#শিশিরের কহিনুর,১১,১২
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ১১
সেই কখন বেড়িয়ে এসেছি ওই খাঁচা থেকে,বারান্দায় শাড়ী ঝুলিয়ে নেমে তারপর বাগানের পিছনের দিকে গিয়ে দেয়াল টপকে বেড়িয়েছি,সামনের দিকে গেলে যে ধরা পরতাম।চলেই আসলাম অবশেষে,এখন আমি স্বাধীন যেটা আমি সব সময় থাকতে চাই কিন্তু কেনো যেনো একটু খারাপ লাগছে আমার,যেনো এই স্বাধীনতা এখন আর আমার চাই না,আমার যেনো ওই লোকটার বন্দি খাঁচাটায়ই উড়তে ইচ্ছে হচ্ছে এখন,আরে না না আমি এসব কি ভাবছি,আমি মুক্ত পাখি আকাশে উড়বো,খাঁচার মধ্যে থেকে উড়ার কোনো ইচ্ছা আগ্রহ আমার নেই।মনকে বুঝিয়ে পিলুপিলু পায়ে হাঁটছি ফাঁকা রাস্তায়,রাত যে এখন অনেক, প্রায় ১১ টা হবে,আমার উদ্দেশ্য একটাই এখান থেকে সোজা রেলস্টেশন যাবো তারপর টিকিট কেটে রাঙামাটি চলে যাবো আর সেখানেই নিজের নতুন জীবন শুরু করবো,মুক্ত স্বাধীন জীবন, একটা গাড়ি করে এতটুকু এসেছি,একটু দুরে রেলস্টেশন, এই রাস্তাটা ছোট তাই গাড়ি ঢোকে না,কোনো রিক্সারও আতাপাতা আশেপাশে নেই তাই হাঁটছি,অনেকটা ভয় করছে আমার,কারন চারিদিকে খুব বেশি না হলেও বেশ অন্ধকার আর অন্ধকার আমি অনেক ভয় পাই, হঠাৎ অনুভব করলাম কিছু লোক আমার পিছু করছে,পিছনে তাকাতেই দেখলাম গুন্ডা টাইপের তিনটে লোক হাতে ধারালো ছুঁড়িও আছে বটে,কেউ এদের আমাকে মারার জন্য হায়ার করলো না তো,এদের দিকে তাকাতেই সংশয়টা মনে কাজ করে গেলো আমার,আমি জোর পায়ে হাটা ধরলাম ওরাও তাই করছে,যেনো এখানে হাঁটাহাঁটির কম্পিটিশন চলছে,একসময় শুরু হলো দৌঁড় প্রতিযোগীতা,যেনো আমি অলিম্পিকে দৌঁড়াচ্ছি আর এই পেটমোটা নাক বুজা লোকগুলো আমার প্রতিধন্ধী,দৌঁড়াতে গিয়ে মিস করছি ব্যাঙটাকে এখন থাকলে বজ্জাতগুলোকে যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিতো আমার কি জানা ছিলো আমার মনের টান এতো প্রখড়,দৌঁড়াতে গিয়ে ধাক্কা খেলাম কারো সাথে,লোকটা আমায় পড়ে নেওয়ার আগেই ধরে নিলো চোখ তুলে তাকাতেই ভয়ে বুকটা আমার মোচড় মেড়ে উঠলো,ব্যাঙটার চোখগুলো লালবর্ণ ধারন করে আছে,এখন তো ভয় টা আমার ওই লোকগুলো থেকে এই ব্যাঙটাকেই বেশি করছে,তারপরও ভয়কে গুলি মেরে লুকিয়ে গেলাম ব্যাঙটার পিছন,পিছন থেকে উকি মেরে দেখলাম লোকগুলো কি এটিটিউড নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,বেচারাদের জন্য অনেক খারাপ লাগছে আমার,কারন এতো হিরোর মতো এটিটিউড দেখিয়ে কি লাভ হবে এদের,একটু পর তো ওদের হালটাই দেখার মতো থাকবে না,ব্যাঙটা অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওগুলার দিকে,লোকগুলো কি পাওয়ার নিয়ে এগিয়ে এলো কিন্তু কি হলো এতো পাওয়ার দেখিয়ে সব পাওয়ার ফুস করে দিলো বজ্জাতটা,এতো শক্তি আর এতো বুদ্ধি কোথা থেকে আনে ব্যাঙটা এই জানে মাত্র,হয়তো ওর শাশুড়ীমা ওকে ছোটবেলায় বেশি বেশি দুধ আর বাদাম খাইয়েছিলেন আর ও খেয়েছেও,আমার মতো হয়তো ছিলো না বরাবরই লক্ষি ছেলে ছিলো মায়ের কথা শুনতো,আজকে তাই সুফল পাচ্ছে,লোকগুলোকে তিনতিনটা পাঞ্চ মেরে ফেলে দিলো তারপর জুতার পিছন প্যান্টের পকেট থেকে চাকু বার করলো আর ইচ্ছামতো প্রহার করলো ওই লোকগুলোর চোখের দিকে, হাতে, পেটে,এক্সট্রা মার তো আর আছেই, তারপর কোমড়ের পিছন থেকে রিভালভার বার করলো আর তিনটার হাত আর পা বরাবর গুলি করলো আর শেষে একটা ডায়লগও মারলো।
যারাই আমার কহিনুরের দিকে চোখ তুলে তাকাবে তাদের হাল আমি এমন করবো যে বেঁছে থেকেও কোনো কাজের থাকবে না বার বার মড়তে চাইবে।
সত্যিই তো লোকগুলোর এমন হাল করেছে যে বেঁচে গেলেও ওরা আর কোনো কাজে লাগবে না,ল্যাংড়া লুলা হয়ে যাবে,ওদের মেরে ব্যাঙটা ঘাড় ত্যারা করে ডেবিল লুকে ঠোঁট বাকিয়ে আমার দিকে তাকালো।আমি জানি এখন আমার পালা আমায় কে বাঁচাবে,কেউ নেই বাঁচানোর তাই আবার শুরু করলাম দৌঁড় প্রতিযোগীতা কিন্তু এর জন্য আমার দৌঁড় কোনো প্রতিযোগীতা না ও তো একটু ছুটেই আমার সামনে চলে আসলো,আসলেই হয়তো লোকটা বেশি বেশি ডিম দুধ খেয়েছে তাই এতো পাওয়ার,আমি কিছু বুঝার আগেই বিনা বাক্যে আমার গালে বসিয়ে দিলো ভাড়ী একটা,আমি পড়ে গেলাম রাস্তায়, মোটেও খারাপ লাগছে না আমার এতে এটার স্বাদ যে আমার অনেক পরিচিত,হয়তো এখন আরও দুচারটে দিয়ে দিলেই খুশি হতাম,কারন দুচারটে দিলেই ওই লোকটার রাগ একটু কমে যেতো তারপর আমায় আবার আদর করতো আর ক্ষমা করে দিতো কিন্তু লোকটা তা করলো না বরং একদম শান্তভাবেই আমায় কোলে নিয়ে হাঁটতে লাগলো, আমার ভয়টা ক্রমশ বেড়েই চলেছে কারন এই নিরবতা ঘুর্ণিঝড় এর পূর্বাভাস দিচ্ছে,এতোদিনে আমি একে অনেক ভালোকরে জেনে গেছি,নিশ্চয়ই আমার কপালে বর্তমানে অনেক দুঃখ আছে,লোকে বলে না সুখে থাকতে ভুতে কিলায় আমাকেও কিলাইছিলো তাই এসব আবালের মতো কাজ করলাম,এবার আমাকে কে বাঁচাবে।
এদিকে রোদেলা দরজা লক করে সেই কখন থেকে কাঁদছে, কাঁদবে নাই বা কেনো, চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষকে কি কেউ অন্যের সাথে সহ্য করতে পারতো,রোদেলার বয়স ২০ বছর,ও আর নুর সমবয়সী, রোদেলা এইচএসসি দিয়েছে মাত্র,কোচিং করছে, ওদেরই মেডিক্যাল কালেজে ভর্তি হবার প্লান ওর, রোদেলা ছোটবেলা থেকেই আকাশকে পছন্দ করে কিন্তু আকাশ ওকে ছোট বলে বরাবরই অদেখা করতো,এখনও করে,কিন্তু রোদেলা নিজের অনুভুতি সম্পর্কে পুরোই অবগত ও আকাশকে ভালোবাসে ও তা জানে,আকাশ ওর ভালোবাসাকে আবেগ মনে করলেও ওর ভালোবাসাটা সত্য,কিন্তু আকাশ কভুও তা বুঝতে চাইবে কি না কে জানে,আজকে রোদেলা আকাশের পছন্দের কালারের একটা ড্রেস পড়েছিলো,ওটা পড়ে আকাশের সামনেও এসেছে অনেক বার, ওকে জিজ্ঞেসও করেছে ওকে কেমন লাগছে দেখতে কিন্তু আকাশ ওর কোনো আনসারও করে নি,এমনকি ওকে যথারীতি অদেখাও করলো,রোদেলা এতে অনেক কষ্ট পেলো, ওর কষ্টের মাত্রাটা তখন বেশি বেড়ে গেলো যখন দেখলো পার্টিতে ড.রিয়া এসেছে,রিয়াকে দেখতেই আকাশের মুখে এক ফালি হাসি ফুঁটে উঠলো,যেনো ও রিয়ারই অপেক্ষায় ছিলো,রিয়া আসার পর থেকে রিয়া আর আকাশ সে কি গল্পগুজব শুরু করলো,তাও একাকিত্বে,যেনো ওদের এই পার্টির কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই, ওরা একে অপরের মাঝে ব্যস্ত হয়ে আছে,দুজনের কাপড়ের কালারও সেইম মিলে গেছে,ড.রিয়া ওদের মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর,আকাশও তাই,রোদেলা প্রায়ই দুজনকে এভাবে একসাথে দেখেছে,সেই কলেজে এখন অব্দি ভর্তি না হলেও সেখানে প্রায়ই যাওয়া হয় রোদেলার তাই দেখেছে ,কিন্তু আজ আর সহ্য করতে পারলো না রোদেলা তৎক্ষনাৎ ছুঁটে চলে গেলো রুমে আর বেড়ুলোই না,সেই থেকে কান্না করছে,নিচে যে এতো কিছু ঘটে গেছে তার কোনো কিছুই ও জানে না।
উনি আমাকে নিয়ে এলেন উনার সেই ভুত বাংলায়,তারপর টানতে টানতে নিজের রুমের দিকে নিয়ে যেতে শুরু করলেন ,আমি যেনো আন্দাজ করতে পারছি কি হতে চলেছে আমার সাথে,এমনটা যে এর আগেও আমার সাথে হয়েছিলো কিন্তু আজ এর থেকেও বেশি কিছু হবে হয়তো সেটা বুঝতে পারছি আমি,বার বার বলছি আমায় ক্ষমা করে দিন আমি আর কখনো এমনটা করবো না ছেড়ে দিন আমায়,কিন্তু কে শুনে কার কথা উনি আমায় টেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলেদিলেন রুমে আমি ফ্লোরে গিয়ে আঁচড়ে পড়লাম,তারপর উনি উত্তপ্ত কন্ঠে গর্জে বললেন।
অনেক সাহস বেড়েছে না তোর,আমায় ছেঁড়ে চলে যেতে নিয়েছিলি,একা থাকতে চাস তুই,আমার থেকে দূরে থাকতে চাস,তবে তাই হবে আজ,আজকে তোর এমন হাল করবো যে তুই চিৎকার করে করে আমায় ডাকবি,আমার কাছে আসার চেষ্টা করবি কিন্তু আমায় পাশে পাবি না,আমি দিবো না তোর কোনো ডাকে সাড়া,কথাটা বলে উনি দরজা বাহির থেকে বন্ধ করে দিলেন,আমি বুঝতে পারছি না উনি এবার কি করতে যাচ্ছেন,তৎক্ষনাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলো,আমি চিৎকার করে উঠলাম,সারাঘরে খিটখিটে অন্ধকার, সারাটা রুম লক করা,তার উপর অন্ধকার, বন্ধ রুমে আমার শ্বাস আটকে যায়,আর অন্ধকারে আমি অনেক ভয় পাই,তাই চিৎকার করছি,বার বার দরজায় বাড়ি দিচ্ছি আর বলছি মি.খান আমার ভয় করছে আমার পাশে আসুন,আমায় বাঁচান,আমি মরে যাবো এখানে,আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে,আমার ভয় করছে প্লিজ আপনি আমার পাশে আসুন,আমায় বাঁচান,মি.খান,মি.খান,প্লিজ।
এদিকে শিশির দরজার ঠিক অপরপাশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে,শিশির নিজে গিয়ে ঘরের সকল বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিলো তখন তারপর এসে এখানে বসে পড়লো,ও ভালো করেই জানে নুরের বন্ধ রুমে দম বন্ধ হয়ে আসে তাছাড়াও অন্ধকার অনেক ভয় পায় নুর,নুরের পিছন এক্সট্রা লোক লাগিয়ে রেখেছে শিশির তাছাড়া বাড়ির চারিদিকেই সিসিটিভির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছিলো অনেক আগেই শুধু নুরের সেইফটির জন্য তাই নুরের খোঁজ বার করা ওর জন্য বড় কিছু ছিলো না,নুর এদিকে জোড়ে জোড়ে চিৎকার করছে, নুরের প্রতিটা চিৎকার ওর কানে আসছে যা ওর মনকে করে দিচ্ছে ক্ষতবিক্ষত, চোখের জল বেয়ে নিচে গড়াচ্ছে,পাথরের ন্যায় বসে আসে সেখানে,আজ যে ওর কহিনুর ওকে সত্যিই পাশে ডাকছে তবে সে যবে না,সাড়া দিবে না সে ডাকে আপাতত ,এটাই যে নুরের সাজা,কিন্তু উক্ত সাজা যে নুরের থেকে বেশি বেদনা ওকেই দিচ্ছে,সহ্য করতে পারছে না ও আর।
নুর চিৎকার করতে করতে একসময় অচেতন হয়ে লুটে পড়লো ফ্লোরে।
পিটপিট করে চোখ খুললাম,চোখ খুলেই আশেপাশে যথেষ্ট আলোর দ্বিধার করতে পারলাম,মনে থাকা ভয়ের রেশটা কাটলো অনেক,দেয়ালে থাকা ঘড়ির উপর চোখ পড়লো দেখলাম রাত ৩ টা বাজে,পাশে দেখলাম একটা স্যালাইন ঝুলছে খালি করা,আমার হাতের ঠিক পাশেই,আমার হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম হয়তো ওটা এতোসময় আমাকেই দেওয়া হয়েছে,পাশেই সোফাতে দুজন ডাক্তার বসে বসে ঘুমুচ্ছে,এদিকে আমার অন্য হাতে অনুভব করলাম কিছু একটা দিয়ে আটকানো,তাকাতেই দেখলাম একটা হাতকড়া লাগালো যার অন্য প্রান্ত ব্যাঙটার হাতে লাগানো,হয়তো আমি পালিয়ে যাবো বলে তা করেছে,ব্যাঙটা আমাকে কোলে নিয়ে বেডে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে আর আমি ওর কোলে শুয়ে আছি,এই লোকটা আমার সাথে যা করেছে সে হিসেবে এই মুহুর্তে ওকে আমার ঘৃণা করার কথা কিন্তু এর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কোনো ঘৃণাই কাজ করলো না আমার মনে,আমি উঠে বসলাম ঠিকঠাক হয়ে,বড় ইচ্ছে করলো উনার খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলানোর, আর আমি তাই করলাম,আজ আর উনাকে থাপ্পড় মারার ইচ্ছা জাগলো না মনে, সত্যিই কেনো যেনো ভদ্রতার সহিত উনার গালে হাত বুলালাম,তখনি উনি ঘুমের ঘরেই বলে উঠলেন।
কহিনুর,কহিনুর,আমায় ছেঁড়ে যেও না কহিনুর, কহিনুর,কহিনুর। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি কহিনুর।
লোকটা ঘুমের ঘরেও আমারই নাম নিচ্ছে,এমনটা কি আদোও হতে পারে,ঘুমের মধ্যেও লোক অন্যকে নিয়ে ভাবতে পারে যেখানে তখন নিজের ভাবনার উপর মানুষের কোনো কন্ট্রোলই থাকে না,এই লোকটা যে ঘুমের ঘরেও আমার ভাবনাই ভাবছে,তবে কি যে জিনিসটাকে আমি শুধু জেদ,টাকার পাওয়ার,হিংস্রতাই মনে করছিলাম ওটা কি সত্যিই ভালোবাসা?ভালোবাসা কি এরকমও হয়?
এদিকে মাহেরার ফোনে একটা ফোন আসলো,ফোনটা হাসিমুখে রিসিভ করলেও ফোনের ওপাশের কথা শুনে খনিকে মুখটা মলিন হয়ে গেলো ওর,চোখে মুখে ফুঁটে উঠলো রাগের ছাঁপ,ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিলো ফ্লোরে,আর খনিক চিৎকার করে বললো।
আমার প্লেন এরকম বেস্তে যেতে পারে না,না না না।ছাড়বে না তোকে নুর,ছাড়বোনা,আজ বেঁচে গেলি তো কি হয়েছে,তোকে আমি ঠিকই সড়িয়ে দিবো,শিশির শুধুই আমার,আর ওকে আমার কাছ থেকে কেউ কেড়ে নিতে পারবে না,কেউ না।
আসলে নুর যখন বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছিলো তখন ওকে আর কেউ না দেখলেও মাহেরা ঠিকই দেখেছিলো আর তারপর ওর পিছন তৎক্ষনাৎ নিজের পাওয়ার বসে কিছু গুন্ডা লাগিয়ে দিয়েছিলো ওকে মেরে ফেলার জন্য।
চলবে…..
#শিশিরের কহিনুর
#লেখিকাঃআরোহী নুর
#পর্বঃ১২
আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলাম আমি,কালরাতে উনার চেহারার দিকে তাকাতে তাকাতে কখন ঘুমিয়েছিলাম জানি না,এখন দেখি আশেপাশে কেউ নেই,না ওই ডাক্তারেরা,না উনি না ওই ঝুলন্ত স্যালাইনটা,এমনকি হাতের হাতকড়াটাও নেই,তবে আমি কি রাতে স্বপ্ন দেখছিলাম।পরক্ষণেই নিজের ভাবনাকে গুলি মেরে চলে গেলাম ওয়াসরুমে,ফ্রেস হয়ে দরজা খুলে নিচের দিকে যেতে শুরু করলাম,কিন্তু পুরো বাড়িটায় অন্ধকার ছাড়া আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না,অনেক ভয় হচ্ছে আমার তাই উনাকে ডাকছি, আমারও কি অভ্যাস হয়ে গেছে এখন ভয় পেলেই আগে উনার নামটাই মুখে আসে, কেনো যে এমন করি একমাত্র আল্লাহই জানেন,সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামছি আর উনাকে ডাকছি হঠাৎ পুরো ঘরের লাইট যেনো একসাথেই জ্বলে উঠলো,সামনে দৃষ্টি পরতেই আমার চোখ আটকে গেলো,চোখ দিয়ে অজরো জল পড়া শুরু হলো,কিন্তু এই জল যে কষ্টে এলো না, এটা যে সুখের জল,কারন সামনেই আমার পরিবার আমার সব আত্নীয় স্বজন দাঁড়িয়ে আছে,সবাই আমাকে উদ্দেশ্য করে হেপি বার্থডে বলে চিৎকার করে উঠলো,আজ আমার জন্মদিন আমার মনেই ছিলো না,প্রতি বছর এই দিনটার জন্য কতো অপেক্ষা করে থাকি কিন্তু এ বছর মনেই ছিলো না,আজকে আমার ২১ তম জন্মদিন,সবাই আমাকে টেনে নিলো নিজেদের মাঝে আর কতো আনন্দ করা শুরু করলো,ব্যাঙটার পুরো বাড়ি আমার আত্নীয় স্বজন ভরে আছে,নিজের জন্মদিন প্রতিবছর পালন করলেও ঘরোয়াভাবে ছোট করে করেছি কিন্তু এরকম এতো বড়সড় করে করার কথা কখনো ভাবি নি,বাড়িটা অনেক সুন্দর করে সাজানো,সারা বাড়িতে আমার পছন্দের ফুল লাগানো,আমার পছন্দ মতো ডেকোরেশন করা,সব কিছুই আমার মন মতোই করা হয়েছে,আমার ঠিক সামনের দেয়ালের দিকে বেলুন দিয়ে অনেক বড় করে লেখা হেপি বার্থডে কহিনুর,ওগুলোতে লাইট জ্বলছে বিভিন্ন রঙের যা আমার অনেক ভালো লাগছে,একটা টেবিলে হিয়া বড় একটা কেক রাখা,কেকটার উপরও সুন্দর করে লিখা হেপি বার্থডে মাই লাভ,আমি বুঝতে পারলাম এসব কিছুই ওই ব্যাঙটা করেছে,প্রথমে মারবে তারপর আদর দেখাবে,আমি একটা মুকমুড়ো দিয়ে সবার সাথে অনেক মজা করতে শুরু করলাম,এক সাইডে সবার থেকে খনিক দূর হয়ে দেয়ালে ঠাস দিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ব্যাঙটা,আমি ওকে দেখেও দেখতে চাইলাম না,সবার সাথে মজা করছি,হঠাৎ জেবিন আপি আমায় ডেকে নিলো কেক কাটার জন্য,সবাইকে পাশে রেখে কেক কাটলাম,সবাই হেপি বার্থডে বলে চিৎকার করে উঠলো,আমি কেকটা কেটে প্রথম বাইট মাকে খাওয়াবো তখনি জেবিন আপি আমার হাত ধরে নিলো,আমি ওর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকালে ও বললো।
এটাতে সবার প্রথম অধিকার যার আছে তাকে খাওয়া,তোর স্বামীকে।
উনাকে কেনো খাওয়াবো?আর উনি কখন থেকে আমার স্বামী হয়ে উঠলেন হুহ।
তুই মানিস আর না মানিস,ও তোর স্বামী, জানিস ও তোকে কতো ভালোবাসে, তোর জন্মদিনে তোকে স্যারপ্রাইজ দিবে বলে আমাদের সবাইকে লোক পাঠিয়ে নিজেদের বাড়ি থেকে আনতে লোক পাঠিয়েছে, আমাদের ওই লোকগুলোর সাথে আসার জন্য আগে থেকেই বলে দিয়েছিলো, যে তোর জন্মদিনে আমাদের সবাইকে এনে না কি তোকে সারপ্রাইজ দিবে,সে অনুযায়ী কাল রাত বারোটার আগেই আমরা এখানে পৌঁছে যাই,কাল রাত বারোটাতে সবাই তোকে স্যারপ্রাইজ দিবো এটাই প্লেন ছিলো,এসব কিছুই সব এসআরকে করিয়েছে সব তোর জন্য,ওর লোকেরা আমাদের সসম্মানে নিয়ে আসে এখানে কালকে,কিন্তু আমরা যখন আসলাম তখন এসে দেখলাম তুই বেডে অজ্ঞান অবস্থায় পরে আসিস, দুজন ডাক্তার তোর চেক আপ করছে,তখন দেখতে পাই এসআরকে তোকে কোলে নিয়ে বসে আছে,পাগলের মতো কান্না করছে তোকে বুকে জড়িয়ে, ডাক্তারগুলোকে শাসাচ্ছে যাতে ঝটফট তোকে ভালো করে,ওদের মেরেছিলোও হয়তো,ওদের দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো,তখন ওকে যে কেউ দেখলে বলতো হয়তো পাগল,আমারও তখন ওকে পাগল মনে হয়েছিলো, ও যে সত্যিই পাগল,আর শুধুই তোর ভালোবাসার পাগল আরু,তোর সবকিছুতেই প্রথম অধিকার ওর আরু,তাই এ ফাস্ট বাইটটাও ওরই প্রাপ্য।
কথাটা শুনে আমি একপলক মায়ের দিকে তাকালে মাও মাথা নেড়ে হ্যাঁ বোধক সম্মতি দিলেন,আমি উনার দিকে তাকালাম উনি অসহায় ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে,উনার দৃষ্টিতে আমি তখন একটু লোভ আন্দাজ করতে পারলাম,আর তা যে শুধু আমার একটু ভালোবাসা পাওয়ার লোভ,আমার মনটা কেনো তখন একটু মোচড় দিয়ে উঠলো কে জানে,এগিয়ে গেলাম উনার পানে আর হাত বাড়ালাম উনার দিয়ে,উনি অবাক দৃষ্টিতে আমার পানে তাকালেন,আমি উনাকে ইশারা করলাম আমার হাত ধরার জন্য,ঠোঁটের কোনে একটু হাসি ঝুলিয়ে, উনি হাত ধরলেন আর আমি উনাকে আমার সাথে করে নিয়ে এলাম কেকের সামনে,তারপর ফাস্ট বাইটটা নিয়ে উনার মুখের সামনে ধরলাম,উনার চোখের কোনে আবারও সেই একফালি জল অনুভব করলাম আমি,আমার এই ছোট সহানুভূতিও উনার জন্য অনেক তা আন্দাজ করতে পারলাম আমি,উনি আলতো করে কেকের এক কোন মুখে ছুঁয়ালেন,তারপর আর ওখানে দাঁড়ালেন না,তড়িঘড়ি করে বাইরের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন,আমি বুঝতে পারলাম না উনার এমন করার মানে আর বুঝতেও চাইলাম না,সবার সাথে মেতে উঠলাম খুশিতে ঝুমঝুম করে।
শিশির বাইরে গিয়ে বাগানের দিকে চলে গেলো,সেখানের দোলনাতে বসে আকাশের পানে তাকিয়ে বলতে লাগলো।
আমি জানি খোদা তুমি ঠিকই আমার কহিনুরের মনে আমার জন্য জায়গা করে দিবে,আজ আমার কহিনুর আমাকে হাসিমুখে নিজের কাছে ডাকলো,কেকের ফাস্ট বাইটটা আমায় দিলো এর মানে তো এটাই না ও আমাকে একটু হলেও ভালোবাসে,এটাই না খোদা,আপনি আমার কহিনুরের মনে আমার জন্য জায়গা করে দিয়েছেন,তাই না,আমি জানি খোদা, আপনি ওকে ঠিকই আমার করে দিবেন,শুধুই আমার।
কথাগুলো শিশির আকাশের দিকে তাকিয়ে পাগলের মতো বলছে,চোখ বেয়ে পড়ছে অজস্র জল।
সারাদিন অনেক মজা করলাম আমি,সারাদিন উনি একবারও সামনে আসেন নি,আমিও উনার খোঁজ করি নি একদম,সন্ধ্যায় সব চলে যেতে নিলেন,উনার অনেক লোক মানে বডিগার্ড এসেছে আমার আত্মীয় স্বজনের নিজেদের বাড়িতে পৌঁছে দিতে,সবাই চলে যাচ্ছে আসতে আসতে,চলে যাবার আগে আমার সিলেটি মা সিলেটি ভাষায়ই আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে গেলেন,বিয়েটা যেভাবেই হোক হয়ে গেছে আমি যেনো সংসারটা এবার ভালোভাবেই করি,আমি যেমন কখনোই উনার কথা শুনি নি আজও শুনলাম না,এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে দিলাম,আমি আর ওই কুনোব্যাঙটার সাথে সংসার করবো অসম্ভব, হুহ।
________________
রোদেলা এক কাপ কফি নিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে আকাশের দিকে তাকিয়ে।
এটা কি?ভ্রুযোগল কুচকে বললো আকাশ।
কফি বানিয়েছি ভাইয়া তোমার জন্য,খেয়ে দেখো কেমন হয়েছে?
হা হা হা হা,তুই আর কফি,আল্লাহ আমি এ দিনও দেখবো কখনো ভাবি নি,হা হা হা।
এমন করো না ভাইয়া আমার খারাপ লাগছে,আমি তো এতোও অকর্মা না যে তোমার জন্য এক কাপ কফিও করতে পারবো না।
তোর কফি ভালো হবে না আমি জানি।
খেয়ে দেখো না ভাইয়া।
দেখ কাজ আছে যা এখান থেকে।
প্লিজ ভাইয়া খাও না।
ওফ অসহ্য, ওকে ফাইন দে।
কথাটা বলে আকাশ কফিটা নিয়ে এক চুমুক দিয়েই থুথু করে ফেলে দিলো।
এসব কি কফি বানিয়েছিস,একদম বাজে,ছি এসব মানুষ খায়,তোর মতো অকর্মা শুধু সাজুগুজু আর ফাজলামো ভালো করে করতে পারে এসব না,বলদ কোথাকার,আমার মুখের টেষ্টটাই নষ্ট করে দিলো,যা সর আমার সামনে থেকে।
কথাটা বলে আকাশ ওকে সাইড করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো,রোদেলা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ওর যাওয়ার পানে,ওর কফিটা এতোও খারাপ হয় নি যতোটা রিয়েক্ট আকাশ করেছে,কিন্তু সেদিন যখন রিয়া বাড়িতে এসেছিলো তখন রিয়া আকাশের জন্য কফি বানিয়েছিলো,সামনে রোদেলা থাকায় ওকেও এক কাপ দিয়েছিলো,কফিটাতে এক চুমুক দিয়ে অপর চুমুক দেওয়ার কোনো সামর্থ্য হয় নি রোদেলার,কিন্তু আকাশ সেই বিস্বাদ কফি খেয়েও কি তারিফ করেছিলো রিয়ার,তবে রোদেলার সাথেই কেনো এমন করে,মন রাখার জন্য অনততো একটু তারিফ তো করতেও পারতো।
___________
আমি গাড়িতে বসে আছি,উনিও পাশে,আমরা বাড়িতে যাচ্ছি মানে খান ম্যানশনে,ট্রাফিক জ্যাম লেগে আছে,আমরা জ্যাম ছাড়ার অপেক্ষায় আছি,উনি বরাবরই আমার দিকে তাকাচ্ছেন আমি উনার দিকে তাকাচ্ছি না,মুখ একসাইড করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছি,হঠাৎ দেখলাম একটা বাচ্চা কান্না করছে,আমি কিছু বলবো বা করবো এর আগেই উনি নেমে গেলেন গাড়ি থেকে,ছেলেটির বয়স প্রায় ৮ বছর হবে,প্যান্ট শার্ট ছিঁড়া,হয়তো টুকাই একটা ছেলে,উনাকে নামতে দেখে আমিও গাড়ি থেকে নামলাম,উনি গিয়েই ছেলেটির সামনে বসলেন হাঁটু গেঁড়ে ,ছেলেটি মা মা বলে কাঁদছে,উনি ওর গালে হাত রেখে মধুর আর নরম কন্ঠে ওকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে,ছেলেটি বললো ও ওর মাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না,ও আর ওর মা নাকি একসাথে ফুল বিক্রি করতে এসেছিলো এখন ও ওর মাকে খুঁজে পাচ্ছে না,কথাটা শুনার পর উনি ছেলেটির চোখের জল মুছে দিলেন আর কপালে একটি চুমু একে বললেন।
আমি তোমার মাকে এনে দিবো,তুমি একদম কাঁদবে না কেমন।
কথাটা বলে উনি উনার বডিগার্ডদের ডাকলেন যারা গাড়ি নিয়ে আমাদের গাড়ির পিছনেই ছিলো,উনি ওদের কাছে বাচ্চাটিকে দিলেন আর বললেন ইমিডিয়েটলি ওর মাকে খুঁজে দিতে,আর ওর আর ওর মায়ের থাকা খাওয়ার একটা ভালো ব্যবস্থা করে দিতে,ওরা মাথা নাড়িয়ে ছেলেটিকে নিয়ে গেলো,উনিও উঠে এসে আমাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসিয়ে নিজেও বসলেন অপর পাশে,কিছুক্ষণে ট্রাফিক ছাড়লো আর উনিও ড্রাইবিং করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লেন,উনি আর এখন বার বার তাকাচ্ছেন না আমার দিকে কিন্তু আমি এখন একনজরে তাকিয়ে আছি উনার দিকে,মানুষটাকে যতোটা হিংস্র ভেবেছিলাম হয়তো ততোটাও নয়,এই হিংস্র রুপটার আড়ালে যে একটা সুন্দর মনুষ্যত্বও লুকিয়ে আছে, যা হয়তো পৃথিবীর অনেক কঠিনত্বের নিচে চাপা পড়ে গেছে,আর মানুষটা চেয়েও তা সামনে নিয়ে আসতে পারছে না,আজ কেনো যেনো হঠাৎ ইচ্ছে হলো এই মানুষটাকে একটু অনুভব করতে,ইচ্ছে হলো উনার বিষয়ে অনেক কিছু জানতে,কিন্তু আমার কেনো এমন অনুভুতি হচ্ছে,যাকে আমি সহ্যই করতে পারি না তাকে কেনো আমি বুঝার চেষ্টা করছি,কেনো?আমি উনার প্রতি আবার দূর্বল হয়ে পড়ছি না তো,আরে না না এ হতে পারে না আমি উনাকে ভালোবাসি না আর কখনোই বাসবো না,কোনোদিন না।
_____________
রাতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিলাম তখনি উনি আমার পিছনে এসে আমার গলায় একটা পেন্ডেন্ট পড়িয়ে দিলেন,পেন্ডেন্ট টা হয়তো ডায়মন্ডের, অনেক সুন্দর পেন্ডেন্ট,যাতে স্পষ্ট ইংরেজি শব্দে লিখা শিশির।উনি ওটা আমার গলায় পড়াতে পড়াতে বললেন।
এটা কখনো খুলবে না বলে দিলাম,এটা তোমাকে বার বার মনে করিয়ে দিবে তুমি শুধুই আমার,কহিনুর শুধুই শিশিরের, কথাটা আয়নার দিকে তাকিয়ে আমাকে দেখতে দেখতে উনি বললেন,তারপর আমার ঘাড়ের চুলগুলো একসাইড করে আমার ঘাড়ের একসাথে জটলা পেকে থাকা নেশাময়ী দুটি তিলে গভীর চুমু খেলেন আমি শিহরিত হয়ে চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম,এক হাতে খামছে ধরলাম হাতের পাশে থাকা নিজের গায়ের কাপড়,এবার উনি আমার কানের লতিতে আলতো চুমু খেয়ে বলে উঠেন।
লজ্জা পেলে যে তোমায় আরও মায়াবী লাগে মায়াবতী,তখন যে এ বুকে তীর চলে,ইচ্ছে করে তোমার সব লজ্জা ভেঙে দিই,করে নেই তোমাকে নিজের।
কথাটা শুনে আমার তখন লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে মন চাইলো,আমি উনাকে আলতো ধাক্কা দিয়ে নিজে থেকে ছাড়িয়ে বেডে গিয়ে একসাইড হয়ে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম মুখ ঢেকে,যেনো উনি আমার লজ্জাময় মুখটা আর দেখতে না পারেন আর এসব উদ্ভট চিন্তাও উনার মাথায় না আসে।
চলবে………