#শূন্য_আঁধার
#অন্তিম_পর্ব
#জয়ন্ত_কুমার_জয়
তনুর মায়ের কোল থেকে বড়বড় চোখ করে শিশুটা তাকিয়ে আছে তনুর দিকে।সে হয়তো তার মৃ*ত মা কে দেখতে পাচ্ছে।
এম্বুলেন্সে তনুর মৃ*ত দেহ তোলা হলো।তনুর ডান হাত শক্ত করে বুকে চেপে ধরে আছে জয়।তার চোখ অশ্রুসিক্ত। সারা শরীর কাঁপছে। মনে মনে ভাবছে তনুর সাথে কাটানো সুন্দর সুন্দর মুহূর্তগুলি।
এম্বুলেন্সে নিজের লা*শের সাথেই বসে আছে তনু।সে চোখ ভরে নিজের মৃ*ত দেহ দেখছে।মৃ*ত্যুর পর যেন তার মুখটা আরো মায়াবী হয়ে গেছে।তনু মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো,কি এমন করেছিলাম আমি? সবকিছু কি এতোই সহজভাবে হারিয়ে যাবে? আমার কি কিচ্ছু করার নেই? আমি আমার সন্তানকে দেখছি,কিন্তু কোলে নিতে পারছি না।একটা মা হয়ে এটা মানা খুব কঠিন।এখন আমার সবকিছু থেকেও কিচ্ছু নেই।মনে পড়ে গেলো রবি ঠাকুরের সেই দুটি লাইন,
সময়ের সমুদ্রে ডুবে আছি
কিন্তু এক মূহুর্ত সময় নেই
তনু পরম যত্নে নিজের মেয়েকে স্পর্শ করলো।শিমুল তুলোর মতো কি সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে।দেখলেই কোলে নিতে ইচ্ছে করে।কিন্তু সে নিতে পারছে না।তার সে ক্ষমতা আর নেই,হারিয়ে গেছে।শিশুটা তনুর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,সে চাহনিতে আছে মুগ্ধতা,আছে ভালোবাসা। তনু কোমল স্বরে বললো
” কিরে অভাগী,কি দেখিস ওভাবে হুম?তোর মৃ*ত মা’কে দেখতে পাস তুই? তোর একদিক দিয়ে কপাল খারাপ,মায়ের আদর পেলি না।কিন্তু তুই আরেকদিক দিয়ে সেরা,সেটা কি জানিস? তুই পৃথিবীর সেরা বাবা পেয়েছিস,সেরা বাবা।এই লোকটা যে কতোভালো,সেটা তুই বুঝতেই পারবি না।যতদিন যাবে তত মনে হবে এই মানুষটার ভালোর গভীরতার শেষ নেই।ওপরে ওপরে একটু শক্ত,কিন্তু মনটা একদম এইটুকু শিশুর মতো ”
তনুর দেওয়া অভাগী নামটা মনে হয় তার মেয়ের খুব পছন্দ হয়েছে।সে বাস্তবকে মেনে নিয়েছে সহজে।তনু যতবার অভাগী বলে ততবার এইটুকু শিশুর চোখ চকচক করে ওঠে।আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে তাকিয়ে থাকে তনুর দিকে।এমন ভাবে তাকায় মনে হয় সে তনুর সব কথা বুঝতে পারছে।পরম আগ্রহে তার কথা শুনছে।তনুও আগ্রহ নিয়ে তার মেয়ের সাথে কথা বলে
” তোর বাবা আমায় কেমন ভালোবাসতো শুনবি? এই জীবনে আমি চেয়েছি অথচ তোর বাবা পূরন করেনি এমনটা কখনো হয়নি। তোর চোখ দেখে মনে হচ্ছে তুই শুনতে চাস,তাহলে শোন।একদিন তোর বাবার প্রচন্ড জ্বর।কথা বলতে পর্যন্ত পারে না।১০৪° জ্বরে কাঁপছে। তখন আমি ওকে বললাম ” তোমার কি খুব খারাপ লাগছে? কিছুই তো খাচ্ছো না, কি খেতে চাও বলো আমি আনবো “।তখন তোর বাবা ফিসফিস করে বললো ” কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না “। তখন আমি বললাম ” আচার খাবে? জ্বরের মুখে আচার খুব ভালো লাগে,মুখে স্বাদ ফিরিয়ে আনে।আম,বড়াইয়ের আচার না।কাচা-পাকা তেঁতুলের আচার।আরো ভালো হয় যদি কাঁচা তেতুল মরিচ গুড়ার সাথে মিশিয়ে কচকচ করে খেতে পারো।এই যে দেখেছো,তোমায় বলতে বলতেই আমার আঁচার খেতে ইচ্ছে করছে “।তখন তোর বাবা গম্ভীর হয়ে বললো সে নাকি চা খাবে। আমি উঠে গিয়ে চা বানালাম।ফিরে এসে দেখি এত্তো এত্তো আচার।কোত্থেকে এতো আচার আসলো জানতে চাইলে তোর বাবা বললো ড্রয়ারে ছিলো।আমি সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম। তারপরের দিন যখন ছাদে গেলাম তখন কাজের ছেলেটা আমায় বললো ভাবী,কাল রাইতের আচার কেমন ছিলো।আমিতে অবাক হয়ে গেলাম।কাজের ছেলেটাকে বললাম, তুমি কিভাবে জানো?। ছেলেটা বললো, কাল রাতে যখন ভাইজান অসুস্থ শরীরে নিচে নামতে দেখলাম তখন ওনারে বললাম,ভাইজান কই যান? উনি কিছু বললেন না।চুপ করে চলে গেলেন।অসুস্থ শরীরে কই যায় সেটা দেখার জন্য আমিও ওনার পিছে পিছে গেলাম।গিয়ে দেখি উনি আচার কিনে পকেটে ঢুকিয়ে রাখলেন।ওখান থেকেই বুঝলাম আফনে আচার খাইতে চাইছেন।এই দুই বছরে ভাইজানরে আপনার আবদার কখনো অপূর্ণ রাখতে দেখি নাই।মানুষটা আপনেরে বড়োই ভালোবাসে।
গল্প শেষে তনু হাসছে।অভাগীর চোখ টলটল করছে।মনে হচ্ছে সে গল্পটায় গাঢ় বিষন্নতার ছায়া দেখতে পেয়েছে।তনু হাসি থামিয়ে বললো
” কিরে কান্না করছিস নাকি? একটু আগে জন্ম নিলি, এর মধ্যেই কান্না?। অতি প্রিয় জিনিস বেশিদিন কাছে থাকে না, আমারো থাকেনি।হারিয়ে ফেললাম।ওইতো আমাদের বাড়ি দেখা যাচ্ছে। জানিস ওই বাড়িটায় আমাদের কতো স্মৃতি মিশে আছে? আগে বড় হয়ে নে,তখন সব বলবো।ততক্ষণ পর্যন্ত তোর সাথে থাকতে পারবো কি না জানিনা।আরেকটা কথা আমার কি মনে হয় জানিস? তোর বাবা কখনো বিয়ে করবে না,যদিও আমি বেঁচে থাকার সময় বলেছিলাম,আমি ম*রে গেলে তুমি আরেটকা বিয়ে করে সুখে থাকবে,এতে আমি মোটেও কষ্ট পাবো না,কিন্তু আমার দীর্ঘবিশ্বাস,ও বিয়ে করবে না।বাকি জীবনটুকু আমার স্মৃতি নিয়েই কাটিয়ে ফেলবে, রোজ গোলাপ নিয়ে আসবে,বেলী ফুলের সিজনে বেলী মালা নিয়ে আসবে,যত্ন করে তার পাশের বালিশের ওপর রাখবে।বৃষ্টি এলোই দৌড়ে ছাদে যাবে, ছাঁদে আমায় খুজবে”
________________
মিহুর বয়স এখন সাত।জয় তার মেয়ের নাম মিহু রেখেছে।এটা তার আর তনুর পছন্দের ঠিক করা নাম।মিহুর স্বভাব একদম অন্য রকম।সে খুবই চঞ্চল। সারাক্ষণ ঘরে উড়ে বেড়ায়,ছবি আঁকে। তার ছবিতে একটা মেয়েই থাকে, সেই মেয়েটাকে দেখতে তনুর মতো।তনুর ছবি দেখলে জয় নিজেকে সামলাতে পারে না।তাই এই বাড়িতে তনুর কোনো ছবি নেই।
অন্য দিনের মতোই মিহু ছাদে ওঠার সিঁড়িতে বসে ছবি আঁকছে।সে পরম যত্নে একটা মেয়ের মুখ আঁকছে। তখন আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি শুরু হলো।মিহু সিঁড়ির মধ্যে স্হানে বসে ছিলো।সেখান থেকে তুলি,রংগুলি সরিয়ে ফেললো।কারন মিহু জানে তার বাবা কিছুক্ষণের মধ্যেই ছাঁদে যাওয়ার জন্য সিঁড়িতে আসবেন।তাই আগে থেকেই প্রস্তুতি।
জয় চোখে চশমাটা পড়তে পড়তে সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন।মিহু তার বাবার হাত ধরে ছাঁদে গেলো।জয় সিঁড়িতে দারিয়ে থাকে,মিহু খুব আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে।জয় তার মেয়ে মিহুর মধ্যে তনুকে দেখতে পায়।মনে হয় তনু ছাঁদে লাফালাফি করছে।তারপর অশ্রুতে ভেজা চশমাটা হাতে নিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে নিজের রুমে যায়।তখন তাকে কেউ ডিস্টার্ব করে না।তিনি মানিব্যাগ থেকে তনুর ছোট্ট সাইজের ছবিটা বেড় করেন।মনে মনে তনুর সাথে কথা বলতে বলতে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে।আজকে তেমন হলো না।জয় ঘরে ডুকলো,তার সাথে মিহুও ঘরে ঢুকলো।আহ্লাদী স্বরে বললো
” বাবা আজকে আর তুমি মায়ের ছবি দেখে কাঁদতে পারবে না ”
” আমি যে কাদি সেটা তোকে কে বললো? ”
” আমি জানি,আমি সব জানি।আচ্ছা বাবা তুমি বৃষ্টি এলেই যে সিঁড়িতে দারিয়ে দারিয়ে আমার লাফালাফি দেখো,কেনো দেখো আমি সেটা বুঝতে পারি।কিন্তু কখনো তোমায় বলিনি ”
” কি বুঝতে পেরেছিস?”
” রহিম চাচার কাছে শুনেছি,বৃষ্টি হলেই মা ছাঁদে যেতো,বৃষ্টিতে ভিজতো।তোমার বৃষ্টিতে ভিজলে গলার টনসিল ফুলে যায় তাই মা’কে সঙ্গ দিতে তুমি সিঁড়িতেই দারিয়ে দারিয়ে মাকে দেখো। কারন মায়ের আবদার তুমি কখনো ফেলতে না”
জয় মুগ্ধ চোখে মেয়ের কথা শুনছে।মিহু আবারো বললো
” তুমি বাইরে থেকে আাসার সময় গোলাপ ফুল,বেলী মালা নিয়ে আসো সেটাও আমি জানি।মা বেঁচে থাকতে তুমি এসব নিয়ে আসতে, সেই অভ্যাস এখনো আছে,তাই না বাবা? ”
জয় মিহুকে কাছে টেনে নিলেন।মিহুকে জরিয়ে ধরে চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।মিহু অবিকল তার মায়ের মতো করে কথা বলছে।জয় মিহুর প্রতিটি কথা ও কাজে তনুকে স্পষ্ট দেখতে পায়।মনে মনে ভাবে,তনু হয়তো দূর কোনো আকাশ থেকে তাদের দেখে মুচকি হাসে।
জয় একটা টেলিস্কোপ কিনেছে। সেটা দিয়ে সে রোজ রাতে গ্রহ নক্ষত্র দেখে।তার বিশ্বাস তনুকে এই নক্ষত্রের মাঝে খুজে পাওয়া যাবে,কে জানে তখন হয়তো তনুকে আরো মায়াবী লাগবে।সেই মায়াবী মুখটা দেখার জন্য বছরের পর বছর জয় সারারাত জেগে আকাশে নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকে।দেখতে না পেয়ে হতাশ হয়ে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে বিছানায় ঘুমাতে যায়।
___________________________সমাপ্ত___________________________