#শূন্য_আঁধার [৩]
#জয়ন্ত_কুমার_জয়
দরজা থেকে উঁকি দিয়ে বেডে থাকা মেয়েটিকে দেখে তনুর শরীর রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে গেলো।মুখ দিয়ে যেন কোনো কথা বেরুচ্ছে না,শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে।মেয়েটি আর কেউ নয়,সে নিজেই।তনু দেখলো সে নিজেই বেডে শুয়ে আছে।
তনু এক পা এক পা করে কাছে এগিয়ে যাচ্ছে বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটির কাছে।যতোই কাছে যাচ্ছে ততই বুকের ভেতরটা কেমন যেন শূন্যতা অনুভব করছে।এটা কিভাবে সম্ভব?এই তো আমি দারিয়ে আছি,তাহলে বেডে এই অবিকল আমার মতো দেখতে মেয়েটা কে?
তনু অবিকল নিজের মতো দেখতে মেয়েটার গালে স্পর্শ করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।গালে হাত দিতেই তনুর চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো।একি কান্ড? আমি স্পর্শ করতে পারছি না কেন?।
তনু যতবারই স্পর্শ করার জন্য গালে হাত ছোঁয়ানোর চেষ্টা করছে ততবারই হাত শরীর ভেদ করে নিচে নেমে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে তনু আলোর তৈরী কোনো কিছু,যা কোনোকিছুকে স্পর্শ করতে পারে না।তনু বুঝতে পারছে না এসব কি হচ্ছে। তনু সামনে থাকা মেয়েটার দিকে একপলক তাকালো।কি মিষ্টি মুখ,শরীরে জল নেমে হাত,পা ফুলে গেছে,তবুও লাবন্যর এতোটুকুও কমতি নেই,মেয়েটির গলা অব্দি সাদা চাদরে ঢাকা।শুধু মুখখানা বেড় হয়ে আছে।সেই মুখে কিছুটা বিষন্নের ছিটেফোঁটা।
একজন নার্স এসে তনুর ডে*ডবডির সারা শরীর সাদা কাপড়ে আবৃত করলেন।নার্সের মুখে একটু দুখি দুখি ভাব।তনু বাহিরে বেড় হয়ে এলো।দেখলো ডাক্তারের কাছে জয় এগিয়ে গেলো।জয় কি বলবে সেটা শোনার জন্য তনু দ্রুত কাছে এলো।শুমতে পেলো ডাক্তার বলছে
” আঃ বিষয়টা খুবই দুঃখজনক,আসলে আমরা পেসেন্টকে বাঁচাতে পারিনি।উই আর এক্সট্রিমলি সরি ”
কথাটা শুনে জয় বিষ্য়য় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ডাক্তারের প্রতি।ইতোমধ্যে তনুর বাবা মাও উপস্থিত হয়েছেন।তনুর মা কান্নায় মূরছা যাচ্ছেন বারবার,তার পাশেই গালে হাত দিয়ে বসে আছেন তনুর বাবা।তনু নিজেও ডাক্তারের কথা গুলি শুনলো।বেশকিছুক্ষন সময় লাগলো এটা বুঝতে যে সে আর বেঁচে নেই,সে মারা গেছে।
তনু এক পা এক পা করে বাবা মায়ের কাছে গিয়ে দারালো। মায়াবী স্বরে বললো
” মা তুমি কেদো না,এইতো আমি দেখো,তোমার তনু তোমার সামনে, তোমরা কেউ আমায় দেখতে পাচ্ছো না কেন? ”
এরপর সেখান থেকে জয়ের কাছে গিয়ে বেশকিছুক্ষন কথা বললো তনু।কিন্তু জয় কোনো উত্তর দেয় নি।নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো বেডে থাকা তনুর মৃত শরীরের প্রতি।
____________
লাশ কা*টা ঘরে বেডের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ফুটফুটে একটা মেয়ে বাচ্চা।যার জন্ম স্বাভাবিকভাবে হয়নি।একটা মৃ*ত শরীরের ভেতর থেকে তার জন্ম।বাচ্চাটিকে দূর হতে রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে মুখ নিয়ে দেখছে ডোম এবং দুজন ডাক্তার। তারা দ্বিধা দন্দে পড়ে আছেন।এই রহস্যর কোনো সমাধান তাদের জানা নেই।বরকত ভয় ভয় নিয়ে ফিসফিস করে বললো
” স্যার এই বাচ্চাকে নিয়ে এখন কি করবো? ”
ডাঃসেলিম ক্ষীণ স্বরে বললো ” কি আর করবো, যার বাচ্চা তাকে দিয়ে দিবো, ”
” কিন্তু স্যার এখন এই বাচ্চাকে নিয়ে যাবেন কিভাবে? এতোক্ষণে তো পেসেন্টের ডেডবডি তাদের বাড়ির লোকের হাতে পৌঁছে গেছে।তারা হয়তো ভেবে নিয়েছে অপারেশনের আগেই তিনি মারা গেছেন।এতো পরে বাচ্চাটাকে নিয়ে গেলে যদি আমরা কোনো বিপদে পড়ি? ”
” সেটা তেমন কোনো বড় বিষয় না।ওনার পেটে সে*লাইয়ের দাগ তো আছেই।ডোম নিজ হাতে শে*লাই দিয়েছে।আমরা বলবো যে বাচ্চাটার অক্সিজেনের ঘাটতি ছিলো তাই অক্সিজেন সাপ্লিমেন্ট দেয়া হচ্ছিল এতোক্ষণ ”
” আচ্ছা স্যার, যা ভালো বোঝেন ”
জয় নিজের সন্তানকে কোলে নিয়ে আছে।তাকে ঘিরে দারিয়ে আছে তনুর বাবা মা। তারা নাতনির মুখ দেখে কিছুটা সুখ পেয়েছেন।তাদের চেহারায় কিঞ্চিৎ সুখ ফুটে উঠলো।ডাঃ সেলিম বেশ গুছিয়েই ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করেছেন।তিনি একটা অক্সিজেন মাস্ক শিশুর মুখে দিয়ে তাদের সামনে নিশে গেলেন।গম্ভীর স্বরে জয়ের উদ্দেশয় বললো
” মিঃ জয়,আমরা মা কে বাঁচাতে পারিনি,কিন্তু সন্তানকে পেরেছি।জন্মের সাথে সাথে অক্সিজেনের ঘাটতি ছিলো,তাই অক্সিজেন সাপ্লিমেন্টের জন্য অন্য কেবিনে নিয়েছিলাম।এখন মোটামুটি সুস্থ।এই নিন ”
স্ত্রীকে হারিয়ে সন্তানকে কাছে পেয়ে জয় কোনো প্রশ্ন করলো না।কাপা কাপা হাতে নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
তনু ওখানেই দারিয়ে আছে।বারবার চিৎকার করে জয়কে বলছে তার কোলে বাবুকে দিতে কিন্তু জয় শুনতে পাচ্ছে না তার কথা।বেকুলতা কাটিয়ে জয়ের পাশে দারিয়ে নিজের মেয়েকে একপলক দেখলো।তনুর এখন আর তেমন আনন্দ লাগছে না,নিজের মেয়েকে প্রথম বার দেখার মতো সুখ তনু বুঝতে পারছে না।শুধু তাই নয়,কিছুক্ষণ থেকে তার মনে হচ্ছে তার মধ্যে ঘৃনা,সুখ,দুঃখ,হাসি,কান্না কোনোকিছুর কোনো অস্তিত্ব নেই।কোনো মা তার সন্তানকে প্রথনবার দেখলে যে পরিমাণ খুশি হয় তনুর তার বিন্দু মাত্র খুশি লাগছে না।তার কাছে মনে হচ্ছে এটা আর এমন কি ব্যাপার,পেটে ধারন করেছি, এখন জন্ম হয়েছে।এতে তেমন সুখের,আনন্দের কিছু নেই?।
তনু নিজের সন্তানের দিকে তাকিয়ে বললো
” কিরে দুষ্ট, বাবার কোলে তো ভালোই হাত পা নাড়াচ্ছিস।একটু বড্ড ইচ্ছে করছিলো তোকে কোলে নিতে, আদর করতে।কিন্তু এখন আর সে ইচ্ছে করছে না।মনে হচ্ছে যে, যা কিছু হচ্ছে তাতে আমার কিচ্ছু করার নেই।আমার সব অনুভূতি হারিয়ে গেছে রে,তোকে দেখে আমার আনন্দ, সুখ, কিছুই হচ্ছে না।এতে কি তুই রাগ করেছিস? রাগ করে না সোনা,তোর মা তো এখন বেঁচে নেই,মরে গেছে।আমার দুঃখ না হলেও তোর জীবনটা দুঃখে কাটবে।মায়ের ভালোবাসা পাবি না।মায়ের ভালোবাসা যে সন্তান পায় না সে চির অভাগা।আমার ইচ্ছে করছে তোর নাম অভাগী রাখতে।”
তনুর কথা শুনে সদর জন্ম নেওয়া শিশুটা মুখটা হাসিতে বেঁকে গেলো।এইটুকু সময়েই বাচ্চাটা দারুন ভাবে হাসতে পারছে।তার শারিরীক গঠনও বেশ ভালো।দেখে মনে হবে তার বয়স চার,পাঁচ মাস।তনু জয়ের দিকে তাকিয়ে বললো
” কি মিস্টার,নিজের মেয়েকে দেখে খুশি তো? তোমার চোখে জল কেন? আমার জন্য এতো কাদছো কেন? আমি তো আগেই বলেছিলাম আমি বাঁচবো না।আচ্ছা আমাদের বাবুটার নাম কি রাখবো? মনে আছে আমরা একটা নাম ঠিক করে রেখেছিলাম।ভেবে রেখেছিলাম মেয়ে হলে নাম রাখবো মিহু।কিন্তু এখন আমি আমার মতামত পাল্টাচ্ছি।ওর নাম হবে অভাগী। অভাগী নামটা তোমার কেমন লাগছে গো?। ওহহ আরেকটা বলতে তো ভুলেই গেছি,মেয়ে কিন্তু দেখতে একদম আমার মতো হয়েছে।মনে আছে? মেয়ে কার মতো দেখতে হবে সেটা নিয়ে আমরা রীতিমতো ঝগড়া শুরু করে দিতাম? এমন ও হলো দুইদিন তুমি কিচ্ছু খেলে না।খেতে বললেই বলেছিলে যে আমায় স্বীকার করতে হবে যে মেয়ে তার বাবার মতো হবে।কি সুন্দর ছিলো সেসব মুহূর্ত তাই না? ”
জয় তনুর ডেড*বডির পাশে বসে আছে। কয়েকবার হাত বাড়িয়ে মুখ থেকে সাদা চাঁদরটা সরাতে গিয়েও সরাতে পারেনি, হাত সরিয়ে নিয়েছে।আর প্রত্যকবারই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছে।এখনে কাঁদছে, তবে চোখের জল শুকিয়ে গেছে জন্য চোখে জল নেই,কিন্তু চোখ রক্তের মতো লাল হয়ে আছে।তনুর মায়ের কোল থেকে বড়বড় চোখ করে শিশুটা তাকিয়ে আছে তনুর দিকে।সে তার মৃ*ত মা কে দেখতে পাচ্ছে।
চলবে?