মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-৫৩,৫৪,৫৫ শেষ

0
922

#মেঘবতীর_শহরে,পর্ব-৫৩,৫৪,৫৫ শেষ
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
৫৩
,

সকাল পেরিয়ে এখন দুপুর প্রহর।চারিদিকে তপ্ত রৌদ্র!চিলেকোঠার রুমে এসে বসে আছে মুহতাসনিম।নিচে থাকাটা তার জন্য এখন একপ্রকার দুষ্কর হয়ে উঠেছে।খানিকক্ষণ আগে কোথাও একটা বেরিয়ে যায় জাহিন।একটাবার বলেও যায়নি কোথায় গিয়েছে সে।মুহতাসনিম অবশ্য ফোনে তাকে ট্রাই করেছিলো জাহিন বরাবরের মতো ফোন কেটে দিয়েছে।চরম বিরক্তি ধরেছে মুহতাসনিমের।এদিকে বাড়ির চিন্তায় হাড় হিম হয়ে আসছে।মুনাকেও আর ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না।মুহতাসনিমের শত ভাবনার ছেদন ঘটিয়ে মিনা বেগম ডেকে উঠেন,

“মুহু তোরে নবনী আপা ডাকতাছে নিচে।

নিশ্চুপ কয়েক সেকেন্ড মিনার দিকে তাকিয়ে থাকে মুহতাসনিম।পরক্ষণে ধীর পায়ে চলে যায়।

~~~

মায়ের কোলে মাথা রেখে বাচ্চাদের মতো গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে জাহিন।পরম আদরে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে যাচ্ছে নবনী।দৃশ্যটুকু দেখে চোখের কোণা জলে চিকচিক করে উঠে মুহতাসনিমের।মায়ের আদর কেমন হয় জানা নেই মুহুর!হঠাৎ দরজার দিকে দৃষ্টি পরতেই বলে নবনী,

” আরে মুহতাসনিম ভেতরে আয়।

সঙ্গোপনে চোখের জলটুকু মুছে ভেতরে এসে দাঁড়ায় মুহতাসনিম।এখনও মায়ের কোলে চোখ বুজে শুয়ে আছে জাহিন।ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি নবনীর।পরক্ষণে হাতে থাকা একটা চাবির ছড়া মুহতাসনিমের সম্মুখে নিয়ে বলে,

“জাহিন নতুন ফ্ল্যাট কিনেছে মুহতাসনিম।আমরা আজই চলে যাবো।

জোড় করে হাসার চেষ্টা করলো মুহতাসনিম।মুখের মলিনতায় চাপা পরে রইল কৃত্রিম হাসিটুকু!একেই চিন্তায় মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।সকাল বেলা তখন মুনার সাথে ভালো মতো কথাও হয়নি।তার আগে জাহিন ফোনটা নিয়ে নেয়।শুধু মুনাকে এটুকু বলে রেখে দেয় ‘চিন্তা করো না আমি দেখছি’।

এখন তো মুহু দেখছে জাহিন নতুন ফ্ল্যাটের চাবি নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করেছে!মুহতাসনিমের মা,বোনের কথা কি বেমালুম ভুলে গেল জাহিন?ভেতরে এক চাপা কষ্ট অনুভব করলো মুহতাসনিম।নিরবে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করে বলে নবনী,

” মুখ টা এমন শুকনো লাগছে কেন মুহতাসনিম? কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছিস?

আচমকা মায়ের কোল থেকে তড়াৎ করে উঠে বসে জাহিন।মুহুর শুকনো মুখখানা তার দৃষ্টিগোচর হয়নি।কি কারণে মেয়েটা এমন মুখ ভার রেখেছে তা অজানা নয় জাহিনের।মুহতাসনিমের উদ্দেশ্যে বলল জাহিন,

“সব কিছু গুছিয়ে নাও মুহু।আর বেশিক্ষণ এখানে থাকবো না আমরা।

উঠে তাড়া নিয়ে বলে নবনী

” আমি বরং তোর নানুমণির থেকে বিদায় নিয়ে আসি।

বলেই বেরিয়ে যায় নবনী।এতক্ষণ জমে থাকা চোখের জলটুকু টুক করে মেঝেতে পরে মুহতাসনিমের।ধরা গলায় কেবল বলে,

“আমি বাড়ি যাবো।

চমকে তাকায় জাহিন।পরক্ষণে বলে,

” কেন?

মুহতাসনিমের রাগ ক্রমশ বাড়ে।উঠে কয়েক কদম মুহুর সম্মুখে আসে জাহিন।আলতো হাতে মুহুর দু গালে হাত রেখে বলে,

“চোখে পানি কেন?ওমন মায়াবী চোখে পানি মানায় না মুহু!

জাহিনের কথাটুকু সহ্য হচ্ছে না মুহতাসনিমের।ভেতরে চেপে আছে কষ্ট।ছোট্ট একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলে জাহিন,

” মুনা আর তোমার মা ঢাকায় আসছে।আমাদের নতুন ফ্ল্যাটে।

কথাটুকু শোনা মাত্র বিস্ফোরিত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় মুহতাসনিম।নিজের কানকে বিশ্বাস হচ্ছে না যেন।খুশিতে উত্তেজিত হয়ে ঠোঁট জোড়া মৃদু কাঁপছে।একটুখানি হেসে বলে জাহিন,

“সকালে মুনার সাথে কথা বলেই বেরিয়ে যাই আমি।ফ্ল্যাট ম্যানেজ করি দ্রুত।তার আগেই মুনাকে বলি ঢাকায় রওনা দিতে।সেখানে নিরাপদ নয় তারা।মুনাকে বলেছি ফোন বন্ধ রাখতে।সিম কার্ড ফোন থেকে খুলে নিতে বলি।টেনশন করো না খানিকক্ষণ আগে বাইরে থেকে কল করেছে মুনা।প্রায় এসে গেছে তারা।আমি চাই না এ বাড়িতে এসে অপমানিত হোক তারা।তাই এ সিদ্ধান্ত আমার।

খুশিতে চোখ জোড়া চিকচিক করছে মুহতাসনিমের।মুহূর্তেই ঝাপটে ধরে জাহিনকে।বুকের মধ্যিখানটায় মুখ রেখে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে।খুশির কান্না!একজীবনে এত ভালো একজন জীবনসঙ্গী আশা করেনি মুহতাসনিম।জীবনের সূচনা টা হয়েছিল তার কষ্ট দিয়ে!উপসংহার কি তবে ভালো কিছু হবে?দুহাতে মুহুকে আরেকটু বুকে জড়িয়ে নেয় জাহিন।মৃদু হেসে বলে,

” মা মণি এসে যাবে তো এখনি।

নিঃশব্দে হেসে দূরে চলে আসে মুহতাসনিম।তক্ষুনি রুমে প্রবেশ করে নবনী।রেহেনা বেগমকে বুঝিয়ে এসেছেন এটা জানান।বাড়ির সবাইকেও বলা হয়েছে জানায়।এবার শুধু তাদের যাওয়ার পালা।এ বাড়ি থেকে নেওয়ার মতো কিছুই নেই নবনীর।শূন্য হাতে কেবল ছেলে আর ছেলের বউ নিয়ে বিদেয় নেয়।

~~~

পড়ন্ত বিকেল!সূর্য টা পশ্চিমে হেলে পরেছে।গোধূলি লগ্ন!খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে রক্তিম সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে মুহতাসনিম।নতুন ফ্ল্যাটে তাদের রুমের বেলকনিটায় দাঁড়িয়ে আছে।বেলকনির একপাশে শুভ্র রঙের ক্যামেলিয়া গাছ!তার ঠিক উল্টোপাশে কালো রঙা গোলাপ গাছ।রুমটা একদম মুহতাসনিমের মনের মতো করে সাজিয়েছে জাহিন।দেয়ালের এক কোনায় জাহিন,মুহুর বিশাল একটা ছবি টাঙ্গানো!

নবনীর ডাকে ঘোর কাটে মুহতাসনিমের।বাড়ি থেকে মুনা’রা এসেছে জানাতেই দৌড়ে ড্রয়িং রুমে চলে আসে মুহতাসনিম।সোফায় বসে আছে পারুল বেগম।জাহিনের হাতে মস্তবড় ব্যাগ।পাশে দাঁড়ানো মুনাকে এসে ঝাপটে ধরে মুহতাসনিম।বোনকে জড়িয়ে ধরে মুনাও।

পারুল বেগমের চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে আজ খুশিতে।জাহিন আসার সময় রাস্তায় মুনার বিয়ের ব্যাপার টা জানায় পারুল কে।বিনাবাক্যে রাজি হয় পারুল।নিজের মেয়ের এমন জায়গায় বিয়ে হবে ভাবতেই তো স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে!মুহতাসনিম কে এতদিন অপয়া,অলক্ষুণে মনে করলেও আজ মুহুর জন্য তার জীবনের এই পরিবর্তন এটা স্বীকার করতেই হবে।জাহিন বলেছে জীবনের বাকিটুকু সময় যেন পারুল এখানেই থাকে।এত খুশির খবর একসাথে পেয়ে যেন বাকরুদ্ধ পারুল!মৃত স্বামী আলতাফ মিয়ার কথা মনে পড়ে খুব করে!মানুষ টা তো কতটা কষ্ট করে গেছে!আজকের এই সুখের দিনটুকু তার কপালে দেখার সৌভাগ্যটুকু হলো না!নিরবে ভেতর থেকে হাহাকার বেরিয়ে আসে পারুলের।নবনী গিয়ে পারুল আর মুনার রুমটা দেখিয়ে দেয়।

মুহতাসনিম কে একা পেয়েই আবদারের সুরে বলে উঠে জাহিন,

“মুহু রিকশায় করে শহর দেখবে?আমার অনেকদিনের ইচ্ছে তোমাকে নিয়ে হুডতোলা রিকশায় শহর ঘুরবো।

মুহতাসনিম আমতাআমতা করে কিছু বলতে যাবে, কথাটুকু কেড়ে নিয়ে বলে জাহিন,

” আমার ছুটি আজই শেষ মুহু।

একটুখানি হেসে বলে মুহতাসনিম,

“এক্ষুণি তৈরি হয়ে আসছি আমি।

~~~

সন্ধ্যার প্রহর।রিকশায় পাশাপাশি বসে আছে জাহিন মুহতাসনিম।মুহুর,কালো পাড়ের ধূসর রঙা শাড়ির আঁচল টুকু বাতাসে দুলছে!আঙ্গুল আঙ্গুল ভাজ করে বসে আছে জাহিন।সন্ধ্যার রঙ্গিন শহরে ব্যস্ত মানুষের দল!আশেপাশের জগৎ ভুলে মুহুতে মত্ত জাহিন!মুহুর খোঁপা খানায় একটা বেলি ফুলের মালা গুঁজে দিয়েছিল জাহিন।তার তীব্র সুভাস এসে মনকে যেন আরও চনমনে করে দিচ্ছে!জাহিনের দৃষ্টি বারংবার লজ্জায় ফেলে দিচ্ছে মুহতাসনিম কে।লোকটা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে!আশেপাশে লোক কি তার খেয়ালে নেই!মৃদু গলা ঝেড়ে কেশে বলে মুহতাসনিম,

“ডাক্তার দের কি চোখের পলক পরে না?নাকি আমার ডাক্তার টাই শুধু এমন?

একদৃষ্টি নিয়ে তাকিয়েই বলে জাহিন,

” মুহু ভালোবাসা,সম্পর্ক এত সুন্দর,স্নিগ্ধ আর নিষ্পাপ হয়?যদি আরও হাজার বছর আগে তোমার সাথে আমার পরিচয় হতো?এমন একটা মায়াবতী মেঘবতীকে পেয়ে জীবন স্বার্থক আমার!আরও হাজার বছর আমি বাঁচতে চাই আমার ছোট্ট মেঘবতীর শহরটা নিয়ে।যে শহরে শুধুই ভালোবাসা!কোনো কালো অতীতের ছোঁয়া নেই!

জাহিনের বোকা বোকা কথা শুনে হাসি পায় মুহতাসনিমের।খিলখিল করে হেসে বলে,

“ডাক্তার রা এত বোকা হয় তাও জানা ছিল না আমার।আমি তো ভেবেছি আপনি ভালোবাসা বুঝেন’ই না।রক্ত মাংসে গড়া জীবন্ত এক রোবট!এখন তো দেখছি ভালোবাসার গভীর থেকে গভীরে প্রবেশ করে ফেলেছেন ডাক্তার!যেখানে সহজে কেউ প্রবেশ করতে পারে না!

মুহতাসনিমের হাতটা মুখের সামনে নিয়ে উল্টোপিঠে ছোট্ট একটা চুমু খায় জাহিন।মৃদু শিউরে ওঠে যেন মুহতাসনিম।তিরতির চোখ জোড়া ওপাশে নিক্ষেপ করে আড়াল করতে চায় লজ্জামাখা মুখটুকু!

” মায়ায় জড়িয়েছি মুহু।ভয়ংকর ভালোবাসায় ডুবেছি।

বলেই গলা ঝেড়ে গানের সুর তোলে জাহিন,

‘ধরিয়া রাখিও সোহাগে আদরে আমার মুখর পাখি
‘তোমার প্রাসাদ প্রাঙ্গণে
‘মনে করে সখি,বাঁধিয়া রাখিও
‘আমার হাতের রাখি
‘তোমার কনককঙ্কনে
‘ভালোবেসে সখি নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো
‘তোমার মনেরও মন্দিরে।

ততক্ষণে জাহিনের কাঁধে মাথা এলিয়ে দেয় মুহতাসনিম।কেন জানি আজ মুহতাসনিমেরও মনে হচ্ছে ভালোবাসা সত্যি খুব সুন্দর অনুভূতি!ভীষণ সুন্দর!

গান শেষ হতেই নিভৃতে মুহুর কপালে কোমল অধরযুগল ছুঁইয়ে দেয় জাহিন।আবেশে চোখ বুজে আসে মুহতাসনিমের।ভালোবাসা সত্যিই ভয়ংকর সুন্দর!

হাওয়াই মিঠাই দেখতে পেয়েই রিকশা থামায় জাহিন।নেমে গিয়ে কিনে নিয়ে আসে হাওয়াই মিঠাই।অধরে হাসি রেখে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে মুহতাসনিম।প্যাকেট খুলে সেটা মুহতাসনিমের মুখের কাছে ধরে জাহিন।ইশারায় খেতে বলে।আবারও আপন গতিতে চলতে থাকে প্যাডেল চালিত রিকশা।মুখ খানিকটা ভার করে বলে মুহতাসনিম,

“আপনি খাবেন না?একটা নিয়ে আসলেন যে?

কিঞ্চিৎ নিজের মুখে নিয়ে বলে জাহিন,

” একটা কি দুজন মিলে খাওয়া যাবে না?

আবারও লজ্জায় চোখ নামায় মুহতাসনিম।জাহিন যখন আবারও রিকশা থামাতে বলল, চমকে উঠে মুহতাসনিম।রাস্তার পাশে মহিলারা রঙবেরঙের কাঁচের রেশমি চুড়ি নিয়ে বসেছে।সেদিকে ছোটে জাহিন।মুহূর্তেই কয়েক রঙের চুড়ি নিয়ে আসে।লোকটাকে আজ বদ্ধ পাগল প্রেমিক লাগছে মুহতাসনিমের।রিকশায় বসে মুহুর হাত টা টেনে চুড়ি পরিয়ে দিতে থাকে জাহিন।নিরবে জাহিনের কর্মকান্ড দেখছে মুহতাসনিম।লোকটা কি ভালোবাসায় উন্মাদ হয়ে গেল!নিজের হাতে চোখ বুলিয়ে বলে মুহতাসনিম,

“আমার হাতের চুড়ির মাপ আপনি কি করে জানলেন?

মুহতাসনিমের দিকে একপলক তাকিয়ে বলে জাহিন,

” তোমার একজোড়া বালা আমার কাছে ছিল।সেগুলো প্রতিনিয়ত কতবার দেখেছি জানো না।নানান বাহানায় সহজে সেগুলো ফেরত দিইনি তোমায়।

ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে ফের বলে জাহিন,

“তোমার মায়ায় জড়িয়েছি সেই কবেই!নিরবে মন ভালোবেসে ফেলেছিল নিজের অজান্তেই!অথচ বোকা মন সেটা বোঝেইনি!

জাহিনের কথায় আবারও খিলখিল করে হাসে মুহতাসনিম।মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে জাহিন।এ যেন চাঁদের একফালি হলদে কিরণ!

চলবে………

#মেঘবতীর_শহরে
পর্ব-৫৪
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,

ঢাকায় পারুল বেগমের প্রায় মাস খানেক এর বেশি সময় কেটে যায়।বাড়ির খোঁজ খবর অজানা।জুয়েল মির্জা নাকি ভাঙচুর চালিয়েছে বাড়িতে।বাধ্য হয়ে জাহিনের টাকাটা রাখে জুয়েল।

মুনার কাগজ পত্র প্রায় তৈরি।কালকে বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে মুনা।পরবর্তী গন্তব্য তার জানা নেই।ভাগ্যে কেমন ধরনের মানুষ অপেক্ষা করছে তাও অজানা!পুরোপুরি এক অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে জাপানে পাড়ি জমাবে মুনা।যার সাথে সারাটা জীবন কাটাবে তাকে দেখার সৌভাগ্যটুকু তার এখনও হয়নি।অবশ্য মুহতাসনিম ছবি নিয়ে এসেছিল।দেখার প্রয়োজন বোধ করেনি মুনা।

~~~

রাত্রি প্রহর।আকাশটা থমথমে আর গুমোট হয়ে আছে।এক্ষুনি বুঝি ঝেঁপে বর্ষণ হবে।গালে হাত রেখে খোলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে মুনা।বেলকনিতে প্রবেশ করে মুহতাসনিম।বোনের যে মন খারাপ তা আর বুঝতে বাকি নেই।কাঁধে হাত ছোঁয়াতেই চমকে উঠে মুনা।ভেজা চোখদুটো নিয়ে ঘুরে তাকায়।তৎক্ষনাৎ বোনকে জড়িয়ে ধরে মুহতাসনিম।কান্নায় ভেঙে পরে।কন্ঠ যথাসম্ভব কঠিন করে বলে মুনা,

“কাঁদছিস কেন মুহুপু?আমি ছেড়ে চলে যাবো তাই?বাবাও তো আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।তাই বলে আমরা কি এত ভেঙে পরেছি?

মুনার কথায় কলিজা মোচড় দিয়ে ওঠে মুহতাসনিমের।তার ছোট্ট বোনটা কত বড় হয়ে গেছে!কথার ধরণ কেমন বিজ্ঞ দের মতো!বোনকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলে মুহতাসনিম,

” একদম ভয় পাবি না মুনা।যখন ইচ্ছা হয় তখনই আসতে পারবি তুই।

হাত গুটিয়ে দাঁড়ায় মুনা।দূর আকাশে দৃষ্টি ফেলে বলে,

“জীবন আমায় কোথায় দাড় করাচ্ছে রে আপু?অপরপ্রান্তের মানুষটা কেমন তাও জানি না।এভাবে কি সম্পর্ক হতে পারে?কোন গোলকধাঁধায় আটকে যাচ্ছি আমি?

আশ্বস্ত কন্ঠে বলে মুহতাসনিম,

” তোর জিজু তো আর খারাপ চাইবে না।ওই জুয়েল মির্জার থেকে এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত ঢের ভালো।আমার জীবনের সাথে কি ঘটেছিল তা তো তুই জানিসই।চোখের সামনে পুরো অনাকাঙ্ক্ষিত ভবিষ্যত নিয়ে ডাক্তারের সাথে সম্পর্কে যাই।বিশ্বাস কর আমার চাওয়ার চেয়ে শতগুণে বেশি দিয়েছেন খোদা আমায়।যা আমার কল্পনাতীত ছিল!সুন্দর একটা সংসার আমারও হবে ভাবতে পারিনি।

মুহতাসনিমের কথার প্রতিত্তোরে শুধু ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুনা।

~~~

পারুল বেগম হাতে হাতে মেয়ের সকল জিনিসপত্র গুছিয়ে দিচ্ছে।আজকে খুশির অন্ত নেই তার।এতবড় ভাগ্য নিয়ে মুনা জন্মেছে তা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না।কত বড় দেশে পাড়ি জমাবে মেয়ে তার।অবশ্য মেয়ের জামাইকে ছবিতে দেখে নিয়েছেন পারুল বেগম।নবনীও টুকিটাকি কিছু হাতে হাতে এগিয়ে দিয়েছে।সকাল হলেই মুনার ফ্লাইট।জাহিন জরুরি কাজে আটকে আছে।তার পক্ষে মুনাকে বিদেয় দেওয়া সম্ভব নয়।এটা শুনে অবশ্য সবার মন একটু খারাপ হয়।তাতে তো আর কিছু করার নাই।

~~~

ধোঁয়াশা ঘোলাটে ভোরের আকাশ।রাত থেকে সকাল হওয়া সবই নিজ চোখে দেখেছে মুনা।একফোঁটা ঘুম ধরা দেয়নি চোখে।পাশে বসে ছিল মুহতাসনিম।বোনকে একা রেখে যে যেতে ইচ্ছে করছিলো না কিছুতেই!ভেতরের রুম থেকে শোরগোল পাওয়া যাচ্ছে।ভোর বেলা উঠে মেয়ের জন্য খাবার তৈরি করছে পারুল।খানিকক্ষণ পরেই তাদের রওনা হতে হবে এয়ারপোর্টে।

~~~

সময় এখন সকাল নয়টা।এয়ারপোর্টে মুনাকে বিদায় দিতে এসেছে সবাই।কেবল জাহিন নেই।সেদিনের পর থেকে রিতা বেগম পুরোপুরি যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে নবনীর সাথে।রিশানের কলটাও পর্যন্ত ধরেন না।আজকে মুনার যাওয়ার খবর রিতার কানে পৌছেছে।অবশ্য নবনী কল করেছিল।শায়লা জানায় রিতা নাকি রুমে দরজা এটে বসে আছে।পরক্ষণে ফোন কেটে দেয় নবনী।আজকের এই দিনটা একদিন থাকবে না।সুদিন অবশ্যই আসবে।দিন সবসময় ভালো যায় না কারোই।ছোট্ট একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মুনাকে বিদায় জানায় নবনী।পাশে মরা কান্না জুড়েছেন পারুল।আশেপাশে অনেকেই তাকিয়ে ছিল।শক্ত চোখমুখ খানি নিয়ে বলে মুনা,

“মা আমার থেকে তোমার দূরে সরে যাওয়া,এটাই বোধহয় ছিল তোমার সবচেয়ে বড় শাস্তি!চাইলেই নিজের পেটের মেয়েকে একটুখানি ছুঁয়ে দিতে পারবে না।বুকে টেনে নিতে পারবে না।

এ কথা শুনে হাউমাউ করে কাঁদছে পারুল।চোখ বেয়ে অনর্গল পানি পরছে মুহতাসনিমের।বুকটা ভার হয়ে আছে।মেয়েকে ধরে অজস্র চুমোতে ভরিয়ে দিলেন পারুল বেগম।কোনো হেলদোল নেই মুনার।চোখে এক ফোটা জলের দেখা মিললো না তার।কাটা কাটা শব্দে কেবল মায়ের উদ্দেশ্যে বলল মুনা,

” তোমার আরেক মেয়েকে রেখে যাচ্ছি তো মা।এই যে আমার কথা মনে হলে মুহুপু কে ছুঁয়ে আদর করে দিও একটুখানি।বোনটা আমার মায়ের আদর পায়নি কখনও।এই উছিলায় যদি মা পায়!

ভাঙা আওয়াজে বলে মুহতাসনিম,

“এভাবে বলছিস কেন মুনা?তুই দূরে থাকলেও আমাদের মনের মধ্যে থাকবি সবসময়।

পাশ থেকে নবনী বলে,

“কে বলে তোমার বোন মায়ের আদর পায়নি?তাকে জিগ্যেস করো তো সে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হয়েছে কিনা কখনও?তুমি এ নিয়ে ভাববে না।তোমার বোন মায়ের আদর থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না কখনও!

সবশেষে বিদায় নিয়ে চলে যায় মুনা।মেয়ের শেষের কথাগুলি বুকটা পোড়াচ্ছে পারুলের।মেয়ে তার সত্যিই তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে!এ জীবনে মেয়েকে কি আর স্বচক্ষে দেখা হবে তার?ভাবতেই ফাঁকা বুক হুহু করে ওঠে!

~~~

দুপুর গরিয়ে বেলা এখন বিকেল।এয়ারপোর্ট থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুয়ে আছে মুহতাসনিম।এখন অব্ধি ওঠে ফ্রেশ হয়নি।শরীর টা প্রচন্ড দূর্বল লাগছে তার।কাল থেকে খাওয়া,ঘুম কিছুই হয়নি।নবনী মাঝে দুবার ডেকে গেছে।পরে আসছি বলে এড়িয়ে যায় মুহতাসনিম।শত ভাবনার মাঝেই ঘুমের রাজ্যে চলে যায়।

সন্ধ্যা বেলা মুহতাসনিম কে ডাকতে আসে নবনী।বেঘোরে ঘুমোচ্ছে দেখে চলে যায়।মেয়েটা ফ্রেশ না হয়ে না খেয়ে ঘুমিয়ে পরায় খানিকটা রাগ হয় নবনীর।

রাতের দিকে ঘুম কাটে মুহতাসনিমের।দরজার সামনে নবনীকে হুট করে দেখে চমকে উঠে।মুখে রাগ ভাব নিয়ে বলে নবনী,

” এখন যদি দেখতাম না তুই এখনও জাগিসনি তাহলে আজ সত্যি আমার হাতে মার খেতিস তুই।যা ওঠে ফ্রেশ হয়ে আয়।আমি খাবার দিচ্ছি।

অপরাধীর মতো মুখ করে ওঠে দৌড়ে ফ্রেশ হতে চলে যায় মুহতাসনিম।মুচকি হেসে স্থান ত্যাগ করে নবনী।

পারুল বেগম খাওয়া শেষে রুমে গিয়ে শুয়ে আছেন।মন তার বড্ড খারাপ।যতক্ষণ পর্যন্ত না খবর পাবে মেয়ে তার জাপানে পৌছায়নি ততক্ষণ অস্থির মন সস্থি অনুভব করবে না।

~~~

কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে বর্তমানে মুনা দাঁড়িয়ে আছে জাপানের রাজধানী টোকিও তে।অচেনা আগন্তুকের অপেক্ষারত।বিশাল বিশাল গগনচুম্বী ইমারত গুলো মনে খানিকটা ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে।নিজ দেশের ঢাকা শহরটাও ভালোমতো দেখা হয়নি মুনার।আর সে কিনা ভিনদেশর মাটিতে পা ছুঁয়িয়েছে!কেমন হবে তার ভিনদেশী জীবণ?শত ভাবনার মাঝে কেউ ডেকে উঠে,

“মিস মুহতানিম?

বেশ চমকে উঠে মুনা।শুকনো ঢোক গিলে পাশে তাকায়।বেশ সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে!পরনের বেশভূষা আর গায়ের শ্বেত রঙ বলে দিবে এ দেশেরই নাগরিক!খুব সূক্ষভাবে খেয়াল করলে ভিন্নতা ধরা যাবে।ততক্ষণে হালকা কেশে নিয়ে ছেলেটি বলে,

” আমি রিশান।

নিজেকে স্বাভাবিক করার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় মুনা।জড়োসড়ো ভাব কিছুতেই কাটছে না।ততক্ষণে লাগেজ নেওয়ার জন্য হাত বাড়ায় রিশান।সেদিকে খেয়াল হতেই মুনা দেখে শুভ্র রঙের হাতের আঙ্গুলের ডগা গুলো রক্তিম হয়ে আছে!অপেক্ষা না করে নিজেই লাগেজ হাতে নেয় রিশান।তাড়া নিয়ে বলে,

“গাড়ি নিয়ে এসেছি চলুন।

মুনার চিন্তা কেবল বাড়তেই থাকে।মস্তবড় শহরে পড়াশোনা ছেলেটির!বনেদি ঘরের সন্তান।তার মতো তুচ্ছ মেয়েকে নিজের জীবনে কেন ঠাঁই দিলো?এর পেছনে কি কোনো কারণ আছে?সবটাই যে জানতে হবে মুনাকে!

~~~

মুনা জাপান পৌছেছে আজ সাতদিন।এর মাঝে আর বাড়ি ফেরেনি জাহিন।আজ অবশ্য মুহতাসনিম ফোনে জিগ্যেস করেছিল জাহিনকে সে কবে ফিরবে।বরাবরের মতো অভিমান নিয়ে সে জানায় আর আসবে না।মা মণির থেকে শুনেছে জাহিন,মুহু ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করে না,ঘুমোয় না।যেদিন সবকিছু নিয়মমাফিক করবে মুহু সেদিনই জাহিনের দেখা পাবে।মন খারাপ করে ফোন রেখে দেয় মুহতাসনিম

পরক্ষণে দুই মাকে চা বানিয়ে দিয়ে রুমে এসে শুয়ে পরে।মুহূর্তেই ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়।

~~~

ঘড়ির কাটা রাত দশটায়।ঘুম ছুটে যায় মুহতাসনিমের।আড়মোড়া ভেঙ্গে ওঠে বসতেই ভয়ানক চমকে ওঠে!তার পাশে জাহিন বসে বসে বই পড়ছে!সে কি সত্যিই জাহিনকে দেখছে?কয়েকবার চোখের পলক ফেলে দেখে নেয়।নাহ্ সত্যিই তার ডাক্তার সম্মুখে বসে আছে!খানিকটা কাছে গিয়ে গুটিসুটি মেরে জাহিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে মুহতাসনিম।পরমুহূর্তে গাম্ভীর্য কন্ঠস্বর শুনতে পায়,

“আমি কাওকে অনুমতি দিইনি আমার কোলে শোবার।

রাগে চোখমুখ কুচকে আসে মুহতাসনিমের।লোকটাকে বরাবরের মতোই বেরসিক লাগে।সেদিকে তোয়াক্কা না করে জাহিনের পেটের দিকটায় মুখ গুঁজে দেয়।যথাসম্ভব হাসি চেপে রাখে জাহিন।জোরপূর্বক মুহতাসনিম কে টেনে বসায়।

“অবেলায় কিসের ঘুম?সবকিছু নিয়মের বাইরে চলে যাচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে অসুস্থ হয়ে যাবে তো।

চোখেমুখে দ্বিগুণ রাগ নিয়ে জাহিনকে ধাক্কা মেরে খাটে ফেলে দেয় মুহতাসনিম।ধপ করে এসে বক্ষস্থলে মাথা রেখে বলে,

” আমি আপনার রোগী নয় যে আপনার কথা শুনতে বাধ্য।সবকিছুই অনিয়ম হবে।একটুখানি নিয়ম ভাঙ্গলে কিছু হয় না হু!

মুহতাসনিম কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে বলে জাহিন,

“নিয়মের উর্ধ্বে তো যাওযা যাবে না ম্যাডাম।

” তাহলে এবার বলুন আপনি কেন আমায় না বলেই চলে আসলেন?

“ছোট্ট শাস্তি ছিল এটা।যদি নিয়ম ভাঙ্গো তাহলে এর চেয়ে বড় শাস্তি পাবে।

ধুপ করে উঠে বসে মুহতাসনিম।অভিমানি মুখ চলে যেতে নিলেই পেছন থেকে খপ করে হাত ধরে ফেলে জাহিন।চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,

” আমি কি যেতে বলেছি?

পরক্ষণে টেনে কাছে নিয়ে আসে।দুহাত কটিদেশ স্পর্শ করে বলে,

“তোমাকে দূরে ঠেলে দিলে যে সবচেয়ে বড় শাস্তি আমার পাওয়া হবে মুহু!

চোখ গোলগোল করে ডাকায় মুহতাসনিম।সর্বাঙ্গ তার শিহরিত হয় অজানা অনুভূতি তে!লজ্জায় তাৎক্ষণিক চোখ নামায়।ফের থুতনিতে হাত রেখে মুখ টা উঁচু করে জাহিন।মুহূর্তেই জাহিনের ওপর ঢলে পরে মুহতাসনিম!মৃদু ভয় পেয়ে যায় জাহিন।খেয়াল হতেই দেখে জ্ঞান হারিয়েছে মুহু!

চলবে……৷

#মেঘবতীর_শহরে
সমাপ্ত
নাদিয়া ইসলাম সানজিদা
,
,

আটতলা ভবনের উপর বিলাসবহুল এক রেস্তোরাঁয় মুখোমুখি বসে আছে মুনা আর রিশান।চারিদিকে খোলামেলা রঙবেরঙের আলোকরশ্মি ছড়িয়ে।চাকচিক্যে মোড়া গোটা শহর।বেশিরভাগ টেবিল জুড়েই কপোত-কপোতী।ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার করে রিশান।পরক্ষণে মুনার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,

“আর ইউ ওকে?

মুনা কেবল নিশ্চুপ মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বলে।মেয়েটাকে নিতান্তই চুপচাপ আর সরল মনে হয়েছে রিশানের।প্রয়োজনের বাইরে একটা টু শব্দটুকু নেই!গলা খানিক খাঁকারি দিয়ে বলে রিশান,

” আপনি কি এখনও মানসিক ভাবে প্রস্তুত নন বিয়ে করার জন্যে?দেখুন আপনার জীবন আপনার সিদ্ধান্ত।আমি কখনই এই নিয়ে নিজের মতামত চাপাবো না।আপনি মুক্ত আর স্বাধীন।কারো জিম্মায় নন।সুতরাং স্বাভাবিক হয়ে আপনার উত্তর জানাতে পারেন।

মুনা এবার খানিকটা নড়েচড়ে বসে।গ্লাস টা নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নেয়।সামনে থাকা রিশানের দিকে দৃষ্টি ফেলে বলে,

“আমাকে একটা কারণ বশত এখানে পাঠানো হয়েছে।এবং দ্রুত এই কার্যক্রম হোক সেটাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।মানে বিয়ের কথা বলছি আমি।আসলে আমি মন থেকে চেয়েছিলাম কিছুটা সময় নিতে।অবশ্য এখানে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই আমার।বিষয়টা কি আমি বোঝাতে পেরেছি?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে রিশান।ছোট্ট মেয়েটার বুদ্ধিমত্তার তারিফ করতে হয়।কৌশলে কি সুন্দর করে গুছিয়ে বলে দিলো কথাটা।ছোট্ট একটা শ্বাস ছেড়ে বলে রিশান।

” আমি তো বরাবরের মতো বলেছি আপনি মুক্ত বিহঙ্গ।আপনি চাইলে আপনার ডিসিশন পাল্টাতেও পারেন।আমি এতে হস্তক্ষেপ করবো না।

“একটা মানুষকে জানার জন্যে নূন্যতম একটা সময়ের প্রয়োজন হয়।যতই হোক সারাটাজীবন একসাথে কাটানোর কথা হচ্ছে।আপনি না হয় আরেকটু ভালো ভাবে জেনে নিন আমার ব্যাপারে।হতে পারে জোরপূর্বক আপনাকে এ বিয়েতে মত দেওয়ানো হয়েছে।আমাদের পরিচয় কেবল কদিনের।

মুনার কৌশলগত কথা পদে পদে মুগ্ধ করে রিশানকে।এই মেয়ের অদম্য শক্তি তাকে একদিন বহুদূর নিয়ে যাবে।সে সময় বোধহয় বেশি দূরে নয়।শুধু দরকার একটুখানি সঠিক সাপোর্ট!তবে এটা বেশ কৌশলে রিশানকে বুঝিয়ে দিয়েছে মুনা।খাবার সামনে পরিবেশন হতেই মুনাকে এগিয়ে দিতে দিতে বলে রিশান,

” ভবিষ্যতে কিছু হবার ইচ্ছে আছে নাকি?অবশ্য এখনও খুব ছোট আপনি।

খাবার সামনে নিয়ে বলে মুনা,

“সবটাই সময়ের ব্যাপার।বর্তমান সুযোগ সুবিধা বলবে আমার ভবিষ্যৎ।চাইলে নিজের মতো করেও ভবিষ্যত গড়া যায়।

” কিছু হবার ইচ্ছে আছে আপনার?আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।

খানিকটা খাবার মুখে পুরে বলে মুনা,

“স্বপ্ন সবারই থাকে রিশান সাহেব।তা পূরণ বা বাস্তবায়নে দরকার সঠিক একজন মানুষ।আপাতত আমি আপনাকে জানি।সঠিক মনে হলে তবেই আমি স্বপ্ন পূরণের দিকে এগোবো।

বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না রিশান।তবে ভাইয়ের জন্য মন থেকে একপ্রকার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলো।তার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার বুঝি মুহতানিম ছিল।এত সুন্দর চিন্তাভাবনার একটি মেয়েকে কি করে আপন না করে থাকা যায়?রিশানের এলোমেলো জীবণ টা ঘোছানোর চাবিকাঠি যে এই মেয়ের হাতেই!চুপচাপ খাওয়ায় মনোযোগী হয় রিশান।

~~~

হসপিটালে মুহতাসনিম কে নিয়ে বসে আছে জাহিন।খানিক্ষন আগে কিছু টেস্ট করিয়ে বের হয়েছে।তার রিপোর্ট পাবে একটুপর।মুহতাসনিমের ভয়ার্ত চুপসে যাওয়া মুখোপানে তাকিয়ে হাসি পাচ্ছে জাহিনের।কাল রাতে যখন মেয়েটা হুট করে জ্ঞান হারিয়েছে কলিজা ভয়ে কেঁপে উঠেছে জাহিনের।ইদানিং শরীর টাও নাকি ভালো যাচ্ছে না।খানিকটা সন্দেহ বশত মুহতাসনিম কে নিয়ে একপ্রকার হসপিটালে এসেছে জাহিন।
নবনী ইতিমধ্যে বারকয়েক কল করে ফেলেছে।মেয়েটার শরীরের অবস্থা জানার জন্যে যেন মরিয়া তিনি।

জাহিনের ডাক আসলে মুহতাসনিম কে রেখে ভেতরে যায়।ফাইল হাতে নিতেই অজানা কারনে বুক ধ্বুক ধ্বুক করছে!জাহিনের ভাবনাই কি তবে সত্যি হবে?হাত বুঝি মৃদু কাঁপছে!গণ্ডস্থল শুকনো অনুভূত!ফাইলটা খুলেই ইংরেজি লেখাগুলোতে চোখ বুলায় জাহিন।যা আন্দাজ করেছিল ঠিক তাই!মুহূর্তে চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে জাহিনের।বাবা হওয়ার অনুভূতি বুঝি এত মধূর হয়!ভেতরে এক সাগর পরিমান তোলপাড় নিয়ে এলোমেলো পা ফেলে মুহতাসনিমের কাছে আসে জাহিন।অস্থির মুহু উঠে দাঁড়ায়।জাহিনের গালে হাত রেখে বলে,

“আপনি কাঁদছেন কেন ডাক্তার?

হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছে মুহতাসনিমের কপালে ওষ্ঠ ছোঁয়ায় জাহিন।বুকের মধ্যিখানে ঝাপটে ধরে।খানিকটা ইতস্তত ভাব নিয়ে বলে মুহতাসনিম,

” আশেপাশে লোক আছে।

সেদিকে তোয়াক্কা নেই জাহিনের।ভেজা কন্ঠে কেবল বলে,

“পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুখনুভূতি তুমি আমায় দিয়েছো মুহু।এবার হয়তো গোটা পৃথিবী জানবে বাবার ভালোবাসা কত সুন্দর কত স্নিগ্ধ আর মায়াভরা হয়!সব বাবারা স্বার্থপর হয় না মুহু!আমি তার প্রমান রেখে যাবো।

জাহিনের বুকে ফুপিয়ে কেঁদে উঠে মুহতাসনিম।পৃথিবীর সর্বসুখ যে আজ তাকেও স্পর্শ করেছে!জাহিনের প্রতিটি কথা যেন শ্রুতি মধূর লাগছে।আশেপাশে অনেকেই এই দম্পতিদের খেয়াল করছে।কেউ বা বিস্ময় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে।সে দিকে ভ্রুক্ষেপ নেই কারোই।

~~~

ধোঁয়াসা নীলাভ আকাশ।সন্ধ্যে গনিয়েছে।মায়ের কাছে খুশির খবরটা জানাতে এসেছে নবনী।রেহানা বেগম খুশিমনে পান চিবুতে চিবুতে বললেন,

” তাইলে সবার আগে জাহিনের সন্তানের মুখ দেখমু?মেলা খুশি হইছি আমি।

শায়লা বেগম পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।বলার মতো কোনো ভাষা তার মুখে নেই।এখন আর মন খুলে নবনীর সাথে কথা বলা হয় না।রিতা বেগম সেদিনের পর বাবার বাসায় চলে গেছেন।এ বাড়ির মুখোমুখি হননি আর।নবনীর বিশ্বাস হয়তো কোনো একদিন রিতার এই রাগ জেদের অবসান ঘটবে।

যাওয়ার সময় অনেক বার মাকে সাথে যাওয়ার জন্যে বলেছে নবনী।নাখোশ করে দেন রেহেনা বেগম।একেবারে জাহিনের ছেলেপুলে হলে যাবেন জানান।অগত্যা কথা বাড়ায়নি নবনী।মন ভার নিয়ে নিশ্চুপ বিদায় নেয়।

~~~

রাতের আকাশে তারাদের ভীড়।এককোণে অর্ধআকৃতির চাঁদখানা জ্বলজ্বল করছে!আবছা রূপোলি আলো চারিপাশ।দোলনায় পা নামিয়ে বসে আছে মুহতাসনিম।মেঝেতে বসে মুহতাসনিমের কোলে মাথা রেখে পেটের কাছে মুখ গুঁজে আছে জাহিন।কত সহস্রবার চুমো খেয়েছে হিসেব নেই!জাহিনের এই ছোট খাটো মিষ্টি পাগলামি গুলো বেশ উপভোগ করছে মুহতাসনিম।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি ভরা গালে হাত বুলিয়ে বলে মুহতাসনিম,

“কালকে তো আপনার ছুটি শেষ।সকাল সকাল যেতে হবে।ঘুমাবেন না?

দুদিকে কেবল মাথা নেড়ে না বলে জাহিন।মৃদু শব্দ করে হাসে মুহতাসনিম।জাহিনের চুলে আঙ্গুল চালিয়ে বলে,

” বাচ্চাদের মতো পাগলামি শুরু করেছেন।

কোল থেকে মাথা তুলে বলে জাহিন,

“পাগলামি কিছুই করিনি মুহু।শুধু আমাদের সন্তানকে সুস্থ রূপে দুনিয়ায় ভূমিষ্ট হতে দাও তখন নয়তো দেখো পাগলামি।

চোখদুটো জলে ভেসে ওঠে মুহতাসনিমের।তৎক্ষনাৎ ওঠে মুহতাসনিমের পাশে বসে জাহিন।চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়ে বলে,

” একদম কান্না করা যাবে না।শরীরের পুরোপুরি যত্ন নিতে হবে।মনে রেখো এখন তোমার মাঝে ছোট্ট একটা অস্তিত্ব বেড়ে উঠছে!

কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বলে মুহতাসনিম,

“মায়েরা আমার যত্নের কোনো কমতি রাখবে না এটা নিশ্চিন্ত থাকুন।

মুহূর্তেই জাহিনকে ঝাপটে ধরে মুহতাসনিম।কান্নারত কন্ঠে বলে,

“আপনি একজন দায়িত্বশীল স্বামী।আমি জানি পিতার দায়িত্ব এতটুকুও ক্ষুন্ন হবে না আপনার দ্বারা।শুধু এতটুকুই বলবো এভাবেই ভালোবেসে যাবেন আমাদের আমৃত্যু অব্ধি!

দুহাত দিয়ে মুহতাসনিম কে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিয়ে বলে জাহিন,

” এ যে ভয়ংকর মায়া মুহু!আজ থেকে মায়া যে দ্বিগুণ হয়ে হয়ে গেছে।দেহ থেকে প্রান আলাদা হবার আগ পর্যন্ত এ মায়া কাটবার নয় মুহু।ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।আমার ছোট্ট মায়া জড়ানো মেঘবতীর শহর টা বুকের মাঝে খুব যত্নে পুষে রাখতে চাই আজীবন!

ভেজা কন্ঠে হেচকি তুলে কাটা কাটা শব্দে বলে মুহতাসনিম,

“ভা-লো-বা-সি।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here