দলিল ৯

0
317

দলিল ৯

উত্তরায় তিথি এসেছে আজ চারদিন হয়।
মা সায়রা বেগম এতে ভীষন খুশী। এতদিন পর মেয়েকে কাছে পেয়েছেন। শুভ আসেনি কেন সেটার কারনে সামান্য মনঃক্ষুণ্ণ। তিথি কৌশলে সব ম্যানেজ করে নিয়েছে।
অনেকদিন পর তিথিরও বেশ রিলাক্স লাগছে। তাকে বেশী বেশী গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বাসায়। অনুভুতি খুব সুখকর। কারন শুভর থেকে দুরে আছে। অযথা প্যারা নাই। এমন একটা সাময়িক বিরতি নেবার দরকার ছিল। যদিও এটা সমাধান না।
শুভ ফোন দিয়েছে বেশ কয়েকবার।
তিথি এতে টলেনি। বরং বেশ শক্ত অবস্থানে আছে।
মা বহুবার বলেছে শুভ যেন চলে আসে। কটা দিন থেকে যাক। তিথি হা না।কিছুই বলেনি।

বড়বোন তানি রোজই বিকেল হলে চলে আসছে। চাঁদের হাট বসে এই উপলক্ষে। সেও উত্তরাতে থাকে। তানির দুই ছেলেমেয়ে সারা আর মাহির। এরা এলে পুরো বাড়ি হুড়োহুড়িতে মেতে উঠে। তিথির পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যায়। যখন তারা ভাইবোন সব একসাথে মজা করত।

উত্তরার বাড়িটি চারতলা। বাবা কিবরিয়া খন্দকার সরকারী চাকরী করতেন। এখন অবসরে আছেন। চাকরী করা অবস্থায় তিনি বাড়িটি করেছেন। প্রায় পচিশ বছর আগ। সেই হিসাবে পুরানো বাড়ি। ডিজাইন বা নকশার দিক থেকে। ছেলে পাভেল তার সাথেই থাকে। ব্যাংকে জব করে। ছেলে বউ রিয়া গৃহিনী। তাদের একমাত্র মেয়ে ইমা।
পাভেল চুপচাপ স্বভাবের। ছোট থেকেই এমন। ইদানীং আরো চুপচাপ হয়ে গেছে। তিথি আসাতে তার প্রতিক্রিয়া পজিটিভ নাকি নেগেটিভ বুঝা যাচ্ছে না। সে অফিসে করে দশটা পাঁচটা। আসা যাওয়ার পথে তিথির সাথে হাসি মুখে কথা বলে। তবে খুব বেশী উচ্ছাস নাই । ভাবী রিয়া ভীষন চতুর মেয়ে। সাংসারিক। সবাইকে খুশী রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে।

তিথি এসে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে তার রুম নিয়ে। ইমার পড়ার টেবিল সেলফ সব গাদা করে সাজানো তার রুমে। এটা দেখে প্রথম দিনেই এসে তিথি মাকে অভিযোগ করে বসে।

: মা আমার রুমে বইপত্র কেন?

সায়রা বেগম জানতেন এটা নিয়ে সমস্যা হবে। তিথি হয়তো মানবে না। তবুও নরম সুরে মেয়েকে বুঝিয়ে বলেন।

: তিথি তোরা থাকিস না। রুমটা খালিই পড়েছিল।
এদিকে ইমার পড়ার রুম ছিল না। টিচার এলে বসার রুমে পড়তে হত। এতে নাকি ইমার ডিস্টার্ব হচ্ছিল।তাই রিয়া এসে আমাকে বলল তোর রুমট যেন দিয়ে দিই।

তিথি এই কথা শুনে রাগ করলেও জোর দিয়ে কিছু বলতে পারল না।

: বাহ। আমরা পরের বাড়িতে চলে গেছি বলে এখানকার সব অধিকার চলে গেছে?
আমরা এসে কোথায় থাকব তাহলে?

সায়রা বেগম মেয়েকে বুঝিয়ে শান্ত করে। তিথি এরপর কথা বাড়ায়নি।

: তোরা কদিন আর থাকিস। এ কদিন একটু মানিয়ে নে। ইমা বড় হচ্ছে। ওর জন্য কদিন পর আলাদা রুম দিতে হবে। সেটা নিয়ে ভাবনায় আছি।
যৌথ ফ্যামিলিতে থাকলে মন বড় করে থাকতে হয়। সবার আগে নিজেরটা বুঝলে হয় না।

তিথি বেশ হোচট খেলো। সত্যিই তো। এভাবে কখনও ভাবা হয়নি। ইমা এখন এই বাড়ির মেয়ে। তার অধিকার তিথির চেয়ে বেশী।
একসময় তিথির যতটা প্রভাব ছিল এখন ইমার ততটা।
তিথির চুপ থাকা দেখে সায়রা বেগম কাছে এসে আলতো করে পিঠে হাত রাখলেন। তিথি জানে মা তাকে এখন সান্তনা দেবে। বাস্তবতা বোঝাবে।

: মন খারাপ করলি?

: নাহ।

: তোরা তোদের সংসারে চলে গেছিস। আমরা বুড়ো হয়ে গেছি না? এখন রিয়া ইমা ওরাই আমার কাছে তোদের মত।
তাদের সুবিধা অসুবিধা আমাকেই দেখতে হবে।
মায়ের দৃষ্টিতে কি ছিল তিথি বুঝে গেছে।

তিথিকে এরপর আর কিছুই বলতে হয়নি। সায়রা বেগম দেখলেন তিথির মন বেজার। আগে এটা তিথির নিজের রুম ছিল। বিয়ের পর পর ফাঁকাই থাকত। এখন ফাঁকা নেই। সংসারে কোন শূন্যস্থান দীর্ঘদিন ফাঁকা থাকে না। পুরন হয়ে যায়।

দুপুরে ঘুমিয়ে পড়েছিল তিথি। হৈ চৈ শুনে জেগে যায়। তানি এসেছে তার দুই বাচ্চাকে নিয়ে। রীতিমত বাজার বসেছে।
সায়রা বেগমের কাচা ঘুম ভেঙেছে। কিছুটা বিরক্ত হলেও মুখে তা প্রকাশ করল না। তানির মাথা গরম। কিছু হলে রেগে যায়। এরপর ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে। তানি এসেই বকবক শুরু করে। ননস্টপ কথা বলে। সায়রা বেগম ধৈর্য ধরে সব শুনেন।

তিথি পাশের রুম থেকে উঠে এলো।
ঘুম ভাঙা চোখে তিথি দেখে তানি নিচু গলায় কি একটা নিয়ে আলাপ করছে। তিথিকে দেখে থেমে যায়।
সায়রা বেগম তিথিকে ডেকে কাছে এনে বসায়।
তানি বেশ আড়চোখে লক্ষ্য করে। তার চেহারায় একটা লুকোচুরি ভাব।

: ওরে বাবা আম্মা এখনও তোকে আগের মতই আদর করে। তোর কপাল রে তিথি।
বাপের বাড়িতেও আদর শ্বশুরবাড়িতেও আছিস মহাসুখে।

তিথি তেমন একটা পাত্তা দিলো না। তবুও কিছু বলতে হয়।

: আপা কি যে বলো না। আম্মা কি শুধু আমাকে আদর করে, তুই কি পানিতে ভেসে এসেছিস?
তোকেই বেশী আদর করে।
বড় মেয়েরা লাকি হয় বুঝলি?

তানি ভেতরে ভেতরে বেশ জেলাস হচ্ছে। তিথিকেও সে খুব একটা সহ্য করতে পারে না। ।

: লাকি না ছাই। তোকে আব্বা আম্মা দুজনই বেশী ভালবাসে।
দেখিস না আমি এলে আব্বা কেমন বিরক্ত হয়।

সায়রা বেগম মেয়ের কথায় আমলে নিলো না। তার মুখ ফসকে তবুও বেরিয়ে এলো।

: তানি এসব কি বলিস। তোর আব্বার বয়স হয়েছে বাচ্চাগুলো এসে হৈ চৈ করলে তার শরীর খারাপ লাগে।

তানি মুখ কালি করে রাখছে। এখন তার মুখে যা আসে তাই বলবে।

: কেন তোমার ছেলের নাতনী হৈ চৈ করে না, খালি আমার বাচ্চারা করে?

তানির আচরন দেখে তিথি অবাক হয়। এত অবুঝ এই বয়সে।

: আপা কি হইছে। বাচচারা হৈ চৈ করলে আম্মা আব্বা কথা বলবেই। এটা নিয়ে আবার কথা কেন।

: তুই কি বুঝবি। এখনও তো বাচ্চা কয়নি। কদিন পর দেখিস তোকেও শুনতে হবে।
আম্মা তো সারা মাহিরকে পছন্দই করে না। সারাক্ষন ইমা ইমা করে।
এগুলো আমরা বুঝি না?
সায়রা বেগম মেয়ের কথায় কান দেন না।
তার মেয়েটার বুদ্ধি শুদ্ধি কমই ছিল। এখন আরো কমেছে।

: তানি শোন মা, আমার কাছে সবাই সমান। তোর ছেলেমেয়ে আর ইমার মধ্যে।কোন ফারাক নাই।

: তাই? আমি সব বুঝি। তুমি ইমাকে বেশী আদর করো।

তিথি হেসে ফেলল। সে তানিকে ইশারায় কিছু না বলতে বলল।

: আপা, আম্মা এদের নিয়ে থাকে বুঝলি। এদের প্রতি আম্মার আলাদা টান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কেন সারা মাহিরকে ওর দাদী আদর করে না?

তানি ঠোট উল্টিয়ে ফেলে।
: ইশ! ভালো বলছিস। আমার বাচ্চারা মন্দভাগ্য নিয়ে এসেছে বুঝলি। ওর দাদী তার মেয়ের নাতিকে নিয়ে পড়ে থাকে। আমার শাশুড়ি আম্মার মত না। ছেলের বউ আগে না তার মেয়ে আগে।

সায়রা বেগম বেশ চিন্তিত। মেয়েটা দিন দিন বোকা হয়ে যাচ্ছে। যেখানে যায় ঝগড়া বাঁধায়।

: তানি তুই শাশুড়িকেও দেখতে পারিস না। আমি মা আমাকেও দেখতে পারিস না। তাহলে কার সাথে চলবি?

তানি এই কথায় ভয়ংকর রাগ করল। সে সোজা রুম ছেড়ে চলে যায়। পিছু পিছু তিথিও এলো।

তানি রুমে এসে কাঁদছে। ওড়নার কোনা দিয়ে চোখ মুছে আর কাঁদে । তিথি দেখল তাকে কিছু বলা দরকার।

: আহা কি হলো?

তানি চোখ মুছে বসল। একদম স্বাভাবিক। তিথি বিস্মিত চরমে তার আচরনে । মুহুর্তে মুড বদল।

: তিথি শোন জরুরী কথা আছে।
আম্মাকে তো।চিনিস নাই। আমাদের সাথে যা করে সব উপরে উপরে। সে রিয়া ইমা ছাড়া পথ দেখে না বুঝলি। আমার কি মনে হয় জানিস রিয়া আম্মাকে হাত করেছে কিছু খাইয়ে। দেখিস না আম্মার কত যত্ন করে। এইসব চালাকি।
ঐ মেয়ে বহুত চালাক। আম্মাকে হাতে রাখে কেন জানিস?

তিথি এসব কথা শুনতে চাইছে না। যতই ঘাটাবে ততই নোংরামো হবে। সম্পর্কে তিতা আসবে।
তবুও অনিচ্ছায় কথা বলছে।

: কেন?

: যাতে আম্মার সব গয়না ইমা পায়। রিয়া ভীষন চালাক মেয়ে। এমন ভালো মানুষের ভাব ধরে থাকে। কেউ বুঝবে না তার পেটে কি আছে। আম্মা একবারে গেছে। বউ বলতে অজ্ঞান।
তুই রিয়াকে নিয়ে কিছু বললে দেখিস কি উত্তর দেয়।

: তোর বাচ্চা হোক দেখবি একচুল দাম পাবি না এই বাড়িতে।

তিথির কেমন অদ্ভুত লাগল। নিজের মাকে নিয়ে কত কথা বলছে তানি তার মুখে একটু আটকায় না।

: আপা কি বলিস?

তানি মজা পাচ্ছে এসব বলতে। তার আগ্রহ বেড়েছে।

: হুম। সব সত্যি। তুই যে আছিস দেখ গিয়ে আড়ালে কত কথা হইতেছে।

তিথি গভীর ভাবনায় পড়েছে।

: কি কথা?

: এই যে একা একা চলে এলি। কেন। কি হয়েছে। শুভ আসে নাই কেন।

তিথি উল্টো বলে বসে।

: প্রশ্নটা কি তোরও?

: আরে না। তোকে টাচ দিয়ে রাখলাম তলিয়ে দেখিস। আরে শোন না আম্মার যে গহনা আছে। সেগুলো একবার দেখিস তো।
আম্মা কখনও আমাদের দেখায় না। কিন্ত আম্মার মোটামুটি বিশ ভরি সোনার গয়না আছে। এগুলো কি করবে বল তো। এই বয়সে আর তো পড়বে না। কিন্ত এগুলোর তো ফায়সালা আছে। কে কে পাবে এটা জানতে হবে না?

: আপা তোর বিয়েতে আম্মা গহনা দিয়েছে তো?
তোর পাওনা শেষ।

: না। শেষ না। আমাদের পাওনা শেষ। এখন তার নাতি নাতনীদের পাওনা আছে। আমি জানি আম্মা ওগুলো সব ইমাকে দেবে।
কিন্ত আমি এটা হতে দিবো না। আমার মেয়ে সারাকেও দিতে হবে। একবারে সমান সমান।

তিথি শোন তুই যেমন আমি তা নই। আম্মাকে রিয়া হাতের মুঠোয় রাখে। রিয়া যা বলে তাই মানে।
এটা শুধু গহনা হাতিয়ে নেবার জন্য বুঝলি?

তিথির মন খারাপ হয়েছে নিজের মাকে নিয়ে তানি এভাবে ভাবছে এটা নিচুতা।

: রিয়ার বোনেরা নিয়মিত এই বাড়িতে আসে তখন ওদের জন্য কত কিছু রান্না হয়। সব ভালো ভালো পদ।
পোলাও রোস্ট সব হয়।
কই আমি যে আসি রিয়া দেখিস এক বাটি নুডলস নয়তো বড়া চা দিয়ে বিদায় করে দেয়।
আম্মাও তেমন কিছু বলে না। সেজন্য রিয়া এত লাই পেয়েছে।
আম্মা যদি আমাকে গুরুত্ব দিত দেখতি কত কি রেধে আমাকে খাওয়াতো।
আমি কি খেতে আসি, না রে। এসব দেখি বলে মনে কষ্ট পাই।

সারা মাকে ডাকছে। তানি বের হয়ে গেছে।তিথি বুঝতে পারল না এত বেশী আড়াআড়ি সংসারে কেন ঢুকে যায়। আসলে সবাই স্বার্থপর। সবাই খালি নিজেরটা বুঝে।
এমন সময় রিয়া ট্রে হাতে রুমে ঢুকে। তিথিকে দেখে মিষ্টি করে হাসে।

: কি মন খারাপ নাকি তিথি?

: নাতো।

: হুম।

রিয়া ট্রে থেকে প্লেট তুলে তিথির হাতে ধরিয়ে দেয়। ফুলকপির বড়া ভাজা। সুন্দর ঘ্রান পাচ্ছে। সাথে মগ ভর্তি কফি।

: এত কি করছো?

: খাও। খেয়ে মন ভালো করো। আর শুভকে আসতে বলো।

তিথি খাবারটা হাতে নিয়ে এক মুহুর্ত রিয়াকে লক্ষ্য করে। রিয়ার মুখ হাসি হাসি। কিন্ত তার ভেতরে অন্য কথা।
মেয়েটা চতুর ধরনের। মানুষকে কায়দা করে।হাতে আনতে পারে। সে তিথিকে শুভর কথা বলেছে। কারন শুভ আসা মানে তিথির চলে যাওয়া।
রিয়া কি চাচ্ছে তিথি এই বাড়ি থেকে চলে যাক। ইনফ্যাক্ট মাও কি চাইছেন। শুধু মুখে বলতে পারছেন না।
তার মানে তিথির আসাটা কেউ ভালো ভাবে নেয়নি।
তাহলে কি তানিই ঠিক বলেছে।

: শুভ আসবে মানে?

রিয়া কিছুটা দমে যায়।

: ওমা জামাই আসবে না বাড়িতে?

: হুম।

রিয়া চলে যেতেই তিথি উঠে পড়ে।
তারপর কফি হাতে সোজা ছাদে চলে আসে।
ছাদটা ভীষন খোলামেলা। তিথি হেঁটে হেঁটে কফি খেলো। কিন্ত মন খারাপ নিয়ে। সে বুঝতে পারছে না আসলেই কি মা তাকে বলতে পারছে না যে তার চলে যাওয়া দরকার।
হঠাৎ করে ভেতরটা বড্ড খালি খালি লাগছে। কেমন একটা শূন্যতা ভেতরে। একটা হাহাকার। কেউ পাশে না থাকার।
তিথির চোখ ভরে জল এলো।
আসলেই সংসার বড় কঠিন জায়গা। এখানে কেউই আপন হয় না।

তামান্না হাসান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here