দলিল – ৬

0
288

দলিল – ৬

অজ পাড়া গায়ের ব্যাংক। ক্লায়েন্ট কম। বলা যায় বেশ ফাঁকাই।
তিথিকে লাইন ধরে দাঁড়াতে হয়নি। ঢুকেই ক্যাশ কাউন্টারে টাকা জমা দিয়েছে।
শুভ সোফায় বসেছিল।
টাকাগুলো জমা নেবার সময় অফিসার জানতে চাইল এতগুলো টাকা কোথা থেকে পেয়েছেন।
তিথি হাসিমুখে বলল।
” নিজেদের জমি সেল করেছি ”
অফিসার তবুও জিজ্ঞাসু চোখে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে।

” ম্যাডাম প্লিজ ডকুমেন্টস দেখান “।
তিথি বেশ অপ্রস্তুত হচ্ছে। এগুলো অযথাই হয়রানি। ব্যাংকের কাজ মানুষের টাকা রাখার। সেটা কোথা থেকে এলো। কিভাবে এলো সেটার মূল বা উৎসের খোঁজ ইদানীং শুরু হয়েছে।
তিথি মিষ্টি করে বুঝিয়ে।বলল।
: আপনি এত জেরা করছেন কেন, ব্যাংক টাকা রাখবে।সেটা আমি কোথা থেকে পেয়েছি তাও বলতে হবে।
বললাম তো একবার।
অফিসার চৌকস ভঙিতে তিথিকে নিয়ম কানুন বুঝিয়ে যাচ্ছে। তিথি বিরক্ত হলেও শুনলো।
: ম্যাম আসলে সবটাই রুলস।
মুখে বললে তো হবে না। প্রমান দেখাতে হবে।
এখানে আড়াই লাখ টাকা রয়েছে। সংখ্যাটা দেখবেন না? এতগুলো টাকা কোথা থেকে এলো এটা তো প্রশ্ন হতেই পারে।
আজকাল নানা ধরনের ক্রাইম হচ্ছে। কে ভালো কে খারাপ বলা মুশকিল।

: তাই। আমাকে দেখলে সেই রকম মনে হচ্ছে? লেডি কিলার টাইপের কিছু?

তিথি হাসছে। অফিসার বেশ বিব্রত হয়ে গেলো। সে তিথিকে আপাদমস্তক দেখল। স্মার্ট বাচনভঙ্গি। দারুন কথাও বলে। পড়াশুনা জানা শিক্ষিত শহুরে মেয়ে। এদের সাথে বেশী বলাও কঠিন। একটা বললে আরেকটা বুঝে।

: না ঠিক আছে ম্যাম।

শুভ ওদের কথাবার্তার মাঝখানে একবার আড়চোখে দেখল। তবুও সে উঠে যায়নি। তিথির উপর এমনিতে চটে আছে। আজ এতগুলো লোকের সামনে বেকায়দায় পড়বে বলে চুপ ছিল। আর তিথি কত বড় সুযোগ নিয়ে টাকাগুলো হাতিয়ে নিলো। এই টাকার যন্ত্রনায় আজ শুভর ঘুম আসবে না। পুষে রাখা ক্ষোভ আপাতত স্থগিত থাক। আগে ঢাকা গিয়ে পৌঁছাক। তারপর তিথির সাথে এটা নিয়ে বুঝার বাকী আছে। শুভ এত সহজে ছেড়ে দেবে না। তার ভেতরে চাপা রাগ রয়েছে।
শুভ আস্তে করে ব্যাংক থেকে বের হয়ে আসে।

মাঝ দুপুরে হঠাৎ করে ক্লায়েন্ট বেড়ে গেছে। দু চারজনের জায়গায় সাত আট জন।
তিথি এখনও কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছে।
তিথি টাকা জমা দিয়ে পাশ ফিরে দেখে শুভ নেই।
সে দ্রুত বের হতে হতে ফোনটা তুলল।

: শুভ কই তুমি?
: আছি। তোমার কাজ শেষ?

: হুম।

: চলে আসো।

প্রখর রোদ। কিন্ত উত্তাপ নেই। কেমন উম মাখা। শরীরে আলস্য আসে। তিথি ব্যাংক থেকে বের হয়ে হাঁটা ধরল। লং জার্নিতে শরীরে ক্লান্তি এসেছে। এখন রোদের কারনে আরো আলসি লাগছে। শুভ রাগ নিয়ে চলে গেছে । তিথি সব বুঝেও স্বাভাবিক আছে । শুভর আচরন বদলেছে আজ নতুন নয়। অনেক আগেই তিথি টের পেয়েছিল। । আজ কেবল পরীক্ষাটা হয়ে গেলো।

তিথিকে কি তার ভালো লাগে না। কেন লাগে না। এই ভালো না লাগা দিয়ে তো সংসার হয় না। হয় দূরত্ব। তারপর দূরত্বের কারনে সসম্পর্কের ইতি ঘটে। আগে শুভর বাবা বোনের কথায় তিথি কষ্ট পেলে শুভ রিএ্যক্ট করত। এখন করে না। এতে তিথির দুঃখ হয়। সেটা শুভ জেনেও করে। তিথির বুক জুড়ে ভয়াবহ এক শূন্যতা আছে। যা শুভর জন্য হাহাকার করে। সময়ে সেটা ক্ষোভে পরিনত হয়েছে। তাই আজ যা ঘটল সেটা তিথি ইচ্ছে করেই ঘটিয়েছে।
শুভর রিএ্যকশান দেখার জন্য।
এটুকু খুব দরকার ছিল।

ঝিরঝিরে একটা বাতাস। রোদের শরীরেও কাঁপন ধরায়। তিথি ওড়নাটা ভালো ভাবে জড়িয়ে নিলো। শীত শীত আমেজ। শীতের ঘ্রান।
চোখ বন্ধ করে ফেলল তিথি।

সাব রেজিস্টার এলো তিনটা দশে। কাগজপত্র জমা হয়েছে। অফিস হঠাৎ সরগরম হয়ে উঠে।
প্রচুর কাজের প্রেসার। আনাগোনা বেড়েছে লোকজনের।
বারেক একাই ছোটাছুটি করেছে। শাকিল আর লিটন শুভর সাথে ব্যস্ত ছিল।
অফিসের সব কাজ গুছিয়ে শুভ বারেককে সাথে নিয়ে বের হয়। তার চুপ করে যাওয়াটা সবাই খেয়াল করলেও সামনাসামনি কিছুই জিজ্ঞাস করা হয়নি।

পড়ন্ত বিকেলে শুভ আর তিথি মুক্তাগাছা থেকে রওনা করে। ঘড়ির কাঁটায় চারটা দশ তখন।
হু হু বেগে গাড়ি ছুটছে ঢাকার পথে। দীর্ঘ পথের।ক্লান্তিতে সিটে মাথা এলিয়ে দিয়েছে তিথি। ভারী ঘুম পাচ্ছে তার।
পাশে শুভ কানে ইয়ারফোন গুজে জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। তিথির দিকে তার নজর নাই। যেন তিথিকে সে চিনেই না।

জামান গাড়িতে উঠার পর একটাও কথা বলেনি। চুপচাপ ড্রাইভ করছে।
দেড় ঘন্টা পর ওরা ত্রিশাল পেরিয়ে ভালুকার কাছে চলে আসে। সন্ধ্যের বাতি জ্বলে উঠেছে হাইওয়ের রাস্তায়। ঘন সবুজের মাঝে নিবু নিবু আলোর রহস্যময়তা অপূর্ব সুন্দর সেই দৃশ্য। জামান আস্তে আস্তে গাড়ি চালাচ্ছে।

: স্যার চা খাইবেন?

শুভকে মিররে দেখা যাচ্ছে। খুব আনমনা।
জামান আবার ডাকল।

: স্যার গাড়ি থামাই?

শুভ এতক্ষন খেয়াল করেনি জামান ডাকছে।

: হুম।

হাইওয়ের একপাশে গাড়ি থামল। গাড়ি রেখে জামান এক দৌড়ে উধাও।
শুভ নেমে আসে। জানালার গ্লাসে সেটা টোকা দিয়ে তিথিকে ডাকল।

: কিছু খাবে?

শুভ খুব সাবলীলভাবে কথা বলছে যেন কিছুই হয়নি।
তিথি আস্তে করে মাথা নাড়ে।

তিথি নেমে আসে। শুভ একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঢুকল। পিছু পিছু তিথিও আসে। মাঝারি মানের রেস্টুরেন্ট। খাবারের মান বেশ ভালো। তিথি মেনু দেখছে। ধোঁয়া মাখা চুলায় রান্না চলছে। দারুন ঘ্রান।

শুভ একটা টেবিলে বসল। তিথি এসে বসতেই। ওয়েটার হাজির।
শুভ তিথিকে জিজ্ঞেস করল।
: কি খাবে?

: কি আছে

তিথির কথা শুনে ওয়েটার গরগর করে মেনু বলে যাচ্ছে। পরোটা ভাত মাছ মুরগী ডাল সবজি গরু।
শুভ মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে তেল ছাড়া পরোটা আর সবজি ডাল অর্ডার করে।

তিথি জানতে চাইল।

: মিষ্টি আছে?

: না ম্যাডাম।

খাবার চলে এসেছে অল্প সময়ের মধ্যে। জামান বসেছে উল্টো দিকের একটা টেবিলে।
সে ভাত নিয়েছে। সাথে গরু আর সবজি ডাল।
শুভ ইশারায় জামানকে আরো কিছু লাগবে কিনা জানতে চাইল।

জামান একগাল হেসে না করে।

ওদের খাওয়া শেষ হয় বেশ তাড়াতাড়ি। এরপর শুভ বিল মিটিয়ে ফেলে। তিথি বের হয়ে চা খুঁজতে লাগল । হঠাৎ দেখে পাশে ছোট একটা খুপড়ির মত চায়ের দোকান। মাঝবয়সী একজন লোক চা বানাচ্ছে। নানা পদের চায়ের লিস্টও। তিথি চোখ বুলায়। বাহারী নাম। সে দেখেশুনে একটা মশলা চায়ের অর্ডার করল।
বসার জন্য চেয়ার পাতা আছে। বেঞ্চ রয়েছে দুটো।
মাথায় টুপি। গায়ে চাদর মুড়ানো লোকটা তিথিকে বসতে বলল।

: আফা বহেন।

: না, ঠিক আছে।
তিথি বসল না। সে হাঁটছে। চমৎকার রাত। কি সুন্দর ঝকঝকে তারা। মনকাড়া। বিশাল চাঁদের আলো চুইয়ে ঝরছে পৃথিবীর বুক জুড়ে। ফোয়ারার মতন। আজ কি পূর্নিমা। তিথি আনমনে হাঁটতে থাকে। তার খুব ইচ্ছে হলো শুভর পাশে থাকতে। আশপাশ তাকিয়ে দেখে শুভ নেই। হঠাৎ চোখ গেলো গাড়ির দিকে। শুভ গাড়ির কাছেই সিগারেট খাচ্ছে। তিথির মনে হলো ইদানীং শুভর সিগারেট খাওয়াটা বেড়েছে। দিনে দশ বারোটা খায়। আগেও খেতো তবে এত বেশী না।
সে হাত দিয়ে শুভকে ডাকল। কিন্ত শুভ খেয়াল এলো না।
তিথি চোখ ফিরিয়ে নিতেই দেখে দশ এগারো বছরের ছেলেটি চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে।

: আফা আমনের চা।

তিথি চা খাচ্ছে। কিন্ত তার মনের খচখচানি কমলো না।
শুভ তাকে এড়িয়ে যাচ্ছে। এটা পরিস্কার। সেটা আজকের টাকার জন্য নয়। একটু একটু করে শুভর পরিবর্তন আজকে প্রকট হয়ে গেছে।
তিথির মনস্থির করে ফেলেছে। শুভকে সে কি কি বলবে।

তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here