সুখের খোঁজে,পর্ব -৯,১০

0
413

#সুখের খোঁজে,পর্ব -৯,১০
#মৌমিতা হোসেন
০৯

বিথি বলে,”অবশ্যই ভাবী।চলো তোমাকে বাসাটা দেখাই।”

নিতু শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে দেয়।এরপর বিথির সাথে বের হয়।এই তিনদিন নিতু খাওয়ার ঘর আর ওর নিজের ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যায়নি।পুরো বাসা ঘুরে দেখলো। বাসাটা মাঝখানে পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা।একপাশে তিনটি রুম,কিচেন, দুটি ওয়াশরুম। তিনটি রুম ভাড়া দেয়া।আর যেই পাশে তৌসিফ থাকে সেই পাশে দুটো বেডরুম,ড্রইংরুম,ছোট ডাইনিং স্পেস,দুটো বাথরুম, একটা বাড়ান্দা আর কিচেন।রুম গুলো বেশ বড় বড় তবে অনেক পুরোনো বিল্ডিং।ফ্লোর পাকা করা।ওয়ালে অনেক জায়গায় শেওলা পড়েছে।সব ঘরই এলোমেলো।সব রুমে পুরোনো ফার্নিচার এ ভরা আর খুব অগোছালো।এর মাঝেই শ্বশুড় বাইরে থেকে এসে নিতু কে দেখে খুশি হয়।ডেকে পাশে বসায়।বলে,”তৌসিফ কোথায়?”

নিতু মাথা নিচু করে বলে,”বাইরে গিয়েছে। কোথায় সেটা জানিনা বাবা ।বলে যায়নি আমাকে।”

“তুমি জিজ্ঞেস করেছো?শোনো বৌমা আজ তোমায় কিছু কথা বলি।মন দিয়ে শুনবে। তোমার শ্বাশুড়ি বেঁচে থাকলে হয়তো তিনি বলতেন। অবশ্য বেঁচে থাকলে হয়তো আজ আমার ছেলেটা এমন হতোইনা।যাই হোক তৌসিফের বয়স যখন দশ বছর তখন ওর মা মারা যায়। মাকে খুব ভালোবাসতো ছেলেটা।ওর মা মারা যাওয়ার পর আমি একা ছেলেকে সামলাতে ব্যর্থ হই।ওর চাচা-চাচি চেষ্টা করেছিলো তবে ওদেরও সংসার আছে।নিজ সংসার ফেলে আমার ছেলের পেছনে পরে থাকার সময় কোথায়।তাই আমি ওদেরকেও দোষ দিতে পারিনা।সবাই বলেছিলো আমাকে বিয়ে করতে কিন্তু সেসব আর আমাকে দিয়ে হয়নি। তোমার শ্বাশুড়ি মা এর জায়গা আমি অন্য কাউকে দিতে পারিনি।আর তৌসিফ মা কে হারিয়ে পড়াশোনায় অমনোযোগী হয়ে যায়।কোনরকম এইচএসসি দেয়ার পর আর আমি আটকে রাখতে পারিনি। বন্ধুদের পাল্লায় পরে ছেলেটা আমার বেপরোয়া হয়ে গেছে। আমার ছেলের মনটা ভালো।ওর একটু যত্নের প্রয়োজন,ভালোবাসার প্রয়োজন। আমার বিশ্বাস তুমি ওকে ঘরমুখো করতে পারবে।দোকানটা যদি অন্তত ঠিকমতো চালায় তাহলেও তোমরা ভালোভাবে চলতে পারবে। নাহলে সমস্যায় পড়বে। আমার সম্বল এটুকুই।”

একটু থেমে আবার বলে,”এটা এখন তোমার সংসার। নিজের মতো করে সব গুছিয়ে নাও। তৌসিফ কে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দোকানে পাঠাও। দায়িত্ব নিতে বলো। আমার কিছু হলে ছেলেটা বিপদে পড়বে। জানিনা তোমাকে কতোটা বোঝাতে পেরেছি। এখন থেকে তৌসিফ এর বাইরে কখন,কোথায় যায় সেসবের হিসেব নেবে। নিজের অধিকার আদায় করে নিতে হয়। এটা মনে রেখো। অনেক কিছু বললাম মা। এবার যাও ফোন করে দেখো ও কোথায় আছে।আর অনেক বেলা হয়েছে খেয়ে নাও তুমি।”

নিতু বলে,”ঠিক আছে বাবা। আমি চেষ্টা করবো আপনার কথা মতো চলার।”

আকবর আলি নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যায় ঘরে।তখনি বিথি হাসি দিয়ে বলে,”ভাবি এতো দায়িত্ব তুমি নিতে পারবে তো?যাক এখন ভাইয়াকে ফোন দাও।বলো তাড়াতাড়ি চলে আসতে।”

নিতুর খেয়াল হলো ওর কাছে তো তৌসিফ এর মোবাইল নম্বর নেই।আসলে ওর সাথে তেমন কোন কথাই তো হয়নি।ফোন নম্বর কীভাবে নেবে।তাই বিথিকে বলে,”আমি রুমে গিয়ে ফোন দেবো।এখন বাদ দাও বিথি।”

বিথি বলে,”ঠিক আছে ভাবী।আমি তাহলে এখন যাই। আমার টিচার আসবে।”

বিথি যেতেই নিতু ভাবে তৌসিফ কে ওর কাজের জন্য পছন্দ না হলেও মা আর শ্বশুর আব্বার কথা শুনতে হবে। মেনে নিতেই হবে।তাই চেষ্টা করতে সমস্যা কি। খুব ক্ষুধা পেয়েছে নিতুর। রান্না ঘরে দেখলো রান্না করা আছে।এক বুয়াকে দেখেছিলো রান্না করতে। তিনি হয়তো এই কাজটা সামলান। খেতে নিয়ে এমন রান্না খেতে পারলো না নিতু। বাসায় ওর মা যাই রাধতো খুব ভালো লাগতো।নিতু ও শিখেছে মায়ের কাছ থেকে রান্না। তাই মনে মনে ভাবে কাল থেকে ও নিজেই রান্না করবে।

খেয়ে উঠে ঘরে একবার চোখ বোলালো।শরীর খারাপ লাগলেও ভাবলো ঘরটাকে একটু মানুষের বসবাসযোগ্য করতে হবে।তাই ঘর গোছানো শুরু করে।ঘর গোছাতে গোছাতে সন্ধ্যা পার হয়।তখনো তৌসিফ আসেনা। নিতু ফ্রেশ হয়ে আজ নিজেই রান্না ঘরে গিয়ে চা বানায়।

আকবর আলি নিতুর হাতে চা দেখে বেশ খুশী হয়।দুজন মিলে চা খায়।আকবর আলি ওনার কাজে চলে যায়। নিতু ঘরে এসে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পরে।রাত এগারোটায় ঘুম ভাঙ্গে।তখনো তৌসিফ বাসায় আসেনি। অপেক্ষা করতে করতে বেশ রাত করেই তৌসিফ ঘরে ফেরে। ঘড়িতে তখন বারোটা পার হয়েছে। ঘরে ঢুকে তৌসিফ একটু অবাক হয়।সব গোছানো,টিপটপ। নিতু তৌসিফকে দেখে ওর খাবার গরম করে টেবিলে দিয়ে ডাকতে এলো।এর মধ্যে তৌসিফ ফ্রেশ হয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছিলো। নিতু গিয়ে বলে,”খাবার দিয়েছি। খেতে আসুন।”

তৌসিফ মোবাইলের তাকিয়েই উত্তর দেয়,”আমি খেয়ে এসেছি। এখন আর খাবো না। তুমি খাবার ঢেকে রেখে ঘরে আসো। তাড়াতাড়ি আসবে।”

নিতু প্রচন্ড বিরক্ত হয় ওর কথা শুনে। মনে মনে ভাবে ,”লোকটা এমন কেনো?গম্ভির,শক্ত মনের। সুন্দর করে যেনো কোন কথাই বলতে পারেনা।কি করে থাকবো আজীবন এই লোকের সাথে?”

খাবার ঢেকে নিতু ইচ্ছে করেই দেরি করে রুমে এসে দেখে তৌসিফ ঘুমিয়ে পড়েছে। নিতু যেনো প্রান ফিরে পায়।ও কোনভাবেই আজ আর ওসব চাচ্ছিলোনা। জেগে থাকলে বাধাও দিতে পারতো না।তাই মনে মনে বেশ খুশি হয়। চুপচাপ তৌসিফ এর পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পরে। ভোরে তৌসিফ এর গভীর স্পর্শে নিতুর ঘুম ভাঙে। কিন্তু কিছু করার থাকে না।তাই নিতু ও সায় দেয়। তবে মনের দুরত্ব যে একশত ভাগই রয়ে যায়। তৌসিফ আজকেও তার কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে।

নিতুর অস্বস্তি হয়।ও তৌসিফ কে আগে ভালোভাবে জানতে চায়,চিনতে চায়। তৌসিফ এর পছন্দ,অপছন্দ সব জানতে চায়।মন থেকে ভালোবাসতে চায়। এই ছোট্ট জীবনে যতোটুকু নিতু বুঝেছে তাতে বিয়ে মানে প্রথমে দুটি হৃদয়ের বন্ধন তারপর শরীরের।আর তাই এই চারদিন ধরে তৌসিফ এর ব্যবহারে নিতু বেশ বিরক্ত হচ্ছে।ও খেয়াল করেছে তৌসিফ এর ওর সাথে কথা বলার বা ওকে জানার কোনো আগ্ৰহ নেই। তৌসিফ শুধু সময়মতো এসে তার নিজের প্রয়োজনে নিতু কে কাছে টেনে নিচ্ছে। খারাপ ভাবে বললে ওকে ভোগ করে আবার ছেড়ে দিচ্ছে। এখানে ও কোন ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছেনা।আর তাই নিতুর সব কিছু বিষাক্ত লাগছে বিয়ের পর থেকে।

নিতু সিদ্ধান্ত নেয় ও নিজেই আগ বাড়িয়ে কথা বলবে তৌসিফ এর সাথে। তৌসিফ কে জানার চেষ্টা করবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পরে নিতু।বাড়ান্দায় পাখির ডাকে নিতুর ঘুম ভাঙে।উঠে ফ্রেশ হয়ে ভাবে আজ নিজ হাতে নাস্তা বানাবে।এর মধ্যেই কলিং বেল বাজলে দরজা খুলে দেখে এক মধ্যবয়সী মহিলা।পান খেতে খেতে ভেতরে ঢুকতে নিলে নিতু বাধা দেয়।বলে,”খালা কার কাছে এসেছেন?”

মহিলা হেসে উত্তর দেয়,”বৌমনি উইঠ্যা পড়ছেন? আমি এই বাড়ি কাম করি আট বছর ধইরা।গতো কয়দিন ঝামেলায় ছিলাম তাই আইতে পারি নাই। আরেকটা মাইয়ারে দিয়া গেছিলাম রান্না করোনের জন্য।খুব শখ ছিলো তৌসিফ বাবার বিয়ায় মজা করমু কিন্তু হইলোনা।যাই হউক ঢোকতে দেন।এই কয়দিনে তো দেহন যাইবো ম্যালা কাম জমছে।”

নিতু বুঝতে পারেনি যে এই বাড়ির রান্নার কাজ এই মহিলা করেন।তাই ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলোনা।এর মধ্যে আকবর আলি এসে দেখে বলেন,”রাহেলা তুমি অবশেষে আসলে।এমন ঝামেলার মাঝে কি তোমার ছুটি নেয়া ঠিক হয়েছিলো?যাক ভেতরে আসো ।এই আমার বৌমা। তৌসিফ এর বৌ। তোমাকে চেনে না তাই ঢুকতে দিতে চাচ্ছিলোনা। এসে তাড়াতাড়ি নাস্তা বানাও।”

নিতু দরজা ছেড়ে দাঁড়ায়।রাহেলা ভেতরে ঢুকে ঘর গোছানো দেখে অবাক হয়।বলে,”বৌমনি দেখি আইসাই বাসার মানচিত্র পাল্টায় ফালাইছেন। মাশাআল্লাহ।এমন একজন মাইয়া মানুষের খুব দরকার ছিলো এই বাড়িতে।এখন আপনে আপনের সংসার মন মতো সাজায় নেন।”

নিতু বলে,”ঠিক আছে খালা। আমি আপনাকে খালা বলেই ডাকবো।এখন আগে রান্না ঘরে চলেন দু’জন মিলে নাস্তা বানাই।”

রাহেলা খুব খুশি হয়। সবাই তাকে বুয়া বলেই ডাকে।এই প্রথম কেউ খালা বলে এতো সম্মান দিয়ে ডাকছে।তাই নিতু কে অল্প দেখাতেই রাহেলার বেশ পছন্দ হয়।রান্না ঘরে গিয়ে দুজন মিলে মজার নাস্তা বানায়।আজ নিতু ঠিক করে সবাই একসাথে খাবে।তাই তৌসিফ কে ডাকতে যায়। কিন্তু তৌসিফ তখনো গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। কয়েকবার ডাকার পরেও না উঠলে যখন জোরে ধাক্কা দেয় তখন তৌসিফ বেশ রেগে যায়। নিতু রাগ দেখে ভয় পায়।সরি বলে আর না ডেকে মন খারাপ করে চলে আসে। শ্বশুর কে নিয়ে নাস্তা করে।আকবর আলি এমন পরিবেশ দেখে খুশিতে কেঁদে দেয়। নিতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দেয়।বলে,”আমার বিশ্বাস তুই পারবি আমার ছেলেটাকে সঠিক পথে আনতে। দোয়া করি মা।”

নিতু শ্বশুর এর কথায়, আদরে খুব খুশি হয়। বাবার জায়গাটা এর মধ্যেই নিতু মনের অজান্তে আকবর আলি কে দিয়ে দিয়েছে। নাস্তা পর্ব শেষ করে নিতু রাহেলা কে নিয়ে ঘর পরিষ্কার করতে নেয়।এমন সময় তৌসিফ এর ডাকে দৌড়ে রুমে যায় নিতু। আগে কখনো তেমন একটা শাড়ি পরেনি নিতু।তাই সামলাতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে ওকে। এলোমেলো অবস্থায় নিতু কে দেখে তৌসিফ কিছু সময় ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। নিতু নিজেকে সামলে বলে,”আমাকে ডেকেছেন?”

“হুম। কোথায় ছিলে? তোমার এমন অবস্থা কেনো কি করছিলে?”

“জ্বী ঘর পরিষ্কার করছিলাম। আপনাকে নাস্তা দেবো এখন?”

“একটু পরে দিও ।আগে দরজা চাপিয়ে এদিকে এসো। দরকার আছে।”

তৌসিফ নিতু কে ডাকলেই ওর অস্থিরতা বেড়ে যায়।ও ভাবতে থাকে এখন কি আবার তৌসিফ ঐ একই কাজ করবে? ভাবতে ভাবতে লজ্জা ঝেড়ে আস্তে করে বলেই ফেলে ,”এখন কি আবার আপনি ঐ একই কাজ করবেন? মানে আমি তো রান্না ঘরে কাজ করছিলাম। কিছু দরকার পড়লে খালা ডাকবে আমায়।তখন আমাকে না পেলে খারাপ ভাববে।”এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো খুব সাহস করে বলে নিতু।এরপর নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে।

তৌসিফ নিতুর কথা শুনে জোরে হেসে দেয়।

চলবে……

#সুখের খোঁজে…..(পর্ব -১০)
#মৌমিতা হোসেন

তৌসিফ এর উচ্চস্বরে হাসি শুনে নিতু চোখ তুলে তাকায়।খানিক মুগ্ধ হয়। গায়ের রং শ্যামলা ,লম্বা, দেখতে ভালোই।হাসিটাও বেশ সুন্দর।নীল রঙের পাঞ্জাবি পড়েছে। দেখতে বেশ লাগছে। তাকিয়ে থাকে নিতু।এর মাঝে কখন যে তৌসিফ নিতুর একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা আর খেয়াল করেনি।পেটে কারো হাতের স্পর্শে আঁতকে ওঠে নিতু। তৌসিফ ওর এতো কাছে খেয়াল হতেই মাথা নিচু করে ফেলে। আবার অস্বস্তি বাড়তে থাকে নিতুর। তৌসিফ গুজে রাখা শাড়ি এক টানে খুলে আঁচলটা সামনে টেনে দেয়।

মুখে ফুঁ দিয়ে চুলগুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিয়ে বলে,”এভাবে ধবধবে সাদা পেট দেখিয়ে কি কাজ করো তুমি? শরীর ঢেকেও কাজ করা যায়।এই শরীর আমি ছাড়া অন্য কেউ না দেখুক।আশা করি বুঝতে পারছো।আর এলোমেলো তোমাকে দেখতে ভালোই লাগছে।আবারো নেশা হয়ে যাচ্ছে।
তবে ঐ যে তোমার খালা তোমাকে এখন ডাকবে তাই তোমার ভাষায় ঐ কাজ এখন আর না করি। তোমাকে ছেড়ে দিলাম এখনের মতো।হলো?” বলে নিতু কে ছেড়ে শিষ বাজাতে থাকে আর চুল আঁচড়াতে থাকে।

নিতুর খুব অস্বস্তি হয় সাথে লজ্জাও পায়। মনে হচ্ছিলো বরফের মতো জমে গেছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে দেখে তৌসিফ বলে,”নাস্তা কি পাবো আজ? মানে নাস্তা দেবে নাকি চলে যাবো? এভাবে দাড়িয়ে আছো কেনো? নাকি অন্য কোন ইচ্ছা আছে?”

তৌসিফ এর কথা শুনে নিতু চমকে ওর দিকে তাকায়।আর এক মুহূর্তও দেরি না করে রান্না ঘরে চলে যায়। তাড়াতাড়ি নাস্তা টেবিলে সাজায় ।এর মাঝেই তৌসিফ খাবার ঘরে এসে নাস্তা খায়।আজ তৃপ্তি নিয়েই খায় তৌসিফ। ঘরে চোখ বুলিয়ে ভালো লাগে ওর।বৌ ঘর গুছিয়ে রাখছে তাই একটু বেশি ভালো লাগে।

এতোটা সময় নিতু চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তৌসিফ পানি খেয়ে বাইরে যেতে নিলে নিতু জানতে চায়,”কোথায় যাচ্ছেন?”

তৌসিফ একটু অবাক চোখে তাকালে নিতু হাত কচলাতে থাকে আর বলে,”না মানে বাবা বলেছে জেনে রাখতে।এজন্য আর কি।না বলতে চাইলে সমস্যা নেই। বলতে হবে না।”

একটু বিরক্ত হয়ে তৌসিফ বলে,”আমি কোথায় কখন যাবো এসবে তোমার কোন কাজ নেই। আমি এসব কৈফিয়ত কাউকে দেইনা। আমার ব্যাপারে নাক গলাবেনা।”

“ঠিক আছে আর জানতে চাইবো না।কখন আসবেন সেটা কি বলবেন?”

“যখন মন চাইবে তখন আসবো।আর এর মাঝে যদি আবার তোমার নেশা হয় তাহলেও আসবো।হলো?”কথাটা বলে তৌসিফ মুচকি হেসে সিগারেট খেতে খেতে চলে যায়।

সিগারেটের গন্ধ নিতুর সহ্য হয়না।বমি চলে আসে। নিতুর আবারো বিরক্ত লাগে। একটু আগের ক্ষনিকের ভালোলাগা আবারো উড়ে যায়। মনে মনে বলে,”কোন ভালো দিক নেই।এই মানুষটার সাথে কীভাবে মানিয়ে চলবো আমি।কথাও বলেনা।ত্যাড়া উত্তর, সিগারেট খায় সব মিলিয়ে অসহ্যকর।”

নিতু আবারো কাজে লেগে পরে। সংসার এর কাজ করতে নিতুর ভালোই লাগে। এভাবেই বেশ কিছু দিন কেটে যায়।সারাদিন রাহেলা খালার সাথে কাজ,গল্প এসবেই মেতে থাকে নিতু।সময় পেলেই মায়ের সাথে কথা বলে,বাড়ান্দায় পাখিটার সাথেও বেশ সখ্যতা হয়েছে ওর। বিকেলে বিথিরা প্রায়ই আসে তখন গল্প করে ।এক কথায় সব মিলিয়ে নিতুর বেশ ভালো সময় কাটে। শুধু তৌসিফ আসার সময় হলেই ওর অস্থিরতা,অস্বস্তি বাড়তে থাকে।বাড়ি এসেই নিতু কে যেনো ওর খুব করে চাই।প্রয়োজন ছাড়া কোন কথা নেই।রাত হলেই সম্পর্ক গভীর হওয়া আর ভোর হলে মনে হয় যেনো ওকে চেনেইনা তৌসিফ। নিতু খুব করে ভাবে ,”বিবাহিত জীবন বুঝি এমন হয়? এভাবেই কি আমাকে আজীবন থাকতে হবে?”এই কদিনে নিতু অনেক চেষ্টা করেছে তৌসিফ এর সাথে কথা বলতে,গল্প করতে , ওকে জানতে কিন্তু তৌসিফ এর সময়ই নেই। তবে আজকাল যেকোন প্রয়োজনে নিতুর ডাক পরে। নিতু সবটা মেনে তৌসিফ কে ভালোবাসতে চায় কিন্তু তৌসিফ এর এড়িয়ে যাওয়া, অবহেলা দেখে আবার পিছিয়ে যায়।খুব বিরক্ত হয় নিতু।আর এসব কারনে তৌসিফ এর মোবাইল নাম্বারটা ও নিতুর আর নেয়া হয়না।

তৌসিফ কথা বেশি না বললেও মনে মনে নিতুর কাজে বেশ খুশি হয়। সকালে ঘুম থেকে উঠে থেকে শুরু করে বাইরে যাওয়ার সময় আবার সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলেই হাতের কাছে সব পাচ্ছে। নিতু সব এগিয়ে তৌসিফ এর হাতের কাছে এনে রাখে।সব গোছানো,বাড়িটাকে এখন সত্যি বাসা মনে হচ্ছে। সারাদিন আড্ডার মাঝেও যখনি নিতুর কথা মনে পড়ছে তখনই হুট করে বাসায় চলে আসছে।এটা নিছক শরীরের টানে নাকি নিতুর ভীতু চেহারা ওর মনেও কিছুটা জায়গা করে নিয়েছে সেটা ঠিক বুঝতে পারছেনা তৌসিফ। নরম তুলতুলে নিতুর সান্নিধ্য ওর বেশ লাগে। সারাক্ষন মেয়েটার মাঝে ডুব দিতে ইচ্ছে হয়। তৌসিফ ভাবে বোকাসোকা এই মেয়েটা সব মিলিয়ে একেবারে মন্দ নয়। তবে কেনো জানি এর বেশি নিতু কে জানতে ইচ্ছে করেনা।আর এই একটু একটু ভালোলাগার কথাও নিতু কে বলা হয়না।নিতুর রান্নায় অভ্যস্ত হয়ে পরে বাবা আর ছেলে। খাওয়ার সময় নিতু সামনে থাকে। কিছু লাগলে এগিয়ে দেয়।এসবই তৌসিফ এর ভালো লাগে। আজকাল আর বাইরে তেমন একটা খায়না। তবে এই একটু ভালোলাগার কথাটাও নিতু কে বলা হয়না। বলতে ইচ্ছা হয়না। নিতুর জন্য ওর যেই অনুভূতি আস্তে আস্তে তৈরি হচ্ছে এমন অনুভূতি আগে অন্য কারো জন্য কখনো হয়নি। তৌসিফ ভাবে,”বিয়েটা যদিও করার কোন ইচ্ছা ছিলো না। কিন্তু বিয়ের পর থেকে সময় খারাপ কাটছে না।বেশ ভালোই কাটছে।”

আকবর আলি তৌসিফকে বিয়ের পর থেকে বলছে দোকানে বসতে।দোকানের সব কিছু জেনে রাখতে। কিন্তু তৌসিফ কোনভাবেই রাজী নয়।বললেই বলে,”বাবা, বিয়ে করতে বলেছো করেছি এর বেশি আর কিছু বলো না।ওসব দোকান আমি সামলাতে পারবো না।”

আকবর আলিও মাঝে মাঝে রেগে যায়। আবার মাঝে মাঝে ঠান্ডা মাথায় তৌসিফ কে বোঝায়। কিন্তু কোন কাজ হয়না। দোকানে না গিয়ে সারাক্ষন আড্ডা দেয়। বাইরে ঘুরে বেড়ায়। আকবর আলি নিতু কে বলে,”আমার বয়স হয়েছে মা।আজকাল শরীর ভালো লাগছে না। ছেলেটাকে বোঝাও । ওকে দোকানে বসতে বলো।”

নিতু বলে,”চিন্তা করবেন না বাবা আমি ওনাকে বলবো ।”কিন্তু মন মনে ভাবে কীভাবে বলবে।সেতো দরকার ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে কোনো কথাই বলেনা।আর বলার সুযোগও দেয়না।

আকবর আলি নিতুর কথা শুনে একটু নিশ্চিন্ত হন।আসোলে গত ৩/৪দিন ধরে আকবর আলির শরীর বেশ খারাপ লাগছে।তাই এই একমাত্র ছেলেটার জন্য তার খুব চিন্তা হয়।আর এখনতো সাথে এমন লক্ষি একটা বৌও আছে। মেয়েটাকে সাধ করে ছেলের বৌ করে এনেছে।এখন ছেলে যদি লাইনে না আসে তাহলে মেয়েটার জীবন নষ্ট।এসব ভেবে কদিন ধরে আকবর আলির মনটাও ভালো লাগছে না।

তপুর সাথে নিতুর হাতে গোনা ২/৩দিন দেখা হয়েছে।তপুর নিতু কে বেশ ভালো লেগেছে। তবে বিয়ের পরেও তৌসিফ এর এমন বাইরে আড্ডাবাজি , সারাক্ষন বাইরে ঘোরাঘুরি দেখে তপু বিরক্ত। কয়েকবার তৌসিফ কে বলেছে এসব এখন ছাড়তে। কিন্তু তৌসিফ উল্টো তপুর সাথে খারাপ ব্যবহার করে।দুজনের মাঝে শৈশবে খুব ভাব থাকলেও বড় হবার সাথে সাথে দুরত্ব অনেকটাই বেড়েছে।কেউ যেনো কারো কথা শুনতে চায়না।

আকবর আলির ঔষধ শেষ হয়ে গেলে নিতু ভাবে ও আনতে যাবে।তখনি তপু বাইরে বের হচ্ছিলো। নিতু কে দেখেই জিজ্ঞেস করে,”কী ব্যাপার নিতু কোথায় যাচ্ছো?”

“জ্বী বাবার ঔষধ শেষ।আনতে যাচ্ছি। বাবার শরীরটা ভালো না।”

তপু বলে,”আচ্ছা ঔষধের নামটা আমাকে বলো আমি নিয়ে আসছি। তোমাকে বাইরে যেতে হবে না। কিছু লাগলে এরপর থেকে আমাকে বলো আমি এনে দেবো। আমার মোবাইল নম্বরটা রেখে দাও।”বলেই নিতুর নম্বর নিয়ে ওর মোবাইলে ফোন দেয়।এরপর সেইভ করে রাখতে বলে।

নিতু সাথে সাথে সেইভ করে রাখে।তৌসিফ তখনি একটা কাজে বাসায় আসছিলো।এমন সময় তপু কে নিতুর সাথে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে মেজাজ খারাপ করে আবার বাইরে চলে যায়। তপু চাচার জন্য ঔষধ নিয়ে ফেরার পথে রাস্তায় তৌসিফ কে দেখে বলে,”চাচা অসুস্থ জানিস সেই খবর?”

তৌসিফ এর মেজাজ এমনি খারাপ থাকে।এর মাঝে তপুর কথায় খানিক বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলে,”আমার বাবার অসুস্থতার খবর কি আমাকে তোর কাছ থেকে জানতে হবে?”

তপু বোঝায়।বলে,”দেখ তৌসিফ তুই এখন বিয়ে করেছিস। একটা মেয়ের দায়িত্ব তোর ওপর।চাচাও অসুস্থ তাই সবকিছু বোঝার চেষ্টা কর। সংসার এর দায়িত্ব নে।মেয়েটাও বেশ ভালো। ওকেও সময় দে।তোর বাবা কিন্তু সে আমারও চাচা তাই তোকে কথাটা জিজ্ঞেস করেছিলাম।”

তৌসিফ এর রাগ যেনো আরো বেড়ে গেলো। রেগে কিছু না বলে ওখান থেকে বাসায় চলে আসে। বাসায় ঢুকেই আজ খুব রাগ দেখাচ্ছে। নিতু বুঝতে পারেনা। তপু ঔষধ দিয়ে চলে যায়। তৌসিফ নিতু কে ডাকে। জানতে চায়,”কি দিয়ে গেলো তোমাকে?”

নিতু বলে,”বাবার ঔষধ।”বলা শেষ করতেই তৌসিফ এসে গাল চেপে ধরে।

চিৎকার করে বলে,”বাবার ঔষধের কথা আমায় ফোন করে বলা যেতো না?তপু কে কেনো বলতে হবে?ওর সাথে তোর এতো কি কথা?”

নিতু কেঁদে দেয়। বলে,”ছাড়ুন ব্যাথা পাচ্ছি। আমি বলিনি ভাইয়াকে।আমি ঔষধ আনতে বাইরে যাচ্ছিলাম তখন উনি জোর করে আমাকে বাইরে যেতে বারন করে নিয়ে আসলেন।আর আমার কাছে আপনার ফোন নম্বর নেই। আপনি দেননি তো।”

শেষ কথা শুনতেই তৌসিফ গাল ছেড়ে দিলো।ঠিকই তো নিতুর নম্বর ওর কাছে আছে তবে এতো দিনে একবার ও তৌসিফ নিতু কে ফোন দেয়নি।আর নিতু ও দেয়নি। নিতু ইচ্ছে করেই ফোন নম্বর চায়নি। আবার যদি রেগে যায় এই ভেবে। নিতু কাঁদতে থাকে। তৌসিফ এর এমন ব্যবহার ওর ভালো লাগে না। খুব মায়ের কথা মনে পরে।

তৌসিফ রাগে চেয়ার ফেলে দিয়ে বাড়ান্দায় চলে যায়। সিগারেট খেতে থাকে।কেনো জানি নিতুর সাথে তপুকে হাসিমুখে কথা বলতে দেখে ওর ভালো লাগে না। ছোটবেলা থেকেই তপুর সাথে ওর ভুল বোঝাবুঝি তাই হয়তো বিষয়টা স্বাভাবিক হওয়ার সত্ত্বেও ওর ভালো লাগে না।সব কিছু অসহনীয় লাগতে থাকে। তৌসিফ ঐ দিন আর বাইরে যায়না। সারাদিন খাওয়া দাওয়াও করেনা। নিতু একবার ডাকে খেতে তৌসিফ রাগ দেখালে আর ডাকার সাহস করেনা।নিতুও খায়না।বিষন্ন মনে ওর কাজ করে যায়। রাতে খেতে ডাকলেও বলে দেয় যে খাবেনা।তাই নিতু রাতেও খায়না।সব গুছিয়ে রাতে ঘুমাতে গেলে দেখে তৌসিফ তখনও বাড়ান্দায় বসে আছে।পুরো রুমে সিগারেট এর গন্ধ। এমনি সারাদিন খায়নি সাথে এই গন্ধ সব মিলিয়ে নিতুর পেট গুলিয়ে বমি পায়। মুখে পানি দিয়ে আস্তে এসে শুয়ে পরে। তৌসিফ এর সাথে আর আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি বা ডাকতেও যায়নি।ভাবে ডাকলে আবার যদি রেগে যায়।আর দুপুরের ঘটনায় ওর মনটাও খারাপ ছিলো। সম্পর্কটা কীভাবে স্বাভাবিক হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করতে থাকে নিতু।

এদিকে সারাদিন নিতু তৌসিফ কে এড়িয়ে চলায় ওর মন মেজাজ এমনি খারাপ ছিলো।এর মাঝেই হঠাৎ রুমের লাইট অফ দেখে রুমে এসে লাইট জ্বালিয়ে দেখে নিতু শুয়ে পড়েছে। এটা দেখে তৌসিফ এর রাগ যেনো তরতর করে চরমে উঠে গেলো।ও সিগারেট ফেলে নিতুর পাশে শুয়ে ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুজে দেয়। মনে হচ্ছে সব রাগ নিতু কে কাছে টেনে নিলেই কমবে। নিতুর অস্বস্তি হলেও প্রথমে ভাবে কিছু বলবে না। কিন্তু ক্ষুধা, সিগারেট এর বাজে গন্ধ আর এর সাথে পুরো শরীরে তৌসিফ এর হাতের অবাধ্য বিচরনে নিতুর আর সহ্য হয়না। খুব খারাপ লাগে,বমি পায় যার কারনে না পেরে দ্রুত তৌসিফ কে সরিয়ে দিয়ে উঠেই ওয়াশরুমে দৌড়ে চলে যায়।বেসিনে গলগল করে বমি করে, দুর্বল হয়ে পরে। শরীরে আর বল পায়না।কোন রকম মাথায় পানি দিয়ে আস্তে ধীরে বের হয়।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here