#মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-৫০,৫১,৫২
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
৫০
,
ঘড়ির কাটা ভোর পাঁচটায়!আধো চোখ মেলে তাকায় জাহিন।কখন চোখ লেগে গিয়েছিল বুঝতে পারেনি।পাশে খেয়াল হতেই দেখে মুহতাসনিম নেই!মুহূর্তেই ঘুম ছুটে যায় জাহিনের।তড়াৎ করে ওঠে বসে।চোখ ঢলে পুরো রুমে চোখ বুলিয়েও মুহতাসনিমের দেখা পেল না!
বিলম্ব না করে বেলকনিতে চলে আসে জাহিন।এখনও তীব্র বর্ষণ হচ্ছে!বৃষ্টির দাপট ধোয়াশা করে দিয়েছে চারিপাশ!রাত থেকে থেমে,থেমে বৃষ্টি হচ্ছে!পরিবেশ বেশ ঠান্ডা!উদোম গায়ে কাটা দেওয়ার মতো অনুভুত!আচমকা দৃষ্টি জীর্নশীর্ন বাড়িটির ওঠোনে পরতেই সাদা,ধূসর রঙা শাড়ি পরিহিতা মেঘবতীকে দেখতে পায় জাহিন।মুহূর্তে’ই অশান্ত বুকটা শান্ত হয়ে আসে।চোখ বুজে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে জাহিন।পরক্ষণে ফের দৃষ্টি সেদিকে রাখে।মেয়েটা সত্যি’ই বড় অদ্ভুত!সময় অসময়ে বৃষ্টিতে নেমে যায়!দু হাত মেলে চাতক পাখির মতো আকাশে তাকিয়ে আছে!গায়ে শাড়িখানা অগোছালো ভাবে জড়ানো!কোমড় বেয়ে নামা একগুচ্ছ ভেজা এলোকেশ লেপ্টে আছে!নিশ্চুপ দৃষ্টি জাহিনের!তার মেঘবতীর তনু ময়ের সবটাই যে তার চেনা!সর্ব তনুময়ের খাঁজে খাঁজে’ই যে জাহিনের স্পর্শ লেগে আছে!
বাধ্য হয়ে কালকে মুহতাসনিম কে নিজে থেকে এতটা কাছে টেনে নিয়েছে জাহিন।পারুল বেগমরের ভাবভঙ্গি মোটেও সুবিধার লাগেনি তার কাছে।ছলে কৌশলে তিনি যে মুহু কে ব্যবহার করবেন না তার নিশ্চয়তা নেই!মুহু যে জাহিনকে ভিষণ ভালোবাসে তা আর বুঝতে বাকি নেই!দোটানার আড়ালে ঢেকে ছিল এই ভালোবাসাটুকু!নিসন্দেহে মৃত্যু ছাড়া জাহিনকে ছেড়ে যাবে না মুহু এটা নিশ্চিত!সত্যি’ই নারী হৃদয় বড্ড কোমল হয়!যে একবার সে হৃদয় ছুঁতে পারে সে জানে নারীর ভালোবাসা কত সুন্দর,কত স্নিগ্ধ, কত পবিত্র!নারীকে ছোঁয়ার আগে তার হৃদয় স্পর্শ করতে হয়!তবেই নিখাঁদ ভালোবাসা মেলে!
এই তীব্র বর্ষণে যদি আজ গাঁ ভেজায় জাহিন নির্ঘাত ভয়ানক জ্বর বাঁধাবে!তবে মনের ইচ্ছাটুকু দমিয়ে দেওয়া যাবে না কোনোমতে!পরক্ষণে রুমে এসে গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে পরে জাহিন।
~~~
তুমুল বর্ষণে গুনগুন করে গানের সুর তোলে মুহতাসনিম,,
যদি ডেকে বলি,এসো হাত ধরো
‘চলো ভিজি আজ বৃষ্টিতে
এসো গান করি মেঘ মল্লারে
‘করুণ ধারা দৃষ্টিতে
‘আসবে না তুমি,জানি আমি জানি
‘অকারণে তবুও কেন কাছে ডাকি
‘কেন মরে যাই?তৃষ্ণাতে এই
এসো না চলো জলে ভিজি
‘শ্রাবণও রাতের বৃষ্টিতে!
আচমকা পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরে মুহতাসনিম কে।গুনগুন করে গাওয়া গান মুহুর্তে থেমে যায়!স্পর্শ টা খুব করে চেনা মুহতাসনিমের।কোমড় জুরে শীতল স্পর্শ পেতেই সর্বাঙ্গ ঝংকার তোলে মুহতাসনিমের!হাতপা কাঁপে সমানতালে!এ কেমন অনুভূতি!কাঁধ বরাবর থুতনি রেখে বলে জাহিন,
“মেঘবতী এভাবে আহ্বান করলে ঘরে থাকা যে দায়!
জহিনের কথায় ফের মৃদু কেঁপে ওঠে মুহতাসনিম।লোকটাকে তো ঘুমের ঘোরে রেখে এসেছিল!কখন এলো?মুহূর্তেই ছিটকে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।চোখেমুখে চিন্তার ভাজ ফেলে বলে,
” বৃষ্টির পানি আপনার একদম সহ্য না।এক্ষুনি রুমে চলুন।
জাহিনকে একপ্রকার টেনেটুনে নিয়ে যায় মুহতাসনিম।হতাশ হয়ে বাধ্য ছেলের মতো হেটে চলে আসে জাহিন।
~~~
বেলা বেশ ভালো’ই গড়িয়েছে।এখনও একটুকু রৌদ্রের দেখা মেলেনি।বৃষ্টির তোড় কমেছে কখন।তবে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।চারিপাশে ধূরস অন্ধকার!গুমোট হয়ে আছে আকাশ!মায়ের সাথে হাতে হাতে কাজ করছে মুহতাসনিম।কাল থেকে একপ্রকার ঘরবন্দী মুনা।কারও সাথে তেমন কথা নেই।প্রয়োজনে মুহতাসনিমের সাথে কথা বলেছে টুকটাক।মেয়েটা মানসিক ধাক্কা খেয়েছে প্রচুর!
সকালের নাস্তা তৈরি করে মুনার ঘরে যায় মুহতাসনিম।কাল রাতেও ভালো মতো খায়নি বোনটা।পড়ার টেবিলে বসে আছে মুনা।চোখমুখ বিষন্ন লাগছে তার।পাশে এসে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“একটু খেয়ে নে মুনা।লক্ষী বোন আমার।
কোনো হেলদোল নেই মুনার।চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে।বারংবার খাবার মুখের সামনে ধরছে মুহতাসনিম।নিশ্চুপ হয়ে আছে মুনা।একটু খানি খাবারও গলা দিয়ে নামবে না।নিরবতা ভেঙ্গে বলে মুনা,
” ভাইয়া খেয়েছে?
“না।তোকে খাইয়ে দিয়ে ওনার জন্য নাস্তা নিয়ে যাবো।
চোখ মুছে বলে মুনা,
” আমি এখন খাবো না।আগে ভাইয়াকে খাবার দিয়ে এসো।তারপর আমার জন্য খাবার নিয়ে এসো।
কথা বাড়ায় না মুহতাসনিম।চলে যায়।
~~~
মুনার এরুপ আচরণ ভালো লাগছে না পারুল বেগমের।মা হয়ে কি সত্যিই তিনি অন্যায় করে ফেললো না?মেয়ে কি আদৌ তার সাথে স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারবে কোনোদিন?যত কিছুই হোক জুয়েলের কাছে মুনাকে সপে দিবে না পারুল।দরকার হয় মুহতাসনিমের সংসার ভাঙ্গতেও তিনি দুবার ভাববে না।মুহতাসনিম যখন নিজ থেকে রাজি হয়েছে তবে জুয়েলের কাছে এ প্রস্তাব অবশ্যই রাখবে পারুল।এ ছাড়া যে আর কোনো রাস্তা খোলা নেই পারুলের কাছে!পাশে মুহতাসনিমের অস্তিত্ব টের পেতেই ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসে পারুল।ঝেড়ে কেশে বলে,
“জুয়েলের ব্যাপার টা কিন্তু মিটমাট হয় নাই মুহু।কিছুই বলে যায় নাই সে।টাকা আর শক্তির জোর কোনোটাতেই আমরা পারমু না জুয়েলের সাথে।আমার বড্ড ভয় করতাছে মুহু।
আস্বস্ত কন্ঠে বলে মুহতাসনিম,
” সব ঠিক হয়ে যাবে মা।চিন্তা করো না।এখন মুনাকে কি করে স্বাভাবিক করা যায় সেটা ভাবতে হবে।বয়স কম ওর কখন কি করে বসে বলা যায় না।
কলিজা ধ্বক করে ওঠে পারুলের।শুকনো ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বলে,
“যা’ই হোক বোনকে বাঁচাতে এক পা’ও পিছপা হবি না।তুই আমারে কথা দিছস মুহু,জুয়েল মির্জারে তুই বিয়া করবি।তোর জামাই টাকাটা শোধ কইরা দিলে ঘটনা এতদূর গড়াইতো না!
মায়ের কথা শুনে চমকে উঠে মুহতাসনিম।তখন জোকের বশে কি বলে ফেলেছিল এটা ধরে এখনও বসে আছে মা?জাহিন তো এটা কিছুতেই মেনে নিবে না!না মুহু মানতে পারবে!ভাবতেই গণ্ডস্থল শুকিয়ে আসে মুহতাসনিমের।
~~~
মা মণির সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত জাহিন।নবনী সময় মতো মুহতাসনিমের খোঁজ নেয়।দূর হওয়ায় আসাটা তার জন্য কষ্টকর হয়ে যায়।তবে ছেলে এবার একসপ্তাহের ছুটি নিয়ে এসেছে শুনে মন টা শান্ত হয়।
নিজের করে রাখা প্ল্যান টা মা মণি কে জানায় না জাহিন।আদৌ তার মা মণি এতে সহমত পোষণ করবে কিনা জানা নেই।শেষ অব্ধি সফল হবে তো জাহিন?শত ভাবনা মাথায় নিয়েই ফোন রেখে দেয় জাহিন।
নাস্তার ট্রে হাতে আনমনে রুমে প্রবেশ করে মুহতাসনিম।বিষয়ে টা দৃষ্টিগোচর হয় না জাহিনের।কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে বলে,
” কি হয়েছে মিসেসের?এনি প্রবলেম?
সম্ভিৎ ফিরে তাকায় মুহতাসনিম।পরক্ষণে আমতা আমতা করে বলে,
“তেমন কিছু না।মুনার জন্যে মন খারাপ।খাচ্ছে না।কথাও বলছে না তেমন।
মুহতাসনিমের চিন্তার কারণ খুঁজে পায় জাহিন।তবে এই যে তার মেঘবতীর মুখখানি ভার তার মোটেও সহ্য হচ্ছে না!চট করেই বলে জাহিন,
” শালিকা কোথায়?আমি কথা বলবো তার সাথে।
চকিতে ফিরে তাকায় মুহতাসনিম।পরক্ষণে বলে,
“আপনার কথা শুনবে?
” চেষ্টা করতে ক্ষতি নেই!
~~~
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুনা।আকাশটারও বুঝি আজ তার মতো মন খারাপ!কেমন গুমোট হয়ে আছে!মুহতাসনিমের ডাকে পিছু ফিরে তাকায় মুনা।শান্ত স্বরে বলে মুহতাসনিম,
“তোর ভাইয়া এসেছে।কথা বলবে।
চোখ মুছে ভেতরে আসতে বলে মুনা।জাহিন এসে খাটের কর্নারে বসে।মুনার চোখমুখ বিশ্রী রকম ফুলে আছে!আন্দাজ করা যাচ্ছে কতখানি কেঁদেছে!আস্বস্ত কন্ঠে বলে জাহিন,
“এইটুকু বয়সে এত কান্নাকাটি করলে হবে?তোমার চিন্তার জন্যে তো আমরা আছি।মায়ের উপর ঘৃনা হচ্ছে?একবার ভেবে দেখো তো কিছু ভুল করেছে কিনা তোমার মা?তিনিও এখন তোমাকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে!নয়তো কবেই ওই জুয়েলের হাতে তোমায় তুলে দিতো।
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে ফের বলে জাহিন
“অন্যায় তো হয়েছে কেবল তোমার আপুর সাথে!এবং চিরকাল তেমন টাই হয়ে আসছে!কই তোমার আপু কি এভাবে ভেঙ্গে পরেছে তোমার মতো?না বরং পুড়ে পুড়ে শক্ত ইটের ন্যায় গড়ে ওঠেছে!চাইলে তুমি প্রতিবাদী হতে পারো মুহতানিম।যেটা তোমার বোন পারেনি।সে কেবল ভেতরে ভেতরেই পুড়েছে!তার আত্নচিৎকারের সাক্ষী কেবল সে’ই!এভাবে বেঁচে থাকা যায় না মুহতানিম।তোমার বয়স আঠারো হলে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত তোমার!কারও ক্ষমতা নেই হস্তক্ষেপ করার!তবে এই যে মাঝে আরও কতটা সময় পরে আছে।এর মাঝে জুয়েল যে কিছু করবে না তা অনিশ্চিত!তার জন্যে কোনো না কোনো উপায় তো বের করতেই হবে।ভেবে নাও তোমার জীবণে কিছুই হয়নি!
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে জাহিনের কথা শুনছে মুনা।সত্যিই তার ছোট্ট মস্তিষ্কে এই কথাগুলো প্রবেশ করেনি।
” সবকিছু এত সহজ নয় মুনা।দেশে আইন বলতে কিছু আছে।এটা এখনও প্রাচীন যুগ নয় যে নারী কেনাবেচা হবে!নারীর এখন পুরুষের সমান অধিকার!তবে কেন হেরে যাবে তুমি?সমানে সমানে লড়াই করতে হবে।আর বাকি রইল তোমার মায়ের সিদ্ধান্ত!দুঃসময়ে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।ধরে নাও মায়ের ভুল হয়েছে।এখন সমাধানের পথ বের করতে হবে।অহেতুক কষ্ট,হতাশা চেপে সমস্যার সমাধান হবে না।
মুহতাসনিম অবাক হয়ে জাহিনের কথা শুনছে।কি নিখুঁত ভাবে বোঝাচ্ছে লোকটা।বোনের দিকে একবার তাকিয়ে বলে মুনা,
“আপু তুই সত্যি’ই খুব ভাগ্যবতী!আমি মন থেকে চেয়েছিলাম এমন কেউই তোর জীবণে আসুক যে সম্পূর্ণ রূপে আমার মুহুপু বুঝবে!আমার সোজা,সরল,ভাঙ্গাচোরা মুহুপু পুনরায় গড়ে তুলবে!
মৃদু হেসে বলে জাহিন,
” তোমার জন্যেও খুব ভালো কিছু অপেক্ষা করছে মুহতানিম।সমস্ত কালো রজনী কাটিয়ে উদিত হবে স্নিগ্ধ ভোরের সূর্য!
~~~
সন্ধ্যার প্রহর।কফি হাতে বেলকনিতে জাহিন।সেই দুপুরে বেরিয়ে গিয়ে টাকার ব্যবস্থা করেছে।এখন শুধু জুলেয়ের হাতে পৌছে দেওয়ার অপেক্ষা!মাঝে মুনা কে নিয়ে ঝামেলা তো অবশ্যই হবে!তার প্ল্যান আগেই কষতে হবে।
শত ভাবনা কাটিয়ে রিশানকে কল করে জাহিন।কয়েকবার বাজতেই রিসিভ হয়।কিছুক্ষণ ভাইয়ের খোঁজ নিয়ে শেষে নিজের প্রশ্ন টা করেই ফেলে জাহিন,
“রিশান আমি যদি তোর বিয়ের জন্যে মেয়ে পছন্দ করে রাখি এতে তোর কোনো আপত্তি আছে?
চলবে……..
#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-৫১
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
জাহিনের কথাতে কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় রিশান।জাহিন কোনোদিন নিজ থেকে তাকে বিয়ের কথা বলবে এটা ভাবনাতে নিয়ে আসাও অকল্পনীয় ছিল!তবে জাহিনের যে অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে তা আর বুঝতে বাকি নেই!
“আমার জন্যে তুমি মেয়ে দেখেছো ব্রো!এটা আমার বিশ্বাস করতে হবে?নাকি মজা করছো আমার সাথে?
পুনরায় সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে জাহিন,
” আমি কোনো মজা করছি না রিশান।তুই রাজি থাকলে বেশি দেরি হবে না।
জাহিনের কথায় বেশ অবাক হয় রিশান।ভাবভঙ্গি কেমন পাল্টে গেছে!কি সুন্দর স্বাভাবিক আর সাবলীল লাগছে।পরক্ষণে বলে রিশান,
“মেয়েটা কে শুনি?আমি কি তাকে চিনি?
কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকে জাহিন।ছোট্ট একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে,
” হ্যাঁ চিনিস।
রিশান এবার দফায় দফায় অবাক হয়।সবটা কেমন ঘোলাটে জলের মতো লাগছে!ছোট্ট করে কেবল জিজ্ঞেস করে,
“কে?
” মেয়েটার নাম মুহতানিম।নাম বললে অবশ্য চিনবি না।আলেয়া আন্টির বিয়েতে দেখেছিলি।ফুলওয়ালীর কথা মনে আছে?তার সাথের মেয়েটা।
রিশানের কাছে এবার বিষয় টা সচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার!সোজা ভাবে নিজের শালিকার কথা বলতে চাচ্ছে তার ভাই।রিশান যতদূর জানে বাসার কেউই জাহিনের বিয়েতে খুশি নয়।মেয়েটার সম্পর্কে নাকি সঠিক তথ্যও কেউ জানে না!বিশেষ করে রিশানের মা তার সাথে ফোনে কথা বললেই জাহিনের বউকে নিয়ে নিন্দা করে।অপর দিকে আনানের বউয়ের সে কি প্রশংসা!রিশানকে চুপ থাকতে দেখে বলে জাহিন,
“কিছু বলছিস না যে?রিশান তুই এতটুকু নিশ্চিত থাক মেয়েটা খুবই ভালো!আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি!জগতে এখন কেউ নিখাঁদ ভালোবাসা,সুন্দর সংসার সহজে পায়না!হাতে গোনা দু একজন কেবল পায়!
নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে বলে রিশান,
” হয়তো।ইম্মিসির কথা মনে আছে ব্রো?
ইম্মিসির কথা বলাতে চমকে উঠে জাহিন।রিশান তো জাপানে আছে এখন।ইম্মিসিও তো সেখানেরই বাসিন্দা!তবে তারা এক হয়ে গেল!শুকনো ঢোক গিলে বলে জাহিন,
“হ্যাঁ মনে আছে।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে রিশান,
” ইম্মিসির সাথে পরিচয় হয় এখানে এসে।একপর্যায়ে আমাদের এই পরিচয় থেকে সম্পর্ক গড়ায় প্রনয়ে!পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলি ইম্মিসিকে।একমুহূর্তও ইম্মিসি ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না।রেজাল্ট খারাপ হলো।বাবার কাছে ঝাড়ি খেতে হয়েছে।এসব কিছুই আমার গায়ে লাগেনি।সর্বক্ষন মাথায় বিচরণ করতো ইম্মিসি।
রিশানের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে আছে জাহিন।ভাই তার তাহলে এতদিনে অন্যত্র জড়িয়ে গেছে!খানিক থেমে বলে রিশান,
“তারপর ইম্মিসিকে আমি একদিন সোজা বিয়ের প্রস্তাব দেই।বিনিময়ে হেসে কি বলে ইম্মিসি জানো?
‘বিয়ে?পাগল তুমি?এখন বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না রিশান।লাইফ পুরোটাই পরে আছে।তুমি চাইলে বড়জোর আমরা লিভ টুগেদারে যেতে পারি।
মাঝে কথা কেড়ে নিয়ে বলে জাহিন,
” এখন কি তোরা লিভ টুগেদারে আছিস রিশান?
ছোট্ট একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে রিশান,
“ইম্মিসিকে পাওয়া টা তখন আমায় এতই মরিয়া করে তুলেছিলো যে আমি সাতপাঁচ না ভেবে রাজি হয়ে যাই।প্রায় একমাস একসাথে ছিলাম ব্রো।কয়দিন আগে সবকিছুর বিচ্ছেদ ঘটিয়ে চলে গেছে ইম্মিসি।
চোখবুঁজে লম্বা শ্বাস ছাড়ে জাহিন।রিশানের থেকে এমনটা আশা করেনি।শান্ত কন্ঠেই বলে জাহিন,
” বিরাট অন্যায় করেছিস রিশান।জঘন্য পাপ এটা।বাইরের কান্ট্রিতে গেলেও নিজের সংস্কৃতি,ধর্ম ভুলে যেতে হয়না।ইম্মিসির জাত,ধর্ম,সংস্কৃতি টা কোন পর্যায়ের সেটা ভাবা উচিৎ ছিল তোর।জোকের বশে অন্যায় করে ফেলেছিস।
অনুতপ্ত কন্ঠে বলে রিশান,
“শত চেষ্টায়ও ইম্মিসিকে ফেরাতে পারিনি ব্রো।সম্পর্ক টা পবিত্র হোক আমিও চেয়েছিলাম।ইম্মিসি কেন এমন করলো আমার সাথে?আমার সবকিছু অগোছালো হয়ে গেছে ব্রো।
” আমাদের মতো আবেগ,অনুভূতি,মায়া কাজ করে না তাদের মাঝে।সম্পর্কের কোনো মূল্য নেই তাদের কাছে।নয়তো এমন জঘন্য একটা বিষয় কে সামাজিক ভাবে সৃকৃতি দিতে পারতো না তারা।
খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলে রিশান,
“সবটা তো শুনলে।এখন নিশ্চয়ই তোমার উত্তর পেয়ে গেছো?
কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বলে জাহিন,
” জীবনে ভুল সবারই হয় রিশু।ভুলের উর্ধ্বে কেউ নয়!ভুল টা সংশোধন করে সামনে এগিয়ে যেতে হয় আমাদের।একটা ভুল তো আর মানুষের জীবণ কে থামিয়ে দিতে পারে না।তুই মুহতানিমকেই বিয়ে করবি।
“কিন্তু সবটা জানার পরেও!
” তুই কি জীবন টা আর কারো সাথে জড়াবি না?নাকি একা থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?যদি তোর বাকি জীবনের সঙ্গী মুহতানিম হয় তবে ক্ষতি টা কোথায়?অতীত কিছুই নয় যদি বর্তমান ভালো হয়।আর বর্তমানেও যদি অতীতের যোগসূত্র থাকে তবে সে সম্পর্ক ত্যাগ করাই শ্রেয়!নয়তো ভবিষ্যৎ টা নরক হয়ে যায়!
জাহিনের কথা কিছুটাও বোধগম্য হয় রিশানের।দিনের পর দিন ডিপ্রেশন যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার অতল গহ্বরে!জীবণটা যদি সুন্দর ভাবে সাজানো যায় তাতে ক্ষতি কি?জীবনে আরও একটা সুযোগ দিয়ে দেখাই যাক।
“তুমি যদি বাসায় রাজি করাতে পারো ব্রো তবে দেখো।আমার কোনো আপত্তি নেই।
প্রসন্ন হেসে বলে জাহিন,
” আমি দেখছি।যদি সম্ভব হয় আমি দ্রুত মুহতানিমকে জাপান যাওয়া ব্যবস্থা করবো।মনে হয় না পরিস্থিতি সহজে স্বাভাবিক হবে।তাই খুব শিঘ্রই মুহতানিমকে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো আমি।সেখানে বিয়ে করে নিবি তোরা।আমার ভাইয়ের প্রতি বিশ্বাস আছে আমার।
রাজি হয়ে ফোন রেখে দেয় রিশান।একদিকে ভাই আর অপরদিকে মুহতানিম দুজনের ভালো চাইতেই এই পদক্ষেপ জাহিনের।মাথা থেকে অনেক বড় এক চিন্তা যেন নেমে গেল!পরবর্তী ধাপে দ্রুত এগোতে হবে জাহিনকে।
~~~
আকাশে আজ বিশাল থালার মতো চাঁদ উঠেছে!চারিপাশ টা কি স্নিগ্ধ লাগছে!তারায় তারায় সজ্জিত অম্বর।মেঘের কোনো আনাগোনা নেই আজ।পকেটে হাত পুরে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে জাহিন।টাকাটা এখনও জুয়েল মির্জার বাড়িতে পাঠায়নি।সবকিছুর বন্দোবস্ত করে একেবারে টাকা পাঠাবে।মুহুর পরিবারে বিষয়টা এখনও জানায়নি জাহিন।মুহুর পরিবার থেকে অমত করার কোনো কারণ নেই।এদিক দিয়ে চিন্তামুক্ত জাহিন।
নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।জাহিনকে খুব ভাবুক লাগছে।যেন কোনো একটা বিষয় নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে আছে।কপালে সুক্ষ্ম চিন্তার ভাজ পরে আছে।চাঁদের আলোয় তা স্পষ্ট!একফালি চন্দ্র কিরণে যেন জ্বলজ্বল করছে মুখখানি!মৃদু বাতাসে কপালের চুলগুলো দোলাচ্ছে!এর আগে এতটা খুটিয়ে বা নিখুঁত করে জাহিনকে দেখা হয়নি মুহুর।সামনে থাকা এই গাম্ভীর্য পূর্ন,বলিষ্ঠ শুভ্র দেহের পুরুষ টি শুধুই তার ভাবতেই একরাশ ভালোলাগা ছুঁয়ে দিচ্ছে!আচমকা পাশ ফিরে তাকাতেই মুহুকে খেয়াল করে জাহিন।ডাগর আঁখিদ্বয় নিয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে!কিঞ্চিৎ মৃদু হেসে বলে জাহিন,
“মনে হচ্ছে আমাকে এই প্রথম দেখা হচ্ছে!
হকচকিয়ে উঠে মুহতাসনিম।নিজেকে সামলে নেয়।বারকয়েক চোখের পাতা ফেলে।পরক্ষণে বলে,
” কি ভাবছিলেন শুনি?
সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলে জাহিন,
“ভাবনা তো এখন কতকিছুই।আচ্ছা মুহু ধরো মুনাকে যদি আমাদের বাড়ির বউ করা হয় তবে কেমন হয়?
চকিতে জাহিনের দিকে দৃষ্টি ফেলে মুহতাসনিম।কথাখানি নেহাৎ মজা ছাড়া কিছুই মনে হচ্ছে না।এটা তো স্বপ্নেও ভাবা যায় না।এমন একটা মুহূর্তে এসে এসব মজা কিঞ্চিৎ রাগ ধরাচ্ছে মুহতাসনিম কে।
জাহিন বোধহয় বুঝতে পেরেছে তার মনোহারিণীর রাগ হয়েছে!সরু নাকের পাটা কিছুটা ফুলে উঠেছে!হলদাভাব মুখখানি ফ্যাকাশে লাগছে!জাহিনের খুব করে ইচ্ছে করছে নাকটা টেনে দিক।ইচ্ছে দমিয়ে বলল,
” এখন তোমাকে কোনোভাবেই কিছু বিশ্বাস বা বোঝাতে পারবো না।সময় না হয় সব বলবে।এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা করা’ই শ্রেয়!
কথা বাড়ায় না মুহতাসনিম।তবে লোকটার মতিগতি কিছুই বুঝতে পারছে না।নিজে থেকে যখন কিছু বলতে চাচ্ছে না তবে সে কেন আগ বাড়িয়ে বেহায়ার মতো কথা বের করবে?তার চেয়ে ঢের ভালো সময়ের অপেক্ষা করা’ই শ্রেয়!
আচমকা মুহতাসনিমে কাছে টেনে দাঁড় করায় জাহিন।এরুপ ঘটনার জন্যে যেন মোটেও প্রস্তুত ছিল না মহু!পেছন ঘুরিয়ে আলতো জড়িয়ে ধরে জাহিন।শাড়ির আঁচল ভেদ করে উম্মুক্ত কটিদেশে স্পর্শ পেতেই শিউরে উঠে মুহতাসনিম!কাঁধ বরাবর থুতনি রেখে বলে জাহিন,
“রোজ রোজ কি শাড়ি পরা আপনার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে মিসেস মুহু?
আপনি সম্মোধন করায় খানিকটা চমকে উঠে মুহতাসনিম।এমনভাবে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে জাহিন,কথা বলাও দুষ্কর মনে হচ্ছে!পায়ের তলানি শিরশির করছে মুহুর।এখন কথা বললে নিশ্চিত জড়িয়ে যাবে।জাহিনের মা তো আসার দিন কয়েকটা শাড়িও কিনে দিয়েছিল তাকে।সেগুলো কি কেবল সাজিয়ে রাখার জন্যে?তবে জাহিনের জন্যে ইচ্ছে করেই শাড়ি পরেছে মুহু।শাড়ি পরলে লোকটা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে!তখন কোথা থেকে লজ্জারে এসে ভর করে সর্বাঙ্গে!
কাঁধে ভারী নিশ্বাসের তাপ পেতেই যেন সম্ভিৎ ফিরে পায় মুহতাসনিম।কাঁধে তপ্ত ওষ্ঠের ছোঁয়া পেতেই ভয়ানক ভাবে কম্পিত হয় তনুময়!প্রচন্ড বুক ধরফর করছে মহুর!নিশ্বাসের গতিপথ বেড়েছে যেন দ্বিগুণ!যে কোনো মুহূর্তে যেন বক্ষস্থল চিরে বেরিয়ে আসবে হৃদপিণ্ড!কি ভয়ানক অনুভূতি!মৃদু শব্দে ফিসফিস করে বলছে জাহিন,
” রাগ,অভিমান কি করে ভাঙ্গাতে হয় জানা নেই আমার।শেখাবে মুহু?এই যে খানিকক্ষণ আগে কিঞ্চিৎ রাগে অন্ধকার হয়ে ছিলো তোমার মুখখানি!তখন মনে হয়েছে আমার জগৎ টাই নিকষ কালো আধারে ডুবে গিয়েছিল!শুধু মায়ায় ডুবতে চাই মুহু, আধারে না!মায়াবতীদের রাগ করতে নেই!
কোনোরকম জড়ানো কন্ঠে বলে মুহতাসনিম,
“ঘু..মাবেন চলুন।
” তোমার ঘুম পেয়েছে মুহু?ছেড়ে দেবো?আরেকটু সময় সময় দাঁড়িয়ে থাকলে কি সমস্যা হবে?থাকুক না আজ আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী হয়ে ওই চাঁদটা!
মুহূর্তেই ঘুরে তাকায় মুহতাসনিম।গোল গোল চোখ নিয়ে বলে,
“কিসের সাক্ষী?!ঘুম পেয়েছে চলুন।
বাঁকা হাসে জাহিন।হাসিটা ভয়ানক রহস্যময় লাগে মুহতাসনিমের কাছে!তীর্যক দৃষ্টি নিয়ে কেবল তাকিয়ে থাকে জাহিনের দিকে।নিরবতা বিচ্ছিন্ন করে মুহতাসনিম কে কোলে তুলে নেয় জাহিন।পরক্ষণে ছোট্ট তপ্ত শ্বাস ছেড়ে রুমের দিকে যেতে যেতে বলে,
” অবশ্যই ঘুমাবে মুহু।আমাকে কি বাচ্চা ছেলে মনে হয়,যে তোমার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাবো?
জাহিনের কথাতেও কেমন রহস্য রহস্য গন্ধ পায় মুহু!লোকটা কি সহজ ভাষায় বলতে পারে না কিছু?
~~~
নিয়মমাফিক আজকে চারদিন থাকা হলো মুহুর।অবশ্য জাহিনও ছিল।আজকে ঢাকায় ফিরে যাবে পারুল কে জানায় জাহিন।পারুল বেগম মুহতাসনিম কে পাঠাতে রাজি নয়।জুয়েল মির্জা যদি ঘুনাক্ষরে টের পায় বাড়িতে পারুল আর মুনা একা তবে নিশ্চিত তার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে।তখন একটা সর্বনাশ হয়ে গেলে হাজার আইনি বিচারেও কিছু হবে না।
জাহিন যত দ্রুত ঢাকায় ফিরবে তার কাজ তত দ্রুত হবে।কিন্তু মুহতাসনিম কে রেখে কোনোমতেই যাবে না জাহিন।নিজের জীবন নিয়ে রিস্ক নিতে রাজি তবে মুহতাসনিমের জীবন নিয়ে হেলাফেলা করার দুঃসাহস তার নেই!চিন্তিত জাহিনকে দেখে বলে মুহতাসনিম,
“আপনি না হয় একা ঢাকায় চলে যান।আমি আরও কিছুদিন থাকি।
চলবে……
#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-৫২
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,
জাহিন কোনোমতে মুহু কে একা রেখে ঢাকায় ফিরে যাবে না।খানিকক্ষণ চুপ থেকে শান্ত গলায় বলে জাহিন,
“আমি আজকেই টাকাটা জুয়েল মির্জার বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।মনে হয় না এর পর আর সমস্যা হওয়ার কথা।
পারুল বেগম কোনোমতেই ছাড়বে না মুহুকে।জাহিন আশ্বাস দেয় কিছু হবে না।মাঝে কাঠ কাঠ গলায় বলে মুনা,
” আপুর তো সংসার আছে মা।তুমি এভাবে তো তাকে আটকে রাখতে পারো না।ভুল যখন করেই ফেলেছো এর মাশুল তো গুনতেই হবে!
জাহিন বলে,
“আমি তো অসহায়ের মতো ফেলে যাচ্ছি না তোমাদের।সবকিছুর চিন্তা আমার আছে।ব্যাপারটা আমি দেখছি।
অগত্যা আর বাঁধা দেয়নি পারুল বেগম।এভাবে তো সে ধরে রাখতে পারে না মুহতাসনিম কে।যদি মুহুর জামাই টাকা না দিতো তাতেও তো কিছু করার থাকতো না পারুলের।বাধ্য হয়ে চুপ করে রয়।পরক্ষণে দ্রুত সবকিছু গুছিয়ে মুহুকে নিয়ে ঢাকায় রওনা হয় জাহিন।
~~~
খাটে বসে পান চিবুচ্ছে রেহানা বেগম।পাশে থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নবনী।খাটের এককোনায় বসে চোখের জল মুছতে ব্যস্ত রিতা বেগম।ছেলে তার খানিক্ষন আগে ফোনে জানিয়েছে সে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।এতে অবশ্য খুশিই হয়েছিল রিতা।যখন পাত্রী সম্পর্কে জানতে পারে তখন যেন মাথায় আকাশ ভাঙ্গার অনুভূত!সিদ্ধান্ত রিশানের একার নয় সাথে জাহিনও আছে কথাটা শুনতেই তড়িঘড়ি করে নবনীর কাছে ছুটে আসে রিতা।মরা কান্না জুড়ে দেয়।রাগের বশে কয়েকটা কথাও শুনিয়ে দিয়েছে নবনীকে।ফের নাক টেনে বলে রিতা,
” জাহিন আমার এতবড় সর্বনাশ না করলেও পারতো আপা।আমার বিদেশ পড়ুয়া ছেলের বউ কিনা এমন পরিচয়হীন এতিম একটা মেয়ে হবে!আমি বেঁচে থাকতে এটা হবে না।
এতক্ষণ যাবৎ বেশ নীরব ছিল নবনী।এবার পাল্টা জবাব দেয়,
“তোমার ছেলে তো বাচ্চা নয় রিতা।একজন বলল আর সে বিয়ে করার জন্যে রাজি হয়ে গেল!
রাগ ক্রমশ বাড়ছে রিতার,
” আমার ছেলেটা ছোট।তাকে উসকানি দিয়েছে জাহিন।
“যেহেতু তোমার ছেলে ছোট তবে তাকে তুমি বোঝাও,মা হিসেবে তোমার কথা তো অমান্য করবে না।
“বুঝিয়েছি।আমার কথা শুনতে সে নারাজ!এমন একটা দিন আমায় দেখতে হবে আমি তো কল্পনাও করিনি।
ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে নবনী,
” তোমার কি বিষয় টা আরেকটু ভাবার উচিৎ না রিতা?তোমার ওমন বিদেশ পড়ুয়া ছেলে কেন এমন একটা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হলো?বিষয়টা তো উল্টো ঘোলাটে লাগছে আমার।একটা বিষয় কি জানো রিতা?কখনও কাউকে কোনো বিষয় নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই!পরিস্থিতি কখন কাকে কোথায় দাড় করায় বলা বাহুল্য!জীবন স্থিতিশীল নয়।
“এসব জ্ঞানের বানী শোনাতে হবে না।আপা আসার পর সংসার টা ধ্বংসের দিকেই যাচ্ছে।
রেহানা বেগম হুংকার দিয়ে ওঠেন।চোখ রাঙ্গিয়ে রিতার দিকে তাকিয়ে বলে,
” আমি এখনও জীবিত আছি এই কথা ভুইলা যাইও না রিতা।আমার মেয়েরে এতবড় কথা বলার সাহস তোমার হয় ক্যাম্নে?
পাল্টা কঠিন কন্ঠে জবাব দেয় রিতা,
“ঠিক আছে তাহলে আমরাই চলে যাই।আপনি থাকুন আপনার মেয়েকে নিয়ে।
চোখদুটো বুঝি ঝাপসা হয়ে আসলো নবনীর।মলিন কন্ঠে কেবল বলল,
” এসবের মধ্যে বিচ্ছেদের কথা কেন আসছে রিতা?তোমার সংসার তুমি ফেলে যাবে কেন?আমি চলে যাবার সামর্থ্য রাখি।পথে বসে পরার মতো অবস্থা আমার হয়নি।তবে এই যে এতদিন যাবৎ আমাকে নিয়ে তোমাদের মনে যা ছিল তা সহজেই প্রকাশ পেয়ে গেল আজ!মানুষ রাগের মাথায় যা বলে তা চিরন্তন কঠিন সত্য!
রেহানা বেগম বললেন,
“জাফর শায়লা ওরা ফিরুক রাফসার বাড়ি থিকা।এর একটা বিহিত করবোই।কথাখান কি বললা তুমি?কলিজায় আঘাত করছো আমার।
ওঠে হনহন করে চলে যায় রিতা।
~~~
জাহিন বাড়ি ফিরেই নবনীকে খুঁজছে।কোথাও মায়ের দেখা না পেয়ে ফোন করে।একবার বাজতেই রিসিভ হয়।জাহিন এসেছে শুনে ছাদ থেকে নেমে আসে নবনী। সাথে মিনা বেগমও আসে।ছেলেকে এখন এখানে দেখে কিছুটা চমকে ওঠে নবনী!
” এত তারাতাড়ি ফিরলি যে বাবা?
ক্লান্ত শরীরে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে জাহিন,
“ছুটি শেষের পথে মা মণি।এ ছাড়া উপায় ছিলো না।
মিনা বেগম এগিয়ে এসে মুহতাসনিমের মাথায়,গায়ে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে।নবনী সোজা প্রশ্ন ছোড়ে জাহিন কে,
” তুই কি রিশানের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?
চকিতে তাকায় মায়ের দিকে জাহিন।এ খবর তার মা মণি কি করে পেল!নিশ্চুপ জাহিনকে দেখে বলে নবনী,
“রিশান নিজে তার মাকে জানায় সে মুহতাসনিমের বোনকে বিয়ে করবে।
কথাটুকু কর্নপাত হতেই ভয়ানক ভাবে চমকে উঠে মুহতাসনিম।এমন কিছু শোনার জন্যে মোটেও প্রস্তুত ছিল না!রিতা বেগমের সম্পর্কে তার ধারণা আছে।বোন যে এ বাড়িতে দুদিনও সংসার করতে পারবে না তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
জাহিন ভাবতেও পারেনি তার কাজটা এতটা সহজ ভাবে এগিয়ে যাবে!রিশান অবশ্য ভালোই করেছে।পরিস্থিতি অস্থিতিশীল থাকবে সে ধারণা আগে থেকেই ছিলো জাহিনের।নবনী ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
” আমি জানি আমার ছেলে কখনও ভুল সিদ্ধান্ত নিবে না।আমি কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি না জানি।হয়তো কোনো কারণেই তোর এ সিদ্ধান্ত নেওয়া!ছোট থেকে আমি তোর মা আর আমিই তোর বাবা।আমি জানি এবং চিনি আমার ছেলেটা কেমন।
প্রসন্ন হাসে জাহিন।নিসন্দেহে বিশ্বাস করে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা তার মা মণি।
বাঁধ সেধে বলে মুহতাসনিম,
“কিন্তু!এটা কিভাবে হবে?আমার বোনকে এ বাড়িতে কেউ মেনে নিবে না!আমি বোন হয়ে এটা মেনে নিতে পারবো না।
আস্বস্ত কন্ঠে বলে জাহিন,
” একটু বিশ্বাস রাখো আমার প্রতি।সময় বলে দেবে সবটা।
অশান্ত মন নিয়ে নিশ্চুপ হয়ে রয় মুহতাসনিম।
~~~
রাত বেড়েছে বেশ।বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বইয়ে মুখ গুঁজেছে জাহিন।পাশে চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে আছে মুহতাসনিম।সবকিছু কেমন ওলোট পালোট লাগছে তার কাছে।জাহিন মনে মনে কি ছক কষছে জানা নেই।এর শেষ কোথায় আদৌ বলতে পারবে না মুহু।বই থেকে মুখ তুলে একপলক মুহতাসনিমের দিকে তাকায় জাহিন।হলদেটে রঙের মুখাখানি চিন্তিত হয়ে আছে।হাতে বই নিয়ে’ই দপ করে মুহতাসনিমের কোলের ওপর শুয়ে পরে জাহিন।বইয়ে চোখ রেখেই বলে,
“অশান্ত মস্তিষ্কে কোনো কিছুর সমাধান বের করা যায় না মিসেস মুহু!মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।চরম বিপর্যয়ের সময়ও মাথা শান্ত শীতল রেখে পরিকল্পনা করতে হয়।চিন্তাগ্রস্ত মস্তিষ্কে করা পরিকল্পনা বেশিরভাগ সময়’ই ভুল হয়।
কোনো কথাই কর্নপাত করছে না মুহতাসনিম।মস্তিষ্কে ঠেসে আছে নানান চিন্তা।দরজায় টোকা পরতেই সম্বিৎ ফিরে পায় মুহতাসনিম।দরজার ওপাশ থেকে নবনী ডাকছে খাওয়ার জন্যে।আসছি বলে মুহতাসনিম।জাহিন কোলের মধ্যে মাথা রেখে শুয়ে আছে বিধায় ওঠে দরজা খুলে দিতে পারেনি।
~~~
খাওয়ার টেবিলে বসে আছে সবাই।কেবল রিতা আসেনি।দুপুরেও খায়নি।রাফসাকে দিয়ে ডেকে পাঠায় রেহানা বেগম।খানিক্ষন পর আসে রিতা।চোখমুখ ফুলে আছে তার।জাফর সাহেব কিছুই বুঝতে পারছেন না পরিস্থিতি।টেবিলের দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে রাফসা আর মুহতাসনিম।হাতপা ক্রমশ শীতল হয়ে আসছে মুহতাসনিমের।গলা ঝেরে বলে রেহানা।
“ছোট নাতী বিয়ার সিদ্ধান্ত নিছে।
খাবার মুখে পুরে বলে জাফর সাহেব,
” ভালো সিদ্ধান্ত।মেয়ে কি দেশেরই নাকি বিদেশিনী?
“মেয়ে দেশেরই।জাহিনের শালি।
আচমকা পুরো রুম স্তব্ধ হয়ে গেল!এমন কিছু শোনার জন্যে প্রস্তুত ছিলো না কেউই!শায়লা বেগম বলেই ফেললেন,
” জাহিনের আপন শালি?অবশ্য পরিবার আছে কিনা তাও তো জানি না।
শান্ত কন্ঠে বলল জাহিন,
“মুহতাসনিমের আপন ছোট বোন।
রাগ কন্ঠ নিয়ে বলে জাফর সাহেব।
“এটা কিভাবে সম্ভব!এ বাড়ির বউ তো কোনোমতে ওই মেয়ে হতে পারে না।রিতারও মনে হয় না মত আছে!রিশানের বাবা কি বলে?
মলিন মুখে বলে রিতা,
‘ছেলের বিয়েতে তার অমত নেই!সে যেখানেই বিয়ে করুক।
মাঝে জাহিন বলে,
” আমি তো রিশানের খারাপ চাইবো না মামিমণি।ভেবে নাও সিদ্ধান্ত টা ভালোর জন্যেই।
মাঝে রেহেনা বেগম বললেন,
“আমি এবার সম্পত্তি ভাগ করমু।বয়স কম হয় নাই আমার।এখনই আমার মাইয়ারে কথা শুনাইতে ছাড়ে না কেউ।
চোখমুখ কুচকে বলে জাফর সাহেব,
” এমনিতে সিরিয়াস কথা হচ্ছে তার মধ্যে এসব কি কথা মা?
পাশ থেকে নবনী বলে,
“আমার কোনো সম্পত্তির ভাগ চাইনা মা।আমার ছেলে এবং আমি এতবছর এখানে থেকেছি এর জন্যে কৃতজ্ঞ তোমাদের কাছে।
থমথমে কন্ঠে বলে জাফর সাহেব,
” এসব কথা বাদ রেখে আসল কথায় আসি।
রিতা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে জাফর সাহেব,
“তোমার পরিবারে সবাই রাজি।কেবল তুমি ছাড়া।এখন কথা হচ্ছে ছেলেকে বোঝাতে পারো কিনা দেখো।তবে এখানে বিয়ে হলে আমরা কেউ মত দিবো না তাতে।
রিতা বেগম ফের ফুপিয়ে কাঁদছেন।তার ভেতরে যে বহু চাপা কষ্ট ঠেসে আছে।স্বামীর থেকে ছেলের ব্যাপারে সবটাই জেনেছে রিতা।ছেলে তার এত বিগড়ে যাবে ভাবতে পারেনি।কোন মুখে এই বিয়েতে বাধ সাধবে?চলে যাক ওমন ছেলে নরকে!এ নিয়ে আর একটা কথাও বলবে না রিতা।
আনান বলেই ফেলল,
” কাজটা ঠিক করিসনি জাহিন।
মুচকি হেসে বলে জাহিন,
“আমি কি করেছি আনান?তোরও তো ভাই হয়।আমার কথা শুনলে তোর কথাও নিশ্চয়ই শুনবে।তুই না হয় নিষেধ করে দে রিশুকে।
চুপচাপ খাচ্ছে আনান।আর একটি টু শব্দও করেনি কেউ।
~~~
নিশ্চুপ নৈশপ্রহে নীরব হয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে আনান।নিজেদের সাজানো-গোছানো পরিবার টা আজ ধ্বংসের পথে!
” কি ভাবছো শুনি?
রাফসার কন্ঠস্বর পেতেই সম্বিৎ ফিরে পায় আনান।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
“কিছু না।
দু হাত ভাজ করে দেয়ালের সাথে হেলান রেখে দাঁড়িয়ে বলে রাফসা,
” চিন্তা তো অবশ্যই করছো।একটা কথা কি জানো আনান? যদি আমার পরিবার জানতো তোমার ভাইয়েরা কি লেভেলের মধ্যে সম্পর্ক করেছে তাহলে এ জন্মে আর আমাকে পাওয়া হতো না তোমার।
ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে আনানের।
“এতে আমার কি দোষ?আমরা কি নিচু লেভেলের নাকি আমি তোমার যোগ্য নই?কোনটা বলো?
” তোমরা তো চিটার।সব তথ্য গোপন রেখেছো!এখন তো মনে হচ্ছে আমাকে ডিজার্ব করো না তুমি।এমন কোনো রাস্তার মেয়েকেই বিয়ে করা উচিৎ ছিলো তোমার।
রাগ কন্ঠে বলে আনান,
“আশ্চর্য রাফসা!আমাকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিলে তুমি।
বলেই রাগে গজগজ করতে করতে রুমে চলে যায় আনান।দীর্ঘশ্বাস ফেলে আকাশ পানে তাকায় রাফসা।
~~~
ধোঁয়াশা ঘোলাটে অম্বর।ভোর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে আকাশ।বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মুহতাসনিম।রুমে ঘুমোচ্ছে জাহিন।অশান্ত মন নিয়ে দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি একমিনিটের জন্যেও।আধো ঘুম চোখে বেলকনিতে আসে জাহিন।পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে মুহতাসনিমকে।ঘুমন্ত জড়ানো কন্ঠে বলে,
” কালকে জার্নি হয়েছে।একটু ঘুমও হয়নি কিন্তু।শরীর খারাপ করবে এভাবে চললে।আমার উপর কি বিশ্বাস নেই তোমার?এভাবে চিন্তিত মুখে মেঘবতী কে একটুও ভালো লাগে না।
পাশের বেলকনি থেকে কারো দৃষ্টি থমকে যায় একজোড়া কপোত-কপোতীর দিকে!কি আবেশে জড়িয়ে আছে জাহিন।ভোর হবার সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত বুঝি এটাই!বুক চিরে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে রাফসার।রাতটুকু এখানেই কাটিয়েছে।আনান একটাবার ডাক পর্যন্ত দেয়নি তাকে!বেঘোরে ঘুমোচ্ছে রুমে!
চিন্তিত নিশ্চুপ মুহুকে কোলে তুলে এলোমেলো পা ফেলে রুমে এসে খাটে শুইয়ে দেয় জাহিন।মুহু বসার চেষ্টা করতেই জাহিন পাশে শুয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নেয়।চোখ বুজে বলে,
“এখন আমাদের গন্তব্য কোথায় জানো মুহু ঘুমের রাজ্যে!আর একটা কথা’ও নয়।
বাধ্য মেয়ের মতো চুপচাপ শুয়ে থাকে মুহতাসনিম।
~~~
ঘড়ির কাটা সকাল দশটায়!ফোনে শব্দ হতেই ধরফরিয়ে উঠে বসে মুহতাসনিম।পাশে জাহিন নেই!মুহু কখন ঘুমালো খেয়াল নেই।কফি হাতে বেলকনি থেকে ছুটে আসে জাহিন।ততক্ষণে ফোন রিসিভ করে কানে জড়ায় মুহতাসনিম।ওপাশ থেকে কান্নারত কন্ঠে বলছে পারুল বেগম,
” টাকা তো ফিরাই দিয়া গেছে জুয়েল মির্জা!আমার মুনারেই নাকি বিয়ে করবো।
চলবে…….