অবাধ্য_প্রেম(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) #পর্ব_১

0
2213

#অবাধ্য_প্রেম(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব_১
#নন্দিনী_নীলা

সময়টা আষাঢ় মাসের। বাইরে জুপজাপ বৃষ্টি পাল্লা দিয়ে চলছে শহরের বুকে। ঝমঝম শব্দে চারপাশ মুখরিকতা হচ্ছে আর সেই তালে কারো আর্তনাদ ভেসে আসছে। হসপিটাল করিডরে কয়েক জোড়া মুখ দুশ্চিন্তা পায়চারি করছে। কেউ বসে আছে আল্লাহর নাম নিচ্ছে কেউবা ভগবান বলে বিধাতাকে কে স্মরণ করছে। সবাই এক আল্লাহকে স্মরণ করছে কিন্তু ভিন্ন নামে। বাচ্চার কান্না শব্দে সবার মুখে দুশ্চিন্তার মাঝেও হাসি ফুটে উঠল। একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানকে বাবার কোলে দিতেই বাবার মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল লিলি ছুটে এলো শ্রাবণের কাছে শ্রাবণের কোলে পুতুলের মত একটা মেয়ে। কান্না করার ফলে মুখ লাল হয়ে উঠছিল বাবার কোল পেতেই যেন তার কান্নার গতি কমে এলো। দুশ্চিন্তা যারা পায়চারি করছিল সবাই এতক্ষণে ছুটে এলো শিশু কন্যাটির মুখ দেখার জন্য। সবাই একে একে কোলে নিলো বাচ্চাটাকে শ্রাবণ বাচ্চাকে মায়ের কোলে দিয়ে ডাক্তারের কাছে এগিয়ে গেল।

চিন্তিত মুখে জিজ্ঞেস করল,”ডক্টর আমার ওয়াইফ ঠিক আছে তো?”

ডাক্তার মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,”আপনার স্ত্রী
একদম ঠিক আছে! তিনি এখন ঘুমাচ্ছে। আপনারা একটু পরে দেখা করতে পারবেন কিন্তু এক্ষুনি নয়।”

বলে মহিলা ডক্টর চোখের চশমা টেনে চলে গেল নিজের কেবিনের দিকে।
লিলি বাচ্চা কে কোলে নিয়ে গেল শ্রাবণের দিকে,”ভাইয়া দিপা ঠিক আছে?”
শ্রাবণ মাথা নেড়ে সম্মতি দিল।

ঠিক আধা ঘন্টা পর দিপার সাথে দেখা করার সুযোগ হলো। দিপা মেয়েকে দেখে তো কেঁদেই ফেলল। শোয়া থেকে মেয়েকে একবার স্পর্শ করল চুমু খেলো লিলি যাওয়ার আগে পর্যন্ত কোল ছাড়া করেনি। আসার আগে দিপার শাশুড়ির কোলে দিয়ে এসেছে।

হসপিটাল থেকে রায়ান আর লিলি বেরিয়ে একটা রিকশা নিল। তখনই লিলির ফোনটা বেজে উঠলো। নিবিড় কল করেছে। কল লিস্টের নামটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল লিলির। ও অসহায় মুখ করে তাকাল পাশে বসার রায়ানের দিকে।
রায়ান রিসিভ করতে বলল।
লিলি বলল,”রিসিভ করলে আবার একটা কষ্ট পাবে ভাইয়া। তার মনে আশা ছিল আজকের দিন হয়তোবা আসবে ছোঁয়া। হসপিটালে এসে দিপার মেয়েকে দেখবে। ছোঁয়া তো আজ আসলো না। কোথায় চলে গেল মেয়েটা? ভাইয়ার দিকে তাকানো যায় না কেমন হয়ে গেছে! সারাদিন নাকি কী অবস্থায় পড়ে থাকে! জীবনটা নষ্ট হয়ে গেল কেউ বলে আর তাকে লেখাপড়া করাতে পারল না। এক্সিডেন্ট হয়ে প্রথমবার পরীক্ষা দিল না দ্বিতীয় বারে পরীক্ষার সময় চলে আসছে। তার যা অবস্থা মনে হয় না এবারও পরীক্ষাটা দেবে। কেন চলে গেল ছোঁয়া। ওর জন্য যে একটা মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এসব তো সহ্য করা যায় না। কোথায় এইভাবে হারিয়ে গেল সবকিছু ছেড়ে।”

বাজতে বাজতে কলটা কেটে গেল। সাথে সাথে আবার কল বাজল এবার লিলি কলটা রিসিভ করল।

ওপাশ থেকে এলোমেলো কন্ঠে নিবিড় বলে উঠলো,”লিলি ছোঁয়া কে পেয়েছো তাই না? আমি এখনি আসছি। দিপা দিপার মেয়ে সুস্থ আছে?”

লিলি চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”সবাই ঠিক আছে! এ রাতের বেলায় এই অবস্থায় বের হয়েন না কন্ঠ কেমন লাগছে। আজকে নেশা করেছেন তাই না ভাইয়া।”

নিবিড় বলল,”না আজকে খাইনি। আজকে আমার ছোঁয়া ফিরে আসবে। এই অবস্থায় কি ওর সামনে যাওয়া যায়? আমি তো ঘুমিয়ে ছিলাম এজন্য কন্ঠ এমন লাগছে।”

“আর কখনো ঐসব খাইয়েন না ভাইয়া। এভাবে আপনি যে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ছোঁয়া ফিরে আসলে খুব রাগ করবে। ওর জন্য হলেও এসব থেকে দূরে থাকুন নিজেকে সুস্থ রাখুন।”

“কি বলছ? ছোঁয়া তো ফিরে আসছে! ও কি আজও আসেনি?”কাঁপা কাঁপা গলায় বললে নিবিড়।

লিলি কিভাবে বলবে কথাটা ১৫ দিন ধরে আজকের জন্য অপেক্ষা করছিল নিবিড় আশায় ছিল। দিপার বেবির ওজন বেশি হয়ে গেছিল এজন্য ডাক্তার বলেই দিয়েছিল বাচ্চা সিজার করতে হবে। এজন্য ডেটটা আগে থেকেই মাথায় ছিল। ছোঁয়া বেবিদের অনেক পছন্দ করে। দিপা প্রেগনেন্ট শুনে বলেছিল সবার আগে ও বেবি কে কোলে তুলে নেবে। এজন্য ভেবেছিল আজকে হয়তো বা যেখানেই থাকো হসপিটালে আসবে ছোঁয়া। ছোঁয়া মরে যাইনি এই বিশ্বাসটা নিবিড়ের সাথে লিলি আর দিপা ও করে।
আশাটা ভেঙে গেল। ছয় মাস হয়ে গেল ছোঁয়া নিখোঁজ এই ছয় মাস টা কি ভিশন কষ্টে কেটেছে সবার। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভোগ করেছে এই মানুষটা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। কিভাবে মুখের উপর বলবে আজকেও আপনার ছোঁয়া ফিরে আসেনি।

নিবিড় কে আর মুখে বলতে হলো না নিবিড় আর নীরবতা দেখেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। ফোনটা কেটে দিয়েছে। লিলি ফোনটা দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা রাখে রায়ানের কাঁধে।
আর বলে,”ছোঁয়া কে কিনিবিড় ভাইয়া কোনদিন খুঁজে পাবে না?”

রায়ান মাথা বাঁকিয়ে লিলি কপালে ওষ্ঠ স্পর্শ করে বলে,”সৃষ্টিকর্তা চাইলে ঠিকই পাবে। দুজনের মিল যদি লেখা থাকে তাহলে একদিন না একদিন ঠিকই দুজন দেখা হবে। মিল হবে, ভালোবাসা হবে। তুমি এত টেনশন করো না। তোমার এই মলিন মুখটা দেখতে আমার একটুও ভালো লাগে না।”
_____________________

নিবিড় কল কেটেই ফোন ছুড়ে মারে রেগে। ফোন গিয়ে লাগে ডেসিন টেবিলের আয়নায়। ঝনঝন শব্দ করে আয়না ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
চিৎকার ও ভাঙচুরের শব্দ শুনে ছুটে আসে বাসার সবাই। নিলাশা বেগম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখতে পায় এলোমেলো ভাঙাচোরা জিনিস দিয়ে ভরা রুমটা। ছেলের দিকে তাকিয়ে ঢুকরে উঠে কল দেয় আফিয়া কে। আফিয়া বলে এখনি আসছি। এই রাত এগোরাটায় আফিয়া রাজি হয় আসতে।

নিলাশা বেগম বলে, ” কাল এসো আজ তোমার বাবা মা রাগ করতে পারে।

আফিয়া বলে, ” আচ্ছা এখন আমি নিবিড় কে কল দিচ্ছি আপনি টেনশন করবেন না।”

বলে আফিয়া কলটা কেটে দিল। এদিকে নিলাশা বেগম বলার সুযোগ পেল না। কল দিয়ে তুমি নিবিড় কে পাবে না কারণ এখন আর কল ঢোকার মতন অবস্থাতেই নাই ফোনটা। ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে।

নিবিড় বাসা থেকে বেরিয়ে আসে। কেউ থামাতে পারে না। এই গুরিগুরি বৃষ্টির মাঝেই বাইক নিয়ে বেরিয়ে আসে। নিস্তব্ধ নিরিবিলি একটা জায়গায় এসে সিগারেট ফু দিতে লাগে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ে অনেকটা ভিজে গেছে।
নিবিড় ভেজা চুলগুলো হাত দিয়ে পেছনে দিতে দিতে আওড়ায়,,”তোমার শূন্যতা নিঃশেষ করে দিচ্ছে আমাকে। এলোমেলো ছন্নছাড়া হয়ে যাচ্ছি। আমার এই যন্ত্রণা তোমার হৃদয় কি একটুও অনুভব করছে না?”

বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেল নিবিড় আর এখন সিগারেট খেতে পারছে না। বিরক্ত লাগছে ওর। বিয়ারের বোতলটাও সাথে নেই। রাগে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল,,,”এই বৃষ্টি ও স্বার্থপর। এই বৃষ্টি ও আমাকে কষ্ট কমাতে দিচ্ছে না। তোমার মতই আমাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে বিরক্ত করছে।”

সিগারেট ভিজে চৌচির সারা শরীর ভিজে গেছে। বৃষ্টির মাঝে বাইক স্টার্ট দেওয়ার ইচ্ছে করল না একপাশে পা ছড়িয়ে বসে সামনে পুকুরের দিকে তাকিয়ে রইল।
হঠাৎ করেই বলল,”এই বৃষ্টি আমার সাথে কাঁদছে ছোঁয়া। এই বৃষ্টি কি তুমি দেখতে পাচ্ছ? ছোঁয়া এই বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা আমার কান্নার জলের সাথে মিশে যাচ্ছে। এই বৃষ্টি তুমি ছুয়ে দেখো। আমার অশ্রু তোমার হাত ছুঁয়ে দেবে? তখন‌ও কি তোমার ভেতরটা একটুও কেঁপে উঠবে না? আমার কথা ভেবে?”

নিবিড় সেখানে শুয়ে পড়ল ঘাস আর মাটির সাথে শুতে ওর সাদা শার্টটা কাদায় মাখামাখি হয়ে গেল। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। একদম সোজা হয়ে কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির ফোঁটার সাথে অশ্রু বিসর্জন দিল।
____________________

টিনের চালে একটা ছোট খাটো ঘরের ভেতরে জানালার পাশে বসে আছে একটা মেয়ে। তার দৃষ্টি সামনের বিশাল উঠানের দিকে। সেখানে দুজন পুরুষ কথা কাটাকাটি করছে ঝগড়া করছে। দুজনের পাশে দুজন মহিলা দাঁড়ানো তাদের থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
তারা থামার বদলে আরো গায়ে হাত তুলতে এগিয়ে আসছে। মেয়েটা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে। এদের তর্কবিতর্ক কখন শেষ হবে ভেজা উঠানে একটা পাঁচ বছরের মেয়ে দাড়িয়ে কাঁদছে। তার দিকে তাকিয়ে আছে মায়া ভরা দৃষ্টিতে এই বৃষ্টি ঢেংগিয়ে ওই ঘরে যাওয়া ব্যাপার না কিন্তু বারণ আছে ওই পাশে না যাওয়ায় এজন্য মেয়েটা যেতে পারছে না। রাগে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এলো। পাশের ছোটো রুমটায় গেল। একটা মেয়ে বসে আছে। তার হাতে একটা ছবি ও এই পর্যন্ত কতোবার ওই ছবি খানা দেখতে চেয়েছে তার হিসেব নাই কিন্তু সামনে বসা শ্যামবর্ণের এই মায়াবী মুখশ্রীর মেয়েটি দেখতে দেয়নি।

আজ ও ওর উপস্থিতি টের পেয়ে মেয়েটি ছবিটি লুকিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বলল,” সাদিয়া তুমি এই সময় কিছু বলবে?”

সাদিয়া এগিয়ে এসে মেয়েটির হাত টেনে ধরে বলল,” আপু বাইরে আসো। এতো ফাটাফাটি হচ্ছে তুমি নিশ্চিন্তে ওই ছবি নিয়ে পড়ে আছো।”

মেয়েটি অবাক গলায় বলল, ” কি হয়েছে সাদিয়া? এতো বৃষ্টি হচ্ছে টিনের চাল জমজম শব্দে আমি আওয়াজ পায়নি খেয়াল করিনি। এই রাতে আবার কি হলো। ”

” বাবা আর জেঠা আবার ঝগড়া করতাছে। ওপাশে কলি কান্নার করছে। জেঠি ত বাইরে ঝগড়া থামাতে চাইতাছে। আম্মা আমারে ওই ঘরে যাইতে বারণ করছে আমি তাই কলির কাছে যাইতে পারতাছি না। তুমি ওর কাছে যাও না একটু আপু।”

মেয়েটা উঠে পরল ততক্ষণাৎ বিছানায় থেকে। বেরিয়ে এলো রুম থেকে ছাতা নিয়েই বৃষ্টির মাঝে এগিয়ে এলো কলির কাছে। মেয়েটা বজ্রপাতে ভয়ে সিটিয়ে কান্না করছে। কেউ তার দিকে খেয়াল করছে না এই এতো রাতে বৃষ্টির মধ্যে সবাই ঝগড়া করতে ব্যস্ত কি আজব মানুষ। সাদিয়া মা মা করে ডাকতে লাগল।
ওর মা তাকাতেই বলল,” দয়া করে তামাশা বন্ধ করে আব্বা রে আইতে ক‌ও। এসব আর ভালো লাগছে না।”

মহিলাটা চিৎকার করে বলল,” আমার কথা তোর বাপ শুনছে কোনদিন আজ শুনব ক্যান।”

উওরের ঘর থেকে জেঠার বড় ছেলে বেরিয়ে বারান্দায় থেকে চিৎকার করে থামতে বলল। না থামলে এবার তিনি নামিয়া দুজনকে পিঠাইব ক‌ইল। তা শুনে দুই ভাই নিঃশব্দে বারান্দায় এসে গেল। সাদিয়া রুম থেকে লুঙ্গি আর গামছা এনে দিল বাপের হাতে। তারপর গটগট করে নিজের রুমে চলে গেল।

#চলবে…

( আসসালামু আলাইকুম! কেমন আছেন সবাই?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here