মনের নদী বেশি গভীর,১১,১২
আমিনা তাবাস্সুম
(১১)
নদী মেয়েটা এখনো ধীরে ধীরে ও আমাকে তার জীবনের গল্প বলে যাচ্ছে। একটু একটু করে। মাঝে মাঝে নিজে কিছু লিখে পাঠায় আবার মাঝে মাঝে ওর আর রিদওয়ান ভাইয়ের কথোকপথনের এক দুইটা স্ক্রিনশট পাঠিয়ে দেয়।
– নদী, নদী, নদী, নদী
– জি রিদওয়ান ভাই?
– তুমি আমার বউ হবে?
– আপনার বউ? আপনার তো স্ত্রী আছেই। আমি আবার আপনার বউ হবো কেমন করে?
– উফ, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারা যায়না। প্রশ্ন করলে শুধু পাল্টা প্রশ্ন করে বসে। বলো তুমি আমার বউ হবে কি হবেনা?
– সেটা কী করে সম্ভব? আমি কারো ক্ষতি করতে চাইনা। কারো সংসার ভাঙতে চাইনা। এই আমি বেশ আছি। আপনাকে দূর থেকে সারাটাজীবন এভাবে ভালোবেসে যাবো। আমার আর চাওয়া পাওয়ার কিছু নাই।
– এত কাহিনী শুনতে চাইনি তো। এক কথায় জবাব দাও। হ্যা অথবা না। নদী, তুমি আমার বউ হবে?
নদী চুপ।
রিদওয়ান ভাইও নাছোড়বান্দা। জবাব না শুনে কিছুতেই ছাড়বেনা। বলে উঠে,
– জবাব না দিলে ভেবে নিবো আমাকে তুমি ভালোই বাসোনা। শুধু তোমার সময় কাটানোর জন্য আমার সাথে কথা বলে যাচ্ছ।
– আপনার তা মনেহয়?
– মনেহলে তো তোমার সাথে কথা বলতাম না। কিন্তু মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, ভয় জাগে?
– কীসের ভয় রিদওয়ান ভাই?
– তোমাকে হারানোর ভয়।
– আমাকে হারানোর কোনো ভয় নাই রিদওয়ান ভাই। যার নিজের কোনো সত্তা নেই, যে শুধু আপনারই, তাকে হারাতে হলে আপনার নিজেকে হারাতে হবে আগে।
– তাহলে বলো, তুমি আমার বউ হবে?
কিছুক্ষনের নীরবতা, তারপর নদীর জবাব,
– আপনি চাইলে হবো। আপনি যা চাইবেন আমি তাই হবো।
– তাহলে আজ থেকে তুমি আমার বউ।
নদী কেন যেন এই কথায় খুশি হতে পারেনি। নদী কি ভেবেছিলো যে রিদওয়ান ভাই সত্যি সত্যি নদীকে বিয়ে করার চিন্তা করছে? রিদওয়ান ভাইয়ের নদীর প্রতি আকৰ্ষণ নিয়ে নদীর মনে কখনো সংশয় জাগেনি। কিন্তু নদীর বাইরে তো তার একটা বিশাল জগৎ আছে। ফেসবুকে ঢুকলেই তো নদী সব দেখতে পায়। সেই জগতে তিনি একজন আদর্শ স্বামী, দায়িত্ববান এবং সফল সাংবাদিক, প্রখ্যাত সমাজসেবী এবং সবার প্রিয় ব্যক্তিত্ব । সেই জগৎ ফ্যান-ফলোয়ারে পরিবেষ্টিত, স্তুতিবাক্যে মুখরিত। সেই জগতে রিদওয়ান ভাই শত শত নারীর হৃদয়ের সম্রাট। সেই জগৎ নদীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সেই জগৎ থেকে রিদওয়ান ভাই অতি সযতনে নদীকে লুকিয়ে রেখেছে। যেই জগতের ছোঁয়াটা পর্যন্ত যাতে নদীর না লাগে সেই ব্যাপারে রিদওয়ান ভাই অতি সচেতন। তা না হলে, নদীকে এই বন্দি জীবন থেকে বের করে নিয়েই তো তিনি অনায়াসে ওর সাথে প্রেম করতে পারতেন। সেটা তো তিনি করেননি।
এই ব্যাপারটা উপলব্ধি করার পরও নদী নিজেকে মুক্ত করার ব্যাপারে রিদওয়ান ভাইকে কখনো কিছু বলেনি। নদীর মনেহয়েছিলো, এভাবেই তো বেশ চলছে। যেই ভালোভাসা ও রিদওয়ান ভাইয়ের কাছ থেকে পেয়েছে, মুক্ত জীবনের লোভে সেই ভালোবাসা হারানোর পক্ষপাতী ও ছিলোনা। তারপরও বারবার যখন রিদওয়ান ভাই ওকে “বউ” বানানোর কথা বলা শুরু করেছিলো, নদীর মনের মধ্যে ঠিকই আশা জেগেছিলো। নদী ঠিকই স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। কিন্তু আজ এই দূরালাপনীর বার্তায় নদীকে এভাবে “বউ” এর আসনে বসিয়ে দিয়ে রিদওয়ান ভাই যেন ওর ক্ষীণ আশার প্রদীপটা এক ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে দিলো।
নদীকে চুপ দেখে রিদওয়ান ভাই বলে উঠেছিলো,
– কী হলো? আজ থেকে তুমি আমার বউ। তোমাকে আমার জীবনের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে আপন, সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ আসনে অধিষ্টিত করলাম।
– জি।
– জি মনে কী? আমি তোমাকে যেই আসনে বসালাম, তুমিও আমাকে সেই আসনে বসাতে হবে। তা না হলে তো আমাদের এই পরিণয় পূর্ণতা লাভ করবেনা।
– এভাবে মুখে মুখে আমি একটা কিছু বলে দিলে আমাদের বিয়ে হয়ে যাবে?
– মুখে মুখে একটা কিছু বললে হবেনা। মন থেকে বলতে হবে। তোমার ফাজিল স্বামী ফরিদ কী করেছে? লুকিয়ে লুকিয়ে একটা ছ্যাছড়া হুজুর ডেকে তোমাকে বিয়ে করেছে। ঐটা তোমার বিয়ে মনেহয়? নাকি আমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবেসে দুজনের সম্মতিক্রমে একে অপরকে স্বামী-স্ত্রী মেনে নেওয়াটা তোমার বিয়ে মনে হয়? তুমিই বলো?
নদী এর জবাব দেয়নি। শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো,
– আমাদের বিয়ে হলে কী লাভ হবে?
– লাভ ক্ষতির হিসেব দিতে তো আমরা বিয়ে করছি না। আমরা একে অপরকে ভালোবাসি তাই বিয়ে করছি। বিয়ের পর হয়তোবা আমরা হাত ধরাধরি করে দিগন্তে হেঁটে বেড়াবো, হয়তোবা গভীর রাতে বাঁধভাঙা জোছনায় স্নান করবো, পাহাড়ের ঢালে বসে তোমার এলোচুল নিয়ে আমি খেলবো, বালুকা বেলায় সমুদ্র দেখে মুগ্ধ হওয়া তোমাকে দেখে আমি মুগ্ধ হবো। বিয়ের পর আমি তোমাকে আরো আরো ভালোবাসবো। বিয়ের পর তোমার প্রেমে আমি নিজেকে বিলীন করে দিবো।
তারপর আরেকটু থেমে বলেছিলেন,
– এখন বলো, তুমি আমার কে?
– বউ।
নদীর বুকটা কেমন চিনচিন করে উঠেছিল। কেমন করে ওরা এসব করবে? কল্পনায়? নাকি লুকিয়ে লুকিয়ে? কল্পনায় হলে তো তাও চলে। কিন্তু আবার পালিয়ে, আবার গোপনে? যেমন নয়নের সাথে ও পালিয়ে গিয়েছিলো, যেমন ফরিদ সাহেবের ও গোপন স্ত্রী।
রিদওয়ান ভাই মনেহয় নদীর মনের অবস্থাটা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছিলেন। বলেছিলেন,
– নদী, নদী, নদী, নদী
– জি রিদওয়ান ভাই।
– তুমি দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার গল্প জানো?
– না তো
– দুষ্মন্ত আর শকুন্তলার কথা মহাভারতে আছে। তুমি তো একালের শকুন্তলা। অপরূপা, সুনিতম্বিনী, রূপযৌবনবতী শকুন্তলা মালিনী নদীর তীরে এক মুনি-ঋষির আশ্রমে একাকী বেড়ে উঠে। রাজা দুষ্মন্ত একবার বনে হরিণ শিকার করতে গিয়ে সেই আশ্রম খুঁজে পেয়ে শকুন্তলাকে দেখতে পায়। শকুন্তলার রূপ যৌবনে মুগ্ধ রাজা জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কে? এই বনের ভিতর কি জন্য বাস করিতেছ? আর কি করিয়াই বা এমন সুন্দর হইলে?”
এরপর শকুন্তলা রাজাকে তার গল্প শোনায়। সব শুনে রাজা বলে উঠে,
“শকুন্তলা, আমি তোমাকে বড়ই ভালবাসি। তুমি আমার রানী হও।”
শকুন্তলাও বলে উঠে, “মহারাজ, আমিও তোমাকে অত্যন্ত ভালবাসি। আমি তোমার রানী হইব।”
ব্যস এভাবেই তাদের বিয়ে হয়ে যায়। আর তাদের এই কাহিনী এতযুগ পরও অম্লান হয়ে আছে।
তারপর আরেকটু থেমে রিদওয়ান ভাই বলেছিলো,
– আমার নদী, আমার তটিনী, আমার স্রোতস্বিনী, আমার তরঙ্গিনী, আমার কলকলছলছল নদী করে টলোমলো, আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তাই তোমাকে আমার রানী করিলাম।
এরপর আর নদীরও কিছু বলার ছিলোনা।
এরপর থেকে রিদওয়ান ভাই প্রায়ই দেখা করার জন্য অস্থির হয়ে যেত। তিনি তো জানতেনই নদী কোথায় থাকে, ফরিদ সাহেবের রেস্টুরেন্ট কোথায়। ওকে প্রায়ই একা একা কিছুক্ষনের জন্য কাছের পার্কে বা সামনের দোকানে এসে দেখা করে যাবার জন্য অনুরোধ করা শুরু করে দিয়েছিলো। তিনিই জায়গা ঠিক করে নদীকে বলে দিতেন। ক্ষনিকের একটু দেখা। এটুকু তো রিদওয়ান ভাইয়ের প্রাপ্যই। এইটুকু কি নদী তাকে দিতে পারে না?
এইটুকু নদী সহজেই দিতে পারে। ফরিদ সাহেব তো ওর সাথে তেমন সময় কাটায় না। সম্প্রতি তিনি নদীর উপর থেকে নজরদারিও কমিয়ে দিয়েছিলেন। ছয় বছরের এই বন্দি জীবনে নদী এমনকিছুই করার চেষ্টা করেনি যাতে করে ওর উপর নজরদারি বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন পড়েছিল। বরং রিদওয়ান ভাইকে পাবার পর থেকে নদী একেবারেই ঝামেলা করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। ফরিদ সাহেব নদীর উপর অসন্তুষ্ট হয়, এমন কোনো কাজই করেনি। কিছুদিন হলো ফরিদ সাহেব বরং নদীকে বলতেনও যে সবসময় ঘরের মধ্যে ঘাপটি মেরে পড়ে না থেকে মাঝে মাঝে একটু বাইরে গিয়ে কিছুক্ষনের জন্য একটু হাওয়া বাতাস খেয়ে আসতে পারো তো।
তাছাড়া ফরিদ সাহেব আজকাল ঘনঘন দেশে যাওয়া আসা শুরু করেছিল। তার মা অসুস্থ হবার কারণে। সেইসসময় নীলু ভাবীকে বলেও নদী বাইরে যেতে পারতো। কিন্তু কোনো এক কারণে রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে দেখা করার ব্যাপারে ওর মন সায় দেয়নি। ওর মনেহয়েছিলো এই তো বেশ চলে যাচ্ছে। এই যেটুকু ভালোবাসা নদী রিদওয়ান ভাইয়ের কাছ থেকে পাচ্ছিলো, এটুকুই ওর কাছে অমূল্য সম্পদ। এর বেশি কিছু ও চায়নি। এর বেশি কিছু ওর চাইবার সাহস হয়নি। বরং এর বেশি পেতে গিয়ে যতোটুকু পেয়েছে সেটুকু হারিয়ে ফেলার ভয় ওর ছিল।
তাই ওর বাসা থেকে বের হওয়া নিষেধ বলে ও রিদওয়ান ভাইকে প্রথম প্রথম বুঝ দিয়েছিলো। কিন্তু এরপর দেখা গেলো মাঝে মাঝে রিদওয়ান ভাই বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে, সামনের কোনো কফি শপে এসে ফোন দেয়। শুধু তাইনা, এক ছুটির দিনে ওদের রেস্টুরেন্টে হাজির হয়ে গেলো। রেস্টুরেন্টে বসে খাবার অর্ডার করে সেগুলো সামনে নিয়ে ছবি তুলে আবার নদীকে পাঠিয়ে বলেছিলো,
– এই খাবার কি আমার নদীকে ছাড়া খাওয়া যায়? ঘর থেকে নেমে এসো এখুনি।
নদীর মনে হয়েছে কী সর্বনাশের ব্যাপার। রেস্টুরেন্টের কেউ টের পেয়ে গেলে তো একেবারে সব শেষ হয়ে যাবে। রিদওয়ান ভাইয়ের এইসব আচরণে নদীর বুকে এক ধরণের ভয় জাগলেও, ওর যে আনন্দ হতো না তা না। এই বয়সে এসে রিদওয়ান ভাই যে নদীর জন্য এত পাগল, রিদওয়ান ভাইয়ের মধ্যে যে একজন শিশু বাস করে, তা মনে করে নদী রিদওয়ান ভাইয়ের প্রতি আরো আরো আকৃষ্ট না হয়ে পারেনি। এরপর যাতে তিনি এভাবে রেস্টুরেন্টে চলে না আসে, তাই কালে ভাদ্রে অল্পসময়ের জন্য রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে দেখা করা শুরু করেছিল নদী।
নদী আমাকে একবার লিখেছিলো,
“আপনি আমার গল্প শুনে নিশ্চয়ই আমাকে খারাপ ভাবছেন। আর সাথে রিদওয়ান ভাইকে আরো খারাপ ভাবছেন। আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন রিদওয়ান ভাই ছলে বলে কৌশলে আমার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ধীরে ধীরে আমাকে বশ করে ফেলছে। তাই না? কিন্তু আমি কিন্তু ব্যাপারটা সেভাবে দেখিনা। কী দরকার এত সময় নিয়ে, এতদিন ধরে আমাকে বশ করার? আমাকে পাবার আশায়? আমাকে পাবার জন্য এতকিছুর দরকার কি ছিল? কোথায় ফরিদ সাহেব তো আমাকে পেয়েছে। সে কি আমাকে পাবার জন্য কোনোদিন সময় দিয়েছে? আমার সামান্যতম কোনো খেয়াল করেছে? আমাকে বোঝার চেষ্টা করেছে? নাহ, করেনি। আমার মনের খবর একমাত্র রিদওয়ান ভাইই নিয়েছে। আর এতদিন ধরে কাউকে ভালো না বেসে এভাবে যত্ন নেওয়া অসম্ভব। আমি বিশ্বাস করি রিদওয়ান ভাই আমাকে মন থেকে ভালোবেসেছিলো। একেবারে মন থেকে।”
এরপর একদিন বাসার সামনে দেখা করার পর রিদওয়ান ভাই নদীকে গাড়িতে করে তার অফিসে নিয়ে যায়। নদীকে তার অফিস দেখাতে। রিদওয়ান ভাইয়ের বাসা, অফিস সব কিছুই তো নদীর থেকে খুব একটা দূরে না। একারণেই একই ডাক্তারের চেম্বারে ওদের দেখা হয়েছিলো। ছুটির দিন হবার কারণে অফিসে আর কেউ ছিলোনা।
সেই অফিসের ছোট্ট রুমে দিগন্তে হেঁটে বেড়ানোর সুযোগ হয়নি, বাঁধভাঙা জোছনা ছিলোনা, পাহাড়ের ঢালে বসে এলোচুল নিয়ে খেলা হয়নি, বালুকা বেলায় সমুদ্রের মিষ্টি বাতাসে একে অপরের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকা হয়নি। সেই অফিস ছিলো চেয়ার টেবিলে ঠাসা, ছুটির দিনে দরজা জানালা বন্ধ রাখার কারণে কেমন যেন অন্ধকার, গুমোট। কিন্তু তাতে কী? সেই গুমোট অফিসের দেওয়ালের এক কোনায় রোল করে রাখা কারো ব্যবহার্য ইয়োগা ম্যাটই সব অপূর্ণতা পূর্ণ করে দিয়েছিলো। সেই ইয়োগা ম্যাটই তাদের মিলনের জন্য ছিল যথেষ্ট।
এরপর মাত্র একবার তাদের এভাবে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ হয়েছিলো। আর পরের ছয়মাসে ওদের অল্পবিস্তর দেখা হলেও আর গভীর কিছু হয়নি। নদীর এরকম গোপন প্রণয়ে কেমন যেন বুক কাঁপতো, তাই রিদওয়ান ভাই জোর করেনি। কিন্তু এতে করে নদীর প্রতি আকর্ষণ যে কমে গিয়েছিলো তা কিন্তু না। বরং আরো বেড়ে দিয়েছিলো। মেসেঞ্জারে ওর প্রতি আরো খেয়াল নেওয়া শুরু করেছিলো। নদীকে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছিলো।
তারপর হঠাৎ করেই যেন সব পাল্টে যেতে লাগলো। সূক্ষ্ণ সব পরিবর্তন। কিন্তু প্রতিটা পরিবর্তন নদীর বুকে সুচের ফলার মতো বিঁধতে লাগলো।
(চলবে)
আমিনা তাবাস্সুম
মনের নদী বেশি গভীর
(১২)
আজকে বৃহস্পতিবার, আমাদের সেই অফিস ডে। আজ মোটামুটি সবাই অফিসে এসেছে কিন্তু কাজ তেমন হচ্ছেনা। কাজের চেয়ে গল্পগুজবই হচ্ছে বেশি। আমাদের রিতা আপা অফিসে এলে এটাই হয়। কাজকর্ম বাদ দিয়ে সবাই গল্পে মেতে ওঠে। আগেই তো বলেছি যে রিতা আপা আমাদের এই সংস্থার আরেকজন পার্টনার। সম্পূর্ণ চ্যারিটি করার জন্যই তিনি এই সংস্থার সাথে যুক্ত। এমনিতে তিনি একটা বিশাল থিয়েটার ক্লাব চালান আর সেই থিয়েটারের লাভের কিছু অংশ এই চ্যারিটিতে নিয়মিত দান করে থাকেন।
রিতা আমার থেকে বেশ অনেক বড়ো হবে। আমার ভীষণ শ্রদ্ধাভাজন গুণী একজন আপা। তিনি সাথে আছেন বলেই আমি চাকরি ছেড়ে এই সংস্থা শুরু করার সাহস পাই। আপাকে আমার দারুন অনুপ্রেরণার একজন মানুষ মনেহয়, ভীষণ versatile। তিনি এমনিতে একজন কোয়ালিফাইড ডাক্তার। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা। আশির দশকে মেডিকেল পাশ করেই স্কটল্যান্ডে এসে কিছুদিন জুনিয়র ডাক্তার হিসেবে কাজ করেছিলেন। সেইসময় স্কটল্যান্ডে ডাক্তারদের প্রয়োজন বেড়ে যাবার কারণে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তাররা কিছুদিনের জন্য এরকম সরাসরি কাজ করতে পারতো। রিতা আপার হাজবেন্ড দেলোয়ার ভাইও ডাক্তার। তারা দুইজনই ব্যাচমেট। কিন্তু দেলোয়ার ভাই পড়েছেন রংপুর মেডিকেল কলেজে। বিয়ের পরপরই দুইজন স্কটল্যান্ডে চলে আসেন। রিতা আপা চাকরি করে সংসার চালাতেন আর দেলোয়ার ভাই পড়াশুনা চালিয়ে এদেশের ডাক্তার হবার কোয়ালিফিকেশনগুলো নিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর দেলোয়ার ভাই যখন ডাক্তারি শুরু করলেন তখন রিতা আপা MRCP শুরু করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তখন তাদের বড়ো মেয়েটার জন্ম হয়, এবং তার দুই বছরের মাথায়ই আবার ছেলের জন্ম। দেলোয়ার ভাই তখন নতুন ডাক্তারির চাকরি নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে রিতা আপাকে পুরোপুরি সংসারের কাজ আর বাচ্চা লালন পালনে মন দিতে হয়েছিল। ভীষণ মেধাবী এবং কর্মঠ ডাক্তার রিতা আপা এমন সংসার আর বাচ্চা পালনে মন দিয়েছে যে তাকে দেখলে মনে হবে তার জন্মই হয়েছে সুনিপনভাবে সংসার করার জন্য। সত্যি কথা বলতে কী, এত যত্ন করে সংসার করতে আমি খুব কম মহিলাকেই দেখেছি। রান্না হোক, বাসা গোছানোর কাজ হোক, বাগান করা হোক, ছেলে মেয়েদের যত্ন হোক বা পতির যত্নই হোক, রিতা আপাকে টেক্কা দিতে পারবে এমন মহিলা খুব কম আছে।
বহু বছর আশ মিটিয়ে সংসার করার পর ছেলেমেয়েরা ইউনিভার্সিটিতে চলে গেলে রিতা আপা আবার নতুন করে পাবলিক হেল্থের উপর পড়াশুনা করে চাকরি শুরু করে। এতদিন ধরে সংসার, সন্তান আর স্বামীর জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া রিতা আপাকে তার স্বামী দেলোয়ার ভাইই নিজের জন্য কিছু করার ব্যাপারে ভীষণ উৎসাহ, উদ্দীপনা দিয়ে থাকে। দেলোয়ার ভাইয়ের আগ্রহেই রিতা আপা নতুন করে ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং এত বছর পর জব মার্কেটে ঢুকেও রাতারাতি বেশ ভালোও করেন। এতবছরের বিবাহিত জীবনে রিতা আপা যেই স্যাক্রিফাইস করেছেন পরবর্তীতে দেলোয়ার ভাই তা পূরণ করার জন্য যথাসাধ্য সহযোগিতা করেছেন। এরকম সাধারণত খুব কমই দেখা যায়। রিতা আপা আর দেলোয়ার ভাই আমার দেখা আদর্শ দম্পতিদের একজন।
তবে সেই চাকরি রিতা আপা কেন যেন বেশিদিন করেননি। হঠাৎ করেই তিনি চাকরির প্রতি, সংসারের প্রতি কিছুটা উদাসীন হয়ে পড়েন। রাতারাতি চাকরি ছেড়ে দিয়ে এই থিয়েটার কোম্পানি খুলে বসেন। থিয়েটার ক্লাবের নাম “গণিকা”। গণিকা মানে তো পতিতা। এরকম একটা নাম দেওয়া হলো কেন সেটা একবার রিতা আপাকে জিজ্ঞেস করেও কোনো জবাব পাইনি। এখন তিনি দিন রাত এই “গণিকা” থিয়েটার নিয়েই পড়ে থাকেন। সাউথ এশিয়ান ছেলে মেয়েদের, বিশেষ করে ট্যালেন্ডেড মেয়েদের যাদের চাকরি বা কাজের প্রয়োজন তাদের দিয়েই মূলত এই কোম্পানি চালান তিনি। আমি শুরুতে ভেবেছিলাম যে জলের মতো পয়সা যাবে, এইধরণের কোম্পানি রিতা আপা দাড়া করাতে পারবেনা। এদেশের বড়ো বড়ো থিয়েটার কোম্পানিই এখন পথে বসে যাচ্ছে। আবার সাউথ এশিয়ান থিয়েটার কোম্পানি? অনেকেই আপাকে এই ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছিলো। কিন্তু রিতা আপা শোনেননি, তিনি তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। আর আশ্চর্যভাবে এই থিয়েটার অল্প সময়ের মধ্যেই পসার লাভ করে। এইসব সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ভারতীয়রা অনেক এগিয়ে আছে। তাদেরকে টেক্কা দিয়ে এত তাড়াতাড়ি এই পর্যায়ে পৌঁছানো কীভাবে সম্ভব তা আমার কাছে এখনো রহস্য। এই থিয়েটারের সব পারফরম্যান্স প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের সংস্কৃতিকে একত্রিত করে করা – অনেকটা ফিউশন বলা যায়। ডাক্তার এবং একজন সংসারী মহিলার এই নতুন ট্যালেন্ট দেখে আমি তো রীতিমত মুগ্ধ। কেমন করে যেন একেবারে grass-roots লেভেলের ভীষণ কয়েকজন ট্যালেন্ডেড আর্টিস্ট জোগাড় করেছে। তাদের প্রথম প্রোডাকশন রবীন্দনাথের চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যই একেবারে সুপার হিট। আর কিছু না করলেও এই এক চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যের ফিউশন নিয়মিত প্রচার করেই “গণিকা” লম্বা সময় চালু থাকতে পারবে। রিতা আপার সৃজনশীলতা শুধু না, তার ব্যাবসায়িক বুদ্ধি, মার্কেটিং আইডিয়া সবকিছু মিলিয়েই এই সাফল্য। আর আমার মনেহয় তার এই সাহস এবং কাজের পেছনে দেলওয়ার ভাইয়েরও অবদান আছে। এই যে আপা এখন দিন রাত এই থিয়েটার নিয়ে পড়ে থাকে, দেলওয়ার ভাইয়ের সহযোগিতা না থাকলে কি তা আদৌ সম্ভব হতো?
রিতা আপা আর দেলোয়ার ভাই জুটি আমাদের সংস্থার সবার খুব প্রিয়। দেলোয়ার ভাই হলো আমাদের গণ দুলাভাই। তাকে দেখলেই আমরা দুলাভাই ডেকে সব আবদার শুরু করে দেই। আজকে সকালে তিনি রিতা আপাকে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। যাবার সময় এক মুহূর্তের জন্য আমাদের সবার সাথে দেখা হলো। সেই এক মুহূর্তেই আমরা সবাই বিরিয়ানি খাবার আবদার করে বসেছি। তিনি যদিও আমাদের আবদার হেসে উড়িয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন। কিন্তু কিছুক্ষন আগে রিতা আপাকে জানিয়েছেন যে আমাদের সবার জন্য নাকি বিরিয়ানি, রোস্ট, শামি কাবাব আর মিষ্টির ডেলিভারি অর্ডার করা হয়েছে। সময় মতো খাবার আমাদের কাছে পৌঁছে যাবে।
আজ দুপুরে বিয়ে বাড়ির খাবার খেয়ে আর কাজ করার কোনো অবস্থা থাকবেনা কারো। তাই তাড়াতাড়ি সবাই অল্প কিছু হাতের কাজ সেরে নেবার জন্য যার যার টেবিলে চলে গেলো। আমি, সাদিয়া আপা আর রিতা আপা আমাদের মতো বসেই রইলাম। সাদিয়া আপা আর আমি আমাদের অফিসের সবচেয়ে বয়স্ক মানুষ, আমরা দুইজনই চল্লিশের ঘরে। বাকিরা আমাদের ছোট। তাই আমরা নিজেরাই নিজেদের অফিসের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে আখ্যায়িত করেছি। যদিও আড়ালে আমরা গল্প করি যে বয়স হলে কী হবে, আমাদের তো এখনো নিজেদের অষ্টাদশী মনেহয়। বরং সত্যিকারের আঠারো বছর বয়সে আমরা মনেহয় এখনকার চেয়ে ম্যাচিউর ছিলাম। তবে সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে মাঝে মাঝে তো একটু বাড়তি সুবিধা নেওয়াই যায়। তাই আমরা দুইজন আজকের দিনটা রিতা আপার সাথে গল্প করেই কাটিয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমরা একটা ছোট গোল টেবিলে বসে চায়ের মগ নিয়ে গল্প করছি। রিতা আপা আমাদের কাজ সম্পর্কে অনেক কিছু জেনে নিচ্ছেন,
– তো, তোমাদের “আমাদের গল্পগুলি” প্রজেক্ট তো মনেহয় ভালোই যাচ্ছে। ফেসবুক পেইজ তো দেখি গল্পে ভেসে যাচ্ছে। আমার তো আজকাল এটা বেড টাইম রিডিং। ঘুমানোর আগে দেখে নেই নতুন কোনো গল্প অ্যাড হলো নাকি। তোমাদের এখানে গল্প পাঠানোর নিয়ম কী?
আমি বললাম,
– ওই তো, ইমেইল করে বা পেইজের ইনবক্সে যে কেউ তাদের বা পরিচিত কারো গল্প পাঠাতে পারে। কেউ আমাদের কোনো সাহায্য চাইলে সাথে উল্লেখ করে দিতে পারে। আর শুধু গল্প শেয়ার করতে চাইলে সেটাও করা যায়। ফারাহ আর রুবিনা মিলে গল্পগুলো দেখে, সেগুলো থেকে বেছে, কারো পরিচয় যাতে প্রকাশ না পায় সেভাবে ফরম্যাট বা এডিট করে তারপর তাদের সাথে চেক নিয়ে গল্পগুলো ফেসবুক বা ওয়েবসাইটে পোস্ট করে।
রিতা আপা বললো,
– বাহ্, ভালো তো। মেয়েগুলো ভালো কাজ করছে দেখি। এতে কারো কি কোনো উপকার হচ্ছে?
– দুই তিনজন সাহায্য, পরামর্শ চাচ্ছে। কিন্তু আদৌ কোনো উপকার হবে নাকি তা সময়ই বলে দিবে। আসলে যারা এধরণের সম্পর্কে যায়, তারা সবাই এত ভালনারেবল, যে এদেরকে ট্র্যাপে ফেলা খুবই সহজ।
হঠাৎ করেই রিতা আপার চোখ মুখ পাল্টে গেলো। মনেহয় কোনো এক কারণে তিনি রেগে গেলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
– ভালনারেবল? ভালনারেবল এর সংজ্ঞা তোমাদের কাছে কী? জেনে শুনে সবাই পাপ কাজে জড়াচ্ছে, আরেকজন স্বামীর সাথে প্রেম করছে, ফুর্তি করছে, নিজেদের আনন্দ, ভালোলাগা এসবের জন্য আরেকজনের সংসার, জীবন নষ্ট করে দিচ্ছে। আর তারপর ধরা খেলে বা প্রেম ছুটে গেলে সব পুরুষ মানুষের দোষ হয়ে যায়। আর তখন মেয়েরা হয়ে যায় সব ভালনারেবল। তাই না? আমার কাছে এদের মোটেও ভালনারেবল মনে হয়না। আমার কাছে মনেহয় এরা একেকটা w’h’ore বা তার থেকেও অধম কিছু।
এই বলে তিনি আমাদের দিকে তার মোবাইলটা বাড়িয়ে দিলেন, মোবাইলের স্ক্রিন দেখার জন্য। রিতা আপা তার জীবন দিয়ে মেয়েদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। এই থিয়েটার শুরু করেছেনই মেয়েদের জন্য কিছু করার উদ্দেশ্যে। এই চ্যারিটিতে বড় অংকের টাকা দান করেন যাতে মেয়েদের উপকারে আসে। তার কাছ থেকে এরকম কথা আমরা আশা করিনি। আমি আর সাদিয়া আপা দুইজনই একটু হকচকিয়ে গেলাম। কোনো রকমে দুইজন মোবাইলের স্ক্রিনটা কাছে এনে দেখলাম। সেখানে একটা চিরকুটের ছবি। সেই চিরকুটে সুন্দর গোটা গোটা অক্ষরে হাতে লেখা,
“There is nothing more beautiful than you in this world. Your beauty is divine. Even the beauty of Helen of Troy will look dull next to you. Life is good with you. I want to be near you. I came to this world just for you. I felt your presence long before I met you. At last the love found us.
All I can say that I cannot leave without you my Janer Tukra.”
আমি আর সাদিয়া আপা মুখ চাওয়া চাওয়ি করলাম। এই চিরকুটের মানে কী? এটা কে কাকে দিয়েছে? সাদিয়া আপা বলে উঠলো,
– রিতা আপা, এটা কী? এই মেসেজ আপনাকে কি কেউ পাঠিয়েছে?
রিতা আপা ফোনটা নিয়ে আরেকটা ছবি বের করে আমাদের দেখালো। বললো আমরা স্ক্রল করে পরের কয়েকটা ছবিও দেখতে পারি।
ছবিগুলো রিতা আপার হাজবেন্ড দেলোয়ার ভাই আর আরেকজন মহিলার। দুইজন ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে কফি খাচ্ছে, বাগানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে, এক টাব থেকে দুইজন আইসক্রিম খাচ্ছে, এরকম কিছু ছবি। সেই মহিলা রিতা আপাদের বয়সীই হবে। ট্রয়ের হেলেনের চেয়ে সুন্দরী কিনা তা জানিনা। তবে এই বয়সেও যে সেই মহিলা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী তা অস্বীকার করা যাবেনা। শুধু সুন্দরীই না। একেবারে কেতাদুরস্ত এবং ফ্যাশনেবল মহিলা। এই ছবিগুলোর পর আরো কিছু ফেসবুক মেসেজের স্ক্রিনশট। যেখানে তাদের দুইজনের ছবির উপর হার্ট আঁকা, ফুল আঁকা, একজনের নামের সাথে প্লাস চিহ্ন দিয়ে আরেকজনের নাম লেখা এরকম ছেলেমানুষী কিছু কথোপকথন। তারপর ভীষণ গভীর কিছু প্রেমের বার্তা। কতকটা নদীর কাছে রিদোয়ান ভাইয়ের পাঠানো মেসেজগুলোর মতো।
ব্যাপারটা কী এখন আমি আর সাদিয়া আপা মনেহয় বুঝতে পারছি। কিন্তু কী বলবো তা বুঝে উঠতে পারছিনা। আমার মনে হচ্ছে সাদিয়া আপা আগে কথা বললে আমি যেন বেঁচে যাই। কিন্তু সাদিয়া আপাও কিছু বলছে না।
আমাদের চুপ থাকতে দেখে রিতা আপাই বলে উঠলো,
– তোমাদের দেলোয়ার ভাইয়ের সাথে যেই মহিলাকে দেখলে সে হচ্ছে সানিয়া। আমাদেরই ব্যাচমেট। দেলোয়ারের সাথে রংপুর মেডিকেল কলেজে পড়েছে। ভীষণ বনেদি এবং ধনী পরিবারে ওর বিয়ে হয়েছে। স্বামী আছে, ছেলেমেয়ে আছে এমনকি নাতি নাতনীও আছে। হাজবেন্ড তো ভালো অবস্থায় আছেই আর নিজে তার চেয়েও ভালো করেছে। ইউনিসেফে বড়ো পোস্টে কাজ করে। সারা পৃথিবী চষে বেড়ায়। এখন সুইডেনের চাইল্ড এন্ড অ্যাডোলোসেন্ট হেলথের উপর একটা রিসার্চ প্রজেক্টের সাথে যুক্ত। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় সব ছেলেদের নাকি ক্রাশ ছিল এই মহিলা। দেলোয়ারেরও নাকি ঠিক তেমনই পছন্দ ছিলো। সেটা অবশ্য এতদিন পর জানতে পারলাম। সে সময় তো দেলোয়ার প্রেম করেছে আমার সাথে। তখন কিছু শুনিনি তো। এতবছর পর ওদের মেডিকেল কলেজের ফেসবুক গ্ৰুপে সংযোগ হবার পর দেলোয়ারের সেই পুরোনো পছন্দ উথলে উঠেছে। সেই থেকে সংযোগ, আলাপ এবং তারপর প্রেম। এরপর টানা চারবছর তারা চুটিয়ে প্রেম করে গেছে। এর মধ্যে একবার সুইডেনে কাজের নাম করে বেরিয়েও এসেছে দেলোয়ার। সেই সুইডেন ট্রিপের ছবিই তোমাদের দেখলাম।
একটু যেন দম নিয়ে রিতা আপা আবার শুরু করলেন,
– তার প্রেম করার সুবিধার জন্য এত বছর পর আমার পড়াশুনা, আমার চাকরি সবকিছুর প্রতি তার আগ্রহ। অথচ কী বোকা আমি। কী ভীষণ বোকা। তার আগ্রহ দেখে আমি কৃতজ্ঞ হয়ে খুশিতে এই সংসারের পেছনে আরো আরো কষ্ট করে গিয়েছি। সারাদিন কাজের পর ঘরে ফিরে প্রতিটা দিন দেলোয়ারের জন্য ফ্রেশ রান্না করেছি। কী ভীষণ বোকা আমি।
রিতা আপা যেন আপন মনেই কথা বলে যাচ্ছে,
– আমাদের বয়স এখন কত জানো? ষাট বছর। তার মানে তারা প্রেম শুরু করেছে যখন দুইজনের বয়সই মিড ফিফটি। সাংঘাতিক অ্যাকমপ্লিশড মহিলা। সাংঘাতিক স্ট্রং মহিলা। বন্ধুমহলে ভীষণ সুপরিচিত। ধরলাম দেলোয়ার চরিত্রহীন। ধরলাম না, কথা সত্যি। কিন্তু এই মহিলাকে তোমরা কী বলবে? ভালনারেবল? তোমরা যা ইচ্ছা বলো। I don’t care. I call her w’h’ore. আমি নিজেও তাকে বলেছি। সরাসরি বলেছি।
সাদিয়া আপা বললো আপনি তার সাথে কথা বলেছেন?
– হ্যাঁ, সেটা বিশাল গল্প। এইসব মেসেজ যখন আমার চোখে পড়লো তখন তো দেলোয়ার কিছু অস্বীকার করতে পারেনি। আমি সাথে সাথেই সংসার থেকে বেরিয়ে ছেলের কাছে চলে যাই। আমার ছেলে মেয়ে আমাকে অনেক সাপোর্ট দিয়েছে। কিন্তু ওরাও ভেঙে পড়েছিল। ওদের কাছে তো ওদের বাবা একজন রোল মডেল। চলে যাবার কিছুদিন পর দেলোয়ারের কান্না কাটি, মাফ চাওয়া চাওয়ি শুরু হয়ে গেলো। আমাকে বললো যে এই ছোট্ট একটা ভুলের জন্য এত বড়ো শাস্তি আমি তাকে যেন না দেই। তিরিশ বছরের সংসার যেন ভেঙে না দেই। নিজের জন্য না হলেও ছেলেমেয়েদের কথা চিন্তা করে তাকে যেন মাফ করে দেই। তখন ওর কথা শোনা ঠিক হয়নি। ফিরে আসা আমার ঠিক হয়নি। কিন্তু সেসময় আমি পারিনি। তিরিশ বছরের তিল তিল করে গড়ে তোলা সংসার, তিরিশ বছরের ভালোবাসা, তিরিশ বছরের মায়া, আর সবচেয়ে বড়ো হলো তিরিশ বছরের বিশ্বাস – সবকিছু ত্যাগ করা এত সহজ? তিরিশ বছর ধরে আমি তাকে অন্ধভাবে ভালোবেসেছি, তিরিশ বছরে আমি এক মুহূর্তের জন্য তাকে অবিশ্বাস করিনি। এত বড়ো ভালোবাসার জায়গা ছেড়ে দেওয়া এত সহজ? আমার জন্য সহজ ছিলোনা। আমি ফিরে আসি। ফিরে এসেই আমি চাকরি ছেড়ে এই থিয়েটার ক্লাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। নিজেকে ভুলিয়ে রাখার জন্য। এটাতেও দেলোয়ারের সুবিধা। সে মনেকরে ব্যস্ত থাকায় আমি তার অপকর্ম ভুলে গেছি। তাই আমাকে থিয়েটারের সব ব্যাপারে চরম উৎসাহ দেয় সে।
আমি এবার একটা কথা না জিজ্ঞেস আর করতে থাকতে পারলাম না,
– আপা, উনাদের কি এখনো সম্পর্ক আছে?
– কী জানি? দেলোয়ার তো বলে না। সম্পর্ক নাই। আমার বিশ্বাস হয়না। আমি আর ওকে বিশ্বাস করিনা। আমি ফিরে আসার পর আরো কয়েকবার দেলোয়ার যোগাযোগ করেছে সেই মহিলার সাথে। যোগাযোগ করে আবারো আমার কাছে ধরা খেয়েছে। তারপরই আমি সেই মহিলার সাথে যোগাযোগ করি। সে অবশ্য সব দোষ দেলোয়ারকেই দিলো। পরিবার ছেড়ে বিদেশে একা একা থাকা অবস্থায় দেলোয়ার নাকি দিনের পর দিন, রাতের পর রাত তাকে মেসেজ করে, ফেসটাইম করে কথা বলে বলে তাকে নরম করে দিয়েছে। সে অনেক মানা করেছিলো। বলেছিলো এটা অন্যায়। দেলোয়ার নাকি কোনো মানা শোনেনি। পাগলের মতো ওর পেছনে লেগে ছিলো। তবে তার ভুল হয়েছে বলে সে আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আমি ক্ষমা করতে পারিনি। দেলোয়ারের সম্পর্কে আমার বলার কিছু নাই। বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি যে আরেকজন প্রশ্রয় না দিলে শুধু একপক্ষের আগ্রহে এরকম সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না। এই মহিলাকে আমি w’h’o’re ছাড়া কিছুই বলতে পারছিনা।
রিতা আপা আজ যেন শুধু কথাই বলে যাবেন। আরেকটু থেমে আবার বললেন,
– শুধু তাকেই না আমার নিজেকেও এখন একজন p’r’osti’tute মনেহয়। আমার শরীর ওর প্রয়োজন ছিল সেটা ভোগ করেছে। শুধু কি শরীর? যখন দরকার ছিল আমি চাকরি করে পয়সা আয় করেছি, ও পড়াশুনা করেছে। ওর সন্তানের দরকার ছিল, আমি সেটারও ব্যবস্থা করেছি। ও ক্যারিয়ার গড়েছে, আমি ওর সংসার, আরাম, আয়েশ সবকিছুর ব্যবস্থা করেছি। এই বয়সে এসে ওর হেলেন অব ট্রয়ের সাথে টিনেজ বাচ্চাদের মতো প্রেম করার শখ হয়েছে, তো আমি পড়াশুনা, চাকরি করে ওর প্রেম করার স্পেইস দিয়েছি। আমি তো শুধু p’r’osti’tu’te না, এর উপর কিছু থাকলে সেটা।
ঠিক এই সময়ে দেলোয়ার ভাইয়ের অর্ডার করা বিয়ে বাড়ির খাবার এসে হাজির। মেয়েরাও সাথে সাথে সবাই সেই ঘরে এসে হাজির হয়ে গেলো। আমরা সবাই মহানন্দে খাবার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। আমি আর সাদিয়া আপা ছাড়া বাকি সবাই তো একেবারে দেলোয়ার দুলাভাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন দুলাভাই পৃথিবীতে নাকি আর কোনো শালীর নাই।
সবাই বেশ আনন্দ করেই গল্পসল্প করে খাওয়া দাওয়া করছে। গল্পের বিষয়বস্তু সতেরো তারিখের মাছরাঙা টেলিভিশনের বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠান। রিদওয়ান ভাই আমাদের সংস্থার জন্য একেবারে প্রাইম স্পটে বিশাল স্টলের ব্যবস্থা করেছে। মেয়েরা তো রিদোয়ান ভাইয়ের মহানুভবতায় একেবারে গলে গলে পড়ছে। তিনিও নাকি আমাদের স্টলে সময় দিবেন। এই নিয়ে সবাই তো মহা উত্তেজিত। সবাই এক রঙের শাড়ি পরবে বলে ঠিক করেছে। কিন্তু কোন রং পরা হবে এই নিয়ে চলছে মহা বাকবিতন্ডা। এই প্রথমবারের মতো রিদওয়ান ভাইয়ের সাথে দেখা হবে মনে করে আমি মোটেও উৎসাহবোধ করছিনা। বরং তার সাথে এত কাজে এভাবে আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে যাবার কারণে বুকের ভেতর কেমন খচখচ করছে।
তবে আপাতত বর্ষপূর্তি আয়োজনের চেয়ে আমার মনোযোগ রিতা আপার দিকেই বেশি। আমি রিতা আপার কথা চিন্তা করতে করতে খেয়ে যাচ্ছি। খেয়াল করলাম সাদিয়া আপা শুরুতে অল্পই খাবার নিয়েছিল। মনেহয় মন খারাপ করে খেতে পারছিলো না। কিন্তু এখন আরেক প্লেট বিরিয়ানি নিয়ে কাঁচামরিচ পেঁয়াজ দিয়ে আরাম করে বসে খাচ্ছে। শুধু খাচ্ছেনা রিতা আপা। প্লেটে অল্প একটু ভাত নিয়ে শুধু নাড়াচাড়া করছে। নাড়াচাড়া করতে করতেই হঠাৎ বলে উঠলো,
– কিন্তু আজকাল মনেহয় থেকে গিয়ে আমি ভুল করেছি। যেই বিশ্বাস ভেঙে গেছে সেটা আর জোড়া দেওয়া সম্ভব না। সেই বিশ্বাস তিরিশ বছর ধরে গড়ে তোলা হোক, আর তিনশো বছরের বিশ্বাসই হোক।
এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
নাফিসা, তুমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলে না, আমাদের থিয়েটার ক্লাবের নাম কেন “গণিকা” রেখেছি? সেইসময় আমার মেন্টাল স্টেইট এমন ছিল যে মনে হয়েছিলো আমরা মেয়ে মাত্রই তো তাই। কেউ সেই সানিয়ার মতো গণিকা কেউ আমার মতো। তাই এই নামটাই আমার থিয়েটার ক্লাবের জন্য যথার্থ।
(চলবে)