মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ০১,০২,০৩

0
1861

#মেঘবতীর_শহরে,পর্বঃ০১,০২,০৩
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
০১


জাহিনের হাতে ধপধপ করে জ্বলছে আধো খাওয়া সিগারেট টা!তার রক্তিম ক্ষীণ আলো যেন অন্ধকার মোচন করে সামনে থাকা অর্ধ ভেজা নারীর রূপ উন্মোচনে মত্ত!

ঝুম বৃষ্টি নেমেছে সেই কখন থেকে।এখন নৈশপ্রহর।পুরোনো জীর্নশীর্ন দোতলা বাড়ির নিচে দাড়িয়ে সিগারেট হাতে জাহিন।কোথা থেকে হুট করে সামনে এক আগুন্তক এর দেখা!সাদা জামায় আবৃত কোনো এক সুকেশিনী দাড়িয়ে!ভেজা গাঁ ঢাকতে আপ্রাণ চেষ্টায় মত্ত মেয়েটি।এক মুহূর্তের জন্য দৃষ্টি থমকে যায় জাহিনের।অর্ধাংশ সিগারেট টা নিভু,নিভু জ্বলতে থাকে হাতে!

ভাবতে থাকে এ নিশ্চয়ই কোনো পরী হবে!যে গল্প ছোটবেলায় নানুমনির কাছে প্রায়ই শুনতো জাহিন!গভীর রাত্রী তার মাঝে ঝুম বৃষ্টি!পুরোনো এই বাড়িটায় নিশ্চই কোনো মেয়ে দাড়িয়ে থাকবে না!

সামনে থাকা মেয়েটির হলদাভাব গায়ের রং যেন অন্ধকারে দ্যুতি ছড়াচ্ছে!অজানা এক মোহাবিষ্টে জড়িয়ে আছে জাহিন।কি নিখুঁত অঙ্গভঙ্গিতে আলতো করে গা টা উড়না দিয়ে জড়িয়ে নিচ্ছে মেয়েটি!মুখ টা অবশ্য ভাল করে বোঝা যাচ্ছে না।

বৃষ্টি যেন এখন উত্তর দিক দিয়ে ঝেপে নেমেছে।গায়ে বেশ ভালভাবেই ছাঁট লাগছে।জাহিন খেয়াল করে তার মাথার উপর খানিকটা ছাদ থাকলেও তার সামনে থাকা পরীটির মাথার দিকটা উন্মুক্ত!হাতে থাকা সিগারেট টা সেই কখন নিভে গেছে!জাহিনের মোহ যে কাটছে না কিছুতেই! হঠাৎ উপর তলা থেকে একটা মেয়েলি আওয়াজ কানে ভেসে আসলো।জাহিন যতদুর শুনতে পেয়েছে তা হলো “মুহু আপু বাবা চলে গেছে।তাড়াতাড়ি উপরে আয়।


চোখের পলকে যেন সামনে থাকা পরীটি উধাও!অন্ধকারে কোথাও মিলিয়ে গেল!এদিকে রাতের প্রহর জানান দিচ্ছে জাহিনকে এখনি বাড়ি ফিরতে হবে!জায়গাটা গ্রাম আর শহরের ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে।তবুও বেশ নির্জন যেন।নিজের দিকে খেয়াল হতেই জাহিন দেখে একদম ভিজে চুপচুপ হয়ে গেছে গাঁ!নির্ঘাত জ্বর বাধিয়ে ছাড়বে আজ!বৃষ্টির পানি যে একদম সহ্য হয় না জাহিনের!হাতে থাকা সিগারেট টা ফেলে নিজের গাড়ির দিকে ছোটে জাহিন।

গাড়িতে বসে পকেট থেকে রুমাল টা নিয়ে মাথাটা খানিক মুছে নেয়।মাথা ঝিম মেরে আছে কেমন এ যে জ্বরের পূর্বাভাস!তবে চট করে ” মুহু” নাম টা যেন মাথায় গেথে গেছে জাহিনের।পরীদেরও নাম হয়? সাতপাঁচ প্রশ্ন মাথায় নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয় জাহিন।পেছনের সিটে রিশান,আনান প্রায় আধো ঘুমে ঢুলুঢুলু!


বিয়ে বাড়ির হই হুল্লোড়ে রাতের প্রহর যেন খেয়ালে নেই কারো।বৃষ্টি,কাঁদামাটি যেন আনন্দ দমাতে পারেনি একটুও।সদর দরজায় বসে আছেন মিসেস নবনী।কপালে তার সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ!ঘড়ির দিকে নজর বুলাচ্ছে বারংবার।

সামনে মায়ের চিন্তিত মুখটা দেখে ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসে জাহিন।গলা ঝেড়ে হাসার চেষ্টা করে বলে,

“মা মনি তুমি ঘুমোওনি?

বিচলিত পায়ে এগিয়ে আসেন মিসেস নবনী।ছেলের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বলেন,

” তুই তো একদম ভিজে গেছিস রে জাহিন!তোর তো বৃষ্টির পানি একদম সহ্য হয় না!তা ছাড়া এখানকার কিছুই চিনিস না তুই!মা মনি কে টেনশন দিয়ে মেরে ফেলবি?

“এত কিসের চিন্তা মা মনি?তোমার ডক্টর ছেলে থাকতে তোমার কিসের চিন্তা বলো তো শুনি?

” এখানে বেড়াতে এসে যদি জ্বর বাধিয়ে ফেলিস?কোথায় গিয়েছিলি তোরা?

“এই বৃষ্টিতে বিয়ে বাড়ির কোনো মজা আছে বলো তো?তার চেয়ে ভাল শহরটা ঘুরে দেখে আসলাম!

” পাগল হয়ে গেছিস?এই রাতে তাও আবার বৃষ্টির মধ্যে তুই শহর দেখতে বেড়িয়েছিস?কোথায় গিয়েছিলি?

ওষ্ঠ ছড়িয়ে হেসে জবাব দেয় জাহিন

“মেঘপরীর শহরে গিয়েছিলাম মা মনি!

বলেই লম্বা, লম্বা পা ফেলে রুমের ভেতরে হাটা দেয় জাহিন।পরক্ষণে রিশান আর আনানের কথা মনে হতেই গাড়ির দিকে ছোটে।দুটোকে ঘুম থেকে জাগিয়ে রুমে নিয়ে আসে।



আড়মোড়া ভেঙ্গে রুমে এসে আবারও খাটে ঝপাৎ করে শুয়ে পরে রিশান।পাশে সোফায় বসে হাই তুলতে তুলতে জাহিনের উদ্দেশ্যে বলে আনান,

” গাড়িতে কখন ঘুমিয়ে পরলাম রে জাহিন?আর তুই হুট করে কোথায় নেমে গিয়েছিলি বলতো?

“পাশেই ছিলাম।তোদের যে কখন কি ইচ্ছে জাগে।মা মনি কত শত প্রশ্ন করে বসেছে জানিস?

” কি বলেছিস?সত্যি টা বলে দিসনি তো?

“হ্যাঁ বলেছি রিশান আর আনান সিগারেট খেতে বেরিয়েছে আর আমিও তাদের সাথে গিয়েছি।

” তুমিও খাইছো।নিজে সাধু ক্যান সাজস ভাই?

“মোটেও না।তোরা জোড় করছিলি তাই জলন্ত সিগারেট নিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু দুরে দাড়াই।অমনি ঝুম বৃষ্টি নামে!তারপর……..

কথা থেমে যায় জানিনের।আনান পুনরায় হাই তুলে বলে,

” রাখ তোর ক্যাচাল।তুই সাধু ভাই বুঝছি।অহন ঘুমাইতে দে সর।

রিশানের পাশেই ঠাস্ করে শুয়ে পরে আনান।বাঁকা হেসে জানালার পাশে এসে দাড়ায় জাহিন।কেমন শীত শীত অনুভূত হচ্ছে!আগাম মেডিসিন নিয়ে সোফায় এসে গা এলিয়ে দেয় জাহিন।

চলবে

#মেঘবতীর_শহরে
পর্বঃ০২
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা


সারারাত বৃষ্টির পর সকাল টা কেমন ঝকঝক করছে!পাতায় পাতায় বৃষ্টি বিন্দু ছড়িয়ে।ভেজা মাটির সুভাস ভাসছে চারিদিকে।জানালা গলে রোদ এসে ঠাঁই নিয়েছে ঘরে।বাহারি পাখির কিচিরমিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে।ঘুম আর বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না জাহিনের।বরাবরের মতো সকালে জেগে অভ্যাস।অবশ্য তার ঘুমের কোনো নিয়মনীতি নেই!যখনি সময় পায় খানিক ঘুমিয়ে নেয়।বাড়িতে থাকাকালীন নিয়মের আওতায় চলে আসে সব।



আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে জাহিন।মাথাটা কিঞ্চিৎ ভার লাগছে।কালকে সময়মতো মেডিসিন না নিলে নির্ঘাত জর বাধিয়ে নিতো!কোথাও বেড়াতে এসে অসুখ বাধানো রীতিমতো বিব্রতকর অবস্থা!


বিয়ের তোড়জোড় লেগে গেছে মনে হয়।বাহিরে বেশ ভালই শোরগোল পাওয়া যাচ্ছে!বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ায় জাহিন।পাশে রিশান আর আনান বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।সে দিকে তোয়াক্কা না করে বেরিয়ে যায় জাহিন।

~~~

ছেলে যে ঠিক সকাল সকাল জেগে যাবে সে দিকে টনক আছেন মিসেস নবনীর।হাতে ধোঁয়া উঠা কফি নিয়ে দাড়িয়ে আছেন তিনি।মুখ জুড়ে চিন্তার ভাজ স্পষ্ট! ছেলেকে দেখা মাত্র এগিয়ে এসে ছেলের গাঁ,কপাল বুলিয়ে দেখলেন।

” মা মনি তুমি আমার চিন্তায় নিশ্চয়ই সারারাত ঘুমোওনি?তোমার শরীরের অবস্থা ভুলে গেলে হবে?

“আমার কথা ছাড় তো।তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো।

ওষ্ঠ ছড়িয়ে হাসে জাহিন।পরক্ষণে মাকে জড়িয়ে ধরে।

” তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার বলো তো?

“হয়েছে আমার জন্য চিন্তা থাকলে নিজের খেয়াল রাখতি তুই।

” আমরা কি আজই চলে যাব মামনি?

“ভাবী কে তো বলেছি আজই চলে যাব।

” আমারও জরুরি কাজ আছে।আজই চলে যাওয়া বেটার হবে।

“আচ্ছা তবে।

~~~

মর্নিংওয়াক করতে বেরিয়েছে জাহিন।হঠাৎ কোথা থেকে এক মেয়ে সামনে এসে দাড়ায় জাহিনের।খানিকটা চমকে উঠে জাহিন!

শাড়ি গাঁয়ে,কোমড়ে আঁচল গুজা মেয়েটির।বয়স এই তো কুড়িতে হবে।লম্বাটে চিকন গড়নের।কাঁধ ছড়ানো এক গুচ্ছ কার্লি বাদামী রঙের চুল।চোখের মনি দুটো আকাশী ধূসর রঙের।মেয়েটাকে কেমন অদ্ভুতই লেগেছে জাহিনের কাছে।প্রশ্ন করার আগেই মেয়েটি বলল,

“এই ছেলে তোমার মায়ের নাম কি নবনী?

মেয়েটির কথায় আরও একদফা চমকে উঠে জাহিন।মেয়েটাকে ইঁচড়েপাকা পাকা মনে হচ্ছে।তবে কেন জানি বেয়াদবের তকমা দিতে ইচ্ছে করছে না!বলার ভঙ্গিমা টা খুবই অদ্ভুত রকমের মিষ্টি ছিল!কোনোরকম তুতলিয়ে জবাব দেয় জাহিন

” হু,,,হুম।

“তোমার মা কফি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।যাও ওটা শেষ করে এসো।

মেয়েটির কথাটা কেমন আদেশের মতো শোনালো।মা মনি যে কফিটা নিয়েই কারো ডাকে ভেতরের রুমে গেল আর এদিকে সেটা না খেয়েই বেড়িয়ে এসেছে জাহিন।মনে হতেই ঘরের দিকে হাটা দেয় জাহিন।পেছন থেকে মেয়েটি আবার ডাকে,

” আরে আরে তোমার সাথে আমার কথা শেষ হয়েছে নাকি?

এবার মেয়েটিকে বেয়াদব ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না জাহিনের।ভ্রু কুঁচকে জিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকায় জাহিন।

“না মানে তোমার নাম টা?

” জাহিন আদহাম।

বলেই সোজা হেটে চলে যায় জাহিন।পেছনের মেয়েটির দিকে একবারের জন্যে দৃষ্টি ফেলেনি।

~~~

নবনীর হাত থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে কফি নেয় জাহিন।কপালে সুক্ষ্ম রাগের ভাজ।পর্যবেক্ষন করে নবনী বলে,

” ইম্মিসি তোকে কিছু বলেছে জাহিন?আসলে মেয়েটা একটু অন্যরকম।আমিই তোকে ডাকতাম কিন্তু ইম্মিসি এসে বলল সে’ই ডাকছে।কেন রে নাম ধরে ডেকেছে?আমাকেও নাম ধরে ডাকে।অবশ্য তোর নাম টা আমাকে জিগ্যেস করে গিয়েছিল।

মায়ের কথা শুনে আরেকদফা রাগ উঠে জাহিনের।মেয়েটা নাম জানা সর্তেও তাকে পুনরায় জিগ্যেস করেছে?আস্ত বেয়াদব একটা মেয়ে।

“কিছু না মা মণি।আমি আসছি।

আধো খাওয়া কফির মগ টা নবনীর হাতে ধরিয়ে দিয়ে নিজের কাজে চলে যায় জাহিন।

~~~

পুরো এলাকা ঘুরে মনে হয়েছে জাহিনের, এটা মফস্বল এলাকা।অলিগলি অনেক।শহরতলী যাকে বলে।এর আগে কখনও এখানে আসা হয়নি জাহিনের।

বিয়ে টা বলতে গেলে বেশ ঘরোয়া ভাবেই হচ্ছে।আমন্ত্রিত লোক হাতে গোনা বিশ,পঞ্চাশ জন।জাহিনের মামির বোনের বিয়ে।মায়ের জোড়াজুড়িতে আসতে হলো।নয়ত এত দূরসম্পর্কের আত্মীয়র বিয়েতে আসতো না জাহিন।

~~~

ফ্রেশ হয়ে একদম রেডি হয়ে এসেছে রিশান।বেলা এগারোটা বাজে।পালা ধরে তৈরি হচ্ছে আনান আর জাহিন।আনান’ই আগে গিয়েছে গোসলখানায়।সারাবাড়িতে মাত্র দুইটা গোসলখানা।তারজন্য বেশ বিরক্তি ধরেছে জাহিনের।

চেয়ারে বসে হাতে বই নিয়ে বসেছে জাহিন।ইম্মিসি কয়েকবার জাহিনের রুমে উঁকিঝুঁকি দিয়ে গেছে।খানিকবাদে রিশান এসেছে।সোফায় বসতে বসতে বলে,

” মর্নিংওয়াক করতে এত টাইম লাগিয়ে দিয়েছো ভাই?আনান কখন বেরোয় কে জানে।

কথা কানে না নিয়ে পড়ায় মনোযোগ নিবেশ করে জাহিন।মাঝে দরজার সামনে এসে দাড়ায় ইম্মিসি।রিশান ঠিকঠাক হয়ে বসে ইম্মিসিকে ডাকে।

“হাই ইম্মিসি।এসো ভেতরে বসো।

সৌজন্য মূলক হেসে স্থান ত্যাগ করে ইম্মিসি।বইয়ের মাঝ থেকে একবার চোখ সরিয়ে রিশানের দিকে তাকায় জাহিন।

” ভাই মেয়েটাকে কিন্তু জোশ লাগে!বাঙালি,বিনদেশী মিশ্রিত হওয়ায় আরও বেশী সুন্দর লাগে!

ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করে জাহিন

“মিশেল?মানে?

” আরে আনান ভাইয়ার মামা জাপানিজ মেয়ে বিয়ে করেছে জানো না?

“তুই এত খবর কিভাবে জানলি?

“মেয়েটাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কোনো ঘাপলা কেইস আছে!আনান ভাইয়াকে জিগ্যেস করতেই ব্যস জেনে গেলাম ইম্মিসি হলো মিক্সিং কোয়ালিটি!

আনান গোসলখানা থেকে বেরুতে বেরুতে বলে,

” কিসের কোয়ালিটির কথা বলছিস তোরা?

রিশান দাড়িয়ে বলে,

“বিদেশি বীজের ফলন বাংলাদেশে।সোজা হিসেব।

ওদের আজগুবি কথা শুনলে মাথা ভনঁভন করে জাহিনের।বই রেখে,কোনোরকম গোসল খানায় ঢুকে যায় জাহিন।

~~~

কনে দেখতে ব্যস্ত সবাই।আনান আর রিশান একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছে।মাঝে অবশ্য জাহিন একটা তুলেছে।সবার ভিড়ের মাঝে সেখানে দুটো মেয়ে আসে।একটা বারো,পনেরো বছরের আরেকটা আঠারো’র কোঠায় হবে।পা অব্ধি লম্বাটে গাউন।মাথায় হিজাব বাঁধা।রিশান সবার অগোচরে জাহিনকে কনুই এর গুতো দিয়ে বলে,

” বড় টা কি জোশ না ভাই?অবশ্য বাই ওয়ান গেট ওয়ান মনে হচ্ছে!দুটোই তো একই প্যাকেটে মোড়া!শুধু কালার কম্বিনেশন ভিন্ন!

মেয়েটির দিকে একবার চোখ বুলায় জাহিন।অদ্ভুত মায়াবিনী মুখ!চোখজোড়া যেন অতি পরিচিত!দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে যায় অচেনা,অপরিচিত এই মেয়েটির মাঝে!

কনে হঠাৎ বলে উঠলো,

“মুহতাসনিম তোমরা এসেছো?

জাহিনের কানে মুহূর্তেই ঝংকার দিয়ে উঠে নাম টা ‘মুহতাসনিম’!!!!

চলবে…….

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিযোগ্য]

#মেঘবতীর_শহরে
পর্বঃ০৩
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা


নীচু কন্ঠে জবাব দিল মুহতাসনিম,

“জ্বী আপু মাত্রই এসেছি আমরা।বেশিক্ষণ দেরি করতে পারবো না।

” কি বলো?মাত্রই তো এসেছো তোমরা।না খেয়ে যেতে দিচ্ছি না।

পাশ থেকে মুহতানিম উত্তর দিল,

“আসলে আপুকে আজকে দেখতে আসবে।মা বলেছে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে।

” আচ্ছা বসো তোমরা।বেশিক্ষণ দেরি করাবো না।

খানিক্ষন পর আলেয়া তার মাকে ডেকে টাকা আনিয়ে নিলো।হিসেব বাবদ টাকা টা মুহতাসনিমের হাতে গুঁজে দিলো আলেয়া।ব্যাপার টা দৃষ্টিগোচর হয়নি জাহিনের।মুহতাসনিম’রা তৃপ্তির হাসি নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

রিশান ওমনি জিগ্যেস করে বসলো আলেয়াকে

” মেয়েদুটোকে কিসের টাকা দিলে আন্টি?

“বিয়ে বাড়ির ফুল,ফুলের গয়না সব মুহতাসনিমের থেকে নেওয়া।তারই টাকা দিলাম।

” এ টুকু মেয়ে বিজনেস করে?

“ওর বাবার’ই ব্যবসা।তবে মেয়েটা যতেষ্ট খাটে।তার অবদানই বেশি।

” পড়াশোনা নেই মেয়েটির?

“তা তো বলতে পারবো না।

বাইরে থেকে শোরগোল পাওয়া যাচ্ছে বর এসেছে।হই হই করে সবাই চলে গেছে বাহিরে।জাহিন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।অচেনা মেয়েটার কথাগুলো এত আগ্রহ নিয়ে শুনলো কেন জাহিন?মেয়েটাকে আগে কোথাও দেখেছে বলে মনে হচ্ছে না।তবে অসম্ভব মায়াবী একটা মুখ।কথা বলার সময় চোখের পাপড়ি গুলোও কেমন আলতো ভাবে উঠানামা করে!এত খুঁটিয়ে এর আগে কোনো মেয়ে চোখে পরেছে কিনা জানা নেই জাহিনের!আনানের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে জাহিনের।

~~~

“ধিঙ্গি মেয়ে হয়েছে তোমার বুঝলে?কোথায় আজকে বাড়িতে বসে থাকবি! তা না করে উনি বিয়ে বাড়িতে চলে গেছেন ধেঁই ধেই করে!টাকা টা কি পরে আনতি পারতি না?পারুল বেগম কখন থেকে বাড়ি তুলে চেঁচাচ্ছেন।

আলতাফ মিয়া সামনেই চুপটি মেরে কথা শুনছেন।বউ এর কথার উপর কথা বলার সাধ্য তার নেই!মুহতানিম এগিয়ে আসে।ব্যস্ত হাতে প্লেট বাটি নামাতে থাকে।পাশে থেকে ধমকে উঠেন পারুল বেগম।

” তুই এখানে কি করতে এসেছিস রে মুনা?বলি বিয়ে কি তোর নাকি ওই মুখপুরির?

মায়ের কথা কানে না নিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে আছে মুহতানিম।পাশের রুমে নতুন শাড়ি গায়ে জড়িয়ে বসে আছে মুহতাসনিম।চোখ বেয়ে অনর্গল জল পরে সাজ একদম ঘেটে গেছে!এক্ষুনি মুনা আসলে ঠিক বকে শেষ করে দিবে।সে দিকে একটুও ভ্রুক্ষেপ নেই!কষ্ট যে কোথাও বাঁধা মানতে চায় না।

মায়ের নিত্যদিনের কথাগুলো গায়ে সয়ে গেছে মুহতাসনিমের।আজ অন্তত মায়ের থেকে একটু ভাল ব্যবহার আশা করেছিল।বিয়ে হলে তো চলেই যাবে চিরদিনের মতো।অবশ্য তাকে বিদায় করতে পারলে বাঁচে পারুল বেগম।চোখের কাটা নিশ্চয়ই চোখের সামনে প্রতিদিন সহ্য হয় না কারোরই!

দরজার সামনে দাড়াতেই চেচিয়ে উঠে মুহতানিম!যেন বিশাল কোনো ভুল হয়ে গেছে!রাগী কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,

“মুহু আপু!চেহারার এ কি হাল করেছিস শুনি?কত কষ্ট করে সাজালাম তোকে?

চোখ মুছে মুখে হাসি টেনে নেয় মুহতাসনিম।মুনা কে আলতো জড়িয়ে ধরে বলে,

” তোদের ছেড়ে চলে যাবো এটা ভাবলেই চোখ উপচে জল পড়ছে।কি করে থাকবো বলতো?

“হয়েছে আর বলতে হবে না।মায়ের কথা শুনে কাঁদছিস তুই।ওসব কথা গায়ে মাখিস কেন বলতো?

” ছাড় তো ওসব কথা।

“এই আপু বড় মায়ের শাড়িতে তোকে না খুব সুন্দর মানিয়েছে রে!

শাড়ির আঁচল টা বুকে চেপে চোখ বুজে নেয় মুহতাসনিম।মায়ের চেনা গন্ধ টা যেন শাড়িতে জড়িয়ে আছে আষ্টেপৃষ্টে!

~~~

বিয়ে বাড়ির সকল আয়োজন শেষ হতে সন্ধ্যাে গড়িয়েছে সেই কখন।কনে বিদায় করে বাড়িটা কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে।যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে আনান,রিশান,জাহিন,মিসেস নবনী আর শায়লা বেগম।

জাহিন,আনান,রিশান গাড়িতে বসে বাকিদের অপেক্ষায় আছে।কোথা থেকে ইম্মিসি এসে হাজির।ওয়েস্টার্ন ড্রেস পরে আছে মেয়েটি।এখন একদম ছোট্ট একটি মেয়ে মনে হচ্ছে।একবার চোখ পরতেই চোখ সরিয়ে সামনে তাকায় জাহিন।মেয়েটিকে দেখলে রাগ চরম আকার ধারণ করে।কথা বলার ছলে প্রশ্ন করেই বসে ইম্মিসি,

“চলে যাচ্ছেন আপনারা?

পেছন থেকে রিশান জবাব দেয়,

” হ্যাঁ।তুমি যাবে?

উত্তর না দিয়ে চলে যায় ইম্মিসি।বাঁকা একটুখানি হেসে নেয় জাহিন।রিশানের উত্তর টা মেয়েটি মোটেও পছন্দ করেনি।জাহিনের থেকে উত্তরের আশায় ছিল!শব্দ করে হেসে বলে আনান,

“তোকে তো পাত্তাই দিলো নারে রিশু!

” এসব ছোট মেয়েদের পাত্তাতে কিছু আসে যায় না ব্রো!

~~~

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে ভালোই!পেছনের সিটে সবাই গল্পগুজবে মেতেছে।ফ্রন্টসিটে গাঁ এলিয়ে কানে হেডফোন গুজে দিয়েছে রিশান।

কালকে রাতের কথা মনে পরতেই ‘মুহু’ নামটা কানে বেজে উঠে জাহিনের!সে রাতে কি আসলেই কোনো মানবী ছিল?নাকি পরী?চেহারাটাও তো বোধগম্য হয়নি ততটা!মেঘ ভেঙ্গে বৃষ্টির ঝাপটায় শুভ্র জামায় নেমে এসেছিল মেয়েটি!অন্ধকারে যেন ক্ষনে ক্ষনে দ্যুতি ছড়াচ্ছিল!সে রাতের ঘটনা কি তবে কল্পনীয় হয়ে থাকবে জাহিনের কাছে?!!!দমকা হাওয়ায় কল্পনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে আসে জাহিন।

~~

ঘরের কোনে হাটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে মুহতাসনিম।ঘরে একটুও আলো নেই।নিকষ কালো হয়ে আছে চারিপাশ।চোখে অবশিষ্ট একটুও জল বাকি নেই!দুনিয়া টা বড্ড স্বার্থপর মনে হয় মুহুতাসনিমের।কাছের মানুষ গুলোই যদি এতটা স্বার্থপর হয় তবে এই নশ্বর পৃথিবীতে ভরসা করার মতো কেউ নেই ।এই নির্মম ভাগ্যে কে’ই মেনে নিবে মুহু।এ ছাড়া যে আর কিছুই করার নেই তার!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here