শিশিরের_কহিনুর,পর্বঃ০৬

0
927

#গল্পঃশিশিরের_কহিনুর,পর্বঃ০৬
#লেখিকাঃ_আরোহী_নুর

আলতো করে চোখ খুললাম,খুলেই দেখতে পেলাম দুজন ডাক্তার কাঁপতে কাঁপতে আমার চেকআপ করতে ব্যস্ত,দুজনই অনেক ভয় পেয়ে আছে দেখেই বুঝা যাচ্ছে,একজন ডাক্তার নাকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,নাক দিয়ে উনার রক্ত পড়ছে আর অন্য একজনের ধুলাই হচ্ছে যা করছে ওই পাগল ব্যাঙটা।

ওই তোরা চারচারটে আধা ঘণ্টা ধরে আমার কহিনুরের জ্ঞান ফিরাতে পারছিস না, তোরা কোন ধরনের ডাক্তার, আজ আমি তোদের মেরেই ফেলবো,যে করেই হোক তোরা আমার কহিনুরের জ্ঞান ফিরা নইলে আজ সবার মৃত্যুদিন হবে।

ব্যাঙটা ওই ডাক্তারকে মারতে মারতে কথাগুলো বললো,আমার পাশের একজন ভুঁড়িওয়ালা ডাক্তার কাঁপা কন্ঠে বললেন।

স্যার মেডাম এর জ্ঞান ফিরেছে।

ব্যাঙটা যে মেঘ না চাইতে বৃষ্টি পেয়েছে,রাগি মুখে খনিকে অনেক বড় প্রাপ্তির হাসি ফুঁটিয়ে আমার কাছে এলো,আর এক হাতে ওই ডাক্তারদের চলে যেতে ইশারা করলো,খচ্চর ভিতু ডাক্তারেরা লেজ গুটিয়ে পালালো,এবার ব্যাঙটা আমার হাতে পাগলের মতো চুমু খেতে শুরু করলো,এই প্রথম কোনো ছেলের এমন কোনো স্পর্শ পেলাম তাই হাতগুলো গুটিয়ে নিতে চাইছি,খারাপ লাগছে আমার, খচ্চরটার স্পর্শ মোটেও ভালো লাগছে না,ব্যাঙটা এবার নিজের অধরজোরায় ব্রেক লাগালো আর আমার হাত দিয়ে নিজের গালে থাপ্পড় মারাতে শুরু করলো,এবার আমি কনফার্ম হলাম বেটা সত্যিই পাগল।

মারো আমায় কহিনুর মারো,আমি যে তোমায় আঘাত করেছি,আমি সত্যিই পাগল কেনো যে নিজের রাগে কন্ট্রোল করতে পারি না,আমি কি করে পারলাম আমার প্রাণের উপর হাত তুলতে,আজ তোমার কিছু হয়ে গেলে যে আমি মরে যেতাম,দেখো আমি তোমাকে যতটুকু কষ্ট দিয়েছি তার থেকেও বেশি কষ্ট নিজেকে দিয়েছি,তুমি আমায় আরও মারো,সাজা দেও আমায় কিন্তু আমায় ছেড়ে যেও না কহিনুর,তুমি ছাড়া আমি যে নিস্ব মায়াপরী কেনো বুঝো না তুমি।

সত্যিই দেখতে পেলাম ব্যাঙটার কপাল কাটা,হাতে অজস্র আঘাতের চিহ্ন, হয়তো আমি অজ্ঞান হওয়ার পর নিজেকে আঘাত করেছে।এবার আমার গালে মলম লাগাতে লাগাতে বললো।

কি করবো বলো লক্ষিটি আমি যে তোমায় অনেক ভালোবাসি, যখন তুমি ওসব বললে তখন আমার মনে হলো তুমি আমায় ছেড়ে চলে যাবে,যা আমি মেনে নিতে পারবো না, আমি তোমায় ছাড়া যে বাঁচতে পারবো না প্রিয়সী,আর সেই ভাবনায় নিজের রাগটা কন্ট্রোল করতে পারি নি,যেকোনো মুল্যে তোমার মুখে স্বীকার করাতে চেয়েছি যে তুমি আমায় ভালোবাসো,তোমার বলা ওসব কড়া কথা মেনে নিতে পারি নি তাই এমন করেছি,কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ময়না আমি না হয় খনিকে তোমার প্রেমে পড়ে গেছি কিন্তু তুমি তো পরো নি,হয়তো তোমার আমায় ভালোবাসতে সময় লাগবে তাই আমি তোমায় সময় দিবো কেমন….…,কিন্তু ভালো তোমায় আমাকেই বাসতে হবে।

এতোসময় ভালোভাবে কথা বলে লাস্টের লাইনটা কিরকম একটা ডেবিল লুকে বললো যাতে আমি আবারও ভয় পেয়ে গেলাম, পরক্ষনেই শয়তানটা আবারও চেহারায় মিষ্টিময় ভাব এনে বললো।

ভয় পেয়ো না লক্ষিটি, কেউ নিজের হবু স্বামীকে এভাবে ভয় পায় না কি,আচ্ছা এবার চলো এখন আর তোমায় কোনো জোর করছি না,তোমায় এবার লক্ষি ছেলের মতো বাড়ি দিয়ে আসবো। ওষুধ লাগানো শেষ এবার আমার ময়না পাখি বাড়ি যাবে,বাড়ি গিয়ে রেষ্ট নিবে কেমন।এবার চলো।

কথাটা বলে ব্যাঙটা আবার আমায় কোলে নিলো আমি এখন অব্দি হা না কিছু বলি নি,নড়াচড়াও করছি না,কিছুক্ষণ আগে ঘটা ঘটনার রেশ যে আমার মন থেকে এখন অব্দি যায় নি,ভয়ে আমার হৃদয় জমে গেছে একদম।

যাক লোকটা আমায় আমার বাড়িতে নিয়ে আসলো,আমায় আমার রুমে এনে বেডে শুইয়ে আমার কপালে নিজের অধর ছুঁইয়ে বললো।

রেস্ট করো লক্ষিটি আমি আবার আসবো,তারপর ব্যাঙটা চলে গেলো,ও চলে যাওয়ার পর যেনো সস্তি পেলাম,নিজের স্বাধীন জীবন একটুর জন্য হলেও ফিরে পেলাম,অনেক কান্না করতে লাগলাম আমি,কেনো যে ঢাকায় আসতে গেলাম,তাও ঠিক ছিলো তবে কেনো সেদিন আপির কথার অবাধ্য হয়ে বাইরে ঘুরতে গেলাম,সেদিন না গেলে হয়তো এমনটা কখনো হতোই না,কিন্তু এখন আফসোস করে কি লাভ যা হবার তা তো হয়েই গেছে,কাঁদতে কাঁদতে অনেক সময় পর একটু শান্ত হলাম,আপিকে ফোন করলাম ওকে আবার আমি কিছু বলতে চাই না, কারন এসব কিছু জানা মানে আমার সিলেট ফিরে যাওয়া,তাছাড়া আমি এই মুহুর্তে আপিকে আর টেনশন দিতে চাই না,আপি আমায় বললো ডাক্তারেরা দুলাভাইকে কালকে ছাড়বে উনি এখন সুস্থ আছেন আমায় চিন্তা না করতে,আর বাড়িতেই থাকতে বললো,আপি আর আজ আসবেনা,তাই খেয়ালে থাকতে বললো।আপির সাথে কথা বলে ফোন রাখলাম কিন্তু কিছু ভালো লাগছে না,বার বার সেই ক্ষনের কথা মনে পড়ছে,ফোনে কিছু গেইমস খেলে বান্ধবীদের সাথে চেট করে,বাড়িতে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে,টিভি দেখে সারাদিন কাটালাম,অন্যদিনের মতো আর দৌঁড় ঝাপ,হৈ হুল্লোড় করলাম না,মনে যে সুখ নেই,রাত হয়ে গেছে অনেক ভয় করছে আমার,বাড়িতে একটা কাজের মহিলা আছে বটে,উনি খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন,আমার ঘুম আসছে না,ঘরটা কেমন খালি খালি লাগছে তাই ভয়টাও বেশি হচ্ছে। তাই কম্বল দিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি ঘুরে শুয়ে পড়লাম,ঘুম আসছে না অনেক ভয় হচ্ছে হঠাৎ অনুভব করলাম কেউ একজন আমার কম্বলের ভিতর ঢুকে গেছে, ভয়ে আপন ভাষায় মানে সিলেটি ভাষায় চিৎকার দিলাম,আম্মাগো আমারে বাছাও,

কি বললে?

ওমা কম্বলের তলা থেকে দাঁত কেলিয়ে বের হলো সেই ব্যাঙটা,বুঝলাম সিলেটি ভাষা বুঝে নি,তাই আর বুঝালাম না,উল্টো প্রশ্ন করলাম।

আপনি এখানে কি করছেন?

আমি, ওহ আসলে ভাবলাম আমার প্রাণ পাখিটা আজ একা হয়তো অনেক ভয় পাচ্ছে তাই চলে এলাম ওর কাছে,ভালো করি নি ময়না,এবার চলে আসো আমার বুকে,মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবো নে,কেমন।

আমি নিজে ঘুমোতে পারি আপনার দরকার নেই আমার,আর আমি ভয়ও পাই না চলে যান আপনি?

দেখো সোনা আমি এই মুহুর্তে একদম রাগার মুডে নই,তাই রাগিয়ো না আমায়,চুপচাপ যা বলছি তা করো নইলে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখ আছে।

বজ্জাতটার কথায় অনেক ভয় হলো আমার আবার,এই মুহুর্তে আমার আর কিছু করার নেই,এ যা চায় তা করেই নিবে আমি তো আর একে আটকাতে পারবো না তাই এর কথা মানাই ভালো,নয়তো পরে আরও কি না কি করে বসবে,তবে একে শায়েস্তা করার কোনো পথ ছাড়বো না,মনে মনে পণ নিলাম আমি,আপাততো এর বুকেই যাই,প্রথমে কিরকম যেনো লাগছিলো এভাবে কোনো ছেলের বুকে মাথা রাখলাম,কিন্তু খনিকে ভালোলাগা কাজ করলো,সব ভয় চলে গেলো,কারন আর যাই হোক আমার এ মনটা এতসময়ে জেনে গেছে যে এই বুকটা আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান আর তাই হয়তো একরাশ শান্তির ঘুম নিমিষেই ধরা দিলো চোখের পাতায়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বালিশে আবিষ্কার করলাম আশেপাশে বজ্জাতটা নেই,অনেকটা খুশি হলাম ওকে না দেখে,টেবিলে একটা চিরকুট পেলাম।চিরকুটে লিখা।

শুভ সকাল কহিনুর
ঘুমন্ত অবস্থায় কাউকে এতো মায়াবী দেখায় তোমাকে না দেখলে জানতাম না প্রিয়সী,তোমার ওই মায়াবী মুখখানা জীবনভর দেখলেও যে মন ভরবে না, ভালোবাসি তোমায় অনেক, তুমি যে আমার জীবনের চেয়েও দামী কহিনুর।
আই লাই ইউ মাই লাভ কহিনুর।

ধুর এটা পারেও বটে,এটাকে ফিল্মে নিলে বেষ্ট রোমান্টিক হিরোর এওয়ার্ড পেয়ে যেতো হয়তো,কেনো যেনো আমার পিছন পরে আছে কে জানে,আমি তো কোনোরকম এর থেকে বাঁচলে পারি।

যাকগে,আপি সন্ধ্যায় ফিরবে,আজকে থেকে এদিকে আমার কোচিং শুরু,প্রথম ক্লাস তাই আপি কোচিং মিস দিতে না করলো,আমিও চলে গেলাম মনটা একটু ভালো হবে বলে,তাছাড়া কনিকা তো থাকবেই ওখানে বেশ চলে গেলাম সেথায়, প্রথম ক্লাস খুব ভালো গেলো,প্রথম দিনেই অনেকের সাথে বন্ধুত্ব হয়ে গেলো,আপনারা তো জানেনই আমি খুব মিশুক,আর দুঃখ কষ্ট আমি বেশি সময় মনে রাখি না,কোনো চিন্তাই বেশি সময় স্থায়ী হয় না আমার মাথায়, সে অনুযায়ী আমি এদের সাথে খনিকে মিশে গিয়ে সব কিছু ভুলেই গেলাম,কনিকার সাথেও অনেক মজা করলাম,যেহেতু প্রথম ক্লাস ছিলো তেমন পড়া হয় নি,পরিচয়ের মাধ্যমেই ক্লাস শেষ হলো,ক্লাস থেকে বেড়িয়ে আমি আর কনিকা রাস্তার দিকে আসছিলাম রিক্সার জন্য তখনি একটা ছেলে হাতে ফুল নিয়ে আমার সামনে আসলো,হয়তো আমাদের সাথেরই হবে,মানে ক্লাসমিট,আজকে ক্লাসে দেখেছি প্রথম, বেশ কয়েকবার আমার সাথে কথা বলার চেষ্টাও করেছে,কিন্তু আমি কথা বলি নি কারন আমি ছেলেদের যথারীতি ইগনোর করি,ছেলেটি আমার দিকে ফুলটা এগিয়ে দিয়ে কিছু বলবে এর আগেই ওর হাত বরাবর একটা গুলি পড়লো,সাথে সাথে ছেলেটি মাটিতে পড়ে কাঁতরাতে লাগলো,আমি হতবম্ভ হয়ে গেলাম,কোথা থেকে ব্যাঙটা চলে আসলো কে জানে, এসে ছেলেটিকে খুব মারা শুরু করলো,আশেপাশের কয়েকজন মানুষ ওকে আটকানোর চেষ্টা করলে ওদের দু একজনকেও দু একটা দিয়ে দিলো,তারপর আর কেউ আসে নি এগিয়ে,হয়তো এর পাওয়ার সম্পর্কে কম বেশি সবাই জানে তা আমি সবার দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম,সবাই ভিতু চোখে তাকিয়ে আছে,আমি বেশ কয়েকবার ওকে থামাতে গেলে আমায় বলেছে আমি যদি এই ছেলের প্রতি দরদ দেখাই তবে একে প্রাণে মেরে ফেলবে একটুও রহম করবে না,ছেলেটিকে মারছে আর বলছে তোর সাহস কি করে হলো আমার কহিনুরের দিকে চোখ তুলে তাকানোর,বল,বল না,জানিস না কহিনুর শুধু আমার, শুধুই আমার।ছেলেটিকে মারতে মারতে অজ্ঞান করে ফেলেছে তাও মারছে আমি আর এই হিস্রতা মেনে নিতে পারলাম না,চোখের সামনে অন্ধকার নামলো আমার,আমি নিস্তেজ হয়ে পড়লাম।

নিজেকে আমি কারো বাহুডরে আবদ্ধ অনুভব করতে পারছি,হয়তো আমি আবার জ্ঞান হারিয়ে গিয়েছিলাম,আমি জীবনে কোনোদিন জ্ঞান হারাই নি বড় গর্ব করে বলতাম সবাইকে,কিন্তু এই ব্যাঙটা জীবনে আসার পর থেকে জ্ঞান হারানোই হয়তো আমার মূখ্য কাজ হয়ে পড়েছে,পিটপিট করে চোখ খুললাম ব্যাক্তিটিকে দেখার উদ্দেশ্যে,কার কোলে আছি আমি দেখতে হবে তো।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here