এমেলিয়া,০৩,০৪

0
319

#এমেলিয়া,০৩,০৪

০৩

৩য় বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের ফলাফল দিয়েছে। কবির দৌড়ে এসে অদ্রিকে জড়িয়ে ধরে।আরে গেদু কি হরছ বেটা তুই তো এক্কেরে হাটাই দিছো।
এই কবির ছেলেটা চমৎকার মানুষ।আল্লাহ কিছু কিছু মানুষকে নিজের হাজার মন খারাপ থাকলেও অন্যের মন ভালো করার বিশেষ ক্ষমতা দিয়ে দুনিয়ায় পাঠায়।কবির তাদের মধ্যে একজন।হঠাৎই টেবিলে থাকা ক্যালেন্ডারের দিকে অদ্রির চোখ পরে। এই রে.. ক্লাস,পরিক্ষা, প্রেজেন্টেশানের চাপে কি বার সেটাই ভুলে গিয়েছি।দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে অদ্রি বেড়িয়ে পড়ে।শাহবাগে নেমে সামনে হাঁটা দিতেই দেখতে পায় এমেলিয়া ফুল বিক্রি করছে।এমেলিয়া আরে এএএই এমেলিয়া এইদিকে আয়।দৌড়ে আসে মেয়েটা।
–ভাইয়া গত বুধবার কই ছিলেন,আসলেন না যে,আমি আপনাকে অনেক খুঁজেছি।
অদ্রি একবার তাকায় মেয়েটার দিকে।অঙ্গভঙ্গিতে যেন মনে হচ্ছে অদ্রির উপর এক আকাশ অধিকার তার।
–কেন রে?আমাকে কি কারণে??
এমেলিয়া কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পারে যায় সাথে খানিকটা লজ্জাও ভর করে।প্রশ্নটা বোধ হয় ব্যক্তিগত হয়ে গিয়েছে।অদ্রি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রসঙ্গ পাল্টায়।মেয়েটার যথেষ্ট ব্যক্তিত্ববোধ আছে।
চল সামনে হাঁটি। সারাদিন কিছু খাস নি তাইনা?মাথা নাড়ে এমেলিয়া।
এমেলিয়া কিভাবে বলবে তার ভিতরে যে পূর্ণিমার ভরা জোয়ারে উপচে পড়ছে।অদ্রির কণ্ঠস্বর ই যে তাকে এলোমেলো করে দিতে পারে এক নিমিষে তা কি অদ্রি কখনও জানতে পারবে??

এমেলিয়াঃ ভাইয়া ৩ বছর ধরে এই জায়গাটাতে কেন আসেন আপনি?
— জানতে চাস?
এমেলিয়া সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।
— ফুল এনেছিস?
— হ্যাঁ, এই যে নেন।
–আচ্ছা।
৩ বছর ধরে এই মেয়েটি অদ্রির ফুলের জোগান দিচ্ছে।হয়ত কিছুটা সময় করে এই প্রয়োজনের থেকে একটু কম দেখাটাই যে বন্ধুত্বের, ভরসার হয়তো কিছুটা অভ্যাসের কারণ ও হয়ে উঠেছে তা অদ্রি টের পায়।

অদ্রি বলতে শুরু করে,শোন এমেলিয়া,তখন ফার্স্ট ইয়ার,সদ্য ভার্সিটির গরম হাওয়া গায়ে লাগে।
এমেলিয়া নড়েচড়ে বসে।
অদ্রি বলতে শুরু করে, নতুন নতুন ক্যাম্পাস পেয়ে মনে মনে আনন্দের চূড়ায় উঠে যাই।কাউকে পরোয়া করিনা।একদিন ভার্সিটি গেইটে ঢুকতেই বড়লোক সুন্দরী সিনিয়রের সাথে ধাক্কা লেগে যায়।
রমনীর কথা শুনে ১৭ তে পা দেওয়া রূপসীর বুকের মধ্যে কালবৈশাখী নাড়া দিয়ে ওঠে।ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যায়।হিংসায় প্রায় কান্না চলে আসে।কোনো মত নিজেকে সামলায় এমেলিয়া। তারপর অদ্রিকে ইশারা করে গল্প এগিয়ে নিতে।
ইডিয়ট,চোখে দেখোনা নাকি?কোন ব্যাচ?কোন ডিপার্টমেন্ট?নাম কি?বাড়ি কই?
আমি তো রীতিমত ভড়কে যাই।ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় কাঁদো কাঁদো ভাব।মিস বুঝতে পেরে একটু নরম হন।ডেকে নিয়ে গিয়ে র্যাগের বদলে ট্রিট দেন। তারপর আর কি?সেই যে বকা শুরু হল এর পর ধীরে ধীরে প্রেম।বুঝিসই তো সিনিয়র জুনিয়র তার উপর আমি মধ্যবিত্ত আর সে বড়লোক। কনসেপ্ট টা পুরনো হলেও সামাজিক ট্যাবু তো পুরোনো হয়নি না…কতই না স্বপ্ন দেখতাম।মনে হতো তাকে ছাড়া বাচঁব না।টিউশান করতাম।সপ্তাহ শেষে প্রতি বুধবার সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই জায়গায় এসে দেখা করতাম।ওর পছন্দের ফুল ছিল লাল গোলাপ।বলতো ১১ টা লাল গোলাপ আনবে।ওর ধারণা পৃথিবীর সবথেকে সুন্দর সংখ্যা ১১। তাই সবসময় ১১ টা গোলাপই নিয়ে আসতাম। হঠাৎ একদিন ঠিক এই সময়ে আমার জীবনে নেমে আসে এক পৃথিবী বিষন্নতা।সেদিনও তপ্ত রোদ ছিল,ঝা চকচকে পরিবেশ। অবণী কালো রঙের শাড়ী পড়েছিল। ওর শ্যামবরণ গায়ের কালো শাড়ি আমার চকচকে মনের আকাশে ১ ফালি মেঘের আভা দিচ্ছিল।তখনও বুঝিনি এই মেঘ আমার জীবনে কালবৈশাখী নিয়ে আসবে। হাঠাৎই অবণী মাথা ঘুড়ে পরে যায়। প্রথমটায় কিছু না বুঝতে পেরে চোখে মুখে পানি দেই।তাতেও কাজ না হলে নিয়ে যাই ঢাকা মেডিক্যালে। ডক্টর জানায় ব্রেইন টিউমার।সময় মাত্র এগারো দিন।বাবা মার আলাদা হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা ওর উপর এত করুন প্রভাব ফেলবে বুঝিনি, আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করি।গোটা শহরে ও ছাড়া যে আমার আপন কেউ নাই।কিছু মানুষ কেন এত কম সময় নিয়ে দুনিয়ায় আসে??প্রত্যেকটা দিন আল্লাহ কাছে অবণীর জীবন ভিক্ষা চাইতাম।আল্লাহ আমাকে নিয়ে যাও তবুও মেয়েটা বেচেঁ থাকুক..
অদ্রির চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।এমেলিয়ার খারাপ লাগছে।তবে সেটা অবনীর জন্য নাকি অদ্রি কাঁদছে এইজন্য ঠিক বোঝা যাচ্ছেনা।নারী বড্ড আজব, যেই মেয়েটা দুনিয়াতেই নাই তাকেও ভালো লাগার মানুষের পাশে এক মিনিটের জন্যও ভাবতে পারছে না।প্রচন্ড হিংসা হচ্ছে।এজন্যই বোধ হয় বলা হয় নারীর মন বোঝা দায়।

চলবে….

লেখনীতে-Shahana urmi

#এমেলিয়া

হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে নেয় অদ্রি।দেখাদেখি এমেলিয়াও নিজের চোখ মুছে নেয়।গতকাল ও নাকি শহীদ মিনারে আরেকজনের লাশ পাওয়া গিয়েছে।হচ্ছে টা কি বলতো এমেলিয়া?ঢাকা শহর দিন দিন মানুষের বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে উঠছে।তোকে নিয়ে তো ভয় হয় রে।এমেলিয়াও খানিকটা ভয় পায় তবে প্রিয় মানুষটার সামনে ভয় পেলে চলবে না।ঢোক গিলে বুকে সাহস নিয়ে বলে, আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছ কেন ভাইয়া? আমি পথবাসী আমার কে কি করবে?
–তুই নিজেও জানিস না তোর ওই ভূবণমোহিনী রূপ,তোর সাধাসিধে চলন, তোর ক্ষতির কারণ হতে পারে আচ্ছা আজকে উঠি রে।অন্যদিন আসব।
–ঠিক আছে ভাইয়া।
অদ্রি চলে যায়।যাওয়ার পানে একমনে চেয়ে থাকে এমেলিয়া।অদ্রির এমেলিয়াকে নিয়ে এই সামান্য চিন্তা একরাজ্য স্বপ্ন এনে দেয় এমেলিয়ার চোখে।

দিন যায় এমেলিয়ার চোখে ১ আকাশ ভালোবাসা জমা হয় অদ্রিকে নিয়ে।আজকাল অদ্রি নিয়মিত আসে না।হয় তো জীবনের তাগিদে তার অবণীর জন্য টান ফিকে হয়ে যাচ্ছে।বয়ে চলার নাম ই তো জীবন।

দেখতে দেখতে আরো একটা বছর পার হয়ে গিয়েছে অদ্রি এখন অনেকটা পরিণত। চেহারায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বুদ্ধিমান যুবকের ছাপ।ভালো ফলাফল করায় কদর ও বেড়েছে।তবে অদ্রির কিভাবে যেন ওকালতির থেকে ইনভেস্টিগেশনের দিকে ঝোঁক বেড়েছে।চেয়ারম্যান ম্যামের সুনজরে আসায় নানান ডিটেকটিভদের সাথেও সখ্যতা গড়ে উঠেছে।২/১ টা কাজের অফার ও পাচ্ছে।

ঘড়ির কাটায় রাত প্রায় ২টা। নিস্তব্ধ ঢাকা।কুকুরগুলোও সারাদিনের ছোটাছুটির পর ঘুমিয়ে পড়েছে।মাথার উপরে নিশাচর পাখিগুলো থেমে থেমে ডানা ঝাপ্টাচ্ছে।ভয় লাগছে বেলার।রাশেদ সেই যে পানি আনতে গেল….কি থেকে কি হয়ে গেল? কেন এই সেইম ব্যাচ প্রেম পরিবারগুলো মেনে নেয় না?কেন বেকার যুবকের বেলা দের অন্যের ঘরনি হতে হয়?সমাজ কেন এত নিষ্ঠুর ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মোটা গলার মাতাল একটা সূর ভেসে আসে পেছন দিক থেকে।আজ পাশা খেলবোরে শ্যাম…ও শ্যাম তোমার সনে….প্রথমটায় মনে হয় রাশেদ মজা করছে। এই ছেলেটা পারেও বটে। ঘর থেকে পালিয়ে আসা অসহায় সিচুয়েশনেও মজা…কিন্তু না এটা তো রাশেদ নয় তবে কে?অনাগত ভয়ংকর আশঙ্কায় শিউরে ওঠে বেলা।দৌড়ে পালাবে নাকি রাশেদ রাশেদ বলে চিংকার করবে ভেবে পাচ্ছে না।বুক ধরফর করছে।এই বুঝি হৃদপিণ্ড মুখ দিয়ে বের হয়ে যাবে।চিৎকার করতে গিয়েও গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছেনা।অতর্কিতেই মাতাল মধ্যবয়সী লোকটা ঝাপিয়ে পড়ে হিংস্র থাবা বসায় বেলার শরীরে।কি অসুরে শক্তি,দু হাতে শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে বাধা দেয় বেলা। আশ্চার্য, এক চুল ও নরছে না লোকটা।মুখ দিয়ে নোংরা গন্ধ আসছে। বেলার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।চোখ গুলোও বুঁজে আসছে। মনে মনে ভাবছে রাশেদ আসবে কেউ আসবে আমাকে বাঁচাতে। হে আল্লাহ, আমার সহায় হউ। রক্ষা করো আমায়।নিজের অসহায়ত্বের কাছে হেরে যায় বেলা।এক মুহূর্ত বাবার মুখটা ভেসে ওঠে।এই বাবা কত কষ্ট করেই না লালন পালন করেছে।একবিন্দু অভাব বুঝতে দেয়নি।আজ এই কুৎসিত নিয়তিকে মেনে নিতে হবে ভাবতেই হঠাৎ লোকটা বুক চিরে ভয়ংকর আর্তনাদ করে ওঠে। বেলা ঘটনার আকস্মিকায় ভরকে যায়।কিছু বুঝে উঠতে পারেনা।তাকিয়ে দেখে একটা গাছের ফলা এফোর ওফোর হয়ে বের হয়ে সোজা গিয়ে ঠেকেছে বেলার বুকের উপর।অল্পের জন্য গাঁ ছোঁয় নি।বুকের উপর থেকে পাশে ধপাস করে পড়ে যায় লোকটার দেহ।ধরে যেন প্রাণ ফিরে আসে বেলার।আল্লাহকে লাখো কোটি শুকরিয়াহ জানায়। আশে পাশে তাকাতে চোখ পড়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অবয়বটার দিকে।তবে কি রাশেদ??
অবয়বটা অট্টহাসি দেয়। সে কি ভয়ংকর!হাসিতে যেন আকাশ বাতাশ কম্পিত হয়ে ওঠে।

চলবে…..

পর্ব:০৪
লেখনীতে-Shahana urmi

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here