#মন_পিঞ্জর,পর্বঃ০১
#লেখিকাঃআরোহী_নুর
নিজের স্বামীর বিয়েতে পাগলের মতো নাচ করছে আঁখি মানুষ কতোটা ব্যাথা পেলে এমনটা করতে পারে,পাশেই মিউজিক বক্সে লাউড সাউন্ডে গান বাজছে,
মেরে ইয়ার কি সাদী হে আর সেই সুরে তাল মিলিয়ে পাগলের মতো নাচতে মগ্ন আঁখি,মুখের মিথ্যে হাসিটা যে থামছেই না,আশেপাশের সকলেই হতবাক ওর এমন কান্ড দেখে,হবেই না কেনো এখানে উপস্থিত যারাই আঁখিকে চেনে সবার জানা আছে আঁখির পাগলামি আয়ান কে নিয়ে, আয়ান যে ওর নিশ্বাসে বসবাস করে,যে আয়ানের জন্য আঁখি সবকিছুর মায়া ত্যাগ করেছে আজ সেই আঁখি আয়ানকেই ত্যাগ করতে রাজি হয়ে গেলো তাও হাসিমুখে, এমনও কি হয়ে গেলো ওদের মধ্যে তা বুঝতে ব্যার্থ আশেপাশের লোকজন,তবে সবাই যেনো আঁখির হাসিমুখের পিছনের কষ্টটা বুঝতে সক্ষম হচ্ছে আঁখি তা কাউকে বুঝতে দিতে না চাইলেও,সেখানে উপস্থিত প্রায় অনেকেরই চোখে আঁখির জন্য জল টলমল করছে আর সে জলগুলো বেয়ে পড়ছে দুজনের নয়ন বেয়ে তারা আর কেউ নয় আয়েশা আঁখির একমাত্র ননদ আর আঁখির শ্বাশুড়ি মিরা রাহমান।ওরা হয়তো জানে আসল সত্যটা তাই ওদের এ অবস্থা,এদিকে আজ যেনো আঁখিরই বিয়ে ওর নাচ দেখে কেউ বলবে না আজকে ওর বিবাহিত জীবনের শেষ দিন,যাকে জীবনের সবকিছু উজাড় করে ভালোবেসেছিলো তাকে আজ তুলে দিতে হচ্ছে অন্যের হাতে তাও ওরই খুশির জন্য,আজকাল কয়টা মেয়ে এমনটা করতে পারে এটা বলা দায়,নিজের স্বামীর ভাগটা যে কেউ অন্যকে দিতে চায় না সে জায়গায় আঁখি নেচে গেয়ে স্বামীকে অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে।
গান শেষ হতে না হতেই সিঁড়ি বেয়ে নেমতে লাগলো আয়ান ওর হাতে হাত ধরে নেমে এলো মাহি,দুজনই বিয়ের সাজে,আয়ানকে যে এই প্রথম আঁখি বিয়ের সাজে দেখলো,ওকে শেরওয়ানিতে এতোটা সুন্দর লাগতে পারে তা আঁখি কখনো ভাবেও নি,আয়ানকে নিজের জন্য শেরওয়ানিতে দেখার যে বড় ইচ্ছে ছিলো ওর তা এভাবে কখনো পুরন হবে হয়তো কভু কল্পনাও করে নি সেই অভাগী রমনি,আজকে যে ওর প্রাণের শখা বর সেজেছে তবে যে তা অন্য কারো জন্য,সেই সাজে যে আঁখির নাম দূর দূর পর্যন্ত নেই,অন্য মেয়ে নিজের স্বামীর বাহু জড়িয়ে নেমে আসছে ওর সাথে তাল মিলিয়ে দৃশ্যটা বুক ছিঁড়ে ফেলছে আঁখির,সেখানে উপস্থিত সকলে প্রত্যাশা করছে হয়তো আঁখি এবার স্বাভাবিক বিহেব করবে,এবার হয়তো এই মুহুর্তটা আর আট-দশ টা মেয়ের মতো মেনে না নেওয়ার চেষ্টা করবো,ফুলকি দিয়ে কান্না করে উঠবে,নিজের স্ত্রী ভাগের জন্য ভিক্ষা চাইবে আয়ানের কাছে কিন্তু সবাইকে আজও আরেকবার অবাক করে দিয়ে মুখে একফাঁলি হাসি ঝুলিয়ে আয়ান আর মাহির দিকে এগিয়ে গেলো আঁখি,দুজনেরই হাত ধরে নিচে নামালো,তারপর নিজের আঁখিদ্বয় থেকে এক চিনতে কাজল এনে ওরা দুজনেরই কানের পিছন লাগিয়ে বললো।
কারো নজর যেনো না লাগে।
ধন্যবাদ আঁখি আমাকে বোঝার জন্য,এজন্যই তোমাকে এতো ভালো লাগে,তুমি সবকিছুই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নাও।
আয়ানের বলা কথাগুলো কাটার মতো লাগছে আঁখির মন পিঞ্জরে তাও ওকে তা আন্দাজ করতে না দিয়ে হাসিমুখে বললো আঁখি।
বিয়ের দিন নিজের হবু বউয়ের সামনে অন্য মেয়ের প্রশংসা করা মোটেও ভালো দেখায় না আয়ান সাহেব।
তারপর একটু থেমে বললো।
ইশ দেখেন না নাচ গানের চক্করে আমি আসল জিনিসটাই ভুলে গেলাম,যেটা ছাড়া আপনার সংসারে অশান্তিও নামতে পারতো,হা হা।
জোড় করে মুখে দুষ্টামিময় হাসি ফুঁটিয়ে ছুঁটে গেলো একটা রুমের দিকে,একটু পরেই ফিরে এলো হাতে একটা কাগজ নিয়ে,এনেই কাগজটা এগিয়ে দিলো আয়ানের দিকে।
এটা আমার তরফ থেকে আপনাদের বিয়ের গিফ্ট,কেমন হয়েছে বলবেন না।
কাগজটা হাতে নিয়ে আয়ান দেখতে পেলো ডিভোর্স পেপার,যার নিচের দিকে সুন্দর করে লিখা আনাহিতা তাবাস্সুম আঁখি,সাইন টা দেখে কোনো যেনো মনটা মোঁচড় দিলো আয়ানের, যথারীতি এই খারাপ লাগাকে অগ্রাজ্য করে ঠোঁটের কোনো তৃপ্তির হাসি ফুঁটিয়ে আবারও বললো।
তুমি সত্যিই অসাধারণ, আবারও ধন্যবাদ।
এবারও আঁখি স্বাভাবিক ভাবে বললো,আর কতো ধন্যবাদ জানাবেন আয়ান সাহেব,এতো কৃতজ্ঞতাও কাউকে দেখানো ভালো না,কারন যতোটা কৃতজ্ঞতা লোক দেখায় ততোটা আদায় করতে সবাই পারে না।
ছাঁড়েন এসব কথা আপনার বিয়ের ক্ষন যে পেড়িয়ে যাচ্ছে তাড়াতাড়ি পা বাড়ান।
আঁখির তিক্ত কয়েকটা কথা শুনে কিছুটা খারাপ লাগা কাজ করলো আয়ানের মনে কিন্তু সে ক্ষন বেশিসময় থাকলো না,আয়ান আর আঁখির দিকে না তাকিয়েই স্টেজের দিকে পা বাড়ালো।
চোখের সামনেই নিজের স্বামী আজ অন্যকে নিজের অবস্থান দিতে চলেছে,যে স্বামীকে ভালোবাসতে কখনো কোনো কমতি রাখে নি আঁখি,তবে কি কমতি রয়ে গেছিলো ওর ভালোবাসায় যে আজ ওর জায়গায় অন্য কাউকে বসালো আয়ান,কি করে পারলো আয়ান তা করতে,মন পিঞ্জরে এসব ব্যাথার্থ অনুভুতি তখন জমা হলেও মুখে ফুঁটে উঠতে দিলো না আঁখি,ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো মুখে এক ফালি হাসি টানিয়ে,সবাই আঁখিকে দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে চলে গেছে,কেউ কখনো আঁখিকে কাঁদতে দেখে নি,হাসি মুখটাই যে আঁখির সর্বচেনা,তাই বলে এমন মুহুর্তেও আঁখি এমনটা কবরে তা কখনো কেউ কল্পনাও করে নি।কাজি সাহেব আয়ানকে কবুল বলতে বললে আয়ান আঁড়চোখেই একবার তাকালো আঁখির দিকে,আঁখির হাসিমুখটা যেনো তখন অনেক জ্বালাচ্ছিলো ওকে, কিন্তু পরক্ষণেই কাজি সাহেবের আরেকবার ডাকাতে স্বাভাবিক হলো আয়ান আর তিনবারই পর পর কবুল বললো ,আঁখির চোখের সামনেই সুন্দরভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেলো,সব মিলিয়ে আট বছরের বন্ধুত্ব,চার বছরের ভালোবাসা আর দুই বছরের সংসার এমনভাবে ভাঙবে ওর কে জানতো।মিরা রাহমান আর আয়েশা চোখের জল ত্যাগ করতে করতে এলেন আঁখির কাছে,মিরা রহমান ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে উঠলেন।
কি করে পারলি রে মা এমনটা করতে,নিজের সংসার এভাবে অন্যের হাতে তুলে দিতে পারলি?কেনো করলি রে মা এমন?
কি করবো মা বলো,যে সংসারকে আমি নিজের মনে করে আগলে রেখে বেঁচে ছিলাম সেটা যে আদোও আমার না তা জানা ছিলো না আমার মা,আজকে যে সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরে সে মিথ্যের সাথে আর থাকার শক্তি পেয়ে উঠলাম না আমি,যার পাওনা তাকেই দিয়ে দিলাম সবকিছু।কথাটা বলে স্থানটা ত্যাগ করলো আঁখি মিরা রাহমান আয়েশাকে জড়িয়ে ধরে ঢুকরে কেঁদে উঠলেন
আসতে আসতে সব আত্নীয় স্বজনেরা বিদায় নিলেন,এবার আঁখি নিজে মাহিকে নিয়ে এলো আয়ানের রুমে,যে ঘরটা এতোদিন নিজের মতো করে সাজিয়ে রাখতো,সে ঘরটা আজকে অন্যের জন্য সাজিয়েছে নিজের হাতেই,আজ যে এই ঘরটা অন্য কারো,ভালোবাসার মানুষটাই যেখানে নিজের রইলো না সেখানে এই ঘরের সাথে কিসের মায়ায় জড়াবে আঁখি,কথাটা ভেবে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুঁটে উঠলো ওর ঠোঁটের কোনে,এবার মাহি ভ্রযোগল কুঁচকালো তারপর বললো।
কি হয়েছে পাগল হয়েছিস না কি?এভাবে হাসছিস কেনো?তেজ মরবে না তোর কখনো তাই না,বলেছিলাম না একদিন ঠিকই তোর সব কেঁড়ে নিবো দেখ কেঁড়েই নিলাম।হা হা।
আঁখি এবার তাচ্ছিল্যের হাসিখানা আরও প্রখড় করে বললো।
তুই কিছুই কেঁড়ে নিস নি মাহি আমি তোকে ভিক্ষে দিয়েছি বলতে পারিস।তুই সেই ছোটবেলা থেকেই সবসময় আমার সাথে প্রতিযোগিতায় মেতে থাকতি,সবসময় আমার জিনিস পাওয়ার লোভ তোর থেকেই যেতো কিন্তু কখনো আমার কিছুই কেঁড়ে নিতে পারিস নি কারন ওই জিনিসগুলো আমি ডিসার্ভ করতাম,ওগুলা আমার ছিলো,তবে ভেবে দেখ আজকে আয়ানকে তুই এতো সহজে কেমনে পেয়ে গেলি,তবে শুন আমি বলি,আয়ান কখনো আমার ছিলো না, আমি মুক্ত ভেবে ময়লাতে হাত দিয়েছিলাম আর সেই ভুল আজ তুইও করলি মাহি,একবার ভেবে দেখ আয়ানের সাথে আমার ৮ বছরের সম্পর্ক ও নিমিষেই ভুলে গেলো তবে তোর সাথে কয়েকমাসের সম্পর্ক ভুলতে ওর কতক্ষণ লাগবে।সব শেষে বলবো ভালো থাকিস,আর যাকে পেয়েছিস তাকেও ভালো রাখিস।
কথাটা বলে রুম ত্যাগ করলো আঁখি, আঁখির কথায় মাহির অন্তর আত্মা যেনো খনিকে কম্পন করে উঠলো,সত্যিই তো আয়ান ওর জন্য আঁখিকে ছেড়েছে,যদি অন্য কারো জন্য ওকে ছেড়ে দেয়,কথাটা ভয়ের সৃষ্টি করলো মাহির মনের গহীনে।
না আয়ানকে আমি হাতছাড়া করবো না,ও শুধুই আমার,ও তোকে ছেড়েছে কিন্তু আমাকে কখনো ছাড়বে না,আমি কখনোই তা হতে দিবো না।কথাটা আনমনে বললো মাহি।
রুম থেকে বেড়ুতে গেলেই আঁখির ধাক্কা লাগলো আয়ানের সাথে,আঁখি তখন পড়ে যেতে নিলে ধরে নিয়েছিলো আয়ান,আঁখি এবার নিজেকে আয়ানের থেকে ছাড়িয়ে নিজেকে সামলে সেখান থেকে চলে যেতে নিলে আয়ান ওকে পিছু ডাক দিলো,ডাকটা শুনে আঁখি নিজের ছুঁটন্ত কদম শান্ত করে ঠায় দাঁড়ালো।আয়ান এবার বললো।
আসলে তোমাকে কিছু বলার ছিলো।
আঁখি স্বাভাবিক ভাবে আয়ানের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো।
বলেন আয়ান সাহেব আমি আর কি সাহায্য করতে পারি আপনার?
আয়ান একটু আমতা আমতা ভাব নিয়ে বললো।
আসলে দেখো আমাদের মধ্যে তো এখন আর কোনো সম্পর্ক রয়ে যায় নি,তাছাড়া এখন এখানে মাহিও আছে,হয়তো তোমাকে এখানে সর্বক্ষণ দেখলে ওর ভালো লাগবে না,তাই আরকি।আমি আশা করি তুমি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাইছি।
আমি বুঝতে পারছি আয়ান সাহেব আপনি কি বলতে চাইছেন,আপনাকে ও নিয়ে চিন্তা করতে হবে না কালকে সকালে আপনি আর আমায় এখানে দেখতে পাবেন না।
আবারও ধন্যবাদ আঁখি তোমায়।তোমার কিছু চিন্তা করতে হবে না আমি অন্য কোথাও তোমার থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা করে দিবো।
আঁখি এবার আবারো তাচ্ছিল্য হাসিতে ঠোঁট বাকিয়ে বললো।
আপনার আর কষ্ট করতে হবে না আয়ান সাহেব,আপনি নতুন মেরেড লাইফ এনজয় করেন আমি আমার টা দেখে নিবো,আপনি তো আমাকে ভালোকরেই জানেন আঁখি একাই একশো।
আঁখি আর দাঁড়ালো না সেখানে চলে গেলো।আয়ান কিছুক্ষন চেয়ে রইলো ওর পথপানে,সংসারের চাপে এই দূরন্ত আঁখি যে কোথাও হারিয়ে গেছিলো আজ যেনো তার একটু ঝলক আবারও দেখতে পেলো আয়ান,মনের ভিতর ওর অদ্ভুত একটা খালিলাগা কাজ করছে জানে না তার কারনটা,আবারও নিজের মনের সে সত্য বানিগুলো উপেক্ষা করে ঢুকে গেলো বাসর ঘরে, আজকে যে ওর সুন্দর রাতটা নষ্ট করতে চায় না সেই একঘেয়ে অতীতের টানে।
রাত ২ টা,পাশের রুম থেকে ভেসে আসছে আয়ান মাহির ঘনিষ্ঠ মুহুর্তের কিছু অমান্যকর শব্দ, যা জ্বালাতন করছে আঁখিকে,বুকে আয়ান আর নিজের বিয়ের ছবি আঁকড়ে ধরে দেয়ালে ঠাস দিয়ে বসে আছে,কানে ভেসে আসছে সেসব শব্দ, সহ্য করতে পারছে না আঁখি আর,সবার সামনে কঠিন মানবি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করলেও একাকিত্বে যে আঁখি অনেক দূর্বল তা হয়তো কারো জানা নেই,চোখের জল বাঁধা মানছে না বয়েই চলেছে,মুখখানা নিজের হাতে চেপে ধরেছে যেনো ওর বুক ফাঁটা আর্তনাদ কারো কানে না যায়,বাইরেও প্রবল ঝড় এসেছে,আজকে যেনো সেই আকাশটাও আঁখির কষ্টে ভেঙে পড়েছে,পারছে আজ ওই আকাশটাও নিজের জল আটকে রাখতে,আঁখির চোখের সাথে যেনো তাল মিলিয়ে নিজের জলও অতিবাহিত করছে।আঁখি এবার আলতো করে হেঁটে হেঁটে বেলকোনির দিকে গেলো তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বললো।
কেনো খোদা,কেনো এমনটা হলো আমার সাথে।কি কমতি ছিলো আমার ভালোবাসায়?একদিন যার জন্য সব ছেড়ে চলে আসলাম সেই আজ আমায় ছেড়ে দিলো।হয়তো এটাই আমার পাপের সাস্তি,ওর ভালোবাসার জন্য আমি না জানি কতোজনকে কাঁদিয়েছি,এমনকি…….
কথাটা বলে একটু থামে আঁখি কিছু একটা ভেবে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবার বলে।
আমি জানি খোদা এটা আমার ভাগের শাস্তি,তবে তাই ভালো মাথা পেতে নিলাম,নিতেই যে হবে এ ছাড়া যে কোনো উপায়ও নেই আমার কাছে।
চলবে…..