শূন্য_আঁধার [১]

0
834

#শূন্য_আঁধার [১]
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার মৃত্যু হচ্ছে। আমি ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে টলে পড়ছি কিন্তু কিচ্ছু করতে পারছি না,কিচ্ছু না! মৃত্যু আমার সম্মুখে!

মাঝরাত থেকে আমার প্রচন্ড ভয় লাগছে।মৃত্যুর ভয় না,! আমার সন্তানকে দেখতে না পাওয়ার ভয়।আমি আগে থেকেই জানতাম আজ আমার মৃত্যু হবে।কিভাবে হবে সেটাও জানি।আমার পেটে যে সন্তান বেড়ে উঠছে তাকে জন্ম দিতে গিয়েই আমি মারা যাবো।পাশেই জয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।ওর গা ঝাকিয়ে কয়েকবার ডাকলাম,কিন্তু ঘুমের মধ্যেই উুঃ উুঃ করলো,কিন্তু উঠলো না,হয়তো সারাদিনের অফিস করে খুব ক্লান্ত সে।আমি কষ্ট সহ্য করতে না পেরে এবার একটু জোরেই ওকে ধাক্কা দিলাম।জয় ঘুমঘুম নিয়ে বিরক্তির স্বরে বললো

” কি হয়েছে? সমস্যা কি? ”

” আমি মারা যাচ্ছি জয়! ”

” প্রতিদিন একই কথা ভালোলাগে না।তুমি দেখছি আমায় পাগল না বানিয়ে ছাড়বে না।আমার সকালে উঠতে হয়,প্রতিদিন এসব নাটক ভালোলাগছে না ”

” আমি সত্যি বলছি,ধীরে ধীরে আমার মৃত্যু হচ্ছে ”

” সারাদিন অফিস করে আমি অনেক ক্লান্ত তনু,প্লিজ রসিকতা বন্ধ করো।ঘুমাও ”

” আচ্ছা ”

জয়কে আর কিছু বললাম না।শুধু শুধু ওকে ডেকেই বা কি হবে,ও তো আমার মৃত্যু আটকাতে পারবে না।যখন আমি প্রথম বুঝতে পারি আমার পেটের বাবুটার জন্ম দিতে গিয়েই আমি মারা যাবো তখন জয়কে বিষয়টা জানাই।জয় তখন হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলো

” তোমার মাথা ঠিক আছে? ”

” হ্যা, আমার মাথা শরীর সব ঠিক আছে।আমি সত্যিই মারা যাবো ”

জয় তাচ্ছিল্যর মতো করে বললো ” তা কিভাবে মারা যাবে? ছাঁদ থেকে লাফিয়ে? না ইঁদুর মারা বিষ খেয়ে? ”

” আমি হসপিটালের মারা যাবো,সেখানে ছাঁদ,ইঁদুর মারার বিষ এগুলো পাবো কোথায়? ”

তনুর কথা শুনে জয় একটু নড়েচড়ে বসলো।তনুর কাছে ঝুকে এসে বললো ” হঠাৎ এমন কেনো মনে হচ্ছে তোমার? ”

” কেন মনে হচ্ছে সেটা বলতে পারবো না।শুধু তোমায় জানিয়ে দিলাম ”

” আমি তো এখন জেনে গেলাম,আর কিছু জানাবে? আমার অফিসের কিছু কাজ আছে সেগুলো করি এখন? ”

” করো,যত কাজ আছে করো ”

তারপর কিছুদিন পরপরই ওর সাথে এই বিষয়ে কথা বলতাম যেমন,আমি মারা গেলে ও দ্বিতীয় বিবাহ করবে কি না,আমায় ভুলে যাবে কি না,মাঝরাতে কে চা বানিয়ে দিবে,আরো কতো কি! জয় শুধু হু, হু করতো।কখনো আমার কথা বিশ্বাস করতো না।বিশ্বাস করার মতোও তো কোনো কথা আমি বলিনি।আমার মৃত্যু হবে সেটা আমি নিজেই জানি,কখন হবে, কেন হবে সেটাও জানি, বিষয়টা নিতান্তই হাস্যকর,তবুও এটাই যে সত্যি সেটা কখনো জয়কে বোঝাতে পারিনি।

বাবুটার পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে আসছে, তখন থেকেই আমার মনে চাপা একটা ভয় হতে শুরু করে।গত দুইদিন থেকে ঘরের সব বাতি জ্বালিয়ে রাখি।আজকেও বাতি জ্বলছে।সারা ঘরে আলোরা খেলা করছে,তবুও মনে হচ্ছে চোখের সামনে সবকিছু কেমন যেন ছায়া ছায়া হয়ে যাচ্ছে।সবকিছু কেমন ধোঁয়াশার মতো লাগছে।মনে হচ্ছে সারা শরীর ধীরে ধীরে কর্পূরের মতো উড়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতরটা চিনচিন ব্যাথা করছে।পেটের বাবুটা এখন কেন জানি নড়াচড়া করছে না,সেও কি বুঝতে পারছে?তার মায়ের মৃত্যু হচ্ছে? তাই পেটে লাফঝাপ বন্ধ করে চুপ করে আছে?।তলপেট থেকে একটা ব্যাথা চিনচিন করে মাথা অব্দি উঠে যাচ্ছে,এটাই কি মৃত্যুর যন্ত্রনা?

কিছুক্ষন আগে তনুর কথা শুনে জয়ের ঘুম পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। অন্য পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করেই জেগে আছে।মনে মনে ভাবছে,তনু কি অন্যবারের মতো এখনও মজা করছে? ও এরকম মজা করে কি আনন্দ পায়? এখন তো আমাদের বাবুর পৃথিবীতে আসার সময় হয়ে গেছে,এখন অন্তত ওর এ ধরনের মজা করা উচিৎ নয়।এসব ভাবছে জয়, তখনই জয় বুঝতে পারলো বিছানাটা কাঁপছে। জয় পাশ ফিরে তনুর দিকে তাকাতেই ধরফর করে উঠে বসলো। ভয়ার্ত স্বরে তনুর হাত চেপে ধরে বললো

” তনু কি হয়েছে? কি হয়েছে তোমার? এভাবে তোমার সারা শরীর কাঁপছে কেন? তনু চোখ খোলো,তনু? ”

তনু কোনো কথা বলছে না।শুধু চাপা একটা আওয়াজ করছে,সাথে মুখ বারবার বেঁকে যাচ্ছে,আর সারা শরীর ধনুকের মতো বাঁকা করছে।এক হাতে তনুর হাত চেপে ধরে আরেক হাতে বালিশের কাছে থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ড্রাইভারকে ফোন করে বললো গাড়ি বেড় করতে, তনুকে হসপিটালে নিতে হবে। ফোনটা কেটে দিয়ে জয় তনুর গালে হাল্কাভাবে থাপ্পড় দিতে দিতে বললো

” এই তনু,চোখ খোলো না, কি হলো তোমার? আমি তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না,চোখ বন্ধ করে রেখো না, চোখ খোলো, এমন সময় চোখ খোলা রাখতে হয় তনু,”

জয়ের কথা তনু শুনতে পাচ্ছে, আবছা আবছা ভাবে জয়কে দেখতেও পাচ্ছে।কিন্তু সে কোনোভাবেই চোখ মেলতে পারছে না।শুধু মুখ দিয়ে গোঙ্গানির শব্দ হতে লাগলো।তনুর মনে হচ্ছে তার সময় ফুরিয়ে আসছে,তার খুব ইচ্ছে ছিলো তার সন্তানকে দেখে যেতে,কিন্তু সেটা হয়তো আর কখনো সম্ভব না।তনুর মনে হতে লাগলো তার সারা শরীর হাল্কা হয়ে আসছে,শরীরের প্রতিটি অংশ ধীরে ধীরে শূন্যতে মিলিয়ে যাচ্ছে।

গাড়িতে উঠেই জয় লক্ষ্য করলো তনুর সারা শরীর জমতে শুরু করেছে।রক্তপ্রবাহ অচল হয়ে যাচ্ছে। জয় সবসময় তনুর হাত ও পায়ের তালু ঘষছে আর ড্রাইভারকে বারবার বলছে তারতারি ড্রাইভ করতে।

হসপিটালে পৌঁছার সাথে সাথে তনুকে নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো।জয় তনুর সাথে ভেতরে যেতে চাইলে তাকে বাইরেই অপেক্ষা করতে বলা হলো।জয় শুধু ছটফট করছে,এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। এই মুহূর্তে তার কি করা উচিৎ সে বুঝতে পারছে না।আকস্মিক ঘটনায় সে একদম ঘাবড়ে গেছে।

জয়ের একবার মনে হলো তাদের বাবা-মাকে বিষয়টা জানানো দরকার।কিন্তু তার বাবা,মা থাকেন গ্রামের বাড়িতে।এতো রাতে তো তারা আসতে পারবেন না,শুধু শুধু তাদের চিন্তায় ফেলার কোনো মানে হয় না।কাল সকালে বললেই হবে।তনুর বাবা,মা শহরেই থাকে।তাদের বলা যেতে পারে।

জয় কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা হাতে নিলো, কয়েকবার রিং হয়ে ওপাশ থেকে ফোন ধরলো।গম্ভীর স্বরে বললো

” জয়,এতো রাতে ফোন করছো,সব ঠিক আছে তো? ”

” বাবা, তনুর শরীর হঠাৎ খারাপ হয়েছে,ওকে ক্লিনিকে নিয়ে এসছি ”

” তনু অসুস্থ ? কি হয়েছে ওর ? ”

“আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি হয়েছে,হঠাৎ মাঝরাতে ওর সারা শরীর কাঁপতে লাগলো, আমি ভয় পেয়ে ক্লিনিকে নিয়ে এসছি ”

” আচ্ছা আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।কোন ক্লিনিকে আছো? ”

” হেল্থ প্রাইভেট ক্লিনিকে ”

” আচ্ছা আমি আসছি,তুৃমি চিন্তা করো না,সব ঠিক হয়ে যাবে ”

ডাক্তাররা ওটিতে নিয়ে গিয়ে স্টেথোস্কোপটা তনুর বু’কে ধরতেই বুঝলো তনুর নার্ভ একদম শান্ত,অর্থাৎ সে মারা গেছে।হয়তো দুই,তিন মিনিট হয়েছে তার মারা যাওয়ার।ডাক্তারদের মাথায় হঠাৎ শয়তান ভর করলো,নোংরা একটা কাজ তাদের মাথায় চেপে বসলো,তারা একে অপরের দিকে তাকালো।তাদের উদ্দেশ্য তনুর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অঙ্গ সরিয়ে ফেলা।অপারেশনের নাম করে দুজন ডাক্তার ষরযন্ত্র তনুকে লাশ কাটা ঘরে নিয়ে গেলো।

ইতোমধ্যে ডোম তনুর শরীরে অস্ত্রোপচার শুরু করে দিয়েছে।দু’জন ডাক্তারের মধ্যে একজন আরেকজন ডাক্তারকে বললো,

” স্যার এটা কি ঠিক হচ্ছে? যদি আমরা ধরা পড়ে যাই কেনো ভাবে? ”

” ধরা পড়া বলতে রোগীর পরিবারের কথা বলছো তো? বিষয়টা তারা বুঝতেই পারবে না।আর বুঝতে পারলে কিছু টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করিয়ে দিবো।মৃত লাশের বিনিময়ে টাকা পাচ্ছে এই বা কম কি?

” কিন্তু স্যার ইনি তো অন্তঃসত্ত্বা,এনার ক্ষেত্রে আমার মন সায় দিচ্ছে না ”

” এতে আবেগ নিয়ে ডাক্তার হওয়া যায় না।এনাকে দেখো,যুবতী একটা মেয়ে।এর শরীরের সব অঙ্গ একদম টাটকা।ভালো ডলারে সা*প্লাই দিতে পারবো।বিদেশিরা এমন যুবতী মেয়ের শরীরের অ*ঙ্গ বিলিয়ন ডলারে কিনতে আগ্রহী ”

তাদের কথাবার্তা চলাকালীন সময়ে ডোম,অর্থাৎ যে লাশ কাট*ছে, তার হাতের অস্ত্র মেঝেতে ফেলে দিয়ে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে গেলো। ডাক্তার ডোমের উদ্দেশ্য বললো

” কি হয়েছে? ভূত দেখে ফেললে নাকি? এভাবে অস্ত্র ফেলে দেওয়ার মানে কি ”

” স্যা…স্যা..স্যার ”

” কি হয়েছে? সমস্যা কি,? তোতলাচ্ছ কেন? ”

” স্যা..স্যার এনার পে*টের বাচ্চাটা মনে হলো বেঁচে আছে ”

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here