সুখের খোঁজ,পর্ব-০১,০২

0
1380

#সুখের খোঁজ,পর্ব-০১,০২
#মৌমিতা হোসেন।
(সূচনা পর্ব)

ভোর বেলা উঠে নামায পড়ে বই নিয়ে বসেছে নিতু।আর মাত্র পনেরো দিন পর এসএসসি পরীক্ষা।অথচ এখনো অনেক পড়া বাকি।নিতু ভেবে পায়না এতো পড়ার কি দরকার।সেই তো বিয়ে দিয়ে দেবে। সংসার করবে,বাচ্চা লালন-পালন করবে।নিতুর ঘরের কাজ করতে খুব ভালো লাগে।মায়ের সাথে সব কাজে সাহায্য করে নিতু। শুধু পড়তে ইচ্ছে করেনা ওর।নিতু মায়ের কাছে গিয়ে বলে,’মা পড়াশোনা না করলে কি হবে? আমার কাছে অনেক কঠিন লাগে, পড়তে ভালো লাগে না। কিছুই মাথায় ঢোকেনা।’

মা সালেহা চা বানাচ্ছিলো।চা বানাতে বানাতে বলে,’একটু কষ্ট করে পড় মা।এখন পড়াশোনা না করলে কেউ দাম দেয়না।অন্তত এইচএসসি পাশ কর। নাহলে ভালো জায়গায় বিয়েও দিতে পারবো না তোকে। আল্লাহ জানে তোর কি হবে।’

নিতু মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,’যা হবে ভালো হবে। আমি তো সব পারি মা। শুধু পড়ালেখা করতে আমার ভালো লাগে না। অনেক কঠিন লাগে।’

মা দোয়া ইউনুস,আয়তাল কুরসি মনে মনে পড়ে ফুঁ দিয়ে দেয়।বলে,’যা এবার দোয়া পড়ে ফুঁ দিয়ে দিয়েছি। এবার পড়তে বস।দেখবি সব পড়া মাথায় ঢুকবে। এখন যা আমাকে চা বানাতে দে।সেতু আর সাজিদ কে ডেকে উঠা।সকাল সাতটা বেজে গেলো এখনো ওঠার নাম নেই এই দু’জন এর। পড়তে বসবে কখন। ওদের ডেকে তুইও পড়তে বস। আমি চা নিয়ে আসছি।’

নিতু জানে ইচ্ছা না থাকলেও বাবার জন্য ওকে পড়তে হবে,পাশ করতে হবে। নাহলে বাবা ফয়সাল আহমেদ অনেক কষ্ট পাবে। ভাবতে ভাবতে সেতু আর সাজিদ কে ডাকতে থাকে।সেতু আর সাজিদ হলো নিতুর ছোট বোন আর ভাই।সেতু অষ্টম শ্রেণীতে আর সাজিদ চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে।এরা দু’জনই পড়াশোনায় ভালো। ওদের ডাকতেই উঠে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসে।

নিতুরা থাকে মিরপুর চৌদ্দ নম্বরে।তিন রুমের বাসা । বাসাটা এখন ওদের জন্য ছোট হলেও ভাড়া কম হওয়ায় এখানেই থাকছে প্রায় বারো বছর ধরে।এই বাসার ভাড়া সব মিলিয়ে বারো হাজার।ফয়সাল সাহেব একজন সরকারি কর্মচারী।যা বেতন পায় তা দিয়ে এর বেশি ভাড়া দিয়ে থাকা ওনার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে কষ্ট করে চলতে হলেও ওদের মনে শান্তি ছিলো।বেশ হাসি-আনন্দেই দিন কাটে ওদের।পড়ার মাঝেই মা সবার জন্য চা ,বিস্কিট নিয়ে আসে। সবাই চুপচাপ খেতে থাকে। নিতু কাপ রাখতে গিয়ে বলে,’মা আমি তোমাকে কাজে সাহায্য করি? তোমার তো কষ্ট হচ্ছে।’

মা খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলে,’তোর সামনে পরীক্ষা।একটু তো পড় । রেজাল্ট খারাপ হলে তোর বাবা খুব কষ্ট পাবে বলে দিলাম।’

নিতু বুঝতে পারে অযুহাত দেখিয়ে লাভ নেই।তাই গিয়ে পড়তে বসে।
এদিকে নিতুর মা তাড়াতাড়ি করে ভাত,ডাল রান্না করে, আলুভর্তা বানায়। সবাই সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে যায়।নিতুর বাবা অফিসে যায়। ওদের বিদায় দিয়ে দুপুরের রান্না বসায় সালেহা। সপ্তাহে দুই/তিন দিন অবশ্য সকালে ডিম ভাজিও থাকে। যেদিন ডিম থাকে সেদিন সাজিদ বেশ খুশি থাকে।এই বাজার দরে অল্প আয়ে প্রতি বেলায় ভালো খাবার যোগান দেয়া ফয়সাল সাহেব এর জন্য বেশ কষ্টকর।তাই একটু হিসাব করে চলতে হয়। মেয়েদের বিয়ের জন্য কিছু সঞ্চয়ও করতে হয়।মাথায় থাকে সব সময় এতো এতো চিন্তা।

নিতু পড়াশোনায় তেমন ভালো না হলেও কাজেকর্মে বেশ দক্ষ। সেলাই, রান্না এসবই পারে।শান্ত স্বভাবের, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।এক কথায় লক্ষি মেয়ে হলো নিতু। কিন্তু পড়াশোনায় ভালো না হওয়ায় বাবা খুব চিন্তিত নিতু কে নিয়ে।

অফিস থেকে এসে আজ ফয়সাল সাহেব এর শরীরটা কেমন জানি লাগছিলো। বুকে কয়েকদিন ধরেই চিনচিনে ব্যাথা করছে।ডাক্তার দেখানো দরকার কিন্তু খরচের ভয়ে যাচ্ছেনা।এই মাসে এখনো ছেলের স্কুলের বেতন দেয়নি।নিতুর পরীক্ষা সামনে তাই ওর জন্য কিছু কেনাকাটা করতে হয়েছে আর এজন্যই সাজিদ এর বেতনটা দেয়া হয়নি। স্কুলে গিয়ে আজ বলে এসেছে সমস্যার কথা। আগামী মাসে একসাথে দুই মাসের বেতন দেবে।নিম্ন মধ্যবিত্ত দের এভাবেই চলতে হয়। অনেক দিন ধরে ভাবছে সালেহাকে একটা সুতির শাড়ি কিনে দেবে। খরচের প্রেশারে সেটাও হয়ে উঠছে না।ছোট ছোট ইচ্ছেগুলো এভাবেই সব চাপা পরে যায় প্রয়োজনের কাছে।প্রয়োজন মেটানোই যেখানে দায় সেখানে এসব ইচ্ছা কীভাবে পুরন করবে সে। বর্তমান বাজার দরের সাথে যেনো কোনভাবেই পেরে ওঠেনা নিতুর বাবা।সব মিলিয়ে আজ কিছুটা অসহায় বোধ করছে। ফয়সাল সাহেব ডাকে নিতু কে।

নিতুর আজ শেষ স্কুল ছিলো।শাড়ি পরে গিয়েছিলো।সব বান্ধবীরা পরিকল্পনা করে শাড়ি পরে।নিতুর স্বাস্থ্য ভালো,গায়ের রং ফর্সা,লম্বা চুল। তবে দেখতে খুব যে সুন্দরী সেটা নয়। মোটামুটি চেহারা। লম্বা হওয়ায় শাড়ি পরার পর নিতু কে আজ দেখতে বেশ ভালো লাগছে।ওর চেয়ে সেতু দেখতে বেশি ফর্সা না হলেও বেশ মিষ্টি ।আজ স্কুলে সবাই মিলে বেশ মজা করে, অনেক ছবি তোলে। স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠান থাকায় আজ নিতুর বাসায় আসতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে। এসে দেখে বাবা চলে এসেছে।বাবার ডাকে নিতু দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কি হয়েছে বাবা?ডেকেছো আমাকে?’

বাবা নিতু কে দেখে অবাক হয়।ভাবে কতো বড় হয়ে গেছে মেয়েটা।সেই ছোট্ট পরীটা আজ শাড়ি পড়েছে।বাবা বলে,’মাশায়াল্লাহ। আমার মেয়েকে দেখতে আজ অনেক সুন্দর দেখা যাচ্ছে।কতো বড় হয়ে গিয়েছিস তুই।’

নিতু বাবার কথায় লজ্জা পায়।বলে,’বাবা আজ বিদায় অনুষ্ঠান ছিলো তাই আজ মায়ের এই শাড়িটা পড়ে গিয়েছিলাম।’

‘হুম বুঝতে পেরেছি। আমার কাছে এসে একটু বসবি আম্মু?তোর সাথে একটু কথা ছিলো।’

নিতু সাথে সাথে এসে বাবার গলাটা জড়িয়ে ধরে বসে পরে।বলে,’বলো বাবা কি হয়েছে। তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?’

‘হুম একটু খারাপ লাগছে আজ। বুকটা ব্যাথা করছে। কিন্তু আমি ডেকেছি অন্য কথা বলতে।’

‘বলো বাবা শুনছি আমি ‘

‘শোন মা পড়াশোনা ছাড়া জীবনে কেউ মুল্য দেবে না এই যুগে। আর মাত্র কয়দিন বাকি আছে পরীক্ষার। একটু ভালো করে পড় যেনো ভালো ভাবে পাশ করতে পারিস।কার কখন কি হয় সেটা কি কেউ বলতে পারে? আমি এখন আছি কাল তো নাও থাকতে পারি।জীবনে বিপদে পড়লে যেনো কখনো কারো কাছে হাত পাততে না হয়। পড়াশোনা করে যেনো প্রতিষ্ঠিত হতে পারিস অন্তত এতো টুকু পড়াশোনা কর আম্মু।’

বাবার কথা শুনে নিতুর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। পড়ালেখা করতেই তো ওর যেনো অনেক কষ্ট। তবুও নিতু বলে,’বাবা আমি পরীক্ষায় ভালোভাবে পাশ করবো দেখে নিও। তোমার সম্মান আমি রাখবো।চিন্তা করোনা। তুমি শুধু দোয়া করো আমার জন্য।’

বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিতু পোশাক পরিবর্তন করে হাতমুখ ধুয়ে পড়তে বসে।বাবার কথায় নিতুর মনটা খারাপ হয়ে যায়। নিতু বাবার কথা ভাবে আর মনে মনে বলে,’ইচ্ছে না হলেও আমি পড়বো বাবা।দেখে নিও আমি ভালো রেজাল্ট করে তোমাকে দেখাবো।’

পরদিন ভোরে উঠেই নামায পড়ে পড়তে বসে নিতু।সেতু, সাজিদ ঘুম থেকে উঠে বোনের পড়ার ধরন দেখে বেশ অবাক হয়। পরবর্তী কয়দিন নিতু খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ে। পরীক্ষা শুরু হয়ে যায়। পরীক্ষা গুলো মোটামুটি ভালোই হয়।পড়ার পর নিতুর খুব আফসোস হয় কারন ও দেখলো পড়াগুলো খুব সহজ। আগে থেকেই পড়লে হয়তো আরো ভালো হতো পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষ হয়।

পরীক্ষা শেষ হবার এক সপ্তাহ পরে হঠাৎ একদিন নিতুর বাবার বুকে ব্যাথা বেড়ে যায়। সকাল থেকেই ব্যাথা করতে থাকায় অফিসে যায়নি।নিতুর বাবা সালেহাকে ডেকে পাশে বসিয়ে বলে,’এতোগুলো বছরে তোমার জন্য কিছুই করতে পারিনি সালেহা।এজন্য মাফ করে দিও। আমি না থাকলে মেয়েদের দিকে খেয়াল রেখো। নিজের যত্ন নিও। তুমি তো নিজের বেলায় খুব উদাসীন। এভাবে উদাসীন না হয়ে নিজের দিকেও একটু নজর দিও। আমার কিছু হলে ওদের দিকে খেয়াল রেখো।’

কথা বলতে বেশ কষ্ট হচ্ছিলো তাই সালেহা স্বামীকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘নিতুর আব্বু আপনার কি শরীর বেশি খারাপ লাগছে?কি সব আবোল তাবোল বকছেন?কোনো কিছুতেই আমার কোনো আফসোস নেই। আপনার সাথে আমি খুব সুখে সময় কাটিয়েছি।তাই এসব বাজে কথা রেখে চুপ করে রেস্ট নিন। আপনার এসব কথা আমার ভালো লাগছে না।’
কথাগুলো বলতে বলতে সালেহার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিলো। হঠাৎ এসব কথা শুনে নিতুর মায়ের মনের ভেতর কেমন জানি করতে থাকে।

সন্ধ্যার পর ফয়সাল সাহেব এর শরীর বেশি খারাপ হয়ে যায়। সেটা দেখে মা নিতু কে ডেকে বলে,’নিতু মা তাড়াতাড়ি সামনের ফার্মেসি থেকে আসিফ ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয়।তোর বাবা কেমন জানি করছে।’

ডাক্তার আসিফ সামনের ফার্মেসি তে বসে। অনেক বছর ধরে এখানে আছে তাই নিতুদের পরিবারের সবাইকে খুব ভালো করেই চেনে। বিপদে আপদে ডাকলেই চলে আসে।নিতু দের সবাইকে বেশ আদর করে। সাজিদ কে দেখলেই চকলেট অথবা একটা পাঁচ টাকার কেক ধরিয়ে দেয়। এসবের জন্য ওরা সবাই ডাক্তার চাচাকে বেশ পছন্দ করে। এলাকায় ওনাদের নিজেদের বাড়ি। দুই সন্তান নিয়ে বেশ সুখের সংসার।ভালো এবং অমায়িক মানুষ হিসেবে এলাকায় ও ওনার বেশ পরিচিতি।

নিতু ওড়নাটা কোন রকম মাথায় দিয়ে দৌড়ে গেলো ফার্মেসিতে।আসিফ দেখেই বললো,’কি হয়েছেরে নিতু? এভাবে হাপাচ্ছিস কেনো?’

নিতু বলে,’চাচা দয়া করে তাড়াতাড়ি একটু বাসায় চলুন।বাবা কেমন জানি করছে।’

আসিফ তাড়াতাড়ি চেম্বার বন্ধ করে নিতুর বাসায় যায়। গিয়ে দেখে নিতুর বাবার অবস্থা ভালো নয়।হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। উনি দ্রুত এলাকায় কয়েকজনকে নিয়ে এম্বুলেন্স এ করে স্থানীয় এক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাথে নিতুর মা আর নিতু ও যায়। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয়না। হাসপাতালে নিতে নিতে এম্বুলেন্স এর ভেতরেই ফয়সাল সাহেব শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। হাসপাতালে ডাক্তার ওনাকে মৃত বলে ঘোষনা দিলে নিতুর মা কান্নায় ভেঙে পরেন।এক সময় সেন্সলেস হয়ে যায়।আর নিতু নিশ্চুপ, নির্বাক চেয়ে থাকে বাবার মুখের দিকে……

#সুখের খোঁজে……(পর্ব -২)
#মৌমিতা হোসেন

আসিফ কাকে রেখে কাকে সামলাবে বুঝতে পারছিলো না। যেহেতু তিনি একজন ডাক্তার আর ওখানে অন্য ডাক্তারদের সাথে তার ভালো পরিচয় ছিলো তাই তাড়াতাড়ি নার্সদের বলে সালেহা বেগমকে দেখতে।এরপর নিতুর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে,’এভাবে ভেঙ্গে পড়লে ভাবিকে কে সামলাবে মা?এখন তোরাই তোর মায়ের ভরসা।তাই তুই ভাবির পাশে বসে ওনার দিকে খেয়াল রাখ। আমি ফর্মালিটিজ শেষ করে আসছি।’

কথাগুলো বলে আসিফ চলে যায় আর হাসপাতালে সব ঝামেলা শেষ করে। এদিকে কিছুক্ষণ পরেই নিতুর মায়ের জ্ঞান ফিরে আসে।জ্ঞান ফিরতেই নিতু কে ধরে কান্নায় ভেঙে পরে। সবাই মিলে লাশ নিয়ে বাসায় আসলে বাবার লাশ দেখে সেতু, সাজিদ কান্না শুরু করে। সব আত্মীয়দের কে খবর দেয়া হয়।ফজরের নামাজের পর জানাজা পড়ানো হয়। ফয়সাল সাহেব এর ভাই বোনরা গ্ৰামে গিয়ে লাশ দাফন করতে চায়। কিন্তু অনেক আগেই একবার ফয়সাল সাহেব কথা প্রসঙ্গে সালেহার কাছ বলেছিলেন যে মৃত্যুর পর ওনার লাশ যেনো বেশি সময় না রাখা হয়।আর যেনো কাছের কবরস্থানেই দাফন করা হয়।

তাই কান্নার মাঝেই সালেহা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,’না নিতুর আব্বুর লাশ এই কবরস্থানেই দাফন করা হবে। এটা ওনার শেষ ইচ্ছা।তাই এই প্রসঙ্গে কেউ আর কোন কথা না বললেই খুশি হবো।’

এই কথা শুনে কেউ আর কোন কথা বলেনি।ওনার বলে যাওয়া জায়গাতেই ওনাকে কবর দেয়া হয়। নিতুর কোন মামা নেই।একজন খালা নারায়নগঞ্জ থাকতো।খবর শুনে তিনিও চলে আসেন।কাছের আত্মীয় বলতে এই খালা আর এক চাচা, দুই জন ফুপি।ফুপি দু’জন নিতুর বাবার চেয়ে বয়সে বড়।আর চাচা ছোট। সবাই ওদের অনেক ভালোবাসে।

সালেহা বেগম কে সারা দিনে সবাই শতো চেষ্টা করেও কিছু খাওয়াতে পারছেনা।কান্না করছে আর বিলাপ করেই যাচ্ছে। নিতু বুঝতে পারছেনা ও কি করবে। বাবাকে হারানোর সাথে সাথে মায়ের এই অবস্থা নিতু যেনো কোনভাবেই মেনে নিতে পারছে না।রাতে নিতুর খালামনি সহ সবাই জোর করে ওর মাকে একটু খাওয়ায়।

সবাই শোকে ক্লান্ত হয়ে পড়লে নিতু বাবার ঘরে যায়।গতরাতেও বাবার সাথে কতো কথা হয়।একদিনের ব্যবধানে আজ বাবা না ফেরার দেশে চলে গেছে। ভাবতেই চোখের জল গড়িয়ে পরে নিতুর চোখ থেকে।নিতু মনে মনে বলতে থাকে,’বাবা কেনো আমাদের ছেড়ে চলে গেলো।কি করে থাকবো এখন বাবাকে ছেড়ে।”বাবার ছবি দেখে অঝোরে কাঁদতে থাকে নিতু। সারাদিন পর এই বুঝি সময় পেলো বাবার জন্য শোক প্রকাশ করার। সালেহা বেগম মেয়ের কান্না শুনে পাশের ঘর থেকে এসে নিতু কে জড়িয়ে ধরে।দুজন মিলে কাঁদতে থাকে।যেনো কান্নার মধ্য দিয়েই মনের সকল কষ্ট বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসলেই কি কান্নার মাধ্যমে সব কষ্ট ভোলা যায়…..

কেটে যায় এক সপ্তাহ। দুরের আত্মীয়রা সবাই তৃতীয় দিন মিলাদ পড়ানোর পরেই চলে যায়।ফুপুদের নিজেদের সংসারে অনেক ঝামেলা তাই ওনারা ও চলে যায়।একমাত্র চাচা আফজাল ভাইয়ের সংসার কীভাবে কী চলবে সেটা নিয়ে চিন্তায় পরে যায়।

নিতুর চাচার নিজের ব্যবসা। নিউমার্কেটে তিনটা দোকান আছে।ভালোই চলে।প্রায় ছয় বছর আগে শেষ দোকানটা নেয়ার সময় কিছু টাকা কম পরে যায় তখন ফয়সাল সাহেব তার জমানো টাকা থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা ভাই আফজাল কে ধার দেয়।আস্তে আস্তে সেই টাকা শোধ করতে বলে। কিন্তু বাজার মন্দার কথা বলে সেই টাকা এতো বছরেও ফেরত দেয়নি। আফজাল সাহেব ঠিক করে সেখান থেকে মাসে মাসে কিছু টাকা সংসার চালানোর জন্য ভাবীকে দেবে। যেহেতু টাকার বিষয়টা দুই ভাই ছাড়া অন্য কেউ জানে না।তাই তিনি জানাতেও চায়না।তার ধারনা এভাবে টাকাটা দিয়ে আস্তে আস্তে যতোটুকু পারে শোধ করবে।আর না পারলে করবে না। ভাইয়ের কাছ থেকেই তো টাকাটা নিয়েছে। এই টাকা শোধ করতেই হবে এমন তো কোন কথা নেই। যেটুকু দেবে এতেই নিশ্চই সবাই খুশি হবে। আবার সবাই তাকে ভালো বলবে। এমনটা ভেবে চাচা আফজাল সাহেব ভাবিকে সংসার খরচের জন্য চার হাজার টাকা দিয়ে নিজ বাসায় চলে যায়।

আর যাওয়ার আগে বলে,’ভাবি জানেন তো এই বাজার দরে আমাদের মতো মানুষের পক্ষে সংসার চালানো কতোটা কষ্টের। নিজের সংসার চালাতেই হিমশিম খাচ্ছি।তাই খুব বেশি কিছু হয়তো করতে পারবোনা আপনাদের জন্য। তবে প্রতি মাস যতোটুকু পারি আমি সাহায্য করবো।’

দেবর এর কথা শুনে সালেহা কি বলবে বুঝে উঠতে পারেনা।তাই চুপ থাকে। তবে এটা বুঝতে পারে যে সামনে তার জন্য কঠিন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে।

এদিকে চাচার এমন উদারতা দেখে নিতু বেশ খুশি হয়। সবাই চলে গেলে মন বেশী খারাপ হবে তাই খালাকে যেতে দেয়না সেতু, সাজিদ।এই খালা নিতুর মায়ের চেয়ে বয়সে বড়।খালু সৌদি থাকে ‌।দুজন খালাতো ভাই-বোন ।বোন রুমকি গতো বছর বিয়ে হয়ে গেছে।আর ভাই রাতুল চাকরির সুবাদে থাকে চট্টগ্রাম।খালা একাই থাকে নারায়ণগঞ্জ। সপ্তাহে একবার এসে দেখে যায় মাকে।তাই সংসার এর তেমন ঝামেলা না থাকায় নিতু,সেতুর জোড়াজুড়িতে আরো কিছু দিন থাকার সিদ্ধান্ত নেয়।খালার এই সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বেশি খুশি হয় সাজিদ আর সেতু।

জীবনে বেঁচে থাকার সংগ্ৰাম আসলে অনেক কঠিন।এই সংগ্ৰাম করে বাঁচতে গিয়ে বিগত দুই মাসে বাবার কথা সারাক্ষন আর মনে পড়েনা।চল্লিশ দিন পর খালামনি চলে যায়।সেতু, সাজিদ ওদের পড়াশুনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নিতুর রেজাল্ট দেবে পরের সপ্তাহে এটা নিয়ে ও খুব চিন্তায় পরে যায়। এদিকে সালেহা বেগম একা সংসার চালাতে গিয়ে কীভাবে কি করবে ভেবে পায়না। সারাদিন ব্যস্ত থাকলেও রাতে ফয়সাল সাহেবের কথা খুব মনে পড়ে। চোখের জলে বালিস ভেজে। স্বামী নামক মানুষ টা যে সব সময় বটগাছের মতো ওদের সবাইকে সর্বক্ষণ আগলে ছায়া দিয়ে রেখেছিলো সেটা উপলব্ধি করতে থাকে প্রতি মুহূর্ত।

ফয়সাল সাহেবের কর্ম ক্ষেত্র থেকে সালেহা একটা বড় এমাউন্ট এর টাকা পায়। কিছু সেভিংস আছে। কিন্তু কোন আয় না করে জমানো টাকা খরচ করতে থাকলে এক সময় সব টাকা শেষ হয়ে যাবে।এই দুই মাসে সেটা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে।অনেক ভাবার পর খেয়াল হলো যে সে মোটামুটি সেলাই পারে।অন্যের কাছে হাত পাতা বা ছোট হবার চেয়ে কষ্ট করে অর্থ উপার্জন করা ভালো হবে।তাই ঠিক করলো সেলাই করবে। অনেক বছর ধরে এখানে থাকার কারনে এলাকার সবাই মোটামুটি চেনে। এক্ষেত্রে তার বিশ্বাস সেলাই শুরু করলে এলাকায় অন্যরাও তাকে সাহায্য করবে।আর তাই নতুন একটা মেশিন কিনে সেলাই এর কাজ শুরু করে।এসব নিয়েই তিন সন্তানকে নিয়ে সুখের খোঁজে নতুন করে পথ চলতে শুরু করে সালেহা।

নিতু মায়ের চিন্তা,কষ্ট আর রাত হলেই মায়ের কান্না দেখে মন খারাপ করে। মায়ের জন্য কি করা যায় ভাবতে থাকে। কিন্তু এই ছোট্ট মস্তিষ্ক এসব নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারে না। দেখতে দেখতে নিতুর পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ এর দিন চলে আসে। নিতুর মা মনপ্রান দিয়ে দোয়া করতে থাকে যেনো মেয়েটা অন্ততো পাশ করে। বিয়ে দিতে হলেও তো আজকাল শিক্ষিত হতে হয়। নিতু যেহেতু পড়ালেখায় ভালো না তাই ওকে নিয়ে সালেহার আশা ও কম।

নিতু মায়ের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে স্কুলে যায়। রেজাল্ট এ দেখে যে সে ‘বি ‘পেয়েছে।একটুর জন্য ‘এ’পায়নি। খুব আফসোস করে নিতু। আগে থেকেই যদি আর একটু ভালো করে পড়তো তাহলে আরো ভালো করতে পারতো। নিতুর সব বান্ধবীরা ওর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করেছে।যাই হোক পাশ করেছে এটাই বেশি। বাসায় গিয়ে রেজাল্ট বললেই মা অনেক খুশি হয়ে নিতু কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।মেয়ে যে পাশ করেছে এতেই সে অনেক খুশি। ভাবতে থাকে,আজ নিতুর বাবা বেঁচে থাকলে মেয়ের এই রেজাল্ট দেখেই অনেক খুশি হোতেন। সবাইকে মিষ্টি মুখ করাতেন। কিন্তু কপালে যেনো এই সুখটুকুই ছিলোনা।

নিতু ও বাবাকে খুব মিস করছিলো। কাঁদতে থাকে আর মনে মনে বলে,’দেখো বাবা আমি পাশ করেছি। আমি এখন থেকে আনেক ভালো করে পড়বো বাবা। তুমি কেনো আমাদের একা ফেলে চলে গেলে।’

নিতু ঠিক করে কলেজে ভর্তি হয়ে ও আরো ভালো করে পড়বে। বাবার ইচ্ছা পূরণ করবে। নিতু কলেজে ভর্তি হয়।আর মন দিয়ে পড়া শুরু করে।এর মাঝে কলেজে যাওয়া আসার পথে একটা ছেলে তাকে প্রায়ই বিরক্ত করা শুরু করে। সালেহা বেগম বিষয়টা জানার পর থেকে খুব চিন্তায় পরে যায়। সংসার এর কাজ,সেলাই, বাচ্চাদের স্কুল, পড়াশোনা সব মিলিয়ে অস্থির হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে নিতু কে আর পড়াবেনা।

পরদিন নিতু কলেজের জন্য রেডি হতে নিলেই মা বলে,’তোর আর কলেজে যাওয়া লাগবে না। বাসায় বসে পড়।কোনরকম পাশ করতে পারলেই হবে।’

কিন্তু নিতু তো ততোদিনে মনে মনে নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করে দিয়েছে। মায়ের কথা শুনে মায়ের কাছে গিয়ে বলে,’কেনো মা কলেজে যাবো না কেনো? আমি পড়বো মা। আমি পড়ালেখা করে চাকরি করবো। তোমাকে আর কষ্ট করতে দেবো না।দেখবে তখন আমাদের সংসারে অনেক শান্তি থাকবে। চাকরি নিয়ে আমি সেতু, সাজিদ কেও পড়াবো।বাবার ইচ্ছা আমি পুরন করবো।’

মেয়ের কথা শুনে সালেহা অবাক হয়।যেই মেয়ে পড়ার নাম শুনতে পারতো না।সেই মেয়েও এখন পড়তে চাচ্ছে? কিন্তু এতো প্রতিকুলতায় সে একা সবাইকে রক্ষা করতে পারবে না হয়তো।তাই আবারো বলে,’এতো কথা বলিস না নিতু ‌কলেজে যেতে নিষেধ করেছি তাই যাবিনা।বাসায় বসে পড়।’

নিতু খুব মন খারাপ করে। বারবার মায়ের কাছে অনুরোধ করায় অবশেষে মা রাজি হয়। তবে ঠিক করে দুই মেয়েকেই এখন থেকে সে নিজে নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে।আর এর মাঝে ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দেবে।

সালেহা সাথে থাকায় এলাকার ছেলেটা আর সাহস করেনা নিতুর পিছনে লাগার বা ওকে ডিস্টার্ব করার। তবে সুযোগ খুজতে থাকে। এভাবেই কলেজের প্রথম বছরটা শেষ হয়।

কলেজে যেতে ত্রিশ টাকার মতো রিকশা ভাড়া লাগে। প্রতিদিন এতো টাকা খরচ করা নিতুর মায়ের পক্ষে সম্ভব ছিলো না।কারন সেলাই করে খুব বেশি আয় করতে পারতো না। এতো সময়ও পায়না।তাই পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা করতে হতো।এক বেলা মাছ/মাংস/ডিম খেলে পরের বেলায় শুধু সবজি দিয়ে খায়। এভাবেই অনেক কষ্ট করে জীবন চলতে থাকে।আর রাত হলেই এতো এতো চিন্তা ঘিরে ধরে সালেহাকে।

এদিকে নিতু খুব মন দিয়ে পড়ে। বাবার কথা মনে পড়লেই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।বাবা ছাড়া জীবনে চলার পথটা যে কতোটা কঠিন সেটা টের পেতে থাকে হারে হারে।রাতের আকাশের তারার মাঝে নিতু বাবাকে খুঁজে বেড়ায়। খুব করে কাঁদে।ছোট ভাইটা যখন খাবার নিয়ে বায়না ধরে আর মা না দিতে পেরে মুখে আঁচল চেপে কাঁদে সেটা নিতুর ভালো লাগে না। খুব কষ্ট হয় তখন…. খুব।

আর তখন মাকে বলে,’মা ভেবো না।পড়া শেষ করে আমি চাকরি নিলেই তোমার সব কষ্ট শেষ হবে দেখো।’

নিতু জানে না সে কতোটা করতে পারবে মা আর ভাই বোনদের জন্য। তবে মাকে খুব করে আশ্বাষ দেয়।

বাবা মারা যাওয়ার পর চাচা চার /পাঁচ মাস টাকা দেয়।এরপর থেকে বিভিন্ন সমস্যার কথা বলে এড়িয়ে যায়। নিতুর কাছে চাচাকে আজকাল খুব স্বার্থপর মনে হয়।ফুপিদের ও বিরক্ত লাগে।ফুপিরা ফোন দিলেই ওর মাকে শুধু নিতুর বিয়ের কথা বলে।আর এটাই নিতুর বিরক্তির কারন।

চলব…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here