#অবাধ্য_প্রেম( দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#পর্ব_৮( বর্ধিতাংশ)
#নন্দিনী_নীলা
ট্রেন গন্তব্যে এসে থামতেই সবাই নামতে লাগলো। নিবিড় সেই যে আমার সাথে কথা বলেছিল তারপর আর আধা ঘন্টা চলে গেছে । নিবিড় না আমার দিকে তাকিয়েছে আর না কথা বলেছে। চোখ মুখ কঠিন করে বসে ছিল। বাকিটা সময় আমার পাশে বসে ছিল ইভা আপু তিনি আমাকে সমস্ত ঘটনায় খুলে বলেছে আমি নাকি জ্বরে বেহুশ হয়ে গেছিলাম। যে মেয়েটার পাশে বসে ছিলাম তার নাম রাত্রি। সেই মেয়েটা নাকি ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিল। আর এদিকে ইভা আপুরা বান্দরবান যাচ্ছিল ট্যুরে।
সব শুনে আমি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে ছিলাম নিবিড়ের দিকে। তার দৃষ্টি ফোনে, বা মাথা উঁচু করে দুই একটা কথা বলেছে বন্ধুদের সাথে।
রাত্রি নামের মেয়েটার সাথে দেখা হলো ট্রেন থেকে নামতেই। তৌহিদ ভাইয়া তাকে ধরে নিয়ে এসেছে আর জিজ্ঞেস করছে কোথায় যাবে রাত্রি ও বান্দরবান যাবে তার নানু বাড়ি সেখানে। এটা শুনেই তৌহিদ ভাইয়া আমাদের সাথে যাওয়ার তোষামোদ করতে লাগল। রাত্রি রাজি হয়ে গেছে।
আমার পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,” তোমার জন্য আমি কাল কতো ভয় পেয়েছিলাম জানো?”
আমি অপরাধী ন্যায় তাকালাম। রাত্রি বলল,” তোমার কি জ্বর চলে গেছে?”
” জ্বর নাই শরীর এমনিতেই ক্লান্ত লাগছে। আর কালকের জন্য সরি।”
রাত্রি বলল,” কাল তো বয়ফ্রেন্ড এর কোলে ছিলে। এখনো কোলে বসে থাকো তাহলে আর ক্লান্ত লাগবে না। আমি কতো কষ্ট পাইছি জানো।”
আমি অবাক গলায় বললাম,” তুমি কষ্ট পাইছো কেন?”
রাত্রি কিছু বলতে যাবে তৌহিদ এসে আটকে দিল। আর বলল জিপ ঠিক করা হয়ে গেছে। জিপে ওঠার আগে সকালের নাস্তা করে নেবে এখানের একটা হোটেল থেকে। সবাই হোটেলে গিয়ে বসলাম। রুটি ভাজি খেয়ে নিলো। আমি খুব একটা খেতে পারলাম না মুখটা তেতু হয়ে আছে। নিবিড় নিজের ব্যাগ থেকে ওষুধ বের করে আমার সামনে রাখলো। আমি অসহায় চোখে নিবিড়ের দিকে তাকালাম নিবিড় চলে গেল। এতো রাগ!
জিপে উঠার পর আমার এক পাশেই ইভা আপু অন্য পাশে রাত্রি বসে ছিল। নিবিড় যে আমার উপরেই রেগে আছে এটা সবাই বুঝতে পেরেছে। কারণ অনেকক্ষণ ধরে নিবিড় আমার সাথে কথা বলে না। এজন্য নিবিড়ের সাথে আমার বসা হবে না সবাই ভেবে নিয়েছিলো। আমি এতদিন পরে প্রিয় মানুষগুলোকে পেয়ে খুবই আনন্দিত। জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম ইভা আপু, রাত্রি, আকাশ ভাইয়া, সবার সাথে। একমাত্র আফিয়া আমার সাথে একটাও কথা বলে নি। শুধু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে পরোক্ষ করছিল। তার চোখে আমার জন্য রাগ আমি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছি। আমিও আগবাড়িয়ে কথা বলিনি।
সবাই জিপে উঠে বসে আছি। এদিকে নিবিড় আর তৌহিদ ভাইয়া কোথায় যেন গেছে। তাদের জন্য ওয়েট করছি গাড়িতে বসে রাত্রির সাথে কথায় কথায় ওর সম্পর্কে জেনে নিলাম। রাত্রি অনার্স প্রথম বর্ষের এখনো ভর্তি হয় নাই আবেদন করেছে অর নাকি পছন্দের ভার্সিটিতে আসে নাই। এজন্য ও প্রাইভেটে ভর্তি হবে। ওর নানু বাসা বান্দরবান। মামাতো বোনের বিয়ে উপলক্ষেও হঠাৎ করে এসেছে একাই। ওর বড় ভাইয়ের আসার কথা ছিল আজকে কিন্তু সবকিছু ঠিক করার পরে তিনি নাকি হঠাৎ বিজনেসের কাজে জরুরী ভিত্তিতে কুমিল্লা গেছে। আর বলেছে সেখান থেকে এসে নিয়ে যাবে বিয়ের আরও তিন দিন পর কিন্তু রাত্রি খুবই চঞ্চল মেয়ে আর জেদি। ও যেহেতু ভেবেছে গতকাল যাবে তাই গতকালই। এজন্য বাসার কাউকে না বলেই একাই টিকেট নিয়ে চলে এসেছে রাগ করে।
জেদ করে আসার কথা শুনে আমি রাত্রি কে একটু নীতিবাক্য শুনালাম কারণ এখন তো পরিবারের সবাই হয়তো ওর জন্য টেনশনে আছে। আর ও ফোন অফ করে রেখেছে কারো সাথে যোগাযোগ করেনি। এ কথা শুনে রাত্রিও বুঝতে পারলে ও ভুল করেছে। তাড়াতাড়ি ফোন অন করল।
এদিকে নিবিড় আর তৌহিদ ভাইয়া এসে পরল। নিবিড় এসেই আমার দিকে একবার তাকাল তারপর ইভা আপুর হাত ধরে টেনে উঠিয়ে দিল। ইভা আপু তো চিৎকার করে উঠল। কে শোনে কার কথা। আমি ও অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। রাত্রি ফোনে কথা বলছে। নিবিড় ইভা আপুর জায়গায় বসল।
ইভা আপু গাল ফুলিয়ে বলল,” মুখে বললেই হতো ওখানে বসতে চাস। এমন ভাবে ভয় দেখালি কেন?”
নিবিড় বলল,” অনেকে মুখের কথা বুঝতে চায়না। তাই কাজে করায় বিশ্বাসী এখন আমি।”
” ধুর তোদের রহস্য কথা শুনে আমি আর পাগল হতে চায় না।”
রাত্রি কথা শেষ করে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল,” আম্মু আব্বু নাকি আমার চিন্তায় কাল থেকে বসে আছে। এখন থানা যেতো কল না দিলে। ধন্যবাদ তোমার জন্য আমি ছেলেমানুষী পাগলামি বুঝতে পারছি।”
” বাবা মা কে কখন কষ্ট দিও না। থাকতে ওদের ভালো রাখতে না পারলে পরে সেই তোমাকেই আফসোস করতে হবে।”
জিপ ছাড়ল। উঁচু নিচু আঁকাবাঁকা রাস্তা বেয়ে চলছে। শীতল হাওয়া মন মস্তিষ্ক ঠান্ডা করে দিচ্ছে। সারি সারি পাহাড় ঘন সবুজ পাহাড়, নাম না জানা গাছগাছালি। প্রকৃতি মুগ্ধ করা সৌন্দর্য, অপরুপ দৃশ্য দেখছি সাথে ঝাঁকুনি খাচ্ছি। মন বসছে এই সিট বেল ছিঁড়ে আমি জিপ থেকে ওই গহীন অরণ্যে পড়ে যাব। ভয়ে আমার বুক ঢিপঢিপ করছে।
তখনি নিজের পেছনে একটা হাতের অস্তিত্ব পায়। নিবিড় খুব সাবধানে আমার পেছনে দিয়ে কোমর চেপে ধরল। টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখল। তার দৃষ্টি বাইরের অরণ্যে। আমি চকিতে মাথা তুলে নিবিড় দিকে তাকিয়ে আছি। নিবিড় এদিকে তাকালোই না। আমি তার এক পাশের গালের দিকেই চেয়ে আছি। চোখ নামিয়ে তাকালাম নিবিড়ের হাঁটুর ওপর থাকা ডান হাতটার দিকে। আমি নিজের ডান হাত বাড়িয়ে এতটা টেনে নিজের দুহাতের মাঝে নিলাম। নিবিড় আমার স্পর্শ পেয়ে চোখ বাঁকা করে তাকাল তারপর আগের ন্যায় বসে রইল।
এদিকে রাত্রি জহরি নজরে চেয়ে আছে নিবিড়ের হাতের দিকে। নিবিড় ছোঁয়ার কোমর চেপে জরিয়ে রেখেছে হাত। তা দেখছে আড়চোখে। তৌহিদ রাত্রি কে লজ্জায় লাল নীল হতে দেখে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। অতঃপর মাথা নিচু করে নিচু স্বরে বলল,” আমি তো এখনো এমন কিছু করিনি যে তুমি লজ্জায় লাল হবে। ব্যাপার কি ব্লাসিং খাচ্ছ কেন?”
রাত্রি লজ্জিত মুখে বলল,” ধুর আমি অন্যের ভালোবাসা দেখে মুগ্ধ প্লাস লজ্জা পাচ্ছি। আপনি খালি উল্টা পাল্টা বুঝলেন কেন?”
তোহিদ ঠোঁট কামড়ে ধরে হেঁসে বলল,” ও তাই। আমাকে বয়ফ্রেন্ড বানিয়ে নাও সুন্দরী। আমার ভালোবাসা দেখে না হয় লজ্জিত মুখটা এই বুকের লুকিয়ে রেখো।”
তৌহিদ নিজের বক্ষস্থলের দিকে ইশারা করল। রাত্রি চোখ কটমট করে বলল,” আপনি খুব নির্লজ্জ তো। এসব বলতে লজ্জা লাগছে না। ছিহ আপনার সাথে আর কথা বলব না আমি।”
” সুন্দরীদের রাগলে ঠিক পাকা টমেটোর মতো লাগে। মন চায় খপ করে ধরে গিলে খেয়ে ফেলি।”
” ছিহ কি অশ্লীল কথাবার্তা।”
আফিয়া রক্তবর্ণ চোখে ছোঁয়া আর নিবিড়ের দিকে তাকিয়ে আছে। নিবিড় রাগ করে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে আর ছোঁয়া নিবিড়ের হাত শক্ত করে ধরে নিবিড়ের বাহুতে মাথা রেখে আছে। ঝাঁকুনিতে দুল খাচ্ছে সবাই। কারো দিকে কারো নজর নাই যে যার মতো ব্যস্ত। নিবিড় ছোঁয়াকে আগলে রেখেছে কোমর চেপে ধরে সব কিছুই লক্ষ্য করছে আফিয়া। এসব জাস্ট সহ্য করতে পারছে না। সব কিছু তছনছ করে ফেলতে ইচ্ছে করছে।
____________________________________
দশটায় আমরা সবাই গন্তব্যে এসে পৌঁছালাম। মাঝখানে নেমে গেছে রাত্রি। ওর মামাকে কল করে জানিয়েছেন তিনি গাড়ি নিয়ে আসছে ওকে নিতে। রাত্রি নামতেই তৌহিদ ভাইয়া মুখ কালো করে ফেলেছে। ইভা আপু রাত্রির নাম্বার নিয়েছে।
ছেলেরা ছেলেদের রুমে ও মেয়েরা মেয়েদের রুমে চলে এলাম। কটেজ টা দারুন সুন্দর কাঠের তৈরি। আর প্রত্যেক রুমে সাথে কি দারুন বেলকনি। বেলকনিতে ছোট ছোট কাঠ দিয়ে বানানো মাঝে মাঝে ফাঁকা এজন্য নিচে তাকালেই নিচের পাহাড় দূরে মাটি দেখা মিলে। হাউজটা যেন ঝুলন্ত এমন টাইপের। দুইটা খাট রুমে। একটায় রিসা আপু আর আফিয়া চলে গেল। অন্যটায় আমি আর ইভা আপু।
সাজ কড়া আলনা আছে একটা সেখানে প্রয়োজনীয় পোশাক রেখে ব্যাগ একপাশে রাখা হলো। ছোট একটা ট্রি টেবিল ও সিঙ্গেল একটা সোফা। তার পাশেই একটা ড্রেসিং টেবিল আছে। বড় একটা আয়না যেখানে নিজের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ভালো করেই দেখা যায়। আফিয়া সোফায় নিজের ব্যাগ রেখে বাথরুমে চলে গেল ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পরল। আমি চারপাশ দেখছি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের রুমের দুই রুম পরে নিবিড়দের রুম।
সবাই ফ্রেশ হলে এলে আমাকে ইভা আপু ওয়াশরুমে পাঠালো।
একেবারে গোসল করে এসেই নিজেকে ফ্রেশ লাগতে শুরু করল।
ভেজা চুল ছেড়ে বিছানার এক কোনে বসে আছি। আফিয়া আমার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালাম আর আমার দিকে এগিয়ে এলো। আমি চমকে ওঠে নিজেও উঠে দাঁড়ালাম।
আফিয়া আমার হাত ধরে টেনে আয়নার সামনে নিয়ে এলো।
আমি হকচকিয়ে গেলাম। ইভা আপু ফোন চাপতে ছিল এসব দেখে এগিয়ে এলো।
” কি করছিস?”
আফিয়া তার কথার উত্তর দিল না আয়নার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,, ” ছোঁয়া লুক। দেখো তো দুজনের মাঝে কে বেশি সুন্দরী।”
আমি তাকালাম। আফিয়া আপু একটা গাঢ় সবুজ গাউন পড়েছে হাঁটু অবধি। সাদা ছেলোয়ার ও সাদা
ওরনা গলার সাথে লাগিয়ে রেখেছে। কালার করা লম্বা চুল গুলো এক পাশ দিয়ে বুকের উপর থেকে কোমর পর্যন্ত ফেলে রাখা। ফর্সা গায়ে অপূর্ব সুন্দরী লাগছে তাকে। এখন আফিয়া একটুও সেজে নাই ফর্সা ত্বক একদম স্বচ্ছ। খুব সুন্দর লাগছে তাকে খাড়া নাক, গোলাপি ঠোঁট বড়ো বড়ো চোখ মাশাআল্লাহ। নিঃসন্দেহে তিনি সুন্দরী তালিকা থাকা মেয়েদের মধ্যে একজন। আমি এবার নিজের দিকে তাকালাম। আমার গায়ের রঙ কালো না আবার ফর্সা ও না। হলুদ করে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের। কালো চুল আমার, সেটা কোমর পর্যন্ত না, পিঠ পর্যন্ত। আমার ঠোট গোলাপি না। আমার পরনে গোলাপি রঙের সেলোয়ার কামিজ। সব মিলিয়ে আফিয়া আপুর সামনে আমি মেয়েটা খুবই অসুন্দর। কিন্তু নিজেকে আমি কখনো অসুন্দর ভাবি না। আমার এই সৌন্দর্য নিয়েই আমি যথেষ্ট খুশি।
তাই আমি আয়নার দিকে তাকিয়ে বললাম,” আমরা দুজনেই খুব সুন্দরী আপু। আপনি সাদা সুন্দরী। আমি শ্যাম সুন্দরী।”
আফিয়া হয়তো চেয়েছিল আমি ওকে সুন্দরী বলি আর নিজেকে অসুন্দর ভেবে মুখ কালো করে থাকি। কিন্তু আমি তা করিনি এজন্য আফিয়া আপু খুব রেগে গেল। আমার হাত মুচড়ে ধরে বলল,” এই চেহেরা নিয়ে তুই আমার সাথে সুন্দরী প্রতিযোগিতা করিস।”
ইভা আপু জোর করে আমাকে তার থেকে ছাড়িয়ে নিল। আর তখনি দরজায় টোকা পরল। বাইরে এসে দেখি নিবিড়রা সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাত চেপে ধরে বাইরে আসলাম। আমার চোখ ছলছল করে উঠছিল। তা সবার অগোচরে মুছে নিলাম। হাতে ব্যাথা করছে। লাল হয়ে উঠেছে আমার হাত।
নিবিড় হঠাৎ করেই আমার হাত চেপে ধরলো। আমি কিছু বলব তার আগেই টেনে হাঁটতে লাগল।
” আস্তে ধরেন ব্যাথা পাচ্ছি।”
#চলবে…….