#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -১৭,১৮
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
১৭
তিতিশা কে পড়ানো শেষ করে ওদের ড্রইং রুমে বসে আছি। আরিয়ানা আপু নাকি আমাকে অপেক্ষা করতে বলেছেন। তিতিশা ও আমার পাশে বসে আছে। আর একটু পর পর চাচ্চু চাচ্চু বুলি আওড়াচ্ছে। এই মেয়ে কি চাচ্চু ছাড়া আর কিছুই বুঝে না? যেভাবে বলে মনে হয় যেন ওর চাচ্চু একদম সেরা। তিতিশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম,,,,
—এতো কথা বলতে নেই বাবু।
—মিস আমি তো চাচ্চুর কথা বলছিলাম। তুমি জানো চাচ্চুর মোবাইলে না তোমার ছ,,,,,
আরিয়ানা আপু কে আসতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলাম আমি । তিতিশা ও তার কথা অসমাপ্ত রেখে ছুটে গেল আরিয়ানা আপুর কাছে। ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম আরিয়ানা আপুর সাথে সুদর্শন একটা লোক ও এগিয়ে আসছেন এদিকে। লোকটা কে আমার পরিচিত মনে হচ্ছে। একবার প্রিয়ুদের বাসায় নিউজে দেখেছিলাম তাকে। হম,,,ওনি তো বিখ্যাত রাজনীতিবিদ তোহাশ চৌধুরী। ওনি এখানে কি করছেন? তিতিশা লোকটা কে ঝাপটে ধরল ” বাবাই” বলে। বুঝতে আর বাকি রইল না ইনি তিতিশার বাবা। ভাবতেই পুরো শরীর অসার হয়ে আসছে এতো বড় একজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে অবস্থান করছি আমি এ মুহুর্তে । নার্ভাস ফিল হচ্ছে খুব বেশি। তিতিশা কে কোলে নিয়ে সামনে র সোফায় বসলেন আরিয়ানা আপু ও তোহাশ চৌধুরী। আমার দিকে এক নজর তাকিয়ে ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে বললেন,,,,
—আসসালামু আলাইকুম। আমি তিতিশার বাবা।
ওনার কথায় ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেলাম আমি। সালাম টা আমার দেওয়া উচিত ছিল কিন্তু ঘাবড়ানোর জন্য হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম। ঠোঁটে হাসি বজায় রেখেই তিনি বললেন,,,
—এতোদিন বাড়ির বাহিরে ছিলাম আমি একটা কাজে। আজ বিকেলেই ফিরেছি। আরিয়ানার কাছে জানতে পারলাম তুমি তিতিশার নিউ টিউটর। আমার মেয়ে ও বিকেল থেকে তোমার বিষয়ে অনেক বার বলছিল। খুব পছন্দ হয়েছে ওর তোমাকে। আমার কাছে আবদার করল আর কারো কাছে কখনও পড়বে না সে। পড়লে শুধু তোমার কাছেই পড়বে। এ প্রথম কোনো টিউটর কে এতো পছন্দ হয়েছে তিতিশার। আমি ও আরিয়ানা একটা বিষয়ে ভেবেছি খানিক সময় আগেই। এখন দেখা যাক তোমার সিদ্ধান্ত কি হয়!
—জ্বি বলুন স্যার।—(মৃদু কন্ঠে বললাম আমি)
হেঁসে উঠল আরিয়ানা আপু্। ওনার এই হাসির কারণ আমি ঠাহর করতে পারছি না। হালকা হেসে স্যার বলে উঠলেন,,,
—স্যার ডাকার প্রয়োজন নেই শ্রেয়সী। আমি তোমার বড় ভাইয়ের মতো। তুমি বরং আমায় ভাইয়া বলে ডেকো।
চোখ দুটো ছলছল করে উঠল । এ বাড়ির মানুষগুলো এতো ভালো কেন? অপরিচিত একটা মেয়েকে অবলীলায় কেমন আপন করে নিয়েছে।ধরা গলায় বললাম,,,
—বলুন ভাইয়া।
— তুমি তো জানো শখের বসে আরিয়ানা একটা স্কুলে জব করে। মাঝে মাঝে স্কুল মিটিং বিভিন্ন কাজে তার বেশিরভাগ সময় বাহিরে কেটে যায়। তাছাড়া আমাদের অফিসের কাজে ও হেল্প করে অনেক যার জন্য তিতিশার সাথে খেলার অথবা ঘুরার সময় হয়ে উঠে না। অবশ্যই প্রত্যেক সপ্তাহে একবার ঘুরা হয় মেয়েটা কে নিয়ে তবুও ওর পাশে চায় কাউকে সারাক্ষণ। আমি খেয়াল করেছি মেয়েটা খুব মিশে গেছে তোমার সাথে অথচ অন্য কাউকে দেখলেই লুকিয়ে থাকতো । মেইন কথায় আসি। তোমার জন্য একটা জব অফার আছে।
তোহাশ ভাইয়ার কথায় চমকে উঠলাম আমি।জব অফার মানে!! জব! একটা জবের তো ভীষণ প্রয়োজন আমার। সাবলীলভাব বজায় রেখে জিজ্ঞেস করলাম,,,
—কেমন জব ভাইয়া?
— আমার মেয়ের সাথে থাকার জব। মানে তিতিশার সাথে সাথে থাকবে। ওকে পড়াবে। ওকে নিয়ে মাঝে মাঝে ঘুরতে যাবে। আর তার জন্য তোমাকে চব্বিশ ঘন্টাই আমাদের বাসায় থাকতে হবে। স্টাডি করবে তাতে আমাদের কোনো প্রবলেম নেই। তিতিশা খুশি হলেই চলবে আমাদের।
আরিয়ানা আপু ও মুচকি হেসে বললেন,,,,
—রাজি হয়ে যাও শ্রেয়া। তুমি এ বাড়িতে থাকলে আমাদের মেয়েটা খুব খুশি হবে। সাথে এ বাড়ির বাকি মেম্বার ও।
একটা আশ্রয়ের, একটা জবের খুব প্রয়োজন ছিল আমার।আজ সন্ধ্যার দিকেই জানতে পারলাম রীতি আপুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। কালই চলে যাবেন ওনি বাসা ছেড়ে।ওনি চলে গেলে কিভাবে থাকব আমি একা বাসায় সেটা ভাবতেই খুব ভয় করছিল আমার। তার চেয়ে বড় কথা আমার একার পক্ষে পুরো ভাড়া টা দেওয়া কখনো পসিবল না। এমন সময় এতো ভালো একটা জব পাওয়া এতো ভালো একটা বাড়িতে থাকতে পারাটা আমার জন্য না চাইতেও বিরাট এক পাওয়া। তবুও মনে কিছুটা সংকোচ নিয়ে জবাব দিলাম,,,,
–আমি ভেবে দেখব ভাইয়া।
—ঠিক আছে।
।
।
ক্যাম্পাসে বেলীফুল গাছটার নিচে পাতানো বেঞ্চ টা তে বসে আছি আমিও প্রিয়ু। এসাইনমেন্টের চিন্তায় মগ্ন দু’জন। এক গাদা এসাইনমেন্ট দিয়েছেন টিচার। ফিজিক্স সাবজেক্ট বরাবরই আমার শত্রু। কেন যে এই সাবজেক্ট টাই জুটল আমার কপালে। স্যার কড়া গলায় বলে দিয়েছেন কারো সাথে মিলতে পারবে না কারো এসাইনমেন্ট । এক তো সবকিছু এতো কঠিন কোনো প্রাইভেট ও পড়ি না আমি তার ওপর স্যারের দেওয়া এসাইনমেন্ট। প্রিয়ু ও হতাশ হয়ে বসে আছে। একদমই মানতে পারছে না সে এসব এসাইনমেন্টের প্যারা। গালে হাত দিয়ে বসে আছি দুজন। আচমকা কারো কন্ঠ শুনে হতাশার ভাবনা ছিঁড়ে বেরিয়ে এলাম দু’জন। চেয়ে দেখলাম সম্মুখে আয়ুশ ভাইয়া দাড়িয়ে।তার থেকে কিছু টা দূরে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে তূর্য চৌধুরী। কাল আমায় জোর করে আইসক্রিম খাইয়ে কি সুন্দর করে সং সেজে দাড়িয়ে আছেন জনাব। এই লোক একদিন আমায় মেরেই হয়তো দম নিবেন।
—কোনো সমস্যা জেরি?
–বিশাল বড় সমস্যা ভাইয়া।–লাফিয়ে উঠে বলল প্রিয়ু।
প্রিয়ুর কান্ডে হেসে দিল আয়ুশ ভাইয়া। প্রিয়ুর চেহারাতে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে উঠলেন,,,
— তা কি সমস্যা ম্যাডাম?
অভিশঙ্কায় পড়ে গেল প্রিয়ু। আমতা আমতা করে বলল,,,
—ওই তো এসাইনমেন্টের প্যারা ভভভাইয়া।
—ওহ আচ্ছা! এটা প্যারার কি হলো?
—বিষয় টা খুব কঠিন তো। আমরা কিভাবে করবো বলুন।কেমন কঠিন কঠিন সবকিছু। –ঠোঁট উল্টিয়ে বলল প্রিয়ু।
প্রিয়ুর কথার ধরনে হেসে উঠলাম আমি ও আয়ুশ ভাইয়া। দূর থেকে আমাদের দিকে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছেন তূর্য। হাসি থামিয়ে ওনার দিকে তাকাতেই সেখান থেকে চলে গেলেন ওনি। কি হলো! এভাবে চলে গেলেন কেনো! প্রিয়ুর দিকে তাকিয়ে আয়ুশ ভাইয়া বলে উঠলেন,,,
—ন্যাকা রাণী কান্না করার একদম দরকার নেই। চোখের জল গুলো এভাবে ছোট্ট একটা কারণে বিসর্জন দিলে চলে বলো? একদম চলে না। আপাতত এসাইনমেন্টের কথা একদম ভুলে যাও। হতে পারে কাল কোনো সারপ্রাইজ ও জুটতে পারে তোমার ভাগ্যে।
কথাটা বলে সোজা চলে গেলেন আয়ুশ ভাইয়া। ওনার কথাগুলো বুঝা খুবই কষ্টকর। কেমন যেন রহস্য লুকিয়ে থাকে। আর কথা না বাড়িয়ে পরবর্তী ক্লাসের জন্য পা বাড়ালাম দু’জনে। সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই তূর্য ভাইয়ার দেখা মিলল। বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মত্ত জনাব। পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে শুভ্রপরী বলে ডেকে উঠলেন তিনি।পা দুটো থমকে গেল মুহূর্তেই। কাছে এগিয়ে এসে মুখে হাসি টেনে প্রিয়ু কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,,
—তুমি ক্লাসে যাও প্রিয়ুৃ। শুভ্রপরীর সাথে আমার কিছু কথা আছে। বুঝোই তো! আশা করি শালী হয়ে দুলাভাইয়ের বিরোধ হবে না তুমি।
ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকিয়ে রইলাম আমি ওনার দিকে। বলে কি এই লোক! সবার সামনে এমন পরিস্থিতিতে প্রচন্ড লজ্জা লাগছে আমার। প্রিয়ুর হাত ধরতেই আমার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল প্রিয়ু্। উৎসাহিত কন্ঠে বলে উঠল,,,
— অবশ্যই নিয়ে যাবেন ভাইয়া। এই নিন আপনার শুভ্রপরী। আপনার আর আপনার শুভ্রপরীর মাঝে আপনার ছোট্ট কিউট শালী টা কখনও আসবে না। আমি তাহলে চললাম ভাইয়া।
কথাটা বলেই এক দৌড়ে প্রগাঢ়পাড় প্রিয়ু। কোনো উপায় না পেয়ে দ্বিধা নিয়ে থমকে রইলাম আমি। সামনে তাকাতেই দেখলাম ওনার বন্ধুরা ও নেই। উনি ঠোঁট দুটো প্রসারিত করে চেয়ে আছেন আমার দিকে। সাদা শুভ্র ওড়না টা টেনে মাথায় দিয়ে দিলাম ভালো করে। হাতটা ও কেমন কাঁপছে থরথর করে। কম্পনরত স্বরে মাথা নিচু রেখেই বললাম,,,
—কিছু বলবেন?
—অনেক কিছু বলব। চলো আমার সাথে।
—কোথায়?
—আমার প্রতি বিশ্বাস নেই শুভ্রপরী?
—এখানে বিশ্বাসের কথা আসছে না। আমার ক্লাস আছে তো তাই বললাম।
—আজ কোনো ক্লাস করতে হবে না।
কথাটা বলেই তূর্য আমার হাত ধরে বাইকের কাছে নিয়ে এলেন। নিজে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে ইশারা করলেন আমাকে উঠতে। আমি আজ পর্যন্ত বাইকে উঠি নি। ওনি আবার বলতেই কাঁপা কাঁপা হাতে ওনাকে ধরে বসলাম আমি কিছু টা দূরত্ব রেখে। তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলেন ওনি,,
—এভাবে ধরলে তো পড়ে যাবেন। ভালো করে ধরুন।
ওনার কথায় কোনো ভাবান্তর হলো না আগের মতোই ধরে রাখলাম। বাইক চলতেই ভয়ে তৎক্ষণাৎ ওনার কাঁধে খামচে ধরলাম আমি। বাঁকা হাসি দিয়ে বলল তূর্য,,
—যতই চেষ্টা করো দূরে থাকার ততই নিজ থেকে সন্নিকটে আসবে আমার।
।
।
বাইক বেরিয়ে আসল শহর থেকে। গ্রামের আকা বাঁকা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে একবার ও বাইক থামান নি তূর্য। বসে থাকতে থাকতে আমার কোমড় টাও ব্যাথা করছে। মাথা এলিয়ে দিলাম তূর্যর পিঠে। বাতাস এসে ছুয়ে যাচ্ছে আমাদের শরীরে। ভালো করে তাকাতেই খেয়াল করলাম এটা আমাদের গ্রাম। দু বছর হয়ে গেছে এখানে আর আাসা হয় নি। কার সাথে আসতাম? বাবা যে আম্মুর মতো আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন আমার বিয়ের এক মাসের মাথায়। তূর্য কেন আমায় এখানে নিয়ে আসলেন? জানার আগ্রহ টা নিজের মাঝে দমিয়ে আশ পাশ টায় চোখ বুলালাম আমি। গ্রাম টা আগের চেয়েও খুব সুন্দর হয়ে গেছে। বড় বড় সবুজ গাছপালা গুলো একদম চোখ জুড়ানোর মতো। বিশাল এক জাম গাছের নিচে এসে বাইক থামালেন তূর্য। এ দিক টা একদম খোলামেলা। আশেপাশে কোনো বাড়ি ঘর নেই। কাঁচা রাস্তা। জাম গাছ টা দেখেই মনের মধ্যে বছর দু খানেক আগের স্মৃতি জাগ্রত হলো।
সেদিন বৃষ্টি ছিল। ঝুম ঝুম বৃষ্টিতে পাশের বাড়ির মণি খালার মেয়ে সিমা,,,মণি খালার ছোট ছেলে নাহিদের সাথে এসেছিলাম এই জামতলায়।
আমি গাছের নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই তূর্য বাইক এক সাইডে রেখে আমার নিকটে এসে দাঁড়ালেন। হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। অনায়াসে দ্বিধাহীন ভাবে ওনার হাতে নিজের হাতটা রাখলাম আমি। সাথে সাথেই মনের সবটা জুড়ে বয়ে গেল শীতল স্রোত। জাগ্রত হলো কঠিন বাস্তবতার ভিড়ে চাপা পড়ে থাকা অনুভূতিগুলো। হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা দূরে চলে এলাম আমরা। দূর থেকেই দেখা যাচ্ছে গ্রামের ছোট্ট রিসোর্ট টা। গ্রামের প্রভাবশালী ব্যাক্তিরা মিলে এই রিসোর্ট টা দিয়েছেন যেন দূর থেকে কোনো মানুষ আসলে রাত টা অবস্থান করতে পারেন। এখন মানুষের আনাগোনা হয়তো তেমন একটা নেই। খুব কম সংখ্যকই পর্যটক এখানে আসেন গ্রামের প্রকৃতি উপভোগ করতে। বাবার সাথে এসেছিলাম রিসোর্টে। ওনার এক বন্ধুর ছেলে এখানকার মেনেজার ছিলেন তখন। রিসোর্টে প্রবেশ করতেই খুব অবাক হলাম আমি। আগের চেয়েও খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে জায়গাটা। আমরা ঢুকতেই বাবার সেই কথিত বন্ধুর ছেলে সামনে এসে দাড়ালেন। তূর্যর সাথে হাত মিলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,,
—কেমন আছেন ভাবী?আসতে কোনো সমস্যা হয় নি তো।
ছেলেটার ভাবী ডাকে বুকে হাঁতুড়ি পিটা শুরু হলো প্রচন্ড জোরে জোরে। শব্দটা হৃদয়ে এসে বিঁধল প্রচন্ড বেগে । মনে হয় যেন স্বপ্নে আছি আমি। লজ্জায় তূর্যর টি শার্টের কোমড়ের কাছের কিছু অংশ হাতের মুঠোয় টেনে ধরলাম একটু জোরে। আমার মুখের দিকে এক পলক তাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,
—তোর ভাবী খুব লজ্জা পাচ্ছে। ছোট তো। এতো দূর থেকে এসেছি খুব ক্লান্ত। রেস্ট নিতে চাই।
তূর্যর এমন কথায় লজ্জা -শরম আঁকড়ে ধরল আমায় আরো তীব্র গতিতে। ওনার বন্ধু এক গাল হেসে বললেন,,,
–অফ কোর্স দোস্ত। তোরা রুমে যা। আমি খাবার পাঠাচ্ছি।
।
।
রুমে এসে হাত মুখ ধুয়ে খাটে বসে রইলাম আমি। রুমটা বেশ সুন্দর। কাঠের তৈরি এই ছোট রিসোর্ট টা দেখে মুগ্ধ হবে মানুষ। আসবাবপত্র গুলো সব কাঠের। কিন্তু আমরা কেন এখানে এসেছি? কেন তূর্য এখানে নিয়ে এলেন আমায়? তূর্য ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আমি কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হবো তখনই হুট করে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন তূর্য। হতবাক হয়ে পড়লাম আমি। হাত দু’টো নাড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেললাম। আমার হাত দুটো নিয়ে মাথায় রাখলেন ওনি। ক্লান্ত স্বরে উচ্চারতি করলেন,,,
–মাথা টা খুব ব্যাথা করছে শুভ্রপরী। একটু টিপে দিবা?
সামান্য একটা আবদারে স্তব্ধতা ছেয়ে গেল আমার মন জুড়ে। ক্লান্ত স্বর অথচ তাতে ও কতো ভালোবাসার মিশ্রণ। আলতো হাতে ওনার কপালে টিপে দিতে লাগলাম আমি।উল্টো হয়ে আমার পেটে মুখ গুজে দিলেন তূর্য। নিমিষেই ড্রাম বাজার শব্দ করে উঠল আমার হৃদপিণ্ডে। আকস্মিক এমন এক হামলায় ঝিকে উঠল আমার মন -প্রাণ, দেহ। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে এলো আবেশে। হারিয়ে ফেললাম কথা বলার শক্তিটুকুও। খাবার আসতেই আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লেন তূর্য। দরজা মেলার আগে আমার মাথার ঘোমটা টা দিতে ইশারা করলেন তিনি। দরজা খুলতেই একজন লোক খাবার দিয়ে গেলেন রুমে। প্লেটে খাবার নিয়ে বিছানায় এসে বসলেন তূর্য । আমিও গুটি শুটি মেরে বসে রইলাম এক কোণায়। আমার ও খিদে লেগেছে খুব বেশি। সেই সকালে খেয়েছি এখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল প্রায়। উঠতে নিব তখনই তূর্য ডেকে উঠলেন,,,
—কোথায় যাচ্ছো শুভ্রপরী?
থমকালাম আমি। ওনার দিকে তাকিয়ে সংকোচ নিয়ে বললাম,,,
–খাবার আনতে।
—এদিকে এসো।
–জজজ্বি??
–এদিকে আসতে বলেছি।
কাঁপা কাঁপা পায়ে ওনার থেকে কিছুটা দূরে বসতেই আমার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরলেন ওনি। অশ্রু এসে ভীড় জমালো আমার চক্ষুতে। ওনার কেয়ার গুলো খুব পুড়ায় আমায়। যখন দূরে থাকি খুব মিস করি এই কেয়ার গুলো। ইচ্ছে করে কখনও দূরে না যাই। মিশে থাকি একদম ওনার সাথে যেন এই কেয়ার গুলো আমার নামে হোক প্রতিদিন প্রতিটা সময়। খাবার টা মুখে পুরে নিলাম আমি। কে বলবে এ মানুষ টা রুড বিহেভ করেছে আমার সাথে? অতিরিক্ত রাগী হলেও মানুষ টা অতিরিক্ত ভালোবাসে আমায় । তবুও একটা কষ্ট একটা আক্ষেপ থেকে যায় মনের কোণায়!!! আর পারছি না চেপে রাখতে মনের মধ্যে। এক ফোঁটা জল গড়িয়ে গেল গাল বেয়ে।
।
।
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছি নীরবে। তূর্য নিচে গিয়েছেন কোনো একটা কাজে। সামনের দিকে তাকিয়ে আছি এক নজরে। এক জোড়া প্রেমিকযুগল হয়তো বা নতুন দম্পতি হাতে হাত রেখে বসে আছে দোলনায়। একটু পর পর হেসে উঠছে মেয়েটা। বেশ ভালো মানিয়েছে তাদের। এক উত্তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসতেই পেটে কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠলাম আমি। নিঃশ্বাস ভারি হয়ে আসতে লাগল ক্রমশ। মানুষটার গরম শ্বাস আঁচড়ে পড়ছে ঘাড়ে, কানে।কানের কাছে স্লো ভয়েসে বলে উঠল মানুষ টা,,,
–এখানে কেন নিয়ে এসেছি জানতে চাও না শুভ্রপরী?( ঘোর লাগা কন্ঠে)
—চাই।–একদম নিচু স্বরে জবাব দিলাম আমি ।
সাথে সাথেই আমাকে কোলে নিয়ে রুমে নিয়ে আসলেন ওনি। বিছানায় বসিয়ে ফ্লোরে হাটু মুড়ে বসে আমার কোলে মাথা রেখে বলে উঠলেন,,,
–আজ এখানে নিয়ে এসেছি তোমায় পরিচয় করাতে আমার হৃদয়ে সুপ্ত অনুভূতি গুলোর সাথে। আজ জানাতে চাই এক বৃষ্টিস্নাত কন্যা কিভাবে মিশে গেছে আমার অস্তিত্বে।
কথাটা বলেই আমার মুখের দিকে তাকালেন তূর্য। চোখ দুটো ছলছল। রক্তিম আভা ছেয়ে আছে দু নয়নে। উহু, রাগের নয় কোনো এক চাপা কষ্টের স্বাক্ষী এই লাল বর্ণ।
চলবে,,,
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)
#তোমাতেই পূর্ণ আমি
#পর্ব -১৮
#লেখিকাঃআসরিফা সুলতানা জেবা
বন্ধুদের সাথে তিন দিনের ট্যুর শেষে ঢাকায় ব্যাক করছি আজ। বাহিরে তুমুল বেগে বর্ষণ হচ্ছে। মাঝ পথে এমন এক বর্ষণের শিকার হবো ভাবতেই পারি নি আমরা। সকাল বেলা ও কড়া রোদ্দুর ছিল প্রকৃতি জুড়ে। মাঝ রাস্তায় ঝুম বৃষ্টি তার উপর রাস্তায় বড় এক বট গাছ উপরে পড়ে আছে। পুরো রাস্তায় ব্লক হয়ে গেছে গাছটা পড়ে। সরাতে প্রায় ঘন্টাখানেক লাগবে। এই ঘন্টাখানেক কোনোভাবেই এই বর্ষার মাঝে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তখনি ফুহাদ উতসাহিত কন্ঠে বলে উঠল,,,
—দোস্ত এদিকে খানিক টা দূরে গ্রাম সাইডে একটা রিসোর্ট আছে। আজ নাহয় এখানেই থেকে যায় আমরা। শুনেছি গ্রামের এই ছোট খাটো রিসোর্টের পরিবেশ টা খুবই মনোরম।
ফুহাদের কথায় সম্মতি জানিয়ে গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলাম গ্রামের কাঁচা রাস্তা দিয়ে রিসোর্টের দিকে। রাস্তায় কাঁদার ছড়াছড়ি। গাড়ি ও আর সামনে নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। বাকি পথ নাকি হেঁটেই যেতে হবে। মেজাজ খারাপ হয়ে এলো আমার। জীবনে কখনও গ্রামে আসি নি। তার উপর এই কাঁদা তে হাটতে ভীষণ রাগ হচ্ছে আমার। ফুহাদ কে গালি দিতে দিতে গাড়ি এক সাইডে রেখে হাঁটতে হাঁটতে একটা জাম গাছ থেকে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালাম সবাই। ভিজে বেহাল অবস্থা সবার। তবে বৃষ্টি আমার পছন্দ। খুব বেশিই পছন্দ। সামনে এগিয়ে যেতেই একটা মেয়ের কন্ঠ শুনে থমকে গেলাম আমি। শুভ্র রঙের থ্রি পিছ পড়া একটা মেয়ে। পিছন টা দেখা যাচ্ছে শুধু। গায়ের জামা টা ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে। খালি পা দুটো কাদায় মাখামাখি। সাথে একটা ছেলে ও একটা মেয়ে। জাম গাছের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। মনে তীব্র আগ্রহ জাগ্রত হলো মেয়েটার চেহারা টা এক পলক দেখার। তিহান,,ফুহাদ,,আয়ুশ চলে গেলেও দাঁড়িয়ে রইলাম আমি অধীর আগ্রহ নিয়ে। জীবনে প্রথম কোনো মেয়ে দেখে থমকেছি। মেয়েটার মুখশ্রী না দেখেই পাগল প্রায় আমি। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন মেয়েটার মুখশ্রী দর্শন হলো না তখন এক রাশ হতাশা নিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালাম আমি। মন কে মানাতে না পেরে মস্তিষ্কের বিরুদ্ধে গিয়ে এক পলক পিছন ফিরে তাকাতেই বুকের বা পাশ টা ধুক করে উঠল প্রচন্ড বেগে । উত্তাল ঢেউ গর্জে উঠলো হৃদয় কুঠিরে। চোখে ভাস্যমান এক বৃষ্টিস্নাত কন্যা যে এক নিমিষেই বর্ষণ হয়ে আঁচড়ে পড়ছে আমার মন, হৃদয়, মস্তিষ্কে। মুহূর্তেই চারদিক অন্ধকার মনে হতে লাগল আমার কাছে। প্রকৃতির মাঝে এক শুভ্রপরী ব্যাতিত কিছুই দৃশ্যমান হচ্ছিল না আমার দু নয়নে। এক অজানা ভ্রম, এক অজানা ঘোর ঘিরে ধরল । সেখানে আর এক সেকেন্ড ও না দাড়িয়ে চলে এলাম রিসোর্টে।
রিসোর্টে আসতেই জানতে পারলাম আমাদের কলেজ লাইফের পরিচিত এক বন্ধু এখানকার মেনেজার। এ গ্রামেই তার বসবাস। বিকেলের দিকে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে মগ্ন ছিলাম সেই শুভ্রময়ীতে। হঠাৎ চোখের সামনে আবারও ভেসে উঠল সেই মেয়ে। কল্পনা ভেবে বেলকনিতে থেকে নিচে এসে বাগান এড়িয়া তে যেতেই আবারও সেই শুভ্র কন্যা। এবার সাদা নয় কালো এক ড্রেস পরিহিত মেয়েটা। একটা লোক এসে মেয়েটা কে তাড়া দিতেই মুচকি হেসে লোকটার সাথে চলে গেল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আমি। মেয়েটা আমার হৃদয়ে যার পিছনে মেয়েরা ঘুরে বেড়ায় সেই তূর্য চৌধুরীর হৃদয়ে প্রখরভাবে ঘায়েল করেছে,,স্পর্শ করেছে। মেয়েটা কে আমার চাই ই চাই। মেয়েটা কে ছাড়া নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছিল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল। আমার সেই ফ্রেন্ড কে জিজ্ঞেস করতেই জানালো মেয়েটা ওদেরই গ্রামের। ঢাকা তে থাকে। নাম শ্রেয়সী। ব্যাছ এতটুকুই এনাফ ছিল আমার জন্য। বাকি ইনফরমেশন বের করা আমার কাছে কঠিন কিছু ছিল না।
ঢাকা ব্যাক করার পর থেকেই প্রতিদিন সকাল বিকাল নিয়ম করে আড়ালে দাঁড়িয়ে শুভ্রপরী কে এক নজর দেখার জন্য ছুটে যেতাম সব ফেলে। রাত জেগে চিরকুট লিখতাম আমার হৃদয়স্পর্শীর নামে। নিদ্রা আমার দু চোখে কোনোভাবেই ধরা দিত না।সারাক্ষণ শুধু চিন্তা লেগেই থাকতো কবে আমার শুভ্রপরী কে বন্দী করতে পারব আমি নিজের বাহুডোরে। সিদ্ধান্ত নিলাম শুভ্রপরীর ফাইনাল এক্সাম শেষে একেবারে নিয়ে আসবো নিজের কাছে। আড়ালে থেকে শুভ্রপরী কে প্রটেক্ট করে ও এক কুত্তার বাচ** হাত বাড়িয়েছে আমার কলিজায়। পুরো এক ঘন্টা ইচ্ছে মতো মেরেছি জানোয়ার টা কে। যে হাতে স্পর্শ করেছে আমার হৃদপিণ্ডে সে হাত অক্ষম করে দিয়েছি আমি। কোনো ছেলেকে কাছে ঘেষতে দেয় নি আমার শুভ্রময়ীর । শুভ্রপরী থেকে দূরে থাকা টা প্রতিনিয়ত রক্ত ঝরাচ্ছিল আমার মনে। দহন হতো আমার হৃদয়ে তবুও নিজেকে সামলে রেখেছি তাকে নিজের করে পেতে। কিন্তু কখনও ভাবি নি আমার শুভ্রপরী-ই আমার হৃদয়ে আঘাত হানবে এতো কঠোরভাবে।ক্ষত বিক্ষত করে দিবে আমার মনটা কে। ধোকা দিয়ে হয়ে যাবে অন্য কারো।
।
।
তূর্যর মুখে সবকিছু শুনে থম মেরে বসে রইলাম আমি ।কিন্তু শেষ বাক্যটা আমার হৃদয়ে এসে বিঁধল করুনভাবে। মুহুর্তেই চোখ থেকে গড়িয়ে পড়তে লাগল অজস্র অশ্রুকণা। ডুকরে কেঁদে উঠলাম আমি। তাড়াতাড়ি করে নিজের বাহুতে আমায় আগলে নিলেন তূর্য। তূর্যর বুকে মাথা রেখে কান্নায় দলা কাঁপানো কন্ঠে বললাম,,,
–আমি আপনাকে ধোঁকা দেয় নি তূর্য। আপনাকে ধোঁকা দেয় নি আমি। আপনার শুভ্রপরী মরে যাবে তবুও আপনায় ধোঁয়া দেওয়ার কথা ভাবতেই পারে না। আমি নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি আপনাকে। আপনার হৃদয় কুঠিরে যেমন আমি শুভ্রপরী হিসেবে বিরাজ করছি তেমনি শুরু থেকেই আপনি আমার হৃদপিন্ডে চিরকুট লেখক হয়ে বিচরণ করছেন। আপনাকে ঠকানো আমার সাধ্যের বাহিরে তূর্য।
তূর্যর চোখে ও অশ্রু। শ্রেয়া কে শক্ত করে জরিয়ে নিয়ে বলল,,,
—তাহলে তুই কিভাবে আমার না হয়ে অন্য কারো হলি?তুই কি আমার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারিস নি? তোকে ছাড়া পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম আমি । নিঃশ্বাস নেওয়া টা ও দায় হয়ে পড়েছিল। তোকে আমার ভালোবাসায় বন্দিনী বানাতে গিয়ে নিজে বন্দি হয়ে ছিলাম অন্ধকারে। কিন্তু আমার হৃদপিন্ডে রক্ত ঝরিয়ে তুই দিব্যি থেকেছিস অন্য কারো সাথে। অন্য কারো বববউ হয়ে।
কথাটা বলতে গিয়ে গলাটা ধরে এলো তূর্যর। বুক থেকে মাথা তুলে তূর্যর মুখের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। মানুষ টা খুব ভালোবাসেন আমায় তা আজ চিরকুটে নয় মানুষটার সাথে থেকেই অনুভব করতে পারছি তীব্রভাবে। নিজের কম্পিত হাত টা ধীরে ধীরে ওনার গালে রাখলাম আমি। আমার হাত টা চেপে ধরলেন তূর্য। মুখটা এগিয়ে এনে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিল আমার কপালে সযত্নে। এক ফালি ভালোবাসা দোলা দিয়ে গেল পুরো মন জুড়ে। কান্নামিশ্রিত গলায় আমি বলে উঠলাম,,,,
—পরীক্ষার শেষ হওয়ার পরের দিন আমি কলেজের সামনে এসেছিলাম তূর্য। চাচার,,,,
আমি কথাটা বলার আগেই তূর্যর ফোনটা বেজে উঠল শব্দ করে। চমকে উঠলাম দু’জনেই। চরম বিরক্তি নিয়ে ফোনটা রিসিভ করল তূর্য। হ্যালো বলতেই মুখে নেমে এলো বিষাদের ছায়া। ফোন পেকেটে রেখে দাড়িয়ে পড়লেন ওনি। গায়ের জ্যাকেট টা পড়তে পড়তে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,,
–পরিপাটি হয়ে নাও শ্রেয়া। আমাদের এখুনি ঢাকা ব্যাক করতে হবে।
তূর্য ভাইয়ার কথায় অবাক হলাম আমি। হঠাৎ কি হলো যে এতো বিচলিত হয়ে পড়েছেন ওনি? আর মুখটাও কেমন মলিন হয়ে আছে? কে ফোন করেছিল? আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে বাহিরে নিয়ে আসলেন তূর্য। ওনার বন্ধু কে বিধায় জানিয়ে চলে এলেন সেখান থেকে। সারা রাস্তা একটা কথাও বলেন নি তূর্য। বাইক ও খুব স্পিডে চালাচ্ছিলেন । আমি নীরব দর্শকের মতো শুধু চেয়ে রইলাম।
।
।
হসপিটালে আইসিউও রুমের সামনে বসে আছি আমি মিথি আপু কে জরিয়ে ধরে। মেয়েটা কেঁদেই যাচ্ছে সেই কখন থেকে। ওনাকে শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা আমার নেই। ফুহাদ ভাইয়া বাইক এক্সিডেন্টে করেছেন। অবস্থা খুব একটা ভালো না। বিয়ের দু দিনের মাথায় স্বামীর এমন পরিণতি কোন মেয়েটাই বা সহ্য করতে পারবে! ভালোবাসার মানুষ টা কে হারিয়ে ফেললে বুঝা যায় কেমন কষ্ট হয়। আয়ুশ ভাইয়া হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেয়ালের সাথে। তূর্য গিয়েছেন রক্তের ব্যাবস্থা করতে। তিহান ভাইয়া খবর দিয়েছেন ফুহাদ ভাইয়ার ফ্যামিলি কে। কেউ না দেখলেও আমার দৃষ্টি এড়ায় নি ওনাদের তিন জনের চোখের জল। এতো স্ট্রং মানুষ গুলো ও কেমন ভেঙে পড়েছে বন্ধুর জন্য। ওনাদের না দেখলে আর এমন এক পরিস্থিতিতে না পরলে কখনও এতো সুন্দর এক বন্ধুত্বের বন্ধন দেখার সুযোগ আমার কখনোই হতো না। ফুহাদ ভাইয়ের ব্লাড গ্রুপ “ও-নেগেটিভ”। হসপিটালের ব্লাড ব্যাংকে এ গ্রুপের রক্ত নেই। তাই তূর্য অন্য কোথাও গিয়েছেন রক্তের খোজে। ডক্টর একবার তাড়া দিয়ে গেছেন রক্তের জোগাড় তাড়াতাড়ি করার জন্য। আয়ুশ ভাইয়া ও আর তূর্যর অপেক্ষায় না থেকে বেরিয়ে পড়লেন হসপিটাল থেকে। আয়ুশ ভাইয়া যেতেই হসপিটালে এসে উপস্থিত হলেন ফুহাদ ভাইয়ার বাবা- মা ও খালাতো ভাই।
ফুহাদ ভাইয়ার মা আসতে না আসতেই দোষারোপ করতে লাগলেন মিথি আপু কে। অপয়া বলে অজস্র গালি দিতে লাগলেন। মিথি আপু নিরবে শুধু কেঁদেই যাচ্ছেন। অবাক হলাম আমি। ছেলে আইসিইউ তে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছে অথচ ওনার এখনো মিথি আপু কে নিয়ে প্রবলেম। জীবনে এমন এক পরিস্থিতিতে তো আমিও পড়েছিলাম। শাশুড়ী মা পাশে থাকলেও জা দের,, আত্মীয় স্বজনদের কটুক্তির শিকার হয়েছি। অপয়া নামক শব্দটা ও সেদিন জুড়ে দিয়েছিল আমার সাথে। আমি মিথি আপুর কষ্ট টা ফিল করতে পারছি কিন্তু বড়দের মুখের উপর কিছু বলা ঠিক হবে না আমার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ধৈর্য টা ধরে রাখতে পারলাম না আমি। মিথির আপুর শাশুড়ির একটা কথা খুব খারাপ এবং অনুচিত বলে মনে হলো আমার।
–কতোবার বলেছি এই এতিম মেয়েকে বিয়ে না করতে। এতিম মেয়ে তার উপর অপয়া। জোর করে আমার ছেলেটা কে কেঁড়ে নিল আমার কাছ থেকে। অপয়া মেয়ে বিয়ের দু দিনের মাথায় গিলে ফেললি আমার ছেলেটা কে। কাল নাগিনী। তোর উপর আমার অভিশাপ লাগবে। নিজের বাবা মারে ছোটবেলায় খাইয়া এখন আমার ছেলেটারে ও খাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছিস।
ডুকরে কেঁদে উঠল মিথি আপু। উঠে দাঁড়ালাম আমি। আন্টির কিছুটা কাছে এসে বিনয়ের সাথে বলে উঠলাম,,
–আন্টি আপনার ছেলে আইসিইউ তে। আপনার ছেলের জন্য কষ্ট অনুভব হচ্ছে না? শুনেছি ছেলে সন্তানের কিছু হলে মা’র শ্বাস টুক বন্ধ হয়ে আসে তবে আপনি কিভাবে এমন সিচুয়েশনে মিথি আপু কে গালা গালি করছেন আন্টি? এটা অন্যায়। প্লিজ এমন করবেন না। আল্লাহর কাছে দোয়া করুন ভাইয়া যেন ঠিক হয়ে যায়। কেউ অপয়া হয় না আন্টি। আমাদের সাথে যা হয় আল্লাহর মর্জিতে হয়। ধরুন এই মুহুর্তে আংকেলের কিছু হয়ে গেল তাহলে আমরা সবাই কি আপনাকে অপয়া বলে দাবি করবো? করবো না তাই না? কারণ আপনি তো আর তার জন্য দায়ী থাকবেন না। তেমনি ফুহাদ ভাইয়ার এক্সিডেন্টের পিছনে ও আপুর কোনো হাত নেই। কোনো নারী স্বামী হারিয়ে ববববিধবা হতে চাই না। স্বামী যেমনই হোক প্রত্যেক নারীই স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে। ভুল কিছু বললে ক্ষমা করে দিবেন।
কথাটা শুনে মুখটা কালো হয়ে গেলো আন্টির। ফুহাদ ভাইয়ার খালাতো ভাই তীব্র রাগ নিয়ে তেড়ে এলেন আমার দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলেন,,
—এই মেয়ে তোর সাহস কি করে হলো খালামণি কে এসব বলার? কে তুই এসব বলার হে? তোর সাহস আজ বের করেই ছাড়ব আমি।
কথাটা বলেই ওনি হাত তুলতেই চোখ খিঁচে মুখটা সরিয়ে নিলাম আমি। কিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও গালে কোনো স্পর্শ না পেয়ে চোখ দুটো মেলে তাকালাম আমি। তূর্য দাঁড়িয়ে আমার সামনে। আমার দিকে তোলা ছেলেটার হাত টাকে খুব শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছেন তূর্য। হাতের ব্যাথায় চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে গেছে ছেলেটার। তূর্যর চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।এই বুঝি আগুনের ফুলকি ঝড়ে পড়বে চোখ থেকে। চোয়াল শক্ত করে রাগান্বিত কন্ঠে বলে উঠলেন তূর্য,,,,
—–কতটা কাপুরষ তুই তার প্রমাণ দিচ্ছিলি? ওকে থাপ্পড় মারতে যাচ্ছিলি? তূর্য চৌধুরীর শুভ্রপরী কে আঘাত করতে যাচ্ছিলি? আমার শুভ্রপরী কে আঘাত করার সাহস তো আমি কাউকেই দেই নি। তাহলে তোর এতো সাহস হলো কিভাবে? এই মেয়েটা কে চোখে চোখে রাখি তোর মতো কাপুরুষের হাতে থাপ্পড় খেতে? আজ যদি ফুহাদ আইসিইউ তে না থাকতো তবে তোকে এখানেই খতম করে দিতাম। বেঁচে গেলি আজ ফুহাদের উছিলায়। আজকের পর থেকে কোনো মেয়ের গায়ে হাত তুলতে দশবার ভাববি।
কথাটা বলেই ছেলেটার হাত মুচড়ে ধরলেন তূর্য। কটমট আওয়াজ করে উঠল হাতের হাড্ডি। সাথে সাথেই ছেলেটা কে ছেড়ে দিয়ে আন্টি কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,
–আপনাদের আমি খুব সম্মান করতাম আংকেল আন্টি। ছেলের অবস্থা আশঙ্কাজনক দেখে ও কষ্টের লেশমাত্র নেই আপনাদের মাঝে। হাই সোসাইটি,, সম্মান এসব নিয়ে পড়ে আছেন এখনো। এসব নিজের ছেলের থেকে ও বড় হয়ে গেল তাই না আংকেল? আমি তূর্য দেখে দম নিব কতদিন পর্যন্ত পারেন বেঁচে থাকতে হাই সোসাইটির বড়াই নিয়ে।
আংকেল আন্টি কোনো কথা না বলে বসে পড়লেন পাশের বেঞ্চিতে। পুরো পরিবেশ টা একদম থমথমে হয়ে রইল। তূর্য ছুটে গেলেন ডক্টরের কেবিনে।
চলবে,,,,