শূন্য_আঁধার [২]

0
555

#শূন্য_আঁধার [২]
#জয়ন্ত_কুমার_জয়

তাদের কথাবার্তা চলাকালীন সময়ে ডোম তার হাতের কা*চি মেঝেতে ফেলে দিয়ে বিকট একটা চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে গেলো। ডাক্তার ডোমের উদ্দেশ্য বললো

” কি হয়েছে? ”

” স্যা…স্যা..স্যার ”

” কি হয়েছে? সমস্যা কি,? তোতলাচ্ছ কেন? ”

” স্যা..স্যার এনার পে*টের বা*চ্চাটা মনে হলো বেঁচে আছে ”

দু’জন ডাক্তার একে অপরের দিকে তাকালো।তাচ্ছিল্যের স্বরে ডোমকে উদ্দেশ্য করে বললো

” বাড়িতে বউয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি? না পেট খারাপ? ”

ডোম ভয়ার্ত স্বরে জবাব দিলো

” স্যার আমি সত্যি দেখেছি,,বা*চ্চাটা কেমন ন*ড়েচ*ড়ে উঠেছিলো ”

ডোমের কথা শুনে দু’জন ডাক্তারের মধ্যে প্রথম জন এগিয়ে এলো ডেড*বডির কাছে।এক হাতে নাক চেপে ধরলো কাছে এসে এক পলকে চেয়ে রইলো ডেড*বডির পে*টে থাকা নবজাতকের দিকে।বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ডোমের উদ্দেশ্য বললো

” কোথায় ন*ড়ছে? আমি তো নড়া*চড়া টের পাচ্ছি না।দেখে মনে হচ্ছে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে ”

ডাক্তারের কথা শুনে ডোম কাছে এসে একবার ভয়ার্ত চোখে তাকালো।তারপর লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বললো

” সরি স্যার, চোখের ভুল হয়েছিল মনে হয়।কিন্তু আমি তো স্পষ্ট দেখছিলাম বা*চ্চাটা নড়*ছিলো ”

” এতো কথা না বলে কাজটা করো তারাতাড়ি, সময় নেই বেশি ”

বলেই প্রথম ডাক্তার দ্বিতীয় ডাক্তারের কাছে এসে দারালেন।ডোম তার কাজ শুরু করলো।ডাক্তার দু’জনার নাম সেলিম ও বরকত।সেলিম লক্ষ্য করছে বরকত খুব ভয় পেয়ে আছে,তার কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। সেলিম স্বাভাবিক স্বরে বললো

” কি হয়েছে? ঘামছো কেন ? শরীর খারাপ?”

” আসলে স্যার আমার বিষয়টা খুব খারাপ লাগছে ”

” দেখো বরকত,তুমি এই হসপিটালে নতুন এসেছো।আমি এখানে কত বছর থেকে আছি যানো? দশ বছর ধরে।এই দশ বছরে এমন অনেক অপা*রেশন আমি করিয়ে নিয়েছি।তুমি ভয় পেয়ো না, কিচ্ছু হবে না।এতো আবেগ রাখা ঠিক না,”

বরকতের মনে সেলিমের প্রতি তীব্র ঘৃণার জন্ম তৈরি হলো।একটা ডাক্তার হয়ে সে কিভাবে এটা করতে পারে?।বরকত ঠিক করলো এখানে আর এক মূহুর্ত থাকবে না।তখনই ডাঃসেলিম বললেন

” বুঝলে বরকত,বাঙালীর অবস্থা হয়েছে অনেকটা শামুকের মতো। যে জলে থাকে সেই জল কখনো খায় না,তারা শুধু বৃষ্টির জল খায়,কারন বৃষ্টির জল দূর্লভ,দূর্লভ জিনিসের প্রতি ভালোবাসার শেষ নাই ”

বরকত চুপ করে থাকলো।সে এখানে নতুন এসেছে।তার সিনিয়র ডাঃ সেলিম।তাকে উপেক্ষা করে এই মুহূর্তে চলে যাওয়াটা এক ধরনের অভদ্রতা হবে, তাই বরকত চুপ করে দারিয়ে রইলো।ডাঃ সেলিম আবারো বললেন

” কেন বললাম একথা জিগ্যেস করবে না? ”

” কেন স্যার? ”

” দেখবে আমাদের দেশের মানুষরা টাকা পয়সা খরচ করে বাইরে যায় চিকিৎসার জন্য। সেখানে নাকি ভালো চিকিৎসা হয়।আরে মূ*র্খের দল, আমরা কি উড়ে উড়ে এসেছি নাকি? আমরা কি চিকিৎসা দিতে পারি না? অন্যর দেশে কেন যেতে হবে? নিজের দেশের ওপর আস্থা এদের আসবে কবে?”

” জি স্যার ঠিক বলছেন ” বাধ্য হয়ে তালে তাল মিলিয়ে বললেন।

” এই কাজটা তোমার কাছে কাছে কি মনে হয় বরকত? ভালো না খারাপ? ”

” খুবই জ*ঘন্য।পি*শাচ ও এই কাজ করবে না।”

” কেন এটা করছি সেটা শুনলে তোমার রাগ থাকবে না,শুনতে চাও? ”

” না স্যার ”

” তোমার চোখে মুখে আমার প্রতি ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি,সেটা দূর করা দরকার।শোনো, বিদেশে চারটা বড় বড় হসপিটালে আমার পাঁচ জন বন্ধু আছে।আমরা একসাথে পড়ালেখা করেছি।আমরা ঠিক করেছিলাম অসহায় মানুষের পাশে দারাবো,”

” এটা কি পাশে দারানো? ”

” পুরে কথা শোনো আগে।আমরা ঠিক করলাম যারা খুবই অসহায় তাদের সাহায্য করবো।তুমি হয়তো জানো এই সব অ*ঙ্গ অন্য শরী*রে স্হা*পন করার মেডিকেল চার্জ কতো বেশি।এটা অসহায় মানুষের পক্ষে সম্ভব না।এই যে এসব যে আমি সরিয়ে ফেলি সেটা কোথায় যায় জানো? সেই হসপিটালে,যেখানে এই সবের মাধ্যমে অন্য একটা জীবন সুন্দর হয়ে যায়,বেঁচে যায়! জীবন্ত মানুষের শ*রীর নেওয়া পাপ,মৃ*ত শরীরের অ*ঙ্গ নেওয়া পাপ না, ”

বরকত লক্ষ্য করলো কথাগুলি বলতে বলতে ডাঃসেলিমের গলা ধরে আসছে।তিনি সম্ভবত কান্না করছেন,অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে না।লোকটাকে বরকত যতোটা খারাপ ভেবেছিলো, লোকটা তার চেয়েও বেশি ভালো।বরকতের চোখেও পানি চলে এলো,এতো ভালো মানুষ সে আগে দেখেনি।বরকত তার পা ছুঁয়ে সালাম করলেন।ডাঃসেলিম বললেন

” একবার ভাবো বরকত,মৃ*ত শরী*রে অংশ নিয়ে একটা জীব*ন্ত শরীর বেঁচে থাকবে,”

ডোম দ্বিতীয় বারের মতো একটা চিৎকার দিয়ে পিছিয়ে গেলো।ভয়ার্ত স্বরে বললো

“স্যার, আবার নড়ছে,এইবার আমি স্পষ্ট দেখছি,চোখ খুলে আমার দিকে তাকাইছে,”

ডাঃসেলিম ডোমের কথা শুনে একট অবাক হলেন।প্রথমবার ভুল হয়,দ্বিতীয় বার নয়।তিনি ডে*ডবডির কাছে এসে দেখতেই তার সারা শরীর হীম হয়ে আসলো।কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো,। ডাঃসেলিম দেখছেন তার সামনে রাখা ডে*ড ব*ডির পে*টের বাচ্চাটা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে।নবজাতক যেমন ভয়ংকর ভাবে তাকায় ঠিক তেমনি ভাবে তাকিয়ে আছে।এটা কি ভাবে সম্ভব? মৃ*ত শরীরে এতোক্ষণ পরেও এই নবজাতক বেঁ*চে আছে কি করে? এর মা মা*রা গেছে বিশ মিনিটের মতো হয়ে গেলো,এই বিশ মিনিটে এই বাচ্চাটার তো অক্সিজেনের অভাবে মা*রা যাওয়ার কথা? তাহলে বেঁচে আছে কিভাবে?

ডাঃসেলিমের থম মেরে দারিয়ে থাকা দেখে বরকত কাছে এলো।বরকত কাছে এসে দেখলো নবযাতক চোখ পিটপিট করছে,সেই চোখে শুধুই শূন্যতা।

__________

তনু দেখছে সে অন্ধকার একটা ঘরে বেডে শুয়ে আছে।ওপরে একটা বাল্ব জ্বলজ্বল করছে,সেই বাল্বের আলো শুধু বেডে পড়ছে।তনু উঠে বসলো।উঠে বসতেই মনে হলো তার শরীর খুব হালকা হয়ে গেছে,একদম বাতাসের মতো।পাশে তাকাতেই দেখলো অ্যাপ্রোন গায়ে দিয়ে একজন থম মেরে দারিয়ে আছে,তার যেন চোখের পলক পড়ছে না।তার এরুপ চাহনিতে তনুর অস্বস্তি হতে লাগলো।তনু সোজা উঠে দরজাতে হাত রাখতেই দরজা ভেদ করে দরজার ওপাশে চলে গেলো।তনু হতভম্ব হয়ে দরজার দিকে তাকালো।ব্যাপার কি?এভাবে বেড়িয়ে এলাম কিভাবে? দরজা তো বন্ধ, না খুলেই দরকার ভেতর দিয়ে আমি বেড় হলাম কিভাবে?।বিষ্ময়কর চোখে আশেপাশে তাকালো তনু।এই যায়গাটা কেমন যেন বদ্ধ লাগছে।তনু এক পা এক পা করে সামনে যেতে যেতেই দেখলো সামনেই জয় পায়চারি করছে।একবার এদিক,একবার ওদিক যাচ্ছে, আর ঘনঘন তার ডানদিকের রুমে তাকাচ্ছে। তনু ডানদিকের রুমটার দিকে তাকালো,রুমের ওপরে লেখা ও.টি।তনুর সব মনে পড়ে গেলো,মনে পড়লো তার সন্তানের কথা,মৃ*ত্যু যন্ত্রনার কথা,হসপিটালে আসার কথা।এসব মনপ করতেই তবুর বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠলো।নিজের পে*টের দিকে তাকালো তনু।দেখলো পে*ট স্বাভাবিক হয়ে আছে।মানে কি? আমার পেটে যে আমাদের বাবু ছিলো? সে গেলো কোথায়? তার কি জন্ম হয়ে গেছে? তাহলে আমি এখানে কেন,আমার বাচ্চা কোথায়?।

তনু ছুটতে লাগলো জয়ের দিকে।জয়ের কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো

” জয় আমাদের বাবু কোথায়? তুমি শুনছো? আমাদের বাবু কোথায়? কোথাও দেখতে পাচ্ছি না কেন ওকে? ”

জয় কোনো জবাব দিচ্ছে না।এমনকি তনুর দিকে তাকাচ্ছেও না।তনু তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জয়ের দিকে তাকালো,জয়ের আরো কাছে গিয়ে চেচিয়ে বললো

” কি হলো জয় আমার কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন? আমি কি বলছি তোমার কানে যাচ্ছে না? আমার বাবু কোথায়? জয় কথা বলো, কি হয়েছে তোমার? আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছো? ”

এবারেও জয় কিচ্ছু শুনতে পেলো না।সপ নিজের মতোই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে,কাকে কাকে যেন ফোন করছে।মনে হচ্ছে তনুকে তার নজরেই পড়ছে না,তনু যেন অদৃশ্য হয়ে গেছে।

ও.টির দরজা খুলে কয়েকজন ডাক্তার বেরিয়ে এলো।তনু হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তারের কাছে জানতে চাইলো তার বাচ্চা কোথায়,কিন্তু তারাও যেন তনুকে দেখতে পাচ্ছে না এমন ভঙ্গি করলো।তনু বুঝতে পারছে না কেন তাকে সবাই না দেখার ভান করছে।দরজা থেকে উঁকি দিয়ে বেডে থাকা মেয়েটিকে দেখে তনুর শরীর
র*ক্তশূ*ণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।মুখ দিয়ে যেন কোনো কথা বেরুচ্ছে না,শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে।মেয়েটি আর কেউ নয়,সে নিজেই।তনু দেখলো সে নিজেই বেডে শুয়ে আছে।

চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here