ভালোবাসি_প্রিয়_তোমাকে পর্বঃ ০২

0
519

গল্পঃ #ভালোবাসি_প্রিয়_তোমাকে
পর্বঃ ০২
নিঝুম জামান (ছদ্মনাম)

ওনার মত মানুষের মুখে আমার সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। তাকে কিছু বলব এমন সময় দেখি মা আসছে। তাড়াতাড়ি তার থেকে থেকে চলে এলাম। এর আগে নিষান ভাইয়ার কারণে কত কাহিনি হয়েছে! এখন আবার উনার সাথে দেখলে ঝামেলা হতে পারে
মা কাছাকাছি আসতেই মা আমাদের বলল,

‘ তোরা তিনজন এখানে কি করছিলি? ওখানে সবাই ভিডিও করছে। লিজা তোদের খুঁজছে, মিমকে স্টেজে আনবে তোরা চান্দিনা ধরবি সেজন্য। তাড়াতাড়ি যা।’

‘হুম মা, সেখানেই যাচ্ছিলাম।’

মা চলে যেতেই রিমি-তিন্নি আমাকে ঘিরে ধরল, দুজনের একপ্রশ্ন,

‘নিরাপু, নিষান ভাইয়া তোমাকে কি বলছিল? তোমার হাত ধরে? তোমাকে কি সে পছন্দ করে?’

ওদের কথা শুনে আমার মেজাজটা বেশ খারাপ হলো। ওদেরকে বললাম, তার আগামী শুক্রবার বিয়ে। আমার হাত ধরে তিনি বিয়ের দাওয়াত দিচ্ছিল। আমার সাথে তোরা যাবি তার বিয়ে খেতে?’

‘আহ, নিরাপু মজা করো না। বলো না কি বলেছে?তুমি তার কাছে আমার কথাটা বলেছো? (রিমি)

‘শোন রিমি, বড়বোন হিসেবে তোকে একটা ভালো উপদেশ দেই। নিষান ভাইয়ার কথা বাদ দে। তুই তার যেই রূপ দেখে পাগল হচ্ছিস সেই রূপ দেখে বহু মেয়ে তার ওপর ক্রাশ খেয়েছে। আর বহু ক্রাশ খাওয়া ছেলেদের হাজারটা গার্লফ্রেন্ড থাকে। এদের ক্যারেক্টারে প্রবলেম থাকতে থাকতে পারে। তাই বলছি কি…

আমার কথা শুনে রিমি কেমন জানি ক্ষেপে গেল। সে কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠল,

‘সব ছেলেরা একরকম হয় না নিরাপু। আমার ক্রাশকে নিয়ে আর একটাও বাজে কথা শুনতে চাই না। তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই। আমি গেলাম।’
বলে রিমি তেজ দেখিয়ে তিন্নিকে সাথে নিয়ে চলে গেল। আমি আটকাতে চেয়েও পারলাম না।
.
.
গায়ের হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত দুটো বাজল। অনেক হৈ-হুল্লোড় করেছি। তবে পুরো হলুদের অনুষ্ঠান জুড়ে একটা জিনিস খেয়াল করেছি সেটা হচ্ছে নিষান ভাইয়ার দিকে যতবার তাকিয়েছি ততবারই দেখেছি তিনি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ব্যাপারটাতে আমার বেশ অস্বস্তি লেগেছে।

বিয়ের দিন সকালে বড়রা সবাই মিমআপুকে হলুদ লাগিয়ে গোসল করাচ্ছিল। আর ছোটরা মানে আমাদের বয়সী সবাই রং খেলা, কাঁদা ছোড়াছুড়ির প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমার রং খেলার ইচ্ছা ছিল না তাই
উঠানের পাশে বড় দিঘীর পাড়ে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে রইলাম।
বলা যায় রং খেলা, কাঁদা ছোড়াছুড়ির হাত থেকে লুকিয়ে রইলাম। কারণ দিঘীর এপাশটায় কেউ তেমন আসে না। মনের সুখে বসে বসে গান গাইছিলাম।

‘সাত সাগর আর তেরো নদী,
পার হয়ে তুমি আসতে যদি।
রূপকথার রাজকুমার হয়ে
আমায় তুমি ভালোবাসতে যদি।’

বেশ জোরে জোরেই গান গাইছিলাম। হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ‘ভালোবাসার জন্য একেবারে রূপকথার রাজকুমারকেই লাগবে? সাধারণ মানুষ কি ভালোবাসতে জানে না?’

‘না, জানে না।’

পিছনে তাকিয়ে দেখি নিষান ভাইয়া। তার কথা শুনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গান গাওয়া বন্ধ করে দিলাম।
কে বলবে তাকে এসময় এখানে আসতে। আমার গান গাওয়ার মুডটা নষ্ট করে দিল।

‘আরে গান গাওয়া বন্ধ করলে কেন? গানের গলা তো ভারি চমৎকার! ‘

আমি কোন উত্তর দিলাম না। উনি আবারও বলে উঠলেন,
‘এখন এখানে বসে আছো? ওইদিকে তো সকলে
রং খেলছে, কাঁদা ছোড়াছুড়ি করছে। ‘

‘আমি খেলব না। এর আগেরবার কাঁদা মাখিয়ে আমার অবস্থা নাজেহাল ছিল তাই এখানে বসে আছি। আপনি রং খেলছেন না কেন?’

‘ আমিও খেলতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি তুমি নেই। তাই তোমাকে খুঁজতে এখানে চলে এলাম। তোমার মত সুন্দরী একখানা বেয়াইন থাকতে একা একা কি রং খেলা, কাঁদা ছোড়াছুড়ি করা জমে?’
বলে উনি একটা বাঁকা হাসি দিলেন।

নিষানের কথা শুনে নিরা ওর দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘মানে?’

নিষান হাত দিয়ে শিষ বাজাতেই দিঘীর পাড়ের গাছগুলো পেছন থেকে লুকিয়ে থাকা বাড়ির সব রংখেলা পাব্লিকগুলো বেরিয়ে এলো। ওদের একেকজনকে বানরের সাথে তুলনা করলেও কম হবে। কালি,রং, কাঁদা সব মেখে ভুত সেজে আছে। ওদের দেখে আমি দৌড় দিয়ে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তার আগেই নিষান ভাইয়া রঙে ভরা বালতি আমার ওপর ঢেলে দিল এরপর অন্য বালতিতে থাকা কাঁদাপানিও গাঁয়ে ঢেলে দিল। আমার এত সুন্দর স্ট্রেট করা চুল থেকে কীভাবে কাঁদা পরিষ্কার করব ভাবতেই মেজাজটা যা খারাপ হলো তা বলার বাইরে। সব থেকে বেশি রাগ
হলো নিষান ভাইয়ার ওপর। এজন্যই বলে দুষ্ট লোকের মিষ্টি কথায় ভুলতে নেই। ওনার সাথে কথা বলাটাই আমার ভুল হয়েছে।
তবে আমিও কম না। নিষান ভাইয়াকে শরীরের শক্তি দিয়ে ধাক্কা মারলাম দিঘীর পানিতে। বেচারা নিজেকে বাঁচাতে চেয়েও পারল না সিঁড়িতে আছাড় খেয়ে পানিতে গিয়ে পড়ল। তার পানিতে পরা দেখে আমি আমি রাক্ষসীদের মত হাহাহা করে হেসে দিলাম।
কিন্তু আমার হাসাটা খুব বেশি স্থায়ী হলো না তার আগেই পিছন থেকে কেউ একজন আমাকেও ধাক্কা
দিল। ফলস্বরূপ আমিও গিয়ে পানিতে পড়লাম।
সাঁতার পারি না তাই দিঘীর পানি খেয়ে উঠলাম।
.
.
মিম আপুর বিয়েতে একটা লাল খয়েরী একটা গাউন পড়লাম সাথে গোল্ডেন হিজাব বাঁধলাম।
চুল থেকে ভালভাবে কাঁদা পরিষ্কার করতে পারি নি তাই চুল খুলি নি।
রিমি-তিন্নির সাথে গতকালের ঘটনার পর থেকে
আমার সাথে নেই। এখন আমার সঙ্গী বলতে
মাইশা আপু। কিন্তু সে কি আর ফ্রী মানুষ যে আমার সাথে কথা বলবেন? তার যে বয়ফ্রেন্ডের সাথে বলার জন্য কত কথা পেটে জমানো আছে সেটা একমাত্র তিনিই জানেন।
সারাদিন এটা ওটা করে করে নিজের মত কাটালাম।

সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পর মিম আপুকে বিদায়
দেওয়া হলো। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় বাড়ির সকলে কান্নাকাটি করছিল। তা দেখে আমার ভীষণ
হাসি পাচ্ছিল। মেয়ে নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে এখানে কান্নার কি আছে? বিদায় দিবে হাসিমুখে।

নিষান ভাইয়ার আম্মু-আব্বু আজকে এসেছেন। তার বাবার কাজের জন্য হলুদে আসতে পারেন নি। তাই বিয়েতে এসেছেন। তার মা অসুস্থ, তার যত্ন-আত্তি করতে আমার মা আমাকে নিয়োগ করেছেন।
প্রচন্ড গরম পড়েছে, তাই আন্টিকে শরবত বানিয়ে খাওয়ালাম। তার মাথা ব্যথা করছিল তাই হালকা মালিশ করে দিলাম।
আন্টি যথেষ্ট ভালো মানুষ।তার সাথে অনেকক্ষণ আড্ডা দিলাম। কথায় কথায় তিনি বলে উঠলেন,

‘ সত্যিই তুমি খুব লক্ষ্মী একটা মেয়ে। খুব সহজেই মানুষের সাথে মিশতে পারো।’

তার কথা শুনে আমি মুচকি হাসি দিলাম। তিনি আবারও বলে উঠলেন,
”ইশ! তোমার মত মিষ্টি একটা মেয়ে যদি আমার নিষানের বউ হতো! তা মা তুমি কোন ক্লাসে পড়?

আন্টি কথা শুনে আমি অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম ওনি কি আমাকে ওনার বজ্জাত বদরাগী পোলার বউ বানানোর
পরিকল্পনা করছেন নাকি?
‘নাহ্, এখানে থাকা আর উচিত হবে না। যাদের বড় ছেলে আছে সেই আন্টিদের সাথে কথা বলাই যাবে না। দেখা যাবে বাবা মায়ের কাছে আবার বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে।’ (মনে মনে)

শোনা যায় না এমন গলায় নিরা বলল,
‘আন্টি আমি অনেক ছোট মানুষ। আমি এবার ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।’

নিষানের মা আরও কিছু বলতে চাইছিলেন তার আগেই নিরা ‘বাইরে একটু কাজ আছে’ বলে সেখান থেকে চলে গেল।
.
রাত এগারোটা বেজে গেছে। নিষান ভাইয়ার মায়ের
ভয়ে রুমে আর যাই নি।। আমার মায়ের কোনো খবর নেই, খুবই ব্যস্ত মানুষ তিনি। নিজের আদরের ছোট ভাইজির বিয়ে বলে কথা। বিয়েতে কি কি উঠেছে সেগুলো মামা-খালামনিদের সাথে দেখছেন।অন্য সময় হলে আমার খবর রাখতে আরও পাঁচজন লোক নিয়োগ করত। রিমি,তিন্নি, আমার সাথে নেই। ওদের ক্রাশকে আমি পঁচিয়েছি তাই আমার সাথে ঝগড়া করে আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছে। মাইশা আপুও বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলতে ছাদে চলে গেছে। ।ইন্টারনেট কানেকশনও খুব লো তাই এই গভীর রাতে বাইরে বসে বসে বোর হওয়া আর মশার কামড় খাওয়া ছাড়া আপাতত কোনো কাজ নেই। এখন আমার সঙ্গী বলতে ক্লাস ফোরে পড়া এক ভাগ্নী আর টু-তে পড়া এক খালাতো ভাই। বাড়ির পাশেই মেলা বসেছিল ইদ উপলক্ষে। ইদ চলে গেলেও মেলা শেষ হয় নি। বাড়ি থেকে তাকালেই মেলা দেখা যাচ্ছে। মাঝখানে শুধু একটা বড় দিঘি। হঠাৎ আমার মনে হলো এখানে বসে মশার কামড় খাওয়ার চাইতে মেলায় ঘুরে আসা অনেক ভালো। বিয়ে বাড়ি তাই সব জায়গায় মানুষের সমাগম সাথে আলোকিত চারপাশ। ভয় কি আমাদের! বেশি কিছু না ভেবেই আমার সাথের দুটোকে বললাম,

‘কিরে ইকরা আর নাটবল্টু! মেলায় যাবি নাকি? কিছু কিনে দিতে পারব না। শুধু ঘুরব আর চিংড়ির মাথা ভাজা কিনে আনব। তোদেরও সেখান থেকে ভাগ দিব।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, যাব আপু। কিছু কিনে দিতে হবে না।’ বল্টু নাচতে কথাগুলো বলল। আমি বললাম, ‘চল তাহলে’
কিন্তু এরমাঝেই ইকরা আপত্তি জানালো।

‘খালামনি, এখন তো রাত হয়ে গেছে। রাতে মেলায় একা একা গেলে মা খুব বকবে।’

ওর কথা শুনে আমি বেশ রাগ হলো।রাগী সুরেই বললাম,
‘ বড়দের মত একদম পাকনামি মার্কা কথা বলবি না।একা কই? আমরা তো তিনজন আছি। তাছাড়া আমি তোর খালামনি। । তাছাড়া আমি কলেজে পড়ি, এখনো কি আমাকে তোর খুকি মনে হয়?

‘না, আসলে মা যদি বকে..

‘তোর মা জানলে তো বকবে। এখন চল। ‘

মনের সুখে আমরা মেলায় যাওয়ার জন্য রওনা হলাম। উঠান থেকে মেলা দেখা গেলেও রাস্তা দিয়ে যেতে হলে অনেকখানি রাস্তা পেরোতে হয়। মনের ভিতর একটু ভয় উঁকি-ঝুঁকি দেখা দিল। তবে অর্ধেক রাস্তায় যখন এসে পড়েছি তখন আর বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন আসে না। তিনজনে মেলায় ঘুরলাম। ভালোই লাগলো। একপাশে লটারির খেলা চলছে।
লটারির টিকেট দশ টাকা। একটা বল হাতে নিয়ে অপর প্রান্তের বোতলগুলোর একটাতে লাগাতে পারলে গিফট পাওয়া যায়। আমারও খেলতে খুব ইচ্ছে করল।কিন্তু সেখানে অনেক ছেলেদের ভীড়।
সেখান থেকে চলে আসার সময় হঠাৎ চোখে চোখ পড়ল রিমি-তিন্নিদের ক্রাশ মানে নিষান ভাইয়ার ওপর। এখানেও এই বজ্জাতের হাড্ডিটা। আমার দিকে কেমন রাগি চোখে তাকিয়ে আছে।যেখানে যাই, মোটকথা সেখানে এই বজ্জাতটার সাথে দেখা হয়। আর মাঝখান দিয়ে বিশাল বড় ঝামেলার সৃষ্টি হয়। নিষান ভাইয়ার সাথে তানভীরও আছে। তানভীরকে মাঝে মাঝে আমার মনে হয় নিষান ভাইয়ার খাস চামচা। যেখানেই নিষান ভাইয়া সেখানেই তানভীর। আবার নিষান ভাইয়াকে নিয়ে কিছু বললে তানভীর তেড়ে আসে। যাইহোক, নিষান ভাইয়াকে দেখে সেখান থেকে চলে আসলাম। কোনো ঝামেলা করতে চাই না।
এখন মূল টার্গেট হচ্ছে চিংড়ির মাথা ভাজা কিনে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে যাওয়া। মা যদি জানে এতো রাতে আমি মেলায় এসেছি তাহলে পিটিয়ে আমার শরীরের চামড়া তুলে ফেলবে। চিংড়ি মাছের দোকানে যাব তার আগেই একদল ছেলে সেখানে মারামারি লেগে গেল। সেই মারামারি দেখার জন্য আরও ছেলের ভীর জমে গেল। সব ছেলেদের মাঝখানে আমি দাঁড়িয়ে আছি। সাথের পিচ্চু দুটি নেই।শরীরে কেমন জানি অজানা ভয়ের শিহরণ বয়ে গেল। কোনমতে ছেলেদের ভীড় ঠেলেঠুলে বের হয়ে এককোনায় চলে এলাম । এরমাঝে চার-পাঁচটা ছেলে আমাকে টেনে একটা অন্ধকার ভাঙা দোকানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
অতিরিক্ত ভয়ে মুখ দিয়ে কোন কথা বের হচ্ছে না।
ওদিকে কেউ দু’পক্ষের মারামারি দেখতে ব্যস্ত ; আবার কেউ থামাতে ব্যস্ত। আমাকে যে ছেলেগুলো নিয়ে যাচ্ছে কেউই কিছু বলছে না। আমিও যে চিৎকার লোকজনের কাছে সাহায্য চাইব, সেইটুকু গলার স্বরও আসছে না।হঠাৎ করে….

#চলবে?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here