দলিল – ৭

0
296

দলিল – ৭

চা শেষ করে তিথি গাড়িতে গিয়ে বসে। তখনও সিগারেট খাচ্ছিল শুভ।, তিথিকে দেখেও কিছু বলল না। জামান গাড়িতে বসা ছিল। শুভ উঠার পর স্টার্ট দিলো।
পাশাপাশি দুটো মানুষ বসে আছে। কিন্ত কেউ কথা বলছে না। পরিবেশটা হালকা করার জন্য তিথি শুভকে ডাকল।

: শরীর খারাপ লাগছে?

: নাতো, কেন?

তিথি আশ্বস্ত হয়। যাক গুমোট ভাবটা কেটেছে। এখানে বাইরের একটা লোক রয়েছে। তার সামনে স্বাভাবিক থাকা দরকার।

: তোমাকে দেখে তেমনই লাগছে।

শুভ মুচকি হাসে। তার এই হাসি কালেভদ্রে আসে। খুব গভীরে এর অর্থ।
তিথি প্রসঙ্গ বদলে ফেলে।
: একদিনে এত লং জার্নি ভীষন কষ্টকর।

: হুম।

এটুকু বলেই শুভ চুপ। তিথিরও ভালো লাগছে না জোর করে কথা বলতে। তারও মুড অফ হয়ে গিয়েছে শুভর কারনে। সোজা বাইরে মুখ করে আছে।

রাতের নিরবতা কেটে গাড়ি ছুটছে বেশ দ্রুত গতিতেই। রাস্তা বেশ ফাঁকা।জামান ফিরতি পথে বেশ কমার্শিয়াল ভাবে ড্রাইভ করছে। এভাবে যেতে পারলে দশটার মধ্যে ঢাকায় ঢুকতে পারবে। তার টার্গেট এখন দ্রুত যাওয়া। যদিও ভালুকা থেকে ঢাকা পৌঁছতে সব মিলিয়ে যানজট ছাড়া দুই ঘন্টার বেশী লাগার কথা না।
স্পিড বেড়েছে গাড়ির। বেশী স্পিডে একটা দুলুনি আসে শরীরে। ঘুম ঘুম ভাবও চলে আসে। তিথি ঘুমানোর চেষ্টা করল।

অল্প সময়ে ভালুকা ছাড়িয়ে গাড়ি গাজীপুর চলে আসে। কিন্ত এখানে এসেই আটকে যায়। বিশাল জ্যাম। গাড়ি সব বন্ধ হয়ে আছে। শুভ মুখ বাড়িয়ে বাইরের অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করল। নাহ পুরাই জটিল। কোন নড়াচড়া নাই। জামান বের হয়ে আসে। কিছুটা সামনে হেঁটে যায়। হয়তো কোন খবর নিয়ে আসবে। গাজীপুর কমার্শিয়াল এরিয়া। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল কোম্পানিগুলোর কারখানা এখানে। আরো আছে গার্মেন্টস । সব মিলিয়ে এই জ্যাম।
তিথি ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভেঙে দেখে জ্যামে।
পাশে শুভ ভোতা মুখে রয়েছে। হাইওয়েতে গাড়ি আটকে থাকা এক যন্ত্রনা। ইচ্ছে হলেও নামা যায় না। হকার বেড়ে গেছে কিছুক্ষনের মধ্যে। চিপস পপকর্ন পানির বোতল নিয়ে ছোটাছুটি হচ্ছে।
কিন্ত কেউ কিনছে না।

তিথিকে উঠতে দেখে মৃদু ভঙিতে হাসল শুভ। তিথি জিজ্ঞেস করল।

: কয়টা বাজে শুভ?
: সাড়ে আটটা।

শুভ খুব সহজ ভাবে কথা বলছে। তিথি শরীর টেনে ঠিক হয়ে বসল। চুল খুলে গেছে। ক্লিপটা খুঁজে পাচ্ছে না

: ওহ, এতো জ্যাম।
: হুম।

: অনেক রাত হবে না পৌঁছতে?

: এগারটা বাজবে হয়তো।

অপেক্ষা খুব বাজে জিনিস। গাড়িতে ড্রাইভার নাই। তিথি চাইছিল শুভর সাথে কিছু আলোচনা করে নিতে।কিন্ত শুভর আগ্রহ দেখছে না।

অল্প সময় পরে জামান ফিরে এসেছে। তার মুখ কালো। গালাগাল করে এসেছে বোধহয়।

শুভ জানতে চাইল।

; কি হয়েছে জামান?

: আর কি অইবো সার্জেন্ট না থাকলে যা হয়। উল্টো পথে গাড়ি ঢুকাইয়া দিছে। হের মধ্যে এক টেরাক মাল লইয়া মাঝখানে খাড়া। কেডা সরাইবো।
গালিও দিয়া আইছি বেডারে।

শুভ অধৈর্য হয়ে দরজা খুলে বের হয়ে আসে। অনেক গরম লাগছে। একটানা এক জায়গায় বসে থাকলে কোমর ধরে যায়।
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। দু পাশে কিছু দোকানপাট থাকলেও লোক চলাচল কম।
বাইরে আসার পর অনেক হালকা লাগছে। মাথাটা ভার হয়েছিল। তবে সবকিছুর মূল ঐ টাকা। শুভ মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করল।
তবে এত সহজে সে ছাড়বে না। আগে ঢাকা ফিরে যাক।

জ্যাম ছাড়ল আধঘণ্টা পর।
শুভ গাড়িতে এসে বসল।

আবারও ছুটছে গাড়ি। এরপর খুব দ্রুতই টঙ্গী পর্যন্ত চলে এসেছে। জামান গাড়ি বেড়িবাঁধে ঘোরাতে চাইল।
সে আমতা আমতা করে বলল।

: স্যার বেড়িবাঁধ দিয়া যাইগা, তাড়াতাড়ি হইবো।

: এতরাতে ওখান দিয়ে যাবো না।
তুমি উত্তরা দিয়ে যাও।

জামান মুখ খিচড়ে আছে। উত্তরা দিয়ে যাওয়া মানে সেই যানজট। কতক্ষন বসে থাকা লাগে কে জানে।
তবুও সে আবার বলল।

: অনেক রাইত হইয়া যাইবো উত্তরা দিয়া গেলে।

শুভ কথা বাড়াল না। সে নিজেও জানে দেরী হয়ে যাবে। কিন্ত কিছু করার নাই। বেড়িবাঁধ দিয়ে রাতের বেলা যাওয়া আসা বিপদজনক।

উত্তরায় ঢুকেছে গাড়ি। আলো ঝলমল শহর। ঘুমিয়ে পড়া শহর জেগে থাকে এই আলোর জোয়ারে।
শুভর চোখ লেগে এসেছিল একটু। চারপাশে কড়া আলোতে তারও ঘুম ভেঙেছে।

তাকিয়ে দেখে পাশে তিথি ঘুমাচ্ছে। কি স্নিগ্ধ শান্ত মুখখানা। ঘুমালে সব মানুষকে খুব সুন্দর লাগে। নিস্পাপ লাগে। তিথিকেও সুন্দর লাগছে। আগে হলে তাকে ছুঁয়ে দিতো। চুলে আঙুল ডুবিয়ে দিতো কিন্ত আজ শুভর কোন মায়া এলো না তিথিকে দেখে। শুভ খেয়াল করেছে তিথি ভীষন এগ্রোসিভ হয়ে গেছে। একটা প্রভাব খাটাচ্ছে। অনেকটা ক্ষমতা পাবার মত।
মেয়েটা বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। আচ্ছা শুভ যে অনেকটা এড়িয়ে চলে তিথিকে এটা কি সে বুঝেই এমনটা করছে।

উত্তরার জ্যাম পেরিয়ে দেড় ঘন্টা পর ওরা মিরপুর দুই নাম্বারে এসে থামে।
গেইটের কাছে এসে হর্ন দিতেই তিথি জেগে যায়।
তিথি ব্যাগ হাতে নামল। সে শুভর জন্য অপেক্ষা না করে লিফটে উঠে যায়।

অনেকটা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে তিথি ওয়াশরুম থেকে বের হয়।
তারপর চুল মুছতে মুছতে ব্যলকনিতে গিয়ে দাড়ায়। তোয়ালে ঝুলিয়ে রুমে ঢুকতেই দেখে শুভ দরজা লক করে ভেতরে ঢুকছে।
তিথি অবাক হয়। এতক্ষন ও নিচে ছিল কেন। তিথির সাথে একটা আড়াআড়ি ভাব করছে। তাই বলে এতটা।
এখন জিজ্ঞাস করলে বলবে সিগারেট ফুরিয়ে গেছে।
সেটা কি তুমি এনে দিবা।
খোচা মেরে বলতেও পারে।
তারপর দুই কথা তিথি বললে হবে ঝগড়া।
নাহ এত রাতে কোন বাজে ঘটনা না হলেই ভালো।
তিথি ঠান্ডা মাথায় বলল।
: যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি খাবার দিচ্ছি।

শুভ কোন কথা না বলে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে।

তিথি কিচেনে ঢুকে খাবার গরম করল। ফ্রিজে চিকেন আর ডাল ছিল। সে চট করে অল্প ভাত বসিয়েছে।
ভীষন ক্ষুধা পেয়েছে। ভাতের ক্ষুধা। আজ বাইরের খাবার খেয়ে মুখের স্বাদ নষ্ট হয়েছে।

ভাত হতে হতে টেবিলে সব বেড়ে শুভকে ডাকল। ওপাশে শুভর সাড়া নাই। তার মানে এখনও সে ওয়াশরুমে।
তিথির মনে হলো বাসায় ফিরে সব ঠিকঠাক লাগছে। ঠিক আগের মত। যেন কিছুই ঘটেনি শুভর সাথে।
কারন এটা তিথির সংসার। সে সবকিছু সাজিয়েছে নিজের মত করে। অনেক অধিকার তার। কিন্ত মাঝে মাঝে সব ভুল মনে হয়। যেন এখানে তার কোন কিছু নাই। সব শুভর।
শুভর ইনকামের টাকায় সংসার চলে। তিথি শুভর উপর নির্ভর করে আছে । এই নির্ভরতা খুব খারাপ জিনিস।
মন ছোট করে দেয়।
ছেলেরা মেয়েদের এই নির্ভরতাকে অসন্মানও করে।
এতে মনোমালিন্য বাড়ে। অশান্তি হয়।
সম্পর্ক নষ্টও হয়।
সংসার করা মানে মাথা পেতে দেয়া নয়।
তিথির মতে একে অন্যকে সন্মান না করতে পারলে সংসার করার প্রয়োজন ফুরায়।

আধঘণ্টা পর শুভ খেতে এলো। ট্রাউজার আর টিশার্টে শুভকে বেশ মানায়। কেমন হ্যান্ডসাম একটা লুকস আসে।
এমনিতে শুভ সুদর্শন। চোখে পড়ে। শাওয়ার নেবার পর আরো বেশী সুন্দর লাগে প্রতিবার। তিথি আড়চোখে একবার দেখল শুভকে।
খুব চিন্তিত। এতটা চিন্তা কি শুধুমাত্র টাকার জন্য নাকি অন্য কারনও আছে।

দুজনে চুপ করে খেয়ে নিচ্ছে।
কোন কথা নেই কারোর মুখে। একটা অসহ্যকর পরিস্থিতি। নিরবতা ভেঙ্গে তিথিই প্রথম কথা বলল।

: কি হয়েছে তোমার?

: কি হবে?
তিথি খেয়াল করল শুভ বেশ দূরত্ব রেখে কথা বলছে।
: তাহলে এমন চুপ আছো যে?

: এমনি।

শুভ খাবার খেতে খেতে উত্তর করল।

: বুঝলাম না।

শুভ পূর্ন দৃষ্টিতে তিথিকে লক্ষ্য করে। কতটা স্মার্টলি কথা বলছে।

: তিথি আমি খুব ক্লান্ত। প্লিজ পরে কথা বলি?

এরপর খাবার খেয়ে শুভ চলে যায়। তিথি সব গুছিয়ে রুমে এলো। বারোটা বেজে গেছে। বেডরুমের বাতি আগেই নিভানো ছিল। এসে দেখে শুভ রুমে নেই। তিথি অবাক হল না।
এমনকি শুভকে ডাকলও না। আজ সে গেস্টরুমে থাকবে। থাকুক। মাঝে মাঝে একা থাকা লাগে।

তিথি এখন শোবে না। কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করবে।
তারপর শোবে।

আধঘণ্টা হাঁটার পর তিথি রুমে এলো। ড্রেস পাল্টাতে হবে। ড্রয়ার খুলতেই রেড কালার নাইটিটা চোখে পড়ে।অনেকদিন আগে কেনা হয়েছিল কিন্ত পড়া হয়নি। কি চমৎকার গাঢ় রঙ। হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। গায়ে জড়িয়ে দে্খে।
এরপর নাইটি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে যায় তিথি। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে তাকে। সদ্য শাওয়ার নেবার কারনে দারুন স্নিগ্ধ একটা লুকস চলে এসেছে।
তার কোমর পর্যন্ত চুলগুলো খোলা। আয়নায় আরেকবার নিজেকে দেখে নেয়। হঠাৎ করে নিজের প্রতি অসম্ভব একটা পজিটিভ ভাব চলে আসে।
অযথাই আজ একটা মন খারাপ নিয়ে ছিল । এটা খুব ভুল। শুভ তাকে পাত্তা দিবে এটা ভাবাও অনুচিত। বরং নিজেকে নিজে গুরুত্ব দিয়ে নিজেকে ভালো রাখার পথ খুঁজে নেয়া উত্তম।
পাশের মানুষটির খেয়াল খুশীমত নিজেকে প্রেজেন্ট করাটা মুখ্য হওয়া উচিত নয়।
সংসার করছে বলে সব বিলিয়ে দিতে হবে? না।
নিজের বলে কিছু থাকতে হয়। নিজের জন্য রাখতে হয় কিছু। আলাদা করে ভাবতে হয় কখনও কখনও। আমি কেউ এটাও ভাবতে হয়।
তারপর ছোট ছোট খুশীগুলো তৈরী করে নিতে হয় এটা সবটাই নিজের দায়িত্ব। কেউ এসে এগুলো হাতে তুলে দিয়ে যাবে না।

তিথির টুপ করে সাজতে ইচ্ছে করল। সে আবার আয়নার সামনে বসেছে। টিপ পরল কপালে। চোখে কাজলও টানল। বাহ! বেশ তো লাগছে।
গুনগুন করে দুটো গানের কলি গাইতে গাইতে ঠিক করল কাল উত্তরায় চলে যাবে। মায়ের সাথে কটা দিন থেকে আসবে।
মাস্টার্স এর রেজাল্ট এর পর বাবার বাড়িতে যাওয়া হয়নি। একটু রিলাক্স করবে। একঘেয়েমি কাটানো খুব জরুরী।
কয়েকটা জায়গায় সিভি ড্রপ করতে হবে। জবের স্বপ্নটা রেজাল্ট হবার পর আরো শক্ত হয়েছে।
যদিও শুভকে বলা হয়নি যে সে জব করবে।

এর মধ্যে শুভ রুমে ঢুকেছে। বিছানা থেকে বালিশ নিলো। তিথি দেখেছে। কিন্ত কিছু বলল না।
হঠাৎ করে পেছন থেকে স্পর্শ পেয়ে দেখে শুভ বালিশ হাতে দাড়িয়ে আছে।
কেমন বোকা বোকা দৃষ্টি।
তিথির হাসি পেলেও মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।

: দাঁড়িয়ে আছো কেন? কাঁথা লাগলেও নিয়ে যাও। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে।
এটুকুতে শুভ বেশ বিব্রত হয়ে গেছে।
তার চাহনিও পাল্টে গেছে।
দুম করে বলে বসল।
: বাহ! রেড কালারে তোমাকে তো ভারী সুন্দর লাগে।
তিথি মুখ ফুটে কিছু বলল না।
উল্টো ঝাড়ি দিয়ে বসল।

: তুমি যাও। আমি শোবো।

শুভ বালিশটা ছুড়ে ফেলে দেয় বিছানায়। তিথি অবাক হয়ে যায়।

: মানে কি?
তিথি কথা শেষ করল না। এর আগেই শুভ তিথির কোমর জড়িয়ে ধরল। শুভর গায়ে টিশার্ট নেই। পুরোপুরি উদোম গা । তিথির শরীর কেমন কেঁপে কেঁপে উঠে। শুভ আরো কাছ আসে। তিথির এলোমেলো লাগছে। কি হলো এটা। এত সহজে ধরা দিতে হবে। যতটা শক্ত হতে চেয়েছিল মনে মনে মুহুর্তে সব গায়েব। শুভ আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরতেই তিথি ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। শরীরের সুখ মনের সুখ সব একই জায়গায় গাঁথা। এটাই কি সংসার। কারোর কাছে তা সুখ কারোর কাছে অসুখ।
তিথি সেই সুখের কাছে হারাতে লাগল। ক্রমশ।

তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here