সিনেমাটিক #পর্ব–২৬(অন্তিম পর্ব)

0
582

#সিনেমাটিক
#পর্ব–২৬(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_ইসরাত_বিনতে_ইসহাক

এভাবে সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেল, কিন্তু আমার মরণ হলো না।এসব কিছুর প্রতিশোধ নিতেই হয়তো আমি বেঁচে আছি……

আমি চমকে বললাম, কিসের প্রতিশোধ চাচা?

আরিফ চাচা:-আমার মেয়ের সাথে যে অন্যায় করা হয়েছিল, তার প্রতিশোধ। আমিও ওর থেকে ওর প্রিয় জিনিস কেরে নিব।

আমি:-কি অন্যায় করা হয়েছিল সামিয়ার সাথে?

এদিকে জায়ান বাসায় এসে সেই কখন থেকে কলিং বেল বাজিয়ে যাচ্ছে, অথচ কেউ দরজা খুলার নাম ই নিচ্ছে না।আর কলিং বেল এর শব্দ শুনলে তো খুলবে, কারণ কলিং বেল এর সুইচ তো অফ করে রাখা হয়েছে,তাই নাজিফা কলিং বেল এর শব্দ শুনতে পাচ্ছে না।আর আরিফ চাচার কথা আপাদত নাই বা বললাম।

আরিফ চাচা:-সামিয়ার বান্ধবীদের থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সামিয়া একটা ছেলে কে খুব ভালোবাসতো। কিন্তু ছেলে টা বরাবরের মতো সামিয়া কে রিজেক্ট করে আসছে। সামিয়া মে কলেজে পড়াশোনা করতো ঐ কলেজের পাশেই এক ভার্সিটিতে পড়তো ছেলে টা, অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। সামিয়া নাকি প্রায়ই ছেলেটার সাথে দেখা করতে যেত, কিন্তু ছেলে টা সব সময় এরিয়ে যেত।তো একদিন ভার্সিটি ক্যাম্পাসে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে ছেলে টা সামিয়া কে অনেক অপমান করে যার ফলে আমার মেয়ে টা অপমানে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। আমি জানি ঐ ছেলের বিরুদ্ধে কেইস করা যাবে না কারণ জোড়ালো প্রমান নেই আমার কাছে তার উপর অনেক ধনী পরিবারের ছেলে, পুলিশ টাকা খেয়ে কিছুই করবে না।

সবটা বলে চাচা কান্নায় ভেঙে পড়েন, আমার ও খুব কষ্ট হচ্ছে সামিয়া মেয়েটার কথা ভেবে।তাই মুখে দুহাত দিয়ে চোখের পানি ফেলে চলেছি।

এর আনুমানিক পাঁচ মিনিট পর,কারো দৌড়ে আসার শব্দ শুনে হাত হাত সরিয়ে তাকালাম।আর তাকিয়ে যা দেখলাম তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। আমার রীতিমত ভয়ে কাঁপতে লাগলাম।

কারণ,,,,
আরিফ চাচা আমার দিকে ছুরি তাক করে রেখেছেন,আর জায়ান আরিফ চাচার হাতে ধরে আছে। ছুরি টা আর আমার মধ্যে অল্প কিছু দূরত্ব।

(পুলিশ মিস নীলিমা নিলা কে খুঁজে বের করে গ্রেফতার করে এবং মিস নীলিমা নিলার শিকারুক্তিতে জানা যায় আরিফ জামান এই সব করিয়েছেন টাকা খাইয়ে।সব কিছু শুনে জায়ানের যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না আরিফ চাচার মতো মানুষ এরকম করতে পারে। তারপর যখন মনে পরলো নাজিফা বাসায় একা আছে,তাও আবার সাথে আরিফ জামান আছে তখনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে অফিস থেকে, পথে অনেক বার নাজিফা কল করে কিন্তু নাজিফা কল রিসিভ করে না,যার ফলে জায়ানের দুশ্চিন্তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।আর কথা টা মনে হতেই দৌড়ে বের হয়ে চলে আসে জায়ান যার ফলে পুলিশ টিম কে বলা হয়নি যে তার বাসায় এরকম বিপদ।তাই আসতে আসতে পুলিশ টিম কে ও বলে দেয় তার বাসায় চলে আসার জন্য।

তারপর বাসায় পৌঁছে যখন কেউ দরজা খুলছে না দেখে, জায়ান আর সময় নষ্ট না করে,পাইপ দিয়ে উঠে,মেজ ভাবির রুমের বেলকনি দিয়ে ডুকে। তারপর কি হলো তা তো জানেন,,,,,,)

তারপর জায়ান চাচা কে মেরে ছুরি টা ফেলে দিল,পরে চাচা আর জায়ানের মধ্যে লেগে গেল সংঘর্ষ। আমি কিছুই বুঝতে পারছি না চাচা আমাকে কেন মারতে চান? আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না চাচা আমার কোন ক্ষতি করতে পারেন!! এদিকে উভয় উভয়কেই মেরে চলেছে, তবে জায়ানের শক্তির সাথে পেরে ওঠছে না।যার ফলে চাচা একটা ফুল দানি হাতে তুলে নিলো এবং আবার ও আমাকে মারার জন্য উদ্যত হলো, তখন কারো দরজা ধাক্কানোর শব্দ শোনা গেল। শব্দ শুনে জায়ান বললো নাজিফা তারাতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দাও, এদিকে জায়ান চাচাকে চেপে ধরে রেখেছে। তারপর আমি কোন রকমে গিয়ে দরজা খুলে দিতে পুলিশ টিম ডুকে চাচাকে গ্রেফতার করলো।

তারপর চাচা জায়ান কে উদ্দেশ্য করে বললেন, আমি তোর থেকে তোর প্রিয় জিনিস কেরে নিব‌ই যে ভাবে তুই আমার থেকে নিয়েছিলি।
চাচার কথা শুনে জায়ান খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি বলছেন এসব? আপনার কি কেরে নিয়েছি আমি?

আরিফ চাচা:-আমার মেয়ে কে কেরে নিয়েছিস তুই। তোর কারণে আমার মেয়ে সামিয়া জামান আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিল। আমার মেয়ে তোর করা অপমান সহ্য করতে পারেনি যার জন্য,,,

চাচা আর বলতে পারলেন না কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তারপর পুলিশ চাচা কে থানায় নিয়ে গেল।

সবাই চলে যেতে আমি জায়ান কে বললাম, একটা মেয়ে তোমাকে পছন্দ করতেই পারে,ভালোবাসতেই পারে তাই বলে তুমি লোকজনে বরা ক্যাম্পাসের মাঝে মেয়েটাকে অপমান করবে? তুমি এটা ঠিক করোনি জায়ান, একদম ঠিক করোনি। শুধুমাত্র তোমার কারণে একটা পুরো পরিবার ধংস হয়ে গিয়েছে। এরকম টা না করলেও পারতে।জায়ান কে এগুলো বলে, আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম।জায়ান পিছন থেকে ডেকে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু আমি শুনলাম না, রুমে এসে দরজা লাগিয়ে বেডে শুয়ে পড়লাম, আমার খুব খারাপ লাগছে। সামিয়া মেয়েটার জন্য যেমন খারাপ লাগছে ঠিক তেমন শরীর ও খুব খারাপ লাগছে।

প্রথমে পেটের ব্যাথা অল্প হলেও ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যাচ্ছি আর বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছি। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার আর সহ্য করতে না পেরে খুব কষ্ট করে বেড থেকে নেমে দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম, মনে হচ্ছে আমি পরেই যাবো।তার পর ও দরজা টা কোন রকম খুললাম কিন্তু জায়ান কে ডাকার মতো শক্তি পাচ্ছি না। নিচে বসে ব্যাথায় ছটফট করতে লাগলাম, তার পর যখন ব্যাথা আর বেরে গেল তখন চিৎকার দিয়ে কাঁদতেই জায়ান দৌড়ে এলো।এসেই বললো নাজিফা তোমার কি হয়েছে? আমি পেটে হাত রেখে কাঁদছি দেখে জায়ান বুঝতে পারলো আমার পেইন শুরু হয়ে গেছে।তাই কামরুল ভাইকে কল করে গাড়ি ঠিক করতে বললো। তারপর খুব কষ্ট করে আমাকে লিফ্টে নিয়ে গিয়ে, নিচে নামালো। তারপর আমাকে গাড়িতে ওঠাতে কামরুল ভাই সহ সাহায্য করলো।

তারপর হসপিটালে নিয়ে গেলে ডক্টর বললেন ইমার্জেন্সি সিজার করাতে হবে। তারপর যখন সব কিছু ঠিক করে আমাকে ওটিতে নিয়ে যাবে, তখন আমি
জায়ানের হাত টা শক্ত করে ধরে রাখি।জায়ান কে বুঝাই আমার সাথে যাওয়ার জন্য কিন্তু ডক্টর রা কিছুতেই রাজি হলেন না।তাই জায়ান আমাকে অনেক বুঝিয়ে পাঠালো ওটিতে। আমার খুব ভয় হচ্ছে, ওটিতে ডুকে, চারিদিকে বিভিন্ন মেসিন,যন্ত্রপাতি এগুলো দেখে আরো ভয় করছে। তারপর আমাকে একটা ইনজেকশন পুশ করা হলো,যার ফলে আমার অর্ধেক অবশ হয়ে গেল। তারপর ডক্টর রা তাদের কাজ করতে শুরু করলো। আমি সবকিছু দেখছি কিন্তু কিছুই বলতে পারছি না। একজন ডক্টর আমার সাথে বিভিন্ন কথা বলে চলেছেন যাতে করে আমি ঘুমিয়ে না পরি।

এদিকে জায়ান নিজের পরিবারের লোকজন এবং শশ্বুর বাড়ির লোকজন কে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। তারপর আল্লাহ তা’আলা কে ডেকে চলেছে।

আর ভাবছে সেই ভার্সিটি লাইফের কথা। একটা মেয়ে খুব পাগলামি করতো জায়ন কে নিয়ে, মেয়ে টা দেখতে বেশ সুন্দরী ছিল। গায়ের রঙ যেন দুধে আলতা ফর্সা ছিল। কিন্তু জায়ানের এই পাগলামো একদম ভালো লাগতো না,জায়ানের মনোভাব সবসময় এটাই ছিল যে কোন মেয়ের সাথে কখনো প্রেম নামক অবৈধ সম্পর্কে জড়াবে না। যখন সময় হবে তখন বিয়ে করে নিবে। এদিকে সামিয়া মেয়েটার পাগলামি দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রতিদিন জায়ানের সাথে দেখা করতে আসা,জায়ান কে ভালোবাসি বলা, আরো কতো কি। এগুলো তে জায়ান খুব বিরক্ত ছিল তার উপর জায়ানের বন্ধুরা খুব হাসি ঠাট্টা করতো।তাই একদিন রেগে গিয়ে অনেক কথা শুনিয়ে দিয়েছিল যাতে করে মেয়েটা এরকম পাগলামি আর না করে। ঠিক তাই হয়েছিল,ঐ দিনের পর মেয়েটাকে আর কখনো দেখতে ও পায়নি জায়ান। প্রথম প্রথম মেয়েটার কথা মনে পরলেও ধীরে ধীরে মেয়েটার কথা ভুলে যায় জায়ান। কিন্তু জায়ান তো ইচ্ছে করে কিছু করেনি বা মেয়েটা আত্মহত্যা করুক এরকম টা ও কখনো চায়নি।

এসব ভাবতে ভাবতেই ওটির দরজা খুলে একজন নার্স তাওয়ালে জড়িয়ে একটা ফুটফুটে শিশু কোলে করে নিয়ে এলো জায়ানের কাছে।আর বললো মি.জায়ান আপনার ছেলে বেবি হয়েছে। এবার বকশিশ দিন, তারপর জায়ান পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে নার্স কে দিলো।আর বললো আমার স্ত্রী কোথায়?ও কেমন আছে? তখন নার্স বললো উনি ভালো আছেন, কিছুক্ষণ পর উনাকে কেবিনে শিফ্ট করা হবে।

তারপর আলহামদুলিল্লাহ বলে জায়ান তার ছেলে কে খুব সাবধানে কোলে তুলে নিলো।জায়ান বেবি কে কোলে তুলে নিতেই, বেবি বড় বড় চোখে জায়ান কে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে চলেছে। ঠিক মায়ের মতো বড় বড় চোখ পেয়েছে বেবি। খুশিতে জায়ানের চোখে পানি চলে এলো। তারপর জায়ান তার ছেলের কানের কাছে আযান দিল। আযান দেওয়া শেষে আলতো হাতে নিজের ছেলের হাত,পা,গাল এবং চুল গুলো ছোঁয়ে দিতে লাগলো। শেষে কপালে চুমু এঁকে দিল।আর বেবি তার পাপা কে দেখতে ব্যাস্ত।

তার কিছুক্ষণ পর জায়ানের পরিবারের লোকজন চলে আসে।জায়ানের কোলে বেবি কে দেখে সবাই খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।জায়ানের মা কোলে তুলে নেয় উনার নাতি কে। তারপর নাজিফা কে কেবিনে শিফ্ট করা হলে প্রথমে জায়ান নাজিফার কাছে যায় আর নাজিফার কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে কেমন লাগছে এখন?

জায়ানের প্রশ্নে আমি বললাম, ভালো তবে একটু ব্যাথা করছে। আমার কথা শুনে জায়ান নার্স কে ডক্টর ডাকতে বললো, কিন্তু নার্স বললো এখন এরকম একটু ব্যাথা করবেই এটা স্বাভাবিক। তারপর বেবি কে আমার কাছে নিয়ে আসে বড় ভাবি, এতো কষ্টের মাঝে ও বেবি কে দেখে আমার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সবাই বললো বেবি নাকি আমার মতো হয়েছে দেখতে, এতে জায়ান খুব খুশি কারণ তার কারেজের মতো হয়েছে ছোট কারেজ।
____________

এর তিন দিন পর,
আমাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হলো। তারপর পাঁচ দিনের বেলা ছোট কারেজের নাম আমার নামের সাথে মিলিয়ে রাখা হলো_
“নিয়ায রহমান নূর”।নিয়ায রেখেছেন ওর বুবু আর নূর রেখেছে জায়ান। দুইটা নাম ই সবাই খুব পছন্দ করে। সবাই ঠিক করে নূর বলেই ডাকবে সবসময়।
আমার পরিবারের সবাই এসে দেখে গেছে নূর কে প্রথম বার দেখে নূরের নানা ভাইয়া নূর কে গোল্ডের চেইন উপহার দিয়েছে, আমি বললাম কি দরকার এগুলো দেওয়ার তখন আম্মু বলে প্রথম মুখ দেখে নানুর বাড়ী থেকে দিতে হয়।
শুধু তাই নয় নূরের খালামনি আর আংকেল ডায়মন্ডের রিং পরিয়ে দেয় নূর কে।

তারপর,,
তারপর সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে, আল্লাহ তা’আলার রহমতে সুখে শান্তিতে দিন কাটাতে লাগলো নাজিফা, জায়ান আর তাদের ছোট্ট কারেজ নূর।

? সমাপ্ত ?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here