মন_পিঞ্জর #পর্বঃ০২

0
1260

#মন_পিঞ্জর
#পর্বঃ০২
#লেখিকা_আরোহী_নুর

পাশের রুম থেকে অমান্যকর সেসব আওয়াজ এখন আর আসছে না হয়তো দুজন ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছে তাই, আকাশটাও যে এখন ক্লান্ত হয়ে নিরব দর্শকে পরিণত হয়েছে শুধু ক্লান্ত হয় নি আঁখির দুটি আঁখি, শ্রাবনের ধারার মতো বেয়েই চলেছে,চারদিকে পিনপিন নিরবতা কাজ করছে,রাতের শেষ সময়টুকুতে যে কীটপতঙ্গরাও নিজেদের আবাসে শান্তিতে নিদ্রা যাপন করে,কিন্তু সেই শান্তির নিদ্রা যে নেই আঁখির নয়নে,বেশ কয়েকটা মাস ধরে যে এমনই নির্ঘুম রাত কাটায় আঁখি,তবে আজকের রাতটা যে আঁখির একটু বেশিই লম্বা মনে হলো,রাতটা যেনো শেষ হবার নামই নিচ্ছে না,নিরবতা কাটিয়ে হঠাৎ আঁখির কানে ভেসে এলো মুয়াজ্জিন সাহেবের মধুর কন্ঠের আযানের বানি,নয়নের বয়ে পড়া জলটুকু মুছে ওযু করে নামাযের জন্য জায়নামাজে দাঁড়ালো,সুন্দরভাবে নামাযটা শেষ করে মোনাজাত তুলে বলতে লাগলো।

আল্লাহ আমার আর কিছু চাওয়ার নেই আপনার কাছ থেকে,জীবনের সবকিছু হাঁড়িয়ে আর কি পাওয়ার আশা থাকতে পারে ,তবে শুধু একটা জিনিস চাই খোদা আমাকে তুমি ধৈর্য্য দিও,মনে এতোটা শক্তি জুটিয়ো যাতে কখনো কেউ আমাকে ভাঙতে না পারে,কখনো যাতে কারো কাছে দুর্বল হয়ে না পড়ি।একটু শান্তি দিয়ো মনের কোনে যাতে সবকিছু ভুলে সামনে এগুতে পারি।আমিন।

মোনাজাত শেষে ধিমিধিমি পায়ে মিরা রাহমানের রুমের দিকে এগুতে লাগলো আঁখি বুকে আয়ান, আঁখি, আয়শা, মিরা চারজনের ফেমিলি ফটো আকঁড়ে ধরে,হাতে একটা ছোট্ট ব্যাগ।উনার রুমে প্রবেশ করে আলতো হাতে প্রাক্তন শ্বাশুড়ি মায়ের পাদ্বয় ছুঁয়ে এনে হাতটা নিজের কপালে আর বুকে মিশালো,তারপর কান্নামিশ্রিত গলায় হালকা স্বরে বললো।

মাগো তুমি যে কখনো আমাকে ছেলেবউয়ের চোখে দেখো নি,আয়েশা থেকেও যে বেশি আদর তুমি আমায় দিয়েছো,নিজের মাকে ছেড়ে এলেও তোমাকে দেখে উনার কমতি ভুলে যেতাম কিন্তু এভাবে একদিন তোমাকেও ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবি নি,তোমার কাছ থেকে যে সামসামনি এসে বিদায় নেওয়ার ক্ষমতাটুকুও আমার নেই মা তাই চোরের মতো চলে যাচ্ছি দোয়া করো তুমি আমায়।

কথাটা বলে কান্নামিশ্রিত আঁখিদ্বয় মুছে রুমটা ত্যাগ করলো আঁখি,ভালো করে ঘরটাকে একবার দেখে নিলো,এই ঘরের প্রতিটা ইটেরও মায়া যে পড়ে গেছিলো আঁখি,ঘরটার কোনায় কোনায় জমে আছে এখানে কাটানো আঁখির অসীম মুহুর্ত, সবকিছু পিছনে ছেঁড়ে যে চলে যেতে হবে ওকে আজ,পিলিপিলি পায়ে আঁখি মেইনডোর অতিক্রম করবে তখনি পিছন থেকে কারো ডাকে থমকে দাঁড়ায়,পিছন ফিরে দেখতে পায় আয়েশা দাঁড়িয়ে, ও আয়শার দিকে তাকাতেই আয়েশা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে।

কি চলে যাচ্ছিস চোরের মতো,সম্পর্ক শুধু ভাইয়ার সাথে ছিলো বুঝি আমাদের সাথে ছিলো না?একবার ভেবেছিস তোকে ছাড়া আমরা কি করে থাকবো।

কি রে পাগলি এভাবে কাঁদছিস কেনো,আমি তো আর মরে যাচ্ছি না এই শহরেই আছি যখন ইচ্ছে তুই আমার সাথে দেখা করতে পারবি আর ফোনে তো আর আমি আছিই,যখন ইচ্ছা কল করিস।

কি করে পারিস বল এসব?তোর কষ্টে আজকে এই বাড়ির কীটপতঙ্গও হয়তো কান্না করেছে আর তুই এখনও হাসিমুখে কথা বলছিস,কি করে করিস তা বল?তুই না চাইলে আজকে যে এমনটা ঘটতোই না।কেনো করলি এমন বল?

হয়তো আমি না চাইলে আজকে এমনটা ঘটতো না,তবে যা ঘটতো তার কষ্ট যে এর থেকেও বেশি হতো রে আয়েশা।
হয়েছে আর কান্না করিস না এটা আমার কপালের লিখন যা আল্লাহ ছাড়া কেউ মিটাতে পারবে না,ছাড় এসব।
ভালো থাকিস তুই,মায়ের খেয়াল রাখিস,আর সময়মতো ওষুধগুলো দিয়ে দিস উনাকে, আমার জন্য আয়ান আর মাহির সাথে কোনো তর্কে লিপ্ত হস না কেমন,ভালো থাকিস চলি।
আয়েশা এবার ব্যাথার্থ কন্ঠে বললো।

থাকা যায় না।

এ যে আর হয়নারে আয়েশা,চলি।

কথাটা বলে আঁখি ছুটে চলে গেলো,আয়েশা ফ্লোরে লুটে পড়ে কাঁদতে লাগলো,তখনি নিজের কাঁদে কারো ছুঁয়া অনুভব করলো,চোখ তুলে তাকিয়ে দেখলো ওর মা,ঝাপটে ধরলো ওর মাকে।মা চোখের জল ত্যাগ করা অবস্থায় ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন।

চলে গেছে বুঝি অভাগীটা?

হ্যাঁ মা চলে গেছে,আর ফিরবে না।

ফিরেও কি করবে রে মা,সামনে থেকে যে এসব কিছু মেনে নিতে পারবে না,দূরে থাকাই ওর জন্য ভালো,মরিচিকার পথ আর কতো দেখে থাকবে ওই মেয়েটা,ওর চলে যাওয়াতেই যে সবার মঙ্গল ছিলো।
আঁখি এবার কান্না মুছে বললো।

তুমি জেগে ছিলে মা?তবে কেনো ওকে বিদায় দিতে আসলে না।

ঘরের লক্ষিটাকে যে বিদায় দেওয়ার সামর্থ্য আমার ছিলো না রে মা,পারতাম না ওকে বিদায় জানাতে,পারতাম না।কথাটা বলে মিরা রাহমান আবারও কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

আঁখি চলে যাওয়ার আগে বাড়িটাতে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো একদিন বউ হয়ে যে এই বাড়িতে এসেছিলো, ভেবেছিলো মরার পর এই বাড়ি ছাড়বে কিন্তু জীবনের তিক্ত সত্য যে সবকিছুর মায়া এভাবে কেঁড়ে নেবে তা যে আদোও কখনো ভাবে নি আঁখি, চলেই গেলো এবার আর কোনো কিছুর মায়ার টানে না পড়ে।

পরদিন সকালে।

সুন্দর একটা রাত যাপনের পর আরাম করে উপুড় হয়ে ঘুমুচ্ছে আয়ান,ঘড়ির কাটায় ১০ টা ছুঁইছুঁই, এদিকে এই মাত্র স্নান করে ওয়াসরুম থেকে বেড়িয়ে এলো মাহি,আয়ানকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে লজ্জামাখা একটা হাসি ফুঁটালো নেত্রকোনে,রাতের কথা মস্তিষ্কে কড়া নেড়ে উঠলো যে খনিকে তখন,আজকে যে মাহির মনে রাজ্য জয় করা খুশি,আঁখির জীবনের সব থেকে বড় জিনিস কেঁড়ে নিয়েছে তার থেকে বড় পাওয়া ওর জন্য আর কি হতে পারে,এবার পিটপিটিয়ে এগিয়ে গেলো আয়ানের দিকে,তারপর নিজের শাড়ির আঁচলখানির এক কোন দিয়ে ফাজলামো করে আয়ানের কানে শুরশুরি দিতে লাগলো,আয়ান পুরো ঘুমে না থাকলেও অনেকটা ঘুমন্ত অবস্থাতেই বললো।

উফ আঁখি দুষ্টামি করো না তো ঘুমুতে দাও,উঠে গেলে কিন্তু ছাঁড়বো না তোমায়।হুম

কথাটা কর্ণপাত হতেই মাহির ভিতর খক করে উঠলো,আয়ান যে ওর নাম না নিয়ে আঁখির নামটা নিলো,যে আঁখিকে ছুঁড়ে ফেলেছে মাহি আয়ানের জীবন থেকে সে আঁখিই কি না আয়ানের মন আর মস্তিষ্কে এখনও ঘোড়াফিরা করছে,তবে কি মাহি আদোও সফল হয়েছে,না কি আঁখি আজকে হেরে গিয়েও জিতে গেলো আবার,এসব ভাবনা মাহির মুখটা নিরাশ করে দিলো খনিকে,মনে একরাশ অভিমান নিয়ে তাকিয়ে রইলো আয়ানের পানে,এদিকে কথাটা বলার পর আয়ানের হুশ এলো ও কি বলেছে,তাই এবার শুয়া থেকে উঠে বসে মাহির হাত জোড়া নিজের হাতে নিয়ে বললো।

রাগ করো না লক্ষিটি,আসলে ওর সাথে আমি দুবছর একই ঘরে থেকেছি,আমাদের মধ্যে তো স্বামী স্ত্রীর সকল সম্পর্কই ছিলো,তাছাড়া রোজ সকালে ও এভাবেই আমার ঘুম ভাঙাতো তাই ভুলবশত ওর নামটা মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এসেছে,প্লিজ রাগ করো না,সরি এই যে কানে ধরছি।

কথাটা বলে একটু আহ্লাদী করে নিজের কান ধরলো আয়ান,মাহি এবার মুখ ফুলিয়ে বললো।

বুঝতে পারছি ভুলবশত হয়েছে তবে যে সে ভুল ঘন ঘন মেনে নিবো না আমি,ভুল শুধরে নিতে হবে তোমাকে।

তা আর বলতে,এতো সুন্দরী বউ পেয়ে এমন ভুল দ্বিতীয়বার কোনো নরই যে করতে পারবে না ,সত্যিই যে তোমার রুপে জাদু আছে রূপসী ।আয়ানের ন্যাকা কথায় ফুলকি দিয়ে হেসে উঠে মাহি,তারপর বললো

হয়েছে আর ঢং করতে হবে না।

ঢং এর কি দেখেছো তুমি,ঢং তো এখন শবে শুরু করবো।

কথাটা বলে হেচকা টান দিয়ে মাহিকে নিয়ে চাদরের নিচে ডুব দেয় আয়ান।

আঁখি একটা দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে ছিলো হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুললো।

আরে চাচাজান আপনি।

শুনো মেয়ে আমি তোমার চাচাজান না,আমি বাড়ির মালিক,তাই বাড়ি মালিক ডাকবা আমায়,এই নাও চাবি,আজ থেকে তুমি এখানে থাকতে পারবে তবে হ্যাঁ তিনদিনের মধ্যে আমার দু-মাসের এডভান্স চাই নইলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।

কিন্তু চাচা সরি বাড়ি মালিক সাহেব আপনার সাথে তো আমার আগে কথা হয়েছে আর তখন তো আপনি এডভান্স চান নি।

তখন তুমি বিবাহিত ছিলে তাই চাই নি,আর এখন তো শুনলাম তুমি না কি ডিভোর্সি আর এমন ডিভোর্সিরা যে কোন ধরনের থাকে তা আমার ভালোই জানা আছে,তাই এখানে থাকতে হলে আমার কথামতো চলতে হবে আর হ্যাঁ দুমাসের এডভান্সও দিতে হবে, আর যদি তা না দিতে পারো তবে মানে মানে কেটে পড়ো।

না না আমি দুমাসের এডভান্স দিয়ে দিবো আপনি চিন্তা করবেন না।

কথাটা যেনো মনে থাকে।

চলে গেলো বাড়ি মালিক,আঁখি ছলছল চোখে লোকটার পানে তাকিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে দরজাটার তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো,আধভাঙা একটা ঘর তাও মাসের ভাড়া তিন হাজার টাকা,দুমাসের ভাড়া তো ছয় হাজার আসবে কিন্তু এতো টাকা তিনদিনের মাথায় কোথা থেকে আনবে আঁখি,এখানে আসার আগে নিজের সবরকম ব্যাবস্থা করে এসেছিলো আঁখি, ছোট একটা কোম্পানিতেও পার টাইম জব পাইছে,বেতন মাসে ১৫ হাজার টাকা,এই টাকায় তো আঁখির পড়াশুনায়ই লেগে যাবে সবকিছু কি করে কাভার করবে এটাই ভেবে পাচ্ছে না,এটার জন্যও যে দায়ী আঁখির অসীম ভালোবাসা আয়ানের জন্য,আয়ানকে স্যারপ্রাইজ দিবে বলে কি থেকে কি করে নিলো আর যেদিন স্যারপ্রাইজটা দিবে সেদিনই আঁখি আয়ানের তরফ থেকে বড় ধরনের ধাক্কাটা পেলো,আঁখি নিজের সাথে করে নিজের কিছু পেপারস আর ওদের ফেমিলি ছবি ছাড়া কিছুই আনে নি,ব্যাগ থেকে কিছু পেপারস বের করলো,পেপারসগুলো দেখার পর আঁখির চোখ ভরে এলো জলে,একটুতে ঝাঁপ দিলো অতীতে।

আঁখি,বিশিষ্ট বিজনেসম্যান ফায়সাল খানের একমাত্র মেয়ে,ও শুধু ফয়সাল খানের না খান বংশেরই একমাত্র মে ছিলো,কখনো ওর আদিক্ষ্যেতার কোনো কমতি রাখে নি ওর পরিবার,ফুলের টোকাও কখনো পড়ে নি আঁখির উপর,আরাম আয়েশে বড় হয়েছে সবসময়,কষ্ট দুঃখ কখনো ছুঁতেই পারে নি ওকে,ফায়সাল খানতো ওকে বিদেশে পড়াতে চেয়েছিলেন কিন্তু আঁখির সেই জন্মলগ্ন থেকেই যে নিজের জন্মভুমির প্রতি আলাদা টান তাই আর নিজেই বিদেশ গেলো না,দেশেই পড়ালেখা করতে চাইছিলো,আজ থেকে ঠিক ৮ বছর আগে আখি তখন ক্লাস সেভেনে পড়তো,তখন থেকে ওর আয়েশার সাথে পরিচয়,তখন আয়ান একই স্কুলে ক্লাস টেনের এইচএসসি কেন্ডিডেইট ছিলো,আয়শার মাধ্যমে ওর আয়ানের সাথেও পরিচয় হয়,তখন থেকে আয়ানের সাথে ওর বন্ধুত্বের শুরুটা হয়,আয়ান স্কুল ছেড়ে দিলেও আঁখির সাথে ওর যোগাযোগ ছিলো বন্ধু হিসেবে,আয়েশার সাথে হয়ে প্রায়ই যে আয়ানদের বাড়িতে যেতো আঁখি,তারপর আস্তে আস্তে ওদের সম্পর্কের উন্নতি ঘটে, আজ থেকে ঠিক চার বছর আগে আয়ান আঁখিকে নিজের ভিতরে জমে থাকা আঁখির জন্য লুকন্ত অনুভুতি ব্যাক্ত করে,আঁখিও যে তাতে সায় দিতে নিজেকে আটকায় না,ওরও ভিতরে যে তখন একই অনুভুতি কাজ করছিলো,তারপর শুরু হয় দুজনের ভালোবাসার সম্পর্ক, দিনের পর দিন ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ লেগে থাকতো দুজনের,তারপর দুবছর আগে হঠাৎ একদিন ওদের সম্পর্কের কথা কানে যায় খান সাহেবের,আয়ান তখন ডাক্তারি পরছিলো,ওর বাবা ছুট্টো একটা বেসরকারি অফিসের সামান্য কর্মচারী ছিলেন মাত্র,কথাটা শুনে উনি আঁখিকে সাফ সাফ বললেন যে ওর সাথে আয়ানকে মানায় না,খান বংশের মেয়েদের রুচি এতোটা খারাপ হলে তা ভালো চোখে দেখায় না,এমন ছেলের সাথে নিজের মেয়ের কি নিজের বাড়ির চাকরানীর বিয়ে দিতেও নারায হবেন উনি নিজের কথায় ব্যাক্ত করলেন উক্ত ভাব,তখন আঁখিও নিজের শেষ কথা জানিয়ে দিলো যে ও বিয়ে করলে শুধু আয়ানকেই করবে, কারন ও আয়ানকে ভালোবাসে আর সেজন্য ওকে যা করতে হবে ও তাই করবে।তারপর বাপ মেয়ের কথাকাটাকাটিতে একসময় খান সাহেব বললেন আঁখিকে বেঁছে নিতে হবে হয়তো খান বংশ নয়তো আয়ান,আঁখি তখন আর দ্বিতীয়বার না ভেবে বুক ফুলিয়ে আয়ানের নাম নিয়ে মা বাবার পা সালাম করে খালি হাতেই ঘর ত্যাগ করলো,আঁখি তখন ইন্টার পরিক্ষায় গোন্ডেন এ প্লাসের সাথে পাস করেছিলো ডাক্তারি পড়ার ইচ্ছে ছিলো ওর,সেদিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে ও সোজা আয়ানের কাছে যায়,কথাটা শুনার পর আয়ানের একটু কড়াকড়ি ছিলো,কারন ও তখন পড়াশুনা করছিলো,ওর বাবা ওর আর আয়েশার পড়ালেখার খরচ বহন করতে হিমসীম খাচ্ছিলেন উপর থেকে এখন আঁখিও চলে এসেছে,তাই ও তখন বিয়ের জন্যও মোটেও প্রস্তুত ছিলো না,তারপর আঁখি ওকে অনেক বোঝালো,ওকে এ আশ্বাস দিলো যে ওর কোনোকিছুরই ক্ষতি আঁখি হতে দিবে না,নিজের জীবন দিয়ে হলেও আয়ানের স্বপ্ন পুরনে সাহায্য করবে ও,তারপর অনেক কথাবার্তার পর আয়ানচ রাজি হলো,ফরমাল ড্রেসআপেই ১০১ টাকা দেনমোহরে কাজি অফিসে বিয়ে করলো আঁখিকে,তারপর থেকে আঁখি ঢুকে গেলো সংসার জীবনে,নিজের ডাক্তারির স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে কয়েকটা টিউশন ধরলো যাতে আয়ানের পড়ালেখাতে একটু হেল্প করতে পারে,হঠাৎ একদিন আয়ানের বাবা হার্ট এট্যাকে মারা গেলেন তারপর থেকে সারা পরিবারকে আঁখি একা সামলাতে লাগলো,সবাইকে মানসিক প্রশান্তির সাথে আর্থিক সুবিধা পর্যন্ত দেওয়ার ব্যায়স্থায় পড়ে গেলো,দুই একটা টিউশনির সাথে একটা পার টাইম জবও করতো সবই আয়ানের জন্য,অবশেষে এই আঁট নয়মাস আগে আয়ানের ডাক্তারি শেষ হলো সবকিছুই আঁখির বদৌলতে, দূরন্ত সেই আঁখি সংসারের চাপে কোথাও যেনো হাঁড়িয়ে গেছিলো,দিনশেষে মানসিক ও শারিরীকভাবে দূর্বল থাকলেও মুখের হাসিতে লুকিয়ে নিতো সবকিছু,কারন ওর মনের একটাই প্রশান্তি ছিলো নিজের ভালোবাসার মানুষটা নিজের পাশে আছে,শান্তিতে আছে,কিন্তু সে প্রশান্তিটাও রইলো কোথায় আঁখির,হয়তো নিয়তির খেলা এমনই হয়,ডাক্তার হয়ে যাবার পর থেকে আয়ানের ব্যাবহার আঁখির প্রতি কেমন যেনো পাল্টে যাচ্ছিলো, দিনে দশ বার আঁখির সাথে কথা না বলে যে আয়ানের খাবার হজম হতো না যে আয়ানকে যে আঁখি ফোনের পর ফোন করেও পেতো না আর,কখনো ফোন ধরে বলতো ব্যাস্ত আছে ফোন না করতে,তারপর না বলেই ফোন কাটতো,আয়ানের অবহেলা আর ব্যবহার থেকে আঁখি আন্দাজ করতে পারতো যে আয়ানের ওর এমন সংসারী ভাবটা পছন্দ না,ওর যে সেই সংগ্রামী,দুরন্ত, স্মার্ট,ইচ্ছাস্বাধীন আঁখিকে পছন্দ ছিলো এরকম সংসারী মেয়েকে না,তাই আঁখি আবারও নিজের ভালোবাসাকে পেতে নতুন রুপে সাজতে চাইলো,এবার আয়ান ডাক্তার হয়ে গেছে এখন তো আঁখির টাকা পয়সার কোনো দরকার নেই ওর তাই আঁখি ভাবলো এখন আবার আগের মতো হয়ে আয়ানকে নিজের করে রাখবে যেহেতু আয়ানের সেই আঁখিকে পছন্দ, তাই আয়ানের থেকে লুকিয়ে মেডিক্যাল ভার্সিটির কোচিং এ ঢুকলো,অবশেষে এই দুসপ্তাহ আগে আঁখির রেজাল্ট বের হলো,আঁখি শহরের বেষ্ট মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছে,সেদিন যে কতো খুশি ছিলো তা শুধু আঁখিই জানে,আয়ানকে স্যারপ্রাইজ করবে বলে কলেজে ভর্তির কনফার্মেশনের সেই কাগজগুলো নিয়ে আয়ানের কাছে যাচ্ছিলো সেদিন আঁখি,যেহেতু আয়ানকে স্যারপ্রাইজ দিতে চাইছিলো তাই ও যে হাসপাতালে থাকতো সেখানে যাওয়ার আগে জানাইনি আঁখি এমনকি ওর কেবিনে ঢোকার আগে নকও করে নি,সেটাই হয়তো আঁখির চরম ভুল ছিলো,সেদিন যদি আঁখি সেই স্যারপ্রাইজটা দিতে না যেতো তবে হয়তো ভালোই হতো ওর জন্য,নিজের চোখে এমন অমান্য সত্য সহ্য করতে হতো না ওকে,নিজের স্বামীকে এভাবে অন্যমেয়ের সাথে আপত্তিকর মুহুর্তে কি করে কোনো মেয়ে মেনে নিবে,তখন যে আয়ান মাহির সাথে অধরে অধর মিলাতে মগ্ন ছিলো,আর সে মাহি আর অন্য কেউ না আঁখিরই স্কুল ফেন্ড,ফ্রেন্ড বলতে আঁখিই ওকে ফেন্ড মানতো মাহি না,ক্লাসে সবার সেরা ছিলো আঁখি,নাচ, গান,খেলাধুলা,আবৃত্তি, অভিনয়,এমনকি কারাতে, বিতর্ক সবকিছুতেই আঁখি সেরা ছিলো,সব কিছুতে আঁখি ফাস্ট ছিলো সবসময় আর মাহি শত চেষ্টা করেও সেকেন্ডেই আসতো,এমনকি আঁকি খনিকে সবার মন জয় করে নিতো কিন্তু মাহি তাতেও ব্যার্থ ছিলো,যার ফলস্বরূপ আঁখির অনেক বন্ধু ছিলো আর মাহির নেই বললে সারে,তাছাড়া আঁখি কোটিপতির একমাত্র মেয়ে ছিলো আর মাহি সামান্য কনস্টেবলের ৫ম মেয়ে,আর এজন্যই মাহির মনে যে সবসময়ই আঁখিকে নিয়ে হিংসে কাজ করতো, একদিন হিংসের বসে আঁখিকে চ্যালেন্জ করে বসে যে এসএসসিতে ও আঁখি থেকে ভালো রেজাল্ট করে দেখাবে,আঁখি তখন তা সিরিয়াসলি না নিলেও মাহি ঠিকই নেয় কিন্তু ঠিকই এসএসসি এক্সামের সময় আঁখি গোল্ডেন এ প্লাস পায় আর মাহি শুধু প্লাস,এতে যেনো মাহির মনের আগুন আড়ও বেড়ে যায়,তখন রাগের বসে মাহিকে আবারও চ্যালেন্জ করে একদিন ওর সবকিছু মাহি কেঁড়ে নিবে আর আঁখি কিছুই করতে পারবে না এটা বলে,কিন্তু মাহি যে নিজের জেদ এভাবে পুরন করতে মরিয়া হয়ে পড়বে কে জানতো।স্কুল টাইমেও মাহি আয়ানকে পটাতে চায় কিন্তু আয়ান তাড়াতাড়ি স্কুল ত্যাগ করায় তা আর পেরে উঠে না ও,কিন্তু দেড়ি করে হলেও ঠিকই নিজের জেদ পূরন করতে সক্ষম হলো মাহি,সেদিন হঠাৎ আঁখিকে সেখানে দেখে মাহিকে চলে যেতে বলে আয়ান,মাহিও চলে যায় আঁখির দিকে আঁড়চোখের তীক্ত চাহনি দিয়ে ঠোঁটের কোনে শয়তানি হাসি ফুঁটিয়ে,তারপর কেবিনের দরজা বন্ধ করে আয়ান বলতে লাগে।

দেখো আঁখি,আমি চাইনি সত্যটা এভাবে তোমার সামনে আসুক,কিন্তু আজকে এভাবে চলে আসবে আমি তা কখনো ভাবি নি,তবে আজকে যখন সবটা জেনেই গিয়েছো তবে আর তা লুকিয়ে রেখে লাভ নেই,আমি আর তোমাকে ভালোবাসি না আঁখি,আমি মাহিকে ভালোবাসি।

কথাটা শুনে আঁখি কি প্রতিক্রিয়া করবে তাই ভেবে নিতে ব্যার্থ হলো,ঠোঁটের কোনে হাসি ঝুলিয়ে ব্যাথার্থ কন্ঠে বেহায়ার মতো বলতে লাগলো।

তুমি এসব মিথ্যে বলছো না আয়ান?বলো মিথ্যে বলছো,ফাজলামো করছে না আমার সাথে?তুমি তো শুধু আমাকে ভালোবাসো,আমাকে ছাড়া তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসতেই পারো না তাই না?

ইশ কি শুরু করেছো তুমি,এটা কোনো ফিল্ম নয় আঁখি এটা বাস্তব জীবন,আর এ জীবনের কোথাও এটা লেখা নেই যে জীবনে শুধু একজনকেই ভালোবাসতে হবে,ওসব সত্য ভালোবাসা শুধু ফিল্মে বা নাটকে মানায়,কাম ওন আঁখি আমরা এ যুগের,তাও এতো এডাল্ট, এভাবে এতো ইমোশন্স নিয়ে পড়ে থাকলে হয় বলো,জীবনে একজনকে নিয়ে পড়ে থাকলে হয় না আঁখি,একঘেয়ে ভাবটাও যে জীবনের একটা অংশ,আর আমি যে তোমার সাথে থাকতে থাকতে এখন আমার মধ্যে একঘেয়ে ভাবটা চলে এসেছে তোমাকে নিয়ে,তোমাকে এখন আর আমার ভালো লাগে না,আমার তোমার স্টাইল,স্ট্যাটাস,তোমার বিন্দাস কেরেক্টার পছন্দ ছিলো কিন্তু বিয়ের পর তুমি কেমন যেনো সংসারী হয়ে গেলে আর সংসারী আঁখিকে আমার কখনো পছন্দ হয় নি,আর এখন যেনো সেই অপছন্দের মাত্রা ঘৃণাতে পরিণত হতে চলেছে আঁখি।দেখো আঁখি তুমি সবসময় আমার একজন ভালো বন্ধু ছিলে, এমনকি ভালো প্রেমিকাও,ভালো ওয়াইফও এটা মানতে আমি কখনো নারায হবো না কিন্তু আমি আর তোমার সাথে কো ওপারেট করতে পারছি না,তোমাকে এখন আর আমার ভালো লাগে না,তাই এ সম্পর্ককে আর টেনেও লাভ হবে না,বরং দেখবে স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক রাখতে গিয়ে আমাদের বন্ধুত্বের মতো সুন্দর সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে যাবে,দেখো আঁখি তুমি যথেষ্ট মেচোয়ার,কথাটা ভেবে দেখো একবার।আমি আর মাহি রিলেশনটায় অনেক এগিয়ে গেছি তা আজকের এই ক্ষনটা দেখে নিশ্চয়ই বুঝে গেছো তুমি,তাই আর আমার পিছন ছুঁটে লাভ নেই,প্লিজ যতো তাড়াতাড়ি পারো সত্যটা মেনে নিও।

কথাগুলো শুনার পর আঁখি যেনো জ্ঞান শুন্য হয়ে গেলো,এতোবড় চরম সত্য কি করে মেনে নিতো তখন ওই বেহায়া মন পিঞ্জরটা যেখানে বসবাস শুধু আয়ানের।

তারপর থেকে যেনো আয়ান লাইসেন্স পেয়ে গেছিলো, এখন যেনো আঁখিকে ও চোখেও দেখতে না,যখন তখন আঁখির সামনেই মাহির সাথে দেখা করতে চলে যেতো,সারাদিন ওর সামনে বসেই প্রেম আলাপ করতে মগ্ন থাকতো,সে কি কথার সিঁড়ি,আঁখি না চাইতেও সব সহ্য করতো,কিছুই বলতো না কভু,আঁখি যেনো আয়ানের জন্য অদৃশ্য হয়ে গেছিলো,১ সপ্তাহ পর হঠাৎ একদিন আয়ান একটা পেপার এনে আঁখির হাতে ধরিয়ে দিলো আর বললো।

ডিভোর্স পেপার যতো তাড়াতাড়ি পারো সাইন করে দিও।
তারপর চলে গেলো।
এরপর আর কি,আখিও সবকিছু মেনেই নিলো,হয়তো এটাই অনেকাংশে ভালোবাসার প্রতিদান হয়ে থাকে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here