অনাকাঙ্ক্ষিত_প্রেম #পর্ব-২০(অন্তিম পর্ব)

0
978

#অনাকাঙ্ক্ষিত_প্রেম
#পর্ব-২০(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা–ইসরাত বিনতে ইসহাক

তারপর আমিও অজু করে এসে উনার পিছনে নামাজ পড়তে শুরু করলাম,,,,

নামাজ শেষে, উনার ফোনে কল আসে। ফোন টা বেডের উপর ছিল, তো আমি দেখলাম মা কল করেছে তাই রিসিভ করলাম।

আসসালামু আলাইকুম।
মা কেমন আছো? বাসার সবাই কেমন আছেন?আলহামদুলিল্লাহ আমরা সবাই ভালো আছি। তুই কেমন আছিস মা? আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি মা, মা আমাকে মাফ করে দাও। তোমাদের জানানোর মতো পরিস্থিতিতে আমি ছিলাম না তখন।

এরকম আর কক্ষনো করবি না শরীফা, আমাদের কতোটা টেনশান হয়েছিল তুই জানিস? কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপরের দিন বাবাই বাসায় এসে তোকে দেখতে না পেয়ে, ছেলেটা কি পাগলামি শুরু করেছিল তুই যদি দেখতি।

মা আমার আব্বু কোথায়? আব্বু ঠিক আছে তো?তোর আব্বু ঠিক আছে, বাবাই তার আর্মি ফোর্স দের খবর দেয়। পরে আমার ফোনের মেসেজ এবং তোর আপুর কাছ থেকে তোদের বাড়ির ঠিকানা নিয়ে, তোদের বাড়ি ঘিরে ফেলে আর্মিরা।

তারপর তোর আব্বু কে উদ্ধার করে, সাথে কিছু ছেলেপেলে গ্রেপ্তার করে ওদের জেরা করেই জানতে পারে যে তোকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তুই এরকম ডিসিশন কেন নিলি শরীফা?

মা আমি তখন কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার ফোন নিয়ে গিয়েছিল, ভয় দেখানো হয়েছিল যে শরীফের বড় কোন ক্ষতি করে দিবে আর সাথে আব্বুর ও।আমি তখন কি করতাম তুমি বলো মা?আচ্ছা মা রাশেদ ভাই উনি তো আবার আমাদের ক্ষতি করতে চাইবেন??ঐ গুন্ডা টাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে,আর কখনোই জেল থেকে বের হতে পারবে না, এবার জেলেই পচে মরবে সয়তান টা।

শোন শরীফা তুই কোন কিছু নিয়ে টেনশান করিস না, এখন টেনশান করা একদম ঠিক হবে না তোর আর ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবি।

মা তোমার ছেলে তো আমার সাথে কথা বলে না। রেগে আছে হয়তো রাগ কমলে ঠিক কথা বলবে, চিন্তা করিস না।আর এখন থেকে বেয়াই,বেয়ান মানে তোর আব্বু আম্মু তোদের বাড়ি তেই থাকবেন।

আলহামদুলিল্লাহ,
তাহলে আমাদের আর কোন বিপদ নেই বলো?হ্যারে মা আর কোন বিপদ নেই। আচ্ছা শরীফা এখন রাখছি তুই ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করবি কিন্তু। আচ্ছা মা দোয়া করো আমাদের জন্য। তোমরা ও খাবার দাবার খেও। আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ। আল্লাহ হাফেজ।

মায়ের সাথে কথা বলে সব কিছু জানতে পেরে এখন অনেক টা হালকা লাগছে।

শরীফ অনেক কষ্ট করেছেন সারাটা দিন, সে জন্যই ঐ সময় খুব ক্লান্ত লাগছিল।

শরীফ কে খুঁজতে গিয়ে দেখি উনি ল্যাপটপ নিয়ে কিসব কাজ করছেন। আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ও কিছু বললেন না

তাই বেড রুমে ফিরে এসে পায়চারী করছি আর ভাবছি ।কি করে যে উনার রাগ ভাঙ্গবো বুঝতে পারছি না।

এগারোটার দিকে, শরীফ বাহির থেকে খাবার অর্ডার করে আনে। তারপর আমাকে খেতে যেতে বললেন আমি বললাম খাবো না আমি। তখন শরীফ বললেন, এখন কি না খেয়ে আমার সন্তান কে মারতে চাইছো??

আমি উনার এরকম কথা শুনে চমকে উঠলাম আর বললাম শরীফ আপনি এসব কি বলছেন?? কেন আজকে কি করতে গিয়েছিলে মনে নেই? আমি ইচ্ছে করে আমার সন্তান কে মারতে চাইছি? আপনি এটা বিশ্বাস করেন? তুমি একবার আমাকে জানাতে পারতে না?জানিয়েছিলে আমাকে? আমি তখন সে রকম পরিস্থিতিতে ছিলাম না।ব্যাস তোমার কোন কথা আমি শুনতে চাইছি না, এখন খেতে আসো।

এই বলে শরীফ চলে গেলেন।
চোখের পানি মুছে, গিয়ে খাবার খেয়ে নিলাম।

ঘুমানোর সময় উনি পিছন ফিরে ঘুমালেন। উনার এরকম ব্যবহারে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, উনি কেন আমাকে বুঝতে পারছেন না।

সকাল ছয়টা চৌদ্দ তে আমার ঘুম ভাঙ্গে, উঠে নামাজ পড়ে নিলাম, শরীফ মনে হয় পি.টি করতে গিয়েছেন। আমি রান্না ঘরে গিয়ে দেখি তেমন কিছু নেই যে নাস্তা তৈরি করবো। তাই বসে রইলাম।

আটটার দিকে শরীফ নাস্তা নিয়ে আসেন, তারপর দুজনে নাস্তা করে নিলাম।

এরপর শরীফ অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে,আর আমি বসে বসে দেখছি। ইউনিফর্ম পরে চুল গুলো সুন্দর করে ব্রাশ করে সেট করে নিলেন।মা শা আল্লাহ খুব সুন্দর লাগছে উনাকে ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায়। গতকাল খেয়াল করিনি, আজকে বসে বসে ভালো করে দেখছি।

উনি যাওয়ার সময় বলে গেলেন, কাজের মহিলা এসে সব কাজ করে দিবেন। আরো বললেন আমি যেন কোন কাজ না করি।

এগারোটার দিকে শরীফ বাজার করে দিয়ে গেছেন, তারপর কাজের মহিলা এসে রান্না বান্না সব কিছু করে দিয়ে গেছেন।

আমার সারাদিন কোন কাজ নেই, এভাবে কি সময় কাটে। মনে হচ্ছে ঐ বাসাতেই ভালো ছিল, মা বাবা সাইফের সাথে কথা বার্তা বলে সময় কেটে যেত।

দুপুরে শরীফ লাঞ্চ করতে আসেন। লাঞ্চ করে আবার অফিসে চলে যান।

এভাবেই পার করলাম এক সপ্তাহ, শরীফ এখনো আমার সাথে ভালো করে কথা বলেন না।

আমাকে আরেকটা নতুন ফোন কিনে দেন শরীফ।
আব্বু আম্মুর সাথে কথা বলে খুব শান্তি লাগছে।
ঠিক করেছি শরীফ ছুটি পেলেই যাবো আমাদের বাড়িতে, আপুদের ও আসতে বলবো। আমি এসব ভেবে এখনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছি।

আজকে শরীলটা কেমন যেন লাগছে, কেমন যেন দুর্বল দুর্বল লাগছে। শরীফ জানলে দুশ্চিন্তা করবেন তাই উনাকে কিছু জানাইনি।

দুপুরে শরীফ লাঞ্চ করতে আসলে, খাবার টেবিলের কাছে যেতে পা বাড়াতেই মাথা ঘুরে পড়ে যেতে নিলে শরীফ এসে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেন। আমার এই অবস্থা দেখে উনি খুব উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন শরীফা তোমার কি হয়েছে? আমাকে বলো কেমন ফিল হচ্ছে? চলো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।

উনি কি করবেন না করবেন বুঝতে পারছেন না। আমি উনার কান্ড দেখে বললাম আমি ঠিক আছি, আপনি এতো উত্তেজিত হবেন না। কিন্তু উনি আমার কোন কথা শুনলেন না। আমাকে খাবার খাইয়ে হসপিটালে নিয়ে গেলেন।

ডাক্তার কিছু টেস্ট দিলেন। তারপর টেস্টের রিপোর্ট দেখে বললেন রক্ত শূন্যতা যার ফলে এরকম হচ্ছে। বেশি বেশি খাবার খেতে হবে আর টেনশান যেন না করি।

বাসায় আসার পথে শরীফ অনেক ফলমূল কিনে আনলেন।

আমি ফ্রেস হয়ে আসতেই শরীফ অনেক গুলো ফল কেটে এনে বলেন এগুলো সব আমাকে খেতে হবে। আমি বলি খাবো, তবে আপনাকেও খেতে হবে। উনি প্রথমে খেতে চাননি পরে আমার জোরাজুরি তে খেতে বাধ্য হন।

ফল খাওয়া শেষে, আমি বললাম আমার উপর এখনো রেগে আছেন? উনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, তোমার কিছু হলে আমার কি হতো বলো তো?আর তুমি এরকম একটা ডিশিসন কি করে নিলে? আমার সন্তান কে,,,
আর কিছু বলতে পারলেন না, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। আমি ও এবার কেঁদে দিলাম।আর বললাম এরকম ভুল আমি আর কখনো করবো না। আমাকে মাফ করে দিন।

ধীরে ধীরে উনি শান্ত হলেন। তারপর বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই জরিয়ে রাখলেন আমাকে।

আমাদের সম্পর্ক টা আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছে, অবশ্য আগের মতো বললে ভুল হবে আগের চেয়েও মধুর হয়েছে।

আর উনাকে এখন আমি তুমি করে এবং শরীফ বলে ডাকি। উনার ইচ্ছে তেই ডাকা। তবে আমার কাছে আপনি করে সম্বোধন টাই বেশি ভালো লাগে বা লাগতো।

যাই হোক ও আমার প্রতি এতো যত্নশীল কি বলবো।
একটা ছেলে কতটা ধের্য্যশীল হতে পারে, কতটা কেয়ার করতে পারে সেটা আমি আমার প্রেগন্যান্সি টাইমে বুঝেছি।আমার নানা ধরনের শারীরিক জটিলতার জন্য ডক্টর নিষেধ করে দিয়েছিল কোন ধরনের ইন্টিমেসি যেন না হয় ডেলিভারি শেষ হয়ে সুস্থ হওয়া অব্দি।

এই মানুষ টা কে আমি প্রেগ্ন্যাসির সময়ে কখনো ঘুমাতে দেখি নি পরিপূর্ণ ভাবে। এতো টা কেয়ার,এতো টা অস্তিরতা আমার জন্য। এক বিছানায় পাশাপাশি দুজন অথচ তার চোখে আমি শুধু আমার জন্য মায়া দেখেছি,ভালবাসা দেখেছি, অস্থিরতা দেখেছি। ও সব সময় বলে এক বছর কোন ব্যাপার হলো। তুমি সুস্থ হও, বেবি টা সুস্থ ভাবে আসুক তারপর আবার সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।

একটা মানুষ ঠিক কতখানি ভাল হতে পারে সেটা আমি ওরে না দেখলে বুঝতে পারতাম না। এই মানুষ টা কে নিজের থেকেও বেশী ভালবাসি। মানুষ টার ব্যক্তিত্ত্বের প্রেমে পড়েছিলাম। শুধু একটাই আফসোস, আরও আগে কেন দেখা হলো না ওর সাথে!!

ভালবাসার চেয়ে পবিত্র আর কিছু নেই, কথা টা একদম সত্যি। আমি প্রেমে পড়ি তাও প্রতিদিন প্রতি মুহুর্তে এই মানুষ টার প্রেমে পড়ি

আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহ সব কিছুর জন্য।

আমি শরীফ কে বলেছি আমার যদি মেয়ে বেবি না হয় তবে ওর খবর আছে!! শরীফ আমার কথা শুনে আশ্চর্য হয়ে বলে এখানে আমার দোষ কি? আমি বলি যে স্বামী তার স্ত্রীকে ভালোবাসে ঐ স্ত্রীর প্রথম কন্যা সন্তান হয়। তো সে অনুযায়ী দোষ টা তোমারি হবে।

আমার কথা শুনে শরীফ বলে, আচ্ছা তাহলে আমি বুঝি তোমাকে ভালোবাসি না??ভাসো তবে কম। আচ্ছা তাই না? আসো তোমাকে এবার বেশি বেশি ভালোবাসবো। আমি এবার নিজের ফান্দে নিজেই পরে গেলাম।

নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছে,যার কারণে ওর মতো স্বামী পেয়েছি আমি।ওর অনেক কাজ করতে হয় অফিসের, বাসায় এসে ও শান্তি নেই।ও যখন কাজ করে তখন আমি পাশে বসে বসে দেখি আর না হয় ওর কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পরি।আর ও এমনভাবেই কাজ করতে থাকেন। আমি এতো বিরক্ত করার পরেও ও একটুও বিরক্ত বোধ করেন না।

কোন ছেলে তার স্ত্রী কে এতো টা ভালোবাসতে পারে ওকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস ই করবে না।

ওর ছুটির দিনে আমাকে প্রায় সময় হাঁটতে নিয়ে যান, কোয়ার্টার টা খুব বড় এরিয়া নিয়ে করা। কোয়ার্টার আর অফিস পাশাপাশি,তাই বিশাল জায়গা নিয়ে করা। আশেপাশে ঘুরতে খুব ভালো লাগে আমার, চারিদিকে প্রকৃতির সুন্দর্যো খুবই ভালো লাগে।

এভাবেই আনন্দে কাটছে আমার দিন গুলো।মাঝ খানে শরীফের ছুটি তে বাবার বাসা শ্বশুর বাসা থেকে ঘুরে আসি আমরা।

দেখতে দেখতে আমার দশ মাস শেষ হয়ে এলো। একদিন পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়, শরীফ অফিসে থাকে। আমি ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে শরীফ কে কল করি তারপর আমাকে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়। সারাদিন ব্যাথায় ছটফট করি, কিন্তু কিছুতেই সিজার করতে রাজি হ‌ইনা। শরীফ আমাকে অনেক বুঝায়, কিন্তু আমি রাজি হ‌ইনা, অপারেশন খুব ভয় পাই আমি। তাই ব্যাথা সহ্য করেই অবশেষে আল্লাহ তা’আলার রহমতে শেষ রাতের দিকে, আমার ছোট্ট শোনা মনি আমার কোল জুড়ে আসে।

সবাই খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে। তারপর সবার মুখে হাসি ফুটে উঠে। শরীফ তো মহা খুশি,ওর খুশি দেখে নিজেকে সার্থক মনে হয়।

শরীফ তার মেয়ের নাম রাখে “ওয়াশিয়া মারজানা শাফিরা”

সবাই ভিডিও কলে শাফিরা কে দেখে নেয়।

ডেলিভারি নরমালে হ‌ওয়ায় এরপরের দিন ই আমাকে রিলিজ করে দেয় হসপিটাল থেকে।

দুই বাসার লোকজন ই অস্তির হয়ে পড়েছে শাফিরা কে দেখার জন্য,তাই একটু পর পর ভিডিও কল করে সবাই।

এখন শরীফ আমাদের দুজনকেই অনেক কেয়ার করে। শরীফ যখনি আমার সাথে দুষ্টুমি করতে আসে ঠিক তখনি শাফিরা কেঁদে উঠে আর এদিকে শরীফের রোমান্স এর বারোটা বেজে যায়। শরীফের করুন অবস্থা দেখে আমি তখন হাসতে হাসতে শেষ হ‌ই।

? সমাপ্ত ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here