দলিল – ৮
খুব সকালে ঘুম ভেঙেছে তিথির। ঘড়িতে তখন সাড়ে ছয়টা বাজে। জানালার গ্লাস খোলা ছিল রাতে। মাঝরাতে তিথির কেমন গুমোট লাগে সব বন্ধ থাকলে। তাই অল্প খোলা রাখে। হালকা বাতাস আসছে। বেশ হিম ধরা। সেই ঠান্ডা বাতাসে শুভ জড়সড় হয়ে আছে। এতক্ষন সে।তিথির গা ঘেষে ছিল। তিথি উঠে যেতেই উপুড় হয়ে শুয়েছে। তবুও উঠেনি। এত সকালে শুভ কখনও জাগে না।
তিথি উঠে পরেছে। আজ অনেক তাড়া। অনেক কাজ। একটার মধ্যে বেরিয়ে পড়তে হবে। বাসায় মাকে জানায়নি। ইচ্ছে করল না। কোথায় যেন একটু বাধে। বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়িতে অলিখিত একটা অধিকার হারায়। আগের কিছুই থাকে না। কেউ কিছু বললে একটা অহেতুক মন খারাপ এসে ভর করে তখন।
যাবার কথা শুভ জানে না। বলাও হয়নি।
এখন বললে হয়তো রিএ্যক্ট করবে।
দশ মিনিটে তিথি ফ্রেশ হয়ে বেরিয়েছে। শাওয়ার নেবার পর বেশ হালকা লাগে শরীর। কেমন চনমনে হয়ে উঠে।
চনমনে শরীর নিয়ে তিথি সুন্দর সকাল দেখতে ব্যলকনিতে আসে। । টবে আজ পানি দেয়া হয়নি। যদিও সবুজ পাতাগুলো ভেজা। কুয়াশার একটা হালকা প্রলেপ রাতভর চুইয়ে চুইয়ে পড়েছে। এতেই গাছগুলো প্রাণবন্ত হয়ে আছে।
তিথি অল্প করে পানি দিলো। কারন আগামী কয়েকদিন গাছগুলোতে পানি দেয়া হবে না। শুভকে বললেও লাভ নাই। এসবে তার প্রচন্ড আপত্তি।
গাছপালা তার অপছন্দ। বিরক্তিকর জিনিস।
কিছু খেতে হবে। একদম খালি পেট। তিথি কিচেনে ঢুকল। কিচেন যথেষ্ট অপরিষ্কার হয়ে আছে। কাল মিনার ছুটি ছিল। তাই সমস্ত হাড়ি প্লেট এটো। সিঙ্কে জমে আছে সব তিথি এটো প্লেট ধুতে পারে না। বিচ্ছিরি লাগে তার। এখন মিনা আস পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
এই ফাঁকে তিথি চট করে এক মগ কফি বানিয়ে সাথে দু পিস কেক নিয়ে ব্যলকনিতে চলে এলো।
চেয়ারে বসে কফি খেতে খেতে পুরো দিনের প্ল্যান করে ফেলল।
উত্তরা যাবে আগে। লাগেজ বাসায় রাখবে। তারপর কিছু কেনাকাটা আছে। একটা সিভি ড্রপ করতে হবে ।
তিথি জবের জন্য চেষ্টা করছে। ইন্টার্ভিউ দিয়েছে বেশ কয়েকটা। খুব আশায় আছে। একটা কিছু হয়ে গেলে বেঁচে যাবে। পরের উপর নির্ভর থাকা আজকাল মেয়েরা করে না। এদের আত্নসন্মানবোধ বেশী।
ইচ্ছেমত টাকা খরচ করা। নিজের জন্য ভাবতে পারা যেকোন সিদ্ধান্ত নেয়া জব ছাড়া সম্ভব নয়।
জব থাকলে নিজের একটা পরিচয় হয়। মানুষ সমীহ করে চলে তখন।
শুভ তার জবের বিষয়ে তেমন কিছু জানে না।
অবশ্য কিছু ইঙ্গিত মাঝে মাঝে তিথি দিয়েছে। কিন্ত শুভ সেটা বুঝেনি।
তবে তিথি ঠিক করেছে আজ কিছু আলোচনা করবে। একপক্ষীয় দিকগুলো নিয়ে শুভর সাথে খোলাখুলি বলা ভালো। শুভ আজ বাসায় আছে। তার দুদিনের ছুটি ছিল। প্রথমদিন গতকাল চলে গেছে।
আজ দ্বিতীয় দিন।
আজ পুরো দিন সে রিলাক্স করবে। মুভি দেখবে। ঘুমাবে। বাইরে যাবে হয়তো।
আচ্ছা তিথি কি শুভকে বলবে তাকে উত্তরায় নামিয়ে দিয়ে আসতে। যদিও সবসময় তাই হয়েছে। নাহ আজ তিথি একা যাবে। অত নুয়ে থাকা ছাড়া উচিত।
সাতটা বাজতেই মিনা ঢুকল। সে এসে কিচেন পরিস্কার করল। এরপর এটো প্লেট হাড়ি ধুয়ে পরোটা বানিয়েছে। সবজি করেছে। তিথি আগে পিছে থেকে সব শেষ করল। দুপুরে সে খাবে না। একা শুভর জন্য তাই খিচুরির আয়োজন করে রাখল। নাশতার পর রান্না করে ফেলবে।
টেবিলে নাশতা রেডী।
সবজি পরোটা ডিম আর মিষ্টি।
ফ্রিজে মিষ্টি রাখা আছে।
শুভ মিষ্টি খায় না খুব একটা। ডায়েট মেনে চলে। কিন্ত তিথির মিষ্টি লাগবেই।
বিশেষ করে পরোটা হলে।
মিনা নয়টার মধ্য কাজ শেষ করে চলে গিয়েছে। শুভ উঠেছে আরো পরে। তিথি তখনও নাশতা করেনি। শুভর জন্য অপেক্ষা করছিল।
প্রচুর ক্ষিধে নিয়ে বসে থাকা অসম্ভব।
তিথি ডাইনিং থেকে চেচিয়ে ডাকল।
: তুমি বের হবা না?
ওয়াশরুমের দরজা খুলে শুভ মুখ বার করে জানতে চাইল।
: আজ এত তাড়া কেন?
: খুব ক্ষুধা পেটে।
: খেয়ে ফেলো।
শুভ ধড়াম করে দরজা লাগিয়ে দেয়।
শুভ বের হবার আগেই তিথি নাশতা করে নিলো।
এরপর টেবিল গুছিয়ে রুমে চলে আসে। আলমারী থেকে ছোট ট্রলি ব্যাগ নামিয়েছে। খুব বেশী কিছু নেবে না। তবুও ব্যাগ ভরে যাবে।
কয়েকটা ড্রেস টুকিটাকি সব ঢুকিয়ে রাখল। গোছানো শেষ। এখন রান্নাটা করে ফেললে সব কমপ্লিট।
শুভ বের হলো ঝকঝকে চেহারা নিয়ে। নীল টিশার্ট পরনে। সুন্দর লাগছে দেখতে। তিথি এক পলক দেখে আলমারী বন্ধ করল। পেছনে যে শুভ আছে বুঝেনি।
: কি করছো?
তিথি ব্যাগটা সরিয়ে একপাশে রেখে বলল।
: কিছু না,।
: কোথায় যাবে?
শুভ অবাক হলো।
: আম্মার ওখানে।
শুভ এতক্ষন খেয়াল করেনি তিথি ব্যাগ গুছিয়েছে। এবং তাকে না জানিয়ে।
সে ব্যাগের দিকে আঙুল তুলে বলল।
: ওটা কেন?
: থাকব, কয়েকদিন।
: ওহ। আজই যাবে?
: হুম।
: হঠাৎ।
শুভ এটুকু বলে থেমে যায়। তার মাথায় ঘুরছে তিথি হঠাৎ উত্তরায় কেন যাচ্ছে। তাছাড়া এতগুলো টাকার বিষয়টাও ক্লিয়ার করা লাগবে।
এসব ভাবতে ভাবতে সে ডাইনিং এ চলে এসেছে তিথিও পেছনে পেছন এলো। টেবিলে শুভ খেতে।বসেছে। কিন্ত বেশ আনমনা।
তিথিই প্রথম শুরু করল।
: এমনি। কেমন বোর হচ্ছিলাম। তাছাড়া তোমারও একটু স্পেস দরকার।
শুভ পরোটা ছিড়ে মুখে দিচ্ছে।
: আমার স্পেস লাগবে মানে, কি বলছো এসব।
তিথির কথাটা ইঙ্গিতবহ ছিল। কিন্ত শুভ গায়ে মাখল না।
: শুভ তুমি আমাকে কেমন এড়িয়ে চলো ইদানীং। তুমি কি এখনই টায়ার্ড হচ্ছো?
শুভ বুঝতে পারছে তিথি আজ গভীরে চলে যাচ্ছে। এতদিন ধরে শুভ কিছু ভুল করে আসছে। আজ সেটার মুখোমুখি হতে হবে বোধহয়।
: কোথায় এড়িয়ে চলছি? তিথি তুমি একটু বেশী ভেবে ফেলছো মনে হয়।
তিথির গভীর চোখে শুভ তাকাতে পারছে না। এটা সত্যি তিথির প্রতি তার ভালো লাগাটা সাদামাটা হচ্ছে। এটা কি সংসারের নিয়ম। নাকি একসাথে থাকার কারনে একঘেয়েমি চলে আসার কারনে।
: শুভ মাত্র তিন বছর হলো আমাদের সংসারের। এরই মাঝে সুর হারিয়ে যাচ্ছে। কেন, তাছাড়া আমরা তো বোঝাপড়ার জায়গাটা ছেড়ে এসেছি অনেক আগে তাই না? আমরা একে অপরকে চিনতাম। জানতাম।
তাহলে সমস্যটা কোথায়?
আমাদের মাঝে বাস্তবতা যেমন আছে। তেমনি ইমোশনও আছে। তুমি আমার ইমোশনকে ইগনোর করবা সেখানে আমি কি করে থাকবো বলো?
: কি করলাম আমি?
: তুমি আমার প্রতি অবহেলা করছো। তার মানে আমাদের সম্পর্কের মাঝে দ্বিধা চলে এসেছে। কই আমি তো তোমায় অবহেলা করি না। এটা আমার ইমোশনকে অপমান করা।
তোমার কি মনে হয় এমন অপমান আমি সহজে মেনে নেবো?
শুভ চুপচাপে খাচ্ছে।তিথি খেয়াল করল সে বেশ সহজ ভাবে নিয়েছে কথাটা।
খাওয়া শেষ করে চা নিলো। তারপর শান্ত ভঙ্গিতে বলল।
: এত ভারী ভারী কথা কেন, কি হয়েছে তিথি?
: প্রশ্নটা আমারও শুভ, কি হয়েছে তোমার। এই যে নানা ভাবে আমাকে এড়িয়ে যাও। তুমি কি আমাকে নিয়ে কনফিউজড?
শুভ চা শেষ করেছে। আরেক কাপ চা হলে ভালো হত। দীর্ঘ আলোচনার মাঝে চায়ের বিরতি প্রয়োজন।
: কি রকম?
: যেমন আমাকে এখন ভালো লাগে না। না কোন কারন নাই। হতে পারে তোমার রুচির জায়গাটা পরিবর্তন হয়েছে। একসময় যা ভাবতে তা এখন ভুল মনে হয়।
আমাকে আগে ভালবাসতে এখন আর বাসো না।
: না, তা নয়।
: যেমন আমি তেমন সুন্দর নই। যা তোমার বাবা বোন সবসময় বলে। তোমাকে বলে তুমি শুনো। বিয়ের পর পর বলেছে তুমি তখন রিএ্যক্ট করতে। আমি কষ্ট পেতাম বলে আমাকে বুঝিয়ে রাখতে এখন ওরা বললেও রিএ্যক্ট করো না।
আমি কষ্ট পাই তুমি তবুও বল না।
তুমি কি ভাবো আমি সবসময় কেবল শুনে যাবো। তোমার বোন এমনই। কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। তার শ্বশুরবাড়ির মানুষজনকে নিয়েও বলে। তুমি এটা আমাকে বলতে আসবা জানি। কিন্ত এক কথা বারবার কাউকে বললে, বারবার কাউকে খোচালে ভালো লাগে?
আমি তেমন কিছু বলি না। কেন জানো এগুলো অশান্তি আনে। কিন্ত সবসময় চুপ থাকা সম্ভব না। তোমার আব্বাও কথায় কথায় বলে কালো মাইয়া।
এই যুগে মেয়েরা সাদাকালোতে পড়ে নাই শুভ।
আমি নিজেকে সন্মান করি। কিন্ত তোমার বাড়ির পরিবেশ আমাকে অসন্মান করে।
তোমার কি মনে হয় আমার এখানে থাকতে ভালো লাগে?
শুভ এতক্ষন চুপ ছিল। কিন্ত তিথির প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়া লাগবে।
: তুমি আমার সাথে থাকছো। তাদের সাথে না।
: কিন্ত তুমি তাদের দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছো। তারা দুর থেকে যা বলে তুমি সেটাই সত্য বলে ধরে নাও।
আমি এসব দেখছি বহুদিন থেকে। আজ বললাম।
আমার এখন মনে হচ্ছে কিছুদিন তোমার থেকে সরে যাই। তুমি ভাবো। তোমার মস্তিস্ক দিয়ে নিজেকে যাচাই করো। তারপর যদি মনে হয় কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাও। আমাকে জানাও।
শুভ গোলগোল চোখে তিথিকে দেখছে। এতটা কঠিন হবার কারন সে নিজে। কিন্ত সহজে নিজের দোষ সে স্বীকার করবে না।
: ঠিক আছে। কবে ফিরবে?
: জানি না।
তিথি উঠে গেলো। টেবিলে শুভ একা বসে আছে। তার মন এখন স্থির না। তিথি চলে যাচ্ছে মানে অনেক কিছু। তিথির আত্নসন্মানবোধ প্রখর। এমন একটা মানুষকে নিয়ে সে দ্বিধায় আছে।
কয়দিন থাকবে সেটা দেখার বিষয়। তিথির প্রতি তার ভালো লাগা কমছে। একঘেয়েমি লাগে। তাই তিথি চলে যাক এটাই কি শুভ চেয়েছিল।
শুভ ভাবনায় পড়ল। কিন্ত আজকে তার রিলাক্স মুডে থাকার কথা।
তামান্না হাসান