দলিল – ৪
দুইটা দশে গাড়ি এসে থামল মুক্তাগাছা রেজিস্ট্রি অফিসের সামনে। মূল রাস্তা থেকে ভেতরে।বেশ চওড়া পাকা রাস্তার একপাশে একচালা লম্বা একটা টিনের ঘর। তার সামনে বড় বড় হরফে লেখা রেজিস্ট্রি অফিস, মুক্তাগাছা।
অফিসের কাছে।আসতেই শুভ জামানকে গাড়ি থামাতে বলে। গাড়ি রাস্তার একপাশে সাইড করে রাখা হয়। শুভ তড়িঘড়ি করে নেমে যায়। শুভর তাড়াহুড়ো দেখে তিথি খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল।
: আমি কি করবো?
: তুমি এখানেই বসে থাকো। আমি বললে ভেতরে যাবে।
: গাড়িতে বসবো?
তিথির বিরক্তি এখন চুড়ান্ত অবস্থায় আছে । শুভর আচরন ভালোই লাগছে না। কেমন পর পর। যেন তিথি তার কেউই না।
: এখানে কোথায় বসবে? এটা তো অফিস। তাছাড়া আমাদের কাজটা হতে সময়ও লাগবে না। এই বড়জোর আধঘণ্টা।
তোমার কয়েকটা সই ব্যস।
: শুভ তুমি আধা কথা বলছো কেন?
: কোন কথা?
: জমির কাগজে আমার সই লাগবে। কেন কি কারনে
সেটা তো বললে না।
শুভ বেশ রাগ করল।।সে তিথির সাথে এই মুহুর্তে তর্ক করতে চাইছে না। তবুও মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করছে।
তিথি আবারও জানতে চাইল।
: কি বলো?
: তিথি বাড়তি কথা বলো না। মাথা খুব গরম হয়ে আছে। যতক্ষণ না কাজ শেষ হয়। প্লিজ তুমি শান্ত হয়ে বসো।
শুভর যুক্তিগুলো তিথিকে বিস্মিত করছে। কেমন এড়িয়ে যাওয়া উত্তর। সত্য মিথ্যা আড়াল হচ্ছে।
এদিকে তিথি ইচ্ছে করেই কঠিন হচ্ছে। কারন সময় অনেক কিছু করতে বাধ্য করে মানুষকে।
: কথাটা আমি ঢাকায় বলতাম। কিন্ত আসার পথে কোন ঝামেলা হোক সেটা চাইনি।
: তিথি কি বলতে চাইছো?
তিথি হাসল।
: জমির কাগজগুলো একবারও দেখালে না। দেখলে বুঝতাম।
: এখন তো দেখবে।
: হুম দেখবো। সই করার আগে অবশ্যই দেখব।
: তিথি খুব সিম্পল বিষয়টাকে বড় করছো। একটা জমি আমি ছেড়ে দিচ্ছি ঝামেলায় পড়ে। আর সেই জমিটা রহমত চাচার কাছ থেকে ওয়ারিশ হিসাবে আমি পেয়েছিলাম।
: হুম, সেটাই তো জানি।
: প্লিজ তুমি চুপ করে বসো। নইলে বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করো।
শুভ বেশ চাপে আছে। তিথিকে এতটা কৈফিয়ত দিতে হবে সেটা তার মাথায় আসেনি ।
শুভ চলে গেলো। তার নৈতিক আচরন ইদানীং তিথিকে ভাবাচ্ছে। কেমন একটা দূরত্ব যেন তৈরী হচ্ছে। তিথির মনে হয় শুভর সাথে এটা নিয়েও কথা বলবে।
জামান ফিরে এসেছে। হাতে চায়ের কাপ।
: ম্যাডাম চা খাবেন?
: না।
তিথির চেহারা দেখে জামান আস্তে করে করে কেটে পড়ল।
বারেক লোকটা দাঁড়িয়ে আছে অফিসের সামনে। লোকটা আধা বয়সী কাঁচা পাকা চুল। পরনে লুঙি আর শার্ট। শার্টের উপরে একটা চাদর জড়ানো। শুভকে দেখে বারেক এগিয়ে আসে। সালাম দেয়।
তিথি চারপাশে একটু চোখ বুলিয়ে নেয়। প্রত্যন্ত এলাকার অফিস পাড়া। দু চারটা পাকা অফিসও আছে আশপাশে। য়দিওসেখানে বেলা দুইটায় লোকজনের সরব উপস্থিতি কম।
কেবল রেজিস্টি অফিসে লোকের আনাগোনা অনেক। জমিজমার বিষয়। এ নিয়ে।সারাবছর মানুষ দৌড়ের উপর থাকে।
তিথি উশখুশ করছে নামার জন্য।
একটু হাঁটতে পারলে ভালো হত। অনেকটা সময় ধরে।বসা।
দরজা খুলে তিথি নেমে পড়ে। খোলা জায়গা। কেমন ফ্রেশ একটা ওয়েদার। বেশ ভালো লাগছে।
বারেক আর শুভ খুব সিরিয়াস হয়ে কথা বলছে। দুর থেকেই বোঝা যায়। আশপাশে আর কেউ নেই। তিথি গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষন হাঁটল। আড়াইটা বেজে গেছে। দুপুরের লাঞ্চ করা হলেও এখন হালকা কিছু খেলে ভালো হত। কিন্ত শুভ কিছু বলেনি । তিথি দেখল বারেক আর শুভর কথা শেষ। এরপর শুভ কিছুটা দুরে গিয়ে সিগারেট ধরিয়ছে। তিথিকে একা দেখে বারেক লোকটা এগিয়ে আসে।
তিথি সালাম দেয়।
: কেমন আছো?
: জ্বি ভালো
: একটু কষ্ট করন লাগব। সাব রেজিস্টার আইলেই কাগজ দেইখা সাইন দিবো। আফনের সাইনও লাগব কিন্তক।
তিথি হেসে ফেলে।
: জ্বি আমি জানি।
শুভকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। সিগারেট ধরালো। মনে হলো সে কাউকে খুঁজছে।
একটু পর তিনজন লোক অফিস থেকে বের হয়ে এলো। তিনজনই অল্প বয়সী। ওদের সাথে শুভ হাত মেলালো। সবার মুখ বেশ খুশী খুশী।
তিথি হাঁটতে হাঁটতে দেখল ওদের পাঁচজনের দলটা রেজিস্ট্রি অফিসে ঢুকে গেছে।
মাঝ দুপুরে রাস্তাঘাট ফাঁকা। তেমন মানুষজন নাই। অফিসের পাশে একটা ছোট একটা চায়ের স্টল। বারো তের বয়সী একটা ছেলে সেখানে বসা। তিথিকে হা করে দেখছে। তিথি এগিয়ে গিয়ে এক কাপ দুধ চায়ের অর্ডার করে। তার মূলত ক্ষিধে লেগেছে।
ছেলেটা অতি উৎসাহী হয়ে চা তৈরীতে ব্যস্ত হয়ে যায়।
তিথিকে বসতে বলে।
: আফা এইহানে বইন।
কাঠের বেঞ্চি পাতা। স্টলের সামনে। চমৎকার বাতাস। বসার সুন্দর জায়গা। তিথি ধপাস করে বসে পড়ল।
: চায়ের সাথে আর কি আছে?
: আফা বিসকুট আছে, দিমু?
: দাও।
ছেলেটি এক প্যাকেট বিস্কিট এগিয়ে দেয়। লোকাল জিনিস।
তিথি সেটাই চায়ে ডুবিয়ে খেতে থাকে। ছেলেটি বেশ কৌতুহল নিয়ে তিথিকে দেখছিল।
: আফা ডাহা থন আইছুইন?
তিথি হেসে ফেলে। কি চমৎকার আঞ্চলিক ভাষা। শুনতে বেশ লাগে।
: হুম।
ছেলেটির চোখমুখে একটা গর্বিত ভাব চলে আসে।
চায়ে চুমুক দিতে দিতে মাথাটা ফ্রেশ লাগছে। তিথি বারবার অফিসের দিকে তাকাচ্ছিল।
শুভ এখনও বের হয়নি।
প্রায় আধঘণ্টা পর শুভ আর বারেক বের হয়ে এলো।
তিথি চায়ের বিল মিটিয়ে গাড়ির দিকে রওনা হয়।
শুভকে বেশ প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে।
তিথি গাড়িতে গিয়ে বসল। এই সময় বারেক কিছু কাগজ এনে তিথির সামনে মেলে ধরে।
: আফনে এই কাগজগুলায় সাইন কইরা দেইন।
শুভ দুরে দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁকছে। কাছে এলো না।
তিথি কাগজগুলো হাতে নিয়েছে।
: কোথায় কোথায় সই লাগবে?
বারেক কাগজগুলোর পাতা উল্টিয়ে দেখিয়ে দেয়।
অনেকগুলো সই।
তিথি অবাক হচ্ছে।
: এতগুলো সই?
বারেক হাসছে।
: আফনের জমি না?
তিথি চরম বিস্মিত।
: আমার জমি মানে ওটা তো শুভর।
: না না, শুভ বাবাজির না। এইটা আফনের। কেন শুভ বাবাজি আফনেরে কয় নাই?
তিথি বেশ হোঁচট খায়। বারেকের সামনে নিজের সন্মান শেষ করা যাবে না। সে কথা ঘুরিয়ে ফেলে।
: হুম বলেছে। কিন্ত আমি ওসব ওত বুঝি নাতো। তাই আমলে নেইনি।
তিথি কাগজগুলো দেখছে। সত্যিই তো জমির মালিক তিথি। এই যে তিথির ছবি। সাথে সব ডকুমেন্টস।
বারেক প্রচুর কথা বলছে।
: তয় আফনের কপাল বালা। শাকিল আর লিটন জমির দাম ঠিক ঠিকই দিছে।
তিথি জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
: জ্বি।
: আড়াই লাখ টেকা। সুজা কতা না। এইডাই তো শাহিনের পোলা দাম করছিল দেড় লাখ কইছিলো। কত জোর করলো। শুভ বাবাজি ছাড়ে নাই।
তিথির কান গরম হয়ে গেছে। এতগুলো টাকা শুভ অগ্রিম পেয়ে গেছে অথচ তিথিকে একবারও বলেনি।
কিন্ত তিথির মনে হলো শুভকে একটু বাজিয়ে দেখবে।
অনেকগুলো সই এখনও করা বাকী।
তিথি কাগজগুলো গুছিয়ে রাখল।
বারেক অবাক হয়ে।গেছে। সে তাগিদ দিচ্ছে বাকী সইগুলো করার জন্য।
: সবগুলা সই হয় নাই তো?
তিথি অদ্ভুত হাসিটা ধরেই রাখল।
: জ্বি, শুভ আসুক। পরে দিবো।
তামান্না হাসান