আতর প্রথম পর্ব

0
641

রহস্যগল্প_#আতর
প্রথম পর্ব
লেখক খোন্দকার মেহেদী হাসান

লোকটা বলল, স্যার আমি একটা লকার নিতে চাই। খালি আছে কোন লকার?

আমি একটু নড়েচড়ে বসলাম। এই সাধারন কাপড় চোপড় পরা লোক লকার নিতে চাচ্ছে কেন বোঝা যাচ্ছে না। মধ্য বয়সী লোকটার পরনে সাধারন একটা ফতুয়া, ঘিয়ে রঙের একটা প্যান্টের সাথে ছাই রঙের ফতুয়া মোটেই মানানসই নয়। চুল দাড়িও পরিপাটি না, তেল দেয় না অনেকদিন। আমার ইতস্তত ভাব দেখে লোকটা বলল, স্যার আমি কাছেই থাকি, আমার একটা লকার লাগবে কারন আমার কাছে একটা দারুন দামী জিনিস আছে । ওইদিন আমাদের বিল্ডিঙয়ের নীচের তলায় চুরি হইছে, দিনে দুপুরে বাসার তালা ভেঙ্গে নগদ টাকা আর সোনার গয়না নিয়ে গেছে। ওই বাসার বউ বাপের বাড়ি গেছিল আর জামাই ছিল অফিসে। এর মধ্যে চোর কাজ সারছে। বাসার নীচে দারোয়ান ছিল, সে নাকি কিছু জানে না। আমি এখন চোরের ভয় পাচ্ছি , আমার জিনিসটা যদি নিয়ে যায়? তাই কাছে রাখতে আর সাহস পাচ্ছি না। আমারে একটা লকার দেন।

এবার আমি বিরক্ত হলাম। লকারে ক্লায়েন্ট কি রাখবে সেটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপার তবুও কোন অবৈধ জিনিস যাতে সে না রাখতে পারে সেটা খেয়াল রাখা আমাদের দায়িত্ব। এই লোক কি রাখতে চায় লকারে?

আমি হালকা চালে বললাম, কি রাখবেন লকারে?

লোকটা বলল, এক শিশি আতর!

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আতর!

লোকটা তার ছোট ব্যাগ থেকে একটা মাঝারি সাইজের নীল রঙের কাঁচের বোতল বের করে টেবিলে রাখল।

তারপর আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলল , স্যার এটা সাধারণ আতর না। কয়েকশ বছরের পুরানো আতর। আমার এক পূর্বপুরুষ মিশর থেকে আনছিল। এই আতর একবার মাখলে ঠিক একমাস এর ঘ্রাণ থাকে। একদিন বেশীও না আর কমও না। আর এই একমাসে নানা আশ্চর্ষ ঘটনা ঘটে। তবে শর্ত আছে। দশদিন পর পর মোট তিনবার এই আতর মাখতে হবে। দশদিন পর আতর না মাখলে ঘ্রান থাকবে কিন্তু উলটো ফল হবে, বিপদে পড়বেন।

আতরের শিশির ডিজাইনটা একটু অদ্ভুত ধরনের বটে কিন্তু কেউ যদি বলে এটা কয়েকশ বছর আগে মিশর থেকে আনা তাহলে সেটা বাড়াবাড়ি সন্দেহ নাই।
আমি বুঝে গেলাম লোকটা ফ্রড ধরনের। আমাকে ভুজুং দিয়ে টু পাইস কামাতে এসেছে। কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধুকে এমন ধোঁকা দিয়ে টাকা নিয়ে গেছে এক ফ্রড। আমার সেই বন্ধু এক ব্যাংকের স্মার্ট ম্যানেজার। তবু সে পাজলড হয়ে ধরা খেয়ে গেছে। ফ্রড লোকটা প্রথমে তার ব্রাঞ্চে বড় একটা এমাউন্ট এফডিআর ডিপোজিট করবে বলে তাকে লোভ দেখিয়েছে তারপর কিছু কারিকুরি করে বন্ধুর কাছে একটা তাবিজের মতো একটা অকাজের জিনিস বেঁচে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে ভেগে গেছে।

আমি মনে মনে হাসলাম। আমাকে ধোঁকা দিয়ে কিছু বিশ্বাস করানো এতো সহজ না। এইসব ধান্দাবাজদের ভালোই চেনা আছে আমার। মানুষ চড়িয়ে খাওয়া আমার পেশার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
লোকটাকে এখানেই থামিয়ে দেয়া ভালো। তাকে বুঝতে দেয়া উচিৎ সে ভুল জায়গায় এসে পড়েছে, এখানে কোন চালাকি খাটবে না। আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলাম।

বললাম, ভাই কিছু মনে করবেন না। আমরা আসলে আমাদের পুরানো ক্লায়েন্ট ছাড়া কাউকে লকার দেই না। ইনফ্যাক্ট লকার তেমন খালিও নাই আমার।

ইংগীত পরিষ্কার , এবার আপনি বিদায় হোন।

লোকটা উঠে চলে যাওয়ার জন্য দাঁড়াল। তারপর বলল, আপনি আমার কথা বিশ্বাস করেন নি। স্বাভাবিক ব্যাপার। শুধু যাওয়ার আগে একটা জিনিস দেখাতে চাই। আপনি আপনার ডান হাতটা মুঠো করেন একবার।

আমি মহা বিরক্ত হলাম। বললাম, দেখেন এইসব হাত মুঠো করে হাতের মধ্যে তাবিজ বা ওই ধরনের জিনিস আনার পুরান ট্রিক্স বাদ দেন। আমার এগুলো দেখার ইচ্ছা নেই।

লোকটা এবার অদ্ভুত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি ভীষণ অবিশ্বাসী। কিন্তু আপনি একমাস আতরের ঘ্রান পাবেন। আমি আপনার কাঁধে আতর লাগিয়ে দিয়ে গেলাম। একমাস পর আমি আবার আসব, তখন আশাকরি আমার কথার প্রমাণ পাবেন আর আমাকে এই আতরটা রাখার সুযোগ দেবেন।

বলেই লোকটা বের হয়ে গেল। আমি হাসলাম। লোকটা নাকি আমার কাঁধে আতর মাখিয়ে দিয়েছে। কখন দিল যে আমি কিছুই দেখলাম না? ধান্দাবাজি সফল না হলে ওই রকম ডায়ালোগ দিয়ে কেটে পরার রাস্তা খুঁজতে থাকে ফ্রড ধরনের লোকজন।

কাজের চাপে সব কিছু আবার ভুলে গেলাম। রাতে বাসায় ফিরে ঘুমাতে গেছি, সিমি বলল, বাহ তুমি তো আজ দারুন একটা পারফিউম মেখেছ। এতোদিন পর তোমার রুচির একটু উন্নতি দেখছি।

আমি অবাক হয়ে বললাম, কি বল আজ আমি তো কোন পারফিউম মাখি নাই।

সিমি আমার কাছ ঘেঁষে এসে বলল, এই শোন, ভেবে দেখলাম তোমাকে একা রেখে বাবার বাসায় গেলে তোমার কষ্ট হবে। বাদ দিলাম যাও।

আমি আবারও অবাক হলাম। সিমি বেশ কিছুদিন আগেই ঠিক করে রেখেছে এবার মাস খানেক তার বাবার বাসা দিনাজপুরে থেকে আসবে।

সিমি ঘনিষ্ঠ হয়ে বলল, তোমাকে যে একটা হীরার নেকলেস কিনে দিতে বলেছিলাম, ওইটাও বাদ। খামাখা টাকা নষ্ট করে লাভ নাই।

এবার আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। কি হয়েছে সিমির? সে বছরখানেক ধরে ঘ্যান ঘ্যান করছিল তাকে একটা হীরার নেকলেস কিনে দিতে। তার বোনকে তার দুলাভাই বহু আগেই কিনে দিয়েছে হীরার নেকলেস। বাবার বাড়ি গেলে তার ইজ্জত থাকছে না একদম। আমি বলেছিলাম তার দুলাভাইয়ের মতো আমার এতো টাকা নেই , তবুও সে জেদ করে থেকেছে তার হীরার নেকলেস চাই-ই। আমি ক্রেডিট কার্ড দিয়ে একটা নেকলেস কিনে দেব বলে রেখেছিলাম। আজ হঠাৎ সেই নেকলেসের দাবী থেকে সরে গেল কেন? সিমির বাবা মা কি কিছু বলেছে? আমি সিমির এই হঠাৎ বদল চিন্তা করতে করতে ঘুমিয়ে গেলাম।

পরদিন হেড অফিসে আমার মিটিং ছিল। মিটিং শেষে জিএম স্যার ডেকে পাঠালেন। জিএম স্যারের রুমে ঢুকতেই বললেন, বাহ সোহেল তুমি তো দারুন একটা পারফিউম মেখেছ। চমৎকার ঘ্রান। আচ্ছা এটা কি আতর নাকি? আজকাল অনেক ধরনের দারুন সব সুবাসের আতর বের হয়েছে , আগের মতো উৎকট ঘ্রান বের হয় না সেসব থেকে।

আমি একটু চমকালাম। আমি কোন আতর বা পারফিউম ব্যবহার করিনি। মনে পড়ল গতকাল রাতে সিমিও এইরকম কিছু বলছিল। আমি কিছু বললাম না।

জিএম স্যার বললেন, তোমার ব্রাঞ্চ যদিও কিছু প্যারামিটারে এখনো খানিকটা পিছিয়ে আছে, তবু তোমার প্রচেস্টা দেখে আমার ভালো লাগছে। তুমি অনেকদিন ধরেই একটা গাড়ি কিনতে চাচ্ছিলে আজ ভাবছি তোমার গাড়ি কেনার আবেদনটা পাশ করিয়ে দেব। যাও ভালো একটা গাড়ি দেখ, তারপর কোটেশন পাঠাও, এপ্রুভাল দিয়ে দেব।

আমি দারুন খুশী হয়ে গেলাম। অনেকদিন ধরে একটা গাড়ি কেনার শখ ছিল আমার। ঢাকার রাস্তায় যাতায়াতের অবস্থা খুব খারাপ। কিন্তু হেড অফিস আমার গাড়ি কেনার এপ্লিকেশন এপ্রুভ করছিল না এতো দিন নানা অজুহাতে। আজ এতো চট করে গাড়ি পেয়ে যাব ভাবিনি।

বাসায় ফিরলাম খুশি নিয়ে। সিমিকে ডেকে বললাম, যাও তুমি এবার গাড়ি নিয়ে বাবার বাসায় বেড়াতে যাবা। অফিস গাড়ি দিচ্ছে আমাকে। চল এই ছুটির দিনে শো রুমে গিয়ে গাড়ি পছন্দ করে আসি। মাসখানেকের ভিতরই গাড়ি পেয়ে যাব।

কিছুদিন পর অফিসে বসে আছি, আমাদের এলাকার এক প্রভাবশালী নেতা রহমত ভাই ঢুকলেন। আমি আমার রুমের বাইরে থেকেই দেখলাম ভদ্রলোক অপ্রসন্ন মনে কপাল কুঁচকে আছেন। রহমত ভাই বেশকিছু দিন ধরে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কাছে একটা স্পন্সর চাচ্ছিলেন তার এলাকার একটা লোক দেখানো উন্নয়ন কর্মসুচীতে। আমরা জানি ওই কর্মসূচীর বেশীরভাগ টাকাই উনার পকেটে যাবে, তাই রাজি হচ্ছিলাম না। আজ নিশ্চয়ই শক্ত কথা শুনতে হবে আমাকে। লোকটার অনেক প্রভাব। আমাদের বিপদে ফেলে দেয়ার ক্ষমতাও রাখেন। আমি মনে মনে কি বলব ভাবছিলাম।

রহমত ভাই ঢুকে আমার সামনে বসলেন। তার সঙ্গে তার দুই চেলা। তারা পেছনের সোফায় বসল। ভদ্রলোক আমার দিকে তাকিয়ে ভুরু কুঁচকে কিছু বলতে চাচ্ছিল, হঠাৎ মাথা উঁচু করে বলল, বাহ! ভাইজান আপনি তো দারুন একখান আতর মাখছেন। ঘ্রানে মৌ মৌ করতেছে।

আমি কিছু বললাম না। রহমত ভাই বললেন, ভাই আপনি কিছু মনে করবেন না। আমরা অনেক কটু কথা শুনিয়েছি আপনাকে। আমাদের তহবিলের জন্য কোন স্পন্সরশীপ যদি না দেয় আপনার প্রতিষ্ঠান , নাই। এইখানে আপনি একজন কর্মচারি মাত্র। আপনার আর কি করার আছে? আজ আসি।

আমার বিস্মিত মুখের সামনে দিয়ে লোকটা উঠে বের হয়ে গেল। আমার চেয়ে আরোও বেশী বিস্মিত হয়েছে তার চেলা দুইজন। তারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।
একজন বলল, কিন্তু ভাই।

রহমত ভাই তাকে ধমক দিলেন, আরে চল। খামাখা ভদ্রলোককে ডিস্টার্ব করবি কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে বসে গত কয়েকদিনের ঘটনা ভাবছিলাম। সব সমস্যার কেমন তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা এর সঙ্গে কি আতর এর কোন সম্পর্ক আছে? ভেবে দেখলাম গত কয়েকদিন আমার অনেক সমস্যার অলৌকিক সমাধান হয়ে গেছে। সমস্যা গুলোর জট এমনভাবে খুলেছে যেটা অস্বাভাবিক। কিছুক্ষণ ভেবে আনমনে নিজেই হাসলাম। এই ঘটনাগুলো অবশ্যই কাকতালীয়। একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ হিসাবে এই ঘটনার সাথে আতরের সম্পর্ক খুঁজতে যাওয়া হাস্যকর। বোঝা যাচ্ছে ওই লোক কিছুটা হলেও আমার উপর প্রভাব রেখে গেছে।

সে রাতে ঘুমের মধ্যে আতরওয়ালাকে স্বপ্ন দেখলাম। লোকটার হাতে নীল রঙের সেই আতরের বোতল। বলল, স্যার। আজ আপনার আতর লাগানোর দশদিন হইল। কাল থেকে কিন্তু সবকিছুর অন্যরূপ দেখবেন। সাবধানে থাইকেন।

স্বপ্ন দেখে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। দেখি ঘেমে গেছি। সামান্য স্বপ্ন মনের উপর মারাত্মক চাপ ফেলেছে । দারুন পিপাসা লেগেছে। পানি খাওয়ার জন্য এদিক ওদিক তাকিয়ে খেয়াল হলো রুমের লাইট জ্বলানো। এই গভীর রাতে রুমের লাইট জ্বালানো কেনো আবার? তাকিয়ে দেখি সিমি দাঁড়িয়ে আছে বিছানার উলটো পাশে। অদ্ভুত চোখে আমাকে দেখছে। তার দুই হাত দুইপাশে ঝুলছে, এক হাতে একটা ধারালো ছুরি ধরা। আমার শরীর দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সিমি এতো রাতে ছুরি হাতে এইভাবে তাকিয়ে আছে কেন আমার দিকে?

চলবে

Khondokar Mahedi Hasan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here