আষাঢ়ি_পূর্ণিমা #পর্ব_সূচনা

0
1395

#আষাঢ়ি_পূর্ণিমা
#পর্ব_সূচনা
✍️ দিজা মজুমদার

—সম্পর্ক যখন তিক্ততায় ছেঁয়ে যায়, তখন সমাপ্তি টানা জরুরি হয়ে পড়ে। আমি এ সম্পর্কের সমাপ্তি টানতে চাই, রাত্রি। শুনতে তোমার হয়তো খারাপ লাগছে কারণ আমাদের এ সম্পর্কের মেয়াদ এক বছরও হয়নি। মেয়াদ বলতে গিয়ে সম্পর্কটাকে কেমন যেন পণ্য মনে হলো। আমাদের সম্পর্ক কি এমন তুচ্ছ ছিল?

প্রশ্ন করে আদী চুপ করে রইল। সে উত্তর আশা করছে, কিন্তু ফোনের ওপাশে নিশ্বাসের শব্দ বই অন্য কিছুর সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে না। আদী বুঝতে পারছে ওপাশের মানুষটির চোখে এখন নিস্তরঙ্গ সমুদ্রের জল; গড়িয়ে পড়ছে কপোল বেয়ে। কিন্তু ভয়ের চোটে নীরবতা আঁকড়ে ধরেছে।

—সারাদিন আমি ফোন ধরে বসে থাকব না, রাত্রি। Answer me.

আদী রেগে বলল। এতে চমকে গিয়েও স্বাভাবিক হলো রাত্রি। শব্দহীন কান্না চেপে জবাব দিলো,

—আমার কিছু বলার নেই।

—Idiot-এর মতো কথা বলবে না। বলার কিছু নেই মানে কী? ভরদুপুরে আমার বিপি চড়িয়ে দিয়ো না। আমার মনমেজাজ নিয়ে তোমার কিন্তু ধারণা আছে। রেগে গেলে…

আদী আরও কিছু বলার জন্য ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছিল, কিন্তু তাকে থামিয়ে বেশ শক্ত গলায় রাত্রি বলল,

—তবে উত্তর শুনে নাও। ন্যূনতম বিশ্বাস না থাকলে কোনো সম্পর্কই স্থায়ী হয় না। আমি জানি না, তুমি আমার সাথে কোন সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইছ। কারণ তোমার সাথে আমার দু’টি সম্পর্ক রয়েছে। তুমি সম্পর্ক রাখো বা না রাখো তা নিয়ে আমি একটি কথাও বলব না। কিন্তু দয়া করে আমাদের পরিবারের কাছে আমাকে নিচে নামিয়ে দিয়ো না। দূরের সম্পর্ক হলেও তো আত্নীয়। তাই দেখা হলে অন্তত কথা বোলো যেন আত্মীয়স্বজন টের না পায় তুচ্ছ কারণে আমাদের সম্পর্কের সমাপ্তি হয়ে গেছে।

—তুমি অনেক বেশি বলছ। আমি…

—আমি এখন ফোন রাখতে চাই। কারো তীক্ষ্ণ মেজাজ আর চওড়া গলার কড়া কথা শুনতে চাই না। সম্পর্ক তো ছিন্ন করতে চাও। ঠিক আছে, করলাম ছিন্ন। আজকের পর আমৃত্যু তোমায় আমার মুখও দেখাব না। বুশরাকে নিয়ে সুখে থেকো।

—রাত্রি…

আদী ডাকল রাত্রিকে, কিন্তু ফোনের ওপাশে কল কাটার শব্দ হলো। এতে আদী নিজের মাঝে অসম্ভব রাগ অনুভব করলেও ক্রমাগত ফোন করে গেল, কিন্তু প্রতিবার মেয়েলি কণ্ঠে একটি বাক্যই কানে ফিরে এলো,

—আপনার ডায়াল করা নম্বরে এ মূহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।

ঘাড়ের রগ ফুলে ওঠছে। সজোরে ফোন ছুড়ে দিয়ে আদী গোসলখানায় চলে এলো। টিশার্ট এবং প্যান্ট সমেত ঝরনা কলের নিচে মাথা রাখল। প্রেশার বড়ো বেশি বেড়ে গেছে। সমস্ত শরীর কাঁপছে আদীর। চোখ না দেখেও অনুভব করছে তা এখন অসম্ভব লাল হয়ে গেছে কারণ গত দুই বছর ধরেই এ সমস্যায় ভুগছে সে। মাত্র ৩০ বছর বয়েসে ব্লাডপ্রেশার তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে অথচ তার আম্মা আব্বার কারো এ ধরনের সমস্যা নেই।

বছর দুয়েক আগেই আদী জানতে পারে সে ব্লাডপ্রেশারের পেশেন্ট। জহিরের সাথে সেদিন রাগারাগি করছিল এবং এর একপর্যায়ে আদী অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন সবাই মিলে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় আর ডাক্তার জানায় সে হাই ব্লাডপ্রেশারে ভুগছে। ফলে ডাক্তার তাকে বলে কোনোমতে উত্তেজিত হওয়া চলবে না, কিন্তু ডাক্তারের নিষেধাজ্ঞা আদী আমলে নিলে তো?

*

ঘরের বাইরে খা খা রোদ। আতা ফলের গাছটি মনে হচ্ছে রোদের তাপে শুকিয়েই যাবে। চকচক করছে সবুজ পাতা আর সেদিকে তাকিয়ে রাত্রি ভাবছে আদীর কথা। বারান্দার এককোনায় বসে থেকে একই সাথে বাড়ির প্রধান ফটক, আতা গাছ এবং পাশের বাড়ির ছাদ দেখা যায়। এখন দুপুর বলে ও বাড়ির ছাদে ভেজা কাপড় ছাড়া একটি মাছিও নেই। থাকলে অবশ্য সমস্যা হতো; তারা দেখে ফেলত রাত্রি চুপটি করে অশ্রু ঝড়িয়ে যাচ্ছে চৈত্রের দুপুরে।

চার মাস আগেই রাত্রির বিয়ে ঠিক হয়েছে। পাত্র নামীদামী হাসপাতালের ডাক্তার। দেখতে শুনতে মোটামুটি। তবে এ নিয়ে রাত্রির কোনো আপত্তি নেই অবশ্য করার মতো সুযোগ তাকে কেউ দেয়নি। কারণ পরিবারের কেউ তাকে জিজ্ঞাসাও করেনি,

—রাত্রি, তোমার কি বিয়েতে মত আছে? পাত্র পছন্দ হয়েছে?

রাত্রির এখনো পড়াশোনা শেষ হয়নি। সদ্য মাস্টার্সে ভর্তি হয়েছে। তার ইচ্ছে ছিল পড়াশোনা শেষ করে একটি প্রাইভেট স্কুলে চাকরি নিবে। কিন্তু তার মনের খবর কেউ রাখলে তো? আদীকে এসব বলতে চেয়েছিল কতবার, কিন্তু প্রতিবার কোনো না কোনো অজুহাতে সে ঝগড়া করে। অতি তুচ্ছ বিষয়ে কথা কাটাকাটি করে প্রতিবার বলে ওঠে,

—রোজ রোজ এসব ন্যাকামি মার্কা কথা আমার সহ্য হয় না। আমি ওষুধ খাই না কি মাথায় দিই তা নিয়ে এত বলাবলি কীসের? এসব খোঁজ রাখার জন্য এতবার ফোন করা, তা নিয়ে ঝগড়া করা। I can’t tolerate. এমন ভঙ্গুর সম্পর্ক রাখার চেয়ে না রাখাই ভালো।

আদী এসব কথা বললে রাত্রি প্রথম প্রথম খুব অনুনয়বিনয় করত। সম্পর্ক যেন ভেঙে না দেয় সেজন্যে কত কান্নাকাটি করত। প্রথম দিকে এতে অবশ্য আদী শান্ত হতো, কিন্তু ধীরে ধীরে আদী আরও বেশি উগ্র হয়ে গেল। আর রাত্রিও অনুনয়বিনয় করা ছেড়ে দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে শিখে গেল। কিন্তু এমন করে আর কতদিন? কালকে রাত্রি নিজেকে সংযত করে রাখতে পারেনি। উটকো একটি মেয়ে যে কিনা প্যান্ট শার্ট পরে এসে জোর গলায় দাবি করেছে,

—আদী আমাকে ভালোবাসে। কিছু দিন পর আমাদের হয়তো বিয়ে হবে। তুমি আর আমাদের মাঝে রবীন্দ্রনাথের লেখা চোখের বালি হইয়ো না। ওকে?

রাত্রি কিছু বলেনি কেবল হতভম্বের মতো তাকিয়ে ছিল। ক্লাসের সমস্ত স্টুডেন্টের সামনে কেউ তাকে এমন করে কথা শুনিয়ে যাবে তা সে চিন্তাও করেনি। একমুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল চোখের সামনে হিন্দি সিরিয়াল চলছে যেখানে কুচক্রী টাইপ মহিলা এসে তাকে শাসিয়ে গেছে। রাত্রি অপমানিত বোধ করলেও স্বাভাবিক একটি ভাব নিয়ে ক্রমাগত ক্লাস করে গেছে। তবে বাসায় ফিরে এসে যখন আদীকে কল করল, তখন আদী কল রিসিভ করেনি।

রাত দশটা নাগাদ ফোন করে আদী রাত্রিকে জিজ্ঞাসা করেছিল,

—এত কল করার কী আছে? আমি কি মরে গিয়েছি?

—সবসময় এভাবে কেন কথা বলো? আমি কি অদরকারী কাজে তোমায় কল করি?

—অত দরকারী কাজ জেনে আমার লাভ নেই। অসময়ে আমাকে একদম ফোন করবে না। আজকেই শেষ। বলো কেন কল করেছিলে?

আদীর রাগ দেখে রাত্রির অভিমান হচ্ছিল। তাই সে একবার ভেবেছিল এ বিষয়ে কোনো কথা বলবে না, কিন্তু কিছু না বললেও আদী উত্তেজিত হবে। তাই অগত্যা রাত্রি বলতে শুরু করল,

—আজকে হঠাৎ করে একটা মেয়ে এসেছিল আমার কাছে।

—বুশরা?

—আমি তাকে চিনি না। কোনোদিন দেখিনি।

—চেনো না তাহলে ও তোমার কাছে গেল কেন?

—সেটি আমি কী করে বলব? আমাকে সবার সামনে বলে গেল, তোমাকে ভালোবাসে। কিছু দিন পর তোমাদের বিয়ে হবে। আমি যেন…

—তুমি যেন কী? বুশরা তোমাকে এসব বলেছে?

—তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না?

—দেখো রাত্রি, আমি এখন ক্লান্ত আমার ঘুমের প্রয়োজন। প্রেশারের গতি সুবিধার নয়। কবে না জানি স্টোকফোক করে বসি। এখন ফোনটা ছাড়ো। আমি…

আদী কথা শেষ করার পূর্বেই কল কাটার শব্দ শুনতে পেল। এতে ধপ করে তার রাগের বাতি জ্বলে ওঠল। নিজেই রাত্রিকে ফোন করল এবং জিজ্ঞাসা করল,

—কল কাটলে কেন?

রাত্রি ভয়ে কাঁপছে। তার গলা শুকিয়ে আসছে অথচ আদী উত্তেজিত হয়ে একই প্রশ্ন বারবার করছে,

—কল কাটলে কেন?
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here