মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-২৪,২৫

0
587

#মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-২৪,২৫
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
২৪
,

নিশ্চুপ হয়ে জাহিনের পানে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।শুনশান বাতাস বইছে।নিরব মুহূর্তে কেবল বাতাসের শব্দ কানে আসছে।

জাহিন কি বলতে চাচ্ছে?আবারও ভাবনাগুলো কেমন এলোমেলো লাগছে মুহতাসনিমের।তবে কি ভালোবাসা ছাড়া’ই একটা সম্পর্কে জড়াতে যাচ্ছে মুহতাসনিম?আদৌ কি ঠিক হবে?পরক্ষণে যেন সম্ভিৎ ফিরে পায় মুহতাসনিম।আতিক তো খুব সুন্দর করে সবটা বুঝিয়ে দিয়েছেন।দোটানার প্রশ্নই আসে না!জাহিনের উপর ভিষণ বিরক্ত মুহতাসনিম।লোকটা আস্ত একটা পাগল!নয়তো এমন উদ্ভট চিন্তা কখনই মাথায় আসতো না!

উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে জাহিন।মুহতাসনিমকে এমন সজ্জায় সুন্দর লাগলেও দেখতে ভালো লাগছে না জাহিনের।

মুহতাসনিম চোখমুখ শক্ত করে জবাব দিলো,

“হ্যাঁ ভালোবাসি।আর ভালোবাসা ছাড়া সম্পর্ক হয় নাকি?

বলেই ব্যস্ত পায়ে হেটে চলে যায় মুহতাসনিম।পিছু তাকিয়ে থাকে জাহিন।শাড়ির লম্বা আচঁল টা মেঝে ছুঁই ছুঁই!মস্তবড় খোপা থেকে আঁচল পরে আলগা হয়ে এসেছে!

দম ছেড়ে আকাশ পানে তাকায় জাহিন।বিশাল ভাবনায় ডুবে যায়।ভালোবাসা কি তবে সত্যিই একটা সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে?আদৌ সবাই কি ভালোবেসে একসাথে থাকে চিরজীবন?তবে মুহু যেহেতু ভালোবাসে আতিক কে সেক্ষেত্রে একটা সম্পর্কে যাওয়াই যায়!শেষ অব্ধি হিসেব না মিললেও স্বার্থকতা মিলবে!

কাধে কারও স্পর্শ পেয়ে ভাবনা কাটে জাহিনের।আনান হাসি মুখ নিয়ে বলে,

” কিরে আসার পর দেখা করলি না!কল’ও তো করতে পারতি একটা।

পাল্টা হেসে জবাব দেয় জাহিন।

“তুই বাসায় ছিলি না ভাবলাম আসার পর তো কথা হবেই।

” তা কতদিনের ছুটি নিয়ে আসলি?এবার আমার বিয়ে শেষ না হওয়ার আগ পর্যন্ত যেতে দিচ্ছি না তোকে।

“তোর বিয়ের তো আরও বেশ কয়েকদিন বাকি!আমি এসেছি সবে দুটোদিনের জন্যে।তোর বিয়েতে আসার জন্যে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আনান।

মুহূর্তে রেগে যায় আনান।

” চেষ্টার মানে কি জাহিন?তোর কথা মাঝে মাঝে প্রচন্ড রাগ উঠায়।আমার বিয়েতে যদি তুই থাকতে না পারিস তবে তোর সাথে আমার সম্পর্ক সেদিনই শেষ!

জাহিন বেশ বুঝতে পেরেছে আনানের রাগ চরম পর্যায়ে!কথার প্রসঙ্গ পাল্টায় জাহিন।

“আজকে তো তোর বন্ধুর বিয়ে তা কেমন তদারকি করলি?

” বিয়ে তো হচ্ছে আমাদের বাসাতেই!লাইটিং থেকে শুরু করে সব কিছুই আমি তদারকি করেছি।বিয়েটা খুবই ছোট্ট আর ঘরোয়া ভাবে হচ্ছে।এটা নাকি আতিকের বউয়ের ইচ্ছে।

ছোট্ট করে “ওহ” বলে জাহিন।

“মেয়েটা দেখতে খারাপ না বুঝলি তবে পরিবার সম্পর্কে তো কিছুই জানি না।তা ছাড়া বাসাটা পর্যন্ত চিনি না!আতিক বলেছে তার এসব কিচ্ছু জানার প্রয়োজন নেই!

অন্য মনস্ক হয়ে বলে জাহিন,

” ভালোবাসা বোধহয় এমনি হয় রে!

আচমকা ভুত দেখার মতো চমকে উঠে আনান।

“কি বললি জাহিন?তোর মুখ থেকে এ কথা বের হলো?ভা,,,ভা,,,ভালোবা,,,,,সা

হঠাৎ আনানের ফোন বেজে উঠে।স্ক্রিনে ”Rafu” নাম টা ভেসে উঠেছে!

একগাল হেসে জাহিন বলে,

“ভালোবাসা বলতেই তোর ভালোবাসা হাজির।

ফোন রিসিভ করে পাশে চলে যায় আনান।পূনরায় আকাশের দিকে পূর্ন দৃষ্টি মেলে তাকায় জাহিন।

~~~

দুপুর নাগাত পার্লার থেকে সাজিয়ে আনা হয় মুহতাসনিমকে।একটু পরেই আতিকের বাড়ি থেকে মুরব্বিরা আসবেন তারপর ছোট্ট করেই বিয়ে পড়ানো হবে।সকাল থেকে বেশ অনেকবার কল করেছে মুহতানিম।একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা!উত্তেজনার রেশ যেন কাটতে চাইছে না।সম্ভব হলে দৌড়ে চলে আসতো মুহতানিম।বোনের কান্ড দেখে মন ভার হয়ে আছে মুহতাসনিমের।জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্তে পরিবারের কেউ উপস্থিত নেই!এটা যে কতটা যন্ত্রণাদায়ক লাগছে মুহতাসনিমের কাছে!

হঠাৎ ফোন বেজে উঠে মুহতাসনিমের।স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে আতিক।আশপাশ টা একটু তাকিয়ে আড়ালে গিয়ে ফোন রিসিভ করে মুহতাসনিম।

” বিরক্ত করলাম মুহতাসনিম?আপনি বোধহয় সাজতে ব্যস্ত ছিলেন।

“না,কখন থেকে সেজে বসে আছি।

” তারমানে আপনি আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন মুহতাসনিম?

আতিকের কথা এবার লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে মুহতাসনিমকে।

“আচ্ছা রাখছি এখন।

” একটু শুনুন?

“হুম।

” আমাদের বাড়ি থেকে আপনাকে কি রঙের শাড়ি দেওয়া হয়েছে আমাকে সেটাও পর্যন্ত বলেনি।সবটা সারপ্রাইজ রাখতে চাচ্ছে।সব বিচ্ছু আতিফের কাজ বুঝলেন।এবার এখন আমায় বলুন তো আপনি ঠিক কি রঙের শাড়ি পরে আছেন?

ফোনের এপাশ থেকে মুচকি হাসছে মুহতাসনিম।হাসি চেপে বলে,

“সেটা না হয় সারপ্রাইজই থাক!

ফুস করে দম ছেড়ে বলে আতিক,

” সত্যিটা বলে দিলাম তো তাই বললেন না।আমিও সারপ্রাইজের জন্যে অপেক্ষায় রইলাম।

“রাখছি।

“আরেকটা কথা মুহতাসনিম?

ফোন কানে রেখে চুপ করে আছে মুহতাসনিম।

” আমি কিন্তু আজকের পর থেকে আপনাকে আর আপনি বলবো না!সেইম আপনিও!

হঠাৎ ফোনের ওপাশ থেকে শব্দ আসছে কেউ বলছে,ভাইয়া তাড়াতাড়ি আসো।
পরক্ষনে টুক করে লাইন টা কেটে দেয় মুহতাসনিম।

~~~

কোথাও যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছে জাহিন।আয়নায় দাড়িয়ে হাতঘড়ি পরতে ব্যস্ত।দরজার সামনে এসে দাড়ায় নবনী।

“তৈরি হয়ে গেছিস?

আয়নায় তাকিয়েই অবাক হয়ে মায়ের পানে তাকায় জাহিন।

” হ্যাঁ তৈরি কিন্তু তুমি কোথায় যাবে মামণি?

“কেন মুহতাসনিমের বিয়েতে!

” আমি একটু অন্য জায়গায় যাওয়ার জন্যে বের হবো মামণি।

“মানে কি?একটুপরেই মেয়েটার বিয়ে আমরা সবাই উপস্থিত থাকবো সেখানে।ওখানে থাকাটা তোমারও দায়িত্বের মাঝে পরে।

” আজ যদি আমি বাসায় না থাকতাম তবে কি বিয়েটা আটকে থাকতো মামণি?

“অতো কথা বলে লাভ নেই।চলো আমার সাথে।তুমি এসেছো সেটা সবাই দেখেছে তবে এখন গড়িমসি করছো কেন?আর না যাওয়ার তো কোনো কারণ দেখছি না।আমার জানা মতে হসপিটাল ছাড়া আহামরি কোনো কাজ নেই তোমার।

কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে জাহিন,

” ঠিক আছে চলো।

মুহতাসনিমের বিয়েতে যাওয়ার ইচ্ছে এবং মানসিকতা কোনোটাই ছিল না জাহিনের।মামণির জোড়াজুড়িতে যেতে হচ্ছে।

নবনী এবং জাহিন বের হতেই শায়লা বেগম বলেন,

“আমার ছেলের বিয়েতে কিন্তু অবশ্যই থাকবে জাহিন।বাগদান হওয়ার সময় থাকতে পারোনি তার জন্যে তোমার নানুমণি রাগ।

রেহানা বেগম পান চিবুতে চিবুতে বের হোন।পরনে তার সাদা, গোল্ডেন মিশেল তাঁতের শাড়ি।জাহিনের উদ্দেশ্যে বলেন,

” নানাভাইয়ের সাথে আমি রাগ।আমার কথাটা রাখে নাই।এইবার দেখি কি করে।

মুখে হাসি টেনে নানুমণি কে এসে জড়িয়ে ধরে জাহিন।গালে গাল লাগিয়ে বলে,

“আদর দিলে রাগ গলে পানি হয়ে যাবে নানুমণি।

” হইছে ঢং!এই আদর ঘরে বউ আইনা বউয়েরে দে।

কথাটা খানিকটা লজ্জা দিলো জাহিনকে।আনান তৈরি হয়ে এসে বলছে,

“তোমরা উপরে যাও আমি আতিককে নিয়ে আসছি।গাড়িতে আছে ওরা।

রিতা বেগম সিড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠতে উঠতে বলছেন,

” মেয়েটার ভাগ্যে আছে বলতে হয়।নয়তো এমন ঘরে বিয়ে হয় বলুন আপা?

নবনী জবাব দেয়,

“যার ভাগ্যে যেটা লেখা আছে সেটাই হবেই রিতা।এ নিয়ে আমাদের না ভাবলেও চলবে।

~~~

ঘড়িতে সময় তিনটে পয়তাল্লিশ মিনিট।বধূসাজে বসে আছে মুহতাসনিম।ঘরে মিনা বেগম আর জাহিনদের পরিবারের লোক ছাড়া কেউ নেই।বাকি আতিকদের বাড়ি থেকে দশ বারো জন মুরব্বি আসবেন।

জাহিন আড় চোখে একবার মুহতাসনিম কে দেখেছে।গাঢ় নীল রঙের বেনারসি পরে বসে আছে।একটু ভারী সাজ মনে হচ্ছে আজকে।তবে চমৎকার সৌন্দর্য বিরাজ করছে।

~~~

হঠাৎই হুড়মুড়িয়ে রুমে প্রবেশ করে আনান।উপস্থিত সবাই অনেকটা চমকে উঠে!হাপিয়ে উঠেছে আনান।কপাল চুইয়ে ঘাম।বিধ্বস্ত লাগছে কেমন!শুকনো ঠোঁটজোড়া নিয়ে কোনোরকম বলে আনান,

” আতিকদের গাড়িটা এক্সিডেন্ট করেছে!খুব বাজেভাবেই।আমি আসছি।

বলেই বেরিয়ে যায় আনান।একমুহূর্তের জন্যে নিজের কান কে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করলো না মুহতাসনিমের।পুরো রুম স্তব্ধ হয়ে আছে!আচমকা এমন খবর টা কারও মস্তিষ্ক যেন হজম করতে পারেনি!

জানিন একপলক মুহতাসনিমের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে এলোমেলো পা ফেলে আনানের পিছু পিছু ছুটে গেল!বুকের ভেতর টা ভিষণ রকম কাঁপছে জাহিনের।পা গুলি অসার হয়ে আসতে চাইছে!মন থেকে ভিষণ ভাবে চাইছে যেন পুরোপুরি ভালো থাকে আতিক।

কয়েক সিড়ি পাড় হতেই দেখে সিড়িতে বসে আছে আনান।ফুঁপিয়ে কাঁদার শব্দ হচ্ছে।হাটুতে মুখ গোঁজা!থমকে দাঁড়িয়ে পরে জাহিন।কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠে!শুকনো ঢোক গিলে ডেকে উঠে জাহিন,

“এই আ,,,আনান?

তৎক্ষনাৎ উঠে এসে জাহিনকে জড়িয়ে ধরে আনান।ভাঙ্গা কন্ঠে বলে,

“আতিক আর নেই ভাই!

আপনাআপনি চোখদুটো ঝাপসা হয়ে আসলো জাহিনের।

” আমি হসপিটাল যাচ্ছি।তুই এদিকটা সামলা।

দ্রুত পা ফেলে চলে গেল আনান।বাকি সিড়ি গুলো উঠার সাহস করতে পারছে না জাহিন।মুহূর্তে এতকিছু কিভাবে বদলাতে পারে?একটা সুন্দর দিন হতে পারতো আজ!নিয়তি কেন এমন হয়?

~~~

ধীরগতিতে পা ফেলে উপরে চলে আসে জাহিন।ভেতরের রুম থেকে মিনা খালার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে।দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় জাহিন।মুহতাসনিমের হাতে ফোন।পাগলের মতো কাউকে কল করে যাচ্ছে।কপালে রাগের ভাজ।চোখ ভিজে কাজল ঘেটে একাকার!

জাহিনকে দেখে দৌড়ে আসে শায়লা বেগম।

“আনান কে পেলে?কি বলল?

রেহানা বেগম মুহতাসনিমের মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন।

একপলক মুহতাসনিমের দিকে তাকায় জাহিন।পরক্ষণে মৃদু শব্দে বলে,

” বিয়েটা হবে না।আতিক আর নেই মামিমণি!

আচমকা হাত থেকে ফোন পরে যায় মুহতাসনিমের।মিনা বেগম সজোরে চিৎকার করে উঠেন!

~~~

ঘড়িতে সময় বিকাল পাচঁটা!মুহতাসনিমের মাথার কাছে বসে আছে জাহিন।ঘন্টা হবে জ্ঞান হারিয়েছে মুহতাসনিম।অনেক চেষ্টার পরেও জ্ঞান ফেরাতে সক্ষম হয়নি জাহিন।মিনা বেগম কান্নারত কন্ঠে বললেন,

“মাইয়াটারে হসপিটাল নিয়া যাইতে হইবো তো!এইভাবে কতক্ষণ বইসা থাকমু আমরা?

আশ্বাস দিয়ে বলে জাহিন,

” অতিরিক্ত শক থেকে এমন হয়েছে।তা ছাড়া শরীর কিছুটা দূর্বল।ঠিক হয়ে যাবে চিন্তা করবেন না।

মুখ চেপে নিশ্চুপ কাঁদছে নবনী।মিনা বেগম কান্নারত কন্ঠেই বলছেন,

“মাইয়াটা আর এই জীবণে সুখের দেখা পাইলো কই?লাথি উস্টা খাইয়া সৎমায়ের সংসারে বড় হইছে।শেষে সহ্য করতে না পাইরা পলাইয়া ঢাকায় আইছে।ভাবছি এবার মাইয়াটারে নিশ্চিন্তে কারো হাতে তুইলা দিমু।এই মাইয়ার কপালে সুখ নাই!মুখপুড়ি!

বলেই আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পরলো মিনা বেগম।

জাহিন স্তব্ধ হয়ে মিনা বেগমের কথা শুনছে।মেয়েটা কত কষ্ট লুকিয়ে ছিল!হঠাৎ মৃদু মৃদু চোখ মেলে তাকায় মুহতাসনিম।খেয়াল হতেই ব্যস্ত হয়ে বলে জাহিন,

” মুহু ঠিক আছেন আপনি?

পূর্ন চোখ মেলে তাকায় মুহতাসনিম।উঠে দাঁড়ায় জাহিন।মিনা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,

“উনার ভারী ড্রেস চেইন্জ করে দিন।

বলেই বেরিয়ে যায় জাহিন।পিছু পিছু নবনী চলে আসেন।রিতা আর শায়লা বেগম রেহানা বেগমকে নিয়ে সেই কখন চলে গেছেন।

~~~

ছাঁদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।পাশে নবনী এসে দাঁড়ায়।সাতপাঁচ না ভেবেই যেন দ্রুততার সাথে বলে জাহিন,

” আমি মুহু কে বিয়ে করতে চাই মামণি।যদি উনার মত থাকে।

চলবে………

#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-২৫
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,

ছেলের কথাটুকু কর্নপাত হতেই বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে নবনী।চোখ জোড়া জলে চিকচিক করছে!মুহূর্তের মধ্যে ছেলের কি এমন হলো যার জন্যে এত পরিবর্তন?ভেতরে খুশির জোয়ার বইছে নবনীর।

মায়ের দিকে দৃষ্টি নিয়ে এখনও তাকিয়ে আছে জাহিন।উত্তর যে খুব ভালো হবে তা মামণির মুখ দেখেই আন্দাজ করতে পারছে।

খুশি মুখ নিয়েই বলে নবনী,

“উত্তম সিদ্ধান্ত বাবা।আমি যে কতটা খুশি হয়েছি বলার অপেক্ষা রাখে না।তবে মুহতাসনিমের মনের অবস্থা এখন ভালো নয় কিভাবে যে বলি?আমি বরং মিনা আপাকে বলে রাখবো।

“হুম।

ভেতরে রুমে চলে যায় নবনী।

~~~

বুকটা কেন যেন অনেকটা হালকা লাগছে জাহিনের।হুট করে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে নিজের কাছেই অজানা।মুহুর কষ্ট টা কি মেনে নিতে পারেনি জাহিন নাকি অসহায় মুহুর পাশে দাঁড়াতে চাচ্ছে?তার কোনোটাই তো মনে হচ্ছে না জাহিনের।ভাবনাগুলো অদ্ভুত ভাবে কেমন এলোমেলো হয়ে যায়।পরক্ষনে শত ভাবণাগুলো দূরে ঠেলে আনান কে কল করে।কয়েক বার বাজতেই রিসিভ করে আনান।ওপাশ থেকে শোরগোল আর কান্না আহাজারির শব্দ কানে
ভেসে আসছে।আনান প্রথমেই জিগ্যেস করে,

” ওদিকে সব ঠিক আছে জাহিন?মেয়েটা কি করছে?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয় জাহিন,

“শোক টা নিতে পারেনি সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল। আপাতত জ্ঞান ফিরেছে।ওদিকের খবর বল?

“সাংঘাতিক কান্ড ঘটেছে রে জাহিন।আতিকের গাড়িতে ওর ভাই আতিফও ছিল আর তাদের পেছনে ছিল মুরব্বিদের গাড়ি।আতিকের গাড়িটা এক্সিডেন্ট হওয়ার পর আতিককে আর হসপিটাল নেওয়া যায়নি তার আগেই আতিক মারা যায়।তবে আতিফ কে হসপিটাল অব্ধি নেওয়া হয় কিন্তু অবশেষে বাঁচানো যায় না।আন্টি,আংকেল তো দুই ছেলেকে হারিয়ে ভয়ংকর রকম আহাজারি করছে!সত্যি দৃশ্য টা মেনে নেওয়ার মতো নয় রে জাহিন।মাথা হ্যাং হয়ে আছে আমার!

বুক থেকে গলা অব্ধি শুকিয়ে এসেছে জাহিনের।পরিস্থিতি সত্যি কখনও কখনও মারাত্মক ভয়ানক হয়ে উঠে!কালকে অব্ধিও কেউ ভাবেনি আজকের দিনটি এত মর্মান্তক হবে!শুকনো ঢোক গিলে জানতে চায় জাহিন,

” জানাজা কখন?

“যেহেতু এক্সিডেন্ট সেহেতু পুলিশ কেইস তো আছেই, তার উপর আতিক নামকরা উকিল ছিল!সব মিলে জামেলা কাটিয়ে জানাজার সময় আরও পরে নির্ধারিত হবে।

” ঠিক আছে আমাকে পরে জানিয়ে দিস।

“আচ্ছা।

~~~

ফোন টা পকেটে পুরে ঘুরে তাকাতেই থমকে যায় জাহিন।পেছনে মুহতাসনিম দাঁড়িয়ে।পরনে এখনও নীল বেনারসি জড়িয়ে!চোখ,মুখ শুকিয়ে মলিন লাগছে কেমন।অজানা ভয়ে বুক দুরুদুরু করছে জাহিনের।বিয়ে সম্পর্কে কিছু শুনেছে কি মুহু?আগ বাড়িয়েই জিগ্যেস করে জাহিন,

” আপনি?শরীর ঠিক আছে?এখন রেস্ট নেওয়ার প্রয়োজন আপনা…..

কথা থামিয়ে দিয়ে বলে মুহতাসনিম,

“আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন তাইনা ডাক্তার সাহেব?

বেশ চমকে যায় জাহিন।মুহু ঠিক কি বোঝাতে চাচ্ছে বা ইঙ্গিত দিচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না জাহিন।

” বুঝলাম না!

একগাল হেসে বলে মুহতাসনিম,

“শুরু থেকে আপনি বাধা দিচ্ছেন এ বিয়েতে!সম্পর্কের কোনো মূল্যই নেই আপনার কাছে তাই বলে অপরের ভালো চাইতেই সমস্যা আপনার?

” মুহু আপনি ভুল বুঝছেন আমাকে!

“কি ভুল বুঝছি?শুরু থেকে অযথা অহেতুক কথা শুনিয়ে গেছেন!প্রথম থেকেই আপনার বাধা ছিল!আপনি হয়তো মন থেকে চাননি এ সম্পর্ক টা হোক!

চোখ বুজে দম ছেড়ে তাকায় জাহিন।পরক্ষণে বলে,

” আমি আবারও বলছি আপনি ভুল বুঝছেন।এটা নিয়তি মিস মুহু!এর দায়ভার আমার নয়।আর আমাকে কিন্তু আপনিই বুঝিয়েছেন সম্পর্ক টা এত ঠুনকো নয়!এক তরফা কিন্তু ভালোবেসে স্বার্থক হওয়া যায়!যে কথাটায় আমি আগে বিশ্বাসী ছিলাম না।এবং আমি মন থেকেই চেয়েছি আপনার সুন্দর একটা সম্পর্ক হোক!অন্তত যেন সম্পর্কের প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস হয় আপনাদের দেখে!আর আমার ভাবনাতে আগে যা ছিল আমি কেবল সেটাই আপনাকে বলেছিলাম।আমার কথাতে কিন্তু আপনি সম্পর্কে যাওয়া থেকে বিরত থাকেননি!উল্টো…….

কথা থামিয়ে দিয়ে বলে মুহতাসনিম,

“আর সেটাই হয়তো ভুল ছিল!আপনার কথাটা মেনে নিলে আজ হয়তো আতিকের মৃত্যুটা আমায় দেখতে হতো না!

” কিচ্ছু ভুল নয় মুহু।এটা নিয়তি।এতে কারও হাত থাকে না।এখন অন্তত নিজেকে দোষারপ করবেন না এর জন্যে!

“এবার হয়েছে তো শান্তি আপনার?আমি কোনো সম্পর্কে যাচ্ছি না।ভাগ্য ছিনিয়ে নিয়েছে আমার থেকে সবটা।

বলেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।করুণ দৃষ্টি নিয়ে তাকায় জাহিন।মুহুর মনের অবস্থা এখন বিষাক্ত হয়ে আছে।কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে নির্বিকার বলে জাহিন,

“আমি যদি এটাই চাইতাম আপনি কোনো সম্পর্কে না যান,তাহলে আমি আপনার সাথে সম্পর্কে যেতে চাইতাম না মিস মুহু!

মাথা নিচু করে ফুপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে মুহতাসনিম।কোনোকিছু যেন কর্নপাত হচ্ছে না!

~~~

খাটের এককোনায় বসে আছে মিনা বেগম।নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করে নবনী।মিনার পাশে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

” চিন্তা করো না মিনা আপা।সব ঠিক হয়ে যাবে।

নবনীর দিকে তাকিয়ে বলে মিনা,

“আর কি ঠিক হওয়ার আছে আপা?এই মাইয়া আজীবন কষ্ট ভোগ কইরাই যাইবো।নয়তো বিয়ার দিন কেউ জামাই হারা হয়?

বলেই উড়নায় মুখ গুজে আবারও কেঁদে উঠে মিনা বেগম।

” কাঁদছো কেন মিনা আপা?মুহতাসনিমের ভাগ্য খুব ভালো তুমি দেখো।আমার ছেলের বউ করে নিয়ে যাবো আমি মুহতাসনিম কে।

হঠাৎ কান্না থেমে যায় মিনা বেগমের।বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে
শুকনো গলায় বলে,

“এসব কি বলতাছেন আপা?জাহিন বাবা এটা মাইনা নিবো?

আশ্বাস দিয়ে বলে নবনী।

” বিশ্বাস রাখো আমার প্রতি।ছেলের অমতে কিছু হবে না।

~~~

জাহিনের পকেটে থাকা ফোনটা বেজে উঠে।রেলিঙে হাত রেখে নির্বিকার আকাশ পানে তাকিয়ে মুহতাসনিম।চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে।আতিকের মৃত্যুর জন্য চরমভাবে নিজেকে অপরাধী মনে করছে।আজ যদি এই বিয়েতে মুহতাসনিম রাজি না হতো তবে আজ এ দিনটি আসতো না!নিজেকে জড়িয়ে এতো এতো দুঃখের ঘটনা কেন?সুখ কি একটু ছুঁতে পারে না মুহতাসনিম কে?নাকি কপালে সুখের লিখন নেই?

পাশেই কারও সাথে ফোনে ব্যস্ত জাহিন।মুহতাসনিমের কানে শেষ যতটুকু কথা এসেছে তা হচ্ছে,

‘জানাযা রাত নয়টায়?’

শতভাবনাগুলো কাটিয়ে পাশ ফিরে তাকায় মুহতাসনিম।চোখমুছে বলে,

“আমায় নিয়ে যাবেন ডাক্তার সাহেব?

চকিতে মুহতাসনিমের দিকে তাকায় জাহিন।

” এতরাতে আপনি যাবেন?এমনিতে আপনার শরীর ঠিক নেই!

“আপনি আমায় নিয়ে যাবেন কিনা শুধু সেটা বলুন?

ততক্ষণে নবনী আর মিনা এগিয়ে আসে।কান্নার কারণে চোখমুখ ফুলে আছে মিনা বেগমের।মুহতাসনিমের মাথায় হাত বুলিয়ে বলছেন,

” কষ্ট সবসময় থাকে নারে মা!যার কষ্ট বেশি তার সুখও বেশি।এই যে এত কষ্ট অহন পাইতাছস একদিন দেখবি সুখের সময় এইগুলা আর মনেই থাকবো না।

মিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।ভাঙা আওয়াজে ফুঁপিয়ে বলে,

“আমি একবার উনাকে দেখতে যেতে চাই খালা!

মিনা বেগম বললেন,

“আমিও যামুরে মুহু,একটাবার না গেলেও চলবো না।
পরক্ষণে নবনীর থেকে বিদায় নিয়ে রওনা হলো তিনজন।

~~~

বাড়ি ভর্তি শতশত লোক।এখানে আসার পর মুহতাসনিম জানতে পেরেছে আতিফও আর নেই!এত আহাজারি শুনে কলিজা শুকিয়ে এসেছে মুহতাসনিমের।চোখের জল বাধমানছে না!

আতিকের মা মিসেস ময়না বেগম জ্ঞান হারিয়েছেন।পুরো বাড়ি জুড়ে যেন এক তান্ডব লিলা চলেছে।লাশ এখন অব্ধি বাড়িতে আনা হয়নি।

জাহিনের দৃষ্টি কেবল মুহুতেই আবদ্ধ।মেয়েটার এভাবে কান্না মোটেও সহ্য হচ্ছে না জাহিনের।ইচ্ছে করছে একছুটে মেয়েটাকে বুকে আগলে নিয়ে বলুক,

‘কাঁদছেন কেন মিস মুহু?দেখুন আমি তো আছি’

~~~

ঘড়ির কাটা রাত আটটা।লাশ নিয়ে আসা হয়েছে।এম্বুলেন্স থেকে আনান নেমে আসে।চোখ দুটো ভয়ংকর রকম লাল বর্ণ ধারণ করে আছে আনানের।জাহিন এগিয়ে যায়।আনান বলে,

“লাশ পোস্টমর্টেম করতে দেওয়া হয়নি একারণে সব দ্রুতই হয়েছে।তুই একা এসেছিস?

মলিন কণ্ঠে বলে জাহিন,

” না,মিনা আন্টি আর তার ভাগ্নিও এসেছে।

আনান একটু অবাকই হয় মুহতাসনিম এসেছে শুনে।

~~~

আত্মীয়রা সব লাশের কাছে এসে ভীড় জমিয়েছে।ময়না বেগম অজ্ঞাত অবস্থায় এখনও রুমে।

খানিকটা দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখছে মুহতাসনিম।আতিকের মুখটা দেখতেই আচমকা জ্ঞান হারায় মুহতাসনিম!তৎক্ষনাৎ ‘মুহু’ বলে চিৎকার করে এগিয়ে আসে জাহিন।এত শোরগোলের মাঝে মুহতাসনিম কে কেউ খেয়াল করেনি।

দেরি না করে মুহতাসনিমকে কোলে তুলে নেয় জাহিন।কাঁপা ঠোঁটে ব্যস্ত হয়ে বারংবার বলে যাচ্ছে,

“মুহু ঠিক আছেন আপনি?তাকান প্লিজ।মুহু শুনতে পাচ্ছেন?

মুহতাসনিম কে কোলে নিয়েই গাড়ির দিকে ছুটে যায় জাহিন।এক্ষুনি হসপিটাল না নিয়ে গেলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে যে!

চলবে…..

[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিযোগ্য]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here