কাজ হয় নাকি?ফালতু যতসব।”

দৃশ্যর চোখ ভিজে উঠলো।মানুষের ব্যাবহার এতো খারাপ কি করে হতে পারে?হামিদ আবার বলে উঠলো

-“এই ফ্যাসফ্যাস বন্ধ করে সব আপেল তুলো।এটা বাপের হোটেল না।কাজ ঠিক মতো না করলে বেতন কেটে রাখবো।এতো ননীর পুতুল হলে কাল থেকে আর কাজ করতে আসার দরকার নেই।”

দৃশ্য হাতের উল্টা পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে আপেল গুলি তুলতে লাগলো।তার বুক ফেটে কান্না আসছে।মায়ের বুকে ঝাপটে পড়ে কাদতে ইচ্ছে করছে।লাস্ট মায়ের সাথে কথা হয়েছিলো অনেক আগে।দৃশ্য ঢাকায় পৌঁছে জিনিয়া আর লতার সাথে বাসায় উঠার পর দিন মাকে একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে কল করেছিলো।সে নিরাপদে আছে এটাই জানিয়েছিলো।মা অনেক কান্না করছিলো সেদিন।তবে বেশি কথা বলতে পারেনি।তার বাবা চলে আসায় কল কেটে দিয়েছিলো।তার পর দৃশ্য ইচ্ছে করে কল করতো না।সেই সময় সে ছিলো ডিপ্রেশনে।মায়ের সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলা সম্ভব ছিলো না।নিজেকে ইচ্ছে করে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়েছে।

দৃশ্য আপেল তুলতে তুলতে একজনের পায়ের সামনে এসে পড়লো।দৃশ্য লাস্ট আপেলটি তুলে সামনের মানুষটিকে মাথা তুলে দেখলো।শাড়ি পরা একজন নারী দাড়িয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।মুখে তার মাস্ক।দৃশ্য মুচকি হেসে বললো

-“হাউ কেন আই হেল্প ইউ ম্যাম?”

আখি রহমান এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে দৃশ্যর দিকে।রবিন তাকে এখানে নামালে সে কিছুটা অবাক হয়।দৃশ্য কি এই জায়গায় কাজ করে?তিনি ভেতরে আসতেই দেখতে পেলো দৃশ্যকে।এতখন দাড়িয়ে তিনি সবটাই দেখলেন।বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আমজাদ রহমানের রকস্টার ছেলের বউয়ের এই অবস্থান দেখে তার ভীষণ কষ্ট হলো।জয়ের কাছে দৃশ্যের ঢাকা আসার কারণ সবটাই তিনি শুনেছেন।মেয়েটা যে তার ছেলের জায়গাটা কাউকে দিতে পারেনি।তাইতো এতো বিলাসিতার জীবন ছেড়ে এই কষ্টের জীবন বেছে নিয়েছে।আদো মেয়েটা এই জীবন ডিজার্ভ করে?

এই বাচ্চা মেয়েটার এখন সেজে গুঁজে তার পুরো বাড়ি মাতিয়ে রাখার কথা ছিলো। অথচ আজ এই বাচ্চা মেয়েটা স্বামীর কোটি কোটি থাকার পরও জীবিকার জন্য এতটা হার্ড ওয়ার্ক করতে হচ্ছে। এই বাচ্চা মেয়েটার কি আদো কোনো দোষ ছিলো?নিজের উপর আজ ভীষণ রাগ হচ্ছে।স্বামীকে হারিয়ে তিনি নিজের কষ্টে এতটাই বিভোর ছিলো যে তার ছেলেটার যন্ত্রণা ক্ষীণ মনে হয়েছে।আর এই বাচ্চা মেয়েটা তার ছেলেকে আজও পাগলের মতো ভালোবেসে যাচ্ছে।এই মেয়েটার মাঝে যে তার ছেলের প্রাণ লুকিয়ে আছে সেটা কি করে ভুলে গেছিলো তিনি?তাদের এই দূরত্বের এক মাত্র কারণ তিনি নিজে।
দৃশ্য আবার বললো

-“ম্যাম কি লাগবে আপনার?”

আখি রহমানের চোখ ভিজে উঠলো।বাচ্চা মেয়েটাকে এখন বেশ বড়ো মনে হচ্ছে।যে এই যান্ত্রিক শহরে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে।তিনি পরম যত্নে দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন

-“কিছু লাগবে না মা।”

দৃশ্যর বুকটা কেপে উঠলো।আজ কতদিন পর করো মুখে এতো আদরের ডাক শুনলো।মনে কেমন প্রশান্তি বয়ে গেলো।যেনো তার মা মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।কে উনি?চোখ জোড়া কেমন পরিচিত মনে হচ্ছে।আখি রহমান আর কিছু না বলে শপ থেকে বেরিয়ে আসলেন।আসার আগে হামিদ কে বলে আসলেন

-“নিজের ব্যাবহার ঠিক করুন।নাহলে কোথাও সম্মান পাবেননা।নেক্সট টাইম এমন ব্যাবহার করতে দেখলে আপনার খবর করে ছাড়বো।আপনার ভাগ্য ভালো আজ আমার ছেলে ছিলো না।নাহলে ওই মেয়েটার সাথে এমন ব্যাবহারের জন্য আপনার সাথে ঠিক কি হতো আমি জিনেও জানিনা।”

হামিদ বিস্ময় নিয়ে আখি রহমানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।সে দেখলো মহিলাটি বেশ দামী গাড়িতে চড়ে চলে গেলো।সে কিছুটা ভয় পেলো।এতো বিত্তশালী মহিলার এই মেয়ের সাথে কি সম্পর্ক?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here