ধরিত্রী_কথন #পার্ট ৩৩,৩৪

0
1055

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট ৩৩,৩৪
#পিকলি_পিকু
৩৩

কয়েক মাস পার হয়ে গেছে। রাফসান এখন সুস্থ। তবুও ধরিত্রীর কোনো খবর নেই। না আছে মীরার। যেই হাসপাতালে রোগীদের সময় দেওয়ার জন্য সে তার স্ত্রী হতে দূরে সরে গেছে সেই হাসপাতালে ও ওর কোনো জায়গা নেই। ধরিত্রীর বারান্দায় ধরিত্রীর গাছে পানি দিয়েই ওর যা সময় যায়। জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে। ওর ফোনে এখন আর তেমন কেউ ফোন করে না। কেউ খোঁজ করে না। কিন্তু আজ জামির ফোন এসেছে।

– হ্যালো,
– হ্যালো রাফসান। কেমন আছিস?
– মোটামুটি।
– মীরা কেমন আছে?
– আমি কী করে জানবো?
– কীরে , তুই জানবি না! আমাকে বলছিস? সবাই দেখেছে।
– ঐ সব মিথ্যে! আমি আর মীরা কিছুই করিনি।
– ভাবির সাথে এত অন্যায় করে আবার গলা কাঁপাচ্ছিস? তোরা পারিস ও বটে।

রাফসান ফোন রেখে দিল। এখন খুব কম বাইরে যায়। যদিও সাধারণ কারো ওর চেহারা মনে নেই। পরিচিত জায়গায় গেলেই সমস্যা। সেদিন এমনি রাস্তায় ওর পুরনো রোগী দিয়ার দেবর আর তার ছেলের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল। দিয়ার ছেলে তাকে দেখে ধরিত্রীর কথা জিজ্ঞেস করলেও তার দেবর অত্যন্ত ঘৃণায় রাস্তায় থুথু ফেলে চলে গেলেন। থুথু টা যে সে রাফসানের মুখেই মারতে চেয়েছিল তা তার দৃষ্টিতে বোঝাই গিয়েছে। এরপর থেকে সে মাস্ক পরেই বের হয়। তবুও সেদিন সুপার শপ থেকে বাজার করার সময় ওর রাধার সাথে দেখা হলো। সে রাফসানকে দেখতেই মুখ ফিরিয়ে নিল। রাফসান চোখ নামিয়ে অন্য লেনে গেল। কিন্তু আবার হঠাৎ রাধার কার্ট আর রাফসানের কার্টে সংঘর্ষ লাগলো। রাধা রাগ দেখিয়ে ওর কার্ট সজোরে টেনে সরালো। এই ঘটনায় অনেক শব্দ হয়েছে। আর সবার দৃষ্টিও আকর্ষণ হয়েছে। রাধার রাগ ঘৃণা সবই রাফসান বুঝতে পারছে। রাফসান আবার অন্য দিকে গেল। কী বুঝে রাধা রাফসানের পেছনে এসে বলল, ” তোমার প্রেয়সী কোথায় রাফসান?”

রাফসান বুঝতে পারলো। তাই পেছনে না তাকিয়ে সরে আসলো। রাধা আবার ওর পেছনে গিয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,

– প্রেয়সী কোথায়?
– কী যা তা বলছ?

রাফসান ভারী কণ্ঠ পাল্টা প্রশ্ন করল। রাধা ওর সামনে এসে হাত ভাজ করে বলল,

– যার সাথে রঙ্গলীলা করেছ।
– আল্লাহর দোহাই একটু চুপ করবে। এটা পাবলিক প্লেস।
– তোমার মুখে আল্লাহর দোহাই মানায় না। নোংরা লোক!
– তাহলে আমাকে যেতে দাও।

রাফসান আবার চলে আসছিল। রাধা এবার ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলল,

– ধরিত্রী কোথায়?
– জানি না। জানা নেই।
– জানতেও চাও না। জেনে কী হবে? এখন তো যা চাইতে তাই হচ্ছে।
– তুমি কত টুকু জানো আমাকে রাধা? শুধুমাত্র টিভি তে ঐ কয়েকটা ছবি আর আর অহেতুক বকবক? আমি আর নিতে পারছি না এসব। আমি জানি না আমার স্ত্রী কোথায়? বেঁচে আছে না, ম*রে গেছে। ওকে আমি ভালোবাসি। আমি কোনো অন্যায় করিনি। মানুষের উপকার করতে যাওয়া কী ভুল? এই কয়েকটা মাস যে আমি কী করে কাটিয়েছি! থাক। বলে আর কী হবে? তোমরা আমায় নিয়ে ভালো ভাবলেও বা কী, খারাপ ভাবলেও বা কী?

রাফসান শপিং কার্টটা সেখানে রেখেই চলে আসে। রাধা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করে সবাই তামাশা দেখছিল। রাফসানের উপর যতই রাগ থাকুক, ওর উচিত ছিল এরকম পাবলিক প্লেসে এসব নিয়ন্ত্রণ করা।

রাফসান কিছুক্ষণ দূর এসে রাস্তায় বসে পড়ল। এভাবে আর কত দিন পথে ঘাটে অপমানিত হবে। আর ধরিত্রী কে কী খুঁজে পাবে না। কোনোভাবে বাসায় আসার পর রাফসান ইন্টারনেটে প্রাইভেট ডিটেকটিভ খুঁজতে লাগলো। তার এখন যে করেই হোক নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে হবে। যদি সে নির্দোষ প্রমাণিত হয় তবে হয়তো কোনো ভাবে ধরিত্রী জানতে পারবে। আর যখন সে জানতে পারবে সে ফিরে আসবে। রাফসানকে এভাবে দেখে রুবাইয়া প্রশ্ন করল,

– কী হয়েছে?
– আজ রাধা আমাকে রাস্তায় সবার সামনে অপমান করল। মা আমি আর এই অপবাদ মাথায় নিয়ে ঘুরব না। আমি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করব।
– প্রমাণ করে আর কী হবে? ধরিত্রী কী ফিরে আসবে?
– আসবে। ও যখন শুনবে আমি নির্দোষ ওকে আসতে হবে।
– যার দোষ সে তো আর শাস্তি পাবে না।
– তুমি কার কথা বলছ।
– কার আবার? অঙ্কন। আমি গিয়েছিলাম ওর কাছে।

রুবাইয়ার মুখে অঙ্কনের কথা শুনে রাফসানের গায়ে যেন আগুন লেগে গেল।

– তুমি আমাকে আগে কেন বলো নি?
– কারণ তুই অসুস্থ ছিলি। ঠান্ডা হ বাবা, উত্তেজিত হবি না।
– তুমি এর মানে জানো? এর মানে ও জানে ধরা কোথায়। ও জানে মীরা কোথায়। খুব সম্ভবত ও লুকিয়েছে ওদের। সে কারণে পুলিশ ও পাচ্ছে না। একটা মানুষ কী হাওয়া হয়ে গেল? আমাকে আগে কেন বলোনি।

রুবাইয়া রাফসানকে থামাতে পারলো না। সে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল অঙ্কনের অফিসে। সৌভাগ্যক্রমে সে আজ উপস্থিত ছিল অফিসে। রাফসান ঢুকতেই ওকে রিসেপশনিস্ট আটকাতে চায়। সে কোনো পাত্তা না দিয়ে সোজা ভেতরে চলে যায়। গার্ড রা ওর পেছনে ছুটছে। রাফসানের আজ প্রতিশোধ চেপেছে। দরজা খুলেই সে অঙ্কনের কাছে গিয়ে ওকে মা*রতে লাগলো। অঙ্কন নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। ওর গার্ড রাও রাফসানকে আটকাতে পারছে না। অঙ্কনকে মা*রতে মা*রতে রাফসান রক্তাক্ত করে ফেলল। এরপর ক্লান্ত হয়ে সে মাটিতে বসে পড়ল। তারপর সে কান্না করতে লাগল। অঙ্কন নিজেকে সামলে চেয়ারের উপর বসে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। রাফসান চোখ মুছতে মুছতে বলল,

” আমি তোমার সাথে যা করেছি আমি ওসব বাদ দিলাম। তোমার যদি আমার প্রতি ক্ষোভ থাকে তো সেসব আমার ওপর থেকে তোলো। আমার স্ত্রী কোথায় অঙ্কন? ওকে কোথায় রেখেছে? ওর কোনো ক্ষতি করনি তো? আমি আর মীরা না হয় খুব রাগিয়ে দিয়েছিলাম তোমাকে। ধরার কী দোষ? ওকে কেন আটকে রেখেছ?”

অঙ্কন ওর দিকে তাকিয়ে থাকে,

“আমাকে যে শাস্তি দেবে দাও। ওকে ছেড়ে দাও। ওর মা বাবা অপেক্ষা করছে সেখানে। আমি আর ওর সামনে যাব না। ওকে বলে দিও। শুধু বলো ও বেঁচে আছে। অন্তত ওর মা বাবার কাছে যাতে ও থাকে। সমস্ত ঝামেলা থেকে আমার ধরাকে বাইরে রাখো। প্লিজ। আমি তোমার পা ধরছি।”

একটু আগে রাফসান এখানে ধ্বংস যজ্ঞ চালিয়েছে, আর এখন পা ধরছে। অঙ্কনের আনন্দ হওয়ার কথা। কিন্তু ও রাফসানের দিকে অনুভূতিশূন্য হয়ে তাকিয়ে থাকে। এরপর রাফসানের কাছে গিয়ে বলে,

– ইউ লাভ হার?
– জ্বী?
– ধরিত্রী কে?
– হ্যাঁ। অনেক ভালোবাসি। নিজের জীবনের চেয়ে ও বেশি। তাই বলছি ও কোথায় আছে এটা অন্তত ওর পরিবার কে বলে দাও। তার বদলে আমাকে মে*রে ফেলো, বা আটকে রাখো। আমি রাজি।
– সত্যি?
– হ্যাঁ।
– তাহলে আমার বউয়ের পেছনে কেন ঘুরতে?
– কারণ ও আমার বন্ধু।
– মীরাকে ভালোবাসতে না?
– না, বাসতাম না। কখনো বাসিনি। আমাদের মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। ও শুধু আমার বন্ধু। আমি একমাত্র ধরাকে ভালোবাসি, আমার স্ত্রীকে। আমি একসাথে দুজনকে কী করে ভালোবাসব? মীরা আমার ছোটবেলার বন্ধু, বেস্টফ্রেন্ড! বোনের মতো আমার। আমরা এতটা নোংরা না। আমি শুধু ওকে সাহায্য করেছি। সেটা আমার ভুল হলে আমি এখন ক্ষমা চাই।

রাফসান হাতজোড় করে মাথা নিচু করে বসে আছে। অঙ্কন এখনো তাকিয়ে আছে।

– কখনো ভাবিনি এমন অন্যায় না করেও ক্ষমা চাইব। কিন্তু আমি আর পারছি না। আমার ধরাকে দিয়ে দাও।
– আর মীরা?
– ওকেও তুমি নিজের কাছে রেখেছ?
– ধরো, দুজনেই আমার কাছে। যেকোনো একজন কে নিতে পারবে। কাকে নেবে?

রাফসান নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। তারমানে ওরা দুজনেই ওর কাছে আছে। ও দুজনকেই বাঁচাতে চায়। ধরা নির্দোষ, তবে মীরাও দোষী নয়। যেকোনো একজনকে বাঁচানো অন্যায় হবে। রাফসান অনেকক্ষণ ভাবার পর অঙ্কন কে প্রশ্ন করল,

– দুজনেই কী অক্ষত? তুমি ওদের কারো সাথে খারাপ কিছু করোনি তো?
– না। এখনো না। তবে কাকে বাঁচাতে চাও?
– আমি দুজনকেই বাঁচাতে চাই।
– না! তা তো সম্ভব না। যেকোনো একজন।
– আমি চাইবো তুমি কারো ক্ষতি না করো।
– আর?
– ধরিত্রী কে ওর মা বাবার কাছে ফেরত দিয়ে আসো।
– আর মীরা?
– ওর ক্ষতি করো না। তুমি ওর সাথে অনেক অন্যায় করেছ। একসময়ের ভালোবাসা ভুলে এতটা নির্মম কী করে হলে? ওকে দেশবাসীর সামনে এত অপমান কী করে করতে পারলে? আমি না হয় কেউ না। সে তো তোমার স্ত্রী ছিল।
– ও যে আমাকে করল? ওর আমাকে ছাড়া উচিত হয়নি। হোয়াটেভার বাড়ি যাও রাফসান। তুমি যা ডিজার্ভ করো তা পেয়েছ। আর তাই পাবে।

রাফসান এরপর বাড়ি চলে আসে। ও কী তবে ছাড়বে ধরিত্রী কে? এভাবে কয়েকদিন চলে যায়। ধরিত্রীদের বাসার পত্রিকার সঙ্গে একটা কাগজ আসে। জামান তা দেখে সাথে সাথে জোহরা কে ডাকে। অঙ্কন তার কেবিনে বসে ভাবছে, সে কী সত্যি অন্যায় করেছে মেয়েটার সাথে?

ধরিত্রীর জীবনটা তছনছ করার পর অঙ্কনের আরেকটু ইচ্ছে হয়েছিল রাফসানের সাথে খেলার। তাই সে ধরিত্রীকে একটা কল করেছিল। সেদিন সে তার মাকে বলে বেরিয়ে অঙ্কনের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। অঙ্কনের অফিসে ধরিত্রী আর অঙ্কন একান্তে,

– আপনি?
– হ্যাঁ আমিই তোমাকে বলেছি এসব।
– একটা মেয়ের গলা।
– আমার পিএ।
– আপনি জানতেন?
– অনেক আগে থেকেই। তবুও ভালোবাসতাম, অন্ধ ছিলাম। কিছুই বলিনি। সংসার করতে চাইলাম। কিন্তু সে আমার সংসার ভেঙে দিল। কিন্তু রাফসান তোমাকে ছাড়তে পারছিল না। দয়া থেকেই হয়তো।
– দয়া!

ধরিত্রীর গলা ভেঙে আসে। রাফসান ওকে দয়া দেখাতো!
– অর্থাৎ ধোঁকা দিচ্ছিল।
– বলতে তো পারতো।
– পারবে না। আচ্ছা তুমি কী খুশি ওরা যে এক্সপোজ হলো।
– একদম না। আপনি টিভিতে কেন দিলেন?
– আমি ওদের জব্দ করতে চেয়েছিলাম।
– জব্দ তো আমি হলাম। সবাই আমাকে দয়া দেখায়।
– কী আসে যায়। ওরা কাউকে মুখ দেখাতে পারবে না। তবে তুমি চাইলে আমরা ওদের আরেকটু শিক্ষা দিতে পারি।

এই বলে অঙ্কন ধরিত্রীর হাতে হাত রাখলো। ধরিত্রী অঙ্কনের দিকে তাকালো। এরপর নিজের হাত সরিয়ে নিল,

– কী করতে চান?
– আমি আর তুমি তাই করব যা ওরা আমাদের সাথে করেছে।
– স্পষ্ট করে বলুন।
– আমরা নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করব। অভিনয় করব। আমাকে বিয়ের অভিনয় করবে?

ধরিত্রী অঙ্কনের দিকে তাকিয়ে রইল। ও ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। উত্তর কী দেবে?

– কী হলো ধরা?
– দেখুন আপনি হয়তো প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছেন। মাথা ঠিক নেই। আমি আপনাকে বলব এ ধরণের পাগলামি না করতে। আমি রাফসানকে শিক্ষা দিতে ওর মতো নীচে নামতে চাই না। আমি আর ওর সাথে জড়াতে চাই না। মুক্তি চাই আমি।
– কী বলছ ধরা!
– সম্ভব হলে আমাকে এই নামে ডাকবেন না। মীরা আর রাফসান ডাকতো। আমি আর এই জীবনে ওদের মতো বিশ্বাসঘাতক মানুষ চাই না।
– দুঃখিত।

ধরিত্রীর বিষাদ মাখা নয়ন দেখে অঙ্কনের খুব মায়া হলো। এই মেয়েটিকে আজ এই অবস্থায় আনার জন্য সে দায়ী। তার প্রতিহিংসা দায়ী। খুব অন্যায় করে ফেলেছে। একটু পর সে বুঝতে পারল সে হয়তো ধরিত্রীর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। তবে এমনটা ঠিক না। কিন্তু ওর যা নষ্ট করা হয়েছে তা একটু তো ঠিক করা যেতেই পারে।

– আমি তোমার জন্য কী করতে পারি ধরিত্রী?
– আপনি কেন করবেন?
– এই যে একটু তো ভুল করেছি। আমি তোমার একটু উপকার করতে চাই।
– তবে আপনি কী আমাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে পারবেন যেখানে কেউ জানবে না আমি কে। আমাকে কেউ চিনবে না আর চেনা পরিচিত কেউ খুঁজে পাবে না। আমি কিছুদিনের জন্য বাতাসে মিশে যেতে চাই। হাওয়া হয়ে যেতে চাই আমি। কেউ যাতে না জানে আমি কোথায়। আত্মমুক্তি চাই।

অঙ্কন চুপ করে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে তাকে। সত্যি অন্য কারো পাপের ফল ওকে দেওয়া উচিত হয়নি।

– কোথায় যেতে চাও?

(চলবে)

#ধরিত্রী_কথন
#পার্ট৩৪
#পিকলি_পিকু

সকাল সকাল জোহরা বাসে উঠৈছে। একা একাই উঠেছে। আজ জামান নেই। এই দ্বিতীয় বার সে একা ভ্রমণে বের হয়েছে। বিকেলের মধ্যেই সে বান্দরবান চলে এসেছে। সেখান থেকে নেমে সেই কাগজের ঠিকানা অনুযায়ী সে চলে এসেছে সেখানে।

জায়গাটা খুব সুন্দর। বানদরবানের লামায়। পাহাড়ের উপরে একটা আশ্রম। এখানে সবাই ধ্যান করে। মানসিক চাপ থেকে মুক্ত হয়। অনেকেই আছে এখানে। বিভিন্ন দেশের লোক। পাশে একটা এতিম খানা আছে। ধরিত্রী এই জায়গার খোঁজ কী করে পেল? জোহরা খুব ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। হঠাৎ একজন আদিবাসী লোক এসে বলল, “আপনি এখানে কেন আসছেন?”

জোহরা ভয় পেয়ে গেল। অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত লোক। তার শক্ত হতে হবে। তিনি বললেন, “ধরিত্রী আছে? আমার মেয়ে ধরিত্রী। ও এখানে আছে আমি খোঁজ পেয়েছি।”

আরো অনেকে এসে তার কথা শুনে বললেন, “না। নামটা আগে শুনিনি।” তিনি বুঝতে পারলেন, কেউ হয়তোবা মজা করেছে। মন খারাপ করে তিনি চলে যাওয়ার আগেই কাকে যেন দেখলেন। পরিচিত কেউ। তিনি পেছনে ফিরে তাকাতেই দেখলেন কাধ সমান লম্বা চুলের এক মেয়ে। পরনে তার সাদা ঢিলে কামিজ আর পায়জামা। তিনি “চিনি! চিনি!” বলে ডাকতে লাগলেন। মেয়েটি তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। জোহরা দৌঁড়ে গিয়ে ধরিত্রীর গায়ের উপর পড়লো। ধরিত্রী তাকে সামলে বলল,

– মা, তুমি আমাকে খুঁজতে এসেছ?
– হ্যাঁ রে বোকা মেয়ে। একটিবার ও মায়ের কথা ভাবলিনা? এই হতভাগী মা তোর জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিল।
– তুমি ভেতরে চলো। বসো, পানি খাও।

ধরিত্রী কে খুব খুশি দেখাচ্ছে। সে আশা করেনি তার মা এভাবে আসবে। যদি এতই খুশি হওয়ার ছিল তো নিরুদ্দেশ ই বা কেন হলো?

– ওরা যে বলল তুই এখানে নেই?
– কী নাম বলেছ?
– ধরিত্রী।
– এখানে আমি ভিন্ন নামে আছি।
– কী নাম?
– ফারহিন জোহরা। মা আমি আমার পরিচয় বদলে ফেলেছি। আমি এই পরিচয়ে অনেক খুশি। আমার নাম থেকে আমি জামান বাদ দিয়ে ফেলেছি।
– কিন্তু তুই এখানে আমাকে বলবি না? আমি ম*রে যেতাম রে।
– স্যরি মা। আমার তখন মনে হয়েছিল আমি ঐ সমাজে বাঁচতে পারব না। তাই একটু কাপুরুষের মতো পালিয়ে গিয়েছিলাম। তবে এর দরকার ছিল। আমি এখন বুঝতে পারছি। আমি এখন এক অন্য মানুষ।
– আমাকে বলে আসলে কী হতো?
– জানি না। তবে তোমাকে জানাতে চেয়েছিলাম। আর কিছুদিন পর আমি তোমাকেও এখানে আনতে চেয়েছিলাম। এরপর তুমি আর আমি একসঙ্গে এখানে থাকব। জায়গাটা বেশ সুন্দর। মাথা খুব ঠান্ডা থাকে। ফালতু কথা মাথায় আসেই না।

ধরিত্রী নানা কথা বলতে থাকে। জোহরা শুনতে থাকে। জোহরার তো অভিমান করার কথা। কিন্তু সে করছে না। কারণ সে এক নতুন ধরিত্রী কে দেখছে। আগের বিষণ্ণ মেয়েটা থেকে আলাদা। পাগল হয়ে গেছে নাকি? তিনি ধরিত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই সে চুপ হয়ে গেল। এর পর সে তার মাকে বলল,

– কী হয়েছে?
– এই জায়গার, খোঁজ কী করে পেলি?
– এক পরিচিত দিল।
– খরচ?
– বেশি না। আগে উনি ই দিতেন। এখন আমি এই এতিম খানায় পড়াই আর মেডিটেশন শেখানো বাবদ যা পাই তা দিয়ে খরচ হয়ে যায়। তার জন্যই তোমাকেও আনতে চেয়েছি। ঐ লোকটাকে ছেড়ে চলে আস। অনেক শান্তি পাবে।

মা মেয়ে সেখানে অনেক কথা বলল। সারারাত ধরিত্রী ওর মাকে জড়িয়ে ছিল। মায়ের গায়ের গন্ধ নিল। এই উষ্ণতা তার মনে পড়েছিল। কুয়াশাঘেরা সকালে মা মেয়ে হাঁটছে।

– তুই আসার পর আমি অনেক নফল নামাজ পড়েছি, তাহাজ্জুদ পড়েছি। কোরআন খতম করেছি। তুই এলিনা। আমি হতাশ ছিলাম।
– কী করে খোঁজ পেলে?
– তুই বল তো।
– জানি না।
– তোর ঐ পরিচিত লোকটা কী মীরার সাবেক স্বামী, অঙ্কন?

ধরিত্রী চুপ করে রইলো। জোহরা কিছুক্ষণ পর বলল,

– তুই তোর সবচেয়ে বড় শত্রুর সাথেই হাত মেলালি?
– কেউ আমার শত্রু না মা। সবই আমার কপালে লেখা।
– তোর কী একটুও প্রশ্ন জাগলো না যে কেন ও তোকে এত সাহায্য করছে? কেন উপকার করছে? ওর স্বার্থ কী?
– কিছু না মা। ও নিজেও আমার মতো প্রতারিত, তাই।
– আমি যদি বলি কোথাও একটু ভুল হচ্ছে।
– মা প্লিজ। আমি ওসব বিষয়ে আর কিছুই শুনব না। আমি চাই না ওর ব্যাপারে কিছু শুনতে।

ধরিত্রী মুখ ফিরিয়ে চলে যাচ্ছিল। জোহরা ধরিত্রী কে বলল, “যদি বলি রাফসান আর নেই। ও এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছে।”

ধরিত্রী স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মা এসব কী বলছে? রাফসান মা*রা গেছে? জোহরা ধরিত্রীর সামনে এসে দাঁড়ালো। তিনি দেখলেন তার মেয়ের চোখে জল। অজান্তেই সে কাঁদছে। এরপর ধরিত্রী তার মায়ের দিকে তাকালো,

– কীভাবে? ও কী সত্যি নেই?
– কী করতে পারে?

ধরিত্রী তার মুখ চেপে কাঁদতে থাকে। এরপর তার মাকে জিজ্ঞেস করে,

– আত্মহ*ত্যা?
– এরকম অবস্থায় কেউ আত্মহ*ত্যা ই করে। কিন্তু ও হার্ট অ্যাটাক করেছে।
– হার্ট অ্যাটাক!
– এতটা অসহনীয় যন্ত্রণায় সে ছিল। এত অপমান ভৎসর্ণা সহ্য করার পর ওর জীবন ও নিজেই নিয়ে নিত। কিন্তু ও হার্ট অ্যাটাক করেছিল। মৃ*ত্যুশয্যায় সে তার মা কে বলেছিল সে নির্দোষ। এই কাজ সে করেনি।
– আমি যে দেখলাম?
– অনেক সময় চোখের দেখাও ভুল হতে পারে।

ধরিত্রী মাটিতে বসেই কাঁদছে। সে তার দুই পা জড়িয়ে কাঁদছে। জোহরা একটু পর তার পাশে বসে বলল,

– ও বেঁচে আছে। ম*রেনি।

ধরিত্রী জোহরার দিকে তাকালো। তার চোখে অভিমান,

– মা!
– এটা সত্যি ও ম*রেনি, আর এটাও সত্যি যে ও হার্ট অ্যাটাক করেছিল। মরেও যেতে পারতো, কিন্তু বেঁচে আছে।
– তুমি মিথ্যে কেন বললে?
– তুই নিখোঁজ হওয়ার পর আমি প্রতিদিন কোনো না কোনো লা*শ সনাক্ত করতে যেতাম। আমার কেমন লাগতো বল? বুঝেছিস এখন?

ধরিত্রী কিছুই বলে না। কষ্টে সে চোখের জল ফেলে। জোহরা আস্তে আস্তে বলল,

– অঙ্কন তার স্ত্রী মীরা কে মা*রধর করত।
– না, সে খুব ভালোবাসতো।
– না। সব শো অফ। তো শোন।

অঙ্কন আর মীরার পুরো ঘটনা শোনার পর ধরিত্রী থ হয়ে গেল। কিন্তু সে কতো নিষ্পাপ সাজলো। ধরিত্রী আস্তে আস্তে সব বুঝতে পারছে। কিন্তু সে ওদের একই বিছানায় বাজে অবস্থায় দেখেছে।

– আমি ওদের হাতেনাতে ধরেছি।
– ওরা কী হুশে ছিল?
– না।
– অঙ্কন তোকে কী বলেছিল?
– উনি সব জানে। উনিই আমাকে ওদের খোঁজ,

ধরিত্রী চুপ হয়ে যায়। সে বুঝতে পারছে। কিছু একটা গন্ডগোল আছে। জোহরা ধরিত্রীর পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,

– আমি বলব না রাফসান একদম নির্দোষ। ওর কিছু দোষ আছে। অবিশ্বাস আর সম্পর্কে ভাঙন আগে থেকেই ছিল। সম্পর্ক যদি ঠুনকো না হতো তো তুই তৃতীয় কারো কথা শুনে নিজে যাচাই না করে ওর সাথে বসে আগেই কথা বলে নিতি। সম্পর্কের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী জানিস?
– বিশ্বাস?
– না, শব্দ। সেই শব্দ দিয়েই যোগাযোগ তৈরী হয়। শব্দ না হলে ইশারা। সেখান থেকেই আস্থা আসে। তোরা এই ঘটনার অনেক আগে থেকেই কথা বন্ধ করে দিয়েছিলি। তাই একটিবার ও ওকে জিজ্ঞেস করিসনি মীরার সাথে ওর কী ধরণের সম্পর্ক। থাক, যা ছিল তা তোর দোষ না। তাই বলে রাফসান ও এত অপমান হবে না।
– আমি কী করব?
– ওকে ক্ষমা করতে হবে না। আর অঙ্কন, এই ছেলেটাকে জিততে দেওয়া যাবে না।
– আমার পক্ষে সেই মুহূর্তে এটাই সম্ভব ছিল।
– আমি জানি। কিন্তু এখন ফিরে আসার সময় হয়েছে।
– আমি আর আসব না মা।
– তবে তো অঙ্কন জিতে যাবে।

ধরিত্রী চুপ করে থাকে। সেই বিষয়ে তাদের আর কথা হয়নি। জোহরা সেখানে দুইদিন থাকে। দিন শেষে সে ঢাকা চলে যাচ্ছে।

– মা, তুমি ও চলে আসো।
– আবার আসবো। তবে তুই ও আয়।
– আমার এখনো সময় হয়নি। সঠিক সময়ে আসবো।
– তোকে একটা কথা বলিনি। আমি তোর খোঁজ কী করে পেলাম।
– কী করে?
– রাফসান অঙ্কনের কাছে গিয়েছিল। ওকে বলেছিল তোর খোঁজ দিতে। ও বলেছে মীরা আর তোর মধ্যে একজন কে বেছে নিতে।
– মীরা?
– ঐ দিনের পর থেকে ওকে আর দেখা যায় নি। তবে রাফসান তোকে বেছে নিয়েছিল। তার কিছুদিন পরেই আমরা পত্রিকার সঙ্গে একটি চিরকুট পাই। আর তারপর আমি এখানে আসি।

ধরিত্রী তার মায়ের কথা শুনে তার দিকে তাকিয়ে রইলো। এর মানে অঙ্কন ধরিত্রী কে তার অজান্তে ব্যবহার করেছে। মাঝে মাঝেই অঙ্কন তাকে ফোন করে জোহরার খবর দিত, কিন্তু রাফসানের হার্ট অ্যাটাকের খবর দেয়নি। ধরিত্রী তার মাকে হাসিমুখে বিদায় জানালো।

জোহরা ঢাকা নামতেই বাস স্ট্যান্ডে রাফসান কে দেখতে পায়। সে অপেক্ষা করছিল,

– তুমি এখানে কী করছ বাবা?
– আপনি এত দেরি করলেন। আমি বাবার কাছ থেকে জেনে এলাম। উনি তেমন কিছুই বলেননি। ওকে পেয়েছেন?
– হুম। ওখানে লামায় একটি আশ্রমে আছে। তুমি এখানে আসলে কেন? ও দেখলে?
– ওকে দেখলে আমি আগাতাম না মা। ও ভালো আছে?

জোহরার মুখে সব শুনে রাফসান মাথা নিচু করে আছে,

– আপনি ওকে সব বলতে গেলেন কেন?
– দরকার ছিল। মনে করো না যে তোমার কাছে ফেরত যাওয়ার জন্য এসব বলেছি। যাই হোক, জায়গাটা অঙ্কনের পছন্দ করা। সেখানে ও নিরাপদ না।
– মা, আপনি কী আমাকে বিশ্বাস করেন?
– করি। কেন জানো?
– কেন?
– আমি এমনই এক অবিশ্বাসী পুরুষের সাথে বসবাস করছি। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে আমি তার চোখে অপরাধবোধ দেখছি। ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগে। তোমার চোখে আমি সেই অপরাধবোধ দেখি না। তবে তোমাকে আমি পুরোপুরি ক্ষমা ও করব না, দোষারোপ ও করব না।
– আমি অনেক দায়িত্বজ্ঞানহীন একজন মানুষ।
– আমি জানি। আর তুমি সেই বিষয়ে অনুতপ্ত। কিন্তু আমি আমার মেয়ে কে তোমার কাছে ফিরে যেতে বলব না। তবে ধন্যবাদ। তুমি অঙ্কনের কাছে না গেলে আমার মেয়ের খোঁজ আমি পেতাম না।

রাফসান অসম্পূর্ণ এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। কারণ ও এখনো জানে না মীরা কোথায়?

অঙ্কন মাঝরাতে বাড়ি ফিরেছে। সে ঘরে ঢুকতেই কিছু কাজের লোক এগিয়ে আসলো। কোর্ট টা খুলে সে একজনের কাছে দিয়ে ভেতরে আসলো। যেতে যেতে অনেক ভেতরে চলে গেল। তারপর সে একটা হুইলচেয়ার জোরে জোরে টেনে নিয়ে আসলো। তার এই হুইলচেয়ার টানাটানি দেখে সেখানে থাকা এক দেখাশোনার মেয়ে বারণ করছে। একটু পর সে ছেড়ে দিল। হুইলচেয়ারে মীরা বসে আছে। অঙ্কন সেখানে থাকা অন্য মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,

– ডাক্তার এসেছিল?
– হ্যাঁ।
– কী বলল?
– ডান পায়ের ফ্র্যাকচার টা ঠিক হতে সময় লাগবে।
– আর ডান হাত?
– আঙুল গুলো সেরে গেছে, কিন্তু হাত সারতে সময় লাগবে।
– ওকে। আচ্ছা, তুমি চলে যাও। আমরা ঘুমাবো।

মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বেরিয়ে আসে। মীরা চুপ করে থাকে। অঙ্কন কাপড় বদলে এসে মীরাকে উঠিয়ে তার বিছানায় শুইয়ে দিতেই মীরা ব্যথায় চিৎকার করে উঠল। মীরাকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখে অঙ্কন হাসলো,

– কষ্ট হচ্ছে? হোক। তবে জানো, যার জন্য তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছিলে সে তার স্ত্রী কেই চুজ করেছে।
– আমি কারো জন্য তোমাকে ছাড়িনি। ইউ সাই*কো, প্লিজ লিভ মি!
– ছাড়বো না। এত সহজে ছাড়বো না।
– তুমি বলেছিলে, ইউ জাস্ট ওয়ান্ট আ বেবি। এরপর তুমি ওদের বা আমাকে কোনো বিরক্ত করবে না। তুমি আমাকে নিয়ে কেন খেলছ?
– আমি খেলছি না। তুমি খেলছ। তাই তোমার সাথে খেললাম। আমি বলেছি বেবি চাই, তবে এত জলদি না। বেবি দিলেই তুমি চলে যাবে।
– আমার ই ভুল, আমি সেই ব্যাঙের মতো। আমি পারব পারব বলতে বলতে আমার সহ্যশক্তি বাড়িয়েছি। এখন আমি আর কোনো পথ নেই।
– হাহাহাহ! যা খুশি বলো, আমাকে অপমান করা তোমার উচিত হয়নি। আই হেই*ট ইউ ডিয়ার মীরা মোস্তাফা!
– দেন কি*ল মি। এমনিতেই এখান থেকে বের হলে একটা সম্মানের জীবন পাব না। অঙ্কন প্লিজ কি*ল মি।
– তুই বেঁচে থাকবি। তুই দেখবি, আমি কী কী করব তুই দেখবি।
– আমি নিজেই নিজেকে শেষ করে দেব!
– যতবার ম*রতে চাইবি, ততবার তোর একটা একটা হাড্ডি ভাঙবো, আর জোড়া লাগাবো। আমি তোকে একবারে মা*রবো না। তুই বেঁচে থাকবি। হাতে ব্যথা লাগে? না পায়ে বেশি লাগে?

অঙ্কন মীরার ডান হাতের আঘাতে চাপতে চাপতে বলে। মীরা সেই ব্যথায় আর্তনাদ করছে। অঙ্কন মীরার সেই চিৎকার শুনে এক পৈশাচিক আনন্দ পায়। অতঃপর সে মীরার চেহারা স্পর্শ করে। মীরার কষ্টে সে আনন্দ পায়। সে মীরার অশ্রু কে চুম্বন করে। মীরা পদে পদে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভুলটাকে ঠিক করে সে আবার ভুল করেছে। অঙ্কন কে বিয়ে করা বা তার প্রতারণা জেনে তার সাথে থাকাটা ভুল ছিল, সেই ভুল শুধরে তাকে ডিভোর্স দেওয়া ছিল উত্তম সিদ্ধান্ত। দেরিতে হলেও সে বেরিয়েছিল। কিন্তু সেদিন এই দুর্ঘটনার পর মীরা পুলিশ স্টেশনে না গিয়ে অঙ্কনের কাছে গিয়ে আরেকটা ভুল করে ফেলেছিল। সেদিন মীরা রাগের মাথায় অঙ্কনের অফিসে গিয়েছিল,

– তুমি এত নীচ! আমাকে এভাবে রাফসানের পাশে শুইয়ে। ছি! এসব কী করে পারলে?
– কেন আগে ঘুমাওনি ওর সাথে?
– চুপ করো! আমি তোমার মতো নোংরা না। দেখো অঙ্কন, তোমার আমার সমস্যা শুধু আমাদের। তুমি এসব রাফসান আর ধরার মাঝে নিও না। ওদের এমনিতেই অনেক প্রবলেম।
– যা হওয়ার হয়ে গেছে।
– কিচ্ছু হয়নি। ধরাকে সত্যি টা বলে ওকে স্যরি বলো।
– পারবো না।
– অঙ্কন প্লিজ! আমি আর কখনো রাফসানের সাথে দেখা করব না। তুমি ধরাকে সব বলো।
– দেখা করলেই বা কী? তুমি তো আর আমার স্ত্রী নও। আসবে ফিরে?

মীরার মাথা অত্যন্ত গরম হয়ে আছে। কষ্টে ঘৃণায় সে অঙ্কনের টেবিলের উপরের পেপার ওয়েট টা আছাড় মারে। সেই শব্দে অঙ্কন মীরার দিকে তাকিয়ে বলে,

– রাগ হচ্ছে? কষ্ট হচ্ছে? আমার ও হয়েছিল।
– তাই বলে এত নীচে নামবে? দেখ অঙ্কন রাফসান আর ধরা এসবে ছিল না। প্রবলেম তো তোমার আর আমার।
– না। রাফসান ছিল। ওকে শাস্তি পেতে হবে।
– কী করলে তুমি বিশ্বাস করবে রাফসান ছিল না? কী চাও তুমি?

মীরার চিৎকার শুনে অঙ্কন মীরাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– কাম ডাউন।
– প্লিজ অঙ্কন, ওদের একা ছেড়ে দাও।
– আমি যা চাই তা দেবে?
– কী চাও? আমি সব রাজি।
– ফিরে আসো। আমার কাছে ফিরে আসো।

মীরা অঙ্কন কে এক ঝটকায় সরিয়ে বলে,

– অসম্ভব! ঐ নরকে আমি আর যাব না।
– তো তুমি দেখবে আমি আর কী কী করতে পারি।

মীরা নিজেকে সামলে বলল,
– আচ্ছা অঙ্কন, অন্য কোনো উপায় নেই? আমাদের ডিভোর্স তো প্রায় ফাইনাল।
– প্রায়! পুরোপুরি না।
– প্লিজ অন্য কিছু। সেটা আমি মেনে নেব।
– ওকে, তো আমি তোমার দাবি ও মেনে নেব। আমি যখন আমার পাওনা পাব তখন ধরা আর রাফসানকে গিয়ে সত্যি বলে ক্ষমা চাইবো। আর তোমাকে ছেড়ে দেব।
– কী চাও?
– বেবি।

মীরার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কী বলল অঙ্কন এটা?

– মীরা, আমি আমাদের এই কাজী বংশের একজন উত্তরাধিকারী চাই। সেই উত্তরাধিকারী পেতে তোমার চেয়ে বেটার অপশন আর কেউ নেই। তুমি সুন্দরী, বুদ্ধিমতী। ইউ হ্যাভ গুড জিনস। আমরা অনেক ভালো একটা সন্তানের জন্ম দিতে পারি।
– আর ইউ ইনসেইন! বাচ্চা জন্ম দিলেই হয় না। তাকে লালন পালন করতে হয়। আমি তোমার মতো কোনো পাগলের সন্তান চাই না। তোমার মতো একটা পাগলের কাছে কী মানুষ হবে!
– সেটাই। তাই তো তোমাকে চাই। তুমি আমাকে একটা বেবি দেবে। তার লালন পালন করবে। তোমার মতো করেই করবে।
– অসম্ভব! আমি তোমার সাথে এক মুহূর্ত ও থাকবো না। তোমার আমাকে কী মনে হয়?
– মীরা, আমার তোমার গর্ভটা চাই। এই গর্ভেই আমার সন্তান আসবে আমি তার স্বপ্ন দেখেছি। নইলে আমি সারোগেসিতেই যেতাম। কিন্তু ঐ যে বাজারের মেয়েরা কে কেমন। ওরা নেশা টেশা করে। আর আমি আমাদের প্রপার একটা বাচ্চা চাই। আমাদের বাচ্চা। কারণ তোমাকে তো চিনি। হয়তো একটু ভুল করেছ। কিন্তু মানুষ তুমি ভালো।
– তোমাকে আমি যতটা ঘৃণা করি, প্রতি সেকেন্ডে তার দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে। এতটা নোংরা কেউ কী করে হতে পারে!
– তাহলে যেতে পারো। আমি ধরাকেও কিছু বলব না, আর তুমিও মুখ দেখাতে পারবে না। শুধু শুধু এতগুলো জীবন নষ্ট হবে। কিন্তু তুমি যদি আমার সন্তানের জন্ম দাও, আই প্রমিস, আমি তোমাকে এখান থেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেব। বাচ্চাকে তুমি তোমার মতো বিদেশে মানুষ করবে শুধু উত্তরাধিকারিত্ব গ্রহণের সময় সে দেশে আসবে। আমি তোমাকে বা রাফসানকে কোনো বিরক্ত করব না। তোমরা মুক্ত। আমার শুধু একটা উত্তরাধিকার চাই যার মা তুমি।

মীরা আবার একটা ফাঁদে পড়ে গেল। অনেক বড় একটা বোকামি। ওর মতো মেয়ে এই ফাঁদে কেন পড়লো ও নিজেও জানে না। এবার এই ফাঁদ থেকে বের হওয়ার আর কোনো পথ নেই। অঙ্কনের অত্যাচার দিন দিন অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। অঙ্কন সবসময় জিতে যায়।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here