#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৪২,৪৩
#নন্দিনী_নীলা
৪২
নিবিড়ের দের বাসা থেকে চলে এসেছি এক মাস হলো। বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ করে আমি বিকেল বেলা বাসা ছেড়ে বেরিয়ে আসি। সেই সময়টাতে নিবিড় বাসায় ছিল না। রাফসান কাকা আর তাহমিনা আপু আমার সিদ্ধান্ত শুনে খুবই নারাজ হয়। অনেক কিছু বুঝায় থাকার কথা বলে কিন্তু আমি রাফসান কাকাকে একটা কথাই বলি , ‘আমি কিন্তু এই বাসায় আসার পরে আপনাকে বলছি আপনি একটা বাসা খুঁজে দিবেন। না হলে আমি বাসা খোঁজে পেলে এখানে আর থাকতে পারবো না। এখন আপনি আমাকে বাধা দিতে পারেন না।’
আমার কথার প্রেক্ষিতে আর তিনি উত্তর দিতে পারে না কিন্তু তাহমিনা আপু বলতে লাগে, ‘আমি বাসায় আসলাম কোথায় ভাবলাম তুই আছিস। এখন তুই আমাকে ছেড়ে চলে যাবি। এখানে তো ভাড়া দিয়ে থাকছিস তাহলে এখানে থাকতে সমস্যা কি?’
আমি বললাম, ‘আপু ছাদে আমার একা থাকতে ভয় করে। আর ওই ছোট রুমে আমার হয়না।’
‘নিচে না হয়…
আপুর কথা থামিয়ে দিয়ে কোথা থেকে নিবিড়ের ছোট চাচী চলে আসে। আমি চলে যাব শুনে সেতো মহা খুশিতে বলতে লাগে, ‘আপদ তাহলে বিদায় হচ্ছে। বড় আপা শুনলে খুব খুশি হবে।’ বলেই নিবিড়ের মাকে ডাকতে লাগে তিনিও খুব খুশি আমার যাওয়ার খবরটা শুনে। এসব দেখে তাহমিনা আপু মুখটা মলিন করে ফেলে। তিনি বুঝতে পারে আমার এখানে না থাকার কারণটা। তিনি আর আমার সিদ্ধান্তের উপর আপত্তি জানায় না। আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ সাবধানে থাকিস।’
লিহান রা সেই রাত থেকে যাবে আমার এভাবে যাওয়া দেখে বলল, ‘ তুমি কোথায় বাসায় নিছো?
আমি লিলিদের বাসার ঠিকানা দিলাম।
লিহান বাসার ঠিকানা পেয়ে চমকে বলল,’আমার বাসায় ওখানে থেকে পাঁচ মিনিটের ব্যবধান। আচ্ছা যাও, দেখা হবে।’
আবির বেরিয়ে বাইরে এসে বলল, ‘ভাইয়া কিন্তু এসে সব জানতে পারলে খুব রাগ করবে। ভাইয়াকে না জানিয়ে তুমি চলে যাবে।’
আমি রাগান্বিত স্বরে বললাম, ‘তোমার ভাইকে আমি জানাতে যাব কেন? আর তার রাগের ধার ধারি নাকি আমি। আমার যা খুশি তাই করব।’
আবির বলল, ‘তুমি কি আমার উপর খুব বেশি রেগে আছো ভাবি?’
‘ আর একবার ভাবি বললে থাপ্পড় খাবে আমার হাতে ।’
আবির বলল, ‘ ভাবিকে কি চাচি বলব?’
আমি কটমট চোখে আবিরের দিকে তাকালাম।
দরজার ধুপধাপ শব্দে আমি ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলাম। ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাচ্ছে দরজায়। আমি তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলতেই লিলি আমাকে ধাক্কা দিয়ে দরজা থেকে সরিয়ে হুরমুর করে রুমের ভেতরে ঢুকলো।
লিলি নিচে আমার পাতা বিছানায় বসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ‘সর্বনাশ হয়ে গেছে ছোঁয়া।এবার আমার কি হবে?
আমি দরজা আটকে বললাম, ‘ কি হয়েছে? আর একটু হলে তো দরজা ভেঙে যেত!’
লিলি আমার মুখের দিকে অসহায় মুখে তাকিয়ে বলল,’আজকে আমার এংগেজমেন্ট হবে।’
আমি চমকে উঠে বললাম, ‘কি সত্যি? বিয়ে কবে ঠিক হলো! আমাকে তো কিছুই বলিস নি। এখন এনগেজমেন্ট তখন আসছিস বলতে। তুই তো দেখি দীপার থেকেও শয়তান।দুটোতেই আমাকে এইভাবে ঠকালি?’
‘ধুর আমি নিজেই তো জানি না তোকে কিভাবে জানাবো? আমি মাত্র শুনলাম আম্মা আমাকে এসে বলল একটু ফেসিয়াল করার জন্য। বিকেলে নাকি পাত্র পক্ষরা আসবে একেবারে রিং পরিয়ে যাবে।’
‘আমাকে আবার মিথ্যা গল্প শোনাচ্ছিস না তো!’
‘তোর কি আমাকে এইরকম মনে হয়। আমি ছেলেকে দেখিনি পর্যন্ত। কবে ছেলে আমাকে দেখেছি কে জানে। আমারে নাকি খুব পছন্দ হয়েছে। আম্মা ছেলেকে দেখে ফেলেছে। সবকিছু দেখা শেষ। শুধু আমি ছেলেটাকে দেখতে পাই নি। আর বিয়ের সম্বন্ধে কিছু জানতাম না। কিন্তু আমার পরিবার আর ছেলের পরিবার নাকি সবই জানতো। আর এই শয়তান ছেলে নাকি আমাকে সবকিছু জানাতে বারণ করেছিল। তারা ভেতরে ভেতরে বিয়ের পর্যন্ত চলে গেছে আর আমি এখনো এর কিছুই জানিনা। ভাবতে পারিস আমার মনের অবস্থা এখন কেমন? এর জন্য আমি তোর কাছে এসেছি তো সান্তনা নিতে।’
আমি চিন্তিত ভঙ্গিতে লিলির তাকিয়ে বললাম, ‘দোস্ত তুই কি আবার পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিস নাকি? আচ্ছা দোস্ত আমাদের অজান্তে তুই আবার কারো সাথে রিলেশনে জরিয়ে ছিলি না তো। তারপর আবার ব্রেকআপ করে দিছিস এখন সেই ছেলেটা তোর বিয়ে পাত্র হিসেবে তোদের বাড়িতে আসছে।’
আমি সন্ধিহীন চোখে তাকিয়ে আছি লিলির উওরের অপেক্ষায়। কারণ ছেলে যদি ওকে পছন্দ করে আর ওকে না জানিয়ে বিয়ে সব পরিকল্পনা করিয়ে থাকে। তাহলে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এটা লিলি কোনো পূর্ব পরিচিত মানুষ। তার সাথে লিলি আমাদের অজান্তে রিলেশনও করতে পারে। অদ্ভুত ব্যাপার আমার কথাটা শুনে লিলি চমকালো ওর মুখটা দেখে মনে হচ্ছে চোর ধরা পড়ে গেছে ঠাস করে। ও আমার দিকে ঢোক গিলে তাকিয়ে আছে। আর কি যেন ভাবছে। তার মানে কি আমার এই বোকা বান্ধবীটাও প্রেম করেছিল। আর সেটা আমি আর দীপা টের পর্যন্ত পাইনি। কি চালাক মেয়ে বাবা।
‘কি হলো বল তোর বয়ফ্রেন্ড ছিল কি? খুব তো বলতি, রিলেশন করবি না। ভালো সেজে থাকতি।ছেলেদের ধারে ঘেঁষতে যেতি না, কথা বলতি না। এখন কি হলো সেই তো বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে রেখেছিলি এখন বাড়িতে এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আচ্ছা তুই এই বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপ কেন করেছিলি? আর আমাদের থেকে লুকিয়েই বা কেন রাখছিলি তোর মনের কথাটা বল এবার।’
লিলি বলল, ‘দোস্ত আমাকে ভুল বুঝিস না। ব্রেকআপ কিভাবে হবে? আমি তো ওই ছেলের সাথে রিলেশন করিনি। রিলেশন করলে না ব্রেকআপ হবে।’
‘আবার মিথ্যে? এখন আবার ওই ছেলেটা তারমানে চিনে ফেলেছিস। আবার বলছিস রিলেশন করিস নি? রিলেশন না করলেই ছেলে কেন তোর বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেবে? বোকা পেয়েছিস আমাকে?’
‘আমার সম্পূর্ণ কথা তো শোন তারপরে না হয় মন্তব্য করিস।’
‘আচ্ছা আচ্ছা বল।’
‘এই ছেলেটা ওই ছেলেটা কিনা জানিনা। আমার এখন একটা ছেলের কথা মনে পড়ছে। আজ থেকে প্রায় দুই বছর আগের কথা। তখন আমি ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। তখন তোদের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল না। তোদের সাথে তো পরিচয় হয়েছে অনার্সে উঠে। ছেলেটা নাম সম্ভবত ‘ রায়ান ‘
আমি যে গার্লস কলেজে পড়তাম তার পাশে ছিল পলিটেকনিক কোর্স কলেজ। ওই ছেলেটা সেখানেই পড়তো। ছেলেটা কয়েকদিন শুধু আমাদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতো ছুটি হলেই বাইরে বেরিয়ে দেখতাম ওই ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। আমি মাথা নিচু করে চলে যেতাম। আর ছেলেটা কখনো আমার সাথে কথা বলতে আসেনি। আমিও যাইনি। ওই ছেলেটা ওই ভাবে রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে মায়া হতো আবার মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগতো। আমি চলে যেতেই হয়তো চলে যেত কিন্তু আমি যতক্ষণ এখানে থাকতাম ওই ছেলে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে নির্লজ্জের মত।
এভাবে পনেরো দিনের মত চলে যায়। ওই ছেলের ভাব দেখে আমাদের কলেজের প্রায় অনেকেই বুঝে ফেলেছিল ওই ছেলেটা আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। আমার ফ্রেন্ডরা তো আমাকে ওই ছেলেটাকে নিয়ে
টিজ করতে শুরু করে দেয়। পরের দিক দিয়ে ওই ছেলেকে দেখলে আমার বান্ধবীদের মুখ দিয়ে একটা কথায় বের হতো তা হলো, ‘ লিলি ওই দেখ এমন ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কি কষ্ট করে তোর আশিক দাঁড়িয়ে আছে তোর জন্য। যা বেচারার সাথে একটু কথা বলে আয়। আর কতকাল দাঁড় করিয়ে রাখবি।’
ওদের এসব কথা শুনতে শুনতে আমার কানটা জাস্ট পচে যাচ্ছিল। ওদের এমন টিস করা নিয়ে আমি খুব লজ্জা লাগত। কারণ আমি খুবই লজ্জাবতী একটা মেয়ে। কি করবো এই ছেলেটা না আসছে আমার কাছে একটা কথা বলতে আর না ছেলেটাকে পারছিলাম আমি মন ইচ্ছামত একটু অপমান করতে। দিন দিন সবাই যখন বুঝে যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের সবাই প্রায় সব মেয়েরা আমাকে নিয়ে আর ওই ছেলেটাকে নিয়ে গুঞ্জন করত। তারপর আমি এটাও শুনতে পেয়েছি, আমার সাথে নাকি ওই ছেলের গভীর সম্পর্ক আছে। কিন্তু কলেজে সবাই জেনে যাবে এজন্য নাকি আমি ছেলেটাকে সাথে কলেজে কথা বলি না। কলেজের বাইরে নাকি তার সাথে গভীর প্রেম আমার। ছেলেটাকে ইচ্ছে করে কষ্ট দিচ্ছি। বেচারা কেন আমার পেছনে এখনো পড়ে আছে। আমি তাকে অবহেলা করছি।’
যে কাজটা আমি করি নি সে কাজটা নিয়ে যখন সবাই আমার দিকে আঙ্গুল তুলছিল নিজেদের মাঝে। আবার মাঝে মাঝে তো আমার কে বড় আপুরা অনেক কথা বলতো। আমি তখন ভাবলাম এসব যদি স্যাররা জেনে যায় আর যদি আমার মা-বাবাকে বলে দেয়। আব্বা আম্মা এসব ব্যাপারে কিছু জানতে পারলে তো আমাকে মেরেই ফেলবে।
উপায় না পেয়ে ওই ছেলেটার নির্লজ্জ পানা করার কথাটা জানার জন্য আমি কথা বলার সিদ্ধান্ত আমি নিলাম।
কিন্তু সে কথা বলাটা আমাদের কলেজের সামনে বলবো না কারণ কলেজ সামনে বললে সবাই আমাকে জেঁকে ধরবে আমি জানি। এর জন্য কিভাবে ছেলেটাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব এটাই ভাবছিলাম। পরে ভাবার ছেলেটা যেহেতু আমাদের কলেজের সামনে কলেজটাতে পড়ে তাহলে ওইখানেই যাব আমি। তার পরের দিনে আমি ওই কলেজ কয়টা থেকে ক্লাস শুরু হয়ে জেনে আধাঘন্টা আগেই ওই কলেজের ভেতরে গিয়ে বসি। ওইটা যেহেতু কোন বয়েজ কলেজ না এজন্য ওই কলেজে ভেতরে ঢুকতে আমার সমস্যা হয়নি। ওই কলেজে ভেতরে একটি শিমুল গাছ আছে আমি সেই শিমুল গাছটার নিচে বসে গেটের দিকে তাকিয়ে থাকি কখন ছেলেটা ঢুকবে?
তখন আমি ধরব।
অপেক্ষায় থাকতে থাকতে ছেলেটাকে কলেজে আসতে দেখি না এদিকে ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। ছেলেটা হয়তো আজকে আসবে না কি আর করব এদিকে আমার ক্লাস আছে আর আধা ঘণ্টা পরে এজন্য আমি নিজের কলেজে চলে আসি আমি নিজের কলেজের সামনে এসে চমকে উঠি ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে আমার কলেজের সামনে। উদ্বিগ্ন হয়ে দরজা দিকে চেয়ে আছে হয়তো আমাকে খুঁজছে। আমিও আজ ছেলেটাকে বোকা বানাব ভাবলাম। ছেলেটা যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে একটা গাছ আছে আমি সেই গাছের পিছনে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছি। দেখি ছেলেটা আমার জন্য কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আমি গাছের আড়াল থেকে সরে কিছুটা দূরে থাকা ছোট একটা হোটেল সেটার ভেতরে গিয়ে বসে রইলাম। একটু পর পর বের হয়ে দেখছি ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে কিনা। ঠিক আমার ক্লাসটা শুরু হওয়ার ঘন্টা দিল সেই মুহূর্তে ছেলেটা নিজের কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
ছেলেটার মুখ মলিন করে আছে আমাকে দেখতে পায়নি এজন্য কি? তারমানে ছেলেটা সকাল বিকাল দুবার আমাকে ফলো করে। আমি তো যাওয়ার সময় কখন এদিকে তাকাই না।
ছেলেটা হোটেলের কাছাকাছি এসে চলে যেতেই আমি তাড়াতাড়ি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বেরিয়ে এসে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আচমকা সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে ছেলেটা হকচকিয়ে গেল। সামনে কদম ফেলা পা সামনে না ফেলে পেছনে ফেলে অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো।
আমি উনার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম, ‘আপনার সাথে আমার জরুরি কথা আছি। চলেন ওই হোটেল গিয়ে বসি।’
বিনা বাক্যে ছেলেটা রাজি হয়ে গেল আমার সাথে হোটেলে গিয়ে বসল।
#চলবে…..
#অবাধ্য_প্রেম
#পর্ব_৪৩
#নন্দিনী_নীলা
দুজনে মুখোমুখি বসে আছি। ছেলেদের সাথে কথা খুব একটা বলি না বলে অভ্যাস নাই। এজন্য কথা বলতে আমার অস্বস্তি হয়। আজকে ও আমার অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু ছেলেটার উপর তীব্র রাগের জন্য আমি সেসবকে পাত্তা না দিয়ে অনেক সাহস দেখিয়ে জোর করে ছেলের সামনে বসে আছি। এই ছেলেটার জন্য আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মিশে যাচ্ছে।
আমি মাথা নিচু করে হাত মুচরাচ্ছি আর কিভাবে কি বলবো সেই সব গোছাচ্ছি তখনই ছেলেটার দিক থেকে আওয়াজ আসে।
‘কিছু বলবে?’
ছেলেটার কণ্ঠস্বর শুনে আমি ফট করে চোখ তুলে তাকায়।
আমতা আমতা গলায় বলি, ‘ আপনি আমাকে ফলো করেন কেন? আর প্রতিদিন সকাল বিকাল কলেজের সামনে ওমন করে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?’
ছেলেটা প্রশ্ন করে, ‘কেমন করে দাঁড়িয়ে থাকি?’
আমি ক্ষিপ্ত গলায় বললাম, ‘ পাল্টা প্রশ্ন করছেন কেন? আপনার জন্য কলেজে আমাকে প্রতিদিন হেনস্তা হতে হচ্ছে। একটা গার্লস কলেজের সামনে আপনি একটা ছেলে হয়ে কিভাবে দাঁড়িয়ে থাকেন? আপনার কি একটু লজ্জা করে না ? আপনার না হয় লজ্জা নাই থাকতে পারে কিন্তু আমার আছে। আপনার জন্য সবার চোখে আমি কালারে পড়ে যাচ্ছি। সবাই আমাকে নিয়ে গুঞ্জন করে। আপনার সাথে নাকি আমার রিলেশন আছে। আমি নাকি কলেজে এসে পাত্তা দেই না। কিন্তু বাইরে আপনার সাথে অনেক গভীর সম্পর্ক ইস সেসব বলতে পারছি না। কয়েক দিনের মধ্যে স্যার রাও হয়তো জেনে যাবে। আপনাকে না চিনি আর না কখনো কথা বলছি। কিছু না করে সবার চোখে আমি কালারে চলে যাচ্ছি। এবার বলুন আপনি কেন আমাকে এভাবে সবার চোখে খারাপ করছেন?’
সামনে বসা ছেলেটা গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার কথাগুলো শুনলো। আর আমি এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলেই স্বস্তি নিলাম। আমার কথা শেষ হতে সে বলল,’ হোটেলে যেহেতু বসেছি। চা বা কফি কিছু একটা তো অর্ডার দেওয়াই যায়। কোনটা খাবে?’
এদিকে আমি আছি রাগের সপ্তম আসমানে আর
উনি আছে চা কফি নিয়ে আমি রাগী চোখে তাকিয়ে আছি।
তিনি আমার উত্তরের অপেক্ষা করলো না দুই কাপ চা অর্ডার দিয়ে দিল। আমি তখন দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ‘আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চা অর্ডার দিচ্ছেন কেন? আমি আপনার সাথে বসে চা খেতে আসিনি। আপনার জন্য আমার প্রথম ক্লাস মিস গেছে। এজন্য হয়তো আমাকে কাল শাস্তি পেতে হবে। তাও আমি যাচ্ছি না। কারণ আপনি কেন এমন করছেন তা জানাটা অতীব জরুরি।’
চা আসা না পর্যন্ত ছেলেটার মুখ দিয়ে আমি একটা কথা ও বের করতে পারলাম না। চা এলো ছেলেটা চায়ে চুমুক দিল আর আমি এদিকে রাগে গজগজ করছি। অবশেষে ছেলেটার মুখ দিয়ে কথা বের হলো।
‘একটা ছেলে ঝড় বৃষ্টি সবকিছু উপেক্ষা করে। প্রতিদিন সকাল বিকাল কেন একটা গার্লস কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে তুমি বোঝনা?’
আমি ঢোক গিলে অবুঝ গলায় বললাম, ‘না তো কেন দাঁড়িয়ে থাকে?’
ছেলেটা বিস্মিত গলায় বলল, ‘ কলেজে পড়ো তুমি কি এখনো বাচ্চাটি আছো? যে তুমি কিছুই বুঝবে না!’
আমি অস্বীকার করে বললাম, ‘জানিনা জানতে চায় না। আপনি আর কখনো আমাদের কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। আপনার জন্য আমাকে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। অনেক কথা শুনতে হয়েছে। অনেক অপমানিত হতে হয়েছে। আমি আর অপমানিত হতে চাই না।’
ছেলেটা বলল, ‘ তোমার জন্য আমি কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকি কে বলেছে তোমাকে?’
আমি চমকে উঠলাম কথা শুনে। অবাক চোখে ছেলেটার দিকে তাকালাম। ছেলেটা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। তার হাসি দেখে আমি খুব লজ্জা পেলাম তবুও বললাম, ‘কি বলতে চান? আপনি আমার জন্য দাঁড়ান নি? অন্য কারো জন্য দাঁড়িয়েছেন! এটা আমাকে বিশ্বাস করতে হবে! আমি কেন কলেজের সবাই জানে আপনি ওইখানে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন।’
এবার ছেলেটা মুখের হাসি আরও প্রশস্ত করে বলল, ‘রিয়েলি আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতাম?’
আমি দ্রুতই উত্তর দিলাম, ‘অবশ্যই!
‘আচ্ছা আমি যদি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেটা তুমি লক্ষ্য করলে কিভাবে? তার মানে তুমিও কি আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে?’
আমি হতবুদ্ধি চোখে ছেলেটার দিকে তাকালাম। কিভাবে ছেলেটা আমাকে উল্টা ফাসিয়ে দিচ্ছে।
এবার আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম, ‘আপনি আমাকে ফাঁসাচ্ছেন কেন? আমি শুধু দুই এক বার তাকিয়ে দেখেছি আপনি আমার দিকে তাকিয়েছেন কিনা। আর অন্যরা আমাকে বলেছে আপনি আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন।’
‘অন্যরা তো তোমাকে মিথ্যা বলতে পারে? আর তুমি দুই-একবার তাকিয়ে আমাকে জাজ করে নিলে আমি তোমার দিকে তাকিয়ে থাকি। কলেজে এত মেয়ের মাঝে অন্য কারো দিকেও তো তাকিয়ে থাকতে পারি। হয়তো দুই একবার তোমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তখনই তুমি আমাকে দেখেছো। আর আমাকে কখনো তোমার সাথে কথা বলতে আসতে দেখেছো? তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে অবশ্যই তোমার সাথে পরে কথা বলার চেষ্টা করতাম। শুধু শুধু এখানে দাঁড়িয়ে কেন থাকব? আর কত দিনে বা দাড়িরে থাকবো দাঁড়িয়ে থেকেই কে আমি প্রেম,বিয়ে সেরে ফেলব নাকি।’
আমি এবার চিন্তিত মুখে বসে আছি। তাহলে কি সবার আর আমার ধারণা ভুল। এই ছেলে অন্য কোন মেয়ের জন্য দাঁড়িয়েছিল আর সেটা আমি ভেবেছি আমার জন্য। ছি ছি ছি ছেলেটা আমাকে কি ভাবছে ? যে সে ছেলেটাকে নিজের দিকে টেনে নিয়েছি। আমি তো সেই দিন ও ভাবছি ছেলেটা আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকলে আমার সাথে কেন একবার কথা বলতে আসল না।
নিশ্চয় অন্য কারো জন্য সবার ধারণা ভুল ইস ভাবনা টা আগে কেন নিলাম না কথা বলতে চলে এলাম ছেলেটার সাথে। ছেলেটা এখন আমাকে কি ভাবছে। আমি হয়তো ছেলেটাকে পছন্দ করি। মান সম্মান বাঁচাতে এসে দেখা যায় মান সম্মান আরো ডোবালাম। অসহার মুখে ছেলেটা দিকে তাকিয়ে বললাম,’ তার মানে আমার ধারণা ভুল? আমাকে ক্ষমা করে দিবেন আমি সরি।’
আমি আর কোন দিকে না তাকিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে একপ্রকার দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু ছেলেটা সেই মুহূর্তে আমাকে ডেকে ওঠে, ‘লিলি!’
আমি থমকে দাঁড়িয়ে পেছন ফিরে তাকাতেই ছেলেটা বলে উঠে, ‘ইউ আর রাইট। আই লাভ ইউ লিলি!’
আমি হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে আছি ছেলেটার দিকে। আমি কথা শুনে প্রচন্ড রেগে যায়। এইমাত্র আমাকে অন্য জিনিস বোঝাচ্ছিল আর এখনই ভালবাসি বলছে আমি রেগে কঠিন কথা বলতে আবার টেবিলের কাছে যাচ্ছিলাম……
লিলি প্রেম কাহিনী শোনায় বাঁধা প্রদান করল নিবিড়। অনেকক্ষণ ধরেই ফোন দিচ্ছে কিন্তু আমি ধরছি না কারণ আমার ওর কল ধরার কোনরকম ইচ্ছা নাই। তাই বারবার কেটে দিয়েছিলাম নিবিড় এবার মেসেজ করেছে,
‘ ছোঁয়া জান কলটা রিসিভ করো। না হলে কিন্তু আমি পরীক্ষা দিতে না গিয়ে তোমার বাসায় চলে আসব। তুমি নিশ্চয়ই চাইবে না তোমার জন্য আমার একটা বছর নষ্ট হোক।’
পরিক্ষা তার আর চিন্তা করতে হবে আমাকে। রাগে মন চাচ্ছে এখন ফোনটা একটা আছাড় মারি। আবার কল বেজে উঠল এক প্রকার বাধ্য হয়ে কলটা রিসিভ করতে হলো। লিলি কথা থামিয়ে বেলকনিতে চলে গেছে পুরনো প্রেমিকের কথা মনে করে বেচারির মন খারাপ। আহ কি প্রেম!
ফোন কানে নিতেই নিবিড়ের গর্জে ওঠা কন্ঠ
বলল, ‘ ছোঁয়া তুমি কিন্তু কথা দিয়েছিলে আমার ফোন তুমি রিসিভ করবে। আমি যখনই কল দেবো তখনই ফোন রিসিভ হবে। আজ তাহলে কথার খেলাপ করলে কেন? তুমি জানো না আজকে আমার এক্সাম। আমি তোমায় বলেছিলাম পরীক্ষা দেওয়ার আগে তোমার সাথে আমি পাঁচ মিনিট কথা বলে পরীক্ষা জন্য বের হব। তুমি কিন্তু কাজটা ঠিক করছো না আমাকে রাগিয়ে তুমি লিমিট ক্রস করতে বাধ্য করো না।’
আমার মন চাচ্ছে রাগে এখন নিবিড় কে সামনে পেলে ওর চুল উঠিয়ে ফেলতে। কিন্তু সেটা তো সম্ভব না কথা দিয়েছি রাখতেই হবে।
‘শুনুন আমি আপনার মত না। ছোঁয়া নিজের কথা রাখতে জানে। আপনি আমাকে ব্ল্যাকমেল করিয়ে কথা নিয়েছেন তো আচ্ছা আমি বলেছি তো আপনার সাথে আমি প্রতিদিন পরীক্ষার দিনেই শুধুমাত্র ৫ মিনিট করে কথা বলব। আর আজকে আমি কলটা ধরছিলাম না। আমি একটু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করছিলাম। আর আপনার জন্য আমার কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে এর জন্য আমি বারবার ফোন কেটে দিচ্ছিলাম। এবার আপনি যান। পরীক্ষা আপনার আর নাকানি চুবানি তো আমাকে খাওয়াচ্ছেন। আপনি পরীক্ষা দিয়ে ভাল রেজাল্ট করলে আমারে কি লাভ হবে আমি সেটাই জানিনা। কিন্তু আপনার জন্য আমাকে সাফার ঠিকই করতে হচ্ছে। আর নিজেও ফেঁসে গেছি আপনি তো ফাঁসাতে পারেন ভালো। ফেঁসে গিয়ে এখন কপাল চাপলে আর লাভ কি?’
‘একটা সুন্দর করে কথা বল এমন ধমকে ধমকে কথা বললেই কি আর আমার পরীক্ষা ভালো হবে? আমি তোমার ধমক গুলো মনে করে তো কিছু লিখতে পারবো না। একটু মিষ্টি মিষ্টি করে কথা বলো। সোনা, জানু বলে তাহলে না পরীক্ষা আমার সেই রকম হবে।’
‘ কথা বলেছি এই বেশি। আবার আসছেন মিষ্টি কথা নিয়ে। আমার মুখ দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথা বের হয় না।’
‘ আমি নিশ্চিত তোমার মা তোমার মুখে প্রথমে মিষ্টি দেয়নি তোমার মুখ তিতা জিনিস দিছিল এজন্য তিতা কথা বের হয় শুধু।’
‘এবার আপনি যাবেন ১০ মিনিট হয়ে গেল কিন্তু।’
‘আধা ঘন্টা ধরে তুমি আমাকে ওয়েট করিয়েছো। কল রিসিভ করেনি। এখন তো আধা ঘন্টায় কথা হবে। আর আজকে অন্তত বল নিবিড় লাভ ইউ। সত্যি বলছি তুমি কথাট বললেই আমার পরীক্ষা সেই রকম হবে ফাস্ট ক্লাস পেতে কেউ আটকাতে পারবেনা। এই ছোঁয়া বলো না।’
‘ আচ্ছা বলছি।’
নিবিড় খুশিতে বাকবাকুম করছে। আমি রাজি হয়েছি শুনে। আমি এত তাড়াতাড়ি কি করে রাজি হয়ে গেলাম ও বিশ্বাস করতে পারছে না।
নিবিড় বিস্মিত সুরে বলল, ‘ ছোঁয়া আর ইউ সিরিয়াস তুমি রাজি হয়ে গেছো? এক কথায় রাজি হয়ে গেলে আমি তো বিলিভ করতে পারছি না!’
নিবিড় নিজের মনের সুখে কথা বলে যাচ্ছে। খুশি মনে ও তো বিশ্বাস করতে পারছে না এসব বলে যাচ্ছে। আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, নিবিড় আই হেট ইউ।’
নিবিড়ের আনন্দিত মনটা ঠাস করে কালো হয়ে গেল। পাংশুটে করে কিছু বলতে যাবে আমি কল কেটে দিয়েছি বলার আর সুযোগ পেল না বেচারা।
.
নিবিড়ের বাসা থেকে চলে আসার দুদিন পর নিবিড় লিলিদের বাসায় এসে হাজির হয়। নিবিড় কে দেখে তো আমি চমকে উঠি কিছু বলতে যাব নিবিড় আমাকে ধাক্কা দিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকিয়ে নিজেও রুমের ভেতরে ঢুকে পড়ে আর দরজার ছিটকারি লাগিয়ে দেয়।
আমি নিবিড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে বলি, ‘ আপনি এখানে কি করছেন? দরজা লাগাচ্ছেন কেন?বের হোন বাসা থেকে!’
নিবিড় আমার প্রশ্নের উত্তর দেয় না। কিন্তু হাচমকা আমাকে টেনে দেয়ালে ঠেসে ধরে। আর এক হাতে আমার গলা চেপে ধরে শক্ত করে। ব্যথায় আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। নিবিড় দাঁতে দাঁত চেপে কঠোর সরে বলে, ‘আজ এখানেই গলা টিপে মেরে ফেলবো। আমার থেকে দূরে যাওয়ার জন্য তুমি বাসা ছেড়েছো তাই না? কি ভেবেছো বাসা ছারলেই তুমি নিবিড়ের থেকে দূরে চলে যেতে পারবে এতই সোজা?’
এত জোরে গলা চেপে ধরেছে যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমি কথা বলতে পারছি না তবুও আমি টেনে টেনে বললাম, ছাএএড়ুন
‘আগে বল আমার অনুপস্থিতিতে তুই বাসা ছাড়লি কেন?’ নিবিড়ের রাগ দেখে আমি মিইয়ে যাচ্ছি। দম বন্ধ হয়ে মনে হচ্ছে মরে যাব। আর 2 মিনিটে এইভাবে থাকলে আমি নিশ্চিত মরে যাব। কিন্তু লাস্ট মুহূর্তে নিবিড় আমার গলা ছেড়ে দেয়। আমি গলা ধরে খক খক করে কেশে উঠি। জীবন মরণের মাঝখানে ছিলাম খুব ভয় পেয়ে গেছি। নিবিড়কে অনেক সময় রাগ করতে দেখেছি কিন্তু এতটা রাগ আর ভয়ঙ্কর রূপ মনে হয় নি কখনো। আজকে প্রথম দেখলাম এমন রুপ। আমি ভীতু চোখে নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম নিবিড় দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করছে। আমি দূরে সরে দাঁড়িয়ে আছি ভয়ার্ত মুখ করে।
#চলবে……