মন_পিঞ্জর,২৫,২৬

0
803

#মন_পিঞ্জর,২৫,২৬
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_২৫(বোনাস পার্ট)
(রহস্য উন্মোচনের সুচনা পর্ব)

আয়ানের মাথা ঠিক নেই,কথাটা শুনার পর থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না,তখন পার্কের সব সাজসজ্জা নষ্ট করে দিয়েছিলো এমনকি আঁখির জন্য কেক এনেছিলো ওটাও নষ্ট করে দেয়, এবার ঘরে এসে বসে আছে বিছানায় ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে একধ্যানে,কোনো মতেই রাগ দমন করতে সক্ষম হচ্ছে না,তখনি মাহি এসে ওর কাঁধে হাত রাখে, আয়ান এবার ওর দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো অঙ্গভঙ্গিতে বলতে লাগে।

মাহি তুমি জানো আঁখি বিয়ে করে ফেলেছে,ও ড.আদৃতের স্ত্রী।

হোয়াট!আঁখি বিয়ে করেছে।আঁখিও এতোটা ফাস্ট হবে আমি কখনো ভাবি নি,হা হা হা।

তোমার কাছে মজা লাগছে এসব?আঁখি বিয়ে কি করে করতে পারে?

এতে এতো অস্বাভাবিক হওয়ার কি আছে আয়ান,ও বিয়ে করলে তোমার কি?

ও বিয়ে করলে আমার কি মানে?ও কাউকে বিয়ে কিভাবে করতে পারে ও তো আমাকে ভালোবাসে।

আর ইউ সিরিয়াস আয়ান,ও তোমাকে ভালোবাসলে কি হয়? তুমি তো ওকে ভালোবাসো না,বাচ্চামোর একটা সীমা থাকে আয়ান,এভাবে অনর্থক বিষয়ে এতো অস্বাভাবিক হওয়ার কি আছে?

অনর্থক তোমার কাছে এসব অনর্থক মনে হচ্ছে?না ও বিয়ে করতে পারে না,ও অন্য কারো হতে পারে না,আমি তা কখনো মেনে নিবো না,ও এমনটা কিভাবে করতে পারে?

চেঁচিয়ে গর্জে পাগলের মতো কান্ড করতে করতে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো আয়ান,আয়ানের এমন রুপ মাহি এই প্রথম দেখলো, মনের মধ্যে এখন খনিক ভয়ও ধরা দিলো ওর।

না না আমি অনেক দেড়ি করে ফেলছি,এই আয়ান যদি বুঝতে পেরে যায় যে ওর মনে এখনও ওই আঁখিরই বসবাস তবে অনেক বড় ক্যাল্যাঙ্কারি হয়ে যাবে,আমি একে রুপের জালে ফাঁসাতে পারলেও ওর মনে জায়গা করে নিতে পারি নি যা সম্পর্কে ওর নিজেরও জানা নেই,ও তো আমার রুপের মোহে পাগল হয়েছে,কিন্তু আমি তা খুব ভালো করে জানি কারন প্রায় রোজ রাতে ঘুমের ঘরে আঁখির নাম নিতে শুনেছি ওকে আমি, এর মানে এটা নিশ্চিত যে আয়ান এখনও ওই আঁখিকেই ভালোবাসে তবে হ্যাঁ জিনিসটা ওই বজ্জাত আন্দাজ করার আগেই আমাকে নিজের প্লান সাকসেসফুল করতে হবে আর ওই আঁখিরও একটা ব্যবস্থা করতে হবে নয়তো আমার প্লানে নিজের পা ঢুকাতে দু’বার ভাববে না ওই শাঁকচুন্নি।
____________________

আঁখি রাতে আদৃত আসার আগের ফাইলটা নিজের জায়গায় ঠিকমতো রেখে দেয়,প্রায় মধ্যরাতে আঁখি খেয়াল করে আদৃত ফাইলটা নিয়ে কোথাও চলে যায়,সারারাত আঁখি ভাবতে থাকে আদৃত জিনিসগুলো কোথায় লুকোতে পারে তবে তার কোনো সঠিক জবাব ও খুঁজে পেতে ব্যার্থ হয়।

পরদিন ভার্সিটিতে আঁখি শুধু আদৃতকে ফলো করছিলো কখন আদৃত কোনো সার্জারীর জন্য যাবে আর কখন ও একাকিত্বে আদৃতের কেবিনে ঢকার সুযোগ পাবে,হোক না হোক আদৃত এখানেই সবকিছু লুকিয়েছে যতোটুকু আঁখির অনুমান,কারন আদৃত একটা সুরক্ষিত জায়গায় ওগুলা রাখতে চাইবে আর সে হিসেবে ওর কেবিনই উপযুক্ত কারন ওখানে আদৃতের অনুমতি ছাঁড়া কেউই ঢুকবে না।
তাই আঁখির প্লান অনুযায়ী আদৃত একটা সার্জারীর জন্য বেড়িয়ে গেলেই আঁখি সুযোগ বুঝে আদৃতের কেবিনে ঢুকে পড়ে তারপর খুঁজতে লাগে জিনিসগুলো,অবশেষে আঁখির অপেক্ষার আর পরিশ্রমের অবসান ঘটলো,আদৃতের টেবিলের নিচের ড্রায়ারে আঁখি খুঁজে পেলো ওর সব প্রশ্নের জবাব,আঁখি ওগুলো হাতে নিলো সবার প্রথম রিপোর্টগুলো পড়তে নিলো,যা পড়ার পর আঁখি যেনো পুরো ধাতব মূর্তিতে পরিণত হলো অবাকত্বের প্রতিক্রিয়ায়,হাতগুলো একপ্রকার কাঁপতে শুরু হলো আঁখির,এই রিপোর্টগুলো যে আরোহীর,একটা রিপোর্ট প্রেগন্যান্সি নিশ্চিতকরনের আর অন্যটি গর্ভপাতের,আঁখি ঝটফট ডায়েরিটা খুলে পড়তে নিলো,ডায়রিটার প্রথম দিকে আদৃত আর আরোহীর সুন্দর দিনগুলো খুব সুন্দর করে ফুটিয়েছে আদৃত নিজের মন মাধুর্য মিশ্রিত লিখনী দিয়ে,সেখানে আরোহীকে নিয়ে অনেক কবিতাও লিখেছে আদৃত যেখানে লুকিয়ে আছে ওর মনের অসীম ভালোবাসা যা শুধুই আরোহীর জন্য,কিন্তু শেষের দিকের লেখাগুলো ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না আঁখি।

লিখাগুলো অনেকটা প্রায় এরকম……..

প্রিয়সী অনেক ভালোবাসি তোমায়, কিন্তু কখনো জানা ছিলো না তোমার মন পিঞ্জরের কোনো কোনে আমার জায়গা নেই,তোমার মন পিঞ্জর জুরে যে অন্য কারো বসবাস,যখনি তা বুঝে উঠতে সক্ষম হলাম আর পারলাম না তোমার ওই মিথ্যে ভালোবাসাতে নিজেকে রাঙিয়ে নিতে,শুনেছি সত্য ভালোবাসার টানে নাকি মানুষ সব করতে সক্ষম হয়ে পড়ে,কিন্তু কখনো জানা ছিলো না যে লোক ভালোবাসার মানুষটার সুখের জন্য তাকেও ত্যাগ করতে দ্বিধা করে না,আমিও যে পারি নি তোমার সুখের উপর নিজের সুখকে প্রাধান্য দিতে তাই মুক্ত করে দিলাম তোমাকে আর রয়ে গেলো কিছু সুপ্ত কথা আমার মন পিঞ্জরে,থাক না দোষ কি তাতে,সব ভালোবাসা পূর্নতা পাবে এমনতো কোনো কথা নেই।

কথাগুলো পড়ে আঁখির মাথায় আরও জটলা পেকে গেলো কিছুই বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না,আঁখি এবার এলবাম খুললো যেখানে আরোহীর সাথে শুধু অন্য একটা ছেলের ছবি,যে এলবামের কোনো কোনে আদৃতের কোনো ঝলক পেলো না আঁখি,আঁখি নিজের খেয়ালে মগ্ন তখনি ওর কানে ভেসে এলো পিছন থেকে আদৃতের কন্ঠস্বর,অনেকটা স্বাভাবিকভাবে মৃদ্যু কন্ঠে বললো আদৃত।

অবশেষে জেনেই গেলেন যা আজ অব্দি কেউ জানতে পারে নি।আমার ভয়টা যে থেকেই গেলো।

আঁখি এবার আঁখিযোগল তুলে তাকালো আদৃতের পানে,তারপর কাঁপা কন্ঠে বলতে লাগলো।
কি এসব ড.আদৃত?আরোহী মারা যায় নি ও অন্য কোথাও আছে,ওকে আপনি অন্য কারো হাতে তুলে দিয়েছেন কিন্তু কেনো?আর ওই লাশটা?

আমি জানি মিস আঁখি আপনি পুরোটা জানতে পারেন নি তবে এতোটুকু যখন জেনেই গেছেন বাকিটাও আপনাকে আমি জানাবো।

কথাটা গম্ভীর কন্ঠে বলে আদৃত আঁখিকে হাত ধরে টেনে কোথাও নিয়ে যেতে শুরু করে।
_____________________

আয়ান কিছুতেই নিজেকে শান্তি করতে পারছে না,বার বার ওর ভাবনাতে ধরা দিচ্ছে উল্টাপাল্টা সব কথা,আঁখি অন্য কারো স্ত্রী,এর স্পষ্ট মানে ও অন্য কারো সাথে থাকে,অন্য কাউকে স্বামীর অধিকার দেয়,অন্য কারো সাথে রাত কাটায় কথাগুলো ভেবে ভেবে গা জ্বলে উঠছে আয়ানের।

না আমি জানি আঁখি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না,ও তো আমাকে ভালোবাসতো, আমার জন্য পাগল ছিলো,আমার জন্য পৃথিবীর সব সুখ ছেড়ে দিলো,ওর জন্য সব থেকে প্রিয় আমি ছিলাম আমার জন্য সব করতো তবে আজ আমার জায়গা ও অন্য কাউকে কি করে দিতে পারে,কি করে পারলো ও তা করতে,কেনো করলো এমনটা।

কথাগুলো বলতে বলতে আয়ানের চোখ দিয়ে নেমে এলো অল্প জলের স্রোত।

চলবে…….

#মন_পিঞ্জর
#লেখিকা_আরোহী_নুর
#পর্ব_২৬

আদৃত আঁখিকে একা একটা নদীপাড়ে নিয়ে এসেছে।

আপনি আমাকে এখানে কেনো নিয়ে এলেন?

যাতে আমাদের কথা তৃতীয় কোনো কানে না পৌঁছে।

হুম,বলেন এবার কি লুকোচ্ছেন আপনি সবার কাছ থেকে,আরোহীর আসল সত্যটা আসলে কি?

তবে শুনেন।আজ থেকে ঠিক তিন বছর আগে আমার আর আরোহীর বিয়ে হয়,বিয়ের ব্যাপারে আমি আপনাকে যা বলেছিলাম সব সত্য ছিলো,আমি ওকে বাসর রাতে পরিষ্কার করে বলেছিলাম আমরা আগে একে ওপরকে ভালো করে চেনার এবং বোঝার চেষ্টা করবো একে অপরের পরিপুরকে পরিণত হবো তারপর না হয় স্বামী স্ত্রীর মতো সুন্দর সম্পর্কের শুরু করা নিয়ে ভাবা যাবে,যতোসময় না আরোহী আমাকে নিজের স্বামী রুপে মেনে নিবে ততোসময় আমি ওর উপর নিজের অধিকার খাটাতে যাবো না,আমি ওকে বিয়ের আগেও বলেছিলাম ওর দ্বিতীয় কোনো পছন্দ থাকলে আমায় বলতে আমি না হয় দিদুকে বুঝিয়ে বলে সব ঠিক করে দিবো,যেহেতু আমরা দুজনই দিদুর কারনেই বিয়ের এই সম্পর্কে আবদ্ধ হতে যাচ্ছিলাম তাই ওর ব্যক্তিগত কিছু ব্যাপার আলাদা করে থাকা আমার কাছে বড় কিছু মনে হলো না,আমার অবশ্য এমন কিছু ছিলো না সেটা আমি ওকে পরিষ্কার করে তখন বলে দিয়েছিলাম,তখন ও আমায় বললো ওর ব্যক্তিগত কোনো পছন্দ নেই ও আমাকে বিয়ে করতে চায়,বিয়ের রাতেও আমি ওকে ঠিক একই প্রশ্ন আবার করি তখনও ওর উত্তর মোটেও বদলালো না,আমি কখনো ওর উপর নিজের জোর খাটাতে চাইতাম না ওকে ওর মতোই থাকতে দিতাম,ভালোই কাটছিলো আমাদের দিনগুলো, দুজনের মধ্যে ভালো একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও সৃষ্টি হয়েছিলো,আস্তে আস্তে ওকে নিয়ে আমার মনে আলাদা এক ভালোলাগার অনুভুতি সৃষ্টি হলেও আমি ওকে কখনো তা বুঝতে দেই নি,কখনো ওকে ওর ইচ্ছার বিরুদ্ধে পেতে চাই নি তাই হয়তো,কিন্তু কিছুদিনে আন্দাজ করতে পারলাম ও নিজেও আমাদের সম্পর্ক কে পূর্নতা দান করতে চায়,তারপর একদিন ও আমাকে পরিষ্কারভাবেই বললো ওর আমাকে ভালোলাগে ও আমার সাথে এই সম্পর্ককে এগুতে চায়,ওর ইচ্ছাতেই বিয়ের পাঁচমাস পর আমাদের এই সম্পর্ক পূর্নতা পায়,দুজনই ভালোবাসার এক সম্পর্কে আবদ্ধ হই,তারপর অনেক ভালো কাটছিলো আমাদের দিন,আমি যেনো ওকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না,ও যেনো আমার আত্মার সাথে মিশে গিয়েছিলো,জানি না কিভাবে কিন্তু দিন দিন ওর জন্য আমার ভালোবাসাটা শুধু বেড়েই যাচ্ছিলো,ওর কাছ থেকেও যে আমি আমার ভালোবাসার যথেষ্ট প্রতিদান পেতাম হয়তো তাই।কিন্তু হঠাৎ একদিন, মা-বাবা সায়েদা নোমান আর দিদু আমার নানুর বাসায় বেড়াতে চলে গেলেন আরোহীকে নিতে চাইলেও আরোহী গেলো না বললো ওর ভালো লাগছে না,উনারা বেড়াতে চলে গেলেন সে রাতে আর ফিরলেন না,আমারও হাসপাতালে সেদিন অনেক কাজ ছিলো তাই বলেছিলাম রাতে নাও ফিরতে পারি, কিন্তু সেদিন বেশি রাত হবার আগে কাজ শেষ হয়ে গেলে ভাবলাম বাড়ি গিয়ে ওকে স্যারপ্রাইজ করবো,ওর জন্য সেদিন একটা লাল রঙের শাড়ী আর চুরিও নিয়ে যাই,স্যারপ্রাইজ খারাপ হবার ভয়ে সেদিন কলিংবেল বাজাই নি নিজের কাছে চাবি থাকায় ঘরে ঢুকে গেলাম,সারাবাড়ি অন্ধকার করা ছিলো ঘরে কোনো চাকরকেও দেখতে পেলাম না, তাই আমার মনে আরোহীকে নিয়ে দুশ্চিন্তা কাজ করতে শুরু করে দেয় আমি ছুটে যাই আমাদের রুমের পানে, আমাদের রুমেই তখন আলো জ্বলছিলো, রুম থেকে কারো কথা বলার শব্দও আমার কানে ভেসে এলো আমি এগিয়ে গেলাম, রুমের দরজা অনেকটা ফাঁক করা ছিলো যা দিয়ে ঠিক আমার বিপরীতে চলারত দৃশ্যটা স্পষ্ট আমার চোখে পড়লো,আমারই প্রিয়তমা জড়িয়ে ধরে আছে অন্য পুরুষকে, সে লোকটাও নিজের সাথে আঁকড়ে ধরে ছিলো আরোহীকে,আরোহী তখন কাঁদতে কাঁদতে লোকটির উদ্দেশ্য বলছিলো।

আমি আর পারছি না আদনান, আমি আর পারছি না সে লোকগুলোকে ধোকা দিতে যারা আমায় ভালোবাসে আর আমি তোমাকেও ছাড়তে পারছি না,আমি পারবো না তোমাকে ভুলতে।

তবে আর দেড়ি কিসের,চলো দুজন পালিয়ে যাই।আমিও যে তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না আর, চলো না আমার সাথে।

কিন্তু দিদু আমার পরিবার ওদের কি জবাব দিবো? তাছাড়া আদৃত ওর বাচ্চা।

কথাটা শুনে আমি আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলাম না,আমার বাচ্চা কথাটা যেনো এক শিহরন তৈরি করলো আমার শরীরে, আমি দরজা ঠেলে এবার ভিতরে ঢুকে গেলাম,আমাকে দেখে ওরা দুজনই হতভম্ব হলো,কিছুটা অস্বাভাবিকও,ওরা যে তখন আমায় ওখানে একদম আশা করে নি।আরোহীর অবাকত্ব আর ভয়ের পরিমাণ একটু বেশিই ছিলো তা আন্দাজ করতে পারলাম আমি,আরোহী কাঁপা কন্ঠে লোকটিকে বললো।

তুমি যাও আমি ওর সাথে কথা বলছি।

লোকটা চলে গেলো তারপর আরোহী চট করে এসে আমার পায়ে পড়ে গেলো কান্না করতে করতে,আমি কোনো কিছুই বুঝে উটতে পারছিলাম না তখন,ঝটফট ওকে পা থেকে উঠালাম,ও কাঁদতে কাঁদতে অনেকটা হাঁপিয়ে উঠেছিলো তাই ওকে নিয়ে বেডে বসিয়ে পানি খেতে দিলাম,তারপর একটু শান্ত হয়ে ও আমায় বলতে লাগলো ওই ছেলেটার সাথে না কি ওর আমাদের বিয়ের তিন বছর আগ থেকে সম্পর্ক,ছেলেটা ওর সাথে একই ক্লাসে পড়তো।ওখান থেকেই দুজনের প্রেম শুরু,দিদু যখন ওকে বলেন যে ওকে আমাকে বিয়ে করতে হবে তখন ও কি করবে ভেবে পায় না,দিদু ওকে কুড়িয়ে এনে একটা নতুন জীবন, নতুন পরিবার দিয়েছেন, জীবনের সব চাওয়া পাওয়া পূর্ন করেছেন,ওকে মাথায় তুলে রেখেছেন, কখনো ফুলের টোকা অব্দি ওর গায়ে পড়তে দেন নি আর তাই ও দিদুর আর এই পরিবারের ভালোবাসার প্রতিদান দিতে চাইছিলো কিন্তু এভাবে দিতে হবে ও জানতো না,তবে সেদিন না কি আদনানের সাথে কথা বলে অনেক কষ্টে নিজের মনকে মানিয়ে নেয় আমাকে বিয়ে করার জন্য,তারপর আমার সাথে নিজেকে মানিয়ে নেবার চেষ্টায় থাকে,এ ফাঁকে আদনানের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়,কিন্তু কিছুতেই না কি ও আদনানকে ভুলতে পারছিলো না আর আমাকেও মেনে নিতে পারছিলো না,আর তাই ও আমার পাশে আসার চেষ্টা করেছে এটা ভেবে হয়তো আমার সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়িয়ে গেলে আদনানকে ভুলতে সক্ষম হবে,আমাকে নিজের সাথে মেনে নিতে সক্ষম হবে কিন্তু তারপরও না কি সে ব্যার্থ হয়,ও নাকি আমাকে কখনোই ভালোবাসে নি আর কখনো বাসতেও পারবে না,ও শুধু আদনানকে ভালোবাসে আর ওর সাথেই থাকতে চায়,কথাটা শুনে আমি কি প্রতিক্রিয়া করবো বোধগম্য হচ্ছিলো না আমার,কিন্তু ওর বলা পরের কথাগুলো শুনে আমার মস্তিষ্ক যেনো কাজ করা বন্ধ করে দিলো অল্পতে,ও বললো যে ভুলবশত আমার বাচ্চা ওর গর্ভে চলে এসেছে যা ও রাখতে চায় না,ও আদনানের সাথে নিজের জীবন শুরু করতে চায় যেখানে আমার কোনো অস্তিত্ব ওর চাই না,অতপর আমার কাছেই সবকিছুর সমাধান চাইতে থাকলো,কারন ও জানতো একমাত্র আমি ছাড়া আর কেউ ওকে সাহায্য করতে পারবে না,ও আবারও আমার পায়ে পড়লো সবকিছু ঠিক করে দেওয়ার জন্য,তবে আমি কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না,তবে ওর চোখের জলও যে সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমার ছিলো না,অনেক ভালোবাসতাম ওকে,তাই আর কোনোদিক বিবেচনা না করে ওদের সাহায্য করার কথা ভাবলাম,তবে ওকে বলেছিলাম আমাদের বাচ্চাকে না মারতে,ওই নিষ্পাপ প্রাণের তো এখানে কোনো দোষ ছিলো না,আমি ওকে বলেছিলাম কোনোরকম ওকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে দিতে বাকি সব আমি দেখে নিবো কিন্তু ও তা মানতে রাজি হলো না,ওর জীবনে ওর সবকিছুতেই যে ওর আদনানের ছোঁয়াই কাম্য ছিলো,আদনানও না কি এতে সম্মতি দিচ্ছিলো না,তাই আর আমারও কিছু করার থাকলো না, অনেক বোঝানোর পরও মেরে ফেললো ও আমাদের বাচ্চাটাকে,এরপর গর্ভপাতের কারনে খনিক অসুস্থ হয়ে গেলে আমি ওর খেয়াল রাখি কাউকেই কিছু বলি না, তবে সেই সত্যটা একাকিত্বে মেনে নেওয়াটাও সহজ ছিলো না বটে,ও সুস্থ হয়ে উঠলে আমি নিজেই আমাদের ডিভোর্সের সব ব্যবস্থা করি তারপর ডিভোর্স হয়ে গেলে নিজে দাঁড়িয়ে থেকেই ওদের বিয়ে করাই,সাক্ষীটা আমিই ছিলাম,তারপর এক্সিডেন্টের মিথ্যে নাটকটাও আমি করাই,সেদিন আমাদের কারের ভিতর একটা বেনাম লাশ যে আগে থেকেই পুড়া ছিলো তাকে গাড়ির ভিতরে রেখে নিজেরই ভাড়া করা ট্রাক দিয়ে ওকে ধাক্কা লাগাই আর নিজেরই লোক দিয়ে ওতে আগুন ধরাই আর সবার সামনে এভাবে তুলে ধরি যে এটা আরোহী ছিলো যে এক্সিডেন্টে মারা গেছে,তারপর মিথ্যে ডিএনএ রিপোর্টের ব্যবস্থাও আমি করাই,কারন পুলিস লাশ শনাক্ত করনের জন্য ঘর থেকে আরোহীর চিরুনি, টুট ব্রাশ,আরও ব্যবহার্য কিছু জিনিস নিয়েছিলো,স্বাভাবিকভাবেই লাশটার সাথে ডিএনএ মেচ হয় নি তবে তা পুলিশের হাতে পৌঁছার আগে বদলে দেই আমি,সব কিছু ক্লিয়ার করে ওকে আর আদনানকে সবাই থেকে অনেক দূরে কোথাও চলে যেতে বলি।সেদিন আরোহী আমাকে শুকনো মুখে শুধু একটা কথাই বলেছিলো ধন্যবাদ, তারপর আর ফিরেও তাকায় নি,হয়তো অনেক অনেক ভালো আছে সুখে আছে ভালোবাসার মানুষটির সাথে।আমার শুধু একটাই আক্ষেপ রয়ে গেলো…. যে এখানে আমার আর আমার বাচ্চার কি দোষ ছিলো?কেনো আমাদের সাজা পেতে হলো?

নদীর পানে ধ্যানরত দৃষ্টি অটল রেখে কথাগুলো বলে গেলো আদৃত,এদিকে আদৃতের কথাগুলো শুনে আঁখি এখন নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে আছে, চোখ বেয়ে উপছে পড়তে শুরু হয়েছে ওর কিছু জল,একটা মানুষ কি করে একা এতো কিছু করে যেতে সক্ষম হতে পারে,এমনটা কি আদোও সম্ভব, আদৃত এবার আঁখির দিকে এগিয়ে এসে ওর হাতের এলবামটা দেখিয়ে বললো।
এই যে আপনার হাতের এলবাম এটা ওর আর আদনানের সুন্দর মুহুর্তের কিছু স্মৃতি, ওগুলা দেখিয়ে আরোহী আমাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হয় যে ও আদনানের সাথে কতোটা গভীর সম্পর্কে চলে গেছে কারন উক্ত বিষয় যে আমার বেহায়া মন মেনে নিতে মোটেও সমর্থ্য ছিলো না।এই যে এই রিপোর্ট এই এলবাম এগুলা আমি নিজের কাছে কেনো রেখেছি জানেন যাতে আমি নিজের বেহায়া মনকে বিশ্বাস করাতে পারি যে আরোহী কখনো আমার ছিলো না আর কখনো আমার হবেও না,ও অন্য কারো,ওর কোনোকিছুতেই আমার অস্তিত্ব খোঁজা শুধুই বোকামি,ওগুলা আরোহীর প্রতিরক্ষার জন্যও রেখেছি কারন এই বেহায়া মন এখনও বার বার আরোহীর নামেই ছুটে যেতে চায় আর আমি চাই না আমার জন্য ওর চোখে আবারও জল আসুক।
আদৃতের চোখ বেয়ে জল উপচে পড়ার উপক্রম হলো যা বইতে দিতে নারাজ হলো সে,তাই নিজেকে স্বাভাবিক করে এবার গম্ভীর কন্ঠে বললো।

আশা করি কথাটা আপনি আর কাউকে জানাবেন না,আপনাকে বিশ্বাস করি আর আমি জানি আপনি আমার বিশ্বাস কখনো ভাঙবেন না।

অতপর আদৃত আঁখির হাত থেকে প্রমাণগুলো নিয়ে স্থান ত্যাগ করে,আঁখি এখনও যেনো নিজের কানে বিশ্বাস করতে সক্ষম হতে পারলো না,ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আদৃতের পানে দৃষ্টি অটল রেখে।
___________________

রাত ১২ টা বাজে আয়ানের এদিকে সব কিছুতে ফাঁকা লাগতে শুরু হয়েছে,সব কিছু যেনো হাহাকারে পূর্নতা পেয়েছে ওর,চারপাশে শুন্যতা বিরাজমান,সব সুখ থাকা সত্বেও আজ নিজেকে নিঃস্ব লাগছে ওর,বার বার কানে বেজে উঠছে আঁখির বলা কথাগুলো,আঁখি বিয়ে করে ফেলেছে সত্যটা মানতে কেনো এতো কষ্ট হচ্ছে ওর জানা নেই,এদিকে ওর না খেতে ভালো লাগছে না ঘুমোতে,ওর বেহায়া মন যেনো সবকিছুতে আঁখির ছোঁয়াই পেতে চাইছে এবার,আনমনে ভাবছে আঁখিকে নিয়ে অনেক কথা তখন মাহি কিছু পেপারস নিয়ে ওর সামনে প্রকট হলো।

আয়ান এগুলাতে সাইন করে দাও।

এগুলা কিসের পেপারস।

ওই আসলে ভার্সিটির কিছু ইমপোর্টেন্ট পেপারস যেখানে অভিভাবকের সাইন চাই তাই এগুলাতে সাইন করে দাও।

হুম বলো কোথায় করতে হবে?

এই তো এখানে, হুম তারপর এখানে
হুম এখানে……….এই তো হয়ে গেছে।

সাইন করার সাথে সাথে মাহি পেপারসগুলো টান দিয়ে নিয়ে নিলো তারপর মুখে রাজ্য জয় করা হাসি নিয়ে স্থান ত্যাগ করলো,আয়ানের মাহির উপর বিষয়টা নিয়ে একটু সন্দেহ হলেও পরক্ষণেই তা একসাইড করে আবারও আঁখির চিন্তায় মগ্ন হয়।

আঁখি শুয়ে আছে সোফাতে,আদৃত বেলকোনির দোলনায় বসে চাঁদ দেখতে মশগুল , তবে ঘুম নেই আঁখির চোখে, মেনে নিতে পারছে না আদৃতের বলা চরম সত্যগুলো, লোকটা ভালো জানতো আঁখি তবে এতোটা ভালো কখনো কল্পনায়ও ভাবে নি,আজকে আদৃতের জন্য আঁখির মনে থাকা সম্মানের পরিমাণটা যে আরও হাজারগুণ বেড়ে গেছে,অনেক খারাপ লাগছে আঁখির আদৃতের জন্য,হয়তো ওদের দুজনেরই গল্প কিছুটা একইরকম তাই আদৃতের কষ্টটাও অনুভব করতে সক্ষম হচ্ছে আঁখির হৃদয়,আঁখি এবার উঠে গেলো, তারপর পিলুপায়ে এগিয়ে গেলো আদৃতের পানে ওর পাশে গিয়ে বসলো এবার সহানুভূতিময় হাত কাঁদে রাখলো আদৃতের তৎক্ষনাৎ আদৃত ফিরে গিয়ে ঝাপটে ধরলো আঁখিকে তারপর কান্নায় ভেঙে পড়লো।

চলবে…………….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here