অবাধ্য_প্রেম,পর্ব-০১,০২

0
2821

#অবাধ্য_প্রেম,পর্ব-০১,০২
নন্দিনী নীলা
#সূচনা_পর্ব

ক্যাম্পাসের মাঠে আমাকে কান ধরিয়ে দাঁড় করে রেখেছে সিনিয়র ভাইয়ারা। এটা আমার শাস্তি আর এই শাস্তিটা আমি পেয়েছি ক্যাম্পাসের এক বড় ভাইয়ের শরীরের রং দেওয়ার অপরাধে। আমার একমাত্র শাকচুন্নি বান্ধবীর গায়ে রং দিতে গিয়ে আমি ভুল করে এক সিনিয়র ভাই এর শরীরে রং দিয়ে মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। আর সেই ভুল স্বরূপ আমাকে এখন তাদের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। কি একটা বিচ্ছিরি লজ্জাকর অবস্থা। আমার ক্লাসের পরিচিত-অপরিচিত সব বন্ধু বান্ধবীরা সবাই আমাকে দেখে টিটকারি মারা হাসি হাসছে। কারণ আমি হলাম ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু মেয়েটা যে সবাইকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে ব্যস্ত থাকি সব সময়। আর আজকে আমাকে সিনিয়র ভাইদের সামনে মাথা নত করে থাকতে হচ্ছে এটা দেখে ওরা তো খুবই মজা পাচ্ছে। ওরা আমার ওপর কখনোই শোধ তুলতে পারে নাই সবারই আমার ওপর একটা রাগ আছে। তো সেই রাগটা যেন সিনিয়দের শাস্তির সাথে মিশিয়ে দিচ্ছে। সব রাগ একসাথে খাটাচ্ছে। আমি ওদের দিকে একটু পরপর রাগি চোখে তাকাচ্ছি‌। আর ওরা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে‌। খুব লজ্জা লাগছে ওদের।এবার বিশেষ করে যাকে আমি রং দিয়েছি তার দিকে তাকাচ্ছি ছেলেটা বাইকে শুয়ে আমার দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।

তার হাতে আছে ফোন তিনি আমার দিকে ফোনের ক্যামেরা ধরে আছে। আমি লাফ দিয়ে কান থেকে হাত নামিয়ে চিৎকার করে বলে উঠলাম, ‘ ওই ওই আপনি আমার ভিডিও করছেন কেন?’

লোকটা আমার দিকে শয়তানি হাসি দিয়ে তাকিয়ে বলল, ‘এটাই তো আসল মজা।’

ছেলেটার হাসির দেখে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। এত বড় সাহস আমাকে সার্কাস বানিয়ে আবার ভিডিও করা হচ্ছে। সিনিয়র ছেলেটা তো ভারি শয়তান।

আমি ছুটে গিয়ে উনার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে গাছের দিকে ছুড়ে মারলাম আর সাথে সাথে ফোনটা ভেঙে 3 খন্ড হয়ে নিচে পড়ল। আর উনি এক চিৎকার দিয়ে উঠলো নিজের ফোনের এমন মর্মান্তিক অবস্থা দেখে। সবাই বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে‌। তার চোখটাও বড়বড় হয়ে গেছে। রাগান্বিত চোখে আমার মুখমন্ডলের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। আমার এমন সাহস দেখে তিনি হতভম্ব। আর আমি‌‌ তো মারাত্মক খুশি। খুশি নাচতে মন চাচ্ছে। চাইবে না কেন এতোক্ষণ আমাকে অপমান করার হ্যাঁ একটা শিক্ষা তো দিতে পারলাম।

আমি আফসোস স্বরে ফোনটার দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আহারে বেচারা ফোন। কে জানতো এই ফোনটা আজকে ইন্তিকাল করবে?’

আমার কথা শেষ হতে না হতেই কেউ যেন ঝড়ের গতিতে আমার সামনে এসে আমার বাম গালে থাপ্পড় মেরে বসল। আঘাত এতোটাই তীব্র ছিল যে আমার মাথাটা ঝনঝন করে ওঠে। আমি চোখ বন্ধ করে এক দিকে ঝুকে যায়। বাম হাতটা আপনা আপনি আমার গালি গিয়ে ঠেকে। মনে হয় লোহা দ্বারা আঘাত করা হয়েছে। কারো হাতে ও যে এত শক্ত থাকে আর এত শক্তি থাকে থাপ্পড় টা না খেলে হয়তো আমি বুঝতেই পারতাম না।

পাক্কা 5 মিনিট পর আমি দুনিয়াতে ফিরলাম। থাপ্পড় খেয়ে যে আমি কোন দুনিয়ায় চলে গিয়েছিলাম আল্লাহ তালায় জানে। আমি চোখ পিটপিট করে সামনে তাকাতেই এক মানুষরূপী রাক্ষস কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি‌। একটা সেই রাক্ষস যাকে আমি রঙ দিয়েছিলাম।এবং যার ফোনটা আমি এখন ভেঙে ফেলেছি। এতক্ষণ যাকে শয়তানি হাসি দিতে দেখেছি‌। মুখে ছিলো শয়তানি হাসিতে ভরা। এখন তাকেই আমার শক্তপোক্ত রাগী ব্যক্তি বলে মনে হচ্ছে। তার চোখ দিয়ে যেন রক্ত ঝরছে। লাল টকটকে হয়ে আছে তার চোখ দুটো। ফর্সা মুখটা লাল টকটকে হয়ে আছে। কপালে রগ ফুলে উঠেছে মাই গড কি ভয়ঙ্কর বিচ্ছিরি দেখতে লাগছে।

আমি ঢোক গিললাম আস্তে ধীরে বুঝতে দিলাম না আমি তার এই রূপটাকে ভয় পেয়েছি। বুকে সাহস সঞ্চয় করে যথেষ্ট সাহসিকতার সাথে বললাম, ‘ আপনার সাহস তো কম না আপনি আমাকে থাপ্পড় মারলেন। আমি এখনই প্রিন্সিপালের কাছে বিচার দেবো আপনার নামে। যে আপনি মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করেন।’

এটা শুনেছেন ওড়নাটা টা আরো চড়ে উঠল। উনি ফট করে আমার গাল চেপে ধরে বলল, ‘কি বললে আমি মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি করি? মেয়েদের সাথে আমি একটি অসভ্যতামি করেছি বলো! তোমাকে কি আমি এই ভরা মজলিসে জোর করে কিস করেছে বা..

উনার স্পর্শে আমার গা জিন জিম করে উঠল। আমি নিজে থেকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললাম, ‘আপনি তো ভারি বেয়াদব আর অসভ্য ছেলে! বারবার আমাকে টাচ করছেন কেন? আমি তো ভুল করে আপনার গায়ের রং দিছি তার জন্য আপনি আমাকে সবার সামনে অপমান করে কান ধরে দাঁড় করে রাখলেন। আবার সেটা ভিডিও করছেন। নিজের ভুলগুলো চোখে পড়ছে না। অথচ আমার একটা অনিচ্ছাকৃত ভুল কে আপনি ভুল বলে আমাকে এভাবে হ্যাঁ নাস্তা করছেন?’

‘অসভ্যতামি না করেই যদি অসভ্য হয়। তাহলে অসভ্যতামি করে অসভ্য বেয়াদব হব আমি। আর তুমি নিজেকে কি ভাবো মহারানী ভিক্টোরিয়া তোমার ভিডিও আমি করতে যাব কেন? আমি তখন ভিডিও কলে কথা বলছিলাম। তুমি সেটা কে ভুল বুঝেছ তাই আমি তোমাকে ক্ষেপানোর জন্যে ওইটা জাস্ট বলেছি‌। তুমি সত্যতা যাচাই না করেই কেন আমার ফোনটা ভেঙ্গে ফেললে? দুদিন আগে আমি এই ফোনটা কিনেছি কত টাকা দিয়ে জানো? তুমি আমার এতো টাকার ফোনটা এক নিমিষে শেষ করে দিলে?’

‘বেশ করেছি। আপনি আমাকে ক্ষ্যাপা বেন কেন? এমনিতেই সবার সামনে আমাকে মাথানত করিয়ে হাসির পাত্র বানিয়ে আপনার শান্তি হয় নাই। এখন আবার আমাকে খেপাতে আসছেন বেশ করেছি আমি।’

‘ওকে।’

বলেই উনি আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় আবার টাচ করতে আমি সরে যেতে চাই কিন্তু পারি না। কারণ উনি আমাকে আরেক হাত দিয়ে আমার হাত খামচে ধরে রেখেছে। আম ব্যথা পাচ্ছি । কিন্তু ছাড়াতে পারছিনা। সেই মুহূর্তে উনার দুজন বন্ধু এসে উনাকে টেনে হেঁচড়ে আমার সামনে থেকে নিয়ে যায়। আর উনি চিৎকার করতে থাকে।

উনার এক মেয়ে ফ্রেন্ড এসে আমাকে বলে, ‘ তুমি তো দেখছি খুব ফাজিল মেয়ে। নিবিড় এর দের লাখ টাকার ফোনটা ভেঙে ফেললে। নিবিড় কি যে করবে আল্লাহ ভালো জানে।’

আমি ভেংচি কেটে বলল, ‘ ওই ফোন এতো দামী। বললেই বিলিভ করবো পাগল তো আমি।’

‘ না করলে নাই। টেক কেয়ার।’

আমি বললাম, ‘আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না আপনার। আপনি আপনার বন্ধুকে সামলান আমার সাথে টক্কর নিতে আসলে এইভাবে নাকানিচোবানি খাবে। যত্তসব।’

মেয়েটা আমার কথা শুনে আর দাঁড়ালো না চলে গেল। এতক্ষণ আমার ক্লাসের যারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছিল এবার তারা দৌড়ে পালিয়েছে। কারণ আমি ফোনটা ভেঙে নিজেকে খুবই সাহসী প্রমাণ করে ফেলেছি আরেকবার। ক্লাসের বাইরের কেউ জানেনা আমি কতটা ডেঞ্জারাস মেয়ে। কিন্তু ওরা তো খুব ভালোভাবে জানে কারণ ওদেরকে আমি এর আগেও কয়েকবার নাকানিচোবানি খাইয়েছি আজকে আমার এই পরিস্থিতি দেখে ওরা মজা লুটেছি। এর জন্য আমি ওদের জন্য কি কি করব সেই চিন্তাই ওরা ভয়ে পালিয়েছে। আমি হাসতে হাসতে মাঠের ঘাসের ওপর বসে পড়লাম। হাসতে গিয়ে গালে ব্যথা অনুভব করলাম। ইস রাক্ষসটার হাত গন্ডারের শক্ত। এক থাপ্পড়ে আমার গালের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।

আমার দুই মাত্র বেস্টি দীপা আর লিলি।
দীপা এসেই আমার গালে হাত দিয়ে বলল, ‘ইস পাঁচ আঙুলের ছাপ ফুটে উঠেছে।’

আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে বললাম, ‘ সর আমার সামনে থেকে। একদম দরদ দেখাতে আসবি না। তোরা আমার কেমন বেস্টি? আমার বিপদের সময় তোরা তো সেই লুকিয়ে বসেছিলি।’

‘ কে বলেছে লুকিয়ে ছিলাম আমরা তো সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু নিবিড় ভাইয়ের সামনে আমারা কিছু বলার সাহস করতে পারিনি। এমনিতেই সিনিয়র ভাই কিছু বললেও আমরা কিছুই করতে পারতাম না উল্টা ফেসে যেতাম। এর জন্য চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখছিলাম কি হয়? তোর সাথে বাড়াবাড়ি কিছু করার আগে তো তুই একটা বাড়াবাড়ি কাজ করে বসলি। আল্লাহ তাআলা জানে এর জন্য আবার কি বিপদ নেমে আসে তোর উপর।’

‘ তোরা কি আমাকে ভীতু ভাবিস? আজকে যেমন উনার ফোন ভেঙেছি। আবার যখন আসবে আমার সাথে লাগতে সেদিনও আমি…. থাক যখন কারটা তখনই করব। এখন আমার গালটা খুব ব্যথা করছে।’

লিলি বলল, ‘দাঁড়া বরফ নিয়ে আসছে দিলে ব্যথা কমবে। আমি দোকান থেকে একটা আইসক্রিম কিনে আনি।’
বলে লিলি চলে গেলে।

দীপা আমার হাত ধরে বলল, ‘ ছোঁয়া তুই ফোনটা কেন ভাংলি। এর জন্য যদি তোর কোন ক্ষতি চেষ্টা করে।’

‘দীপ তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ও আমাকে কিছু করার চেষ্টা করবে আর আমি কি চুপচাপ বসে আঙুল চুষবি নাকি। সোজা প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে চলে যাব।’

‘প্রিন্সিপাল স্যার নিবিড় ভাইয়াকে কিছু বলবেনা।’

‘ মানে?’

‘মানে এখানে যে এতো কিছু হলো কলেজের একটা স্যার কে ও দেখেছিস এদিকে আসতে?’

‘নাতো আমি ও ভাবছি। এত সবাই ভিড় করে আছে অথচ স্যার ম্যাম রা কেউ আসলো না ব্যাপার কি?’

‘এটাইতো কথা নিবিড় ভাই যেখানে আছে সেখানে যত ঝামেলা হোক না কেন কেউ আসবে না।’

‘হোয়াট কেন?’

‘কারণ এটাই তাদের ক্ষমতা! জোর যার মুল্লুক তার।’

‘ পেঁচানো কথা বাদ দে আমাকে সব ঘটনা খুলে বল।’

লিলি এসে আমার গালে বরফ ডলতে লাগল দীপা আর আমাকে কিছুই বলল না।

ক্লাসে আসতেই সবাই আমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। ওদের কিছু বললাম না মন মেজাজ খারাপ আর তার মধ্যে স্যার চলে এসেছে।
ক্লাস শেষে আমি আর দীপা অটোতে করে বাসায় চলে আসলাম।
গেটের সামনে নামতে একটা বাইক আমাদের সামনে আসে আমি ভাড়া দেওয়ার আগেই রঙ ভর্তি পানি আমার মাথায় ঢেলে দেয়। আমি সহ আমার ব্যাগ টাকা সব ভিজে শেষ আমি এক চিৎকার দিয়ে সামনে তাকাতেই নিবিড়ের দুষ্টু চাহনি দেখতে পায়। আমি নিবিড় এর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকাতেই নিবিড় নিজের কালি মাখানো হাতটা আমার কপাল থেকে সম্পূর্ণ মুখে ঘষে দেয়।

#চলবে…..

( আসসালামু আলাইকুম)

#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_২
#নন্দিনী_নীলা

নিবিড় আমার দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এখন এগজ্যাক্টলি আমার কী রিঅ্যাকশন দেয়া উচিত আমি বুঝতে পারছি না। এতটাই রাগ হচ্ছে এই ভেজা শরীর মনে হয় আমার শরীর গরম হয়ে আসছে। কিন্তু আমি রাগটা প্রকাশ করতে পারছি না। মন চাচ্ছে নিবিড় কে ধরে ইচ্ছামত আছড়ে দিতে। কিন্তু আদৌ কি সেটা আমার কি এই এই দানব টাকে আছড়ানো সম্ভব? নিবিড় দাঁত কেলিয়ে আমাকে চোখ মেরে চলে গেল শো করে। আমি ওইখানে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। দীপা অটোওয়ালা বিশ্মিত নজর দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছে, ‘ ভাই দয়া করে আপনি এখান থেকে যান। ‘

উনিও বিস্ময়ভরা চোখে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। দীপা আমার হাত ধরে বলল,’ তুই ঠিক আছিস ছোঁয়া?’

আমি রাগে ফুঁসছি। গরম চোখে ওর দিকে তাকাতেই ও বললো, ‘ দেখলি তো কি হলো? আজ তোর সাথে আমার আশাটা ভালোই হয়েছে। তাড়াতাড়ি উপরে চল। ওই দেখ রাস্তার লোকজন আমাদের দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে।’

রাগে আমার চোখ দিয়ে জল চলে এসেছে। দীপা আমার চোখে পানি দেখে হাত ধরে টেনে ভেতরে নিতে নিতে বলল, ‘আরে ইয়ার কাঁদছিস কেন? এতো সহজে তো তুই কেঁদে দেওয়ার মেয়ে না। এই কাজটা একদম ঠিক করেনি নিবিড় ভাইয়া। শুধু রঙ মাখানো পানি দিয়েই নয় একদম তোর মুখটা কালো করে দিয়ে গেল। উনি আসলেই খুব বেয়াদব।’

আমি বললাম, ‘ কেন তোর কে আগে ওনাকে খুব ভদ্র মনে হতো? ‘

‘না মানে..

‘দীপা তুই চলে যা বাসায় আজকে আমার মন মেজাজ খারাপ আছে। তোকে যে কারণে বাসায় নিয়ে এসেছিলাম তার কিছু আমি করতে পারবোনা।’

‘আচ্ছা আজকে থাক তাও আমি এখন যাব না। তোর মাথা গরম আছে আমি তোর মাথাটা ঠান্ডা করে যাব।’

‘শোন আমি নিজের মাথা নিজে ঠান্ডা করতে পারি। আমার কাউকে দরকার নাই। তুই থাকলে আমার মাথা গরম হবে তা থেকে। আমাকে একা থাকতে দে। তুই বাসায় চলে যা আমি তোকে ফোন দিবনি।’

এক প্রকার জোর করে দীপাকে পাঠিয়ে দিলাম। সিঁড়ি দিয়ে উঠতেছি তখন আমার পাশের ফ্লাইটের লাভলি আন্টির একমাত্র স্টাইলিশ মেয়ে প্রিয়া আমাকে এমন ভুতের বেশে দেখে ওতো এক চিৎকার দিয়েছে। ওর চিৎকার শুনে মনে হয় আমার কানে তালা ফেটে গেছে। আমি সিঁড়িতে পিছলে পড়তে পড়তে বেঁচেছি।

সিড়ির হাতল ধরে আমি ওর দিকে চেয়ে বললাম,, ‘আরেকবার চিৎকার মারলে কিন্তু একদম জড়িয়ে ধরবে। তখন আমার মতন তোকে ও ভূত দেখা যাবে।’

প্রিয়া ভয় আড়ষ্ট হয়ে গেছিল। কন্ঠটা পরিচিত পেয়ে প্রিয়া ভ্রু কে বলল, ‘এই তুই ছোঁয়া না।’

আমি উত্তর দিলাম না। প্রিয়া এবার রাগী কন্ঠে নাকে ছিটকে বলল, ‘ছিহ কি অবস্থা মুখে কালি দিয়ে। সারা শরীর ভেজা রঙ দিয়ে কেমন দেখাচ্ছে। তোকে দেখে তোমার ঘেন্না পাচ্ছে রে ছোঁয়া। তুই তো এমনি কালো। তারপর এমন কালি মাখিয়েছিস তোকে তো একদম পেতনির মত লাগছে।’

‘ কি বললি আমাকে পেতনির মত লাগছে আয় তোকেও পেত্নী বানিয়ে দেয়।’

বলে আমি ওর দিকে এগুতে লাগলাম। প্রিয়া পেছনে ঘোরে এক দৌড়ে উপরে চলে গেল। আর চেচাতে চেচাতে বলল, ‘কালি বা*চ্চা কালি, রাক্ষসী আমাকে নোংরা করতে আসছিস। মায়ের কাছে এখনই বিচার দেব‌ দাঁড়া। ‘

প্রিয়া চলে গেল। আমি নিজের রুমে এসে তাড়াতাড়ি বাথরুমে ঢুকে মুখে দিকে তাকালাম। সাথে সাথে নিবিড় এর হাত আমার মুখে ঘষে দেওয়ার কথা মনে পরলো। রাগে আমার গা পিত্তি জ্বলে উঠলো। আমি তখন নিবিড় এর হাতটাও টেনে ধরতে পারিনি। এতটাই স্তব্ধ হয়ে গেছিলাম যে আমার মাথায় কাজ করছিল না। পোশাকটার দিকে তাকিয়ে মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল। পোশাকটা মা নিজে পছন্দ করে আমাকে দিয়েছিল নষ্ট হয়ে গেল। সাদা জামার এই রঙ তো কোনদিন উঠানো যাবে না।

জামাটার জন্য অজান্তেই আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো। সাথে ওই নিবিড় এর উপর প্রচন্ড রাগ হলো। একবার সুযোগ পেয়ে নেয়।

পরদিন ভার্সিটিতে আসতেই দেখা হলো নিবিড় এর গ্যাঙ দের সাথে। সবাই জরো হয়ে বসে আছে‌। আমি মাথা উঁচু করে দেখলাম ওরা সবাই আমার ডিপার্টমেন্টের সামনে বসে আছে। ডিপারমেন্ট ঢুকতে গেলে ওদের কাছ দিয়ে আমাকে ক্রস করতে হবে। আমি কটমট চোখে সবার মাঝখানে বসে থাকা অসভ্য নিবিড় এর দিকে তাকালাম। নিবিড় ও সাথে সাথে আমার দিকে তাকালো। আর সাথে সাথে চোখ থেকে কালো সানগ্লাসটা খুলে আমার দিকে দুষ্টু চোখে তাকালো। আমি জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চোখ মারল।

আমি তেরে যেতে লাগলাম নিবিড় দের কাছে। আর তখন‌ই কে জানি ইচ্ছে করে আমাকে ল্যাং মারে আর আমি মুখ থুবরে পড়ে যায়। শুধু পড়ি নি একদম নিবিড় এর উপরে গিয়ে পরেছি। ভরা মাঠে দুজনের‌ই এক বিচ্ছিরি লজ্জাকর অবস্থা তৈরি হলো। আমার মুখ গিয়ে ঠেকেছে নিবিড় এর গলায়। আমি একদম নিবিড় এর কাঁধ ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরেছি ভয় পেয়ে‌। নিবিড় সাথে সাথে আমাকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে চিৎকার করে উঠে দাড়ায়।

‘ হাউ ডেয়ার ইউ। ওয়ারিং অন মাই বডি।’

এতো গুলো মানুষের সামনে একটা ছেলের গায়ের উপর পরে আমার অবস্থা খুব খারাপ। আমি লজ্জায় চুপ করে জামা কাপড় ঠিক করে উঠে দাঁড়ালাম। এই কাজটা কে করল? কে আমাকে এই হনুটার উপর ফালালো।

আমি এখানে বসে থাকা আর দশজনের দিকে তাকালাম আর সাথে সাথে ধরে ফেললাম এই কাজটা কে করেছে। ওই আফিয়াই এ কাজ করেছে। কেমন শয়তানি চাহনী দিয়ে আছে।

দীপা এসেই আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম, ‘ দীপু ওই আফিয়া আপু আমাকে ইচ্ছে করে ল্যাং মেরে নিবিড় এর উপর ফেলেছে। এখন এই আফিয়া কি করতে মন চায় বল তো‌।’

দীপা বলল, ‘চল এখান থেকে। কাউকে কিছু বলার দরকার নাই। আর বললেও তুই এতো জনের সাথে পারবি না।’

‘ কালকে থেকে অনেক সহ্য করেছি আর না। আমি তো বল‌ব‌ই।’

বলেই দীপার হাত জোর করে ছাড়িয়ে আমি আফিয়া মেয়েটার সামনে যাচ্ছিলাম। তখন নিবিড় আমার সামনে এসে দাড়িয়ে বলে, ‘ সুন্দর, হ্যান্ডসাম ছেলে দেখলেই গায়ে পড়তে মন চায় তাই না? নিশ্চয়ই জেনে গেছে আমার ক্ষমতার কথা। এজন আজকে আমার গায়ের উপর পরে পরলে তাইনা নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে। কালকে আমার দের লাখ টাকার ফোন ভেঙেছো। এখন সেই টাকা ফেরত দাও। না হলে আমি কিন্তু তোমাকে এই কলেজ থেকে বের করে দেবো। মাইন্ড ইট।’আঙ্গুল উঠিয়ে শাসিয়ে বললো কথাটা নিবিড়।

আমি বললাম, ‘নিজেকে আপনি খুব সুন্দর হ্যান্ডসাম ভাবেন তাই না। কিন্তু আপনি কিন্তু মোটেও সুন্দর না। ফার্মের মোরগের মত শুধু ধলা।’

‘ইউ তুমি আমাকে ফার্মের মোরগ বললা? ইউ হ্যাভ সার্চ এ বিগ চ্যালেঞ্জ!’ রাগান্বিত স্বরে বলল।

আমি বললাম, ‘ যেটা সত্যি আমি সেটাই বললাম। আর শুনেন আমার আপনার গায়ে পড়ার এত সব জায়গা নাই। আমি এবার ও ইচ্ছে করে আপনার গায়ের উপর পরি নাই। এইটা আপনার ফ্রেন্ড সার্কেলের লোক করেছে। তারা আমাকে ইচ্ছে করে ল্যাং মেরেছে আর আমি তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেছি।’

নিবিড় আমার কথা শুনে হাহাহা করে হেসে উঠলো। আর বলল, ‘তুমি আমাকে মিথ্যা একটা এক্সকিউজ দেবে আর আমি বিলিভ করি নেব? ওরা কেউ এমন করবে না। তুমি ইচ্ছে করে পরে। এখন ওদের ফাঁসানোর ট্রাই করছ। আর ওরা এমন কিছু করার কথা ভাবলে আমাকে অবশ্যই জানিয়ে নিতো। আমাকে না জানি ওরা কিছুই করেনা।’

‘ও আচ্ছা তারমানে এই ফালানোর বুদ্ধিটা আপনারই ছিল। বন্ধুদের সাথে এই প্ল্যান করে এখন আমাকে বলছেন আমি নির্লজ্জ মেয়ে সুন্দর ছেলেদের গায়ে পড়ার জন্য সব করছি তাই না। আপনি তো আমার ভাবনা থেকেও খারাপ দেখছি। নিজে প্লান করে এসব করে এখন আমাকে নির্লজ্জ বেহায়া বলছেন। আসলে লুচু মার্কা ছেলে আপনি। আপনার তো চরিত্রে দোষ আছে বড়লোক বাবার বখাটে ছেলে যাকে বলে। নিজের ক্ষমতার অপব্যবহার করে আপনি ভার্সিটি সবাইকে নিজের হাতের মুঠোয় করে রেখেছেন আবার বড় বড় কথা বলতে আসেন। আপ….

আমি কথা শেষ করতে পারলাম না। নিবিড় আমার দিকে রক্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নিবিড় আমার এক হাত খামচে ধরল। এমন ভাবে ধরেছে মনে হলো লোকটার হাতে ছিল বড় বড় নখ আর সবগুলো নখ আমার হাতে বিঁধে গেছে।

আমি রেগে চিৎকার করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। হাত তো ছাড়লোই না উল্টা নিবিড় আমার হাত আরো শক্ত করে ধরে আমাকে টেনে হেঁচড়ে কোথায় যেন নিয়ে যেতে লাগল। পেছন থেকে ওর বন্ধুরা জিজ্ঞেস করছিল কোথায় যাচ্ছে
ও সবাইকে শুধু বলেছে কেউ যেন আমাদের পেছনে না আসে। আমি আরেক হাত দিয়ে নিবিড়ের হাত চিমটি মেরে বলছি, ‘ আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন? ছাড়ুন আমাকে। আপনি আসলেই একটা অসভ্য, ও লুচু মার্কা ছেলে। মেয়েদের সাথে কেমন বিহেভ করতে হয় জানেন না।’

নিবিড় আমাকে বাংলা বিভাগের পুরাতন বিল্ডিং এর যে রুমটা ছিল আগে। এখন এই রুমটায় ক্লাস করানো হয় না। নতুন বিল্ডিং এর ক্লাস করানো হয়। সেই নোংরা রুমে নিয়ে এসে আমাকে ভেতরে ছুড়ে মারল।

আর নিজে দরজা আটকে দিয়ে বলল, ‘কি বলছিলে আমার চরিত্রের দোষ আছে? আমি লুচু মার্কা ছেলে? আমি অসভ্য? ওকে এত কিছু যেহেতু নামের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে কিছু না করেই। তাহলে সবকিছু নিজের নামের সাথে চালানোর জন্য আমাকে কিছু করতে হবে। কিছু করেই না হয় এসব উপাধি নেব।’

ভয়ে আমি আঁটসাঁট হয়ে যাচ্ছি। সারা শরীর আমারে ঘেমে একাকার অবস্থা। আমার হাঁটু থরথরিয়ে কাঁপছে আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। এই মুহূর্তে আমার সমস্ত সাহস শক্তি কোথায় হাওয়া হয়ে একদম ভীত হয়ে গেছি নিজেও বুঝতে পারছি না। আমি নিজের কাঁপা হাত উঠিয়ে কপালের ঘাম মুছে নিলাম। তারপর ভয়ার্ত কন্ঠে বললাম, ‘ আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এলেন কেন? আপনি কি করতে চাইছেন?’

#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here